গৌতম রায়
ভারতের সদ্যসমাপ্ত অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচনের (২০২৪) ফলাফলে পশ্চিমবঙ্গে যে প্রবণতাা দেখা গেছে- তাকে ঘিরে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরে এ মুহূর্তে বেশ আলোচনা চলছে। বামপন্থিরা একটি আসনও পাননি। কংগ্রেসের মাত্র একটি আসন জুটেছে। বাকিগুলো বিজেপি এবং তৃণমূল কংগ্রেস পেয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গে লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলে যেভাবে মেরুকরণের বিষয়টি কাজ করেছে সেই সম্পর্কে এখনো পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের কোনো ধরনের সংবাদমাধ্যম প্রকাশ্যে খুব একটা মুখ খুলছে না। রামনবমী ঘিরে গোটা হিন্দুত্ববাদী শক্তি গত দশ বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গে অতি সক্রিয়তার ভেতর দিয়ে একটা ভয়ংকর পরিবেশ তৈরি করেছে। তার পাল্টা হিসেবে তাদের স্বাভাবিক মিত্র, তৃণমূল কংগ্রেস, হিন্দুত্ববাদীদের ভাবধারাতে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারকে একেবারে বাজারের আলু পটলের স্তরে নামিয়ে এনেছে। রাম কাহিনীর রামকে ঘিরে ভোটমুখী যে রাজনৈতিক উচ্ছ্বাস আরএসএস, বিজেপিসহ গোটা হিন্দুত্ববাদী শিবির দেখায়, ঠিক সেভাবেই রাম কাহিনীর অপর চরিত্র, ‘হনুমানকে’ ঘিরে ধর্মান্ধতার এক অদ্ভুত ধরনের প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছে তৃণমূল কংগ্রেস।
চলতি বছরে রামনবমীকে কেন্দ্র করে মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুর লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত বেলডাঙ্গায় সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা চরমে পৌঁছায়। পুলিশ প্রশাসন কার্যত দর্শকের ভূমিকা পালন করে। কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়োজিত থাকায় আইনশৃঙ্খলের প্রশ্নে হাত গুটিয়ে বসে থাকে রাজ্যের পুলিশ। সব দায়িত্ব তারা ঠেলে দিতে চেষ্টা করে কেন্দ্রীয় বাহিনীর উপরে। অথচ কেন্দ্রীয় বাহিনীর রাস্তা চিনিয়ে অকুস্থলে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে রাজ্যের পুলিশের একটা ভূমিকা থাকে।
সেই ভূমিকা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে পালন করে না রাজ্যের পুলিশ। তবে তার মানে এই নয় যে, সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার ফলে বিক্ষিপ্তভাবে যে দাঙ্গা হয় বেলডাঙ্গায়, সেটাকে প্রশমিত করবার ক্ষেত্রে প্রথম থেকেই আন্তরিকভাবে সক্রিয় ভূমিকা কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়েছিল। ফলে এমন একটা পরিবেশ তৈরি করে দেওয়া হয়, যেখানে ধর্মীয় মেরুকরণের রেখাটি র মাধ্যমে একেবারে আড়াআড়িভাবে হিন্দু-মুসলমানকে বিভাজিত করে দেওয়া হয়।
সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরি করে হিন্দু মুসলমানের এই সংঘাতের পরিবেশ কিন্তু এই তৃতীয় পর্বের ভোটের আগে পশ্চিমবঙ্গে দেখতে পাওয়া যায়নি। বস্তুত প্রথম এবং দ্বিতীয় পর্বের ভোটে সেভাবে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের পথে হাতে-কলমে বিজেপি বা তৃণমূল যায়নি। সাম্প্রদায়িক প্রবণতার সবটাই তারা সীমাবদ্ধ রেখেছিল প্রচারের ক্ষেত্রে। উত্তরবঙ্গের ভোট মিটে যাওয়ার পর, যেই ভোট মধ্যবঙ্গে প্রবেশ করছে, বিরোধী শিবিরের দুই প্রথমসারির নেতা, সিপিআইর (এম) মোহাম্মদ সেলিম এবং জাতীয় কংগ্রেসের অধীররঞ্জন চৌধুরী, যিনি সপ্তদশ লোকসভার বিরোধী দলনেতা ছিলেন, এই দুজনকে যে কোনো প্রকারে হারানোর জন্য, কার্যত বিজেপি আর তৃণমূল কংগ্রেস সরাসরি সাম্প্রদায়িকতার কার্ডটি খেলতে শুরু করে দেয়।
সাধারণ মুসলমান সমাজের একটা বড় অংশ, যারা খুব তলিয়ে রাজনীতি নিয়ে ভাবেন না, কিন্তু বিজেপির গত দশ বছরের শাসনে হিন্দু সম্প্রদায়িক শক্তি সম্পর্কে তারা আতঙ্কিত। এই অংশের মানুষদের মধ্যে ভারত সেবাশ্রম সংঘের সামাজিক অবস্থান আর রামকৃষ্ণ মিশনের সামাজিক অবস্থান, এই দুটিকে প্রায় এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে দেন মমতা। এভাবেই হিন্দু সম্প্রদায়িকতা এবং মুসলিম সাম্প্রদায়িকতা উভয়ের পালে একটা নতুন হাওয়া এনে দেন মমতা।
এর ফলে যে অংশের লিবারেল হিন্দু, নির্বাচনের কয়েক দিন আগেও মনে করেছিলেন যে ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকেই তারা ভোট দেবেন, ধর্মনিরপেক্ষতা ঘিরে, মেকি ধর্মনিরপেক্ষ তৃণমূলের প্রতি এই লিবারেল হিন্দুদের একটা স্পষ্ট ধারণা ছিল। সেই অংশের মানুষও বেলডাঙ্গার দাঙ্গা, এই দাঙ্গাকে ঘিরে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শিবির গুলির অবস্থান, বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠন (একমাত্র রামকৃষ্ণ মিশন ছাঙা, যারা ধর্মের রাজনৈতিক কারবারের মধ্যে দিয়েই নিজেদের সামাজিক অবস্থান টিকে টিকিয়ে রাখে) তারা এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করল, যাতে লিবারেল বেলডাঙ্গার দাঙ্গার ঘটনাকে দক্ষিণবঙ্গে আরএসএস যেভাবে প্রচার করেছে সেটাকে আরো উস্কে দিয়েছেন মমতা। রামকৃষ্ণ মিশন কে সাম্প্রদায়িক তকমা দিয়ে, রামকৃষ্ণ মিশনের ওপর রাজনৈতিক ছাপ দেওয়ার যে কৌশল মমতা নিয়েছিলেন, সেই কৌশলটি কিন্তু সার্বিকভাবে হিন্দু ভোটের একটা বড় অংশ, তার মধ্যে যেমন সাম্প্রদায়িক হিন্দু ভোট আছে, আবার তেমনি লিবারেল হিন্দু ভোটও আছে, সেই ভোটগুলোকে বিজেপিমুখী করে দিয়েছে।
তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বময় নেত্রী মমতা এবং বিজেপির রাজ্যসভার সাংসদ অনন্ত মহারাজ, যাকে ঘিরে বিচ্ছিন্নতাবাদী রাজনীতির বহু অভিযোগ আছে, এদের মধ্যে সাক্ষাৎটি নিছক সৌজন্যমূলক, তাহলে তারা খুব ভুল করবেন। পশ্চিমবঙ্গে প্রকৃত বিরোধীশূন্য রাজনীতির পরিবেশ তৈরি করবার জন্য বিজেপি-মমতার মধ্যে যে বোঝাপড়া, তার ফলশ্রুতি আমরা দেখেছি দাঙ্গা করে, হিন্দু মুসলমানের মধ্যে পারস্পরিক বিদ্বেষের পারদকে অনেকটা চড়িয়ে দিয়ে সেলিম-অধীরকে যৌথভাবে হারানোর মধ্য দিয়ে।
এই অধীর-সেলিমকে হারানোর সেই নীলনকশাটাই যে মমতা নানা স্তরের আরএসএস ঘনিষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে নিয়ে করেছিলেন সেটা কিন্তু খুব জলের মতো স্পষ্ট হয়ে গেল কোচবিহারে বিজেপির রাজ্যসভা সংসদের বাড়িতে গিয়ে মমতার এই তথাকথিত সৌজন্য বিনিময়ের মধ্যে দিয়ে। বিজেপি একটা লোক দেখানো ভাবে, তাদের দলের রাজ্যসভা সাংসদদের বাড়িতে, মমতার যাওয়া নিয়ে কাগুজে প্রতিবাদ করছে। কারণ কোচবিহার কেন্দ্রে বিজেপির সাংসদ তথা বিগত মন্ত্রিসভায় অমিত শাহের ডেপুটি নিশীত প্রামাণিক পরাজিত হয়েছেন। ফলে একটা ভারসাম্যের রাজনীতি, কৌশলগত কারণেই দেখানোর দরকার হিন্দুত্ববাদী শিবিরের।
আর মমতার প্রয়োজন ঠিক দুই বছর পরে রাজ্য বিধানসভার যে ভোট আসছে, তাকে কেন্দ্র করে বিজেপির সঙ্গে, আরএসএসের সঙ্গে, গোটা হিন্দুত্ববাদী শিবিরের সঙ্গে এবং অবশ্যই হিন্দুত্ববাদীদের আশ্রয় থাকা সমস্ত ধরনের বিচ্ছিন্নতাবাদী শিবিরগুলোর সঙ্গে বোঝাপড়াটাকে একটু ঝালিয়ে নেওয়া।
শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িক শক্তি, ভোটের রাজনীতিতে কখনই তেমন কোনো সাফল্য পায়নি। হরিপদ ভারতীর মতো সাম্প্রদায়িক ব্যক্তিত্ব, জরুরি অবস্থা সময়কালের রাজনৈতিক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে সংসদীয় রাজনীতিতে ভেসে উঠলেও নিজের বা মতাদর্শের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখবার ক্ষেত্রে আদৌ সফল হননি।
এ প্রসঙ্গে অত্যন্ত কৌশলে সিপিআই (এম) নেতা মোহাম্মদ সেলিমকে ঘিরে নোংরা রাজনৈতিক প্রচার শুরু হয়ে গেছে। কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে সেলিম নাকি বিজেপির বিরুদ্ধে সরব ননÑ এমনটা কেউ কেউ প্রচার করতে শুরু করে দিয়েছে।
সেলিম হারাতে সাময়িক স্বস্তি পেতে পারে কেউ কিন্তু তারা জানে না, সেলিমরা কখনো হারেন না। দক্ষিণপন্থি রাজনীতিকদের মতÑ ব্যক্তিস্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে সেলিমরা কখনো রাজনীতি করেননি। করেন না, করবেনও না। ব্যক্তি স্বার্থে টান পড়লে মন্ত্রী হতে না পারলে তৃণমূল আর বিজেপির মধ্যে ডিগবাজি খাওয়া সৌমিত্র খানেরা শখের বিপ্লবী হতে চান। আর মমতা, সৌমিত্রের ব্যক্তিজীবন ঘিরে রুচি বিরুদ্ধ অবস্থান প্রকাশ্যে নিলেও যে কোনো ঝড়তি-পড়তির গায়ে যদি নির্বাচন কমিশনের সার্টিফিকেট থাকে, তাকে দলে ভিড়িয়ে সংখ্যা বাড়াতে তৎপর, তাদের জন্যে কেবল রবীন্দ্রনাথই উচ্চারিত হোকÑ ‘মুখে হাসি তবু চোখে জল না শুকায় রে, হায় ভীরু প্রেম, হায় রে। জয় করে তবু ভয় কেন তোর যায় না।’ আশার আলোতেও ভরসা না পাওয়া এরাই এখন নিজেদের দেউলিয়াপনা থেকেই জন্ম দেবে নতুন ভোর।
[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]
গৌতম রায়
শনিবার, ২২ জুন ২০২৪
ভারতের সদ্যসমাপ্ত অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচনের (২০২৪) ফলাফলে পশ্চিমবঙ্গে যে প্রবণতাা দেখা গেছে- তাকে ঘিরে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরে এ মুহূর্তে বেশ আলোচনা চলছে। বামপন্থিরা একটি আসনও পাননি। কংগ্রেসের মাত্র একটি আসন জুটেছে। বাকিগুলো বিজেপি এবং তৃণমূল কংগ্রেস পেয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গে লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলে যেভাবে মেরুকরণের বিষয়টি কাজ করেছে সেই সম্পর্কে এখনো পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের কোনো ধরনের সংবাদমাধ্যম প্রকাশ্যে খুব একটা মুখ খুলছে না। রামনবমী ঘিরে গোটা হিন্দুত্ববাদী শক্তি গত দশ বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গে অতি সক্রিয়তার ভেতর দিয়ে একটা ভয়ংকর পরিবেশ তৈরি করেছে। তার পাল্টা হিসেবে তাদের স্বাভাবিক মিত্র, তৃণমূল কংগ্রেস, হিন্দুত্ববাদীদের ভাবধারাতে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারকে একেবারে বাজারের আলু পটলের স্তরে নামিয়ে এনেছে। রাম কাহিনীর রামকে ঘিরে ভোটমুখী যে রাজনৈতিক উচ্ছ্বাস আরএসএস, বিজেপিসহ গোটা হিন্দুত্ববাদী শিবির দেখায়, ঠিক সেভাবেই রাম কাহিনীর অপর চরিত্র, ‘হনুমানকে’ ঘিরে ধর্মান্ধতার এক অদ্ভুত ধরনের প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছে তৃণমূল কংগ্রেস।
চলতি বছরে রামনবমীকে কেন্দ্র করে মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুর লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত বেলডাঙ্গায় সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা চরমে পৌঁছায়। পুলিশ প্রশাসন কার্যত দর্শকের ভূমিকা পালন করে। কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়োজিত থাকায় আইনশৃঙ্খলের প্রশ্নে হাত গুটিয়ে বসে থাকে রাজ্যের পুলিশ। সব দায়িত্ব তারা ঠেলে দিতে চেষ্টা করে কেন্দ্রীয় বাহিনীর উপরে। অথচ কেন্দ্রীয় বাহিনীর রাস্তা চিনিয়ে অকুস্থলে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে রাজ্যের পুলিশের একটা ভূমিকা থাকে।
সেই ভূমিকা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে পালন করে না রাজ্যের পুলিশ। তবে তার মানে এই নয় যে, সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার ফলে বিক্ষিপ্তভাবে যে দাঙ্গা হয় বেলডাঙ্গায়, সেটাকে প্রশমিত করবার ক্ষেত্রে প্রথম থেকেই আন্তরিকভাবে সক্রিয় ভূমিকা কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়েছিল। ফলে এমন একটা পরিবেশ তৈরি করে দেওয়া হয়, যেখানে ধর্মীয় মেরুকরণের রেখাটি র মাধ্যমে একেবারে আড়াআড়িভাবে হিন্দু-মুসলমানকে বিভাজিত করে দেওয়া হয়।
সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরি করে হিন্দু মুসলমানের এই সংঘাতের পরিবেশ কিন্তু এই তৃতীয় পর্বের ভোটের আগে পশ্চিমবঙ্গে দেখতে পাওয়া যায়নি। বস্তুত প্রথম এবং দ্বিতীয় পর্বের ভোটে সেভাবে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের পথে হাতে-কলমে বিজেপি বা তৃণমূল যায়নি। সাম্প্রদায়িক প্রবণতার সবটাই তারা সীমাবদ্ধ রেখেছিল প্রচারের ক্ষেত্রে। উত্তরবঙ্গের ভোট মিটে যাওয়ার পর, যেই ভোট মধ্যবঙ্গে প্রবেশ করছে, বিরোধী শিবিরের দুই প্রথমসারির নেতা, সিপিআইর (এম) মোহাম্মদ সেলিম এবং জাতীয় কংগ্রেসের অধীররঞ্জন চৌধুরী, যিনি সপ্তদশ লোকসভার বিরোধী দলনেতা ছিলেন, এই দুজনকে যে কোনো প্রকারে হারানোর জন্য, কার্যত বিজেপি আর তৃণমূল কংগ্রেস সরাসরি সাম্প্রদায়িকতার কার্ডটি খেলতে শুরু করে দেয়।
সাধারণ মুসলমান সমাজের একটা বড় অংশ, যারা খুব তলিয়ে রাজনীতি নিয়ে ভাবেন না, কিন্তু বিজেপির গত দশ বছরের শাসনে হিন্দু সম্প্রদায়িক শক্তি সম্পর্কে তারা আতঙ্কিত। এই অংশের মানুষদের মধ্যে ভারত সেবাশ্রম সংঘের সামাজিক অবস্থান আর রামকৃষ্ণ মিশনের সামাজিক অবস্থান, এই দুটিকে প্রায় এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে দেন মমতা। এভাবেই হিন্দু সম্প্রদায়িকতা এবং মুসলিম সাম্প্রদায়িকতা উভয়ের পালে একটা নতুন হাওয়া এনে দেন মমতা।
এর ফলে যে অংশের লিবারেল হিন্দু, নির্বাচনের কয়েক দিন আগেও মনে করেছিলেন যে ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকেই তারা ভোট দেবেন, ধর্মনিরপেক্ষতা ঘিরে, মেকি ধর্মনিরপেক্ষ তৃণমূলের প্রতি এই লিবারেল হিন্দুদের একটা স্পষ্ট ধারণা ছিল। সেই অংশের মানুষও বেলডাঙ্গার দাঙ্গা, এই দাঙ্গাকে ঘিরে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শিবির গুলির অবস্থান, বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠন (একমাত্র রামকৃষ্ণ মিশন ছাঙা, যারা ধর্মের রাজনৈতিক কারবারের মধ্যে দিয়েই নিজেদের সামাজিক অবস্থান টিকে টিকিয়ে রাখে) তারা এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করল, যাতে লিবারেল বেলডাঙ্গার দাঙ্গার ঘটনাকে দক্ষিণবঙ্গে আরএসএস যেভাবে প্রচার করেছে সেটাকে আরো উস্কে দিয়েছেন মমতা। রামকৃষ্ণ মিশন কে সাম্প্রদায়িক তকমা দিয়ে, রামকৃষ্ণ মিশনের ওপর রাজনৈতিক ছাপ দেওয়ার যে কৌশল মমতা নিয়েছিলেন, সেই কৌশলটি কিন্তু সার্বিকভাবে হিন্দু ভোটের একটা বড় অংশ, তার মধ্যে যেমন সাম্প্রদায়িক হিন্দু ভোট আছে, আবার তেমনি লিবারেল হিন্দু ভোটও আছে, সেই ভোটগুলোকে বিজেপিমুখী করে দিয়েছে।
তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বময় নেত্রী মমতা এবং বিজেপির রাজ্যসভার সাংসদ অনন্ত মহারাজ, যাকে ঘিরে বিচ্ছিন্নতাবাদী রাজনীতির বহু অভিযোগ আছে, এদের মধ্যে সাক্ষাৎটি নিছক সৌজন্যমূলক, তাহলে তারা খুব ভুল করবেন। পশ্চিমবঙ্গে প্রকৃত বিরোধীশূন্য রাজনীতির পরিবেশ তৈরি করবার জন্য বিজেপি-মমতার মধ্যে যে বোঝাপড়া, তার ফলশ্রুতি আমরা দেখেছি দাঙ্গা করে, হিন্দু মুসলমানের মধ্যে পারস্পরিক বিদ্বেষের পারদকে অনেকটা চড়িয়ে দিয়ে সেলিম-অধীরকে যৌথভাবে হারানোর মধ্য দিয়ে।
এই অধীর-সেলিমকে হারানোর সেই নীলনকশাটাই যে মমতা নানা স্তরের আরএসএস ঘনিষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে নিয়ে করেছিলেন সেটা কিন্তু খুব জলের মতো স্পষ্ট হয়ে গেল কোচবিহারে বিজেপির রাজ্যসভা সংসদের বাড়িতে গিয়ে মমতার এই তথাকথিত সৌজন্য বিনিময়ের মধ্যে দিয়ে। বিজেপি একটা লোক দেখানো ভাবে, তাদের দলের রাজ্যসভা সাংসদদের বাড়িতে, মমতার যাওয়া নিয়ে কাগুজে প্রতিবাদ করছে। কারণ কোচবিহার কেন্দ্রে বিজেপির সাংসদ তথা বিগত মন্ত্রিসভায় অমিত শাহের ডেপুটি নিশীত প্রামাণিক পরাজিত হয়েছেন। ফলে একটা ভারসাম্যের রাজনীতি, কৌশলগত কারণেই দেখানোর দরকার হিন্দুত্ববাদী শিবিরের।
আর মমতার প্রয়োজন ঠিক দুই বছর পরে রাজ্য বিধানসভার যে ভোট আসছে, তাকে কেন্দ্র করে বিজেপির সঙ্গে, আরএসএসের সঙ্গে, গোটা হিন্দুত্ববাদী শিবিরের সঙ্গে এবং অবশ্যই হিন্দুত্ববাদীদের আশ্রয় থাকা সমস্ত ধরনের বিচ্ছিন্নতাবাদী শিবিরগুলোর সঙ্গে বোঝাপড়াটাকে একটু ঝালিয়ে নেওয়া।
শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িক শক্তি, ভোটের রাজনীতিতে কখনই তেমন কোনো সাফল্য পায়নি। হরিপদ ভারতীর মতো সাম্প্রদায়িক ব্যক্তিত্ব, জরুরি অবস্থা সময়কালের রাজনৈতিক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে সংসদীয় রাজনীতিতে ভেসে উঠলেও নিজের বা মতাদর্শের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখবার ক্ষেত্রে আদৌ সফল হননি।
এ প্রসঙ্গে অত্যন্ত কৌশলে সিপিআই (এম) নেতা মোহাম্মদ সেলিমকে ঘিরে নোংরা রাজনৈতিক প্রচার শুরু হয়ে গেছে। কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে সেলিম নাকি বিজেপির বিরুদ্ধে সরব ননÑ এমনটা কেউ কেউ প্রচার করতে শুরু করে দিয়েছে।
সেলিম হারাতে সাময়িক স্বস্তি পেতে পারে কেউ কিন্তু তারা জানে না, সেলিমরা কখনো হারেন না। দক্ষিণপন্থি রাজনীতিকদের মতÑ ব্যক্তিস্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে সেলিমরা কখনো রাজনীতি করেননি। করেন না, করবেনও না। ব্যক্তি স্বার্থে টান পড়লে মন্ত্রী হতে না পারলে তৃণমূল আর বিজেপির মধ্যে ডিগবাজি খাওয়া সৌমিত্র খানেরা শখের বিপ্লবী হতে চান। আর মমতা, সৌমিত্রের ব্যক্তিজীবন ঘিরে রুচি বিরুদ্ধ অবস্থান প্রকাশ্যে নিলেও যে কোনো ঝড়তি-পড়তির গায়ে যদি নির্বাচন কমিশনের সার্টিফিকেট থাকে, তাকে দলে ভিড়িয়ে সংখ্যা বাড়াতে তৎপর, তাদের জন্যে কেবল রবীন্দ্রনাথই উচ্চারিত হোকÑ ‘মুখে হাসি তবু চোখে জল না শুকায় রে, হায় ভীরু প্রেম, হায় রে। জয় করে তবু ভয় কেন তোর যায় না।’ আশার আলোতেও ভরসা না পাওয়া এরাই এখন নিজেদের দেউলিয়াপনা থেকেই জন্ম দেবে নতুন ভোর।
[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ]