alt

উপ-সম্পাদকীয়

বেঁটে নারকেল গাছ নিয়ে কিছু কথা

জীবন কৃষ্ণ বিশ্বাস

: সোমবার, ০১ জুলাই ২০২৪

ফল, জল এবং তেলÑ একের মধ্যে শুধু তিন নয়; নারকেল থেকে আরও অনেক কিছু পাওয়া যায় এবং এর অনেক রকমের ব্যবহার। বাংলাদেশে কমবেশি ৩৫ হাজার হেক্টর জমিতে ১০ কোটি নারকেল উৎপাদিত হয়। চাহিদা ৩৫ কোটি। অতএব আরও ২৫ কোটি নারকেল আমাদের বেশি উৎপাদন করতে হবে। কিন্তু উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়া তো দূরের কথা উল্টো কমে যাচ্ছে। এবং এই কমার প্রবণতা ২০১৬-১৭ থেকে লক্ষণীয়। সে বছর উৎপাদন ছিল ৬ লাখ ৮৮ হাজার টন। ২০২১-২২ সালে এই পরিমাণ কমে দাঁড়ায় ৫ লাখ ১০ হাজার টনে।

২০২২-২৩ সালে ছিল ৫ লাখ ছয় হাজার টন। চলতি বছরের উপাত্ত আমার হাতে আসেনি। আমার বিশ্বাস আরও কমে গেছে। অথচ এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। কারণ নারকেলের উৎপাদন বৃদ্ধির ব্যাপারের সরকারের বিশেষ নজরদারি আছে। তবে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নে শুরুতেই কোনো দুর্বলতা ছিল কিনা কে জানে! দেখা যায় যে শুধু বাইরে থেকে খাটো জাত এনেই দেশে চট-জলদি নারকেলের উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। সেখানে এ-সংক্রান্ত গবেষকদের তেমন সম্পৃক্ততা দেখছি না।

দেশে উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ আইন আছে। বাইরে থেকে আনা কোনো ফল বা ফসল গবেষণা ছাড়া মাঠে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে বিধিনিষেধ আছে। অথচ একটি প্রকল্পের মাধ্যমে প্রথমে ভারত; পরে ভিয়েতনাম থেকে সরাসরি খাটো জাতের নারকেলের চারা আমদানি করে কোনো প্রকার গবেষণা ছাড়াই মাঠে নিয়ে যাওয়া হয়। ভারতের জাতগুলো ছিল কেরালা ডোয়ার্ফÑ এগুলো সম্ভবত হাইব্রিড জাত ছিল। ভিয়েতনাম থেকে আনা জাতগুলোও খাটো জাতের। সব খাটো জাতগুলো তিন বছরের মধ্যে ফল দেবে বলে জানানো হয়।

২০১৩ থেকে শুরু করে কয়েক বছর ধরে প্রায় সাত-আট লাখ চারা বিতরণ করা হয়। কিছু ব্যতীক্রম ছাড়া সব গাছ লম্বা হয়ে গেছে। অধিকাংশ গাছে ফল নেই। কিছু ফল আসলেও কৃষকদের বক্তব্য মোতাবেক তিন বছর কেন ছয় বছরেও গাছগুলোতে ফুল আসেনি। অনেক ক্ষেত্রেই গাছ রোগাক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। আমদানিকৃত গাছে পোকামাকড়ের উপদ্রব বেড়ে যাওয়া এবং সময়মতো ফল না ধরায় অনেকেই তাদের বাগান কেটে ফেলেছেন। এ সমস্ত কারণেই একটি পর্যবেক্ষণ কমিটি করে দেয়া হয় পুরো প্রেক্ষাপটটি খতিয়ে দেখার জন্য। উক্ত কমিটিতে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞ বিজ্ঞানী এবং সম্প্রসারণবিদরা ছিলেন। তারা সরেজমিনে বিভিন্ন পরিবেশে স্থাপন করা খাটো নারকেলের বাগান এবং কৃষকের বাগানগুলো পরিদর্শন করে প্রতিবেদন জমা দেন। তাদের প্রতিবেদনে তারা যা বলতে চেয়েছেনÑ ভিয়েতনাম থেকে খাটো জাতের সিয়াম ব্লু এবং সিয়াম গ্রিন জাতের গাছে প্রচুর নারকেল ধরার কথা থাকলেও তেমনটি দেখা যায়নি। আড়াই থেকে তিন বছরের মধ্যে গাছে ফল ধরবে বলে জানানো হয়।

কিন্তু বাস্তবে সেটা হয়নি। বেশির ভাগ বাগানে চার বছরের গাছে পুষ্পমঞ্জুরী দেখা গেলেও সেগুলোতে নারকেল ধরেনি। তবে চার বছরের বেশি বয়সের কিছু গাছগুলোতে ফল দেখা যায় এবং বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফলের সংখ্যা বাড়তে দেখা যায়। তবে ফুল এবং ফল ঝরে যাওয়ার প্রবণতা প্রকট। এমনকি ডাব হওয়ার পরও একসময় ঝরে যেতে দেখা যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে একটি ফলও থাকে না। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ হলো গাছগুলো খাটো জাতের বলা হলেও কোনো গাছই খাটো জাতের নয়। গাছের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধির হার দেশি জাতগুলোর মতো বা ক্ষেত্র বিশেষে বেশি। প্রশ্ন উঠেছে আমদানিকৃত গাছগুলোর বিশুদ্ধতা নিয়েও।

আড়াই বছরে গাছে ফল ধরে এমন ভুল তথ্য প্রচার করে একধরনের ব্যবসায়ী নিজেরা প্রচুর লাভবান হয়েছে। কিন্তু চাষির কোনো লাভ হয়নি। এদের রোগবালাই- পোকামাকড়ের আক্রমণ দেশি জাতের তুলনায় বেশি। নতুন কিছু পোকামাকড়ের উপদ্রবও দেখা গেছে। এগুলোর পরিচর্যার খরচ বেশি। এই পর্যবেক্ষণের আগেই বাংলাদেশে কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকবৃন্দ এই জাতীয় নারকেলের সঙ্গে সম্পর্কিত একটি ভয়ানক খবর দিয়েছিলেন। তারা জানিয়েছিলেন যে এ ধরনের খাটো জাতের নারকেল গাছ আমদানির সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশে একধরনের সাদা মাছির উপদ্রব মারাত্মভাবে বেড়ে গেছে।

এমনকি সাম্প্রতিককালে নারকেল উৎপাদন কমে যাওয়ার মূল কারণ হিসেবে তারা এই সাদা মাছিকে দায়ী করেছেন। এই মাছি গাছের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ দুইভাবে ক্ষতি করে থাকে। যেমন পাতার রস খেয়ে গাছকে দুর্বল করে দেয়। ফলে গাছের নিজের খাদ্য তৈরির ক্ষমতা দারুণভাবে কমে যায়। এই পোকার শরীর থেকে একধরনের মধুর মতো মিষ্টি দ্রব্য নিঃসরণের ফলে পাতার উপর একধরনের ছত্রাকজনিত কালো পর্দা তৈরি হয়। এতেও গাছের খাদ্য তৈরির ক্ষমতা কমে যায়। ফলে গাছ শুধু তার সজীবতা হারায় না, অনেক ক্ষেত্রে মারাও যায়। আরও খারাপ খবর হলো এই মাছিটি শুধু নারকেল গাছের মধ্যেই সীমবদ্ধ নেই। কলা, পেয়ারা, আম, জাম, শিম, মরিচ, কচু, চা, কফি, সয়াবিন, সুপারিসহ কমবেশি ৬১ প্রজাতির গাছকে আক্রমণ করতে পারে।

যাই হোক পর্যবেক্ষণ কমিটির সুপারিশ হলোÑ ভিয়েতনামের খাটো জাতের নারকেল বাগান করে কৃষক এবং উদ্যোক্তা দুজনেই ঠকেছেন। তাদের ভাষায় একটা নিভৃত পরিবেশে আলাদাভাবে ব্যাপক গবেষণা করার পরই এ ধরনের খাটোজাত আমদানির অনুমতি দেয়া উচিত। তবে সিয়াম ব্লু বা গ্রিন জাতের নারকেল আর নয়। পাশাপাশি কায়ক্লেশে টিকে থাকা এ ধরনে বাগান থেকে পাওয়া নারকেল থেকে চারা উৎপাদন ও সম্প্রসারণ বন্ধ করার কথাও বলেছেন।

যাই হোক এই উপর্যুক্ত পর্যবেক্ষণের একটা দুর্বলতা ছিল। তারা ভারত থেকে আমদানিকৃত কেরালা হাইব্রিড জাতের নারকেলের বিষয়ে কিছু বলেননি। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছিÑ এই জাতটির অবস্থাও সংগীন। আর হাইব্রিড হওয়ায় অতিরিক্ত কিছু বিষয় বিবেচনায় আনার দরকার ছিল। কৃষি সম্প্রসারণের অধীনে রোপণ করা এই জাতের কিছু ভালো খবর এবং ফলবতী গাছের ছবি আমি সামাজিক মাধ্যমে দেখেছি। তাহলে কি তড়িঘড়ি করে আমদানি করা বীজের মধ্যে সমস্যা ছিল!

হাইব্রিডের প্রথম প্রজন্মের বীজের সঙ্গে অন্য বীজ চলে এসেছে কিনা। যাই হোক খাটো জাতের নারকেল গাছের এহেন পরিণতি নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার কাছে একবার বিষয়টি জানার চেষ্টা করেছিলাম। তিনি একবাক্যে বলেছিলেন যে আবাদ ব্যবস্থাপনায় খুবই সতর্ক হতে হবে। তাহলে

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটে রোপণ করা খাটো জাতের নারকেল গাছগুলো দুরবস্থার শিকার কেন। সেগুলো আমার তদারকিতেই রোপণ করা হয়েছিল। পরিচর্যার খামতি ছিল না।

তার মানে পরিচর্যা বিষয়ে আরও দক্ষ হতে হবে! একসময় আমি তাদের নারকেলের পরিচর্যা সম্পর্কিত পুস্তিকাটি দেখেছিলাম। সেখানে প্রতি মাসে যেভাবে পরিচর্যার কথা বলা হয়েছে সেটা মোটেই কৃষকবান্ধব নয়।

আর কীভাবে সেই পরিচর্যা পদ্ধতিগুলো ঠিক করা হয়েছে সেটাও কতটা লাগসই কে জানে। শেষ কথা। দেশে সঙ্গনিরোধ আইন আছে। কিন্তু সেটার প্রয়োগ নিয়ে কথা হয়। কারণ সেটাকে পাশ কাটিয়ে, গবেষকদের পাশ কাটিয়ে কীভাবে এই নারকেলের জাতগুলো দেশে আমদানি করা হয়েছিল সেটা আমার মাথায় আসে না। আমাদের এদিকে একটু নজর দেয়া দরকার। নইলে যে ক্ষতি হয়ে গেছে তার

থেকেও বড় ক্ষতি মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। কারণ এটা শুধু নারকেল নয় অন্য ফল, ফসলের বেলায়ও হতে পারে।

[লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট; সাবেক নির্বাহী পরিচালক, কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন]

রাসেলস ভাইপার : আতঙ্ক নয়, প্রয়োজন সচেতনতা

ব্যাংকিং সেক্টরের অনিয়ম দেশের অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করছে

হুমকিতে সমুদ্র, ঝুঁকিতে উন্নয়নশীল দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী

পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থকে কি জলাঞ্জলি দিয়েছে মোদি প্রশাসন

বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ : আইন কী বলে

হাজার টাকার বাগান খাইল পাঁচ সিকার ছাগলে

বাংলাদেশের উন্নতিতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর লজ্জা

মাদকমুক্ত দেশ গড়তে প্রয়োজন প্রতিরোধ কার্যক্রম

রম্যগদ্য : ‘ন্যায়-অন্যায় জানি নে, জানি নে...’

ছবি

কুরবানির ছাগল তাকে চিনতে পেরেছে

ছবি

সুইডিশ মিডসামার : এক আনন্দময় দিনের সূচনা

ছবি

আধুনিক রূপকথা এবং আমাদের রাজাদের গল্প

গাছে গাছে সবুজ হোক দেশ

কত বিষে আমাদের বসবাস

ছবি

তিস্তার দুই নয়নে দুই অশ্রুধারা

বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ান

আদিবাসীরা বৈষম্যের শিকার

ছবি

নারীর অগ্রযাত্রা

ছবি

সিলেট-সুনামগঞ্জের ‘জলাবদ্ধ বন্যার’ দায় কার?

ছবি

বুড়িতিস্তা রিজার্ভার খনন : কৃষক কি উপকৃত হবে?

সেন্টমার্টিন দ্বীপ নিয়ে কী হচ্ছে?

উচ্ছেদকৃত দলিতদের পুনর্বাসন করুন

রম্যগদ্য : অভিযোগ ‘অভিযোগ’ নয়

কেন হেরে গেলেন সেলিম

নীরবে-নিভৃতে কাজ করা এক কৃষিবিজ্ঞানীর কথা

অর্থনীতি কী অবস্থায় আছে?

কোরবানির চামড়ার হকদার

যোগাযোগ অধ্যয়ন কেন গুরুত্বপূর্ণ

এমপি আনারকে নিয়ে যত আইনি জটিলতা

অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও আইনের শাসন

দূর হোক মনের পশুত্ব

মনের পশুত্বের প্রতীকী ত্যাগের আরেক নাম কোরবানি

ঈদে সুস্থ খাদ্যাভ্যাস

এমআইটি : প্রযুক্তির সৃষ্টি রহস্যের খোঁজ

কবিগুরুর বাণী ‘প্রমাণিত মিথ্যা’

কিশোর গ্যাং কালচার বন্ধ হবে কিভাবে

tab

উপ-সম্পাদকীয়

বেঁটে নারকেল গাছ নিয়ে কিছু কথা

জীবন কৃষ্ণ বিশ্বাস

সোমবার, ০১ জুলাই ২০২৪

ফল, জল এবং তেলÑ একের মধ্যে শুধু তিন নয়; নারকেল থেকে আরও অনেক কিছু পাওয়া যায় এবং এর অনেক রকমের ব্যবহার। বাংলাদেশে কমবেশি ৩৫ হাজার হেক্টর জমিতে ১০ কোটি নারকেল উৎপাদিত হয়। চাহিদা ৩৫ কোটি। অতএব আরও ২৫ কোটি নারকেল আমাদের বেশি উৎপাদন করতে হবে। কিন্তু উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়া তো দূরের কথা উল্টো কমে যাচ্ছে। এবং এই কমার প্রবণতা ২০১৬-১৭ থেকে লক্ষণীয়। সে বছর উৎপাদন ছিল ৬ লাখ ৮৮ হাজার টন। ২০২১-২২ সালে এই পরিমাণ কমে দাঁড়ায় ৫ লাখ ১০ হাজার টনে।

২০২২-২৩ সালে ছিল ৫ লাখ ছয় হাজার টন। চলতি বছরের উপাত্ত আমার হাতে আসেনি। আমার বিশ্বাস আরও কমে গেছে। অথচ এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। কারণ নারকেলের উৎপাদন বৃদ্ধির ব্যাপারের সরকারের বিশেষ নজরদারি আছে। তবে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নে শুরুতেই কোনো দুর্বলতা ছিল কিনা কে জানে! দেখা যায় যে শুধু বাইরে থেকে খাটো জাত এনেই দেশে চট-জলদি নারকেলের উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। সেখানে এ-সংক্রান্ত গবেষকদের তেমন সম্পৃক্ততা দেখছি না।

দেশে উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ আইন আছে। বাইরে থেকে আনা কোনো ফল বা ফসল গবেষণা ছাড়া মাঠে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে বিধিনিষেধ আছে। অথচ একটি প্রকল্পের মাধ্যমে প্রথমে ভারত; পরে ভিয়েতনাম থেকে সরাসরি খাটো জাতের নারকেলের চারা আমদানি করে কোনো প্রকার গবেষণা ছাড়াই মাঠে নিয়ে যাওয়া হয়। ভারতের জাতগুলো ছিল কেরালা ডোয়ার্ফÑ এগুলো সম্ভবত হাইব্রিড জাত ছিল। ভিয়েতনাম থেকে আনা জাতগুলোও খাটো জাতের। সব খাটো জাতগুলো তিন বছরের মধ্যে ফল দেবে বলে জানানো হয়।

২০১৩ থেকে শুরু করে কয়েক বছর ধরে প্রায় সাত-আট লাখ চারা বিতরণ করা হয়। কিছু ব্যতীক্রম ছাড়া সব গাছ লম্বা হয়ে গেছে। অধিকাংশ গাছে ফল নেই। কিছু ফল আসলেও কৃষকদের বক্তব্য মোতাবেক তিন বছর কেন ছয় বছরেও গাছগুলোতে ফুল আসেনি। অনেক ক্ষেত্রেই গাছ রোগাক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। আমদানিকৃত গাছে পোকামাকড়ের উপদ্রব বেড়ে যাওয়া এবং সময়মতো ফল না ধরায় অনেকেই তাদের বাগান কেটে ফেলেছেন। এ সমস্ত কারণেই একটি পর্যবেক্ষণ কমিটি করে দেয়া হয় পুরো প্রেক্ষাপটটি খতিয়ে দেখার জন্য। উক্ত কমিটিতে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞ বিজ্ঞানী এবং সম্প্রসারণবিদরা ছিলেন। তারা সরেজমিনে বিভিন্ন পরিবেশে স্থাপন করা খাটো নারকেলের বাগান এবং কৃষকের বাগানগুলো পরিদর্শন করে প্রতিবেদন জমা দেন। তাদের প্রতিবেদনে তারা যা বলতে চেয়েছেনÑ ভিয়েতনাম থেকে খাটো জাতের সিয়াম ব্লু এবং সিয়াম গ্রিন জাতের গাছে প্রচুর নারকেল ধরার কথা থাকলেও তেমনটি দেখা যায়নি। আড়াই থেকে তিন বছরের মধ্যে গাছে ফল ধরবে বলে জানানো হয়।

কিন্তু বাস্তবে সেটা হয়নি। বেশির ভাগ বাগানে চার বছরের গাছে পুষ্পমঞ্জুরী দেখা গেলেও সেগুলোতে নারকেল ধরেনি। তবে চার বছরের বেশি বয়সের কিছু গাছগুলোতে ফল দেখা যায় এবং বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফলের সংখ্যা বাড়তে দেখা যায়। তবে ফুল এবং ফল ঝরে যাওয়ার প্রবণতা প্রকট। এমনকি ডাব হওয়ার পরও একসময় ঝরে যেতে দেখা যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে একটি ফলও থাকে না। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ হলো গাছগুলো খাটো জাতের বলা হলেও কোনো গাছই খাটো জাতের নয়। গাছের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধির হার দেশি জাতগুলোর মতো বা ক্ষেত্র বিশেষে বেশি। প্রশ্ন উঠেছে আমদানিকৃত গাছগুলোর বিশুদ্ধতা নিয়েও।

আড়াই বছরে গাছে ফল ধরে এমন ভুল তথ্য প্রচার করে একধরনের ব্যবসায়ী নিজেরা প্রচুর লাভবান হয়েছে। কিন্তু চাষির কোনো লাভ হয়নি। এদের রোগবালাই- পোকামাকড়ের আক্রমণ দেশি জাতের তুলনায় বেশি। নতুন কিছু পোকামাকড়ের উপদ্রবও দেখা গেছে। এগুলোর পরিচর্যার খরচ বেশি। এই পর্যবেক্ষণের আগেই বাংলাদেশে কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকবৃন্দ এই জাতীয় নারকেলের সঙ্গে সম্পর্কিত একটি ভয়ানক খবর দিয়েছিলেন। তারা জানিয়েছিলেন যে এ ধরনের খাটো জাতের নারকেল গাছ আমদানির সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশে একধরনের সাদা মাছির উপদ্রব মারাত্মভাবে বেড়ে গেছে।

এমনকি সাম্প্রতিককালে নারকেল উৎপাদন কমে যাওয়ার মূল কারণ হিসেবে তারা এই সাদা মাছিকে দায়ী করেছেন। এই মাছি গাছের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ দুইভাবে ক্ষতি করে থাকে। যেমন পাতার রস খেয়ে গাছকে দুর্বল করে দেয়। ফলে গাছের নিজের খাদ্য তৈরির ক্ষমতা দারুণভাবে কমে যায়। এই পোকার শরীর থেকে একধরনের মধুর মতো মিষ্টি দ্রব্য নিঃসরণের ফলে পাতার উপর একধরনের ছত্রাকজনিত কালো পর্দা তৈরি হয়। এতেও গাছের খাদ্য তৈরির ক্ষমতা কমে যায়। ফলে গাছ শুধু তার সজীবতা হারায় না, অনেক ক্ষেত্রে মারাও যায়। আরও খারাপ খবর হলো এই মাছিটি শুধু নারকেল গাছের মধ্যেই সীমবদ্ধ নেই। কলা, পেয়ারা, আম, জাম, শিম, মরিচ, কচু, চা, কফি, সয়াবিন, সুপারিসহ কমবেশি ৬১ প্রজাতির গাছকে আক্রমণ করতে পারে।

যাই হোক পর্যবেক্ষণ কমিটির সুপারিশ হলোÑ ভিয়েতনামের খাটো জাতের নারকেল বাগান করে কৃষক এবং উদ্যোক্তা দুজনেই ঠকেছেন। তাদের ভাষায় একটা নিভৃত পরিবেশে আলাদাভাবে ব্যাপক গবেষণা করার পরই এ ধরনের খাটোজাত আমদানির অনুমতি দেয়া উচিত। তবে সিয়াম ব্লু বা গ্রিন জাতের নারকেল আর নয়। পাশাপাশি কায়ক্লেশে টিকে থাকা এ ধরনে বাগান থেকে পাওয়া নারকেল থেকে চারা উৎপাদন ও সম্প্রসারণ বন্ধ করার কথাও বলেছেন।

যাই হোক এই উপর্যুক্ত পর্যবেক্ষণের একটা দুর্বলতা ছিল। তারা ভারত থেকে আমদানিকৃত কেরালা হাইব্রিড জাতের নারকেলের বিষয়ে কিছু বলেননি। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছিÑ এই জাতটির অবস্থাও সংগীন। আর হাইব্রিড হওয়ায় অতিরিক্ত কিছু বিষয় বিবেচনায় আনার দরকার ছিল। কৃষি সম্প্রসারণের অধীনে রোপণ করা এই জাতের কিছু ভালো খবর এবং ফলবতী গাছের ছবি আমি সামাজিক মাধ্যমে দেখেছি। তাহলে কি তড়িঘড়ি করে আমদানি করা বীজের মধ্যে সমস্যা ছিল!

হাইব্রিডের প্রথম প্রজন্মের বীজের সঙ্গে অন্য বীজ চলে এসেছে কিনা। যাই হোক খাটো জাতের নারকেল গাছের এহেন পরিণতি নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার কাছে একবার বিষয়টি জানার চেষ্টা করেছিলাম। তিনি একবাক্যে বলেছিলেন যে আবাদ ব্যবস্থাপনায় খুবই সতর্ক হতে হবে। তাহলে

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটে রোপণ করা খাটো জাতের নারকেল গাছগুলো দুরবস্থার শিকার কেন। সেগুলো আমার তদারকিতেই রোপণ করা হয়েছিল। পরিচর্যার খামতি ছিল না।

তার মানে পরিচর্যা বিষয়ে আরও দক্ষ হতে হবে! একসময় আমি তাদের নারকেলের পরিচর্যা সম্পর্কিত পুস্তিকাটি দেখেছিলাম। সেখানে প্রতি মাসে যেভাবে পরিচর্যার কথা বলা হয়েছে সেটা মোটেই কৃষকবান্ধব নয়।

আর কীভাবে সেই পরিচর্যা পদ্ধতিগুলো ঠিক করা হয়েছে সেটাও কতটা লাগসই কে জানে। শেষ কথা। দেশে সঙ্গনিরোধ আইন আছে। কিন্তু সেটার প্রয়োগ নিয়ে কথা হয়। কারণ সেটাকে পাশ কাটিয়ে, গবেষকদের পাশ কাটিয়ে কীভাবে এই নারকেলের জাতগুলো দেশে আমদানি করা হয়েছিল সেটা আমার মাথায় আসে না। আমাদের এদিকে একটু নজর দেয়া দরকার। নইলে যে ক্ষতি হয়ে গেছে তার

থেকেও বড় ক্ষতি মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। কারণ এটা শুধু নারকেল নয় অন্য ফল, ফসলের বেলায়ও হতে পারে।

[লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট; সাবেক নির্বাহী পরিচালক, কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন]

back to top