আনোয়ারুল হক
২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের দিন ঢেকে রাখা লালমনিরহাট মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি স্মারক মঞ্চের ম্যুরাল এবং ৩০ মার্চ ম্যুরালের কিছু অংশ ভেঙে ফেলার দৃশ্য
শেখ হাসিনার শাসনামলে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় ডিসিদের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতা থাকতো- কে কত বেশি ভোটের ব্যবধানে সরকারি দলের প্রার্থীকে বিজয়ী করতে পারে। যাদের জেলায় ব্যবধান বেশি হবে তারাই ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের’ ডিসি হিসেবে বিবেচিত হবেন এবং ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের’ সরকার তাকে ততো পুরস্কৃত করবেন। আর এ কাজে ডিসিদের প্রধান সহযোগী ও পুরস্কারের তালিকায় নাম থাকা কর্মকতা ছিলেন এসপি।
২০১৪ সালে বিরোধী দল যেহেতু নির্বাচনে অংশ নেয়নি বা নিরপেক্ষ ব্যবস্থায় নির্বাচনের দাবি না মেনে তাদের অংশ নিতে দেওয়া হয়নি, তাই দেশে ভোটই হয়নি। অর্ধেকেরও বেশি আসনে ক্ষমতাসীনরা বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে যান। ডিসি-এসপিদের বিরোধী দলকে পেটানো ছাড়া ভোটের কসরত প্রদর্শন করতে হয়নি।
আমার নিজস্ব বিবেচনায় ওই সময়ে বিদেশি কূটনৈতিক চাপে শেখ হাসিনা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ কয়েকটি মন্ত্রণালয় বিএনপিকে দিয়ে যে নির্বাচনকালীন সরকারের ফর্মুলা প্রস্তাব করেছিলেনÑ দেশে পার্লামেন্টারি রাজনীতি অব্যাহত রাখার স্বার্থে খালেদা জিয়া আপোসহীন না থেকে তা মেনে নিলে মন্দের ভালো হতে পারতো। সেটি না হওয়ায় কার্যত শেখ হাসিনার নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার সুযোগ তৈরি হয়। অনেকটা একদলীয় বা প্রকৃত অর্থে শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা কায়েম হয়। এসব ভিন্ন রাজনৈতিক আলোচনা। আলোচনা হচ্ছিল ডিসি-এসপিদের নিয়ে।
২০১৮ সালে পার্লামেন্টারি রাজনীতি ও নির্বাচনের ধারা ফিরিয়ে আনতে প্রবীণ রাজনীতিক ড. কামাল হোসেন বিশেষ উদ্যোগ নেন। তিনি দূতিয়ালী করে বিএনপি নেতৃত্ব ও শেখ হাসিনার সাথে বৈঠক অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করেন। শেখ হাসিনা সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের বিষয়ে বিরোধী শিবিরকে আশ্বস্ত করেন।
শোনা যায়, সরকারের শীর্ষস্থানীয়রা বিএনপিকে এই মর্মে আশ্বস্ত করেন যে, নির্বাচনে অন্তত ৭০ থেকে ১০০টি আসনে সরকারি কোন হস্তক্ষেপ থাকবে না। দেশবাসী আশা করেছিলেন, এবার অন্তত একদলীয় পার্লামেন্ট হবে না; কিন্তু কিসের কী? সেবার গিনেস বিশ্ব রেকর্ডে নাম লিখিয়ে হলো নৈশভোট। যার আয়োজক ছিলেন ডিসি-এসপিরা।
‘সারা বিশ্ব অবাক তাকিয়ে রয়/বাংলার ডিসি-এসপিরা মাথা নোয়াবার নয়’! তারা ৭০-এর শূন্য কেটে দিয়ে বিএনপির আসন ৭-এ রাখলেন। আমাদের বন্ধু ডাকসুর প্রাক্তন ভিপি সুলতান মনসুর প্রার্থী হয়েছিলেন মৌলভীবাজার জেলার একটি আসন থেকে বিএনপির সমর্থনে গণফোরাম দলের প্রার্থী হয়ে। গণনা কেন্দ্রে গিয়ে দেখেন সরকারদলীয় প্রার্থীর নাম বিজয়ী হিসেবে ঘোষণার প্রস্তুতি সম্পন্ন। তিনি ছুটলেন ডিসির কাছে। ডিসি বলেন- তার কী করার আছে। গণনায় যিনি এগিয়ে থাকবেন তিনিই বিজয়ী হবেন। সুলতান মনসুর তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন তার আসন সমঝোতার আসন। অন্য আসনের স্টাইলে গণনা এখানে হওয়ার কথা নয়। কে শোনে সুলতান মনসুরের আহাজারি! অবশেষে তিনি ঢাকায় প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়, নির্বাচন কমিশন কার্যালয়, হিল্লিদিল্লি করে যথাযথ স্থানের সাথে ডিসির সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিতে সমর্থ হন এবং কেল্লা ফতেহ! সুলতান মনসুর বিজয়ী ঘোষিত হন। ডিসির মন খারাপ। অন্য ডিসিদের চেয়ে তিনি পিছিয়ে গেলেন!
ডিসি-এসপিরা এ ধরনের মনোভাব থেকে বেরিয়ে আসতে পারছেন না। প্রায় সব রাজনৈতিক সরকারের আমলে ওনারা কমবেশি এভাবেই চলেছেন। তবে এবারে একনাগাড়ে পনেরো বছর একই রাজনৈতিক দলের কর্তৃত্ববাদী একটি সরকার ক্ষমতায় থাকায় তারা বোধহয় ভুলেই গিয়েছিলেন যে তারা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী, কোন দলের আজ্ঞাবহ কর্মকর্তা ন এবং এখনও সেই ধারায় আছেন। না থেকেই বা উপায় কি। হাসিনা সরকার পতনের পর তো সচিবালয়ের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন কথিত সমন্বয়কেরা। পদোন্নতি, বদলি, শাস্তি এসব ব্যাপারে চলে তাদের খবরদারি। সারাদেশে সমন্বয়কদের জন্য ঘোষিত-অঘোষিত সরকারি প্রটোকল ব্যবস্থা থাকার কারনে আগের আমলের মতই সৃষ্টি হয় নতুন বাহাদুরি। ছাত্র সমন্বয়করা রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠার পথে অগ্রসর হলে তাদের জন্য প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে মেলে আগের মতো সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা।
ছাত্র-তরুণদের নতুন দলের প্রথম ঢাকা সমাবেশ উপলক্ষে সারাদেশের জেলা প্রশাসনই সহায়তা করেছে। নতুন দলের প্রতিনিধিরা যেহেতু সরকারেও আছেন তাই কেন্দ্রীয়ভাবেও তারা পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছেন; কিন্তু সবাইকে তাক করে দিয়ে প্রথম স্থান অধিকার করে নিলেন পিরোজপুরের ডিসি। তিনি তার সরকারি দপ্তর থেকে রীতিমতো ‘প্রজ্ঞাপন’ জারি করে বাস মালিকদের নির্দেশনা দিয়ে দেন, নতুন দলের অভিষেককে স্মরণীয় করে রাখতে কিভাবে সহায়তা করতে হবে। অন্যান্য ডিসিদের মন খারাপ।
তারা পিরোজপুরের ডিসি অপেক্ষা অনেক বেশি সহায়তা দেওয়ার পরেও প্রচারের আলোয় আসতে পারলেন না। লালমনিরহাট জেলার ডিসি তক্কে তক্কে ছিলেন কিভাবে দক্ষিণ বাংলার পিরোজপুরকে হারিয়ে ‘সমন্বয়ক ট্রফি’ উত্তরবঙ্গে নিয়ে আসা যায়। উত্তরবঙ্গের সিপাহসালারও ইতোমধ্যে পঞ্চগড়ের সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়ে নির্বাচনী বৈঠক করে দক্ষিণবঙ্গ অপেক্ষা এগিয়ে আছেন। দক্ষিণবঙ্গের সিপাহসালার আবার নির্বাচনে বিশ্বাসী নন। তিনি ব্যস্ত আছেন সেনানিবাস আর সেকেন্ড রিপাবলিক নিয়ে। এ সুযোগে লালমনিরহাট জেলার ডিসি পরপর দুই ছক্কা হাঁকিয়ে পিরোজপুরের ডিসিকে হারিয়ে দিলেন।
এই ডিসি প্রথম ছক্কা মারলেন ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের দিনে, লালমনিরহাট মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি স্মারক মঞ্চের ম্যুরাল কাপড় দিয়ে ঢেকে রেখে। দ্বিতীয় ছক্কাটি মারলেন সমন্বয়ক বাহিনী ও নাগরিক পার্টির নির্দেশমতো ৩০ মার্চ ম্যুরালটির অংশবিশেষ ভেঙে দিয়ে। তিনি গেয়ে উঠলেন- ‘কুলমাখলুকে জাগে রোমাঞ্চ, জিন্দা পাকিস্তান’।
এ বিষয়ে লালমনিরহাটের ডিসি এইচএম রকিব হায়দার সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবের চেতনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রতীয়মান না হওয়ায় ম্যুরালটি কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছিল এবং এরপর অংশবিশেষ অপসারণ করা হয়েছে।’ ডিসিকে ২০২৪-এর চেতনার ঠিকাদারি কে দিলো?
ম্যুরালে কী ছিলো? ম্যুরালে ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পটভূমি, ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ, স্বাধীনতাযুদ্ধ, মুজিবনগর সরকার গঠন, স্বাধীন ভূখ-ে নব রবির উদয়, ’৭১-এর গণহত্যা, বিজয়ে উচ্ছ্বসিত বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাতজন বীরশ্রেষ্ঠ, পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ, জাতীয় পতাকা হাতে উল্লসিত জনতা ইত্যাদি। জনাব রকিব হায়দার এর কোন অংশ ‘আপনার ২০২৪-এর চেতনা’ বিরোধী? গত পনেরো বছর আপনারা এক ধরনের চেতনা ব্যবসা করে এসেছেন, এখন আবার নতুন চেতনা ব্যবসা শুরু করলেন! ম্যুরালটিতে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে এককেন্দ্রিক না করে বরং বহুমাত্রিকভাবে দেখানো হয়েছে। ডিসি, আপনি ইতিহাসকে বিকৃত করছেন।
আপনার কাছ থেকে বা তথাকথিত সমন্বয়কদের কাছ থেকে মুক্তিযোদ্ধারা এবং দেশবাসী ইতিহাসের পাঠ শিখবে না। আপনি পিরোজপুরের ডিসিকে হারিয়ে দিয়ে ‘সমন্বয়ক ট্রফি’ জিতেছেন। আপনাকে অভিনন্দন! তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত হবেÑ এই চেতনা ব্যবসায়ী ডিসিকে অবিলম্বে অপসারণ করা।
[লেখক : সাবেক ছাত্রনেতা]
আনোয়ারুল হক
২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের দিন ঢেকে রাখা লালমনিরহাট মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি স্মারক মঞ্চের ম্যুরাল এবং ৩০ মার্চ ম্যুরালের কিছু অংশ ভেঙে ফেলার দৃশ্য
শনিবার, ০৫ এপ্রিল ২০২৫
শেখ হাসিনার শাসনামলে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় ডিসিদের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতা থাকতো- কে কত বেশি ভোটের ব্যবধানে সরকারি দলের প্রার্থীকে বিজয়ী করতে পারে। যাদের জেলায় ব্যবধান বেশি হবে তারাই ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের’ ডিসি হিসেবে বিবেচিত হবেন এবং ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের’ সরকার তাকে ততো পুরস্কৃত করবেন। আর এ কাজে ডিসিদের প্রধান সহযোগী ও পুরস্কারের তালিকায় নাম থাকা কর্মকতা ছিলেন এসপি।
২০১৪ সালে বিরোধী দল যেহেতু নির্বাচনে অংশ নেয়নি বা নিরপেক্ষ ব্যবস্থায় নির্বাচনের দাবি না মেনে তাদের অংশ নিতে দেওয়া হয়নি, তাই দেশে ভোটই হয়নি। অর্ধেকেরও বেশি আসনে ক্ষমতাসীনরা বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে যান। ডিসি-এসপিদের বিরোধী দলকে পেটানো ছাড়া ভোটের কসরত প্রদর্শন করতে হয়নি।
আমার নিজস্ব বিবেচনায় ওই সময়ে বিদেশি কূটনৈতিক চাপে শেখ হাসিনা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ কয়েকটি মন্ত্রণালয় বিএনপিকে দিয়ে যে নির্বাচনকালীন সরকারের ফর্মুলা প্রস্তাব করেছিলেনÑ দেশে পার্লামেন্টারি রাজনীতি অব্যাহত রাখার স্বার্থে খালেদা জিয়া আপোসহীন না থেকে তা মেনে নিলে মন্দের ভালো হতে পারতো। সেটি না হওয়ায় কার্যত শেখ হাসিনার নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার সুযোগ তৈরি হয়। অনেকটা একদলীয় বা প্রকৃত অর্থে শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা কায়েম হয়। এসব ভিন্ন রাজনৈতিক আলোচনা। আলোচনা হচ্ছিল ডিসি-এসপিদের নিয়ে।
২০১৮ সালে পার্লামেন্টারি রাজনীতি ও নির্বাচনের ধারা ফিরিয়ে আনতে প্রবীণ রাজনীতিক ড. কামাল হোসেন বিশেষ উদ্যোগ নেন। তিনি দূতিয়ালী করে বিএনপি নেতৃত্ব ও শেখ হাসিনার সাথে বৈঠক অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করেন। শেখ হাসিনা সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের বিষয়ে বিরোধী শিবিরকে আশ্বস্ত করেন।
শোনা যায়, সরকারের শীর্ষস্থানীয়রা বিএনপিকে এই মর্মে আশ্বস্ত করেন যে, নির্বাচনে অন্তত ৭০ থেকে ১০০টি আসনে সরকারি কোন হস্তক্ষেপ থাকবে না। দেশবাসী আশা করেছিলেন, এবার অন্তত একদলীয় পার্লামেন্ট হবে না; কিন্তু কিসের কী? সেবার গিনেস বিশ্ব রেকর্ডে নাম লিখিয়ে হলো নৈশভোট। যার আয়োজক ছিলেন ডিসি-এসপিরা।
‘সারা বিশ্ব অবাক তাকিয়ে রয়/বাংলার ডিসি-এসপিরা মাথা নোয়াবার নয়’! তারা ৭০-এর শূন্য কেটে দিয়ে বিএনপির আসন ৭-এ রাখলেন। আমাদের বন্ধু ডাকসুর প্রাক্তন ভিপি সুলতান মনসুর প্রার্থী হয়েছিলেন মৌলভীবাজার জেলার একটি আসন থেকে বিএনপির সমর্থনে গণফোরাম দলের প্রার্থী হয়ে। গণনা কেন্দ্রে গিয়ে দেখেন সরকারদলীয় প্রার্থীর নাম বিজয়ী হিসেবে ঘোষণার প্রস্তুতি সম্পন্ন। তিনি ছুটলেন ডিসির কাছে। ডিসি বলেন- তার কী করার আছে। গণনায় যিনি এগিয়ে থাকবেন তিনিই বিজয়ী হবেন। সুলতান মনসুর তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন তার আসন সমঝোতার আসন। অন্য আসনের স্টাইলে গণনা এখানে হওয়ার কথা নয়। কে শোনে সুলতান মনসুরের আহাজারি! অবশেষে তিনি ঢাকায় প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়, নির্বাচন কমিশন কার্যালয়, হিল্লিদিল্লি করে যথাযথ স্থানের সাথে ডিসির সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিতে সমর্থ হন এবং কেল্লা ফতেহ! সুলতান মনসুর বিজয়ী ঘোষিত হন। ডিসির মন খারাপ। অন্য ডিসিদের চেয়ে তিনি পিছিয়ে গেলেন!
ডিসি-এসপিরা এ ধরনের মনোভাব থেকে বেরিয়ে আসতে পারছেন না। প্রায় সব রাজনৈতিক সরকারের আমলে ওনারা কমবেশি এভাবেই চলেছেন। তবে এবারে একনাগাড়ে পনেরো বছর একই রাজনৈতিক দলের কর্তৃত্ববাদী একটি সরকার ক্ষমতায় থাকায় তারা বোধহয় ভুলেই গিয়েছিলেন যে তারা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী, কোন দলের আজ্ঞাবহ কর্মকর্তা ন এবং এখনও সেই ধারায় আছেন। না থেকেই বা উপায় কি। হাসিনা সরকার পতনের পর তো সচিবালয়ের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন কথিত সমন্বয়কেরা। পদোন্নতি, বদলি, শাস্তি এসব ব্যাপারে চলে তাদের খবরদারি। সারাদেশে সমন্বয়কদের জন্য ঘোষিত-অঘোষিত সরকারি প্রটোকল ব্যবস্থা থাকার কারনে আগের আমলের মতই সৃষ্টি হয় নতুন বাহাদুরি। ছাত্র সমন্বয়করা রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠার পথে অগ্রসর হলে তাদের জন্য প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে মেলে আগের মতো সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা।
ছাত্র-তরুণদের নতুন দলের প্রথম ঢাকা সমাবেশ উপলক্ষে সারাদেশের জেলা প্রশাসনই সহায়তা করেছে। নতুন দলের প্রতিনিধিরা যেহেতু সরকারেও আছেন তাই কেন্দ্রীয়ভাবেও তারা পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছেন; কিন্তু সবাইকে তাক করে দিয়ে প্রথম স্থান অধিকার করে নিলেন পিরোজপুরের ডিসি। তিনি তার সরকারি দপ্তর থেকে রীতিমতো ‘প্রজ্ঞাপন’ জারি করে বাস মালিকদের নির্দেশনা দিয়ে দেন, নতুন দলের অভিষেককে স্মরণীয় করে রাখতে কিভাবে সহায়তা করতে হবে। অন্যান্য ডিসিদের মন খারাপ।
তারা পিরোজপুরের ডিসি অপেক্ষা অনেক বেশি সহায়তা দেওয়ার পরেও প্রচারের আলোয় আসতে পারলেন না। লালমনিরহাট জেলার ডিসি তক্কে তক্কে ছিলেন কিভাবে দক্ষিণ বাংলার পিরোজপুরকে হারিয়ে ‘সমন্বয়ক ট্রফি’ উত্তরবঙ্গে নিয়ে আসা যায়। উত্তরবঙ্গের সিপাহসালারও ইতোমধ্যে পঞ্চগড়ের সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়ে নির্বাচনী বৈঠক করে দক্ষিণবঙ্গ অপেক্ষা এগিয়ে আছেন। দক্ষিণবঙ্গের সিপাহসালার আবার নির্বাচনে বিশ্বাসী নন। তিনি ব্যস্ত আছেন সেনানিবাস আর সেকেন্ড রিপাবলিক নিয়ে। এ সুযোগে লালমনিরহাট জেলার ডিসি পরপর দুই ছক্কা হাঁকিয়ে পিরোজপুরের ডিসিকে হারিয়ে দিলেন।
এই ডিসি প্রথম ছক্কা মারলেন ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের দিনে, লালমনিরহাট মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি স্মারক মঞ্চের ম্যুরাল কাপড় দিয়ে ঢেকে রেখে। দ্বিতীয় ছক্কাটি মারলেন সমন্বয়ক বাহিনী ও নাগরিক পার্টির নির্দেশমতো ৩০ মার্চ ম্যুরালটির অংশবিশেষ ভেঙে দিয়ে। তিনি গেয়ে উঠলেন- ‘কুলমাখলুকে জাগে রোমাঞ্চ, জিন্দা পাকিস্তান’।
এ বিষয়ে লালমনিরহাটের ডিসি এইচএম রকিব হায়দার সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবের চেতনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রতীয়মান না হওয়ায় ম্যুরালটি কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছিল এবং এরপর অংশবিশেষ অপসারণ করা হয়েছে।’ ডিসিকে ২০২৪-এর চেতনার ঠিকাদারি কে দিলো?
ম্যুরালে কী ছিলো? ম্যুরালে ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পটভূমি, ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ, স্বাধীনতাযুদ্ধ, মুজিবনগর সরকার গঠন, স্বাধীন ভূখ-ে নব রবির উদয়, ’৭১-এর গণহত্যা, বিজয়ে উচ্ছ্বসিত বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাতজন বীরশ্রেষ্ঠ, পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ, জাতীয় পতাকা হাতে উল্লসিত জনতা ইত্যাদি। জনাব রকিব হায়দার এর কোন অংশ ‘আপনার ২০২৪-এর চেতনা’ বিরোধী? গত পনেরো বছর আপনারা এক ধরনের চেতনা ব্যবসা করে এসেছেন, এখন আবার নতুন চেতনা ব্যবসা শুরু করলেন! ম্যুরালটিতে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে এককেন্দ্রিক না করে বরং বহুমাত্রিকভাবে দেখানো হয়েছে। ডিসি, আপনি ইতিহাসকে বিকৃত করছেন।
আপনার কাছ থেকে বা তথাকথিত সমন্বয়কদের কাছ থেকে মুক্তিযোদ্ধারা এবং দেশবাসী ইতিহাসের পাঠ শিখবে না। আপনি পিরোজপুরের ডিসিকে হারিয়ে দিয়ে ‘সমন্বয়ক ট্রফি’ জিতেছেন। আপনাকে অভিনন্দন! তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত হবেÑ এই চেতনা ব্যবসায়ী ডিসিকে অবিলম্বে অপসারণ করা।
[লেখক : সাবেক ছাত্রনেতা]