গাজী তারেক আজিজ
গাজা উপত্যকা, ফিলিস্তিনের একটি ক্ষুদ্র ভূখ-, দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েলি দখলদারিত্ব, অবরোধ এবং সংঘাতের শিকার। ইসরায়েল ও মিসরের কঠোর অবরোধের ফলে গাজার অর্থনীতি, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এবং সাধারণ জনজীবন চরমভাবে বিপর্যস্ত। গত এক দশকে এই অঞ্চল বিশ্ব রাজনীতির অন্যতম আলোচিত কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। ইসরায়েলি হামলার নৃশংসতায় গাজা আজ মানবিক বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে। ইসরায়েল-হামাস সংঘাত আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার, মানবাধিকার এবং শক্তির রাজনীতির প্রশ্নকে নতুন করে সামনে এনেছে। গাজার বর্তমান পরিস্থিতি শুধু একটি ভূখ-ের সংকট নয়, বর্তমান বিশ্বের রাজনৈতিক ও নৈতিক মূল্যবোধের প্রতিচ্ছবিও।
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি, নাকি নতুন অধ্যায়?
গাজার সংকটের শিকড় দীর্ঘ। ২০০৭ সালে হামাসের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই ভূখ- কার্যত একটি বিশাল খোলা কারাগারে রূপান্তরিত হয়েছে। ইসরায়েল ও মিশরের অবরোধ, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব এবং দারিদ্র্েযর মধ্যে আটকে থাকা প্রায় ২৩ লাখ মানুষ প্রতিদিন বেঁচে থাকার সংগ্রাম করছে। এই পরিস্থিতি বিশ্ববিবেককে স্তব্ধ করে দেয়।
তবে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া সংঘাত পূর্বের যেকোনো সময়ের চেয়ে ভয়াবহ। হামাসের হামলায় ইসরায়েলে বেসামরিক নাগরিক নিহত হওয়ার পর ইসরায়েল গাজায় পাল্টা আক্রমণ শুরু করে। কয়েক মাসের মধ্যে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, লাখ লাখ বাস্তুচ্যুত হয়েছে এবং অবকাঠামোর বিশাল অংশ ধ্বংস হয়ে গেছে। একবিংশ শতাব্দীতে এমন নির্মম ধ্বংসযজ্ঞ কল্পনা করাও কঠিন।
সাম্প্রতিক সংঘাত ও মানবিক বিপর্যয়
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের আকস্মিক হামলার পর ইসরায়েল গাজায় ব্যাপক সামরিক অভিযান শুরু করে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪৫০০০-এর বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন, যাদের অধিকাংশ নারী ও শিশু। এছাড়া, ১০৬৯৬২ জন আহত এবং হাজার হাজার মানুষ ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে জানা গেছে, ইসরায়েলি হামলায় ১৫ জন ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্যকর্মী নিহত হয়েছেন, যাদের একজন হামলার ভিডিও ধারণ করছিলেন। এই ঘটনা আন্তর্জাতিক মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে। ইসরায়েল এ বিষয়ে দুঃখ প্রকাশ করলেও, সমালোচনা থামেনি।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও দ্বৈত মানদ-
গাজার বিপর্যয়ে আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়ায় দ্বৈত মানদ- স্পষ্ট। পশ্চিমা দেশগুলো প্রথমে ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকারের পক্ষে দাঁড়ালেও, গাজায় বেসামরিক হতাহতের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সমালোচনা বেড়েছে। জাতিসংঘ বারবার যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছে, কিন্তু তা কার্যকর হয়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভূমিকায় কৌশলগত দ্বিধা প্রকাশ পেয়েছেÑএকদিকে ইসরায়েলের নিরাপত্তা, অন্যদিকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরোধিতা। এই দ্বৈত নীতি বিশ্ব দক্ষিণের দেশগুলো, বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বে, গভীর ক্ষোভ জন্ম দিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছেÑইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে পশ্চিমা বিশ্ব যেভাবে ঐক্যবদ্ধ, গাজার ক্ষেত্রে সেই নৈতিক দৃঢ়তা কোথায়?
আরব বিশ্বের মৌনতা ও বাস্তবতা
আরব বিশ্বের প্রতিক্রিয়াও প্রশ্নের মুখে। জনগণের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও প্রতিবাদ থাকলেও, অনেক সরকার কৌশলগত নীরবতা পালন করেছে। সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশগুলো ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পথে এগিয়ে গেলেও, গাজার সংঘাত তা পুরোপুরি বন্ধ করেনি। মিসরের ভূমিকাও সমালোচিতÑরাফা সীমান্ত সাময়িকভাবে খুললেও, বেশিরভাগ সময় বন্ধ রেখে মানবিক সাহায্য ও আহতদের চিকিৎসায় বাধা সৃষ্টি করেছে। এটি প্রমাণ করে, গাজার সংকট শুধু ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্ব নয়, আরব বিশ্বের রাজনৈতিক বাস্তবতারও প্রতিফলন।
ঘামাস : প্রতিরোধ না সন্ত্রাস?
হামাসের ভূমিকা বিতর্কের কেন্দ্রে। তারা নিজেদের প্রতিরোধ আন্দোলন হিসেবে দাবি করলেও, বেসামরিক নাগরিকদের লক্ষ্য করে হামলার কারণে আন্তর্জাতিক মহলে তাদের সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এতে ফিলিস্তিনিদের ন্যায্য অধিকারের দাবি ম্লান হয়ে পড়ে। হামাসের অস্তিত্ব ইসরায়েলকে আগ্রাসনের জন্য একটি ‘নিরাপত্তা হুমকি’র অজুহাত দেয়, যা মার্কিন ও মিত্র শক্তির সমর্থনে বৈধতা পায়। তবে হামাসের উত্থানের মূলে রয়েছে ইসরায়েলি দখলদারিত্ব, রাজনৈতিক দমন ও ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার থেকে বঞ্চনাÑএগুলো উপেক্ষা করে শুধু তাদের প্রতিক্রিয়াকে দোষারোপ করা কি যথাযথ?
মিডিয়া ও তথ্যযুদ্ধ
গাজার সংঘাত তথ্যযুদ্ধের নতুন মাত্রা যোগ করেছে। পশ্চিমা মূলধারার মিডিয়ায় প্রায়ই পক্ষপাত দেখা যায়, যেখানে ইসরায়েলের ক্ষয়ক্ষতি বেশি গুরুত্ব পায়, আর গাজার গণহত্যা গৌণ হয়ে পড়ে। তবে সামাজিক মাধ্যমে ফিলিস্তিনপন্থি আন্দোলন, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে, জোয়ার সৃষ্টি করেছে। ছবি, ভিডিও ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা শেয়ারের মাধ্যমে বাস্তব চিত্র ফুটে উঠছে। ইসরায়েল ইন্টারনেট ও বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করলেও, তথ্যপ্রবাহ পুরোপুরি বন্ধ করতে পারেনি।
অবকাঠামো ধ্বংস ও বাস্তুচ্যুতি
ইসরায়েলের অবিরাম বোমাবর্ষণে গাজার অবকাঠামো প্রায় সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও বাসস্থান ধ্বংসের ফলে প্রায় ৯০% জনগণ বাস্তুচ্যুত। তারা অস্থায়ী শিবিরে অমানবিক পরিস্থিতিতে বসবাস করছে, যেখানে মৌলিক সেবা ও নিরাপত্তার অভাব চরম।
সামনে কী?
গাজার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে মানবিক বিপর্যয় আরও গভীর হবে। যুদ্ধ থামলেও, পুনর্গঠন, পুনর্বাসন ও রাজনৈতিক সমাধান ছাড়া এটি শুধু অস্থায়ী বিরতি হবে। দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান আজ প্রায় অবাস্তব মনে হয়, পশ্চিম তীরে বসতি সম্প্রসারণ, জেরুজালেমের অবস্থান এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে এই পথ বন্ধ।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও জাতিসংঘের ভূমিকা
জাতিসংঘ বারবার যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানালেও তা ব্যর্থ হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো ইসরায়েলের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে, যা অনেকের কাছে একপেশে মনে হয়। অস্ট্রেলিয়াসহ কিছু দেশ স্বাস্থ্যকর্মী হত্যার ঘটনায় স্বাধীন তদন্তের দাবি জানিয়েছে।
পরিশেষে, দীর্ঘমেয়াদি সমাধান তখনই সম্ভব, যখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দ্বৈত নীতি ত্যাগ করে ফিলিস্তিনিদের ন্যায্য অধিকার স্বীকৃতি দেবে এবং ইসরায়েলকে আন্তর্জাতিক আইন মানতে বাধ্য করবে। নইলে, গাজার ধ্বংসস্তূপে শুধু মানুষ নয়, মানবতা, ন্যায়বিচার ও বিশ্ববিবেকও চাপা পড়বে। সময়মতো উত্তরণের পথ না খুঁজলে, এই সহিংসতা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়তে পারে।
[লেখক : অ্যাডভোকেট, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ফেনী ]
গাজী তারেক আজিজ
সোমবার, ০৭ এপ্রিল ২০২৫
গাজা উপত্যকা, ফিলিস্তিনের একটি ক্ষুদ্র ভূখ-, দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েলি দখলদারিত্ব, অবরোধ এবং সংঘাতের শিকার। ইসরায়েল ও মিসরের কঠোর অবরোধের ফলে গাজার অর্থনীতি, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এবং সাধারণ জনজীবন চরমভাবে বিপর্যস্ত। গত এক দশকে এই অঞ্চল বিশ্ব রাজনীতির অন্যতম আলোচিত কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। ইসরায়েলি হামলার নৃশংসতায় গাজা আজ মানবিক বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে। ইসরায়েল-হামাস সংঘাত আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার, মানবাধিকার এবং শক্তির রাজনীতির প্রশ্নকে নতুন করে সামনে এনেছে। গাজার বর্তমান পরিস্থিতি শুধু একটি ভূখ-ের সংকট নয়, বর্তমান বিশ্বের রাজনৈতিক ও নৈতিক মূল্যবোধের প্রতিচ্ছবিও।
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি, নাকি নতুন অধ্যায়?
গাজার সংকটের শিকড় দীর্ঘ। ২০০৭ সালে হামাসের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই ভূখ- কার্যত একটি বিশাল খোলা কারাগারে রূপান্তরিত হয়েছে। ইসরায়েল ও মিশরের অবরোধ, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব এবং দারিদ্র্েযর মধ্যে আটকে থাকা প্রায় ২৩ লাখ মানুষ প্রতিদিন বেঁচে থাকার সংগ্রাম করছে। এই পরিস্থিতি বিশ্ববিবেককে স্তব্ধ করে দেয়।
তবে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া সংঘাত পূর্বের যেকোনো সময়ের চেয়ে ভয়াবহ। হামাসের হামলায় ইসরায়েলে বেসামরিক নাগরিক নিহত হওয়ার পর ইসরায়েল গাজায় পাল্টা আক্রমণ শুরু করে। কয়েক মাসের মধ্যে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, লাখ লাখ বাস্তুচ্যুত হয়েছে এবং অবকাঠামোর বিশাল অংশ ধ্বংস হয়ে গেছে। একবিংশ শতাব্দীতে এমন নির্মম ধ্বংসযজ্ঞ কল্পনা করাও কঠিন।
সাম্প্রতিক সংঘাত ও মানবিক বিপর্যয়
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের আকস্মিক হামলার পর ইসরায়েল গাজায় ব্যাপক সামরিক অভিযান শুরু করে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪৫০০০-এর বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন, যাদের অধিকাংশ নারী ও শিশু। এছাড়া, ১০৬৯৬২ জন আহত এবং হাজার হাজার মানুষ ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে জানা গেছে, ইসরায়েলি হামলায় ১৫ জন ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্যকর্মী নিহত হয়েছেন, যাদের একজন হামলার ভিডিও ধারণ করছিলেন। এই ঘটনা আন্তর্জাতিক মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে। ইসরায়েল এ বিষয়ে দুঃখ প্রকাশ করলেও, সমালোচনা থামেনি।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও দ্বৈত মানদ-
গাজার বিপর্যয়ে আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়ায় দ্বৈত মানদ- স্পষ্ট। পশ্চিমা দেশগুলো প্রথমে ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকারের পক্ষে দাঁড়ালেও, গাজায় বেসামরিক হতাহতের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সমালোচনা বেড়েছে। জাতিসংঘ বারবার যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছে, কিন্তু তা কার্যকর হয়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভূমিকায় কৌশলগত দ্বিধা প্রকাশ পেয়েছেÑএকদিকে ইসরায়েলের নিরাপত্তা, অন্যদিকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরোধিতা। এই দ্বৈত নীতি বিশ্ব দক্ষিণের দেশগুলো, বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বে, গভীর ক্ষোভ জন্ম দিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছেÑইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে পশ্চিমা বিশ্ব যেভাবে ঐক্যবদ্ধ, গাজার ক্ষেত্রে সেই নৈতিক দৃঢ়তা কোথায়?
আরব বিশ্বের মৌনতা ও বাস্তবতা
আরব বিশ্বের প্রতিক্রিয়াও প্রশ্নের মুখে। জনগণের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও প্রতিবাদ থাকলেও, অনেক সরকার কৌশলগত নীরবতা পালন করেছে। সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশগুলো ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পথে এগিয়ে গেলেও, গাজার সংঘাত তা পুরোপুরি বন্ধ করেনি। মিসরের ভূমিকাও সমালোচিতÑরাফা সীমান্ত সাময়িকভাবে খুললেও, বেশিরভাগ সময় বন্ধ রেখে মানবিক সাহায্য ও আহতদের চিকিৎসায় বাধা সৃষ্টি করেছে। এটি প্রমাণ করে, গাজার সংকট শুধু ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্ব নয়, আরব বিশ্বের রাজনৈতিক বাস্তবতারও প্রতিফলন।
ঘামাস : প্রতিরোধ না সন্ত্রাস?
হামাসের ভূমিকা বিতর্কের কেন্দ্রে। তারা নিজেদের প্রতিরোধ আন্দোলন হিসেবে দাবি করলেও, বেসামরিক নাগরিকদের লক্ষ্য করে হামলার কারণে আন্তর্জাতিক মহলে তাদের সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এতে ফিলিস্তিনিদের ন্যায্য অধিকারের দাবি ম্লান হয়ে পড়ে। হামাসের অস্তিত্ব ইসরায়েলকে আগ্রাসনের জন্য একটি ‘নিরাপত্তা হুমকি’র অজুহাত দেয়, যা মার্কিন ও মিত্র শক্তির সমর্থনে বৈধতা পায়। তবে হামাসের উত্থানের মূলে রয়েছে ইসরায়েলি দখলদারিত্ব, রাজনৈতিক দমন ও ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার থেকে বঞ্চনাÑএগুলো উপেক্ষা করে শুধু তাদের প্রতিক্রিয়াকে দোষারোপ করা কি যথাযথ?
মিডিয়া ও তথ্যযুদ্ধ
গাজার সংঘাত তথ্যযুদ্ধের নতুন মাত্রা যোগ করেছে। পশ্চিমা মূলধারার মিডিয়ায় প্রায়ই পক্ষপাত দেখা যায়, যেখানে ইসরায়েলের ক্ষয়ক্ষতি বেশি গুরুত্ব পায়, আর গাজার গণহত্যা গৌণ হয়ে পড়ে। তবে সামাজিক মাধ্যমে ফিলিস্তিনপন্থি আন্দোলন, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে, জোয়ার সৃষ্টি করেছে। ছবি, ভিডিও ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা শেয়ারের মাধ্যমে বাস্তব চিত্র ফুটে উঠছে। ইসরায়েল ইন্টারনেট ও বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করলেও, তথ্যপ্রবাহ পুরোপুরি বন্ধ করতে পারেনি।
অবকাঠামো ধ্বংস ও বাস্তুচ্যুতি
ইসরায়েলের অবিরাম বোমাবর্ষণে গাজার অবকাঠামো প্রায় সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও বাসস্থান ধ্বংসের ফলে প্রায় ৯০% জনগণ বাস্তুচ্যুত। তারা অস্থায়ী শিবিরে অমানবিক পরিস্থিতিতে বসবাস করছে, যেখানে মৌলিক সেবা ও নিরাপত্তার অভাব চরম।
সামনে কী?
গাজার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে মানবিক বিপর্যয় আরও গভীর হবে। যুদ্ধ থামলেও, পুনর্গঠন, পুনর্বাসন ও রাজনৈতিক সমাধান ছাড়া এটি শুধু অস্থায়ী বিরতি হবে। দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান আজ প্রায় অবাস্তব মনে হয়, পশ্চিম তীরে বসতি সম্প্রসারণ, জেরুজালেমের অবস্থান এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে এই পথ বন্ধ।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও জাতিসংঘের ভূমিকা
জাতিসংঘ বারবার যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানালেও তা ব্যর্থ হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো ইসরায়েলের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে, যা অনেকের কাছে একপেশে মনে হয়। অস্ট্রেলিয়াসহ কিছু দেশ স্বাস্থ্যকর্মী হত্যার ঘটনায় স্বাধীন তদন্তের দাবি জানিয়েছে।
পরিশেষে, দীর্ঘমেয়াদি সমাধান তখনই সম্ভব, যখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দ্বৈত নীতি ত্যাগ করে ফিলিস্তিনিদের ন্যায্য অধিকার স্বীকৃতি দেবে এবং ইসরায়েলকে আন্তর্জাতিক আইন মানতে বাধ্য করবে। নইলে, গাজার ধ্বংসস্তূপে শুধু মানুষ নয়, মানবতা, ন্যায়বিচার ও বিশ্ববিবেকও চাপা পড়বে। সময়মতো উত্তরণের পথ না খুঁজলে, এই সহিংসতা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়তে পারে।
[লেখক : অ্যাডভোকেট, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ফেনী ]