alt

উপ-সম্পাদকীয়

ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ও বাস্তবতা

আবু আফজাল সালেহ

: বুধবার, ২৪ জুলাই ২০২৪

নদীমাতৃক বাংলাদেশ পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ। তিনটি প্রধান নদী পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদীবাহিত পলিমাটি দ্বারা গঠিত দ্রুত বর্ধনশীল এই ব-দ্বীপ অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে নদীর গুরুত্ব অপরিসীম। নদী ও তার প্লাবন ভূমি এদেশের ৮০ শতাংশ এলাকার মানুষের জীবন-জীবিকা ও অর্থনীতির নিয়ামক শক্তি। দেশটির নদী জীবন, জীবিকা, অর্থনীতিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করছে। একদিকে বর্ষাকালে প্রচুর পানি ও পলি নদীগুলো দিয়ে বঙ্গোপসাগরে ধাবিত হয় এবং অসংখ্য চরের সৃষ্টি করে, অন্যদিকে শুষ্ক মৌসুমে প্রয়োজনীয় পানি পাওয়া যায়। ব-দ্বীপ অধিবাসীদের বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, নদীভাঙন, পানিদূষণের মতো হুমকি মোকাবিলা করতে হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ২০৫০ সালে দেশটির ১৪% এলাকা নিমজ্জিত হবে বলে আগাম ধারণা দিয়েছে পরিবেশ সংশ্লিষ্টরা। এর নেতিবাচক প্রভাবে ৩০ মিলিয়ন লোক জলবায়ু শরণার্থীতে পরিণত হবে।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাপমাত্রা বৃদ্ধি, অতিবৃষ্টি, বন্যা, খরা, নদীভাঙন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। গঙ্গা অববাহিকায় অবস্থিত বাংলাদেশ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ছে। কখনো অসময়ে প্রবল বৃষ্টি আর বর্ষাকালে অনাবৃষ্টি দেখা দেয়। উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততার কারণে সুপেয় পানির অভাব, শস্য কমে যাওয়া, নদীভাঙন, ফসলহানি ইত্যাদি হচ্ছে। প্রায় প্রতি বছর বিপুলসংখ্যক লোক গৃহহীন হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের জন্য পানিস¤পদ ব্যবস্থাপনা এক বিশাল চ্যালেঞ্জ। শুধু নদীখনন আর বন্দর উন্নয়ন করলে পরিকল্পনার মূল কাজে অনেক পিছিয়ে পড়তে হবে।

এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতেই অতি সম্প্রতি একটি মহাপরিকল্পনা গ্রহণ ও পাস করা হয়েছে। এই পরিকল্পনায় বন্যা, নদীভাঙন, নদীশাসন, নদী ব্যবস্থাপনা, নগর ও গ্রামে পানি সরবরাহ এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, নগর বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনায় দীর্ঘমেয়াদি কৌশল নির্ধারণ করা হয়েছে। এটি ব-দ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০ বা ডেল্টা প্লান-২১০০ নামে পরিচিতি পাচ্ছে। এটি ১০০ বছরের পরিকল্পনা। আপাতত ২০৩০ সাল নাগাদ ৮০টি পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এতে খরচ হবে ৩ হাজার ৭০০ কোটি ডলার। বর্তমান বাজার ধরে টাকার অঙ্কে এর পরিমাণ ৩ লাখ কোটি টাকার বেশি।

ব-দ্বীপ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে ২০৩০ সালের মধ্যে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) বাড়তি দেড় শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে। ১০০ বছরে পানিস¤পদ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে উন্নয়ন পরিকল্পনা এটি।

ব-দ্বীপ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ছয়টি এলাকাকে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। এগুলো হলো উপকূলীয় অঞ্চল, বরেন্দ্র ও খরাপ্রবণ অঞ্চল, হাওর ও আকস্মিক বন্যাপ্রবণ এলাকা, পার্বত্য চট্টগ্রাম, নদীবিধৌত অঞ্চল ও নগর এলাকা। এছাড়া ব-দ্বীপ পরিকল্পনায় বৃহৎ পরিসরে তিনটি লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। সেগুলো হলো ২০৩০ সালের মধ্যে চরম দারিদ্র্য দূর করা, ২০৩০ সালের মধ্যে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করা এবং ২০৪১ সালের মধ্যে সমৃদ্ধ দেশের মর্যাদা অর্জন। বদ্বীপ পরিকল্পনা হলো দীর্ঘমেয়াদি, একক এবং সমন্বিত পানিস¤পদ ব্যবস্থাপনা। দীর্ঘমেয়াদি বলতে পরিকল্পনার লক্ষ্য ২১০০। একক হলো দেশের সব পরিকল্পনার আন্তঃযোগাযোগের মাধ্যমে একক ডেল্টা। সমন্বিত বলতে পানি স¤পর্কিত সকল খাতকে একটি পরিকল্পনায় নিয়ে আসা। ব-দ্বীপ পরিকল্পনা কৌশল সমূহের টেকসই উন্নয়নের মাধ্যমে ডেল্টা ভিশনে পৌঁছাতে সাহায্য করে। সমন্বিত দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় বন্যা ও জলবায়ু পরিবর্তন-স¤পর্কিত বিপর্যয় থেকে নিরাপত্তা নিশ্চিত, পানি ব্যবহারে অধিকতর দক্ষতা আনয়ন, সমন্বিত ও টেকসই নদী এবং নদী মোহনা ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা, জলাভূমি ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং তাদের যথোপযুক্ত ব্যবহার নিশ্চিত, আন্তঃ ও আন্তঃদেশীয় পানিস¤পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য কার্যকর প্রতিষ্ঠান ও ন্যায়সঙ্গত সুশাসন গড়ে তোলা এবং ভূমি ও পানিস¤পদের সর্বোত্তম সমন্বিত ব্যবহার নিশ্চিত করার বিষয়গুলো বর্তমান আর্থ-সামাজিক বাস্তবতায় সর্বাধিক গুরুত্বের দাবিদার।

বাংলাদেশে ইতোপূর্বে খাতভিত্তিক স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোÑ ইন্টারন্যাশনাল ইঞ্জিনিয়ারিং কো¤পানি কর্তৃক ‘মাস্টার প্ল্যান ১৯৬৪’, ‘ন্যাশনাল ওয়াটার প্ল্যান ১৯৮৬, ন্যাশনাল ওয়াটার প্ল্যান ১৯৯২, ফ্লাড অ্যাকশন প্ল্যান ১৯৯২,ন্যাশনাল ওয়াটার পলিসি ১৯৯৯’ ন্যাশনাল ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান ২০০৪, হাওড় এলাকার মাস্টার প্ল্যান ২০১০, বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের কৃষি উন্নয়নের মাস্টার প্ল্যান ২০১৩’ এবং সাম্প্রতিক সময়ে প্রণীত ‘বাংলাদেশের বৃহৎ নগরী, শহর ও ছোট শহরগুলোর মাস্টার প্ল্যান’, বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তন কৌশল ও অ্যাকশন প্ল্যান, পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন প্ল্যান ২০১১-২৫ ইত্যাদি। এসব পরিকল্পনার অধিকাংশই একক খাতভিত্তিক হওয়ার কারণে এর সুফল সংশ্লিষ্ট সেক্টরগুলো পেয়ে থাকলেও অন্য খাতে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া কিংবা চাহিদা বিবেচনায় নেয়া হয়নি।

বাংলাদেশের অর্থনীতি দ্রুত বর্ধনশীল। ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়া, স্থিতিশীল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন ও প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পানি ব্যবস্থাপনা, খাদ্য নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান, প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা করার চ্যালেঞ্জ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর এজন্যই কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা, মৎস্য, শিল্প, বনায়ন, পানি ব্যবস্থাপনা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, স্যানিটেশনসহ সব খাত বিবেচনায় রেখে সমন্বিত দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ একান্ত জরুরি ছিল। ব-দ্বীপ পরিকল্পনায় অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে দেশের উন্নয়ন প্রাধিকারগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাব হ্রাস ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বিবেচনায় রেখে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ পরিকল্পনা তৈরি করা হবে। যেকোনো দীর্ঘমেয়াদি মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা, সুশাসন ও সহায়ক কার্যকর প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো তৈরি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০তে এ বিষয়গুলোকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে সংশ্লিষ্ট সব অংশীজনের প্রতিনিধিত্ব ও সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জগুলোকে স্থানীয় মৎস্য ও কৃষিজীবী মানুষের জীবনধারার সঙ্গে সমন্বয় করার প্ল্যান করতে হবে। উপকূলীয় ভৌত অবকাঠামো নির্মাণে বিশেষ নজর দিতে হবে। শহর রক্ষা বাঁধ, সড়ক, রাস্তা, বাজার, আবাসন, স্যানিটেশন, স্কুল, বিদ্যুৎ, জ্বালানির টেকসই পরিকল্পনা ইত্যাদি বিষয়ে কঠোর হতে হবে। লবণাক্ততা সহনীয় কৃষি ফসল, সার বীজ ব্যবস্থাপনা নিয়ে আরও ভাবতে হবে এবং শহর রক্ষা, ড্যাম, বন্য নিয়ন্ত্রণের জন্য ইনফ্রাস্ট্রাকচারাল কাজগুলোতে কিভাবে রিনিউএবল এনার্জি সোর্সের সমন্বয় আনতে হবে। উপকূলীয় মানুষের জ্বালানি চাহিদাগুলো মিটানো যায়! সুন্দরবনে জীবিকা নির্বাহী লোকদের বিকল্প কর্মসংস্থানের পরিকল্পনা করতে হবে। বর্ষায় ভারত বড় বড় আন্তর্জাতিক নদীগুলোর উজানে দেয়া বাঁধের সøুইস গেট ছেড়ে দিয়ে অতি স্বল্প সময়ে ফ্ল্যাশ ফ্ল্যাড তৈরি করে, দীর্ঘস্থায়ী বন্যা পরিস্থিতি তৈরি করে কিংবা বিদ্যমান বন্যা পরিস্থিতির চরম অবনতি করে। ডেল্টা প্ল্যানে এই মৌসুমী বৃষ্টিপাত এবং ভারতের ছেড়ে দেয়া পানির প্রবাহকে কিভাবে সমন্বিত করে দেশের বর্ষাকালীন ফলন এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা ঠিক রাখা যাবে সেগুলো গুরুত্ব দিতে হবে। অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষ ও প্রাণীর জীবন-জীবিকা, পরিবেশ ও প্রতিবেশের গুরুত্ব দিতে হবে। এগুলো আছে এ মহাপরিকল্পনায়। তবে সরকারকে কঠোরভাবে তদারকি করতে হবে।

নদীমাতৃক বাংলাদেশের প্রকৃতি, জনজীবন, চাষাবাদ প্রায় সবই নদীনির্ভর। তাই বলা হয়, নদী না বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে না। অর্থাৎ বাংলাদেশের জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে। অথচ বাংলাদেশ সে পথেই এগিয়ে চলেছে। অনেক নদী এর মধ্যেই মরে গেছে। অনেক নদী মৃত্যুর পথে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ৫৪টি অভিন্ন নদী রয়েছে। নদীগুলো ভারত থেকে শুরু হয়ে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়েছে। উজানে ভারতের অংশে নদীগুলোর পানি প্রবাহের গতিরোধ করা হলে কিংবা পানি প্রত্যাহার করে নিলে নদীগুলোর বাংলাদেশ অংশে পানি প্রবাহ কমে যায়। নদী শুকিয়ে যায়। বেশি করে পলি জমে ও চর জাগে। তাতে চাষাবাদ ব্যাহত হয়। বন্ধ হয়ে যায় নৌপরিবহন। ক্রমেই নিচে নেমে যায় পানির স্তর। শুরু হয় মরুকরণ প্রক্রিয়া। কারণ বর্ষায় যত পানি বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়ে, তার ৯৫ শতাংশই আসে উজানে থাকা ভারতীয় অঞ্চল থেকে ঢলের আকারে। নদীগুলোর গভীরতা কমে যাওয়ায় তখন বন্যা ও জলাবদ্ধতা অবধারিত হয়ে পড়ে। নষ্ট হয় হাজার হাজার কোটি টাকার ফসল।

তাই বলা যায়- বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০ গুরুত্বপূর্ণ মহাপরিকল্পনা; যা সমন্বিত, সর্বজনীন ও বাস্তবতার নিরিখে সময়ের সঙ্গে পরিবর্তনশীল। দেশের স্থিতিশীল আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এটি হবে ভবিষ্যতের কার্যকরী দীর্ঘমেয়াদি গাইডলাইন। জাতিসংঘ প্রণীত টেকসই উন্নয়নের সতেরোটি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের উদ্দেশ্যে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করতে হলে ব-দ্বীপ পরিকল্পনার উদ্যোগ সফলভাবে পরিচালিত করতে হবে এবং এই পরিকল্পনাকে আরও সুপরিকল্পিতভাবে সমন্বিত করতে হবে। সরকারি এবং বেসরকারি সহযোগী প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে বাস্তবায়ন করতে হবে।

[লেখক: উপ-পরিচালক, বিআরডিবি, সাতক্ষীরা]

আকস্মিক বন্যা প্রতিরোধ ও প্রস্তুতির কৌশল

পতিতাবৃত্তি কি অপরাধ?

বন্যা-পরবর্তী কৃষকের সুরক্ষা করণীয়

নদী সংস্কার : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

নিজের চরকায় তেল দেবার নাম দেশপ্রেম

রম্যগদ্য : ডাক্তারি যখন আইসিইউতে

ডায়াবেটিস ও মুখের স্বাস্থ্য

বাঙালির ইলিশচর্চা

এসডিজি অর্জনে চ্যালেঞ্জ হতে পারে কুষ্ঠ রোগ

প্রসঙ্গ : পরিসংখ্যানের তথ্য বিকৃতি

বোরো ধান বিষয়ে কিছু সতর্কতা এবং সার ব্যবস্থাপনা

বন্যার জন্য ভারত কতটুকু দায়ী

গ্রাফিতিতে আদিবাসীদের বঞ্চনার চিত্র

স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা

পুলিশের সংস্কার হোক জনগণের কল্যাণে

জলবায়ু পরিবর্তন ও আমাদের মনস্তত্ত্ব

উন্নয়নের সুফল সবার কাছে পৌঁছাতে হবে

বন্যার বিভিন্ন ঝুঁকি ও করণীয়

প্রশ্নে জর্জরিত মানুষ ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আবির্ভাব

রম্যগদ্য : এ-পাস, না ও-পাস?

বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষি, উত্তরণের উপায়

গৃহকর্মী নির্যাতনের অবসান হোক

মাঙ্কিপক্স : সতর্কতা ও সচেতনতা

সবার আগে দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে

শিক্ষাক্ষেত্রে দ্রুত যেসব পদক্ষেপ নিতে হবে

বাদী কিংবা বিবাদীর মৃত্যুতে আইনি ফলাফল কী?

নদ-নদীর সংজ্ঞার্থ ও সংখ্যা : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

রাষ্ট্র সংস্কার ও পরিবেশ ন্যায়বিচার

আন্তঃক্যাডার বৈষম্য কি দূর হবে

আইনের শাসন, গণতন্ত্র ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা

অন্তর্বর্তী সরকারের অন্তহীন কাজ

নিষ্ঠার সাথে নিজের কাজটুকু করাই দেশপ্রেম

দেশ থেকে দুর্নীতি নির্মূল করতে হবে

ছবি

ইসমাইল হানিয়ের করুণ মৃত্যু

ক্যাপিটল : মার্কিনিদের গণতন্ত্রের প্রতীক

হাওর উন্নয়নে চাই সমন্বিত উদ্যোগ

tab

উপ-সম্পাদকীয়

ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ও বাস্তবতা

আবু আফজাল সালেহ

বুধবার, ২৪ জুলাই ২০২৪

নদীমাতৃক বাংলাদেশ পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ। তিনটি প্রধান নদী পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদীবাহিত পলিমাটি দ্বারা গঠিত দ্রুত বর্ধনশীল এই ব-দ্বীপ অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে নদীর গুরুত্ব অপরিসীম। নদী ও তার প্লাবন ভূমি এদেশের ৮০ শতাংশ এলাকার মানুষের জীবন-জীবিকা ও অর্থনীতির নিয়ামক শক্তি। দেশটির নদী জীবন, জীবিকা, অর্থনীতিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করছে। একদিকে বর্ষাকালে প্রচুর পানি ও পলি নদীগুলো দিয়ে বঙ্গোপসাগরে ধাবিত হয় এবং অসংখ্য চরের সৃষ্টি করে, অন্যদিকে শুষ্ক মৌসুমে প্রয়োজনীয় পানি পাওয়া যায়। ব-দ্বীপ অধিবাসীদের বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, নদীভাঙন, পানিদূষণের মতো হুমকি মোকাবিলা করতে হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ২০৫০ সালে দেশটির ১৪% এলাকা নিমজ্জিত হবে বলে আগাম ধারণা দিয়েছে পরিবেশ সংশ্লিষ্টরা। এর নেতিবাচক প্রভাবে ৩০ মিলিয়ন লোক জলবায়ু শরণার্থীতে পরিণত হবে।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাপমাত্রা বৃদ্ধি, অতিবৃষ্টি, বন্যা, খরা, নদীভাঙন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। গঙ্গা অববাহিকায় অবস্থিত বাংলাদেশ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ছে। কখনো অসময়ে প্রবল বৃষ্টি আর বর্ষাকালে অনাবৃষ্টি দেখা দেয়। উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততার কারণে সুপেয় পানির অভাব, শস্য কমে যাওয়া, নদীভাঙন, ফসলহানি ইত্যাদি হচ্ছে। প্রায় প্রতি বছর বিপুলসংখ্যক লোক গৃহহীন হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের জন্য পানিস¤পদ ব্যবস্থাপনা এক বিশাল চ্যালেঞ্জ। শুধু নদীখনন আর বন্দর উন্নয়ন করলে পরিকল্পনার মূল কাজে অনেক পিছিয়ে পড়তে হবে।

এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতেই অতি সম্প্রতি একটি মহাপরিকল্পনা গ্রহণ ও পাস করা হয়েছে। এই পরিকল্পনায় বন্যা, নদীভাঙন, নদীশাসন, নদী ব্যবস্থাপনা, নগর ও গ্রামে পানি সরবরাহ এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, নগর বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনায় দীর্ঘমেয়াদি কৌশল নির্ধারণ করা হয়েছে। এটি ব-দ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০ বা ডেল্টা প্লান-২১০০ নামে পরিচিতি পাচ্ছে। এটি ১০০ বছরের পরিকল্পনা। আপাতত ২০৩০ সাল নাগাদ ৮০টি পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এতে খরচ হবে ৩ হাজার ৭০০ কোটি ডলার। বর্তমান বাজার ধরে টাকার অঙ্কে এর পরিমাণ ৩ লাখ কোটি টাকার বেশি।

ব-দ্বীপ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে ২০৩০ সালের মধ্যে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) বাড়তি দেড় শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে। ১০০ বছরে পানিস¤পদ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে উন্নয়ন পরিকল্পনা এটি।

ব-দ্বীপ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ছয়টি এলাকাকে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। এগুলো হলো উপকূলীয় অঞ্চল, বরেন্দ্র ও খরাপ্রবণ অঞ্চল, হাওর ও আকস্মিক বন্যাপ্রবণ এলাকা, পার্বত্য চট্টগ্রাম, নদীবিধৌত অঞ্চল ও নগর এলাকা। এছাড়া ব-দ্বীপ পরিকল্পনায় বৃহৎ পরিসরে তিনটি লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। সেগুলো হলো ২০৩০ সালের মধ্যে চরম দারিদ্র্য দূর করা, ২০৩০ সালের মধ্যে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করা এবং ২০৪১ সালের মধ্যে সমৃদ্ধ দেশের মর্যাদা অর্জন। বদ্বীপ পরিকল্পনা হলো দীর্ঘমেয়াদি, একক এবং সমন্বিত পানিস¤পদ ব্যবস্থাপনা। দীর্ঘমেয়াদি বলতে পরিকল্পনার লক্ষ্য ২১০০। একক হলো দেশের সব পরিকল্পনার আন্তঃযোগাযোগের মাধ্যমে একক ডেল্টা। সমন্বিত বলতে পানি স¤পর্কিত সকল খাতকে একটি পরিকল্পনায় নিয়ে আসা। ব-দ্বীপ পরিকল্পনা কৌশল সমূহের টেকসই উন্নয়নের মাধ্যমে ডেল্টা ভিশনে পৌঁছাতে সাহায্য করে। সমন্বিত দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় বন্যা ও জলবায়ু পরিবর্তন-স¤পর্কিত বিপর্যয় থেকে নিরাপত্তা নিশ্চিত, পানি ব্যবহারে অধিকতর দক্ষতা আনয়ন, সমন্বিত ও টেকসই নদী এবং নদী মোহনা ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা, জলাভূমি ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং তাদের যথোপযুক্ত ব্যবহার নিশ্চিত, আন্তঃ ও আন্তঃদেশীয় পানিস¤পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য কার্যকর প্রতিষ্ঠান ও ন্যায়সঙ্গত সুশাসন গড়ে তোলা এবং ভূমি ও পানিস¤পদের সর্বোত্তম সমন্বিত ব্যবহার নিশ্চিত করার বিষয়গুলো বর্তমান আর্থ-সামাজিক বাস্তবতায় সর্বাধিক গুরুত্বের দাবিদার।

বাংলাদেশে ইতোপূর্বে খাতভিত্তিক স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোÑ ইন্টারন্যাশনাল ইঞ্জিনিয়ারিং কো¤পানি কর্তৃক ‘মাস্টার প্ল্যান ১৯৬৪’, ‘ন্যাশনাল ওয়াটার প্ল্যান ১৯৮৬, ন্যাশনাল ওয়াটার প্ল্যান ১৯৯২, ফ্লাড অ্যাকশন প্ল্যান ১৯৯২,ন্যাশনাল ওয়াটার পলিসি ১৯৯৯’ ন্যাশনাল ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান ২০০৪, হাওড় এলাকার মাস্টার প্ল্যান ২০১০, বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের কৃষি উন্নয়নের মাস্টার প্ল্যান ২০১৩’ এবং সাম্প্রতিক সময়ে প্রণীত ‘বাংলাদেশের বৃহৎ নগরী, শহর ও ছোট শহরগুলোর মাস্টার প্ল্যান’, বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তন কৌশল ও অ্যাকশন প্ল্যান, পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন প্ল্যান ২০১১-২৫ ইত্যাদি। এসব পরিকল্পনার অধিকাংশই একক খাতভিত্তিক হওয়ার কারণে এর সুফল সংশ্লিষ্ট সেক্টরগুলো পেয়ে থাকলেও অন্য খাতে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া কিংবা চাহিদা বিবেচনায় নেয়া হয়নি।

বাংলাদেশের অর্থনীতি দ্রুত বর্ধনশীল। ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়া, স্থিতিশীল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন ও প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পানি ব্যবস্থাপনা, খাদ্য নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান, প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা করার চ্যালেঞ্জ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর এজন্যই কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা, মৎস্য, শিল্প, বনায়ন, পানি ব্যবস্থাপনা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, স্যানিটেশনসহ সব খাত বিবেচনায় রেখে সমন্বিত দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ একান্ত জরুরি ছিল। ব-দ্বীপ পরিকল্পনায় অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে দেশের উন্নয়ন প্রাধিকারগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাব হ্রাস ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বিবেচনায় রেখে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ পরিকল্পনা তৈরি করা হবে। যেকোনো দীর্ঘমেয়াদি মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা, সুশাসন ও সহায়ক কার্যকর প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো তৈরি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০তে এ বিষয়গুলোকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে সংশ্লিষ্ট সব অংশীজনের প্রতিনিধিত্ব ও সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জগুলোকে স্থানীয় মৎস্য ও কৃষিজীবী মানুষের জীবনধারার সঙ্গে সমন্বয় করার প্ল্যান করতে হবে। উপকূলীয় ভৌত অবকাঠামো নির্মাণে বিশেষ নজর দিতে হবে। শহর রক্ষা বাঁধ, সড়ক, রাস্তা, বাজার, আবাসন, স্যানিটেশন, স্কুল, বিদ্যুৎ, জ্বালানির টেকসই পরিকল্পনা ইত্যাদি বিষয়ে কঠোর হতে হবে। লবণাক্ততা সহনীয় কৃষি ফসল, সার বীজ ব্যবস্থাপনা নিয়ে আরও ভাবতে হবে এবং শহর রক্ষা, ড্যাম, বন্য নিয়ন্ত্রণের জন্য ইনফ্রাস্ট্রাকচারাল কাজগুলোতে কিভাবে রিনিউএবল এনার্জি সোর্সের সমন্বয় আনতে হবে। উপকূলীয় মানুষের জ্বালানি চাহিদাগুলো মিটানো যায়! সুন্দরবনে জীবিকা নির্বাহী লোকদের বিকল্প কর্মসংস্থানের পরিকল্পনা করতে হবে। বর্ষায় ভারত বড় বড় আন্তর্জাতিক নদীগুলোর উজানে দেয়া বাঁধের সøুইস গেট ছেড়ে দিয়ে অতি স্বল্প সময়ে ফ্ল্যাশ ফ্ল্যাড তৈরি করে, দীর্ঘস্থায়ী বন্যা পরিস্থিতি তৈরি করে কিংবা বিদ্যমান বন্যা পরিস্থিতির চরম অবনতি করে। ডেল্টা প্ল্যানে এই মৌসুমী বৃষ্টিপাত এবং ভারতের ছেড়ে দেয়া পানির প্রবাহকে কিভাবে সমন্বিত করে দেশের বর্ষাকালীন ফলন এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা ঠিক রাখা যাবে সেগুলো গুরুত্ব দিতে হবে। অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষ ও প্রাণীর জীবন-জীবিকা, পরিবেশ ও প্রতিবেশের গুরুত্ব দিতে হবে। এগুলো আছে এ মহাপরিকল্পনায়। তবে সরকারকে কঠোরভাবে তদারকি করতে হবে।

নদীমাতৃক বাংলাদেশের প্রকৃতি, জনজীবন, চাষাবাদ প্রায় সবই নদীনির্ভর। তাই বলা হয়, নদী না বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে না। অর্থাৎ বাংলাদেশের জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে। অথচ বাংলাদেশ সে পথেই এগিয়ে চলেছে। অনেক নদী এর মধ্যেই মরে গেছে। অনেক নদী মৃত্যুর পথে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ৫৪টি অভিন্ন নদী রয়েছে। নদীগুলো ভারত থেকে শুরু হয়ে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়েছে। উজানে ভারতের অংশে নদীগুলোর পানি প্রবাহের গতিরোধ করা হলে কিংবা পানি প্রত্যাহার করে নিলে নদীগুলোর বাংলাদেশ অংশে পানি প্রবাহ কমে যায়। নদী শুকিয়ে যায়। বেশি করে পলি জমে ও চর জাগে। তাতে চাষাবাদ ব্যাহত হয়। বন্ধ হয়ে যায় নৌপরিবহন। ক্রমেই নিচে নেমে যায় পানির স্তর। শুরু হয় মরুকরণ প্রক্রিয়া। কারণ বর্ষায় যত পানি বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়ে, তার ৯৫ শতাংশই আসে উজানে থাকা ভারতীয় অঞ্চল থেকে ঢলের আকারে। নদীগুলোর গভীরতা কমে যাওয়ায় তখন বন্যা ও জলাবদ্ধতা অবধারিত হয়ে পড়ে। নষ্ট হয় হাজার হাজার কোটি টাকার ফসল।

তাই বলা যায়- বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০ গুরুত্বপূর্ণ মহাপরিকল্পনা; যা সমন্বিত, সর্বজনীন ও বাস্তবতার নিরিখে সময়ের সঙ্গে পরিবর্তনশীল। দেশের স্থিতিশীল আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এটি হবে ভবিষ্যতের কার্যকরী দীর্ঘমেয়াদি গাইডলাইন। জাতিসংঘ প্রণীত টেকসই উন্নয়নের সতেরোটি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের উদ্দেশ্যে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করতে হলে ব-দ্বীপ পরিকল্পনার উদ্যোগ সফলভাবে পরিচালিত করতে হবে এবং এই পরিকল্পনাকে আরও সুপরিকল্পিতভাবে সমন্বিত করতে হবে। সরকারি এবং বেসরকারি সহযোগী প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে বাস্তবায়ন করতে হবে।

[লেখক: উপ-পরিচালক, বিআরডিবি, সাতক্ষীরা]

back to top