alt

উপ-সম্পাদকীয়

কলকাতায় হিজাব বিতর্ক

গৌতম রায়

: শনিবার, ১৫ জুন ২০২৪

ভারতের অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচন শেষ হয়েছে। ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। একক গরিষ্ঠতা নিয়ে দশ বছর পর আর তৃতীয়বারের জন্য বিজেপি সরকার গঠন করতে পারেনি। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদি শপথ নিয়েছেন।

পশ্চিমবঙ্গে ৪২টি আসন তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপি ভাগাভাগি করে নিয়েছে। মাত্র একটি আসন জাতীয় কংগ্রেস পেয়েছে। বাম-কংগ্রেস জোট ঘিরে বহু আশা সাধারণ মানুষের মধ্যে তৈরি হলেও দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, বামপন্থিরা শেষপর্যন্ত একটি আসনও পায়নি। শুধু পায়নিই নয় মাত্র, একটি আসন, যেখানে তাদের দলের রাজ্য সম্পাদক মোহাম্মদ সেলিম প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন, সেখানেই তারা একমাত্র দ্বিতীয় স্থান অধিকার করতে পেরেছেন। বাকি যে কটি কেন্দ্রে তারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন, সবকটাতেই তাদের স্থান হয়েছে তৃতীয়তে।

২০১৯ সালের তুলনায় বিজেপির আসন সংখ্যা অনেক কমে গেছে। তৃণমূলের আসন সংখ্যা বেড়েছে। অনেকের কাছেই এই বিষয়টি স্বস্তিদায়ক ঠেকেছে। কারণ তারা মনে করেছেন, ভোট রাজনীতির নিরিখে হলেও এ রাজ্যে বিজেপির আসন সংখ্যা কমাটা একটা পশ্চিমবঙ্গের মানুষদের পক্ষে ইতিবাচক দিক। কিন্তু মজার কথা হলো, ভোট পর্ব শেষ হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই কলকাতার একটা আইন কলেজের এক অধ্যাপিকা, যিনি ধর্মপরিচয়ে মুসলমান, তিনি হিজাব পরিহিত অবস্থায় কলেজে যাওয়ার কারণে, কলেজ কর্তৃপক্ষ, তাকে ধর্মীয় পোশাকে কলেজে আসতে নিষেধ করেন। কিছু যুক্তি-তর্কের অবতারণা সংশ্লিষ্ট অধ্যাপিকা কলেজ কর্তৃপক্ষকে দেওয়া সত্ত্বেও তারা সেই যুক্তিগুলো মানেন না। ফলে সংশ্লিষ্ট অধ্যাপিকা তার কর্মক্ষেত্র থেকে ইস্তফা দিতে বাধ্য হন।

সেই অধ্যাপিকা অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় বলেছেনÑ কর্তৃপক্ষের হিজাব বিরোধী নীতির জন্যই আমি পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছি। কারণ হিজাব খুলতে বলা হলে, তা আমার ধর্মীয় বিশ্বাস এবং মূল্যবোধের সঙ্গে সংঘাত সৃষ্টি করছে।

রামপুরহাটের ভূমিকন্যা সংশ্লিষ্ট অধ্যাপিকা কিন্তু অত্যন্ত প্রগতিশীল ভাবধারার একজন মানুষ। কোনো অবস্থাতেই ধর্মীয় মৌলবাদের দ্বারা তিনি প্রভাবিত নন। কিন্তু ধর্ম পালনে তিনি নীতিনিষ্ঠ। তাই গত রমজান মাস থেকে তিনি হিজাব পড়তে শুরু করেছিলেন। তিনি যে কলেজে অধ্যাপনা করতেন, সেই কলেজে কোনো পোশাক বিধি কিন্তু আগে ছিল না। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত ওই কলেজটিতে হঠাৎই গত মে মাসে পোশাক বিধি লাগু করা হয়।

কলেজ কর্তৃপক্ষ প্রকাশ্যেই বলেছেন, আমাদের ড্রেস কোডে ধর্মীয় কিছু করা যাবে না। অথচ একজন শিখ ধর্মাবলম্বী পাগডড় যে তাদের ধর্মীয় পোশাকেরই একটি অঙ্গ, সেই জায়গাটিকে ঘিরে কলেজ কর্তৃপক্ষের বক্তব্য- পাগড়িতে সমস্যা নেই।

প্রশ্ন হলোÑ একজন শিখ ধর্মাবলম্বী মানুষের পাগড়িতে যদি সমস্যা না থাকে, তাহলে কেন একজন মুসলমান ধর্মাবলম্বী মানুষের হিজাব ঘিরে আপত্তি? ভারতের মতো ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে পোশাক ঘিরে কোনো সংবিধান নির্দেশিত বিধি-বিধান নেই। ভারতের প্রত্যেকটি নাগরিক কে, তার নিজের নিজের ধর্ম পালনের অধিকার ভারতের সংবিধান দিয়েছে। অথচ খোদ কলকাতা মহানগরীর একটি কলেজ, ফতোয়া জারি করে নিজেদের ড্রেস কোড চালু করেছেন। দেখা যাচ্ছেÑ এই ড্রেসকোডের ফলে শিখ ধর্মাবলম্বী মানুষদের ধর্মীয় বিশ্বাস আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছে না। আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছে কেবলমাত্র মুসলমানদের ধর্মীয় বিশ্বাসটিই।

তাহলে একথা খুব স্পষ্টভাবেই বলতে পারা যায় যে, ভারতের বিভিন্ন অংশে, যেখানে যেখানে বিজেপি রাজনৈতিক ক্ষমতার দিক থেকে বলিয়ান, সরকার পরিচালনা করছে সেই সব অংশে যেভাবে কেবলমাত্র মুসলমান সমাজকে আক্রমণ করবার লক্ষেই নানা ধরনের পোশাক বিধি, ধর্মীয় আচার-আচরণ জনিত বিধি তৈরি করা হচ্ছে, কলকাতা মহানগরীর ওই কলেজটিতেও সেই ধারাটিকে বজায় রেখেই কেবলমাত্র আক্রমণের লক্ষ্যস্থল হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে মুসলমান সম্প্রদায়কে।

সংশ্লিষ্ট অধ্যাপিকা রাজ্যের সংখ্যালঘু কমিশনের দ্বারস্থ হন সংখ্যালঘু কমিশন অত্যন্ত সহৃদয় তার সঙ্গে বিষয়টি দেখেছেন এবং রাজ্যের একজন প্রাক্তন মন্ত্রী বর্তমানে শাসক দলের বিধায়ক অবসরপ্রাপ্ত আইপিএস অফিসার হুমায়ুন কবির অধ্যাপিকাকে নিয়ে কলেজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দেখা করেন। কলেজ কর্তৃপক্ষ কিছুটা নরম মনোভাব দেখালেও তারা তাদের ড্রেসকোডে মহিলাদের মাথায় স্কার্ট পড়ে আসা যাবে এই কথাটি লিখতে রাজি হয়েছেন কিন্তু কোন অবস্থাতেই তারা হিজাব শব্দটি লিখতে রাজি নন।

আসলে গোটা ভারতে গত দশ বছরে বিজেপির একক গরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার পরিচালনার ফলে যে ধরনের সামাজিক পরিবেশ দেশজুড়ে আরএসএস তৈরি করেছে, কলকাতায় এই হিজাব বিতর্ক কিন্তু তারই একটি অংশ। উত্তর ভারতে যেখানে গ্রীষ্মকালে গরম অত্যন্ত বেশি, সেখানে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে মেয়েরা গরমের হাত থেকে একটু স্বস্তি পাওয়ার জন্য নানা ধরনের কাপড় দিয়ে মাথা আবৃত করেন।

মুসলমান মেয়েরা তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী হিজাব পড়েন; কিন্তু মজার কথা হলো, হিজাব শব্দটিকেই এখন একটি প্রায় নিষিদ্ধ শব্দ হিসেবে দেগে দিতে চেষ্টা করছে হিন্দুত্ববাদী শক্তি। পোশাকের মধ্য দিয়ে যে সাম্প্রদায়িক মানসিকতা উসকে দিয়ে, সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা মেরুকরণ তৈরি করে দেওয়Ñ এটা হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তির দীর্ঘদিনের একটা রাজনৈতিক কৌশল। এই কৌশল কে কাজে লাগিয়ে সদ্য সমাপ্ত লোকসভা নির্বাচনে খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, নিজেদের ঘরে ভোটের ফসল তুলতে চেষ্টা করেছেন।

‘বাবু যতো বলে, পারিষদ গণ বলে তার শতগুণ’। খোদ বিজেপির অন্যতম শীর্ষ নেতা তথা দেশের প্রধানমন্ত্রী যখন এইভাবে প্রকাশ্যে মেরুকরণের রাস্তায় হাঁটেন, তখন তো একটি কলেজের অধ্যক্ষ, মহাপুরুষ যে পথে হাঁটবেন, সেই পথে হাঁটবারই চেষ্টা করবেন!

সেভাবেই ভারতজুড়ে এই প্রবণতা চলেছে কিন্তু যখন এটা আমরা পশ্চিমবঙ্গের বুকে দেখতে পাচ্ছি, তখন কিন্তু আমাদের শিউরে উঠতে হচ্ছে। খোদ কলকাতা শহরে একটি নামকরা বেসরকারি কলেজে যখন এ অবস্থা, তখন না জানি গ্রামবাংলায়, খাদ্য-পোশাক, আচার-আচরণÑ এই সমস্ত জিনিসগুলিকে তালগোল পাকিয়ে, সাম্প্রদায়িক শক্তি কিভাবে মানুষে -মানুষে বিভাজনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

স্বস্তির বিষয়, কলকাতায়, রাজ্যের শাসক দল ওই বেসরকারি কলেজটির কে ঘিরে সাম্প্রদায়িক আগ্রাসন বিষয়ে একটা ইতিবাচক অবস্থান নিয়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলোÑ কেন খোদ কলকাতা শহরের মধ্যে এমন ঘটনা ঘটবে? এমন ঘটনা ঘটছে, সে সম্পর্কে কেন রাজ্যে প্রশাসনের কাছে কোনো খবর থাকবে না? একটি কলেজের অধ্যক্ষ কেবলমাত্র মুসলমান সমাজকে আক্রমণ করবার লক্ষ্যেই যে পোশাক বিধি চালু করতে সচেষ্ট হয়েছেন, কেন সেই কলেজের একজন অধ্যাপিকা, যিনি ধর্ম পরিচয়ে মুসলমান, তাকেই একমাত্র এই প্রতিবাদ করতে হবে? সেই কলেজে তো বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী শিক্ষক আছেন। ছাত্র আছেন। কেন তাদের মধ্যে থেকে প্রতিবাদটা হবে না? কেবল একজন শিক্ষিকায় যে হিজাব বিতর্কের প্রকোপে পড়েছেন, তা নয়। ওই কলেজের একজন ছাত্রীর প্রতিও এই ধরনের অমানবিক আচরণ কলেজ কর্তৃপক্ষ করেছেন। প্রশ্নটা এখানেই যে, কেন সেই ছাত্রীদের অন্য সহপাঠীরা প্রতিবাদী মুখর হননি?

যখন একজন শিখ ধর্মাবলম্বীর পাগড়ি ঘিরে কোনো সমস্যা না থাকবার কথা কলেজ কর্তৃপক্ষ বলছেন, তখন এটা খুব স্পষ্টভাবেই বুঝতে পারা যায় যে, কেবলমাত্র মুসলমান সমাজকে আক্রমণ করবার লক্ষ্যেই এই হিজাব বিতর্ক তোলা হয়েছে। ধর্মীয় পোশাক যদি সত্যিই ওই কলেজে নিষিদ্ধ হতো, তাহলে শিখ সম্প্রদায়ের ছাত্র শিক্ষকদের ঘিরে একই প্রশ্ন কিন্তু এই কলেজ কর্তৃপক্ষ করেনি। করেনি এই কারণেই যে, তারা খুব ভালোভাবে জানে, মুসলমানদের উদ্দেশ্যে যে কাজটি তারা করতে চলেছে, সেটি ঘোরতর বেআইনি, অসংবিধানিক, অমানবিক। বিগত লোকসভা নির্বাচনের সময়কালের যে মেরুকরণের প্রচেষ্টা ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক শক্তির এবং প্রতিযোগিতামূলক সম্প্রদায়িক শক্তি করেছে, সেখান থেকেই ওই কলেজ কর্তৃপক্ষ ভেবেছিলেন যে, লোকসভা নির্বাচনে আবার মোদির প্রচার অনুযায়ী বিজেপি যদি ৪০০ আসন পার করে, বিজেপি একক গরিষ্ঠতা নিয়ে কেন্দ্রে শাসন ক্ষমতায় আসবে। তারপর দেশে রাজনৈতিক হিন্দু রাষ্ট্র নিয়ে তান্ডব শুরু হবে। সেই তান্ডবের পটভূমিকা তৈরি করবার জন্যই কি এইভাবে হিজাব ঘিরে একটা বিতর্ক তৈরি করেছিল কলেজ কর্তৃপক্ষ? এই পোশাকজনিত নিষেধাজ্ঞা কেন সঙ্গে সঙ্গে রাজ্য সরকারের দৃষ্টিগোচর হলো নাÑ এ প্রশ্ন অবশ্যই তুলতে হয়।

পশ্চিমবঙ্গে ভোটর রাজনীতির নিরিখে যদি আমরা মনে করে থাকি যে, হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি বিজেপি এখানে কমজোরি হয়ে গেছে, তাহলে কিন্তু আমরা খুব ভুল করব। মুসলমান সমাজের একটা বঙ অংশ বিজেপির বিপদ সম্পর্কে অবহিত হয়েই ভোটটা কিন্তু বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে পশ্চিমবঙ্গের বুকে প্রমোট করবার জন্য যে শক্তি আত্মনিবেদিত, তাদেরই দিয়েছেন।

মুসলমান সমাজের এ কাজের কোনো সমালোচনা এখানে করা হচ্ছে না। একজন স্বাধীন দেশের নাগরিক, তিনি যাকে মনে করবেন, তাকে ভোট দেবেন; কিন্তু চিন্তার বিষয় হলো এই যে, দেশজুড়ে যে সাম্প্রদায়িকতার তান্ডব আরএসএস-বিজেপিসহ সমস্ত হিন্দু সম্প্রদায়িক শক্তি করে চলেছে, সে সম্পর্কে মুসলমান সমাজ যে সচেতনতা পশ্চিমবঙ্গে, বিজেপিকে ভোট না দিয়ে সেটা তারা খুব ভালোভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন, সেই সচেতনতাা কিন্তু মুসলমানদের করেছে বামপন্থিরা।

পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু সম্প্রদায়ের একটা বড় অংশ যে বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সঙ্গে সহমত নয়, সেটাও তারা বুঝিয়ে দিয়েছেনÑ এর পিছনেও রয়েছে বামেদেরই ভূমিকা; কিন্তু সাধারণ মানুষকে বুঝতে হবে যে, পশ্চিমবঙ্গে কিন্তু কখনো এই ধরনের পোশাক বিতর্ক আগে হয়নি। রাজ্যের শাসক দলের একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব সংশ্লিষ্ট কলেজে যাওয়ার পরও কলেজ কর্তৃপক্ষ এভাবে হিজাব শব্দটি না লেখবার সাহস আগে দেখায়নি।

শিখ সম্প্রদায়ের পাগড়ি ঘিরে আপত্তি না থাকা ওই কলেজ অধ্যক্ষ, একটা ধরি মাছ, না ছুঁই পানি গোছের অবস্থান নিয়ে, হিজাব কে চালাতে চাইছেন। এমন পরিস্থিতি কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে আগে কখনো হয়নি। পশ্চিমবঙ্গে যেভাবে ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক শক্তি, উত্তর ভারতের সংস্কৃতির সাম্প্রদায়িকতাকে দীর্ঘ অনুশীলনের মধ্যে দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের বুকে গেঁথে দিতে চাইছে তাকে প্রতিহত করবার কাজে, প্রতিযোগিতামূলক সম্প্রদায়িক শক্তি কোনো ভূমিকা পালন করবে নাÑ এটা নিশ্চিতভাবে বলতে পারা যায়।

কিন্তু এখানেই কূন্য পাওয়া বামপন্থীদের বিষয়টি উঠে আসছে। করোনা জনিত অতিমারি ঘিরে সমস্যা থেকে শুরু করে, চাকরি দুর্নীতি, বিভিন্ন ধরনের নিয়োগ দুর্নীতিসহ মানুষের রুটি-রুজির প্রশ্ন, বামপন্থীরা যেভাবে গত লোকসভা নির্বাচনের প্রচারকার্যে তুলে ধরলেন, তার ভেতর দিয়ে এটাই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, কেবলমাত্র ভোট রাজনীতিকে লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারিত করে বামপন্থিরা কখনো রাজনীতি করেন না।

ভোট রাজনীতির ক্ষেত্রে তাদের জায়গাটা যতই দুঃখজনক আমরা দেখি না কেন, সামাজিক কর্মসূচিতে তারা যেভাবে ভূমিকা পালন করে, সেই ভূমিকাই কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সাধারণ মানুষকে সাম্প্রদায়িকতার বিপদ সম্পর্কে অনেকখানি সচেতন করেছে। এই সচেতনতার জায়গাটি বামপন্থিরা নিজেদের ভোট বাক্সে রূপান্তরিত করতে পারেননি। না পারার অনেক কারণ আছে। প্রথম এবং প্রধান কারণ হলো; বিজেপি আর তৃণমূলের ইলেক্টোরাল বন্ডের টাকার গ্রোতের কাছে, একেবারে সাধারণ মানুষের দেওয়া আর্থিক সহযোগিতাÑ এই অসম লড়াই লড়ার মতো মানসিকতাই বামপন্থিদের ছিল না।

বামপন্থিরা চাইলে ইলেক্টোরাল বন্ডের টাকা নিয়ে গোটা নির্বাচনের ফল ঘুরিয়ে দিতে পারতেন; কিন্তু আদর্শগত কারণে অমন নৈতিক দুরবস্থার ফাঁদে তারা কখনো পা দেবেন না। বামপন্থিরা পারতেন ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার ঘটিয়ে, হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় হিন্দু সেজে, আর মুসলমান অধ্যুষিত এলাকায় মুসলমান সেজে, ধর্মীয় উত্তাপ তৈরি করে, সেই উত্তাপে রুটি সেঁকে, নিজেদের ভোট বাক্স বাড়াতে।

স্বাধীন ভারতে এই কাজ বামপন্থিরা একদিনের জন্য করেননি। আগামী বহুদিন যদি সংসদীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে বামপন্থিদের সেভাবে সাফল্য না আসে, তবুও তারা এভাবে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের পথে হাঁটবেন না। তাই ঐ আইন কলেজে যে ভয়াবহ ঘটনা আমরা দেখতে পেলাম, রাজনীতিতে যাদের অপ্রাসঙ্গিক বলে গদি মিডিয়া শীবাকীর্তন গাইছে, সেই ভয়াবহ ঘটনা সমাজের বুক থেকে অপসৃত করবার ক্ষেত্রে, বামপন্থিরাই একমাত্র যোগ্য। তারাই পারে সামাজিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে, ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক বিজেপির বিভাজনের অভিসন্ধি, আর সেই অভিসন্ধিকে ফলপ্রসূ করবার জন্য প্রতিযোগিতামূলক সম্প্রদায়িক শক্তি তৃণমূল কংগ্রেসের শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের ‘টগর গোষ্ঠমী’ চরিত্রের আচরণকে প্রতিহত করতে।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]

পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থকে কি জলাঞ্জলি দিয়েছে মোদি প্রশাসন

বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ : আইন কী বলে

হাজার টাকার বাগান খাইল পাঁচ সিকার ছাগলে

বাংলাদেশের উন্নতিতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর লজ্জা

মাদকমুক্ত দেশ গড়তে প্রয়োজন প্রতিরোধ কার্যক্রম

রম্যগদ্য : ‘ন্যায়-অন্যায় জানি নে, জানি নে...’

ছবি

কুরবানির ছাগল তাকে চিনতে পেরেছে

ছবি

সুইডিশ মিডসামার : এক আনন্দময় দিনের সূচনা

ছবি

আধুনিক রূপকথা এবং আমাদের রাজাদের গল্প

গাছে গাছে সবুজ হোক দেশ

কত বিষে আমাদের বসবাস

ছবি

তিস্তার দুই নয়নে দুই অশ্রুধারা

বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ান

আদিবাসীরা বৈষম্যের শিকার

ছবি

নারীর অগ্রযাত্রা

ছবি

সিলেট-সুনামগঞ্জের ‘জলাবদ্ধ বন্যার’ দায় কার?

ছবি

বুড়িতিস্তা রিজার্ভার খনন : কৃষক কি উপকৃত হবে?

সেন্টমার্টিন দ্বীপ নিয়ে কী হচ্ছে?

উচ্ছেদকৃত দলিতদের পুনর্বাসন করুন

রম্যগদ্য : অভিযোগ ‘অভিযোগ’ নয়

কেন হেরে গেলেন সেলিম

নীরবে-নিভৃতে কাজ করা এক কৃষিবিজ্ঞানীর কথা

অর্থনীতি কী অবস্থায় আছে?

কোরবানির চামড়ার হকদার

যোগাযোগ অধ্যয়ন কেন গুরুত্বপূর্ণ

এমপি আনারকে নিয়ে যত আইনি জটিলতা

অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও আইনের শাসন

দূর হোক মনের পশুত্ব

মনের পশুত্বের প্রতীকী ত্যাগের আরেক নাম কোরবানি

ঈদে সুস্থ খাদ্যাভ্যাস

এমআইটি : প্রযুক্তির সৃষ্টি রহস্যের খোঁজ

কবিগুরুর বাণী ‘প্রমাণিত মিথ্যা’

কিশোর গ্যাং কালচার বন্ধ হবে কিভাবে

কানিহাটি সিরিজ এবং পঞ্চব্রীহি নিয়ে আরও কিছু কথা

বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশ নিয়ে বিতর্ক

হাতের শক্তি ও মহিমা

tab

উপ-সম্পাদকীয়

কলকাতায় হিজাব বিতর্ক

গৌতম রায়

শনিবার, ১৫ জুন ২০২৪

ভারতের অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচন শেষ হয়েছে। ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। একক গরিষ্ঠতা নিয়ে দশ বছর পর আর তৃতীয়বারের জন্য বিজেপি সরকার গঠন করতে পারেনি। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদি শপথ নিয়েছেন।

পশ্চিমবঙ্গে ৪২টি আসন তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপি ভাগাভাগি করে নিয়েছে। মাত্র একটি আসন জাতীয় কংগ্রেস পেয়েছে। বাম-কংগ্রেস জোট ঘিরে বহু আশা সাধারণ মানুষের মধ্যে তৈরি হলেও দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, বামপন্থিরা শেষপর্যন্ত একটি আসনও পায়নি। শুধু পায়নিই নয় মাত্র, একটি আসন, যেখানে তাদের দলের রাজ্য সম্পাদক মোহাম্মদ সেলিম প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন, সেখানেই তারা একমাত্র দ্বিতীয় স্থান অধিকার করতে পেরেছেন। বাকি যে কটি কেন্দ্রে তারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন, সবকটাতেই তাদের স্থান হয়েছে তৃতীয়তে।

২০১৯ সালের তুলনায় বিজেপির আসন সংখ্যা অনেক কমে গেছে। তৃণমূলের আসন সংখ্যা বেড়েছে। অনেকের কাছেই এই বিষয়টি স্বস্তিদায়ক ঠেকেছে। কারণ তারা মনে করেছেন, ভোট রাজনীতির নিরিখে হলেও এ রাজ্যে বিজেপির আসন সংখ্যা কমাটা একটা পশ্চিমবঙ্গের মানুষদের পক্ষে ইতিবাচক দিক। কিন্তু মজার কথা হলো, ভোট পর্ব শেষ হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই কলকাতার একটা আইন কলেজের এক অধ্যাপিকা, যিনি ধর্মপরিচয়ে মুসলমান, তিনি হিজাব পরিহিত অবস্থায় কলেজে যাওয়ার কারণে, কলেজ কর্তৃপক্ষ, তাকে ধর্মীয় পোশাকে কলেজে আসতে নিষেধ করেন। কিছু যুক্তি-তর্কের অবতারণা সংশ্লিষ্ট অধ্যাপিকা কলেজ কর্তৃপক্ষকে দেওয়া সত্ত্বেও তারা সেই যুক্তিগুলো মানেন না। ফলে সংশ্লিষ্ট অধ্যাপিকা তার কর্মক্ষেত্র থেকে ইস্তফা দিতে বাধ্য হন।

সেই অধ্যাপিকা অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় বলেছেনÑ কর্তৃপক্ষের হিজাব বিরোধী নীতির জন্যই আমি পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছি। কারণ হিজাব খুলতে বলা হলে, তা আমার ধর্মীয় বিশ্বাস এবং মূল্যবোধের সঙ্গে সংঘাত সৃষ্টি করছে।

রামপুরহাটের ভূমিকন্যা সংশ্লিষ্ট অধ্যাপিকা কিন্তু অত্যন্ত প্রগতিশীল ভাবধারার একজন মানুষ। কোনো অবস্থাতেই ধর্মীয় মৌলবাদের দ্বারা তিনি প্রভাবিত নন। কিন্তু ধর্ম পালনে তিনি নীতিনিষ্ঠ। তাই গত রমজান মাস থেকে তিনি হিজাব পড়তে শুরু করেছিলেন। তিনি যে কলেজে অধ্যাপনা করতেন, সেই কলেজে কোনো পোশাক বিধি কিন্তু আগে ছিল না। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত ওই কলেজটিতে হঠাৎই গত মে মাসে পোশাক বিধি লাগু করা হয়।

কলেজ কর্তৃপক্ষ প্রকাশ্যেই বলেছেন, আমাদের ড্রেস কোডে ধর্মীয় কিছু করা যাবে না। অথচ একজন শিখ ধর্মাবলম্বী পাগডড় যে তাদের ধর্মীয় পোশাকেরই একটি অঙ্গ, সেই জায়গাটিকে ঘিরে কলেজ কর্তৃপক্ষের বক্তব্য- পাগড়িতে সমস্যা নেই।

প্রশ্ন হলোÑ একজন শিখ ধর্মাবলম্বী মানুষের পাগড়িতে যদি সমস্যা না থাকে, তাহলে কেন একজন মুসলমান ধর্মাবলম্বী মানুষের হিজাব ঘিরে আপত্তি? ভারতের মতো ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে পোশাক ঘিরে কোনো সংবিধান নির্দেশিত বিধি-বিধান নেই। ভারতের প্রত্যেকটি নাগরিক কে, তার নিজের নিজের ধর্ম পালনের অধিকার ভারতের সংবিধান দিয়েছে। অথচ খোদ কলকাতা মহানগরীর একটি কলেজ, ফতোয়া জারি করে নিজেদের ড্রেস কোড চালু করেছেন। দেখা যাচ্ছেÑ এই ড্রেসকোডের ফলে শিখ ধর্মাবলম্বী মানুষদের ধর্মীয় বিশ্বাস আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছে না। আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছে কেবলমাত্র মুসলমানদের ধর্মীয় বিশ্বাসটিই।

তাহলে একথা খুব স্পষ্টভাবেই বলতে পারা যায় যে, ভারতের বিভিন্ন অংশে, যেখানে যেখানে বিজেপি রাজনৈতিক ক্ষমতার দিক থেকে বলিয়ান, সরকার পরিচালনা করছে সেই সব অংশে যেভাবে কেবলমাত্র মুসলমান সমাজকে আক্রমণ করবার লক্ষেই নানা ধরনের পোশাক বিধি, ধর্মীয় আচার-আচরণ জনিত বিধি তৈরি করা হচ্ছে, কলকাতা মহানগরীর ওই কলেজটিতেও সেই ধারাটিকে বজায় রেখেই কেবলমাত্র আক্রমণের লক্ষ্যস্থল হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে মুসলমান সম্প্রদায়কে।

সংশ্লিষ্ট অধ্যাপিকা রাজ্যের সংখ্যালঘু কমিশনের দ্বারস্থ হন সংখ্যালঘু কমিশন অত্যন্ত সহৃদয় তার সঙ্গে বিষয়টি দেখেছেন এবং রাজ্যের একজন প্রাক্তন মন্ত্রী বর্তমানে শাসক দলের বিধায়ক অবসরপ্রাপ্ত আইপিএস অফিসার হুমায়ুন কবির অধ্যাপিকাকে নিয়ে কলেজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দেখা করেন। কলেজ কর্তৃপক্ষ কিছুটা নরম মনোভাব দেখালেও তারা তাদের ড্রেসকোডে মহিলাদের মাথায় স্কার্ট পড়ে আসা যাবে এই কথাটি লিখতে রাজি হয়েছেন কিন্তু কোন অবস্থাতেই তারা হিজাব শব্দটি লিখতে রাজি নন।

আসলে গোটা ভারতে গত দশ বছরে বিজেপির একক গরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার পরিচালনার ফলে যে ধরনের সামাজিক পরিবেশ দেশজুড়ে আরএসএস তৈরি করেছে, কলকাতায় এই হিজাব বিতর্ক কিন্তু তারই একটি অংশ। উত্তর ভারতে যেখানে গ্রীষ্মকালে গরম অত্যন্ত বেশি, সেখানে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে মেয়েরা গরমের হাত থেকে একটু স্বস্তি পাওয়ার জন্য নানা ধরনের কাপড় দিয়ে মাথা আবৃত করেন।

মুসলমান মেয়েরা তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী হিজাব পড়েন; কিন্তু মজার কথা হলো, হিজাব শব্দটিকেই এখন একটি প্রায় নিষিদ্ধ শব্দ হিসেবে দেগে দিতে চেষ্টা করছে হিন্দুত্ববাদী শক্তি। পোশাকের মধ্য দিয়ে যে সাম্প্রদায়িক মানসিকতা উসকে দিয়ে, সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা মেরুকরণ তৈরি করে দেওয়Ñ এটা হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তির দীর্ঘদিনের একটা রাজনৈতিক কৌশল। এই কৌশল কে কাজে লাগিয়ে সদ্য সমাপ্ত লোকসভা নির্বাচনে খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, নিজেদের ঘরে ভোটের ফসল তুলতে চেষ্টা করেছেন।

‘বাবু যতো বলে, পারিষদ গণ বলে তার শতগুণ’। খোদ বিজেপির অন্যতম শীর্ষ নেতা তথা দেশের প্রধানমন্ত্রী যখন এইভাবে প্রকাশ্যে মেরুকরণের রাস্তায় হাঁটেন, তখন তো একটি কলেজের অধ্যক্ষ, মহাপুরুষ যে পথে হাঁটবেন, সেই পথে হাঁটবারই চেষ্টা করবেন!

সেভাবেই ভারতজুড়ে এই প্রবণতা চলেছে কিন্তু যখন এটা আমরা পশ্চিমবঙ্গের বুকে দেখতে পাচ্ছি, তখন কিন্তু আমাদের শিউরে উঠতে হচ্ছে। খোদ কলকাতা শহরে একটি নামকরা বেসরকারি কলেজে যখন এ অবস্থা, তখন না জানি গ্রামবাংলায়, খাদ্য-পোশাক, আচার-আচরণÑ এই সমস্ত জিনিসগুলিকে তালগোল পাকিয়ে, সাম্প্রদায়িক শক্তি কিভাবে মানুষে -মানুষে বিভাজনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

স্বস্তির বিষয়, কলকাতায়, রাজ্যের শাসক দল ওই বেসরকারি কলেজটির কে ঘিরে সাম্প্রদায়িক আগ্রাসন বিষয়ে একটা ইতিবাচক অবস্থান নিয়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলোÑ কেন খোদ কলকাতা শহরের মধ্যে এমন ঘটনা ঘটবে? এমন ঘটনা ঘটছে, সে সম্পর্কে কেন রাজ্যে প্রশাসনের কাছে কোনো খবর থাকবে না? একটি কলেজের অধ্যক্ষ কেবলমাত্র মুসলমান সমাজকে আক্রমণ করবার লক্ষ্যেই যে পোশাক বিধি চালু করতে সচেষ্ট হয়েছেন, কেন সেই কলেজের একজন অধ্যাপিকা, যিনি ধর্ম পরিচয়ে মুসলমান, তাকেই একমাত্র এই প্রতিবাদ করতে হবে? সেই কলেজে তো বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী শিক্ষক আছেন। ছাত্র আছেন। কেন তাদের মধ্যে থেকে প্রতিবাদটা হবে না? কেবল একজন শিক্ষিকায় যে হিজাব বিতর্কের প্রকোপে পড়েছেন, তা নয়। ওই কলেজের একজন ছাত্রীর প্রতিও এই ধরনের অমানবিক আচরণ কলেজ কর্তৃপক্ষ করেছেন। প্রশ্নটা এখানেই যে, কেন সেই ছাত্রীদের অন্য সহপাঠীরা প্রতিবাদী মুখর হননি?

যখন একজন শিখ ধর্মাবলম্বীর পাগড়ি ঘিরে কোনো সমস্যা না থাকবার কথা কলেজ কর্তৃপক্ষ বলছেন, তখন এটা খুব স্পষ্টভাবেই বুঝতে পারা যায় যে, কেবলমাত্র মুসলমান সমাজকে আক্রমণ করবার লক্ষ্যেই এই হিজাব বিতর্ক তোলা হয়েছে। ধর্মীয় পোশাক যদি সত্যিই ওই কলেজে নিষিদ্ধ হতো, তাহলে শিখ সম্প্রদায়ের ছাত্র শিক্ষকদের ঘিরে একই প্রশ্ন কিন্তু এই কলেজ কর্তৃপক্ষ করেনি। করেনি এই কারণেই যে, তারা খুব ভালোভাবে জানে, মুসলমানদের উদ্দেশ্যে যে কাজটি তারা করতে চলেছে, সেটি ঘোরতর বেআইনি, অসংবিধানিক, অমানবিক। বিগত লোকসভা নির্বাচনের সময়কালের যে মেরুকরণের প্রচেষ্টা ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক শক্তির এবং প্রতিযোগিতামূলক সম্প্রদায়িক শক্তি করেছে, সেখান থেকেই ওই কলেজ কর্তৃপক্ষ ভেবেছিলেন যে, লোকসভা নির্বাচনে আবার মোদির প্রচার অনুযায়ী বিজেপি যদি ৪০০ আসন পার করে, বিজেপি একক গরিষ্ঠতা নিয়ে কেন্দ্রে শাসন ক্ষমতায় আসবে। তারপর দেশে রাজনৈতিক হিন্দু রাষ্ট্র নিয়ে তান্ডব শুরু হবে। সেই তান্ডবের পটভূমিকা তৈরি করবার জন্যই কি এইভাবে হিজাব ঘিরে একটা বিতর্ক তৈরি করেছিল কলেজ কর্তৃপক্ষ? এই পোশাকজনিত নিষেধাজ্ঞা কেন সঙ্গে সঙ্গে রাজ্য সরকারের দৃষ্টিগোচর হলো নাÑ এ প্রশ্ন অবশ্যই তুলতে হয়।

পশ্চিমবঙ্গে ভোটর রাজনীতির নিরিখে যদি আমরা মনে করে থাকি যে, হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি বিজেপি এখানে কমজোরি হয়ে গেছে, তাহলে কিন্তু আমরা খুব ভুল করব। মুসলমান সমাজের একটা বঙ অংশ বিজেপির বিপদ সম্পর্কে অবহিত হয়েই ভোটটা কিন্তু বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে পশ্চিমবঙ্গের বুকে প্রমোট করবার জন্য যে শক্তি আত্মনিবেদিত, তাদেরই দিয়েছেন।

মুসলমান সমাজের এ কাজের কোনো সমালোচনা এখানে করা হচ্ছে না। একজন স্বাধীন দেশের নাগরিক, তিনি যাকে মনে করবেন, তাকে ভোট দেবেন; কিন্তু চিন্তার বিষয় হলো এই যে, দেশজুড়ে যে সাম্প্রদায়িকতার তান্ডব আরএসএস-বিজেপিসহ সমস্ত হিন্দু সম্প্রদায়িক শক্তি করে চলেছে, সে সম্পর্কে মুসলমান সমাজ যে সচেতনতা পশ্চিমবঙ্গে, বিজেপিকে ভোট না দিয়ে সেটা তারা খুব ভালোভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন, সেই সচেতনতাা কিন্তু মুসলমানদের করেছে বামপন্থিরা।

পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু সম্প্রদায়ের একটা বড় অংশ যে বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সঙ্গে সহমত নয়, সেটাও তারা বুঝিয়ে দিয়েছেনÑ এর পিছনেও রয়েছে বামেদেরই ভূমিকা; কিন্তু সাধারণ মানুষকে বুঝতে হবে যে, পশ্চিমবঙ্গে কিন্তু কখনো এই ধরনের পোশাক বিতর্ক আগে হয়নি। রাজ্যের শাসক দলের একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব সংশ্লিষ্ট কলেজে যাওয়ার পরও কলেজ কর্তৃপক্ষ এভাবে হিজাব শব্দটি না লেখবার সাহস আগে দেখায়নি।

শিখ সম্প্রদায়ের পাগড়ি ঘিরে আপত্তি না থাকা ওই কলেজ অধ্যক্ষ, একটা ধরি মাছ, না ছুঁই পানি গোছের অবস্থান নিয়ে, হিজাব কে চালাতে চাইছেন। এমন পরিস্থিতি কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে আগে কখনো হয়নি। পশ্চিমবঙ্গে যেভাবে ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক শক্তি, উত্তর ভারতের সংস্কৃতির সাম্প্রদায়িকতাকে দীর্ঘ অনুশীলনের মধ্যে দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের বুকে গেঁথে দিতে চাইছে তাকে প্রতিহত করবার কাজে, প্রতিযোগিতামূলক সম্প্রদায়িক শক্তি কোনো ভূমিকা পালন করবে নাÑ এটা নিশ্চিতভাবে বলতে পারা যায়।

কিন্তু এখানেই কূন্য পাওয়া বামপন্থীদের বিষয়টি উঠে আসছে। করোনা জনিত অতিমারি ঘিরে সমস্যা থেকে শুরু করে, চাকরি দুর্নীতি, বিভিন্ন ধরনের নিয়োগ দুর্নীতিসহ মানুষের রুটি-রুজির প্রশ্ন, বামপন্থীরা যেভাবে গত লোকসভা নির্বাচনের প্রচারকার্যে তুলে ধরলেন, তার ভেতর দিয়ে এটাই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, কেবলমাত্র ভোট রাজনীতিকে লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারিত করে বামপন্থিরা কখনো রাজনীতি করেন না।

ভোট রাজনীতির ক্ষেত্রে তাদের জায়গাটা যতই দুঃখজনক আমরা দেখি না কেন, সামাজিক কর্মসূচিতে তারা যেভাবে ভূমিকা পালন করে, সেই ভূমিকাই কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সাধারণ মানুষকে সাম্প্রদায়িকতার বিপদ সম্পর্কে অনেকখানি সচেতন করেছে। এই সচেতনতার জায়গাটি বামপন্থিরা নিজেদের ভোট বাক্সে রূপান্তরিত করতে পারেননি। না পারার অনেক কারণ আছে। প্রথম এবং প্রধান কারণ হলো; বিজেপি আর তৃণমূলের ইলেক্টোরাল বন্ডের টাকার গ্রোতের কাছে, একেবারে সাধারণ মানুষের দেওয়া আর্থিক সহযোগিতাÑ এই অসম লড়াই লড়ার মতো মানসিকতাই বামপন্থিদের ছিল না।

বামপন্থিরা চাইলে ইলেক্টোরাল বন্ডের টাকা নিয়ে গোটা নির্বাচনের ফল ঘুরিয়ে দিতে পারতেন; কিন্তু আদর্শগত কারণে অমন নৈতিক দুরবস্থার ফাঁদে তারা কখনো পা দেবেন না। বামপন্থিরা পারতেন ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার ঘটিয়ে, হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় হিন্দু সেজে, আর মুসলমান অধ্যুষিত এলাকায় মুসলমান সেজে, ধর্মীয় উত্তাপ তৈরি করে, সেই উত্তাপে রুটি সেঁকে, নিজেদের ভোট বাক্স বাড়াতে।

স্বাধীন ভারতে এই কাজ বামপন্থিরা একদিনের জন্য করেননি। আগামী বহুদিন যদি সংসদীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে বামপন্থিদের সেভাবে সাফল্য না আসে, তবুও তারা এভাবে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের পথে হাঁটবেন না। তাই ঐ আইন কলেজে যে ভয়াবহ ঘটনা আমরা দেখতে পেলাম, রাজনীতিতে যাদের অপ্রাসঙ্গিক বলে গদি মিডিয়া শীবাকীর্তন গাইছে, সেই ভয়াবহ ঘটনা সমাজের বুক থেকে অপসৃত করবার ক্ষেত্রে, বামপন্থিরাই একমাত্র যোগ্য। তারাই পারে সামাজিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে, ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক বিজেপির বিভাজনের অভিসন্ধি, আর সেই অভিসন্ধিকে ফলপ্রসূ করবার জন্য প্রতিযোগিতামূলক সম্প্রদায়িক শক্তি তৃণমূল কংগ্রেসের শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের ‘টগর গোষ্ঠমী’ চরিত্রের আচরণকে প্রতিহত করতে।

[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]

back to top