আনোয়ারুল হক
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ছাত্রছাত্রীদের বীরত্বগাথা, সরকারি বেসরকারি বাহিনীর গুলি ও হামলায় অগণিত মৃত্যু, আহতের আর্তনাদ, স্বজনহারা পরিবারের মানুষগুলোর আহাজারি গোটা জাতির বিবেককে স্পর্ষ করে। এ পটভূমিতে অধ্যাপক আনু মোহাম্মদের নেতৃত্বাধীন নাগরিক সমাজ ও শিক্ষক নেটওয়ার্কের ডাকে ২ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখে দ্রোহ যাত্রার ডাক দেয়া হয়। মিডিয়াতে প্রচারিত সংবাদে দ্রোহ যাত্রার মিছিলে আমাকে দেখা যাওয়ায় পরদিন আমার স্কুল জীবনের এক বন্ধু (যে সরকারের কর্মকা-ের বিরোধী হলেও আন্দোলনের উদ্দেশ্য ও পরিণতি নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন ছিল) ফোনে আমাকে মিডিয়ায় দেখা যাওয়ার বিষয়টি জানায়।
তবে মূল কথা সেটা নয়। মূল বিষয় টেলিফোন আলাপ চারিতায় সে খুলনায় প্রচলিত একটি অপকথা আমাকে বলে, ‘আজ বুঝবি না বুঝবি কাল, পাছা থাবড়াবি মারবি ফাল’। বিষয় হচ্ছে, গ্রাম দেশে ছেলেকে অতিরিক্ত শুকনো মরিচ ভাতে ডলে পান্তা খেতে দেখে পিতা তাকে এ কথা বলে এটাই বুঝাতে চাইছেন যে, অতিরিক্ত শুকনা মরিচ দিয়ে পান্তা খাইতে খুব মজা লাগলেও আগামীকাল ভোরে মলত্যাগের সময় মলদ্বারের যন্ত্রণায় লাফ দিয়ে দিয়ে পেছন চাপড়াতে হবে।
দ্রোহযাত্রায় যোগ দেয়ার তিন মাস পরে কেন জানি বন্ধুর বলা অপকথাটি মনে পড়ছে। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পলায়নের খবর শোনার সাথে সাথে রাজপথের ছাত্র জনতা হাত উত্তোলন করে চিৎকার করে ওঠে- স্বাধীন স্বাধীন স্বাধীন...অর্থাৎ একনায়কতন্ত্র থেকে, স্বৈরাচার থেকে, জুলুম থেকে স্বাধীন। উৎফুল্ল হয়ে তারা চিৎকার করছে স্বাধীন অর্থাৎ এখন থেকে স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারবে, স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারবে- যে অধিকার থেকে এক দশকেরও বেশি সময় থেকে তারা বঞ্চিত।
একদিন না যেতেই মনে খটকা লাগলো এ কথা শুনে, এটা নাকি দ্বিতীয় স্বাধীনতা। জামাতিরা তো আরো এক ধাপ এগিয়ে বলে ‘আসল স্বাধীনতা’ ছিল ১৯৪৭ সালে পেয়ারা পাকিস্তানের। ১৯৭১ সালের ‘গন্ডগোলে’ পূর্ব পাকিস্তান বাংলাদেশ নামে হয়ে গিয়েছিল ‘ভারতের করদ রাজ্য’ এবং জামাত সে সময়ে পাকিস্তানি শাসক ও সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ এবং মুক্তিবাহিনী নিধনকে সমর্থন করে সঠিক কাজটি করেছিল। রাজাকার, আলবদর বাহিনী গঠন করে মুক্তিযোদ্ধা ও পাকিস্তানের অখন্ডতার বিরোধীদের হত্যা করে ইমানি দায়িত্ব পালন করেছিল এবং ২০২৪ সালে ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ অর্জনই প্রমাণ করে তাদের অবস্থান সঠিক ছিল। শুধু জামায়াত নয়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের যারাই বিরোধী ছিলেন, তারা দাবি উত্থাপন করতে থাকেন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত, জাতীয় পতাকা পরিবর্তন করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত সংবিধান বাতিল করতে হবে।
এসব দেখে আমার ওই খুলনার বন্ধুর পান্তা ভাতের অপকথা, ‘ মারবি ফাল’ -এর কথা মনে পড়ছিল; কিন্তু ছাত্র-জনতার বিজয় মিছিলগুলোতে পূর্বাপেক্ষা আরো বেশি করে ‘আমার সোনার বাংলা’ ‘ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা’ এবারের আন্দোলনের এই রণসংগীতগুলো গীত হতে থাকলে কিছুটা আশ্বস্ত হই। বিএনপি, বামপন্থীদের মোর্চা, গণতন্ত্র মঞ্চসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, বামপন্থী ছাত্র সংগঠনসমূহ, উদীচীসহ আন্দোলনে সক্রিয় সাংস্কৃতিক সংগঠনসমূহ, শিক্ষক নেট ওয়ার্কসহ সমাজের বিভিন্ন অংশের প্রতিক্রিয়া ও প্রতিরোধে অন্ধকারের শক্তি কিছুটা পিছু হঠে।
নতুন কৌশল নেয় ইসলামী কাওয়ালী গানের আসর আয়োজনের। ওরা ভেবেছিল সংস্কৃতি কর্মীরা এটা নিয়ে হৈচৈ করবে। ওরা ওই সুযোগে সংস্কৃতি কর্মীদের আক্রমণ করে একটা অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করবে; কিন্তু তা কেন হবে? গান তো গানই। গান তো মুসলমানি গান, হিন্দু গান বা খ্রিস্টান গান হয় না। তাই যে যা খুশি গাক। শুধু দেশবিরোধী বা রুচিবিরোধী না হলেই হলো। আর কাওয়ালী শোনায় তো আমরা অভ্যস্ত। কে না শুনে থাকবে-
‘হো লাল মেরি (পাট)/ রাখিও বালা ঝুলে লালরে/ দমাদম মাস্ত কালান্দার/ আলীদা বম্বে আন্দার/ দমাদম মাস্ত কালান্দার/ আলীদা প্যায়লা নাম্বার’।
পাকিস্তানের নুসরাত ফতেহ আলী খান কাওয়ালিকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ এবং বাণিজ্যিক রূপ দেন। তিনিসহ জনপ্রিয় কাওয়ালদের উত্থান হয়েছে দরগা ও খানকাহ শরীফ থেকেই। একদিকে কাওয়ালদের স্থান দরগা ও মাজারে আক্রমন এবং ভাংচুর করা আবার অন্যদিকে নিজেরাই কাওয়াল সেজে কাওয়ালী গানের আসর আয়োজন করা- এ ধরনের দ্বিচারিতার সমালোচনার মুখে এবং গান বাজনা করায় ‘ফিরকা’র ভয়ে ওরা কাওয়ালীর আসর বাদ দিয়ে এখন নেমেছে শিল্পকলা একাডেমিতে নাটক করা বন্ধের দাবিতে। প্রায়শই ওরা শিল্পকলা একাডেমিতে আক্রমণ ভাংচুর করছে। অথচ এবারের ছাত্র-জনতার গনঅভ্যুত্থানে ভাঙ্গার কথা ছিলো- স্বৈরশাসনের শৃঙ্খল, অনিয়মের সকল বেড়াজাল, দুর্নীতির সিন্ডিকেট, লুন্ঠন ও শোষনের কাঠামো; কিন্তু ওরা ভাঙতে চাইছে আমাদের হাজার বছরের শিল্প-সংস্কৃতি, সম্প্রীতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য। সেটা কেন দেশবাসী মেনে নেবে?
বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ, বাঙালি সংস্কৃতির নিরবচ্ছিন্ন সাধনা, উদ্ভাস, প্রকাশ, বিকাশের সাথে জড়িয়ে আছে উদীচী, ছায়ানট। উদীচীর শিল্পীরা-কর্মীরা, বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলনের কর্মীরা অতীতের ন্যায় এবারেও স্বৈরাচার বিরোধী সংগ্রামে রাজপথে ছিল। তাদের বিরুদ্ধে ক্রমাগত প্রচারণা ও আক্রমণ ফ্যাসিবাদেরই আর এক রূপ। ১৯৯৯ সালে যশোরে উদীচীর জাতীয় সম্মেলনে, ২০০৫ সালে নেত্রকোনায় উদীচী কার্যালয়ে এবং ২০০২ সালে ঢাকায় রমনা বটমূলে ছায়ানটের অনুষ্ঠানে বোমা, গ্রেনেড হামলা করে যারা নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল সেই ফ্যাসিস্ট দানবীয় শক্তিই ‘ফ্যাসিবাদ বিরোধীতার’ আবরণে চড়াও হয়েছে আমাদের শিল্প সংস্কৃতির বিরুদ্ধে। দেশের বুকে যদি প্রকৃতই কোন সরকার থেকে থাকে তবে শুধু কথ না বলে এই ফ্যাসিস্টদের কঠোর হস্তে দমন করুন। তা না হলে পতিত স্বৈরাচারের ষড়যন্ত্র প্রয়োজন হবে না-অন্ধকারের এই শক্তি দিনের আলোতেই অন্তর্বর্তী সরকারকে অস্থিতিশীল করে ফেলবে।
এ প্রসঙ্গে এটাও স্পষ্টত বিবেচনায় রাখতে হবে যে, কেউ যদি এবারের সংগ্রামে যুক্ত না থেকে থাকেন বা সমর্থন না করে থাকেন তাতেও বা কি যায় আসে। সেটা তার ব্যক্তিগত স্বাধীনতা। এমনকি এই সংগ্রামের বিরুদ্ধে বা সমন্বয়কদের বিরুদ্ধে, অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে কারো কোন বক্তব্য থেকে থাকে তা ব্যক্ত করার স্বাধীনতাও থাকা উচিত। কথা বলা বা মতামত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্যই তো স্বৈরাচারকে উৎখাত করা হয়েছে। তবে ওবায়দুল কাদেরের ‘উদাত্ত আহ্বানে’ কেউ যদি লাঠি সোটা নিয়ে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে নেমে থাকেন তাকে বা তাদেরকে অবশ্যই বিচারের আওতায় আনতে হবে।
এদিকে বিচার ও আইনের শাসন নিয়ে যা চলছে তার সাথে হাসিনা আমলকে পৃথক করা কঠিন; যা চলছে সব নাটক মনে হয়। নাটক না করে, ওদের বিচারের ব্যবস্থা করুন। ওরা আমাদের ভোটাধিকার ছিনতাই করেছে। আমাদের টাকা নিয়ে পালিয়ে গেছে। হাজার হাজার লক্ষ কোটি টাকা! এ দেশের হতদরিদ্র মানুষগুলোর টাকা!
এসবের জন্য যথাযথ মামলা না সাজিয়ে খুনের মামলা! ৩০০-৪০০ জন আসামির তালিকা দিয়ে এক একটি খুনের মামলা। খুনের মামলা হতে পারে শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল, ওবায়দুল কাদের, মাহমুদ হাসান, আনিসুল হক, মো. এ আরাফাতসহ ডজন দুই নেতা মন্ত্রী, কিছু স্থানীয় নেতা ও পুলিশের কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যারা প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে পুলিশকে নির্বিচার গুলি করার হুকুম দিয়েছেন। আর মামলা হতে হবে হেলমেট লীগে অংশ নিয়ে যারা নিরস্ত্র আন্দোলনকারীদের ওপর সশস্ত্র হামলা করেছেন। এর বাইরে সুনির্দিষ্ট মামলা হতে হবে আমাদের ভোটের অধিকার হরণকারী, দেশের সম্পদ লুন্ঠনকারী ও পাচারকারীদের বিরুদ্ধে।
পুলিশ যেমন নির্বিচার গুলি করেছে ঠিক তেমন নির্বিচার খুনের মামলা দেয়া হচ্ছে এবং অধিকাংশই প্রতিহিংসামূলক। প্রতিহিংসা থেকেই কিন্তু ফ্যাসিবাদী প্রবণতা ডালপালা বিস্তার করতে থাকে। সরকার নাকি পুলিশ বাহিনী সংস্কার করবে! অথচ এই পুলিশকে ব্যবহার করেই সারা দেশে খুনের মামলায় নাম ঢুকানো এবং মামলা থেকে নাম বাদ দেয়ার শত শত কোটি টাকার বাণিজ্য হচ্ছে। এ জন্যই কি সহস্রাধিক মৃত্যু আর হাজার হাজার মানুষের পঙ্গুত্বের বিনিময়ে অভ্যুত্থান সংঘটিত হলো?
খুন নয়, খুনের প্রচেষ্টা মামলায় গ্রেপ্তার ও রিমান্ডে নেয়া হলো অভিনেত্রী শমী কায়সারকে। তার অপরাধ তিনি আওয়ামী লীগ করতেন, বিরোধীদের সমালোচনা করতেন, হাসিনার গুণগান করতেন এবং ১৮ জুলাই তারিখে অগ্নিসংযোগ ও ভাংচুরে ‘আহত’ রামপুরা টিভি ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে অগ্নিসংযোগকারীদের সমালোচনা করে বক্তৃতা দিয়েছেন; কিন্তু এ অপরাধগুলো যেহেতু দেশের প্রচলিত আইনের বিরুদ্ধে যায় না, তাই আটক রাখার জন্য জুড়ে দেয়া হলো খুন প্রচেষ্টার কাল্পনিক মামলা। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ, শহীদুল্লাহ কায়সারের কন্যার যখন শেখ হাসিনার পুলিশ বাহিনীর নির্বিচার গুলিতে নিহত শত শত কিশোর, তরুণ ও ছাত্রের মৃত্যুতে কান্না পায় না, কান্না পায় একটা স্থাপনার জন্য তখন শমীর এ পরিণতি দেখে- এ অধঃপতন দেখে আমারই কান্না পায়। কিন্তু তার এ গ্রেপ্তার যে প্রতিহিংসাবশত তা বুঝতে কষ্ট হয় না। শহীদুল্লাহ কায়সারের মেয়ে বলে তিনি আইনের ঊর্ধ্বে নন; কিন্তু তাকে আইনের অপব্যবহারের মাধ্যমে গ্রেপ্তার করে ৫২-এর ভাষা সংগ্রামের যোদ্ধা, বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের আয়োজন পর্বের কলম সৈনিক মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পূর্ব মুহূর্তে আলবদর ও পাক সেনা কর্তৃক অপহৃত প্রগতিশীল লেখক শহীদুল্লাহ কায়সারের বিরুদ্ধে দ্বিতীয়বার প্রতিশোধ নেয়া হলো।
ঠিক একই ঘটনা দেখতে পেলাম আসাদুজ্জামান নূরের ক্ষেত্রে। নূর কাউকে খুন করেছেন বা খুনের জন্য ইন্ধন জুগিয়েছেন এ কথা কোন সুস্থ মানুষ বিশ্বাস করে না। তার কৈশোর তারুণ্য যৌবন নিবেদিত ছিল প্রগতিশীল আন্দোলনে, আমাদের নিয়ে যেতেন ‘নুরলদীনের সারা জীবন’-এর কাছে; সেই আসাদুজ্জামান নূর বার্ধক্যে অধঃপতিত হলেন স্বৈরাচারী স্বেচ্ছাচারী কর্তৃত্ববাদী শেখ হাসিনার কাছে সমর্পিত হয়ে; কিন্তু কেউ আওয়ামী লীগ করলেই খুনের মামলার আসামি করা প্রতিহিংসামূলক ফ্যাসিবাদী প্রবণতা। এ ধরনের উদাহরণ দিয়ে লেখার কলেবর বাড়ানোর প্রয়োজন নেই। কয়েকজন সাংবাদিককেও খুনের মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে- যারা প্রতিনিয়ত ব্যস্ত থাকতেন শেখ হাসিনার নির্লজ্জ ও হাস্যকর তোষামোদি ও গুণকীর্তনে। উল্লেখিত সবার বিরুদ্ধেই আর্থিক দুর্নীতি বা কেলেংকারির অভিযোগ থাকতে পারে; কিন্তু সেসব অভিযোগ না তুলে খুনের হাস্যকর অভিযোগ তোলা হচ্ছে।
এসব কোন বিচারের আয়োজন নয়। ভন্ডামি! শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে পরবর্তী নির্বাচন আয়োজনকে কেন্দ্র করে যে ভন্ডামী শুরু করেছিলেন তা-ই তাকে একপর্যায়ে কর্তৃত্ববাদী স্বৈরশাসকে পরিণত করেছিল এবং তিনি মনে করতেন বাংলাদেশের আইন, বিচার ও নির্বাহী বিভাগ মানেই তিনি। তাই তো নির্বিবাদে বিরোধী দলবিহীন দুটি বিনা ভোটের এবং একটি নৈশভোটের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হয়ে মনে করেছিলেন বংশ পরম্পরায় তিনি যেমন খুশি তেমন বলার ও শাসন করার অধিকার করায়ত্ত করেছেন। আর তার এ ধারণা বা বিশ্বাসই তাকে এমন করুণ পরিণতির দিকে নিয়ে গেছে। বরেণ্য পটুয়া প্রয়াত কামরুল হাসানের আঁকা ইয়াহিয়ার রক্তলোলুপ মুখচ্ছবির আকৃতির প্রতিকৃতি সদৃশ নয়া প্রতিকৃতিতে আজ শেখ হাসিনার মুখচ্ছবি বসেছে। তিনিই বাংলাদেশের একমাত্র শাসক যাকে অপমানজনকভাবে নিজ দেশ থেকে পালিয়ে যেতে হয়েছে। আর যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ প্রত্যক্ষ করল নব অভ্যুদয়ের ভোরের সূর্য।
বুলেট আর বুটের তলায় পিষ্ট ছাত্র-জনতা যে অভ্যুত্থান সংঘটিত করলো, জীবনকে ভালোবাসবে বলে জীবন বিলিয়ে দেয়ার যে ইতিহাস সৃষ্টি করলো তাকে নব্য ফ্যাসিবাদী প্রবণতার কাছে হারতে দেয়া যাবে না। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে প্রশ্ন, এত রক্ত এত অশ্রুর বিনিময়েওÑ
‘স্বর্গ কি হবে না কেনা/ রাত্রির কঠিন তপস্যা কী আনিবে না ভোর!’
[লেখক : সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন]
আনোয়ারুল হক
মঙ্গলবার, ১২ নভেম্বর ২০২৪
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ছাত্রছাত্রীদের বীরত্বগাথা, সরকারি বেসরকারি বাহিনীর গুলি ও হামলায় অগণিত মৃত্যু, আহতের আর্তনাদ, স্বজনহারা পরিবারের মানুষগুলোর আহাজারি গোটা জাতির বিবেককে স্পর্ষ করে। এ পটভূমিতে অধ্যাপক আনু মোহাম্মদের নেতৃত্বাধীন নাগরিক সমাজ ও শিক্ষক নেটওয়ার্কের ডাকে ২ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখে দ্রোহ যাত্রার ডাক দেয়া হয়। মিডিয়াতে প্রচারিত সংবাদে দ্রোহ যাত্রার মিছিলে আমাকে দেখা যাওয়ায় পরদিন আমার স্কুল জীবনের এক বন্ধু (যে সরকারের কর্মকা-ের বিরোধী হলেও আন্দোলনের উদ্দেশ্য ও পরিণতি নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন ছিল) ফোনে আমাকে মিডিয়ায় দেখা যাওয়ার বিষয়টি জানায়।
তবে মূল কথা সেটা নয়। মূল বিষয় টেলিফোন আলাপ চারিতায় সে খুলনায় প্রচলিত একটি অপকথা আমাকে বলে, ‘আজ বুঝবি না বুঝবি কাল, পাছা থাবড়াবি মারবি ফাল’। বিষয় হচ্ছে, গ্রাম দেশে ছেলেকে অতিরিক্ত শুকনো মরিচ ভাতে ডলে পান্তা খেতে দেখে পিতা তাকে এ কথা বলে এটাই বুঝাতে চাইছেন যে, অতিরিক্ত শুকনা মরিচ দিয়ে পান্তা খাইতে খুব মজা লাগলেও আগামীকাল ভোরে মলত্যাগের সময় মলদ্বারের যন্ত্রণায় লাফ দিয়ে দিয়ে পেছন চাপড়াতে হবে।
দ্রোহযাত্রায় যোগ দেয়ার তিন মাস পরে কেন জানি বন্ধুর বলা অপকথাটি মনে পড়ছে। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পলায়নের খবর শোনার সাথে সাথে রাজপথের ছাত্র জনতা হাত উত্তোলন করে চিৎকার করে ওঠে- স্বাধীন স্বাধীন স্বাধীন...অর্থাৎ একনায়কতন্ত্র থেকে, স্বৈরাচার থেকে, জুলুম থেকে স্বাধীন। উৎফুল্ল হয়ে তারা চিৎকার করছে স্বাধীন অর্থাৎ এখন থেকে স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারবে, স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারবে- যে অধিকার থেকে এক দশকেরও বেশি সময় থেকে তারা বঞ্চিত।
একদিন না যেতেই মনে খটকা লাগলো এ কথা শুনে, এটা নাকি দ্বিতীয় স্বাধীনতা। জামাতিরা তো আরো এক ধাপ এগিয়ে বলে ‘আসল স্বাধীনতা’ ছিল ১৯৪৭ সালে পেয়ারা পাকিস্তানের। ১৯৭১ সালের ‘গন্ডগোলে’ পূর্ব পাকিস্তান বাংলাদেশ নামে হয়ে গিয়েছিল ‘ভারতের করদ রাজ্য’ এবং জামাত সে সময়ে পাকিস্তানি শাসক ও সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ এবং মুক্তিবাহিনী নিধনকে সমর্থন করে সঠিক কাজটি করেছিল। রাজাকার, আলবদর বাহিনী গঠন করে মুক্তিযোদ্ধা ও পাকিস্তানের অখন্ডতার বিরোধীদের হত্যা করে ইমানি দায়িত্ব পালন করেছিল এবং ২০২৪ সালে ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ অর্জনই প্রমাণ করে তাদের অবস্থান সঠিক ছিল। শুধু জামায়াত নয়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের যারাই বিরোধী ছিলেন, তারা দাবি উত্থাপন করতে থাকেন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত, জাতীয় পতাকা পরিবর্তন করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত সংবিধান বাতিল করতে হবে।
এসব দেখে আমার ওই খুলনার বন্ধুর পান্তা ভাতের অপকথা, ‘ মারবি ফাল’ -এর কথা মনে পড়ছিল; কিন্তু ছাত্র-জনতার বিজয় মিছিলগুলোতে পূর্বাপেক্ষা আরো বেশি করে ‘আমার সোনার বাংলা’ ‘ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা’ এবারের আন্দোলনের এই রণসংগীতগুলো গীত হতে থাকলে কিছুটা আশ্বস্ত হই। বিএনপি, বামপন্থীদের মোর্চা, গণতন্ত্র মঞ্চসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, বামপন্থী ছাত্র সংগঠনসমূহ, উদীচীসহ আন্দোলনে সক্রিয় সাংস্কৃতিক সংগঠনসমূহ, শিক্ষক নেট ওয়ার্কসহ সমাজের বিভিন্ন অংশের প্রতিক্রিয়া ও প্রতিরোধে অন্ধকারের শক্তি কিছুটা পিছু হঠে।
নতুন কৌশল নেয় ইসলামী কাওয়ালী গানের আসর আয়োজনের। ওরা ভেবেছিল সংস্কৃতি কর্মীরা এটা নিয়ে হৈচৈ করবে। ওরা ওই সুযোগে সংস্কৃতি কর্মীদের আক্রমণ করে একটা অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করবে; কিন্তু তা কেন হবে? গান তো গানই। গান তো মুসলমানি গান, হিন্দু গান বা খ্রিস্টান গান হয় না। তাই যে যা খুশি গাক। শুধু দেশবিরোধী বা রুচিবিরোধী না হলেই হলো। আর কাওয়ালী শোনায় তো আমরা অভ্যস্ত। কে না শুনে থাকবে-
‘হো লাল মেরি (পাট)/ রাখিও বালা ঝুলে লালরে/ দমাদম মাস্ত কালান্দার/ আলীদা বম্বে আন্দার/ দমাদম মাস্ত কালান্দার/ আলীদা প্যায়লা নাম্বার’।
পাকিস্তানের নুসরাত ফতেহ আলী খান কাওয়ালিকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ এবং বাণিজ্যিক রূপ দেন। তিনিসহ জনপ্রিয় কাওয়ালদের উত্থান হয়েছে দরগা ও খানকাহ শরীফ থেকেই। একদিকে কাওয়ালদের স্থান দরগা ও মাজারে আক্রমন এবং ভাংচুর করা আবার অন্যদিকে নিজেরাই কাওয়াল সেজে কাওয়ালী গানের আসর আয়োজন করা- এ ধরনের দ্বিচারিতার সমালোচনার মুখে এবং গান বাজনা করায় ‘ফিরকা’র ভয়ে ওরা কাওয়ালীর আসর বাদ দিয়ে এখন নেমেছে শিল্পকলা একাডেমিতে নাটক করা বন্ধের দাবিতে। প্রায়শই ওরা শিল্পকলা একাডেমিতে আক্রমণ ভাংচুর করছে। অথচ এবারের ছাত্র-জনতার গনঅভ্যুত্থানে ভাঙ্গার কথা ছিলো- স্বৈরশাসনের শৃঙ্খল, অনিয়মের সকল বেড়াজাল, দুর্নীতির সিন্ডিকেট, লুন্ঠন ও শোষনের কাঠামো; কিন্তু ওরা ভাঙতে চাইছে আমাদের হাজার বছরের শিল্প-সংস্কৃতি, সম্প্রীতি, ইতিহাস-ঐতিহ্য। সেটা কেন দেশবাসী মেনে নেবে?
বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ, বাঙালি সংস্কৃতির নিরবচ্ছিন্ন সাধনা, উদ্ভাস, প্রকাশ, বিকাশের সাথে জড়িয়ে আছে উদীচী, ছায়ানট। উদীচীর শিল্পীরা-কর্মীরা, বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলনের কর্মীরা অতীতের ন্যায় এবারেও স্বৈরাচার বিরোধী সংগ্রামে রাজপথে ছিল। তাদের বিরুদ্ধে ক্রমাগত প্রচারণা ও আক্রমণ ফ্যাসিবাদেরই আর এক রূপ। ১৯৯৯ সালে যশোরে উদীচীর জাতীয় সম্মেলনে, ২০০৫ সালে নেত্রকোনায় উদীচী কার্যালয়ে এবং ২০০২ সালে ঢাকায় রমনা বটমূলে ছায়ানটের অনুষ্ঠানে বোমা, গ্রেনেড হামলা করে যারা নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল সেই ফ্যাসিস্ট দানবীয় শক্তিই ‘ফ্যাসিবাদ বিরোধীতার’ আবরণে চড়াও হয়েছে আমাদের শিল্প সংস্কৃতির বিরুদ্ধে। দেশের বুকে যদি প্রকৃতই কোন সরকার থেকে থাকে তবে শুধু কথ না বলে এই ফ্যাসিস্টদের কঠোর হস্তে দমন করুন। তা না হলে পতিত স্বৈরাচারের ষড়যন্ত্র প্রয়োজন হবে না-অন্ধকারের এই শক্তি দিনের আলোতেই অন্তর্বর্তী সরকারকে অস্থিতিশীল করে ফেলবে।
এ প্রসঙ্গে এটাও স্পষ্টত বিবেচনায় রাখতে হবে যে, কেউ যদি এবারের সংগ্রামে যুক্ত না থেকে থাকেন বা সমর্থন না করে থাকেন তাতেও বা কি যায় আসে। সেটা তার ব্যক্তিগত স্বাধীনতা। এমনকি এই সংগ্রামের বিরুদ্ধে বা সমন্বয়কদের বিরুদ্ধে, অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে কারো কোন বক্তব্য থেকে থাকে তা ব্যক্ত করার স্বাধীনতাও থাকা উচিত। কথা বলা বা মতামত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্যই তো স্বৈরাচারকে উৎখাত করা হয়েছে। তবে ওবায়দুল কাদেরের ‘উদাত্ত আহ্বানে’ কেউ যদি লাঠি সোটা নিয়ে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে নেমে থাকেন তাকে বা তাদেরকে অবশ্যই বিচারের আওতায় আনতে হবে।
এদিকে বিচার ও আইনের শাসন নিয়ে যা চলছে তার সাথে হাসিনা আমলকে পৃথক করা কঠিন; যা চলছে সব নাটক মনে হয়। নাটক না করে, ওদের বিচারের ব্যবস্থা করুন। ওরা আমাদের ভোটাধিকার ছিনতাই করেছে। আমাদের টাকা নিয়ে পালিয়ে গেছে। হাজার হাজার লক্ষ কোটি টাকা! এ দেশের হতদরিদ্র মানুষগুলোর টাকা!
এসবের জন্য যথাযথ মামলা না সাজিয়ে খুনের মামলা! ৩০০-৪০০ জন আসামির তালিকা দিয়ে এক একটি খুনের মামলা। খুনের মামলা হতে পারে শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল, ওবায়দুল কাদের, মাহমুদ হাসান, আনিসুল হক, মো. এ আরাফাতসহ ডজন দুই নেতা মন্ত্রী, কিছু স্থানীয় নেতা ও পুলিশের কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যারা প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে পুলিশকে নির্বিচার গুলি করার হুকুম দিয়েছেন। আর মামলা হতে হবে হেলমেট লীগে অংশ নিয়ে যারা নিরস্ত্র আন্দোলনকারীদের ওপর সশস্ত্র হামলা করেছেন। এর বাইরে সুনির্দিষ্ট মামলা হতে হবে আমাদের ভোটের অধিকার হরণকারী, দেশের সম্পদ লুন্ঠনকারী ও পাচারকারীদের বিরুদ্ধে।
পুলিশ যেমন নির্বিচার গুলি করেছে ঠিক তেমন নির্বিচার খুনের মামলা দেয়া হচ্ছে এবং অধিকাংশই প্রতিহিংসামূলক। প্রতিহিংসা থেকেই কিন্তু ফ্যাসিবাদী প্রবণতা ডালপালা বিস্তার করতে থাকে। সরকার নাকি পুলিশ বাহিনী সংস্কার করবে! অথচ এই পুলিশকে ব্যবহার করেই সারা দেশে খুনের মামলায় নাম ঢুকানো এবং মামলা থেকে নাম বাদ দেয়ার শত শত কোটি টাকার বাণিজ্য হচ্ছে। এ জন্যই কি সহস্রাধিক মৃত্যু আর হাজার হাজার মানুষের পঙ্গুত্বের বিনিময়ে অভ্যুত্থান সংঘটিত হলো?
খুন নয়, খুনের প্রচেষ্টা মামলায় গ্রেপ্তার ও রিমান্ডে নেয়া হলো অভিনেত্রী শমী কায়সারকে। তার অপরাধ তিনি আওয়ামী লীগ করতেন, বিরোধীদের সমালোচনা করতেন, হাসিনার গুণগান করতেন এবং ১৮ জুলাই তারিখে অগ্নিসংযোগ ও ভাংচুরে ‘আহত’ রামপুরা টিভি ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে অগ্নিসংযোগকারীদের সমালোচনা করে বক্তৃতা দিয়েছেন; কিন্তু এ অপরাধগুলো যেহেতু দেশের প্রচলিত আইনের বিরুদ্ধে যায় না, তাই আটক রাখার জন্য জুড়ে দেয়া হলো খুন প্রচেষ্টার কাল্পনিক মামলা। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ, শহীদুল্লাহ কায়সারের কন্যার যখন শেখ হাসিনার পুলিশ বাহিনীর নির্বিচার গুলিতে নিহত শত শত কিশোর, তরুণ ও ছাত্রের মৃত্যুতে কান্না পায় না, কান্না পায় একটা স্থাপনার জন্য তখন শমীর এ পরিণতি দেখে- এ অধঃপতন দেখে আমারই কান্না পায়। কিন্তু তার এ গ্রেপ্তার যে প্রতিহিংসাবশত তা বুঝতে কষ্ট হয় না। শহীদুল্লাহ কায়সারের মেয়ে বলে তিনি আইনের ঊর্ধ্বে নন; কিন্তু তাকে আইনের অপব্যবহারের মাধ্যমে গ্রেপ্তার করে ৫২-এর ভাষা সংগ্রামের যোদ্ধা, বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের আয়োজন পর্বের কলম সৈনিক মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পূর্ব মুহূর্তে আলবদর ও পাক সেনা কর্তৃক অপহৃত প্রগতিশীল লেখক শহীদুল্লাহ কায়সারের বিরুদ্ধে দ্বিতীয়বার প্রতিশোধ নেয়া হলো।
ঠিক একই ঘটনা দেখতে পেলাম আসাদুজ্জামান নূরের ক্ষেত্রে। নূর কাউকে খুন করেছেন বা খুনের জন্য ইন্ধন জুগিয়েছেন এ কথা কোন সুস্থ মানুষ বিশ্বাস করে না। তার কৈশোর তারুণ্য যৌবন নিবেদিত ছিল প্রগতিশীল আন্দোলনে, আমাদের নিয়ে যেতেন ‘নুরলদীনের সারা জীবন’-এর কাছে; সেই আসাদুজ্জামান নূর বার্ধক্যে অধঃপতিত হলেন স্বৈরাচারী স্বেচ্ছাচারী কর্তৃত্ববাদী শেখ হাসিনার কাছে সমর্পিত হয়ে; কিন্তু কেউ আওয়ামী লীগ করলেই খুনের মামলার আসামি করা প্রতিহিংসামূলক ফ্যাসিবাদী প্রবণতা। এ ধরনের উদাহরণ দিয়ে লেখার কলেবর বাড়ানোর প্রয়োজন নেই। কয়েকজন সাংবাদিককেও খুনের মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে- যারা প্রতিনিয়ত ব্যস্ত থাকতেন শেখ হাসিনার নির্লজ্জ ও হাস্যকর তোষামোদি ও গুণকীর্তনে। উল্লেখিত সবার বিরুদ্ধেই আর্থিক দুর্নীতি বা কেলেংকারির অভিযোগ থাকতে পারে; কিন্তু সেসব অভিযোগ না তুলে খুনের হাস্যকর অভিযোগ তোলা হচ্ছে।
এসব কোন বিচারের আয়োজন নয়। ভন্ডামি! শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে পরবর্তী নির্বাচন আয়োজনকে কেন্দ্র করে যে ভন্ডামী শুরু করেছিলেন তা-ই তাকে একপর্যায়ে কর্তৃত্ববাদী স্বৈরশাসকে পরিণত করেছিল এবং তিনি মনে করতেন বাংলাদেশের আইন, বিচার ও নির্বাহী বিভাগ মানেই তিনি। তাই তো নির্বিবাদে বিরোধী দলবিহীন দুটি বিনা ভোটের এবং একটি নৈশভোটের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হয়ে মনে করেছিলেন বংশ পরম্পরায় তিনি যেমন খুশি তেমন বলার ও শাসন করার অধিকার করায়ত্ত করেছেন। আর তার এ ধারণা বা বিশ্বাসই তাকে এমন করুণ পরিণতির দিকে নিয়ে গেছে। বরেণ্য পটুয়া প্রয়াত কামরুল হাসানের আঁকা ইয়াহিয়ার রক্তলোলুপ মুখচ্ছবির আকৃতির প্রতিকৃতি সদৃশ নয়া প্রতিকৃতিতে আজ শেখ হাসিনার মুখচ্ছবি বসেছে। তিনিই বাংলাদেশের একমাত্র শাসক যাকে অপমানজনকভাবে নিজ দেশ থেকে পালিয়ে যেতে হয়েছে। আর যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ প্রত্যক্ষ করল নব অভ্যুদয়ের ভোরের সূর্য।
বুলেট আর বুটের তলায় পিষ্ট ছাত্র-জনতা যে অভ্যুত্থান সংঘটিত করলো, জীবনকে ভালোবাসবে বলে জীবন বিলিয়ে দেয়ার যে ইতিহাস সৃষ্টি করলো তাকে নব্য ফ্যাসিবাদী প্রবণতার কাছে হারতে দেয়া যাবে না। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে প্রশ্ন, এত রক্ত এত অশ্রুর বিনিময়েওÑ
‘স্বর্গ কি হবে না কেনা/ রাত্রির কঠিন তপস্যা কী আনিবে না ভোর!’
[লেখক : সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন]