গোলসান আরা বেগম
মেক্সিকোর প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট ক্লদিয়া শিনবাউম
বিপুল ভোটে জিতে মেক্সিকোতে প্রথম একজন নারী প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। পৃথিবীর ইতিহাসে রেকর্ড সৃষ্টিকারী এই নারী প্রেসিডেন্ট হলেনÑ ক্লদিয়া শিনবাউম। তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীও ছিলেন একজন নারী। এদিকে দক্ষিণ কোরিয়ার জাতীয় পরিষদে রেকর্ড সংখ্যক নারী প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন। নারী জাতির জন্য এধরনের বহু সুসংবাদের বিপ্লব ঘটে যাচ্ছে বর্তমান গ্লোবাল বিশ্বে।
চরম প্রতিযোগিতা ও বিরূপ পরিবেশ মোকাবেলা করে বহু নারী প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে কৃতিত্বের সাথে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। গবেষণায় পাওয়া তথ্যে জানা যায়, টেকসই উন্নয়ন ও মানবাধিকার শক্তিশালীকরণে নারী নেতৃত্ব অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গবেষণায় এমনও দেখা যায় যে, নীতি-নির্ধারণে নারীর অনন্য অভিজ্ঞতা যুক্ত হলে সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মক্ষমতাও উন্নত হয় (তথ্য-দৈনিক প্রথম আলো, ১৩ জুন ২০২৪)। গ্লোবাল বিশ্বের সার্বিক উন্নয়নের প্রয়োজনে নারীর ক্ষমতায়ন, আরো নারী প্রসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী দরকার। আসুন ২০২৪ সালকে নতুন প্রজন্মের নারীদের নেতৃত্বে নিয়ে আসার একটি বছর হিসেবে গড়ে তুলি।
নারীরা যখন প্রতিযোগিতা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা মোকাবেলা করে পায়ের নিচে জোগাড় করছে শক্ত মাটির গাঁথন। ঠিক তখন নারীর জন্য দুঃসংবাদ হলোÑ নারীকে গৃহে আবদ্ধ করার বিভিন্ন পাঁয়তারা তেড়ে আসছে। কেউ কেউ যুক্তি দেখিয়ে বলছেÑ নারীকে চতুর্থ শ্রেণীর বেশি পড়াশোনা করানোর দরকার নাই। স্বামীর ঘরের ফার্নিচার মুছতে পারলে ও সংসারের খরচের টাকাপয়সার হিসাব রাখতে পারলেই যথেষ্ট। হাড়িপাতিলের আওয়াজে বিলিয়ে দেবে দৈনিকের রুটিন পুষি বিড়ালের মতো পায়ে পায়ে ঘুরে। কিছু কিছু অলস গ-মূর্খ তথা কথিত শিক্ষিত নারীরা বলছেÑ বাচ্চা সামলাবো না চাকরি করব। চাকরি করে কি হবে। তারা হয়তো বা ভালো বিয়ের জন্য পড়াশোনা করেছে। সরকার ও বাবার অর্থ ধ্বংস করে অর্জন করছে উচ্চশিক্ষার সনদ। তারা খাওয়া, সাজগোজ কারা, টিভি সিরিয়াল দেখা ও ঘুমানোকে প্রধান দায়িত্ব বলে মনে করে। এর বাহিরেও কতর্ব্য ও দায়িত্বের বিশাল জগৎ পড়ে আছে, তা বুঝার ক্ষমতা তাদের নেই। কোন কোন স্বামী বলছেÑ টাকার জোগান তো আমি দিচ্ছি, তুমি ঘর সামলাও। সন্তান মানুষ করো।
নারীবিদ্বেষীরা বলছে- নারীর চোখ, কান খুলে গেলে তাকে দাবিয়ে রাখা যাবে না। তাকে শোষণ বা শাসনও করা যাবে না। গৃহপালিত জীব হিসেবে খাঁচায় বন্দি রাখবে কিভাবে। ধর্মীয় অনুশাসনের ভয় দেখিয়ে উচ্চশিক্ষিত মেয়েদের চাকরি বিমুখ করা হচ্ছে। তাহলে মেয়েকে শিক্ষিত করার কী প্রয়োজন ছিলো। এই ধারা বাহিকতা বজায় থাকলে নারী শিক্ষা বাধাগ্রস্ত হবে। সেই কুয়ার ব্যাঙ হয়ে পিছিয়ে দিবে সব উন্নয়নগামী প্রবাহকে। তা কি বর্তমান সভ্যতা কামনা করে।
অথচ আমরা জানি কর্মজীবী নারীরা ঘর-বাহির সমান তালে সামলাচ্ছে। তাদের সন্তানরাও উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে। হচ্ছে সৎ, মানবতা জ্ঞানসম্পন্ন অতিশয় নমনীয়, সহনীয় সুনাগরিক।
কর্ম, ধর্ম, মানানসই আড্ডায়, নোবেল বিজয়, হিমালয় বিজয়, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প, সংস্কৃতি, রাষ্ট্র পরিচালনা, মহাশূন্যে গমন, যুদ্ধ পরিচালনা ইত্যাদি সব আঙ্গিকেই রয়েছে নারীর সফলতার স্বাক্ষর। তৃণমূল থেকে শুরু করে উচ্চ স্তরের নারীরাও প্রগতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে করছে বিচরন। নারীর উজ্জ্বল সফলতার অভাব নেই। ক্লান্তিহীন পরিশ্রম তারাও করতে পারে; কিন্তু তার কর্মের নেই কোন সামাজিক, রাষ্ট্রীয় বা অর্থনৈতিক স্বীকৃতি। অথচ বাংলাদেশ তার জাতীয় সংবিধানে নারীকে দিয়েছে সমঅধিকারের স্বীকৃতি। যদিও বাস্তবে তার কার্যকারিতা নেই। উত্তরাধিকারভাবে প্রাপ্ত সম্পত্তিতে নারীর সমঅংশদারিত্বের অধিকার নেই। এক্ষেত্রে শরিয়াহ আইনকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। নারীরা এ ব্যাপারে প্রতিনিয়ত অধিকারের লড়াই করে যাচ্ছে। কবে সে অধিকার পাবে তার নাই কোন ভরসা। তবে নারীর পদচারণা দেখে আমি আশাবাদী অচিরেই নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে।
এদিকে নারীর জন্য রাখা হয়েছে ভর্তি বা চাকরির ক্ষেত্রে সংরক্ষিত কোটা প্রথা। জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে স্থানীর সরকারে নির্বাচনিক পদে রেখেছে সংরক্ষিত নারী আসন। নারীর মুক্ত স্বাধীনসত্তা বিকাশোর জন্য, মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে এ সমস্ত কোটা ও সংরক্ষিত আসনের প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। বরং নারী পুরুষে সমধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিরাট অন্তরায়। যেখানে ৫২% নারীর বসবাস রয়েছে বাংলাদেশে, নারীও উন্নয়নের সব স্তরে রাখছে অবদান। দেশের যে কোন ক্রাইসিসে বিলিয়ে দিচ্ছে জীবন প্রাণ, হোক তা সংখ্যাগত দিক দিয়ে যৎসামান্য। সেক্ষেত্রে কেন নারীকে পেছনমুখী স্রোতে ঠেলে দেওয়ার নীলনকশা তৈরি করার পাঁয়তারা চলছে।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘এই বিশ্বের যা কিছু মহান চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধক নর’Ñ সেই পঙ্ক্তিমালাকে আসুন মেনে নেই। নারীও মানুষ। পৃথিবীর জয়ে-ক্ষয়ে রয়েছে নারীর হাতের ছোঁয়া ও অবদান। নারী-পুরুষ একে অপরের পরিপূরক। আসুনÑ নারীর জন্য সব সুসংবাদ মেনে নেই। দুঃসংবাদগুলো অপসারণ করার জন্য মানবীয় দৃষ্টিভঙ্গিকে করি সুপ্রসারিত। নারীর অগ্রযাত্রাকে এগিয়ে দিয়ে হই মানবিক।
[লেখক : সাবেক সিনেট সদস্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়]
গোলসান আরা বেগম
মেক্সিকোর প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট ক্লদিয়া শিনবাউম
সোমবার, ২৪ জুন ২০২৪
বিপুল ভোটে জিতে মেক্সিকোতে প্রথম একজন নারী প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। পৃথিবীর ইতিহাসে রেকর্ড সৃষ্টিকারী এই নারী প্রেসিডেন্ট হলেনÑ ক্লদিয়া শিনবাউম। তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীও ছিলেন একজন নারী। এদিকে দক্ষিণ কোরিয়ার জাতীয় পরিষদে রেকর্ড সংখ্যক নারী প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন। নারী জাতির জন্য এধরনের বহু সুসংবাদের বিপ্লব ঘটে যাচ্ছে বর্তমান গ্লোবাল বিশ্বে।
চরম প্রতিযোগিতা ও বিরূপ পরিবেশ মোকাবেলা করে বহু নারী প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে কৃতিত্বের সাথে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। গবেষণায় পাওয়া তথ্যে জানা যায়, টেকসই উন্নয়ন ও মানবাধিকার শক্তিশালীকরণে নারী নেতৃত্ব অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গবেষণায় এমনও দেখা যায় যে, নীতি-নির্ধারণে নারীর অনন্য অভিজ্ঞতা যুক্ত হলে সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মক্ষমতাও উন্নত হয় (তথ্য-দৈনিক প্রথম আলো, ১৩ জুন ২০২৪)। গ্লোবাল বিশ্বের সার্বিক উন্নয়নের প্রয়োজনে নারীর ক্ষমতায়ন, আরো নারী প্রসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী দরকার। আসুন ২০২৪ সালকে নতুন প্রজন্মের নারীদের নেতৃত্বে নিয়ে আসার একটি বছর হিসেবে গড়ে তুলি।
নারীরা যখন প্রতিযোগিতা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা মোকাবেলা করে পায়ের নিচে জোগাড় করছে শক্ত মাটির গাঁথন। ঠিক তখন নারীর জন্য দুঃসংবাদ হলোÑ নারীকে গৃহে আবদ্ধ করার বিভিন্ন পাঁয়তারা তেড়ে আসছে। কেউ কেউ যুক্তি দেখিয়ে বলছেÑ নারীকে চতুর্থ শ্রেণীর বেশি পড়াশোনা করানোর দরকার নাই। স্বামীর ঘরের ফার্নিচার মুছতে পারলে ও সংসারের খরচের টাকাপয়সার হিসাব রাখতে পারলেই যথেষ্ট। হাড়িপাতিলের আওয়াজে বিলিয়ে দেবে দৈনিকের রুটিন পুষি বিড়ালের মতো পায়ে পায়ে ঘুরে। কিছু কিছু অলস গ-মূর্খ তথা কথিত শিক্ষিত নারীরা বলছেÑ বাচ্চা সামলাবো না চাকরি করব। চাকরি করে কি হবে। তারা হয়তো বা ভালো বিয়ের জন্য পড়াশোনা করেছে। সরকার ও বাবার অর্থ ধ্বংস করে অর্জন করছে উচ্চশিক্ষার সনদ। তারা খাওয়া, সাজগোজ কারা, টিভি সিরিয়াল দেখা ও ঘুমানোকে প্রধান দায়িত্ব বলে মনে করে। এর বাহিরেও কতর্ব্য ও দায়িত্বের বিশাল জগৎ পড়ে আছে, তা বুঝার ক্ষমতা তাদের নেই। কোন কোন স্বামী বলছেÑ টাকার জোগান তো আমি দিচ্ছি, তুমি ঘর সামলাও। সন্তান মানুষ করো।
নারীবিদ্বেষীরা বলছে- নারীর চোখ, কান খুলে গেলে তাকে দাবিয়ে রাখা যাবে না। তাকে শোষণ বা শাসনও করা যাবে না। গৃহপালিত জীব হিসেবে খাঁচায় বন্দি রাখবে কিভাবে। ধর্মীয় অনুশাসনের ভয় দেখিয়ে উচ্চশিক্ষিত মেয়েদের চাকরি বিমুখ করা হচ্ছে। তাহলে মেয়েকে শিক্ষিত করার কী প্রয়োজন ছিলো। এই ধারা বাহিকতা বজায় থাকলে নারী শিক্ষা বাধাগ্রস্ত হবে। সেই কুয়ার ব্যাঙ হয়ে পিছিয়ে দিবে সব উন্নয়নগামী প্রবাহকে। তা কি বর্তমান সভ্যতা কামনা করে।
অথচ আমরা জানি কর্মজীবী নারীরা ঘর-বাহির সমান তালে সামলাচ্ছে। তাদের সন্তানরাও উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে। হচ্ছে সৎ, মানবতা জ্ঞানসম্পন্ন অতিশয় নমনীয়, সহনীয় সুনাগরিক।
কর্ম, ধর্ম, মানানসই আড্ডায়, নোবেল বিজয়, হিমালয় বিজয়, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প, সংস্কৃতি, রাষ্ট্র পরিচালনা, মহাশূন্যে গমন, যুদ্ধ পরিচালনা ইত্যাদি সব আঙ্গিকেই রয়েছে নারীর সফলতার স্বাক্ষর। তৃণমূল থেকে শুরু করে উচ্চ স্তরের নারীরাও প্রগতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে করছে বিচরন। নারীর উজ্জ্বল সফলতার অভাব নেই। ক্লান্তিহীন পরিশ্রম তারাও করতে পারে; কিন্তু তার কর্মের নেই কোন সামাজিক, রাষ্ট্রীয় বা অর্থনৈতিক স্বীকৃতি। অথচ বাংলাদেশ তার জাতীয় সংবিধানে নারীকে দিয়েছে সমঅধিকারের স্বীকৃতি। যদিও বাস্তবে তার কার্যকারিতা নেই। উত্তরাধিকারভাবে প্রাপ্ত সম্পত্তিতে নারীর সমঅংশদারিত্বের অধিকার নেই। এক্ষেত্রে শরিয়াহ আইনকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। নারীরা এ ব্যাপারে প্রতিনিয়ত অধিকারের লড়াই করে যাচ্ছে। কবে সে অধিকার পাবে তার নাই কোন ভরসা। তবে নারীর পদচারণা দেখে আমি আশাবাদী অচিরেই নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে।
এদিকে নারীর জন্য রাখা হয়েছে ভর্তি বা চাকরির ক্ষেত্রে সংরক্ষিত কোটা প্রথা। জাতীয় সংসদ থেকে শুরু করে স্থানীর সরকারে নির্বাচনিক পদে রেখেছে সংরক্ষিত নারী আসন। নারীর মুক্ত স্বাধীনসত্তা বিকাশোর জন্য, মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে এ সমস্ত কোটা ও সংরক্ষিত আসনের প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। বরং নারী পুরুষে সমধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিরাট অন্তরায়। যেখানে ৫২% নারীর বসবাস রয়েছে বাংলাদেশে, নারীও উন্নয়নের সব স্তরে রাখছে অবদান। দেশের যে কোন ক্রাইসিসে বিলিয়ে দিচ্ছে জীবন প্রাণ, হোক তা সংখ্যাগত দিক দিয়ে যৎসামান্য। সেক্ষেত্রে কেন নারীকে পেছনমুখী স্রোতে ঠেলে দেওয়ার নীলনকশা তৈরি করার পাঁয়তারা চলছে।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘এই বিশ্বের যা কিছু মহান চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধক নর’Ñ সেই পঙ্ক্তিমালাকে আসুন মেনে নেই। নারীও মানুষ। পৃথিবীর জয়ে-ক্ষয়ে রয়েছে নারীর হাতের ছোঁয়া ও অবদান। নারী-পুরুষ একে অপরের পরিপূরক। আসুনÑ নারীর জন্য সব সুসংবাদ মেনে নেই। দুঃসংবাদগুলো অপসারণ করার জন্য মানবীয় দৃষ্টিভঙ্গিকে করি সুপ্রসারিত। নারীর অগ্রযাত্রাকে এগিয়ে দিয়ে হই মানবিক।
[লেখক : সাবেক সিনেট সদস্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়]