হৃদয় দেবনাথ
গত ১ নভেম্বর থেকে দেশে পলিথিনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। পলিথিন বন্ধে ইতোমধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করার পরও বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় সরকারের নেয়া এ উদ্যোগ তেমন কোনো কাজেই আসছে না। শপিংমল থেকে মুদি দোকানদারও ক্রেতাকে পলিথিনে করেই পণ্য ধরিয়ে দিচ্ছে। এছাড়া নিষিদ্ধের প্রায় দুই মাস পার হতে চললেও সরকারের পক্ষ থেকে পলিথিনের ওপর দৃশ্যমান বড় ধরনের কোনো অভিযান পরিচালনা করতেও দেখা যায়নি। এমতাবস্থায় ক্রেতা-বিক্রেতা পড়ছেন উভয়সংকটে।
স্বল্প মূল্যে পলিথিনের বিকল্প পথ তৈরি না করে সমাজ থেকে পলিথিন মুক্ত করা অনেক বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন সচেতন মহল। এদিকে পরিবেশ রক্ষায় সরকারের এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে দ্রুতই পলিথিনের বিকল্প ব্যাবস্থা সৃষ্টি করে পরিবেশ রক্ষায় দেশকে পলিথিন মুক্ত করার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো। পরিবেশ সুরক্ষায় বিশ্বব্যাপী উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার যেমন শেষ নেই, তেমনিভাবে প্রচার-প্রচারণা ও গবেষণার অন্ত নেই। কিন্তু বর্তমানে বিশ্বব্যাপী পরিবেশ দূষণের জন্য যেসব উপাদানকে সবচেয়ে বেশি দায়ী করা হয়, তার মধ্যে পলিথিন অন্যতম। পরিবেশ সুরক্ষার জন্য পলিথিন চরম হুমকি ও বিরাট চ্যালেঞ্জ।
নিষিদ্ধ পলিথিনের সর্বব্যাপ্ত ব্যবহারে বিপন্ন হয়ে পড়েছে দেশের প্রকৃতি পরিবেশ ও প্রতিবেশ। হাট-বাজারগুলো সয়লাব হয়ে আছে পলিথিনের শপিং ব্যাগে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা পরিবেশ অধিদপ্তর কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। নিষিদ্ধ ঘোষিত হলেও পুলিশ ও প্রশাসনের নাকের ডগায় পলিথিন উৎপাদন, বিপণন ও কেনাবেচা চলছে অবাধে। পলিথিন মূলত পলিমার জাতীয় এক ধরনের প্লাস্টিক যা মাটির মধ্যে শত শত বছরেও পচে না। এটি জমির গুণগত মান নষ্ট করে দেয় এবং মাটির উর্বরতা কমিয়ে দেয়। ফলশ্রুতিতে ফসলের উৎপাদন হ্রাস পায়। পলিথিনের কারণে মাটি তার স্বাভাবিক পানি শোষণ ক্ষমতা হারায়, ফলে জমিতে পানি জমে থাকে এবং ফসলের ক্ষতি হয়।এসব পলিথিন মাটিতে পচে না,কৃষিজমির উর্বরতা নষ্ট হয়ে ফলন কমে যায়। বাজারে মুদি দোকান থেকে শুরু করে মাছ, মাংস, শাকসবজি, ডিম, তরকারি, ফল, মিষ্টিসহ যে কোনো বিক্রীত পণ্য ভরে দেয়া হচ্ছে পলিথিনের ব্যাগে।এতে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ, ক্ষতি হচ্ছে কৃষিজমির। কমে যাচ্ছে মিঠা পানির মাছের উৎপাদন। হারিয়ে যাচ্ছে জীববৈচিত্র্য।
পলিথিন জ্বালিয়ে ফেলা হলে বায়ুম-লে বিভিন্ন বিষাক্ত গ্যাস ছড়িয়ে পড়ে। এই গ্যাসগুলো পরিবেশের ক্ষতি করে এবং মানুষের শ্বাসযন্ত্রের রোগসহ নানা শারীরিক সমস্যার সৃষ্টি করে। বিশেষ করে ডাইঅক্সিন ও ফিউরানের মতো ক্ষতিকর পদার্থগুলো ফুসফুসের রোগ এবং ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। প্রতিদিন কোটি কোটি পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার শেষে ফেলে দেয়া হয়। পলিথিনের ক্ষুদ্র কণা বা মাইক্রোপ্লাস্টিক আমাদের খাবার ও পানিতে মিশে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, এই মাইক্রোপ্লাস্টিক মানুষের শরীরে প্রবেশ করলে ক্যান্সারসহ নানা দীর্ঘমেয়াদি রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। এ ছাড়া, পলিথিনের সঙ্গে যুক্ত রাসায়নিক পদার্থগুলো শরীরের হরমোনের স্বাভাবিক কার্যকারিতাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে, যা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এসব পলিথিন ব্যাগের একটা বড় অংশ নদীতে গিয়ে পড়ছে। দীর্ঘদিন ধরে দেশের নদীগুলোর তলদেশে পলিথিনের পুরু স্তর জমেছে।
এমনিতেই দেশের প্রায় সব নদনদীতে পলিথিন-প্লাস্টিক দূষণের মারাত্মক প্রভাব রয়েছে। পলিথিন সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় সিটি করপোরেশন, জেলা শহর, পৌরসভা ও উপজেলা শহর এলাকায়। ফলে শহর এলাকার নদ-নদীগুলোই পলিথিন দূষণের শিকার হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। ঢাকার বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, বংশী, শীতলক্ষ্যা ও ধলেশ্বরী; বরিশালের কীর্তনখোলা; চট্টগ্রামের কর্ণফুলী ও হালদা নদীর তলদেশে পলিথিনের পুরু স্তর পড়েছে। ফলে নদীর দূষণ তো বটেই, জীববৈচিত্র্যও ধ্বংস হচ্ছে। পলিথিন ও প্লাস্টিক দূষণে মাছের জীবনচক্র হুমকির মুখে পড়ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরে বৃষ্টি শেষে সৃষ্ট জলাবদ্ধতার বড় কারণ এ পলিথিন। ড্রেনেজ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে পলিথিনের কারণে। সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলোয় মূলত টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে না-ওঠা এর জন্য দায়ী। ফলে মাটি, পরিবেশ বিপন্ন হয়ে আমাদের খাবারে ঢুকে পড়েছে প্লাস্টিক, পলিথিন। গরিবের সাশ্রয়ী খাবার লালসাকেও ক্যান্সার সৃষ্টিকারী লেড, ক্রোমিয়াম, ক্যাডমিয়ামসহ বেশ কয়েকটি ভারী ধাতুর উচ্চমাত্রার উপস্থিতি পাওয়া গেছে দেশের বাজারগুলো সয়লাব হয়ে আছে নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যাগে।
পরিবেশ সংরক্ষণে ২২ বছর আগে ২০০২ সালে পলিথিন শপিং ব্যাগের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে সরকার। এছাড়া পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী পলিথিনে তৈরি সব ধরনের শপিং ব্যাগ উৎপাদন, আমদানি,বাজারজাতকরণ, বিক্রি ও বিক্রির জন্য প্রদর্শন, মজুত-বিতরণ নিষিদ্ধ করা হয়। এর ব্যত্যয় হলে জেল-জরিমানার বিধান রয়েছে। অথচ এ আইন লঙ্ঘন করেই প্রশাসনের নাকের ডগায় বাজারগুলোয় অবলীলায় বিক্রি হচ্ছে পলিথিন ব্যাগ। সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সারাদেশে অবৈধ পলিথিন তৈরির কারখানা রয়েছে কমপক্ষে ৩ হাজার। এর মধ্যে পুরান ঢাকা এবং বুড়িগঙ্গার তীর ঘেঁষে রয়েছে ৭ শতাধিক কারখানা। এসব কারখানায় দৈনিক ১ কোটি ৪০ লাখ পলিথিন ব্যাগ উৎপাদিত হচ্ছে। পলিথিন মাটিতে মিশে যেতে লাগে ২০০ থেকে ৪০০ বছর। প্লাস্টিক পণ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় ক্যারিব্যাগ বা পলিব্যাগ। হিসাবমতে, গড়ে জনপ্রতি বছরে ব্যাগ বানানো হচ্ছে ৭০০টি এবং একটি ব্যাগ গড়ে সর্বোচ্চ ১২ মিনিট ব্যবহারের পরই প্রকৃতিতে স্থান নেয়।
বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (বাপা) হিসাব অনুযায়ী, শুধু ঢাকাতেই প্রতিদিন প্রায় ২ কোটি পলিথিন ব্যাগ জমা হয়। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে পলিথিনের ব্যবহার ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। পলিমারকরণ বিক্রিয়ায় ইথিন থেকে প্রাপ্ত পলিমারকে পলিথিন বলে। পরিবেশদূষণ, জীববৈচিত্র্য, অর্থনীতি ও মানবস্বাস্থ্যের জন্য পলিথিন মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। আমাদের দেশে আশির দশকে পলিথিনের ব্যবহার শুরু হলেও পলিথিনের সহজলভ্যতাই এর ব্যবহার দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে, ব্যাগ হাতে বাজারে যাওয়া যেন অসহনীয় তার চেয়ে ১০-১৫টি চকচকে পলিভর্তি বাজার নিয়ে ঘরে ফেরা বেশ আরামদায়ক।
বিশ্বব্যাপী পরিবেশদূষণের কারণগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি হলো পলিথিনের যথেচ্ছ ব্যবহার। পরিবেশবিদদের মতে, পলিথিন তৈরিতে ক্ষতিকর কেমিক্যাল ব্যবহৃত হয়, যা পরিবেশ সুরক্ষায় মোটেও উপযোগী নয়। পলিথিন এমন একটি পণ্য, যা মাটির সঙ্গে মিশতে আনুমানিক দেড় হাজার বছর সময় লাগে। পলিথিনের অবাধ ব?্যবহার বিশ্বব্যাপী একটি সমস্যা। পলিথিন অপচনশীল পদার্থ হওয়ায় এর পরিত্যক্ত অংশ মাটির অভ্যন্তরে ঢুকে মাটির উর্বরতা হ্রাস ও মাটিতে থাকা অণুজীবগুলোর স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত করে। পলিথিন শুধু মাটির গুণাগুণ নষ্ট করছে তা-ই নয় বরং বিপন্ন করে তুলছে আমাদের প্রকৃতি ও পরিবেশকেও। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পরিবেশবিরোধী প্লাস্টিক, পলিথিন ব্যবহার কমিয়ে আনতে মাঠপর্যায়ে কঠোর মনিটরিং, সমন্বিত তৎপরতা এবং ব্যাপক জনসচেতনতা দরকার। পাশাপাশি দ্রুত পচনশীল কাগজের ঠোঙা, কাগজ ও চটের ব্যাগের সহজপ্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হবে।
[লেখক : সংবাদকর্মী ]
হৃদয় দেবনাথ
রোববার, ০৬ এপ্রিল ২০২৫
গত ১ নভেম্বর থেকে দেশে পলিথিনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। পলিথিন বন্ধে ইতোমধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করার পরও বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় সরকারের নেয়া এ উদ্যোগ তেমন কোনো কাজেই আসছে না। শপিংমল থেকে মুদি দোকানদারও ক্রেতাকে পলিথিনে করেই পণ্য ধরিয়ে দিচ্ছে। এছাড়া নিষিদ্ধের প্রায় দুই মাস পার হতে চললেও সরকারের পক্ষ থেকে পলিথিনের ওপর দৃশ্যমান বড় ধরনের কোনো অভিযান পরিচালনা করতেও দেখা যায়নি। এমতাবস্থায় ক্রেতা-বিক্রেতা পড়ছেন উভয়সংকটে।
স্বল্প মূল্যে পলিথিনের বিকল্প পথ তৈরি না করে সমাজ থেকে পলিথিন মুক্ত করা অনেক বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন সচেতন মহল। এদিকে পরিবেশ রক্ষায় সরকারের এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে দ্রুতই পলিথিনের বিকল্প ব্যাবস্থা সৃষ্টি করে পরিবেশ রক্ষায় দেশকে পলিথিন মুক্ত করার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো। পরিবেশ সুরক্ষায় বিশ্বব্যাপী উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার যেমন শেষ নেই, তেমনিভাবে প্রচার-প্রচারণা ও গবেষণার অন্ত নেই। কিন্তু বর্তমানে বিশ্বব্যাপী পরিবেশ দূষণের জন্য যেসব উপাদানকে সবচেয়ে বেশি দায়ী করা হয়, তার মধ্যে পলিথিন অন্যতম। পরিবেশ সুরক্ষার জন্য পলিথিন চরম হুমকি ও বিরাট চ্যালেঞ্জ।
নিষিদ্ধ পলিথিনের সর্বব্যাপ্ত ব্যবহারে বিপন্ন হয়ে পড়েছে দেশের প্রকৃতি পরিবেশ ও প্রতিবেশ। হাট-বাজারগুলো সয়লাব হয়ে আছে পলিথিনের শপিং ব্যাগে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা পরিবেশ অধিদপ্তর কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। নিষিদ্ধ ঘোষিত হলেও পুলিশ ও প্রশাসনের নাকের ডগায় পলিথিন উৎপাদন, বিপণন ও কেনাবেচা চলছে অবাধে। পলিথিন মূলত পলিমার জাতীয় এক ধরনের প্লাস্টিক যা মাটির মধ্যে শত শত বছরেও পচে না। এটি জমির গুণগত মান নষ্ট করে দেয় এবং মাটির উর্বরতা কমিয়ে দেয়। ফলশ্রুতিতে ফসলের উৎপাদন হ্রাস পায়। পলিথিনের কারণে মাটি তার স্বাভাবিক পানি শোষণ ক্ষমতা হারায়, ফলে জমিতে পানি জমে থাকে এবং ফসলের ক্ষতি হয়।এসব পলিথিন মাটিতে পচে না,কৃষিজমির উর্বরতা নষ্ট হয়ে ফলন কমে যায়। বাজারে মুদি দোকান থেকে শুরু করে মাছ, মাংস, শাকসবজি, ডিম, তরকারি, ফল, মিষ্টিসহ যে কোনো বিক্রীত পণ্য ভরে দেয়া হচ্ছে পলিথিনের ব্যাগে।এতে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ, ক্ষতি হচ্ছে কৃষিজমির। কমে যাচ্ছে মিঠা পানির মাছের উৎপাদন। হারিয়ে যাচ্ছে জীববৈচিত্র্য।
পলিথিন জ্বালিয়ে ফেলা হলে বায়ুম-লে বিভিন্ন বিষাক্ত গ্যাস ছড়িয়ে পড়ে। এই গ্যাসগুলো পরিবেশের ক্ষতি করে এবং মানুষের শ্বাসযন্ত্রের রোগসহ নানা শারীরিক সমস্যার সৃষ্টি করে। বিশেষ করে ডাইঅক্সিন ও ফিউরানের মতো ক্ষতিকর পদার্থগুলো ফুসফুসের রোগ এবং ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। প্রতিদিন কোটি কোটি পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার শেষে ফেলে দেয়া হয়। পলিথিনের ক্ষুদ্র কণা বা মাইক্রোপ্লাস্টিক আমাদের খাবার ও পানিতে মিশে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, এই মাইক্রোপ্লাস্টিক মানুষের শরীরে প্রবেশ করলে ক্যান্সারসহ নানা দীর্ঘমেয়াদি রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। এ ছাড়া, পলিথিনের সঙ্গে যুক্ত রাসায়নিক পদার্থগুলো শরীরের হরমোনের স্বাভাবিক কার্যকারিতাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে, যা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এসব পলিথিন ব্যাগের একটা বড় অংশ নদীতে গিয়ে পড়ছে। দীর্ঘদিন ধরে দেশের নদীগুলোর তলদেশে পলিথিনের পুরু স্তর জমেছে।
এমনিতেই দেশের প্রায় সব নদনদীতে পলিথিন-প্লাস্টিক দূষণের মারাত্মক প্রভাব রয়েছে। পলিথিন সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় সিটি করপোরেশন, জেলা শহর, পৌরসভা ও উপজেলা শহর এলাকায়। ফলে শহর এলাকার নদ-নদীগুলোই পলিথিন দূষণের শিকার হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। ঢাকার বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, বংশী, শীতলক্ষ্যা ও ধলেশ্বরী; বরিশালের কীর্তনখোলা; চট্টগ্রামের কর্ণফুলী ও হালদা নদীর তলদেশে পলিথিনের পুরু স্তর পড়েছে। ফলে নদীর দূষণ তো বটেই, জীববৈচিত্র্যও ধ্বংস হচ্ছে। পলিথিন ও প্লাস্টিক দূষণে মাছের জীবনচক্র হুমকির মুখে পড়ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরে বৃষ্টি শেষে সৃষ্ট জলাবদ্ধতার বড় কারণ এ পলিথিন। ড্রেনেজ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে পলিথিনের কারণে। সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলোয় মূলত টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে না-ওঠা এর জন্য দায়ী। ফলে মাটি, পরিবেশ বিপন্ন হয়ে আমাদের খাবারে ঢুকে পড়েছে প্লাস্টিক, পলিথিন। গরিবের সাশ্রয়ী খাবার লালসাকেও ক্যান্সার সৃষ্টিকারী লেড, ক্রোমিয়াম, ক্যাডমিয়ামসহ বেশ কয়েকটি ভারী ধাতুর উচ্চমাত্রার উপস্থিতি পাওয়া গেছে দেশের বাজারগুলো সয়লাব হয়ে আছে নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যাগে।
পরিবেশ সংরক্ষণে ২২ বছর আগে ২০০২ সালে পলিথিন শপিং ব্যাগের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে সরকার। এছাড়া পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী পলিথিনে তৈরি সব ধরনের শপিং ব্যাগ উৎপাদন, আমদানি,বাজারজাতকরণ, বিক্রি ও বিক্রির জন্য প্রদর্শন, মজুত-বিতরণ নিষিদ্ধ করা হয়। এর ব্যত্যয় হলে জেল-জরিমানার বিধান রয়েছে। অথচ এ আইন লঙ্ঘন করেই প্রশাসনের নাকের ডগায় বাজারগুলোয় অবলীলায় বিক্রি হচ্ছে পলিথিন ব্যাগ। সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সারাদেশে অবৈধ পলিথিন তৈরির কারখানা রয়েছে কমপক্ষে ৩ হাজার। এর মধ্যে পুরান ঢাকা এবং বুড়িগঙ্গার তীর ঘেঁষে রয়েছে ৭ শতাধিক কারখানা। এসব কারখানায় দৈনিক ১ কোটি ৪০ লাখ পলিথিন ব্যাগ উৎপাদিত হচ্ছে। পলিথিন মাটিতে মিশে যেতে লাগে ২০০ থেকে ৪০০ বছর। প্লাস্টিক পণ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় ক্যারিব্যাগ বা পলিব্যাগ। হিসাবমতে, গড়ে জনপ্রতি বছরে ব্যাগ বানানো হচ্ছে ৭০০টি এবং একটি ব্যাগ গড়ে সর্বোচ্চ ১২ মিনিট ব্যবহারের পরই প্রকৃতিতে স্থান নেয়।
বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (বাপা) হিসাব অনুযায়ী, শুধু ঢাকাতেই প্রতিদিন প্রায় ২ কোটি পলিথিন ব্যাগ জমা হয়। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে পলিথিনের ব্যবহার ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। পলিমারকরণ বিক্রিয়ায় ইথিন থেকে প্রাপ্ত পলিমারকে পলিথিন বলে। পরিবেশদূষণ, জীববৈচিত্র্য, অর্থনীতি ও মানবস্বাস্থ্যের জন্য পলিথিন মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। আমাদের দেশে আশির দশকে পলিথিনের ব্যবহার শুরু হলেও পলিথিনের সহজলভ্যতাই এর ব্যবহার দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে, ব্যাগ হাতে বাজারে যাওয়া যেন অসহনীয় তার চেয়ে ১০-১৫টি চকচকে পলিভর্তি বাজার নিয়ে ঘরে ফেরা বেশ আরামদায়ক।
বিশ্বব্যাপী পরিবেশদূষণের কারণগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি হলো পলিথিনের যথেচ্ছ ব্যবহার। পরিবেশবিদদের মতে, পলিথিন তৈরিতে ক্ষতিকর কেমিক্যাল ব্যবহৃত হয়, যা পরিবেশ সুরক্ষায় মোটেও উপযোগী নয়। পলিথিন এমন একটি পণ্য, যা মাটির সঙ্গে মিশতে আনুমানিক দেড় হাজার বছর সময় লাগে। পলিথিনের অবাধ ব?্যবহার বিশ্বব্যাপী একটি সমস্যা। পলিথিন অপচনশীল পদার্থ হওয়ায় এর পরিত্যক্ত অংশ মাটির অভ্যন্তরে ঢুকে মাটির উর্বরতা হ্রাস ও মাটিতে থাকা অণুজীবগুলোর স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত করে। পলিথিন শুধু মাটির গুণাগুণ নষ্ট করছে তা-ই নয় বরং বিপন্ন করে তুলছে আমাদের প্রকৃতি ও পরিবেশকেও। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পরিবেশবিরোধী প্লাস্টিক, পলিথিন ব্যবহার কমিয়ে আনতে মাঠপর্যায়ে কঠোর মনিটরিং, সমন্বিত তৎপরতা এবং ব্যাপক জনসচেতনতা দরকার। পাশাপাশি দ্রুত পচনশীল কাগজের ঠোঙা, কাগজ ও চটের ব্যাগের সহজপ্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হবে।
[লেখক : সংবাদকর্মী ]