alt

উপ-সম্পাদকীয়

উচ্ছেদকৃত দলিতদের পুনর্বাসন করুন

বাবুল রবিদাস

: শনিবার, ২২ জুন ২০২৪

দাবি বা অধিকার সবদিক দিয়ে নিখুঁত ও সঠিক কিন্তু তামাদি আইন সর্ম্পকে সচেনতার অভাবের কারণে সেই দাবি বা অধিকার চিরকালের জন্য নষ্ট হয়ে যেতে পারে। বেদখল হওয়া জমি উদ্ধার করার জন্য একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে আদালত আশ্রয় নিতে হয়। সেই সময়সীমা পার হলে বেদখলীয় সম্পত্তি বা জমি উদ্ধারের অধিকার তামাদি আইন দ্বারা চিরতরে বারিত হয়ে যায় বটে।

ধরা যাক, যদি কেহ তার কোন গৃহ নির্মাণ অন্তে নিজ অধিকারে, বিনা বাধায় এবং শান্তিপূর্ণভাবে আলো বাতাস পাওয়ার অধিকার একাধিক্রমে ২০ বৎসর যাবত দখল-ভোগ করে থাকে, তবে ২০ বৎসর অতীতে তার অধিকার অপ্রতিরোধ্য ব্যবহার সিদ্ধ অধিকার রূপে গণ্য হবে। অনুরূপভাবে কেহ যদি নিজ অধিকারে শান্তিপূর্ণ এবং প্রকাশ্যেভাবে বিনা বাধায় ২০ বৎসর যাবত জল চলাচলের নালা বা পথধিকার দখল ভোগ করে থাকে, তবে ২০ বৎসর অতীতের এ অধিকারগুলো ব্যবহার সিদ্ধ অপ্রতিরোধ্য অধিকাররূপে গণ্য হবে।

এ জাতীয় অধিকার ২০ বৎসর নিরবছিন্নভাবে, শান্তিপূর্ণ উপায়ে, স্বাধিকারে এবং বিনা বাধায় দখল ভোগ করলে ব্যবহার সিদ্ধ অধিকার জন্মে। কিন্তু একাধিক্রমে দুই (২) বৎসর এ অধিকার প্রয়োগে বাধা প্রাপ্ত হয়ে থাকলে দুই (২) বৎসর পর তা লোপ পায়। অর্থাৎ ব্যবহার সিদ্ধ অধিকার অর্জন করতে সময় লাগে সুদীর্ঘ ২০ বৎসর আর সেই অধিকার লোপ পেতে সময় লাগে মাত্র দুই (২) বৎসর। বিষয়টি আরও পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করা যায় যে, যার বিরুদ্ধে এ দাবি করা হয় তা যদি সরকারের হয় তবে ২০ বৎসরের স্থলে ৬০ বৎসর হতে হবে।

একটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি পরিষ্কার করা যেতে পারে। যেমন, রহিম মন্ডল দীর্ঘদিন যাবত অন্য ব্যক্তির জায়গায় গৃহ নির্মাণ করে বসবাস করছে বা তার প্রতিবেশী করিম প্রধানের বহির্বাটির একপাশ দিয়ে যাতায়াত করছে, গবাদিপশু নিয়ে মাঠে যাচ্ছে এবং ফসলাদি নিয়ে আসছে। প্রয়োজনবোধে মাঠের ফসল গরুর গাড়ি দ্বারা বা ভ্যান দ্বারা একই পথে আনা নেয়া করছে। এভাবে রহিম মন্ডল একাধিক্রমে সুদীর্ঘ ২০ বৎসর যাবত করিম প্রধানের বহির্বাটিই চিহিৃত অংশ নিজ অধিকারে শান্তিপূর্ণ ও প্রকাশ্যেভাবে নিজের চলাচলের পথ হিসেবে ব্যবহার করে আসতে থাকলে ২০ বৎসর পর তার রহিম মন্ডল এ গৃহে বসবাসের বা পথাধিকার অপ্রতিবোধ্য ব্যবহার সিদ্ধ অধিকার বলে গণ্য হবে।

পক্ষান্তরে ২০ বৎসর পর করিম প্রধান রহিম মন্ডলকে তার বহির্বাটির চিহিৃত অংশের উপর দিয়া চলাচল করতে নিষেধ করলে তামাদি আইনত তাহা অগ্রাহ্য হবে কিন্তু করিম প্রধান যদি গৃহ ভেঙে দখল বা বেড়া দিয়ে দুবৎসর পর্যন্ত পথ বন্ধ করে রাখে বা রাখতে পারে তবে রহিম মন্ডলের ২০ বৎসর অর্জিত পথাধিকার একাধিক্রমে দুই বৎসর বাধা প্রাপ্ত হওয়ায় নষ্ট হবে।

অতএব, যদি কেহ এভাবে অর্জিত ব্যবহার সিদ্ধ অধিকারে বাধা প্রাপ্ত হয় তবে তাকে বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার তারিখে থেকে ২ বৎসরের মধ্যে প্রতিকারের জন্য আদালতের আশ্রয় গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় তার দাবি তামাদি আইন দ্বারা বারিত হয়ে যাবে। এভাবে ২০ বৎসর যাবত একাধিক্রমে দখল ভোগজনিত কারণে অর্জিত অধিকারকে ব্যবহার সিদ্ধ অধিকার বলে।

সম্প্রতি হরিজন উচ্ছেদ প্রসঙ্গে প্রাপ্ত তথ্য উপাত্ত থেকে জানা যায় যে, রাজধানীর বংশালের আগাসাদেক রোডে মিরনজিল্লা কলোনির বাসিন্দা দলিত সম্প্রদায়। তারা মূলত পরিষ্কার পরিছন্নতার কর্মে নিয়োজিত। ব্রিটিশ সরকার ১৮৩৮-১৮৫০ এর দিকে তাদের ভারতের বিভিন্ন এলাকা থেকে এনে মিরনজিল্লায় বসবাস স্থাপন করে দেন এবং শহর, রেলস্টেশন, সরকারি অফিস আদালতে ঝাড়– দেয়া ও পরিষ্কার পরিছন্নতার কাজ দিয়েছিল, নামমাত্র বেতনে। ফলে তাদের সংসার কোন মতে চলত মাত্র। অর্থাৎ নুন আনতে পান্তা ফুরানোর ফলে তাদের নতুন প্রজন্ম লেখাপড়া শিক্ষা-দীক্ষায় আধুনিক সমাজের মানুষের মতো গড়ে উঠতে পারেনি। তারা মূলত শ্রেণীবৈষম্যের ও অস্পৃশ্যতার শিকার বৃহত্তম সমাজে অচ্ছুতে কারণে তাদের ওঠাবসা নেই বললেই চলে।

এসব দলিত জাতি হিন্দু সমাজের হলেও তাদের কিন্তু হিন্দু সমাজে গ্রহণযোগ্যতা নেই বললেই চলে। এসব অনগ্রসর জাতিকে বিভিন্ন পত্রপত্রিকার হরিজন বলে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। হরিজন নামটি দিয়েছিল মহনদাস করমচাঁদ গান্ধি ১৯৩৩ সালে সমাজের অস্পৃশ্য বলে বিবেচনা করা লোকজনদের হরিজন নামে নামকরণ করে।

হরিজন অর্থ হচ্ছে ‘হরি’ মানে ভগবান এবং ‘জন’ মানে বান্ধা। অর্থাৎ ভগবানের বান্ধা হচ্ছে হরিজন। বর্তমানে হরিজন শব্দ মর্যাদা হানিকর বলে মনে করা হয়। তাই অনেকে এ শব্দকে ব্যবহার করতে চান না। ড. বি আর আম্বেদকর হরিজন নামকরণের বিরোধিতা করেছিলেন।

মিরনজিল্লায় ৫০০ পরিবার বসবাস করে আসছে সেই ১৮৩৮-১৮৫০ সাল থেকে। এ হিসাব থেকে জানা যায় যে, তারা প্রায় দুশ বৎসরের মতো সময় ধরে সরকারের জ্ঞাতসারে বংশ পরমপরায় বসবাস করে আসছে। এ কলোনিতে গত ১১ জুন ২০২৪ তারিখে উচ্ছেদ কার্যক্রম শুরু হয়।

উচ্ছেদের পূর্বে এ কলোনিতে পানি, বিদু্যুৎ ও গ্যাসের লাইন কেটে দেয়া হয়। এরপর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন বুলডোজার দিয়ে প্রায় ৮০টি ঘর ভেঙে দিয়েছে। উচ্ছেদ আতঙ্কে দুজন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে, গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টাও করা হয়েছে। উচ্ছেদ হওয়া এসব মানুষ পরিবার পরিজন নিয়ে খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবনযাপন করছে। বর্তমানে বর্ষার সময় ঝড়-বৃষ্টি মাথার উপর থেকে ঝরে পড়ছে। অর্থাৎ অবর্ণনীয় কাহিনী। টেলিভিশনে, বিভিন্ন, পত্রপত্রিকায়, খবরটি ছাপানো হয়েছে এবং মহামান্য হাইকোর্টে একটি রিট ফাইল করা হয়েছে। মামলার অর্ডারে স্থিতিবস্থা বজায় রাখতে বলেছেন।

এ অবস্থায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে কোন কিছু অনগ্রসর দলিত জাতির উদ্দেশ্যে বলছেন না। সম্ভবত তারা মামলায় কনটেস্ট করবেন বলে মনে হচ্ছে। মামলাটি দীর্ঘদিন যদি চলে তাহলে দলিত জনগোষ্ঠীর সন্তানদের ভবিষ্যৎ কী হবে? খোলা জায়গায় পানি নাই, বিদ্যুৎ নাই, গ্যাস নাই, বাথরুম নাই। তারা কি স্কুলগামী হতে ঝরে পরবে না? এরকম আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।

আমরা সনিবর্ন্ধ অনুরোধ করব দলিত-বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর পাশে দেশের সমাজহিতৈষী, জ্ঞানী-গুণী সমাজকর্মী, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা, ডোনারদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়ানোর জন্য।

সরকার যে কোন জায়গা অধিগ্রহণ করতে পারে। তবে মসজিদের জায়গা, মন্দিরের জায়গা, শ্মশান ও কবরস্থানের জায়গা অধিগ্রহণ করতে পারে না।

হিউম্যান স্ট্যান্ডার মানে প্রত্যেক সরকারের একটি নির্দিষ্ট সীমা দেয়ার সময় আছে এবং এ সীমা সরকার অতিক্রম করতে পারে না। তবে উপরে ওঠার বিষয়ে কোন সীমা থাকবে না। যদি সরকার নি¤েœর সীমা অতিক্রম করে তা হলে তা মানবাধিকার লংঘনের সামিল হবে।

তাই অবশ্যই এই উচ্ছেদকৃত দলিতদের পুনর্বাসন করতে হবে। কাউকে পেছনে ফেলে উন্নয়ন নয়। ডিজিটাল ও স্মার্ট দেশ গড়তে সবাইকে সাথে নিয়ে এগোতে হবে। সরকার জনগণের ভোটে যেহেতু নির্বাচিত, তাই জনগণের মতামতের মূল্যায়ন অবশ্যই করতে হবে। বহু গৃহহীন মানুষ বাড়িঘর পাচ্ছে, তাহলে দলিতদের ঘর-বাড়ি ভেঙে গৃহহীন করা হচ্ছে কেন?

দেশে কেউ প্রজা নয়, সবাইই নাগরিক। ভোটের সময় তাদের প্রয়োজন অবশ্যই হয়। সেই বিবেচনায় ৬০ বৎসর সরকারি সম্পত্তি দখলের মাধ্যমে সম্পত্তির স্বত্ব অর্জিত হয় বৈকি?

জনগণের ২০ বৎসর আর সরকারি সম্পত্তির ক্ষেত্রে ৬০ বৎসর। উল্লেখ করা আবশ্যক যে, ১৯৭১ সালে জাতি, ধর্ম, বর্ণনির্বিশেষে দলিত জনগণ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল বলেই এদেশ স্বাধীন হয়েছিল। বহু মুক্তিযোদ্ধা হরিজন তথা দলিতদের মধ্যে রয়েছে।

[লেখক : আইনজীবী]

পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থকে কি জলাঞ্জলি দিয়েছে মোদি প্রশাসন

বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ : আইন কী বলে

হাজার টাকার বাগান খাইল পাঁচ সিকার ছাগলে

বাংলাদেশের উন্নতিতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর লজ্জা

মাদকমুক্ত দেশ গড়তে প্রয়োজন প্রতিরোধ কার্যক্রম

রম্যগদ্য : ‘ন্যায়-অন্যায় জানি নে, জানি নে...’

ছবি

কুরবানির ছাগল তাকে চিনতে পেরেছে

ছবি

সুইডিশ মিডসামার : এক আনন্দময় দিনের সূচনা

ছবি

আধুনিক রূপকথা এবং আমাদের রাজাদের গল্প

গাছে গাছে সবুজ হোক দেশ

কত বিষে আমাদের বসবাস

ছবি

তিস্তার দুই নয়নে দুই অশ্রুধারা

বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ান

আদিবাসীরা বৈষম্যের শিকার

ছবি

নারীর অগ্রযাত্রা

ছবি

সিলেট-সুনামগঞ্জের ‘জলাবদ্ধ বন্যার’ দায় কার?

ছবি

বুড়িতিস্তা রিজার্ভার খনন : কৃষক কি উপকৃত হবে?

সেন্টমার্টিন দ্বীপ নিয়ে কী হচ্ছে?

রম্যগদ্য : অভিযোগ ‘অভিযোগ’ নয়

কেন হেরে গেলেন সেলিম

নীরবে-নিভৃতে কাজ করা এক কৃষিবিজ্ঞানীর কথা

অর্থনীতি কী অবস্থায় আছে?

কোরবানির চামড়ার হকদার

যোগাযোগ অধ্যয়ন কেন গুরুত্বপূর্ণ

এমপি আনারকে নিয়ে যত আইনি জটিলতা

অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও আইনের শাসন

দূর হোক মনের পশুত্ব

মনের পশুত্বের প্রতীকী ত্যাগের আরেক নাম কোরবানি

ঈদে সুস্থ খাদ্যাভ্যাস

এমআইটি : প্রযুক্তির সৃষ্টি রহস্যের খোঁজ

কবিগুরুর বাণী ‘প্রমাণিত মিথ্যা’

কিশোর গ্যাং কালচার বন্ধ হবে কিভাবে

কানিহাটি সিরিজ এবং পঞ্চব্রীহি নিয়ে আরও কিছু কথা

কলকাতায় হিজাব বিতর্ক

বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশ নিয়ে বিতর্ক

হাতের শক্তি ও মহিমা

tab

উপ-সম্পাদকীয়

উচ্ছেদকৃত দলিতদের পুনর্বাসন করুন

বাবুল রবিদাস

শনিবার, ২২ জুন ২০২৪

দাবি বা অধিকার সবদিক দিয়ে নিখুঁত ও সঠিক কিন্তু তামাদি আইন সর্ম্পকে সচেনতার অভাবের কারণে সেই দাবি বা অধিকার চিরকালের জন্য নষ্ট হয়ে যেতে পারে। বেদখল হওয়া জমি উদ্ধার করার জন্য একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে আদালত আশ্রয় নিতে হয়। সেই সময়সীমা পার হলে বেদখলীয় সম্পত্তি বা জমি উদ্ধারের অধিকার তামাদি আইন দ্বারা চিরতরে বারিত হয়ে যায় বটে।

ধরা যাক, যদি কেহ তার কোন গৃহ নির্মাণ অন্তে নিজ অধিকারে, বিনা বাধায় এবং শান্তিপূর্ণভাবে আলো বাতাস পাওয়ার অধিকার একাধিক্রমে ২০ বৎসর যাবত দখল-ভোগ করে থাকে, তবে ২০ বৎসর অতীতে তার অধিকার অপ্রতিরোধ্য ব্যবহার সিদ্ধ অধিকার রূপে গণ্য হবে। অনুরূপভাবে কেহ যদি নিজ অধিকারে শান্তিপূর্ণ এবং প্রকাশ্যেভাবে বিনা বাধায় ২০ বৎসর যাবত জল চলাচলের নালা বা পথধিকার দখল ভোগ করে থাকে, তবে ২০ বৎসর অতীতের এ অধিকারগুলো ব্যবহার সিদ্ধ অপ্রতিরোধ্য অধিকাররূপে গণ্য হবে।

এ জাতীয় অধিকার ২০ বৎসর নিরবছিন্নভাবে, শান্তিপূর্ণ উপায়ে, স্বাধিকারে এবং বিনা বাধায় দখল ভোগ করলে ব্যবহার সিদ্ধ অধিকার জন্মে। কিন্তু একাধিক্রমে দুই (২) বৎসর এ অধিকার প্রয়োগে বাধা প্রাপ্ত হয়ে থাকলে দুই (২) বৎসর পর তা লোপ পায়। অর্থাৎ ব্যবহার সিদ্ধ অধিকার অর্জন করতে সময় লাগে সুদীর্ঘ ২০ বৎসর আর সেই অধিকার লোপ পেতে সময় লাগে মাত্র দুই (২) বৎসর। বিষয়টি আরও পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করা যায় যে, যার বিরুদ্ধে এ দাবি করা হয় তা যদি সরকারের হয় তবে ২০ বৎসরের স্থলে ৬০ বৎসর হতে হবে।

একটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি পরিষ্কার করা যেতে পারে। যেমন, রহিম মন্ডল দীর্ঘদিন যাবত অন্য ব্যক্তির জায়গায় গৃহ নির্মাণ করে বসবাস করছে বা তার প্রতিবেশী করিম প্রধানের বহির্বাটির একপাশ দিয়ে যাতায়াত করছে, গবাদিপশু নিয়ে মাঠে যাচ্ছে এবং ফসলাদি নিয়ে আসছে। প্রয়োজনবোধে মাঠের ফসল গরুর গাড়ি দ্বারা বা ভ্যান দ্বারা একই পথে আনা নেয়া করছে। এভাবে রহিম মন্ডল একাধিক্রমে সুদীর্ঘ ২০ বৎসর যাবত করিম প্রধানের বহির্বাটিই চিহিৃত অংশ নিজ অধিকারে শান্তিপূর্ণ ও প্রকাশ্যেভাবে নিজের চলাচলের পথ হিসেবে ব্যবহার করে আসতে থাকলে ২০ বৎসর পর তার রহিম মন্ডল এ গৃহে বসবাসের বা পথাধিকার অপ্রতিবোধ্য ব্যবহার সিদ্ধ অধিকার বলে গণ্য হবে।

পক্ষান্তরে ২০ বৎসর পর করিম প্রধান রহিম মন্ডলকে তার বহির্বাটির চিহিৃত অংশের উপর দিয়া চলাচল করতে নিষেধ করলে তামাদি আইনত তাহা অগ্রাহ্য হবে কিন্তু করিম প্রধান যদি গৃহ ভেঙে দখল বা বেড়া দিয়ে দুবৎসর পর্যন্ত পথ বন্ধ করে রাখে বা রাখতে পারে তবে রহিম মন্ডলের ২০ বৎসর অর্জিত পথাধিকার একাধিক্রমে দুই বৎসর বাধা প্রাপ্ত হওয়ায় নষ্ট হবে।

অতএব, যদি কেহ এভাবে অর্জিত ব্যবহার সিদ্ধ অধিকারে বাধা প্রাপ্ত হয় তবে তাকে বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার তারিখে থেকে ২ বৎসরের মধ্যে প্রতিকারের জন্য আদালতের আশ্রয় গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় তার দাবি তামাদি আইন দ্বারা বারিত হয়ে যাবে। এভাবে ২০ বৎসর যাবত একাধিক্রমে দখল ভোগজনিত কারণে অর্জিত অধিকারকে ব্যবহার সিদ্ধ অধিকার বলে।

সম্প্রতি হরিজন উচ্ছেদ প্রসঙ্গে প্রাপ্ত তথ্য উপাত্ত থেকে জানা যায় যে, রাজধানীর বংশালের আগাসাদেক রোডে মিরনজিল্লা কলোনির বাসিন্দা দলিত সম্প্রদায়। তারা মূলত পরিষ্কার পরিছন্নতার কর্মে নিয়োজিত। ব্রিটিশ সরকার ১৮৩৮-১৮৫০ এর দিকে তাদের ভারতের বিভিন্ন এলাকা থেকে এনে মিরনজিল্লায় বসবাস স্থাপন করে দেন এবং শহর, রেলস্টেশন, সরকারি অফিস আদালতে ঝাড়– দেয়া ও পরিষ্কার পরিছন্নতার কাজ দিয়েছিল, নামমাত্র বেতনে। ফলে তাদের সংসার কোন মতে চলত মাত্র। অর্থাৎ নুন আনতে পান্তা ফুরানোর ফলে তাদের নতুন প্রজন্ম লেখাপড়া শিক্ষা-দীক্ষায় আধুনিক সমাজের মানুষের মতো গড়ে উঠতে পারেনি। তারা মূলত শ্রেণীবৈষম্যের ও অস্পৃশ্যতার শিকার বৃহত্তম সমাজে অচ্ছুতে কারণে তাদের ওঠাবসা নেই বললেই চলে।

এসব দলিত জাতি হিন্দু সমাজের হলেও তাদের কিন্তু হিন্দু সমাজে গ্রহণযোগ্যতা নেই বললেই চলে। এসব অনগ্রসর জাতিকে বিভিন্ন পত্রপত্রিকার হরিজন বলে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। হরিজন নামটি দিয়েছিল মহনদাস করমচাঁদ গান্ধি ১৯৩৩ সালে সমাজের অস্পৃশ্য বলে বিবেচনা করা লোকজনদের হরিজন নামে নামকরণ করে।

হরিজন অর্থ হচ্ছে ‘হরি’ মানে ভগবান এবং ‘জন’ মানে বান্ধা। অর্থাৎ ভগবানের বান্ধা হচ্ছে হরিজন। বর্তমানে হরিজন শব্দ মর্যাদা হানিকর বলে মনে করা হয়। তাই অনেকে এ শব্দকে ব্যবহার করতে চান না। ড. বি আর আম্বেদকর হরিজন নামকরণের বিরোধিতা করেছিলেন।

মিরনজিল্লায় ৫০০ পরিবার বসবাস করে আসছে সেই ১৮৩৮-১৮৫০ সাল থেকে। এ হিসাব থেকে জানা যায় যে, তারা প্রায় দুশ বৎসরের মতো সময় ধরে সরকারের জ্ঞাতসারে বংশ পরমপরায় বসবাস করে আসছে। এ কলোনিতে গত ১১ জুন ২০২৪ তারিখে উচ্ছেদ কার্যক্রম শুরু হয়।

উচ্ছেদের পূর্বে এ কলোনিতে পানি, বিদু্যুৎ ও গ্যাসের লাইন কেটে দেয়া হয়। এরপর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন বুলডোজার দিয়ে প্রায় ৮০টি ঘর ভেঙে দিয়েছে। উচ্ছেদ আতঙ্কে দুজন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে, গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টাও করা হয়েছে। উচ্ছেদ হওয়া এসব মানুষ পরিবার পরিজন নিয়ে খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবনযাপন করছে। বর্তমানে বর্ষার সময় ঝড়-বৃষ্টি মাথার উপর থেকে ঝরে পড়ছে। অর্থাৎ অবর্ণনীয় কাহিনী। টেলিভিশনে, বিভিন্ন, পত্রপত্রিকায়, খবরটি ছাপানো হয়েছে এবং মহামান্য হাইকোর্টে একটি রিট ফাইল করা হয়েছে। মামলার অর্ডারে স্থিতিবস্থা বজায় রাখতে বলেছেন।

এ অবস্থায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে কোন কিছু অনগ্রসর দলিত জাতির উদ্দেশ্যে বলছেন না। সম্ভবত তারা মামলায় কনটেস্ট করবেন বলে মনে হচ্ছে। মামলাটি দীর্ঘদিন যদি চলে তাহলে দলিত জনগোষ্ঠীর সন্তানদের ভবিষ্যৎ কী হবে? খোলা জায়গায় পানি নাই, বিদ্যুৎ নাই, গ্যাস নাই, বাথরুম নাই। তারা কি স্কুলগামী হতে ঝরে পরবে না? এরকম আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।

আমরা সনিবর্ন্ধ অনুরোধ করব দলিত-বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর পাশে দেশের সমাজহিতৈষী, জ্ঞানী-গুণী সমাজকর্মী, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা, ডোনারদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়ানোর জন্য।

সরকার যে কোন জায়গা অধিগ্রহণ করতে পারে। তবে মসজিদের জায়গা, মন্দিরের জায়গা, শ্মশান ও কবরস্থানের জায়গা অধিগ্রহণ করতে পারে না।

হিউম্যান স্ট্যান্ডার মানে প্রত্যেক সরকারের একটি নির্দিষ্ট সীমা দেয়ার সময় আছে এবং এ সীমা সরকার অতিক্রম করতে পারে না। তবে উপরে ওঠার বিষয়ে কোন সীমা থাকবে না। যদি সরকার নি¤েœর সীমা অতিক্রম করে তা হলে তা মানবাধিকার লংঘনের সামিল হবে।

তাই অবশ্যই এই উচ্ছেদকৃত দলিতদের পুনর্বাসন করতে হবে। কাউকে পেছনে ফেলে উন্নয়ন নয়। ডিজিটাল ও স্মার্ট দেশ গড়তে সবাইকে সাথে নিয়ে এগোতে হবে। সরকার জনগণের ভোটে যেহেতু নির্বাচিত, তাই জনগণের মতামতের মূল্যায়ন অবশ্যই করতে হবে। বহু গৃহহীন মানুষ বাড়িঘর পাচ্ছে, তাহলে দলিতদের ঘর-বাড়ি ভেঙে গৃহহীন করা হচ্ছে কেন?

দেশে কেউ প্রজা নয়, সবাইই নাগরিক। ভোটের সময় তাদের প্রয়োজন অবশ্যই হয়। সেই বিবেচনায় ৬০ বৎসর সরকারি সম্পত্তি দখলের মাধ্যমে সম্পত্তির স্বত্ব অর্জিত হয় বৈকি?

জনগণের ২০ বৎসর আর সরকারি সম্পত্তির ক্ষেত্রে ৬০ বৎসর। উল্লেখ করা আবশ্যক যে, ১৯৭১ সালে জাতি, ধর্ম, বর্ণনির্বিশেষে দলিত জনগণ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল বলেই এদেশ স্বাধীন হয়েছিল। বহু মুক্তিযোদ্ধা হরিজন তথা দলিতদের মধ্যে রয়েছে।

[লেখক : আইনজীবী]

back to top