alt

উপ-সম্পাদকীয়

স্বপ্ন ভাঙল সাঁওতাল মুংলু বেসরার

মিথুশিলাক মুরমু

: শনিবার, ০১ মার্চ ২০২৫

গত ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকার একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠানের ডাকে মিটিংয়ে এসেছিলেন দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার কাশিমনগর গ্রামের আদিবাসী সাঁওতাল মুংলু বেসরা। উচ্ছেদের শিকার এই মানুষটির সঙ্গে ঢাকায় মুখোমুখি দেখা হয়। নিজের মাতৃভাষা ছাড়াও আঞ্চলিক বাংলায় কথা বলতে পারেন তিনি। কর্তৃপক্ষকে বলার পরও তাকে বিশেষ সুযোগ দেয়া হয়েছিল, যাতে সশরীরে এসে উচ্ছেদ, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও নির্যাতনের কথা জানাতে পারেন।

সাক্ষাতের সময় জানতে পারি, কয়েক দিন আগে চিহ্নিত দুর্বৃত্তরা তার বসতভিটার মাটি ৫-৬ ফুট গভীর খুঁড়ে ইটভাটায় সরবরাহ করেছে। বড় ভেকু দিয়ে মাটি কেটে ট্রাক্টরে করে সরিয়ে নেয়া হয়। সাঁওতালি ভাষায় বর্ণনা করতে গিয়ে তার চোখে জল চলে আসে। গলা ধরে বলেন, মাটি নেয়ার আগের রাতে তিনি ওই ভিটায় ছিলেন। যে জায়গায় ঘর ছিল, সেখানে বসে কেঁদেছিলেন, স্বপ্ন দেখেছিলেনÑ আবার ঘর তুলবেন, স্ত্রী-সন্তান, মা-বাবাকে নিয়ে ফিরে আসবেন। পৈতৃক ভিটায় দুমুঠো ভাত খেয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু হঠাৎ দমকা হাওয়ায় চেতনা ফিরে আসে। চারদিকে তাকিয়ে দেখেনÑ গাঢ় অন্ধকার, নিস্তব্ধতা। তিনি বুঝে যান, স্বপ্ন ঝড়ে বিবর্ণ হয়ে যাবে। দুমুঠো মাটি হাতে নিয়ে মাথা নিচু করে অস্থায়ী শিবিরের দিকে রওনা দেন।

মুংলুর স্বপ্নের ঘর ভেঙেছে। আর সেই ভাঙা ঘরের মাটিতে গড়ে উঠবে কোনো ক্ষমতাশালীর অট্টালিকা। গত ৫ আগস্ট সরকারের পটপরিবর্তনের ঝড়ে তার সংসার ল-ভ- হয়ে যায়। ৭ আগস্ট দুর্বৃত্তরা পরিকল্পিতভাবে তার বাড়িসহ কয়েকটি পরিবারের ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়, লুটপাট করে, সম্পত্তি কেড়ে নেয়। পরে ক্ষমতাবানরা তার পৈতৃক জমির ধানও নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। প্রায় ১০-১২ বিঘা জমির ধান কেটে নেয়ার পর মুংলু সাহস করে বীরগঞ্জ থানায় যান। আগে অগ্নিসংযোগ, উচ্ছেদ ও হত্যার হুমকির অভিযোগ জানালেও কোনো লিখিত কাগজ পাননি। থানার কর্মকর্তারা স্থানীয়দের সহযোগিতায় ধান ৬০-৪০ শতাংশে ভাগ করে দেন। মুংলু জানান, ধান মাড়াই করার দিনই ক্ষমতাশালীরা ট্রাক্টর দিয়ে জমি চষে সরিষার বীজ ছড়িয়ে দেয়। এখন সরিষা তোলার সময় হয়েছে। আড়ালে-আবডালে কান পাতলে শোনা যায়, মুংলুকে জমিতে নামতে দেয়া হবে না।

চোখের জল মুছতে মুছতে তিনি বলেন, ‘তাহলে কি আমরা পৈতৃক সম্পত্তি পাব না? দেশে কি আইন-আদালত বলতে কিছু নেই? আমরা আদিবাসী সাঁওতাল বলেই কি এত বৈষম্য আর অবিচার?’ তার চোখে আশাহীনতা, শুধু স্রষ্টার ওপর ভরসা।

মুংলু বেসরার বাবা-দাদার পৈতৃক সম্পত্তি প্রায় ১৩ একর। গভীর নলকূপের আওতায় থাকা এই জমির ওপর স্থানীয়দের লোভ বহুদিনের। ১৯৯২ সালে রহমত আলী নামে একজন মামলা করেন, কিন্তু আদালত খারিজ করে দেয়। পরে রফিকুল ইসলাম নামে আরেক ক্ষমতাশালী মামলা করেন, তা-ও ব্যর্থ হয়। সর্বশেষ ২০১৯ সালে এক অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা জমি দখলে নিতে মরিয়া হয়ে ওঠেন। সরকার পরিবর্তনের সুযোগে আদিবাসীদের উচ্ছেদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন। যে সম্পত্তি সাঁওতালরা যুগ যুগ ধরে চাষ করে আসছে, তা কি এভাবে হঠাৎ মালিকানা বদলাতে পারে? ব্রিটিশ আমলে আইন করা হয়েছিলÑ আদিবাসীদের জমি রাজস্ব কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া বিক্রি হবে না। তাহলে এই অন্যায় কীভাবে সম্ভব?

নিরক্ষর হলেও মুংলু সাহসী। মৃত্যুকে তুচ্ছ করে সত্যের জন্য লড়ছেন। খ্রিষ্টধর্মে বিশ্বাসী তিনি বলেন, ‘একদিন তো মরবই। কেউ মারলে মারুক, ওপরে একজন আছেন, তিনি ন্যায় করবেন।’ তার বাবা খোকা বেসরা প্রায়ই বলেন, ‘ঘরবাড়ি, প্রতিবেশী, দেশের মানুষÑ সব অচেনা হয়ে গেল। আমরা কারও ক্ষতি করিনি, তাহলে কেন আমাদের ঘর নিশ্চিহ্ন করা হলো? কেন শরণার্থী হতে হলো? সরকার তো ন্যায় করে, তাহলে আমাদের বিষয়ে নিষ্ক্রিয় কেন?’ খোকার শেষ ইচ্ছাÑ ছেলে মুংলুর নিরাপদ আবাস আর শান্তিতে বেঁচে থাকা। এর চেয়ে সহজ চাওয়া কী হতে পারে?

মুংলুর সঙ্গে কথা বলে মনে হলো, হৃদয়ের কথা বলে তার মুখে প্রশান্তির ছাপ ফুটেছে। আদিবাসীদেরও এ দেশের নাগরিক হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। মুক্তিযুদ্ধে তাদের রক্তের অবদান আলাদা করা যায় না। মুংলুর স্বপ্নকে রূপ দিতে না পারলেও শত আদিবাসীর স্বপ্ন ভাঙতে দেয়া উচিত নয়। যদি স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা তার প্রতি বৈরী থাকেন, তাহলে ন্যায়পূর্ণ ও সাম্যের রাষ্ট্র গড়া অধরাই থেকে যাবে।

[লেখক : কলামিস্ট]

হরিজনদের পদবি : ঐক্যের পথে বাধা

এল নিনো : দেশের কৃষির চ্যালেঞ্জ ও করণীয়

আর কীভাবে আর্জি জানালে নিরাপত্তা পাওয়া যায়?

কোনো স্কুলই খারাপ না

ঢাকার যানজটের টেকসই সমাধান কী

বই কেন পড়বেন

ডায়াবেটিসের জটিলতা বাড়ায় তামাক ও ধূমপান

জাতীয় বিমা দিবস

পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থা

ভাষা আন্দোলনে অংশ নেয়া ভুল হয়ে থাকলে মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতের ভূমিকা সঠিক ছিল!

শিক্ষার গুণগত মান পরিবর্তনে শিক্ষকের মূল্যায়ন

দেশে প্রোগ্রামিংয়ের চ্যালেঞ্জ ও বাস্তবতা

তর্কে সময়, সামর্থ্য এবং শক্তির অপচয় রোধ করুন

পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও দেশপ্রেমে জাতীয় অগ্রগতি

শিক্ষার মানোন্নয়নে প্রাথমিকের লেখাপড়ায় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে

ভোটাধিকার পুনরুদ্ধারের সংস্কার

বই পড়ে কী হবে

জনস্বাস্থ্যের আরেক আতঙ্কের নাম ডিমেনশিয়া

ভারতে সঙ্ঘের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য

রম্যগদ্য : “বঙ্গ হবে কলিঙ্গ”

আদিবাসী ভাষা সংরক্ষণে উদ্যোগ নিন

ছবি

ভাষা আন্দোলনের পটভূমি ও চেতনার অন্বেষণে

প্রযুক্তি, জলবায়ু ও জনসংখ্যার মোকাবিলায় উন্নয়নশীল অর্থনীতির

চাই একটি জাতীয় ভাষানীতি

অস্বাভাবিকের চেয়ে অস্বাভাবিক বায়ুদূষণ

আদিবাসীদের কাঁটাতারে বন্দি জীবন

জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে অভিযোজন : বাংলাদেশের কৌশল

শিক্ষক আন্দোলন প্রসঙ্গে

আর জি কর ঘিরে শাসক কৌশল প্রসঙ্গে

নিজের পথে ইউরোপ

ছবি

এই দাহ্য আগুন কি বিপ্লবী হতাশার বাহ্য রূপ

ভূমিজ বাঁওড় মৎস্যজীবীদের সমাজভিত্তিক সমবায় মালিকানা

মব থামাবে কে?

ভোটাধিকার পুনরুদ্ধারের সংস্কার

ফিরে দেখা বসন্ত উৎসব

এক যে ছিল স্বৈরাচারের আশির দশক!

tab

উপ-সম্পাদকীয়

স্বপ্ন ভাঙল সাঁওতাল মুংলু বেসরার

মিথুশিলাক মুরমু

শনিবার, ০১ মার্চ ২০২৫

গত ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকার একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠানের ডাকে মিটিংয়ে এসেছিলেন দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার কাশিমনগর গ্রামের আদিবাসী সাঁওতাল মুংলু বেসরা। উচ্ছেদের শিকার এই মানুষটির সঙ্গে ঢাকায় মুখোমুখি দেখা হয়। নিজের মাতৃভাষা ছাড়াও আঞ্চলিক বাংলায় কথা বলতে পারেন তিনি। কর্তৃপক্ষকে বলার পরও তাকে বিশেষ সুযোগ দেয়া হয়েছিল, যাতে সশরীরে এসে উচ্ছেদ, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও নির্যাতনের কথা জানাতে পারেন।

সাক্ষাতের সময় জানতে পারি, কয়েক দিন আগে চিহ্নিত দুর্বৃত্তরা তার বসতভিটার মাটি ৫-৬ ফুট গভীর খুঁড়ে ইটভাটায় সরবরাহ করেছে। বড় ভেকু দিয়ে মাটি কেটে ট্রাক্টরে করে সরিয়ে নেয়া হয়। সাঁওতালি ভাষায় বর্ণনা করতে গিয়ে তার চোখে জল চলে আসে। গলা ধরে বলেন, মাটি নেয়ার আগের রাতে তিনি ওই ভিটায় ছিলেন। যে জায়গায় ঘর ছিল, সেখানে বসে কেঁদেছিলেন, স্বপ্ন দেখেছিলেনÑ আবার ঘর তুলবেন, স্ত্রী-সন্তান, মা-বাবাকে নিয়ে ফিরে আসবেন। পৈতৃক ভিটায় দুমুঠো ভাত খেয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু হঠাৎ দমকা হাওয়ায় চেতনা ফিরে আসে। চারদিকে তাকিয়ে দেখেনÑ গাঢ় অন্ধকার, নিস্তব্ধতা। তিনি বুঝে যান, স্বপ্ন ঝড়ে বিবর্ণ হয়ে যাবে। দুমুঠো মাটি হাতে নিয়ে মাথা নিচু করে অস্থায়ী শিবিরের দিকে রওনা দেন।

মুংলুর স্বপ্নের ঘর ভেঙেছে। আর সেই ভাঙা ঘরের মাটিতে গড়ে উঠবে কোনো ক্ষমতাশালীর অট্টালিকা। গত ৫ আগস্ট সরকারের পটপরিবর্তনের ঝড়ে তার সংসার ল-ভ- হয়ে যায়। ৭ আগস্ট দুর্বৃত্তরা পরিকল্পিতভাবে তার বাড়িসহ কয়েকটি পরিবারের ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়, লুটপাট করে, সম্পত্তি কেড়ে নেয়। পরে ক্ষমতাবানরা তার পৈতৃক জমির ধানও নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। প্রায় ১০-১২ বিঘা জমির ধান কেটে নেয়ার পর মুংলু সাহস করে বীরগঞ্জ থানায় যান। আগে অগ্নিসংযোগ, উচ্ছেদ ও হত্যার হুমকির অভিযোগ জানালেও কোনো লিখিত কাগজ পাননি। থানার কর্মকর্তারা স্থানীয়দের সহযোগিতায় ধান ৬০-৪০ শতাংশে ভাগ করে দেন। মুংলু জানান, ধান মাড়াই করার দিনই ক্ষমতাশালীরা ট্রাক্টর দিয়ে জমি চষে সরিষার বীজ ছড়িয়ে দেয়। এখন সরিষা তোলার সময় হয়েছে। আড়ালে-আবডালে কান পাতলে শোনা যায়, মুংলুকে জমিতে নামতে দেয়া হবে না।

চোখের জল মুছতে মুছতে তিনি বলেন, ‘তাহলে কি আমরা পৈতৃক সম্পত্তি পাব না? দেশে কি আইন-আদালত বলতে কিছু নেই? আমরা আদিবাসী সাঁওতাল বলেই কি এত বৈষম্য আর অবিচার?’ তার চোখে আশাহীনতা, শুধু স্রষ্টার ওপর ভরসা।

মুংলু বেসরার বাবা-দাদার পৈতৃক সম্পত্তি প্রায় ১৩ একর। গভীর নলকূপের আওতায় থাকা এই জমির ওপর স্থানীয়দের লোভ বহুদিনের। ১৯৯২ সালে রহমত আলী নামে একজন মামলা করেন, কিন্তু আদালত খারিজ করে দেয়। পরে রফিকুল ইসলাম নামে আরেক ক্ষমতাশালী মামলা করেন, তা-ও ব্যর্থ হয়। সর্বশেষ ২০১৯ সালে এক অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা জমি দখলে নিতে মরিয়া হয়ে ওঠেন। সরকার পরিবর্তনের সুযোগে আদিবাসীদের উচ্ছেদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন। যে সম্পত্তি সাঁওতালরা যুগ যুগ ধরে চাষ করে আসছে, তা কি এভাবে হঠাৎ মালিকানা বদলাতে পারে? ব্রিটিশ আমলে আইন করা হয়েছিলÑ আদিবাসীদের জমি রাজস্ব কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া বিক্রি হবে না। তাহলে এই অন্যায় কীভাবে সম্ভব?

নিরক্ষর হলেও মুংলু সাহসী। মৃত্যুকে তুচ্ছ করে সত্যের জন্য লড়ছেন। খ্রিষ্টধর্মে বিশ্বাসী তিনি বলেন, ‘একদিন তো মরবই। কেউ মারলে মারুক, ওপরে একজন আছেন, তিনি ন্যায় করবেন।’ তার বাবা খোকা বেসরা প্রায়ই বলেন, ‘ঘরবাড়ি, প্রতিবেশী, দেশের মানুষÑ সব অচেনা হয়ে গেল। আমরা কারও ক্ষতি করিনি, তাহলে কেন আমাদের ঘর নিশ্চিহ্ন করা হলো? কেন শরণার্থী হতে হলো? সরকার তো ন্যায় করে, তাহলে আমাদের বিষয়ে নিষ্ক্রিয় কেন?’ খোকার শেষ ইচ্ছাÑ ছেলে মুংলুর নিরাপদ আবাস আর শান্তিতে বেঁচে থাকা। এর চেয়ে সহজ চাওয়া কী হতে পারে?

মুংলুর সঙ্গে কথা বলে মনে হলো, হৃদয়ের কথা বলে তার মুখে প্রশান্তির ছাপ ফুটেছে। আদিবাসীদেরও এ দেশের নাগরিক হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। মুক্তিযুদ্ধে তাদের রক্তের অবদান আলাদা করা যায় না। মুংলুর স্বপ্নকে রূপ দিতে না পারলেও শত আদিবাসীর স্বপ্ন ভাঙতে দেয়া উচিত নয়। যদি স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা তার প্রতি বৈরী থাকেন, তাহলে ন্যায়পূর্ণ ও সাম্যের রাষ্ট্র গড়া অধরাই থেকে যাবে।

[লেখক : কলামিস্ট]

back to top