alt

opinion » post-editorial

ইসমাইল হানিয়ের করুণ মৃত্যু

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

: রোববার, ১১ আগস্ট ২০২৪
image

ইসমাইল হানিয়ে

ইরানের তেহরানে হামলায় নিহত হয়েছেন হামাসের শীর্ষ রাজনৈতিক নেতা ইসমাইল হানিয়ে।হামলায় হানিয়ে ছাড়াও তার একজন দেহরক্ষী নিহত হয়েছেন।হানিয়ে হত্যাকাণ্ডে ইসরায়েলকে দায়ী করেছে হামাস ও ইরান।

মিশরের এক শরণার্থী শিবিরে ১৯৬২ সনে ইসমাইল হানিয়ার জন্ম।১৯৮৭ সনে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে তিনি হামাসের সাথে সংশ্লিষ্ট হন, ১৯৯৭ সনে তাকে হামাস অফিসের প্রধান করা হয়।ফিলিস্তিনের দুটি অংশ- পশ্চিম তীর এবং গাজা; প্রধান দুইটি রাজনৈতিক দল ফাতাহ এবং হামাস।১৯৯৪ সনে ইসরায়েলের সাথে ফিলিস্তিনের এক চুক্তি বলে ‘ফিলিস্তিন জাতীয় কর্তৃপক্ষ’ গঠিত হয় এবং এর মাধ্যমে ফিলিস্তিনিরা কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিজেদের পরিচালনা করার স্বাধীনতা লাভ করে।ফিলিস্তিন জাতীয় কর্তৃপক্ষ এখন আর নেই, এখন বলা হয় ফিলিস্তিন রাষ্ট্র, এই রাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস।মাহমুদ আব্বাসের অবস্থান গাজায় নয়, তিনি থাকেন পশ্চিম তীরের রামাল্লায়।২০০৬ সনে ফিলিস্তিন আইন সভার নির্বাচনে হামাস বেশির ভাগ আসনে জয় পাওয়ার পর ইসমাইল হানিয়েকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ দেন প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস।

মাহমুদ আব্বাস ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অস্ত্রের ব্যবহার বন্ধ করার পক্ষের লোক এবং বহুবার ফিলিস্তিনি দলগুলোর প্রতি অস্ত্রের ব্যবহার বন্ধ করার আহবান জানিয়েছেন, কিন্তু হামাসসহ কয়েকটি সশস্ত্র গোষ্ঠী তার কথায় কান দেয়নি।হানিয়ের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কিছুদিন পর ফাতাহ এবং হামাসের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘাত শুরু হলে গাজায় মাহমুদ আব্বাসের রাজনৈতিক পার্টি ফাতাহার কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়।প্রধানমন্ত্রী হানিয়ের এই সিদ্ধান্ত কর্তৃত্বের প্রশ্নে প্রেসিডেন্ট আব্বাসের প্রতি সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছিল; তাই তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে হানিয়েকে বরখাস্ত করে সালাম ফায়াদকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন।প্রেসিডেন্টের আব্বাসের এই সিদ্ধান্ত হামাস পরিপালন করেনি, ফলে গাজা এবং পশ্চিম তীরে দুটি পৃথক সরকার গঠিত হয়।এর পর থেকে গাজা শাসন করছে হামাস এবং পশ্চিম তীর করছে ফাতাহ।পরবর্তীকালে সরকার দুটিকে এক করার জন্য বহুবার চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু হয়নি।

ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা ভূখণ্ডে অবিরাম হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল।টানা ১০ মাসেরও বেশি সময় ধরে চালানো এই হামলায় এখন পর্যন্ত নিহত হয়েছে ৪০ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি।বিগত এপ্রিল মাসে ইদের দিন গাজায় একটি শরণার্থী শিবিরে ইসরায়েলের বিমান হামলায় ইসমাইল হানিয়ের তিন ছেলে ও বেশ কয়েকজন নাতি-নাতনি প্রাণ হারিয়েছে।ইসরায়েলের হামলায় হানিয়ের পরিবারের সদস্যদের মৃত্যুর ঘটনা এটাই প্রথম নয়; ফেব্রুয়ারিতে নিহত হয় তার আরেক ছেলে, অক্টোবরে প্রাণ হারায় তার ভাই ও ভাতিজা, নভেম্বরে তারএক নাতি নিহত হয়।হানিয়ে জানিয়েছেন, চলমান যুদ্ধে তার পরিবারের ৬০ সদস্য নিহত হয়েছে। হামাস প্রধান আরও জানিয়েছেন, তার ছেলেদের হত্যার মাধ্যমে যুদ্ধের গতিপথ বদলানো যাবে না এবং হামাস যুদ্ধবিরতির দাবি থেকে একটুও সরে আসবে না।ইসরায়েলের সঙ্গে চলমান যুদ্ধবিরতির আলোচনায় হামাসের পক্ষে ইসমাইল হানিয়া মুখ্য ভূমিকা পালন করে যাচ্ছিলেন।

হানিয়ার মৃত্যুর কয়েক ঘন্টা পূর্বে বৈরুতের দক্ষিণ উপকণ্ঠে ইসরায়েলের আরেকটি হামলায় লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর কমাণ্ডার ফুয়াদ শোকর নিহত হন।ফুয়াদ শোকরকে হত্যা করার কয়েকদিন পূর্বে ইসরায়েল-অধিকৃত গোলান মালভূমিতে হিজবুল্লাহর রকেট হামলায় ১২ জন ইহুদি নিহত হয় এবং এর জন্য ইসরায়েল ফুয়াদকে দায়ী মনে করে। ১৯৮৩ সনে লেবাননের রাজধানী বৈরুতে যুক্তরাষ্ট্রের মেরিন সেনাদের ব্যারাকে বোমা হামলার মূল পরিকল্পনাও নাকি তিনি করেছিলেন, ওই হামলায় ২৪১ জন মার্কিন সেনা নিহত হন।এই হামলায় হেজবুল্লাহ নেতা আব্বাস আল-মুসাভিও জড়িত থাকায় ইসরায়েল ১৯৯২ সনে মুসাভির মোটরকেডের উপর তাদের অ্যাপাচি হেলিকপ্টার থেকে বোমা বর্ষণ করে, এতে মুসাভি, তার স্ত্রী, সন্তানসহ ৭ জনের মৃত্যু হয়।

ইসরায়েল এভাবে তাদের শত্রুদের হত্যা করে থাকে।ইসরাইলের ‘মোসাদ’ পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর গোয়েন্দা সংস্থা।দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে যারা ইহুদিদের হত্যা করেছিল তাদের এখনো খুঁজে খুঁজে বের করে মোসাদ খুন করেছে।হিটলারের নাৎসি বাহিনীর লেফটেন্যান্ট কর্নেল অ্যাডলফ আইকম্যান নির্বিচারে ইহুদি হত্যার জন্য দায়ী।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর তিনি বাঁচার জন্য এক দেশ থেকে আরেক দেশে পালিয়ে বেড়াতে থাকেন।১৯৬০ সনে ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ তাকে আর্জেন্টিনা থেকে অপহরণ করে ইসরায়েলে নিয়ে যায় এবং বিচার করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে।১৯৭২ সনের মিউনিখ অলিম্পিকে ইসরায়েলি খেলোয়াড়দের উপর গুলি চালানোর সাথে জড়িত ফিলিস্তিনিদের এখনো খুঁজে খুঁজে বের করে মোসাদ হত্যা করছে। ইরাকের দূরপাল্লার কামানের গবেষক জেরাল্ড বুল, হামাসের ড্রোন প্রজেক্টের দলনেতা মোহাম্মদ জাওয়ারি, রকেট আধুনিকায়নের ফিলিস্তিনি গবেষক ফাদি আল বাৎশ, ফিলিস্তিনের ফাতাহ আন্দোলনের উপপ্রধান আবু জিহাদ, ফিলিস্তিনের ইসলামিক জিহাদ আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা ফাতহি শাকিকীসহ আবাবিল ড্রোনের আবিস্কারক মোহাম্মদ আল-জাওয়ারিকে ইসরাইলের মোসাদ এত নিখুঁতভাবে হত্যা করেছে যে, হত্যার পর গবেষণা করে শুধু ধারণা করা হয়েছে, মোসাদ ছাড়া এমন গুপ্তহত্যা আর কারো পক্ষে করা সম্ভব নয়।

ইরানের মাটিতে ইসমাইল হানিয়েকে হত্যার পর ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি ক্ষেপেছেন এবং হানিয়ে হত্যার যথাযথ জবাব দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।কিন্তু ইসরায়েলের সাথে ইরানের সরাসরি যুদ্ধ করার ক্ষমতা নেই।ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংস করার জন্য ইসরায়েল ওৎ পেতে আছে, প্রথম সুযোগেই তাদের পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংস করে দেবে। হানিয়ের হত্যা ঘটনা থেকে ইরানের দুর্বলতা প্রতিপন্ন হয়।হানিয়ে নতুন রাষ্ট্রপতির অভিষেক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ইরানে গিয়েছিলেন, ইরান তার নিরাপত্তার ব্যাপারে সতর্কও ছিল; কিন্তু ইসরায়েলের নজরদারি থেকে হানিয়ের অবস্থানের ভবনটিকে রক্ষা করতে পারেনি।ইরানের স্থানীয় সময় রাত দুটার দিকে বিমান হামলা চালিয়ে তাকে হত্যা করা হয়।ইরানেরও গোয়েন্দা সংস্থা আছে, কিন্তু তারা টেরও পায়নি।ইরানের অভ্যন্তরে ইসরায়েলের বিমান গিয়ে বোমা বর্ষণ করল, অথচ ইরানও টের পেল না।এমন একটি ঘটনা ঘটেছিল ১৯৮০ সনে ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময়। যুদ্ধরত অবস্থায় ইরাক ছিল সর্বোচ্চ সতর্কতায়, এই অবস্থায় ইসরায়েল বিমান আক্রমন করে ইরাকের পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংস করে দেয়, ইরাক টেরও পায়নি।

ইরানের অভ্যন্তরে ঢুকে ইসরায়েল শুধু হানিয়েকে হত্যা করেনি, হানিয়ের আগে হত্যা করেছে ইরানের বহু পারমাণবিক বিজ্ঞানীকে।তাদের হত্যা করেছে ইরানের মাটিতেই।তাদের বিজ্ঞানীদের কে মেরেছে তার রহস্য এখনো অনুদঘাটিত।তবে বিজ্ঞানীদের রহস্যজনক মৃত্যুর সাথে মোসাদ জড়িত বলে সবাই ধারণা করছে।ইরান যাতে পরমাণু শক্তির অধিকারি হতে না পারে সেজন্য মোসাদ সক্রিয়; তারা মাটির নিচে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায়ও কয়েকবার আক্রমণ করেছে। যুদ্ধ করার জন্য ইরানের নতুন প্রজন্মের বিমান নেই, ইসরায়েলের অত্যাধুনিক বিমান ও ক্ষেপনাস্ত্র হামলা মোকিবিলায় ইরানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও দুর্বল। ইরান থেকে ইসরায়েলের নিকটতম দূরত্ব ১০০০ কিলোমিটার।কিছুদিন আগে ইরান ঘোষণা দিয়ে ইসরায়েলের উপর তিন শতাধিক দ্রোন ও ক্ষেপনাস্ত্র নিক্ষেপ করেছিল, কিন্তু ইসরায়েলের মাটিতে পড়েছে নিক্ষিপ্ত বোমা-দ্রোনের মাত্র এক শতাংশ।বাকি দ্রোন ও ক্ষেপনাস্ত্র ইসরায়েলের ভূমিতে আঘাত হানার আগেই আকাশে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে।তাই ইরান মুখোমুখি যুদ্ধে জড়াবে বলে মনে হয় না।হামাস, হিজবুল্লাহ, হুতিরা হচ্ছে গিনিপিগ- এরা অহর্নিশ প্রাণ দিয়ে যাচ্ছে।

মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর রয়েছে প্রচুর সম্পদ, অসংখ্য সৈন্য, অগুণতি কেনা সর্বাধুনিক মারণাস্ত্র- এগুলোর ব্যবহার হয় নিজের মধ্যে পারষ্পরিক যুদ্ধে।পশ্চিম পাকিস্তানের সাবেক প্রধান বিচারপতি এম আর কায়ানি তার ‘নট দ্য হোল ট্রুথ’ বইতে লিখেছেন, পাকিস্তানের সৈন্যরা শুধু নিজের দেশ দখল করতে পারে, তাদের অস্ত্র ব্যবহৃত হয় নিজের দেশের জনগণের বিরুদ্ধে।কায়ানির কথাটি সম্ভবত ইরানসহ প্রায় সকল মুসলিম দেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

[লেখক: সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক; সাবেক এমডি, টাকশাল]

চা-জনগোষ্ঠীর দণ্ডপূজা ও উপেক্ষিত অধিকার

মেরিটোক্রেসি: সমাজ ও রাজনীতির প্রাসঙ্গিকতা

রম্যগদ্য: হাতের মুঠোয় বিশ্ব

শারদীয় পূজার দিনলিপি

ঋণের জন্য আত্মহত্যা, ঋণ নিয়েই চল্লিশা

জাকসু নির্বাচন ও হট্টগোল: আমাদের জন্য শিক্ষণীয় কী?

নরসুন্দর পেশার গুরুত্ব ও সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন

বিভাগভিত্তিক এমপিআর নির্বাচন পদ্ধতি

প্ল্যাটফর্ম সমাজে বাংলাদেশ: জ্ঞানের ভবিষ্যৎ কার হাতে?

আনন্দবেদনার হাসপাতাল: সরকারি ও বেসরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থার বাস্তবতা

ছবি

ভিন্ন ধরনের নির্বাচন, ভিন্ন ধরনের ফল

বেসরকারি খাতে সিআইবি’র যাত্রা: ঋণ ব্যবস্থার নতুন দিগন্ত

স্বাস্থ্যসেবায় মানবিকতা প্রতিষ্ঠা হোক

ছবি

নেপালে সরকার পতন ও বামপন্থীদের ভবিষ্যৎ

ডাকসু নির্বাচন ও সংস্কারপ্রয়াস: রাজনৈতিক চিন্তার নতুন দিগন্ত

নির্বাচন কি সব সমস্যার সমাধান

জিতিয়া উৎসব

ছবি

অলির পর নেপাল কোন পথে?

রম্যগদ্য: “মরেও বাঁচবি নারে পাগলা...”

অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শ্রীপুর পৌরসভা

ভূরিভোজ, উচ্ছেদ এবং আদিবাসী পাহাড়িয়া

অনলাইন সংস্কৃতিতে হাস্যরসের সমাজবিজ্ঞান

মামলাজট নিরসনে দেওয়ানি কার্যবিধির সংস্কার

বাস্তব মস্কো বনাম বিভ্রান্ত ইউরোপ

ছাত্রসংসদ নির্বাচন ও ভবিষ্যৎ ছাত্ররাজনীতির গতিপ্রকৃতি

সড়ক দুর্ঘটনা: কারও মৃত্যু সাধারণ, কারও মৃত্যু বিশেষ

ঐকমত্য ছাড়াও কিছু সংস্কার সম্ভব

আবার বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম : সংকটে সাধারণ মানুষ

ডায়াবেটিস রোগীর সেবা ও জনসচেতনতা

ভিন্ন ধরনের ডাকসু নির্বাচন

ডাকসু নির্বাচন : পেছনে ফেলে আসি

প্রসঙ্গ : এলডিসি তালিকা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ

“কোপা চাটিগাঁ...”

ই-কমার্স হতে পারে প্রবৃদ্ধির ইঞ্জিন

ভারত-চীনের নতুন সমীকরণ

সাইবার যুগে মানুষের মর্যাদা ও নিরাপত্তা

tab

opinion » post-editorial

ইসমাইল হানিয়ের করুণ মৃত্যু

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

image

ইসমাইল হানিয়ে

রোববার, ১১ আগস্ট ২০২৪

ইরানের তেহরানে হামলায় নিহত হয়েছেন হামাসের শীর্ষ রাজনৈতিক নেতা ইসমাইল হানিয়ে।হামলায় হানিয়ে ছাড়াও তার একজন দেহরক্ষী নিহত হয়েছেন।হানিয়ে হত্যাকাণ্ডে ইসরায়েলকে দায়ী করেছে হামাস ও ইরান।

মিশরের এক শরণার্থী শিবিরে ১৯৬২ সনে ইসমাইল হানিয়ার জন্ম।১৯৮৭ সনে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে তিনি হামাসের সাথে সংশ্লিষ্ট হন, ১৯৯৭ সনে তাকে হামাস অফিসের প্রধান করা হয়।ফিলিস্তিনের দুটি অংশ- পশ্চিম তীর এবং গাজা; প্রধান দুইটি রাজনৈতিক দল ফাতাহ এবং হামাস।১৯৯৪ সনে ইসরায়েলের সাথে ফিলিস্তিনের এক চুক্তি বলে ‘ফিলিস্তিন জাতীয় কর্তৃপক্ষ’ গঠিত হয় এবং এর মাধ্যমে ফিলিস্তিনিরা কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিজেদের পরিচালনা করার স্বাধীনতা লাভ করে।ফিলিস্তিন জাতীয় কর্তৃপক্ষ এখন আর নেই, এখন বলা হয় ফিলিস্তিন রাষ্ট্র, এই রাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস।মাহমুদ আব্বাসের অবস্থান গাজায় নয়, তিনি থাকেন পশ্চিম তীরের রামাল্লায়।২০০৬ সনে ফিলিস্তিন আইন সভার নির্বাচনে হামাস বেশির ভাগ আসনে জয় পাওয়ার পর ইসমাইল হানিয়েকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ দেন প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস।

মাহমুদ আব্বাস ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অস্ত্রের ব্যবহার বন্ধ করার পক্ষের লোক এবং বহুবার ফিলিস্তিনি দলগুলোর প্রতি অস্ত্রের ব্যবহার বন্ধ করার আহবান জানিয়েছেন, কিন্তু হামাসসহ কয়েকটি সশস্ত্র গোষ্ঠী তার কথায় কান দেয়নি।হানিয়ের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কিছুদিন পর ফাতাহ এবং হামাসের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘাত শুরু হলে গাজায় মাহমুদ আব্বাসের রাজনৈতিক পার্টি ফাতাহার কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়।প্রধানমন্ত্রী হানিয়ের এই সিদ্ধান্ত কর্তৃত্বের প্রশ্নে প্রেসিডেন্ট আব্বাসের প্রতি সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছিল; তাই তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে হানিয়েকে বরখাস্ত করে সালাম ফায়াদকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন।প্রেসিডেন্টের আব্বাসের এই সিদ্ধান্ত হামাস পরিপালন করেনি, ফলে গাজা এবং পশ্চিম তীরে দুটি পৃথক সরকার গঠিত হয়।এর পর থেকে গাজা শাসন করছে হামাস এবং পশ্চিম তীর করছে ফাতাহ।পরবর্তীকালে সরকার দুটিকে এক করার জন্য বহুবার চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু হয়নি।

ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা ভূখণ্ডে অবিরাম হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল।টানা ১০ মাসেরও বেশি সময় ধরে চালানো এই হামলায় এখন পর্যন্ত নিহত হয়েছে ৪০ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি।বিগত এপ্রিল মাসে ইদের দিন গাজায় একটি শরণার্থী শিবিরে ইসরায়েলের বিমান হামলায় ইসমাইল হানিয়ের তিন ছেলে ও বেশ কয়েকজন নাতি-নাতনি প্রাণ হারিয়েছে।ইসরায়েলের হামলায় হানিয়ের পরিবারের সদস্যদের মৃত্যুর ঘটনা এটাই প্রথম নয়; ফেব্রুয়ারিতে নিহত হয় তার আরেক ছেলে, অক্টোবরে প্রাণ হারায় তার ভাই ও ভাতিজা, নভেম্বরে তারএক নাতি নিহত হয়।হানিয়ে জানিয়েছেন, চলমান যুদ্ধে তার পরিবারের ৬০ সদস্য নিহত হয়েছে। হামাস প্রধান আরও জানিয়েছেন, তার ছেলেদের হত্যার মাধ্যমে যুদ্ধের গতিপথ বদলানো যাবে না এবং হামাস যুদ্ধবিরতির দাবি থেকে একটুও সরে আসবে না।ইসরায়েলের সঙ্গে চলমান যুদ্ধবিরতির আলোচনায় হামাসের পক্ষে ইসমাইল হানিয়া মুখ্য ভূমিকা পালন করে যাচ্ছিলেন।

হানিয়ার মৃত্যুর কয়েক ঘন্টা পূর্বে বৈরুতের দক্ষিণ উপকণ্ঠে ইসরায়েলের আরেকটি হামলায় লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর কমাণ্ডার ফুয়াদ শোকর নিহত হন।ফুয়াদ শোকরকে হত্যা করার কয়েকদিন পূর্বে ইসরায়েল-অধিকৃত গোলান মালভূমিতে হিজবুল্লাহর রকেট হামলায় ১২ জন ইহুদি নিহত হয় এবং এর জন্য ইসরায়েল ফুয়াদকে দায়ী মনে করে। ১৯৮৩ সনে লেবাননের রাজধানী বৈরুতে যুক্তরাষ্ট্রের মেরিন সেনাদের ব্যারাকে বোমা হামলার মূল পরিকল্পনাও নাকি তিনি করেছিলেন, ওই হামলায় ২৪১ জন মার্কিন সেনা নিহত হন।এই হামলায় হেজবুল্লাহ নেতা আব্বাস আল-মুসাভিও জড়িত থাকায় ইসরায়েল ১৯৯২ সনে মুসাভির মোটরকেডের উপর তাদের অ্যাপাচি হেলিকপ্টার থেকে বোমা বর্ষণ করে, এতে মুসাভি, তার স্ত্রী, সন্তানসহ ৭ জনের মৃত্যু হয়।

ইসরায়েল এভাবে তাদের শত্রুদের হত্যা করে থাকে।ইসরাইলের ‘মোসাদ’ পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর গোয়েন্দা সংস্থা।দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে যারা ইহুদিদের হত্যা করেছিল তাদের এখনো খুঁজে খুঁজে বের করে মোসাদ খুন করেছে।হিটলারের নাৎসি বাহিনীর লেফটেন্যান্ট কর্নেল অ্যাডলফ আইকম্যান নির্বিচারে ইহুদি হত্যার জন্য দায়ী।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর তিনি বাঁচার জন্য এক দেশ থেকে আরেক দেশে পালিয়ে বেড়াতে থাকেন।১৯৬০ সনে ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ তাকে আর্জেন্টিনা থেকে অপহরণ করে ইসরায়েলে নিয়ে যায় এবং বিচার করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে।১৯৭২ সনের মিউনিখ অলিম্পিকে ইসরায়েলি খেলোয়াড়দের উপর গুলি চালানোর সাথে জড়িত ফিলিস্তিনিদের এখনো খুঁজে খুঁজে বের করে মোসাদ হত্যা করছে। ইরাকের দূরপাল্লার কামানের গবেষক জেরাল্ড বুল, হামাসের ড্রোন প্রজেক্টের দলনেতা মোহাম্মদ জাওয়ারি, রকেট আধুনিকায়নের ফিলিস্তিনি গবেষক ফাদি আল বাৎশ, ফিলিস্তিনের ফাতাহ আন্দোলনের উপপ্রধান আবু জিহাদ, ফিলিস্তিনের ইসলামিক জিহাদ আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা ফাতহি শাকিকীসহ আবাবিল ড্রোনের আবিস্কারক মোহাম্মদ আল-জাওয়ারিকে ইসরাইলের মোসাদ এত নিখুঁতভাবে হত্যা করেছে যে, হত্যার পর গবেষণা করে শুধু ধারণা করা হয়েছে, মোসাদ ছাড়া এমন গুপ্তহত্যা আর কারো পক্ষে করা সম্ভব নয়।

ইরানের মাটিতে ইসমাইল হানিয়েকে হত্যার পর ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি ক্ষেপেছেন এবং হানিয়ে হত্যার যথাযথ জবাব দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।কিন্তু ইসরায়েলের সাথে ইরানের সরাসরি যুদ্ধ করার ক্ষমতা নেই।ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংস করার জন্য ইসরায়েল ওৎ পেতে আছে, প্রথম সুযোগেই তাদের পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংস করে দেবে। হানিয়ের হত্যা ঘটনা থেকে ইরানের দুর্বলতা প্রতিপন্ন হয়।হানিয়ে নতুন রাষ্ট্রপতির অভিষেক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ইরানে গিয়েছিলেন, ইরান তার নিরাপত্তার ব্যাপারে সতর্কও ছিল; কিন্তু ইসরায়েলের নজরদারি থেকে হানিয়ের অবস্থানের ভবনটিকে রক্ষা করতে পারেনি।ইরানের স্থানীয় সময় রাত দুটার দিকে বিমান হামলা চালিয়ে তাকে হত্যা করা হয়।ইরানেরও গোয়েন্দা সংস্থা আছে, কিন্তু তারা টেরও পায়নি।ইরানের অভ্যন্তরে ইসরায়েলের বিমান গিয়ে বোমা বর্ষণ করল, অথচ ইরানও টের পেল না।এমন একটি ঘটনা ঘটেছিল ১৯৮০ সনে ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময়। যুদ্ধরত অবস্থায় ইরাক ছিল সর্বোচ্চ সতর্কতায়, এই অবস্থায় ইসরায়েল বিমান আক্রমন করে ইরাকের পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংস করে দেয়, ইরাক টেরও পায়নি।

ইরানের অভ্যন্তরে ঢুকে ইসরায়েল শুধু হানিয়েকে হত্যা করেনি, হানিয়ের আগে হত্যা করেছে ইরানের বহু পারমাণবিক বিজ্ঞানীকে।তাদের হত্যা করেছে ইরানের মাটিতেই।তাদের বিজ্ঞানীদের কে মেরেছে তার রহস্য এখনো অনুদঘাটিত।তবে বিজ্ঞানীদের রহস্যজনক মৃত্যুর সাথে মোসাদ জড়িত বলে সবাই ধারণা করছে।ইরান যাতে পরমাণু শক্তির অধিকারি হতে না পারে সেজন্য মোসাদ সক্রিয়; তারা মাটির নিচে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায়ও কয়েকবার আক্রমণ করেছে। যুদ্ধ করার জন্য ইরানের নতুন প্রজন্মের বিমান নেই, ইসরায়েলের অত্যাধুনিক বিমান ও ক্ষেপনাস্ত্র হামলা মোকিবিলায় ইরানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও দুর্বল। ইরান থেকে ইসরায়েলের নিকটতম দূরত্ব ১০০০ কিলোমিটার।কিছুদিন আগে ইরান ঘোষণা দিয়ে ইসরায়েলের উপর তিন শতাধিক দ্রোন ও ক্ষেপনাস্ত্র নিক্ষেপ করেছিল, কিন্তু ইসরায়েলের মাটিতে পড়েছে নিক্ষিপ্ত বোমা-দ্রোনের মাত্র এক শতাংশ।বাকি দ্রোন ও ক্ষেপনাস্ত্র ইসরায়েলের ভূমিতে আঘাত হানার আগেই আকাশে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে।তাই ইরান মুখোমুখি যুদ্ধে জড়াবে বলে মনে হয় না।হামাস, হিজবুল্লাহ, হুতিরা হচ্ছে গিনিপিগ- এরা অহর্নিশ প্রাণ দিয়ে যাচ্ছে।

মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর রয়েছে প্রচুর সম্পদ, অসংখ্য সৈন্য, অগুণতি কেনা সর্বাধুনিক মারণাস্ত্র- এগুলোর ব্যবহার হয় নিজের মধ্যে পারষ্পরিক যুদ্ধে।পশ্চিম পাকিস্তানের সাবেক প্রধান বিচারপতি এম আর কায়ানি তার ‘নট দ্য হোল ট্রুথ’ বইতে লিখেছেন, পাকিস্তানের সৈন্যরা শুধু নিজের দেশ দখল করতে পারে, তাদের অস্ত্র ব্যবহৃত হয় নিজের দেশের জনগণের বিরুদ্ধে।কায়ানির কথাটি সম্ভবত ইরানসহ প্রায় সকল মুসলিম দেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

[লেখক: সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক; সাবেক এমডি, টাকশাল]

back to top