এম এ হোসাইন
বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বড় ধরনের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে যা পরিচালিত হচ্ছে পুনরুত্থিত রক্ষণশীল মতবাদ, নীতিগত স্বায়ত্তশাসনের সংকোচন এবং প্রযুক্তিগত বৈপ্লবিক পরিবর্তনের মাধ্যমে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য, এই রূপান্তরগুলো অভূতপূর্ব চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। একসময়ের প্রভাবশালী ওয়াশিংটন কনসেনসাস যা ছিল একটি নব্য-উদারনীতিবাদী পরিকল্পনা বা মুক্ত বাজার, বেসরকারিকরণ এবং রাজস্ব সংযমের পক্ষে, কিন্তু আজ তার প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে উন্নয়ন কৌশলে একটি শূন্যতার সৃষ্টি করেছে। যেহেতু ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাণিজ্য ও শিল্পনীতিকে নতুনভাবে রূপ দিচ্ছে তাই উন্নয়নশীল অর্থনৈতিক রাষ্ট্রগুলোকে ক্রমবিচ্ছিন্ন বিশ্বে স্থিতিশীলতা ও প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে নতুন পথ নির্ধারণ করতে হবে।
ওয়াশিংটন কনসেনসাসের পতন বৈশ্বিক অর্থনৈতিক শাসনে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় নির্দেশ করে। দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে, এই কাঠামো আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক নীতিকে চালিত করেছে, যেখানে বাজার উন্মুক্তকরণ, নিয়ন্ত্রণমুক্ত অর্থনীতি এবং কঠোর রাজস্ব শৃঙ্খলাকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। তবে, বাজারমুখী ব্যবস্থাপনায় অনড় থাকার ফলে অসমতা, জলবায়ু পরিবর্তন এবং উদীয়মান অর্থনীতির অনন্য চাহিদাগুলোর মতো জরুরি সমস্যাগুলো উপেক্ষিত হয়েছে।
আজ, রক্ষণশীল বাণিজ্য নীতি ও অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদের উত্থানের ফলে মুক্তবাজার অর্থনীতির পতনকে ত্বরান্বিত করছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৮ সাল থেকে মার্কিন-চীন বাণিজ্য যুদ্ধে ৫৫০ বিলিয়ন ডলারের পণ্যের ওপর ২০%-এর বেশি শুল্ক আরোপ করা হয়েছে, যা এই পরিবর্তনের বাস্তব চিত্র। উন্নত অর্থনীতিগুলোÑ যেমন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নÑ তাদের অভ্যন্তরীণ শিল্পকে রক্ষার জন্য ক্রমবর্ধমান হারে ভর্তুকি ও আমদানি বাণিজ্যের ওপর প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন চীনা ইলেকট্রিক গাড়ির ওপর শুল্ক আরোপ করেছে, আর যুক্তরাষ্ট্র তাদের চিপস অ্যান্ড সায়েন্স এক্টে দেশীয় সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদনকে উৎসাহিত করতে ৫২ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করেছে। যদিও এসব নীতি ‘অর্থনৈতিক নিরাপত্তার’ প্রতি কৌশলগত দৃষ্টি পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়, তবে এগুলো বিশ্বব্যাপী সরবরাহ চেইনকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যকে আরও গভীর করতে পারে।
বিশেষত সম্পদনির্ভর অর্থনীতিগুলো নতুন বাণিজ্য কাঠামোর কারণে তীব্র সংকটের সম্মুখীন। বিশ্ব বাণিজ্যের বিভাজন এবং উন্নত অর্থনীতির শিল্পনীতির প্রসার তাদের রপ্তানি সম্ভাবনা সংকুচিত করেছে এবং অনিশ্চয়তা বাড়িয়েছে। তেল ও খনিজ সম্পদের ওপর নির্ভরশীল দেশগুলো চাহিদার অস্থিরতা এবং রাজস্ব সংকোচনের কারণে নাজুক অবস্থায় পড়েছে।
এছাড়া উন্নত দেশগুলোর কঠোর অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিবেশকে আরও জটিল করে তুলেছে। মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভের সুদহার বৃদ্ধির ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলোর ঋণ পরিশোধের খরচ বেড়ে গেছে, যেখানে অনেক দেশ আগেই অটেকসই ঋণের চাপে বিপর্যস্ত। জাম্বিয়া ও শ্রীলঙ্কার ঋণ খেলাপি হওয়া নিম্ন আয়ের দেশগুলোর সংকটের বাস্তব উদাহরণ। বিশ্ব ব্যাংকের মতে, ৬০%-এর বেশি নিম্ন আয়ের দেশ ঋণ সংকটে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে, যা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে বিনিয়োগের সক্ষমতা ব্যাহত করছে।
জলবায়ু পরিবর্তন, উন্নয়নশীল অর্থনীতির জাতিগুলোর মুখোমুখি হওয়া চ্যালেঞ্জগুলোতে আরেকটি স্তর যোগ করেছে। কার্বন নির্গমনের একটি ক্ষুদ্র অংশ অবদান রাখা সত্ত্বেও, এই দেশগুলো জলবায়ু দুর্যোগের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি বহন করে থাকে। ২০২২ সালে পাকিস্তানে বিধ্বংসী বন্যায় ৩০ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয় যা অভিযোজন তহবিল এবং জলবায়ু পরিবর্তনের স্থিতিশীলতার জরুরি প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ। যাইহোক, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতি বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া এখনো অপর্যাপ্ত, উন্নত দেশগুলি জলবায়ু অর্থায়নের জন্য তাদের প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। এদিকে ক্রমবর্ধমান ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা পোল্যান্ড এবং দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলিকে প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়াতে প্ররোচিত করেছে, যা উন্নয়ন বাজেটকে আরও ছোট করে ফেলছে।
জনসংখ্যাগত পরিবর্তন উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনাকে আরও জটিল করে তুলেছে। যেমন আফ্রিকার যুব জনসংখ্যার বৃদ্ধি একটি সুযোগ সৃষ্টির পাশাপাশি একটি চ্যালেঞ্জও উপস্থাপন করে। দ্রুত বর্ধনশীল তরুণ জনসংখ্যা মহাদেশটিতে একটি বৃহৎ জনশক্তির ব্যবহার করার সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। যাইহোক, পর্যাপ্ত চাকরি সৃষ্টি ছাড়া যুব বেকারত্ব সামাজিক অস্থিরতা এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে পারে। বিপরীতভাবে, এশিয়ায় বার্ধক্যজনিত জনসংখ্যা পেনশন সিস্টেমের উপর এক ধরনের চাপ তৈরি করছে এবং এজন্য অর্থনৈতিক সচলতা বজায় রাখার জন্য উদ্ভাবনী সমাধানের প্রয়োজনীয়তা অত্যাবশকীয় হয়ে পড়েছে। প্রতিটি অঞ্চলের এই জনশক্তির চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করার জন্য উপযুক্ত নীতিমালার বাস্তবায়ন জরুরি হয়ে পড়েছে।
প্রযুক্তিগত অভিযোজন বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে পুনর্গঠন করার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। ঐতিহাসিকভাবে, কাঠামোগত উন্নয়ন ও কৃষি থেকে শিল্পায়নে শ্রমশক্তি স্থানান্তর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির একটি মূল চালিকা ছিল। যাইহোক, স্বয়ংক্রিয়তা এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বর্তমানে এই ধারাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। আজকের উৎপাদন শিল্প ক্রমবর্ধমানভাবে মূলধননির্ভর ও স্বল্প চাকরির সুযোগ তৈরি করছে। ২০০০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত, সাব-সাহারা আফ্রিকায় উৎপাদনশীল কর্মসংস্থান ৮% এ স্থবির হয়ে পড়েছে, যেখানে পূর্ব এশিয়ার শিল্পায়নের সময় এটি ২৮% ছিল। এই প্রবণতা ঐতিহ্যবাহী প্রবৃদ্ধি মডেলের সীমাবদ্ধতাকে তুলে ধরে এবং বিকল্প কৌশলের প্রয়োজনীয়তা নির্দেশ করে।
শ্রমনির্ভর পরিষেবা খাতে যেমন পর্যটন, খুচরা বিক্রয় ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম উৎপাদনশীলতা বাড়ানো একটি সম্ভাব্য বিকল্প হতে পারে। ভারতের আইটি খাত যা দেশের মোট জিডিপিতে ৮% অবদান রাখে। ফলে এই ব্যবস্থাপনার সম্ভাবনার বাস্তবতাকে তুলে ধরে। তবে, পরিষেবাকেন্দ্রিক অর্থনীতিতে রূপান্তর হতে হলে শিক্ষা, ডিজিটাল অবকাঠামো এবং গবেষণা ও উন্নয়নে শক্তিশালী সরকারি বিনিয়োগ প্রয়োজন, যেখানে অনেক উন্নয়নশীল দেশ পিছিয়ে রয়েছে।
এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নীতি-নির্ধারকদের উচিত ম্যাক্রোইকোনমিক স্থিতিশীলতা, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক কাঠামোগত পরিবর্তনকে অগ্রাধিকার দেয়া। দীর্ঘমেয়াদি প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে রাজস্ব কাঠামো শক্তিশালী করা অপরিহার্য। উদাহরণস্বরূপ, ইন্দোনেশিয়ার ২০২০ সালের কর আমনেস্টি কর্মসূচি, যা অবৈতনিক কর থেকে ১১ বিলিয়ন ডলার পুনরুদ্ধার করে এবং মহামারিকালীন সহায়তায় ব্যয় করা হয়। এভাবে দেশীয় সম্পদ ব্যবস্থাপনার সম্ভাবনাকে সার্থক করে তুলেছে। একইভাবে, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং নমনীয় বিনিময় হার বজায় রাখার মাধ্যমে বহিরাগত অর্থনৈতিক ঝুঁকি সামলানো সম্ভব। মিশর ২০১৬ সালে মুদ্রাকে উন্মুক্ত করার যে সিদ্ধান্ত নেয়, তা শুরুর দিকে কঠিন হলেও দেশটির অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করে এবং মুদ্রানীতির নমনীয়তার ক্ষেত্রে এক মূল্যবান শিক্ষা প্রদান করে।
ঋণ ব্যবস্থাপনা উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হয়ে রয়ে গেছে। ঋণ পুনর্গঠন চুক্তি, যেমনÑ ঘানার ২০২৩ সালের দ্বিপক্ষীয় ঋণদাতাদের সঙ্গে করা চুক্তিÑ অর্থনৈতিক চাপ কমানো এবং উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় আর্থিক অবকাশ সৃষ্টি করতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি, উন্নয়নশীল অর্থনীতিগুলোকে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করতে প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, রুয়ান্ডার আইরেম্বো প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ১০০টিরও বেশি সরকারি সেবা ডিজিটালাইজ করা হয়েছে, যা দুর্নীতি ও অদক্ষতা কমিয়ে ডিজিটাল প্রশাসনের রূপান্তরমূলক শক্তির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
দৃঢ় অর্থনীতি গঠনের জন্য শিক্ষা ও উদ্ভাবন সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ভিয়েতনামের স্টেম শিক্ষার ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ তার প্রযুক্তিভিত্তিক উৎপাদন শিল্পের বিকাশকে ত্বরান্বিত করেছে, যা প্রমাণ করে যে মানবসম্পদে কৌশলগত বিনিয়োগ দীর্ঘমেয়াদে উল্লেখযোগ্য সুফল বয়ে আনতে পারে। একইভাবে, মরক্কোর নূর ওয়ার্জাজাতে সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প, যা ১৩ লাখ বাড়ির বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করে, দেখিয়ে দিয়েছে যে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করার পাশাপাশি জলবায়ু সংকট মোকাবিলায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
অন্তর্ভুক্তিমূলক কাঠামোগত রূপান্তর টেকসই উন্নয়নের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। যদিও সেবা খাত কর্মসংস্থান সৃষ্টির সম্ভাবনা জাগিয়ে তোলে তবে এটি এককভাবে উন্নয়নশীল দেশগুলোর শ্রমবাজারে প্রবেশকারী লক্ষাধিক তরুণকে সুযোগ দিতে পারবে না। শ্রমঘন উপখাত, যেমনÑ পোশাক শিল্প, এখনো অপরিহার্য। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে ৪০ লাখ কর্মী কাজ করেন, যাদের ৬০% নারী। এ খাত থেকে দেশটি বছরে ৪৫ বিলিয়ন ডলার আয় করে, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করা এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে ক্ষমতায়নে বিশাল সম্ভাবনা তুলে ধরে।
বিশ্বব্যাপী সহযোগিতার অপরিহার্যতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ‘রক্ষণশীলতা’ (protectionism) মনোভাব বৈশ্বিক অসমতা আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে এবং আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জগুলোকে তীব্রতর করতে পারে। যখন উন্নত অর্থনীতিগুলো নিজেদের দেশীয় শিল্পের জন্য ভর্তুকি দিচ্ছে, তখন উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য প্রযুক্তি ও আর্থিক সহায়তার ন্যায্য প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। উদীয়মান অর্থনীতির কণ্ঠস্বরকে শক্তিশালী করতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল সংস্থা, আইএমএফের কোটা ব্যবস্থাপনার সংস্কার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। একইভাবে, জি২০-এর কমন ফ্রেমওয়ার্ক ফর ডেট রিলিফের মতো উদ্যোগগুলোকে আরও দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে, যাতে ঋণ সমস্যার ন্যায়সঙ্গত সমাধান নিশ্চিত করা যায়।
আঞ্চলিক সহযোগিতা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। উদাহরণস্বরূপ, আফ্রিকান কন্টিনেন্টাল ফ্রি ট্রেড এরিয়া (AFCFTA) ৫৪টি দেশের মধ্যে একটি অভিন্ন বাজার গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়েছে, যা আন্তঃআফ্রিকান বাণিজ্যকে উৎসাহিত করবে এবং বহিনির্ভরতা কমাবে। এ ধরনের উদ্যোগগুলো দেখিয়ে দেয় যে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জনে পারস্পরিক সহযোগিতা কতটা অপরিহার্য।
আগামীর পথচলা বাস্তব প্রেক্ষাপট ও অংশীদারিত্বের ওপর নির্ভরশীল। উন্নয়নশীল অর্থনীতিগুলোকে আত্মনির্ভরশীলতার সঙ্গে বৈশ্বিক সম্পৃক্ততার ভারসাম্য রক্ষা করতে হবেÑ আঞ্চলিক জোট ও অভ্যন্তরীণ সংস্কারের মাধ্যমে ২১শ শতকের জটিল বাস্তবতা মোকাবিলা করতে হবে। একই সময়ে, উন্নত দেশগুলোকে বুঝতে হবে যে একটি স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধ বিশ্ব গড়তে পারস্পরিক সহযোগিতা অপরিহার্য; এটি কোনো শূন্য-সমষ্টির প্রতিযোগিতা নয়। শুধু সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই আমরা অন্তর্ভুক্তিমূলক ও স্থিতিশীল অর্থনীতি গড়ে তুলতে পারি, যা ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত করবে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কাঠামো হয়তো বিভাজিত, তবে দূরদর্শী নেতৃত্ব ও সম্মিলিত উদ্যোগের মাধ্যমে আমরা এমন এক ভবিষ্যৎ গড়তে পারি, যা সবার জন্য কল্যাণকর হবে।
[লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক]
এম এ হোসাইন
বৃহস্পতিবার, ২০ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বড় ধরনের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে যা পরিচালিত হচ্ছে পুনরুত্থিত রক্ষণশীল মতবাদ, নীতিগত স্বায়ত্তশাসনের সংকোচন এবং প্রযুক্তিগত বৈপ্লবিক পরিবর্তনের মাধ্যমে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য, এই রূপান্তরগুলো অভূতপূর্ব চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। একসময়ের প্রভাবশালী ওয়াশিংটন কনসেনসাস যা ছিল একটি নব্য-উদারনীতিবাদী পরিকল্পনা বা মুক্ত বাজার, বেসরকারিকরণ এবং রাজস্ব সংযমের পক্ষে, কিন্তু আজ তার প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে উন্নয়ন কৌশলে একটি শূন্যতার সৃষ্টি করেছে। যেহেতু ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাণিজ্য ও শিল্পনীতিকে নতুনভাবে রূপ দিচ্ছে তাই উন্নয়নশীল অর্থনৈতিক রাষ্ট্রগুলোকে ক্রমবিচ্ছিন্ন বিশ্বে স্থিতিশীলতা ও প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে নতুন পথ নির্ধারণ করতে হবে।
ওয়াশিংটন কনসেনসাসের পতন বৈশ্বিক অর্থনৈতিক শাসনে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় নির্দেশ করে। দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে, এই কাঠামো আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক নীতিকে চালিত করেছে, যেখানে বাজার উন্মুক্তকরণ, নিয়ন্ত্রণমুক্ত অর্থনীতি এবং কঠোর রাজস্ব শৃঙ্খলাকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। তবে, বাজারমুখী ব্যবস্থাপনায় অনড় থাকার ফলে অসমতা, জলবায়ু পরিবর্তন এবং উদীয়মান অর্থনীতির অনন্য চাহিদাগুলোর মতো জরুরি সমস্যাগুলো উপেক্ষিত হয়েছে।
আজ, রক্ষণশীল বাণিজ্য নীতি ও অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদের উত্থানের ফলে মুক্তবাজার অর্থনীতির পতনকে ত্বরান্বিত করছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৮ সাল থেকে মার্কিন-চীন বাণিজ্য যুদ্ধে ৫৫০ বিলিয়ন ডলারের পণ্যের ওপর ২০%-এর বেশি শুল্ক আরোপ করা হয়েছে, যা এই পরিবর্তনের বাস্তব চিত্র। উন্নত অর্থনীতিগুলোÑ যেমন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নÑ তাদের অভ্যন্তরীণ শিল্পকে রক্ষার জন্য ক্রমবর্ধমান হারে ভর্তুকি ও আমদানি বাণিজ্যের ওপর প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন চীনা ইলেকট্রিক গাড়ির ওপর শুল্ক আরোপ করেছে, আর যুক্তরাষ্ট্র তাদের চিপস অ্যান্ড সায়েন্স এক্টে দেশীয় সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদনকে উৎসাহিত করতে ৫২ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করেছে। যদিও এসব নীতি ‘অর্থনৈতিক নিরাপত্তার’ প্রতি কৌশলগত দৃষ্টি পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়, তবে এগুলো বিশ্বব্যাপী সরবরাহ চেইনকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যকে আরও গভীর করতে পারে।
বিশেষত সম্পদনির্ভর অর্থনীতিগুলো নতুন বাণিজ্য কাঠামোর কারণে তীব্র সংকটের সম্মুখীন। বিশ্ব বাণিজ্যের বিভাজন এবং উন্নত অর্থনীতির শিল্পনীতির প্রসার তাদের রপ্তানি সম্ভাবনা সংকুচিত করেছে এবং অনিশ্চয়তা বাড়িয়েছে। তেল ও খনিজ সম্পদের ওপর নির্ভরশীল দেশগুলো চাহিদার অস্থিরতা এবং রাজস্ব সংকোচনের কারণে নাজুক অবস্থায় পড়েছে।
এছাড়া উন্নত দেশগুলোর কঠোর অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিবেশকে আরও জটিল করে তুলেছে। মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভের সুদহার বৃদ্ধির ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলোর ঋণ পরিশোধের খরচ বেড়ে গেছে, যেখানে অনেক দেশ আগেই অটেকসই ঋণের চাপে বিপর্যস্ত। জাম্বিয়া ও শ্রীলঙ্কার ঋণ খেলাপি হওয়া নিম্ন আয়ের দেশগুলোর সংকটের বাস্তব উদাহরণ। বিশ্ব ব্যাংকের মতে, ৬০%-এর বেশি নিম্ন আয়ের দেশ ঋণ সংকটে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে, যা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে বিনিয়োগের সক্ষমতা ব্যাহত করছে।
জলবায়ু পরিবর্তন, উন্নয়নশীল অর্থনীতির জাতিগুলোর মুখোমুখি হওয়া চ্যালেঞ্জগুলোতে আরেকটি স্তর যোগ করেছে। কার্বন নির্গমনের একটি ক্ষুদ্র অংশ অবদান রাখা সত্ত্বেও, এই দেশগুলো জলবায়ু দুর্যোগের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি বহন করে থাকে। ২০২২ সালে পাকিস্তানে বিধ্বংসী বন্যায় ৩০ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয় যা অভিযোজন তহবিল এবং জলবায়ু পরিবর্তনের স্থিতিশীলতার জরুরি প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ। যাইহোক, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতি বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া এখনো অপর্যাপ্ত, উন্নত দেশগুলি জলবায়ু অর্থায়নের জন্য তাদের প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। এদিকে ক্রমবর্ধমান ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা পোল্যান্ড এবং দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলিকে প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়াতে প্ররোচিত করেছে, যা উন্নয়ন বাজেটকে আরও ছোট করে ফেলছে।
জনসংখ্যাগত পরিবর্তন উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনাকে আরও জটিল করে তুলেছে। যেমন আফ্রিকার যুব জনসংখ্যার বৃদ্ধি একটি সুযোগ সৃষ্টির পাশাপাশি একটি চ্যালেঞ্জও উপস্থাপন করে। দ্রুত বর্ধনশীল তরুণ জনসংখ্যা মহাদেশটিতে একটি বৃহৎ জনশক্তির ব্যবহার করার সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। যাইহোক, পর্যাপ্ত চাকরি সৃষ্টি ছাড়া যুব বেকারত্ব সামাজিক অস্থিরতা এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে পারে। বিপরীতভাবে, এশিয়ায় বার্ধক্যজনিত জনসংখ্যা পেনশন সিস্টেমের উপর এক ধরনের চাপ তৈরি করছে এবং এজন্য অর্থনৈতিক সচলতা বজায় রাখার জন্য উদ্ভাবনী সমাধানের প্রয়োজনীয়তা অত্যাবশকীয় হয়ে পড়েছে। প্রতিটি অঞ্চলের এই জনশক্তির চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করার জন্য উপযুক্ত নীতিমালার বাস্তবায়ন জরুরি হয়ে পড়েছে।
প্রযুক্তিগত অভিযোজন বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে পুনর্গঠন করার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। ঐতিহাসিকভাবে, কাঠামোগত উন্নয়ন ও কৃষি থেকে শিল্পায়নে শ্রমশক্তি স্থানান্তর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির একটি মূল চালিকা ছিল। যাইহোক, স্বয়ংক্রিয়তা এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বর্তমানে এই ধারাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। আজকের উৎপাদন শিল্প ক্রমবর্ধমানভাবে মূলধননির্ভর ও স্বল্প চাকরির সুযোগ তৈরি করছে। ২০০০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত, সাব-সাহারা আফ্রিকায় উৎপাদনশীল কর্মসংস্থান ৮% এ স্থবির হয়ে পড়েছে, যেখানে পূর্ব এশিয়ার শিল্পায়নের সময় এটি ২৮% ছিল। এই প্রবণতা ঐতিহ্যবাহী প্রবৃদ্ধি মডেলের সীমাবদ্ধতাকে তুলে ধরে এবং বিকল্প কৌশলের প্রয়োজনীয়তা নির্দেশ করে।
শ্রমনির্ভর পরিষেবা খাতে যেমন পর্যটন, খুচরা বিক্রয় ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম উৎপাদনশীলতা বাড়ানো একটি সম্ভাব্য বিকল্প হতে পারে। ভারতের আইটি খাত যা দেশের মোট জিডিপিতে ৮% অবদান রাখে। ফলে এই ব্যবস্থাপনার সম্ভাবনার বাস্তবতাকে তুলে ধরে। তবে, পরিষেবাকেন্দ্রিক অর্থনীতিতে রূপান্তর হতে হলে শিক্ষা, ডিজিটাল অবকাঠামো এবং গবেষণা ও উন্নয়নে শক্তিশালী সরকারি বিনিয়োগ প্রয়োজন, যেখানে অনেক উন্নয়নশীল দেশ পিছিয়ে রয়েছে।
এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নীতি-নির্ধারকদের উচিত ম্যাক্রোইকোনমিক স্থিতিশীলতা, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক কাঠামোগত পরিবর্তনকে অগ্রাধিকার দেয়া। দীর্ঘমেয়াদি প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে রাজস্ব কাঠামো শক্তিশালী করা অপরিহার্য। উদাহরণস্বরূপ, ইন্দোনেশিয়ার ২০২০ সালের কর আমনেস্টি কর্মসূচি, যা অবৈতনিক কর থেকে ১১ বিলিয়ন ডলার পুনরুদ্ধার করে এবং মহামারিকালীন সহায়তায় ব্যয় করা হয়। এভাবে দেশীয় সম্পদ ব্যবস্থাপনার সম্ভাবনাকে সার্থক করে তুলেছে। একইভাবে, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং নমনীয় বিনিময় হার বজায় রাখার মাধ্যমে বহিরাগত অর্থনৈতিক ঝুঁকি সামলানো সম্ভব। মিশর ২০১৬ সালে মুদ্রাকে উন্মুক্ত করার যে সিদ্ধান্ত নেয়, তা শুরুর দিকে কঠিন হলেও দেশটির অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করে এবং মুদ্রানীতির নমনীয়তার ক্ষেত্রে এক মূল্যবান শিক্ষা প্রদান করে।
ঋণ ব্যবস্থাপনা উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হয়ে রয়ে গেছে। ঋণ পুনর্গঠন চুক্তি, যেমনÑ ঘানার ২০২৩ সালের দ্বিপক্ষীয় ঋণদাতাদের সঙ্গে করা চুক্তিÑ অর্থনৈতিক চাপ কমানো এবং উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় আর্থিক অবকাশ সৃষ্টি করতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি, উন্নয়নশীল অর্থনীতিগুলোকে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করতে প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, রুয়ান্ডার আইরেম্বো প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ১০০টিরও বেশি সরকারি সেবা ডিজিটালাইজ করা হয়েছে, যা দুর্নীতি ও অদক্ষতা কমিয়ে ডিজিটাল প্রশাসনের রূপান্তরমূলক শক্তির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
দৃঢ় অর্থনীতি গঠনের জন্য শিক্ষা ও উদ্ভাবন সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ভিয়েতনামের স্টেম শিক্ষার ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ তার প্রযুক্তিভিত্তিক উৎপাদন শিল্পের বিকাশকে ত্বরান্বিত করেছে, যা প্রমাণ করে যে মানবসম্পদে কৌশলগত বিনিয়োগ দীর্ঘমেয়াদে উল্লেখযোগ্য সুফল বয়ে আনতে পারে। একইভাবে, মরক্কোর নূর ওয়ার্জাজাতে সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প, যা ১৩ লাখ বাড়ির বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করে, দেখিয়ে দিয়েছে যে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করার পাশাপাশি জলবায়ু সংকট মোকাবিলায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
অন্তর্ভুক্তিমূলক কাঠামোগত রূপান্তর টেকসই উন্নয়নের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। যদিও সেবা খাত কর্মসংস্থান সৃষ্টির সম্ভাবনা জাগিয়ে তোলে তবে এটি এককভাবে উন্নয়নশীল দেশগুলোর শ্রমবাজারে প্রবেশকারী লক্ষাধিক তরুণকে সুযোগ দিতে পারবে না। শ্রমঘন উপখাত, যেমনÑ পোশাক শিল্প, এখনো অপরিহার্য। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে ৪০ লাখ কর্মী কাজ করেন, যাদের ৬০% নারী। এ খাত থেকে দেশটি বছরে ৪৫ বিলিয়ন ডলার আয় করে, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করা এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে ক্ষমতায়নে বিশাল সম্ভাবনা তুলে ধরে।
বিশ্বব্যাপী সহযোগিতার অপরিহার্যতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ‘রক্ষণশীলতা’ (protectionism) মনোভাব বৈশ্বিক অসমতা আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে এবং আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জগুলোকে তীব্রতর করতে পারে। যখন উন্নত অর্থনীতিগুলো নিজেদের দেশীয় শিল্পের জন্য ভর্তুকি দিচ্ছে, তখন উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য প্রযুক্তি ও আর্থিক সহায়তার ন্যায্য প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। উদীয়মান অর্থনীতির কণ্ঠস্বরকে শক্তিশালী করতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল সংস্থা, আইএমএফের কোটা ব্যবস্থাপনার সংস্কার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। একইভাবে, জি২০-এর কমন ফ্রেমওয়ার্ক ফর ডেট রিলিফের মতো উদ্যোগগুলোকে আরও দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে, যাতে ঋণ সমস্যার ন্যায়সঙ্গত সমাধান নিশ্চিত করা যায়।
আঞ্চলিক সহযোগিতা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। উদাহরণস্বরূপ, আফ্রিকান কন্টিনেন্টাল ফ্রি ট্রেড এরিয়া (AFCFTA) ৫৪টি দেশের মধ্যে একটি অভিন্ন বাজার গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়েছে, যা আন্তঃআফ্রিকান বাণিজ্যকে উৎসাহিত করবে এবং বহিনির্ভরতা কমাবে। এ ধরনের উদ্যোগগুলো দেখিয়ে দেয় যে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জনে পারস্পরিক সহযোগিতা কতটা অপরিহার্য।
আগামীর পথচলা বাস্তব প্রেক্ষাপট ও অংশীদারিত্বের ওপর নির্ভরশীল। উন্নয়নশীল অর্থনীতিগুলোকে আত্মনির্ভরশীলতার সঙ্গে বৈশ্বিক সম্পৃক্ততার ভারসাম্য রক্ষা করতে হবেÑ আঞ্চলিক জোট ও অভ্যন্তরীণ সংস্কারের মাধ্যমে ২১শ শতকের জটিল বাস্তবতা মোকাবিলা করতে হবে। একই সময়ে, উন্নত দেশগুলোকে বুঝতে হবে যে একটি স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধ বিশ্ব গড়তে পারস্পরিক সহযোগিতা অপরিহার্য; এটি কোনো শূন্য-সমষ্টির প্রতিযোগিতা নয়। শুধু সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই আমরা অন্তর্ভুক্তিমূলক ও স্থিতিশীল অর্থনীতি গড়ে তুলতে পারি, যা ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত করবে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কাঠামো হয়তো বিভাজিত, তবে দূরদর্শী নেতৃত্ব ও সম্মিলিত উদ্যোগের মাধ্যমে আমরা এমন এক ভবিষ্যৎ গড়তে পারি, যা সবার জন্য কল্যাণকর হবে।
[লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক]