জিয়াউদ্দীন আহমেদ
ট্রাফিক পুলিশের অনুপস্থিতিতে বিভিন্ন সড়কে ট্রাফিকের দায়িত্ব পালন করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা। ২০১৮ সালেও তারা একই দায়িত্ব পালন করেছিল, তখন উল্টো পথে আসা মন্ত্রীর গাড়ি পেছনে ফেরত নিতে বাধ্য করা হয়েছিল। ট্রাফিক জ্যামের মূল কারণ গণপরিবহনের ড্রাইভারদের বেপরোয়া আচরণ। এদের বেপরোয়া আচরণে একটি বাসেরও দেহ অক্ষত নেই। সারা রাস্তা দখল করে গাড়ি কোণাকুণি অবস্থায় থামিয়ে রাখার বদঅভ্যাস হয়েছে ট্রাফিক পুলিশের প্রশ্রয়ের কারণে। বেপরোয়া বাসের নিয়ম ভাঙার প্রতি তাদের খেয়াল থাকে না, খেয়াল থাকে ট্রাকের প্রতি। কিন্তু ছাত্রদের অদক্ষ হাতেও সব গাড়ির চালক ট্রাফিক আইন মানতে বাধ্য হয়েছেÑ যত্রতত্র গাড়ি থামানোর সাহস করেনি কেউ, উল্টো পথে চলেনি কোনো গাড়ি, হেলমেট ছাড়া মোটরসাইকেল চলা বন্ধ ছিল, লাইন ভেঙে তাড়াহুড়ো করে যারাই সামনে যাওয়ার চেষ্টা করেছে তাদের যেতে হয়েছে সবার পরে।
একটি কার গাড়ির পেছন থেকে যেখানে মালামাল রাখা হয়, একজন মেয়েকে উদ্ধার করে ছাত্ররা। গাড়ির ভেতরে সিট খালি থাকা সত্ত্বেও মেয়েটি পেছনে ডালার ভেতরে কেন, এমন প্রশ্নের উত্তর ছিল, মেয়েটি গৃহকর্মী। কোন বিতর্কে না গিয়ে দ্রুত মেয়েটিকে সম্মুখের খালি সিটে গৃহকর্ত্রীর পাশে নিয়ে বসানো হলো। গৃহকর্ত্রী ভালোবেসে গৃহকর্মীকে তার পাশের সিট ছেড়ে দেয়নি, দিয়েছে ভয়ে। তবে এই অপমানের শোধ মেয়েটির ওপর বর্তাবে, বাসায় নিয়ে নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দিতে পারে। বহুদিন আগের ঘটনা, রাস্তায় থামানো এক সিএনজির ভেতর দুই শিশু সন্তানের সম্মুখে একজন পুরুষ একজন মেয়েকে মারছিল, পথচারীরা জিজ্ঞেস করেই স্থান ত্যাগ করছে দেখে এক পথচারীকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী হয়েছে ভাই?’ উত্তর হচ্ছে, ‘না ভাই, কিছুই হচ্ছে না, স্বামী তার স্ত্রীকে মারছে’। পরদিন একটি কলাম লিখেছিলাম, ‘বউ পেটানোর অধিকার’। দুঃখের বিষয়, স্বামীর হাতে মার খাওয়া এই বউরাও গৃহকর্মীদের পেটায়।
রামপুরা ওয়াপদা রোড ধরে মহানগর আবাসিক এলাকায় যাওয়ার পথে একটি মসজিদ, মসজিদের গাঘেঁষে একটি মাদ্রাসা। মাদ্রাসার ভেতর একটি শিশুর কান্না শুনে ভেতরে ঢুকে দেখলাম, এক নারী শিশুটিকে অনবরত মারছে, আশপাশের সবাই তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, পাশের বাসা থেকে মা এসে তার ছেলেকে মাদ্রাসার ক্লাসরুমে মারছে, এভাবে মারতে নিষেধ করায় সবাই আমার প্রতি বিরক্ত, কারণ মা তার শিশু সন্তানকে মারবে, এতে কারো মাথা ঘামানোর কিছু নেই। পশ্চিমের দেশগুলোতে নিজের বচ্চাদেরও শারিরীক বা মানসিকভাবে শাসন করা যায় না; বাচ্চা স্বয়ং নালিশ করলে বা কোন প্রতিবেশী স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে নালিশ করলে মা-বাবাকে জবাবদিহি করতে হয়। আমাদের দেশে একটা সাধারণ নিয়ম হচ্ছে, ‘আমার সন্তানকে আমি শাসন করব, তাতে তোমার কী’! নিষ্ঠুর প্রজাতির মানুষ কালক্রমে পৃথিবীর বিভিন্ন এলাকায় সভ্য হয়েছে, হচ্ছে, কিন্তু আমরা ইহকালে আর সভ্য হব বলে মনে হয় না।
গৃহকর্মীদের ওপর অমানুষিক ও পাশবিক নির্যাতনের কাহিনী প্রায়ই পত্রিকায় ছাপা হয়। নিঃস্ব, গরিব শিশু গৃহকর্মীদের চোর সাব্যস্ত করে, চুরি করে তরকারি খাওয়ার অভিযোগে, অসুস্থ হয়ে কাজ না করার কারণে, মনিবের সমবয়সী শিশুদের যতœ না নেয়ার উছিলায়, অতিরিক্ত পরিশ্রমে মেঝেতে ঘুমিয়ে পড়ায়, সকালে আজান দেয়ার আগে ঘুম না ভাঙার অজুহাতে, একটি পিরিস বা কাপ ভেঙে মনিবের বিরাট লোকসান করার কারণে, ভারী বস্তু বহনের অক্ষমতায়, কোন পণ্য তাৎক্ষণিক খুঁজে না পাওয়ায় চুরির সন্দেহে, মনিবদের খাওয়ার সময় তাকিয়ে থাকার অপরাধে আগুনের সেঁক, খুন্তির খোঁচা, লাঠির আঘাত, পায়ের লাথি, পেন্সিলের গুঁতা, আঙুল মচকে দেয়া, চুল ধরে আছাড় দেয়ার ঘটনা নিত্য দিনের। শরীরের ওপর এই নির্যাতন গৃহকর্মীদের কাছে খুব বড় শাস্তি নয়Ñ বড় শাস্তি হচ্ছে তাদের কয়েক বেলা অভুক্ত রাখা। আরও বড় শাস্তি হচ্ছে নির্যাতনের সময় কাঁদতে না দেয়া। এর চেয়েও বড় দ- হচ্ছে, মার খাওয়ার কথা বলার কোন আশ্রয় না থাকা।
শিশু গৃহকর্মীদের নির্যাতন করে মনিবরা সম্ভবত জৈবিক ও পাশবিক আনন্দ পায়। টেলিভিশন দেখা তাদের জন্য হারাম। তারপরও চলাফেরার মাঝখানে আঁড়চোখে টেলিভিশনের দিকে তাকানোর প্রলোভন তাদের থাকে। অল্প বয়সে শুধু ভাইবোন নয়, খেলার সাথীরাও ধাক্কাধাক্কি, মারামারি করে থাকে। ধাক্কাধাক্কিতে ব্যথা পেলে এই শিশুদের নালিশের একটি আশ্রয়স্থল থাকে এবং নালিশের এই আশ্রয়টিই শিশুর আঘাতকে নিরাময় করে দেয়। রক্ষা করার কেউ আছেÑ এটা শত আঘাতেও একটা বিরাট প্রবোধ। কিন্তু গৃহকর্মে নিয়োজিত শিশু যখন দেখে যে, চারদিকে সব মনিব, বয়সে কনিষ্ট মনিবের ছোট বাচ্চাও তার হুকুমদাতা প্রভু, তখন গৃহকর্মী বাচ্চাটির নীরবে নির্যাতন সহ্য করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না। এই শিশুগুলোর বোবাকান্না তখনই মর্মান্তিক হয় যখন তারা তার আশপাশের কারো সঙ্গে একটু খুনসুটিও করতে পারে না, নির্বাক হয়ে মনিবের শিশুদের মারামারি দেখে। তারও তখন একটু মার দিতে, মার খেতে ইচ্ছে করে।
গৃহকর্মী শিশুগুলো অল্প বয়সে তাদের পরিচিত পরিবেশ, মা-বাবা, দাদা-দাদি, আত্মীয়স্বজন ত্যাগ করে দূরদূরান্তে বিরূপ পরিবেশ ও অপরিচিত লোকজনের সঙ্গে বসবাস করতে বাধ্য হয়। তারা জানে, শত দুঃখ-কষ্টেও তাদের মনিবের নির্যাতন সহ্য করে কাজ করে যেতে হবে। মনিবও অসহায় গৃহকর্মীদের ওপর জুলুম-নিপীড়ন চালিয়ে যায়। দুর্বলের ওপর আক্রোশ ঝাড়ার এই পাশবিক মনোবৃত্তির অন্যতম হাতিয়ার হচ্ছে বিত্ত। শিক্ষিত ও সম্পদশালী হলেও সংস্কৃতির অনুশীলন না থাকায় এরা কদাকার, বর্বর।
দাস সৃষ্টির ইতিহাস হাজার বছরের। যুদ্ধে পরাজিত বন্দীদের দাস বানানো সব যুগে সব দেশের সর্বজন গ্রাহ্য নীতি ছিল। অন্যদিকে দারিদ্রের কারণেও শিশু শ্রমিক সহজলভ্য হয় এবং নিষ্ঠুর অত্যাচার সহ্য করে তারা শুধু খেতে পাওয়ার আশায় শ্রম দিতে থাকে। রোম সাম্রাজ্যে দাসরা মানুষ পদবাচ্য ছিল না। এই দাসদের কাজে নিয়ে পশুদের মতো মাজায় লোহার বেড়ি পরিয়ে রাখা হতো যাতে পালিয়ে যেতে না পারে। রোম সাম্রাজ্যে দাসদের নির্যাতনের কাহিনীর সাক্ষী ভ্যাটিকান সিটির পাশের কলোসোল, যা দেখার জন্য অগণিত পরিব্রাজক কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে রোম শহরে বেড়াতে যান। এই কলোসোল ছিল প্রভুদের মনোরঞ্জন ও চিত্ত বিনোদনের কেন্দ্র। কৃষ্ণাঙ্গ দাসদের ওপর শেতাঙ্গদের নৃশংস নির্যাতনের করুণ কাহিনী ‘রুটস’ সিনেমায় সুন্দরভাবে চিত্রায়িত হয়েছে।
তরল-স্বর্ণ জ্বালানি তেলের বদৌলতে মধ্যপ্রাচ্যের বেদুইনেরা খোলা মাঠের তাবু ছেড়ে এখন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থায় বসবাস ও চলাফেরা করে। দারিদ্রের সুযোগ নিয়ে আমাদের মতো গরিব-মিসকিনদের অল্প বেতনে গৃহের দাস-দাসি বানিয়ে সেবা পেতে এদের বর্তমানকালেও কোন অসুবিধা হচ্ছে না। এই মুসলিম উম্মার ভাইরা ‘মিসকিন’ গৃহদাসীদের যেভাবে নির্যাতন করে তা শত শত বছর আগের রোমকদের অত্যাচারের চেয়েও বেশি মর্মন্তুদ বলে প্রতিভাত হয়। ইসলাম দাসদের ব্যাপারে উদার হলেও ইসলামে দাসপ্রথা নিষিদ্ধ নয়। তাই বোধহয় আইএস যোদ্ধারা হাল আমলে দাস-দাসিদের বেচাকেনার হাট বসিয়েছিল। ধর্মে দাসপ্রথা নিষিদ্ধ না হলেও ১৮০৭ সালে ব্রিটেন মানুষ বেচাকেনা আইন বন্ধ করে দেয়, আমেরিকায় আব্রাহাম লিঙ্কন করেছেন ১৮৬২ সালে।
দাস হয়ে কেউ জন্মায় না এবং একবার দাস হলে সারাজীবন দাসত্ব বরণ করার অপরাধও কেউ করে না। দারিদ্রের দুষ্টচক্র থেকে সমাজের একটি শ্রেণীর বেরিয়ে আসা সম্ভব হচ্ছে না বলে এরা হাজার বছর ধরে দুর্ভাগ্যের শিকার। এদের নাকি পরকালে অঢেল প্রাপ্তি রয়েছে, কিন্তু এই অঢেল প্রাপ্তির লোভে আমরা কেউ গরিব হতে চাই না। ছাত্রদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ও ক্ষমতা গ্রহণের পর সমাজের সব ক্ষেত্রে বিরাজমান সব বৈষম্যের অবসান হোক, গৃহকর্মীরা হিংস্র মনিবদের নির্যাতন থেকে মুক্তি পাকÑ এই কামনা আমাদের সবার।
[লেখক : সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক; সাবেক এমডি, টাকশাল]
জিয়াউদ্দীন আহমেদ
শনিবার, ২৪ আগস্ট ২০২৪
ট্রাফিক পুলিশের অনুপস্থিতিতে বিভিন্ন সড়কে ট্রাফিকের দায়িত্ব পালন করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা। ২০১৮ সালেও তারা একই দায়িত্ব পালন করেছিল, তখন উল্টো পথে আসা মন্ত্রীর গাড়ি পেছনে ফেরত নিতে বাধ্য করা হয়েছিল। ট্রাফিক জ্যামের মূল কারণ গণপরিবহনের ড্রাইভারদের বেপরোয়া আচরণ। এদের বেপরোয়া আচরণে একটি বাসেরও দেহ অক্ষত নেই। সারা রাস্তা দখল করে গাড়ি কোণাকুণি অবস্থায় থামিয়ে রাখার বদঅভ্যাস হয়েছে ট্রাফিক পুলিশের প্রশ্রয়ের কারণে। বেপরোয়া বাসের নিয়ম ভাঙার প্রতি তাদের খেয়াল থাকে না, খেয়াল থাকে ট্রাকের প্রতি। কিন্তু ছাত্রদের অদক্ষ হাতেও সব গাড়ির চালক ট্রাফিক আইন মানতে বাধ্য হয়েছেÑ যত্রতত্র গাড়ি থামানোর সাহস করেনি কেউ, উল্টো পথে চলেনি কোনো গাড়ি, হেলমেট ছাড়া মোটরসাইকেল চলা বন্ধ ছিল, লাইন ভেঙে তাড়াহুড়ো করে যারাই সামনে যাওয়ার চেষ্টা করেছে তাদের যেতে হয়েছে সবার পরে।
একটি কার গাড়ির পেছন থেকে যেখানে মালামাল রাখা হয়, একজন মেয়েকে উদ্ধার করে ছাত্ররা। গাড়ির ভেতরে সিট খালি থাকা সত্ত্বেও মেয়েটি পেছনে ডালার ভেতরে কেন, এমন প্রশ্নের উত্তর ছিল, মেয়েটি গৃহকর্মী। কোন বিতর্কে না গিয়ে দ্রুত মেয়েটিকে সম্মুখের খালি সিটে গৃহকর্ত্রীর পাশে নিয়ে বসানো হলো। গৃহকর্ত্রী ভালোবেসে গৃহকর্মীকে তার পাশের সিট ছেড়ে দেয়নি, দিয়েছে ভয়ে। তবে এই অপমানের শোধ মেয়েটির ওপর বর্তাবে, বাসায় নিয়ে নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দিতে পারে। বহুদিন আগের ঘটনা, রাস্তায় থামানো এক সিএনজির ভেতর দুই শিশু সন্তানের সম্মুখে একজন পুরুষ একজন মেয়েকে মারছিল, পথচারীরা জিজ্ঞেস করেই স্থান ত্যাগ করছে দেখে এক পথচারীকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী হয়েছে ভাই?’ উত্তর হচ্ছে, ‘না ভাই, কিছুই হচ্ছে না, স্বামী তার স্ত্রীকে মারছে’। পরদিন একটি কলাম লিখেছিলাম, ‘বউ পেটানোর অধিকার’। দুঃখের বিষয়, স্বামীর হাতে মার খাওয়া এই বউরাও গৃহকর্মীদের পেটায়।
রামপুরা ওয়াপদা রোড ধরে মহানগর আবাসিক এলাকায় যাওয়ার পথে একটি মসজিদ, মসজিদের গাঘেঁষে একটি মাদ্রাসা। মাদ্রাসার ভেতর একটি শিশুর কান্না শুনে ভেতরে ঢুকে দেখলাম, এক নারী শিশুটিকে অনবরত মারছে, আশপাশের সবাই তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, পাশের বাসা থেকে মা এসে তার ছেলেকে মাদ্রাসার ক্লাসরুমে মারছে, এভাবে মারতে নিষেধ করায় সবাই আমার প্রতি বিরক্ত, কারণ মা তার শিশু সন্তানকে মারবে, এতে কারো মাথা ঘামানোর কিছু নেই। পশ্চিমের দেশগুলোতে নিজের বচ্চাদেরও শারিরীক বা মানসিকভাবে শাসন করা যায় না; বাচ্চা স্বয়ং নালিশ করলে বা কোন প্রতিবেশী স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে নালিশ করলে মা-বাবাকে জবাবদিহি করতে হয়। আমাদের দেশে একটা সাধারণ নিয়ম হচ্ছে, ‘আমার সন্তানকে আমি শাসন করব, তাতে তোমার কী’! নিষ্ঠুর প্রজাতির মানুষ কালক্রমে পৃথিবীর বিভিন্ন এলাকায় সভ্য হয়েছে, হচ্ছে, কিন্তু আমরা ইহকালে আর সভ্য হব বলে মনে হয় না।
গৃহকর্মীদের ওপর অমানুষিক ও পাশবিক নির্যাতনের কাহিনী প্রায়ই পত্রিকায় ছাপা হয়। নিঃস্ব, গরিব শিশু গৃহকর্মীদের চোর সাব্যস্ত করে, চুরি করে তরকারি খাওয়ার অভিযোগে, অসুস্থ হয়ে কাজ না করার কারণে, মনিবের সমবয়সী শিশুদের যতœ না নেয়ার উছিলায়, অতিরিক্ত পরিশ্রমে মেঝেতে ঘুমিয়ে পড়ায়, সকালে আজান দেয়ার আগে ঘুম না ভাঙার অজুহাতে, একটি পিরিস বা কাপ ভেঙে মনিবের বিরাট লোকসান করার কারণে, ভারী বস্তু বহনের অক্ষমতায়, কোন পণ্য তাৎক্ষণিক খুঁজে না পাওয়ায় চুরির সন্দেহে, মনিবদের খাওয়ার সময় তাকিয়ে থাকার অপরাধে আগুনের সেঁক, খুন্তির খোঁচা, লাঠির আঘাত, পায়ের লাথি, পেন্সিলের গুঁতা, আঙুল মচকে দেয়া, চুল ধরে আছাড় দেয়ার ঘটনা নিত্য দিনের। শরীরের ওপর এই নির্যাতন গৃহকর্মীদের কাছে খুব বড় শাস্তি নয়Ñ বড় শাস্তি হচ্ছে তাদের কয়েক বেলা অভুক্ত রাখা। আরও বড় শাস্তি হচ্ছে নির্যাতনের সময় কাঁদতে না দেয়া। এর চেয়েও বড় দ- হচ্ছে, মার খাওয়ার কথা বলার কোন আশ্রয় না থাকা।
শিশু গৃহকর্মীদের নির্যাতন করে মনিবরা সম্ভবত জৈবিক ও পাশবিক আনন্দ পায়। টেলিভিশন দেখা তাদের জন্য হারাম। তারপরও চলাফেরার মাঝখানে আঁড়চোখে টেলিভিশনের দিকে তাকানোর প্রলোভন তাদের থাকে। অল্প বয়সে শুধু ভাইবোন নয়, খেলার সাথীরাও ধাক্কাধাক্কি, মারামারি করে থাকে। ধাক্কাধাক্কিতে ব্যথা পেলে এই শিশুদের নালিশের একটি আশ্রয়স্থল থাকে এবং নালিশের এই আশ্রয়টিই শিশুর আঘাতকে নিরাময় করে দেয়। রক্ষা করার কেউ আছেÑ এটা শত আঘাতেও একটা বিরাট প্রবোধ। কিন্তু গৃহকর্মে নিয়োজিত শিশু যখন দেখে যে, চারদিকে সব মনিব, বয়সে কনিষ্ট মনিবের ছোট বাচ্চাও তার হুকুমদাতা প্রভু, তখন গৃহকর্মী বাচ্চাটির নীরবে নির্যাতন সহ্য করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না। এই শিশুগুলোর বোবাকান্না তখনই মর্মান্তিক হয় যখন তারা তার আশপাশের কারো সঙ্গে একটু খুনসুটিও করতে পারে না, নির্বাক হয়ে মনিবের শিশুদের মারামারি দেখে। তারও তখন একটু মার দিতে, মার খেতে ইচ্ছে করে।
গৃহকর্মী শিশুগুলো অল্প বয়সে তাদের পরিচিত পরিবেশ, মা-বাবা, দাদা-দাদি, আত্মীয়স্বজন ত্যাগ করে দূরদূরান্তে বিরূপ পরিবেশ ও অপরিচিত লোকজনের সঙ্গে বসবাস করতে বাধ্য হয়। তারা জানে, শত দুঃখ-কষ্টেও তাদের মনিবের নির্যাতন সহ্য করে কাজ করে যেতে হবে। মনিবও অসহায় গৃহকর্মীদের ওপর জুলুম-নিপীড়ন চালিয়ে যায়। দুর্বলের ওপর আক্রোশ ঝাড়ার এই পাশবিক মনোবৃত্তির অন্যতম হাতিয়ার হচ্ছে বিত্ত। শিক্ষিত ও সম্পদশালী হলেও সংস্কৃতির অনুশীলন না থাকায় এরা কদাকার, বর্বর।
দাস সৃষ্টির ইতিহাস হাজার বছরের। যুদ্ধে পরাজিত বন্দীদের দাস বানানো সব যুগে সব দেশের সর্বজন গ্রাহ্য নীতি ছিল। অন্যদিকে দারিদ্রের কারণেও শিশু শ্রমিক সহজলভ্য হয় এবং নিষ্ঠুর অত্যাচার সহ্য করে তারা শুধু খেতে পাওয়ার আশায় শ্রম দিতে থাকে। রোম সাম্রাজ্যে দাসরা মানুষ পদবাচ্য ছিল না। এই দাসদের কাজে নিয়ে পশুদের মতো মাজায় লোহার বেড়ি পরিয়ে রাখা হতো যাতে পালিয়ে যেতে না পারে। রোম সাম্রাজ্যে দাসদের নির্যাতনের কাহিনীর সাক্ষী ভ্যাটিকান সিটির পাশের কলোসোল, যা দেখার জন্য অগণিত পরিব্রাজক কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে রোম শহরে বেড়াতে যান। এই কলোসোল ছিল প্রভুদের মনোরঞ্জন ও চিত্ত বিনোদনের কেন্দ্র। কৃষ্ণাঙ্গ দাসদের ওপর শেতাঙ্গদের নৃশংস নির্যাতনের করুণ কাহিনী ‘রুটস’ সিনেমায় সুন্দরভাবে চিত্রায়িত হয়েছে।
তরল-স্বর্ণ জ্বালানি তেলের বদৌলতে মধ্যপ্রাচ্যের বেদুইনেরা খোলা মাঠের তাবু ছেড়ে এখন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থায় বসবাস ও চলাফেরা করে। দারিদ্রের সুযোগ নিয়ে আমাদের মতো গরিব-মিসকিনদের অল্প বেতনে গৃহের দাস-দাসি বানিয়ে সেবা পেতে এদের বর্তমানকালেও কোন অসুবিধা হচ্ছে না। এই মুসলিম উম্মার ভাইরা ‘মিসকিন’ গৃহদাসীদের যেভাবে নির্যাতন করে তা শত শত বছর আগের রোমকদের অত্যাচারের চেয়েও বেশি মর্মন্তুদ বলে প্রতিভাত হয়। ইসলাম দাসদের ব্যাপারে উদার হলেও ইসলামে দাসপ্রথা নিষিদ্ধ নয়। তাই বোধহয় আইএস যোদ্ধারা হাল আমলে দাস-দাসিদের বেচাকেনার হাট বসিয়েছিল। ধর্মে দাসপ্রথা নিষিদ্ধ না হলেও ১৮০৭ সালে ব্রিটেন মানুষ বেচাকেনা আইন বন্ধ করে দেয়, আমেরিকায় আব্রাহাম লিঙ্কন করেছেন ১৮৬২ সালে।
দাস হয়ে কেউ জন্মায় না এবং একবার দাস হলে সারাজীবন দাসত্ব বরণ করার অপরাধও কেউ করে না। দারিদ্রের দুষ্টচক্র থেকে সমাজের একটি শ্রেণীর বেরিয়ে আসা সম্ভব হচ্ছে না বলে এরা হাজার বছর ধরে দুর্ভাগ্যের শিকার। এদের নাকি পরকালে অঢেল প্রাপ্তি রয়েছে, কিন্তু এই অঢেল প্রাপ্তির লোভে আমরা কেউ গরিব হতে চাই না। ছাত্রদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ও ক্ষমতা গ্রহণের পর সমাজের সব ক্ষেত্রে বিরাজমান সব বৈষম্যের অবসান হোক, গৃহকর্মীরা হিংস্র মনিবদের নির্যাতন থেকে মুক্তি পাকÑ এই কামনা আমাদের সবার।
[লেখক : সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক; সাবেক এমডি, টাকশাল]