গৌতম রায়
ভারতে যে ওয়াকফ আইন ছিল, সেটি ভারত সরকার কর্তৃক দেশের সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়ের জন্য কোনো দয়ার দান ছিল না। ভারতের স্বাধীনতা যখন ব্রিটিশের কাছ থেকে হস্তান্তরিত হয় ৪৭ সালে, সেই হস্তান্তরের চুক্তির মধ্যেই উল্লিখিত ছিল, স্বাধীন ভারতে সংখ্যালঘু মুসলমানসহ অন্যান্য সব ধর্মীয়, ভাষাগত, জাতিগত, সংখ্যালঘু মানুষ; ব্রিটিশ শাসনকালে যেসব ব্যক্তিগত আইনের সুযোগ সুবিধা পাচ্ছেন; স্বাধীন ভারতেও সেই সুযোগ সুবিধে তারা পাবেন। ক্ষমতা হস্তান্তরের চুক্তিতে ব্রিটিশ সরকারের প্রতিনিধি এবং ভারতের তৎকালীন নেতারা যে স্বাক্ষর করেছিলেন তারই ভিত্তিতে মুসলমান সম্প্রদায়ের ব্যক্তিগত আইন আছে। ব্যক্তিগত আইনেরই অংশ হলো এই ওয়াকফ। দীর্ঘদিন ধরে ভারতের বুকে যে সমস্ত দানবীর মুসলমানেরা তাদের নিজেদের সম্প্রদায়ের অর্থ, সামাজিক- সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় উন্নতির জন্য নিজেদের সম্পত্তি ওয়াকফবদ্ধ করেছেন, তার রক্ষণাবেক্ষণ বহমানতা এবং যাদের উদ্দেশ্যে এই ওয়াকফ সম্পত্তির বিলি ব্যবস্থা করা হয়েছে, সেগুলো যাতে সঠিকভাবে ব্যবহৃত হয়, সেই জন্য ওয়াকফ আইন চলে আসছে।
পরবর্তী সময়ে ভারতের সংবিধান যখন গৃহীত হয়, সেটি এই ক্ষমতা হস্তান্তরের চুক্তির ওপর ভিত্তি করেই রচিত হয়েছিল। সেখানে সংখ্যালঘু মুসলমানদের ব্যক্তিগত আইন ওয়াকফসহ সমস্ত কিছু বজায় রাখবার বিষয়টি স্বীকৃতি লাভ করেছে। তাই এখন হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি সংগঠন বিজেপির দাবি অনুযায়ী যদি মুসলমানদের ব্যক্তিগত আইন অস্বীকার করা হয়, তাহলে ক্ষমতা হস্তান্তরের চুক্তিটিকেই অস্বীকার করা হবে। যার ফলে, ভারতের সংবিধানের কার্যত কোনো অস্তিত্ব থাকবে না।
হিন্দুত্ববাদীরা অবশ্য এটাই চায়। ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানকে বাতিল করে, রাজনৈতিক হিন্দু রাষ্ট্রে ভারতকে তারা পরিণত করতে চায়। সেই লক্ষ্যেই তারা দীর্ঘদিন ধরে ওয়াকফ সম্পত্তি ঘিরে, আইন ঘিরে নানা ধরনের কথাবার্তা বলে আসছে। যার জেরে হিন্দু-মুসলমানের বিভাজনের অক্ষরেখাটি আরও বেশি শক্তিশালী হচ্ছে।
ওয়াকফ বোর্ড হলো ধর্মের স্বার্থে সৃষ্টিকর্তার কাছে নিবেদিত সম্পত্তি। এই সম্পত্তি সমাজের গরিব মানুষদের কল্যাণে এবং ধর্মীয় আচরণের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবহৃত হবে। তত্ত্বগতভাবে ওয়াকফ সম্পত্তি কখনো কোনো রকমই হস্তান্তর করা যায় না। এই সম্পত্তির স্থায়িত্ব সামগ্রিক। ওয়াকফ সম্পত্তির মালিকানা হলো মহান আল্লাহর। যেহেতু আল্লাহর পার্থিব সমাজে শারীরিক উপস্থিতি উপলব্ধির বিষয়, তাই সম্পত্তির দেখভালের মালিকানা আসে ওয়াকফ মুতাওয়াল্লির ওপরে।
ভারতে সুলতানি শাসনের বহু থেকেই ওয়াকফ সম্পত্তি ছিল এই অঞ্চলের বিভিন্ন প্রান্তে মুসলমান জনবসতিতে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ভারতের সুলতানি শাসনের আগে সমুদ্র উপকূলে মালাবার, গুজরাট এবং চট্টগ্রাম অঞ্চলে মুসলমান সমাজের বসতি ছিল। ভারতে ইসলাম আসে প্রধানতঃ বাণিজ্য সূত্রে আর সুফি প্রচারকদের প্রচারের মধ্যে দিয়ে।
ব্রিটিশ শাসন আমলে ১৮১০ সালে ওয়াকফ সংক্রান্ত প্রথম আইন প্রণীত হয়। ঐতিহ্য পরপম্পরাই ওয়াকফ সম্পত্তি মুতাওয়াল্লিরা রক্ষণাবেক্ষণ করেন এবং শরিয়া আদালতের কাজিরা সে সম্পর্কে বিচার করেন। ১৮১০ সালে ব্রিটিশরা এই সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রথম আইন প্রণয়ন করে। স্বাধীন ভারতে ১৯৫৪ সালে ওয়াকফ আইন গৃহীত হয়। পরে সেটি সংশোধিত হয় ১৯৫৯ সালে, ১৯৬৪ সালে ১৯৬৯ সালে এবং ১৯৮৪ সালে।
বিজেপি সরকারের সংশোধনী আইনের আগে প্রচলিত ওয়াকফ আইন ১৯৯৫ সালের দ্বারা গৃহীত। এটি ২০১৩ সালে সংশোধিত হয়েছে। এই আইন ৯ টি অধ্যায়ে এবং ১১৩টি ধারায় বিভক্ত।
কেন বিজেপি আইন সংশোধন করছে? এই আইনটি সংশোধনের উদ্দেশ্যে আরএসএস, তার রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপিকে দিয়ে যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রসারিত করছে, সেটি হচ্ছে, মুসলমান মুক্ত ভারত।
তার বাইরেও আরও একটা বিশেষ কারণ লুকিয়ে আছে বিজেপির এই আইন সংশোধনের মধ্যে দিয়ে। সেটি হলো ভারতে মুসলমানদের সম্পত্তি গ্রাস করা। ওয়াকফ সম্পত্তির পরিমাণের মধ্যেই এটা আমরা দেখতে পাব। সাচার কমিটির হিসাব অনুযায়ী ভারতে প্রায় ৪.৯ লাখ নথিকৃত ওয়াকফ বোর্ড রয়েছে।
ওয়াকফ সম্পত্তির নিয়ন্ত্রণে ছয় লাখ একর জমি রয়েছে, যার বাজার মূল্য হলো ৬ হাজার কোটি টাকা। যেহেতু এই বাজার মূল্য হিসাবে প্রায় পঞ্চাশ বছরের পুরানো, এর ২০০৬ সালে বাজারি মূল্য নির্ধারিত হয় ১.২ লাখো কোটি টাকাতে। সাচার কমিটির বিবৃতি অনুযায়ী, ওয়াকফ থেকে থেকে বাৎসরিক আয় হলো ১৬৩ কোটি টাকা, যা তার বাজার মূল্যের শুধু ২.৭%।
যদি এই সম্পত্তি যথাযথ ভাবে ব্যবহৃত হয় তাহলে তার থেকে প্রায় ১০% ন্যূনতম আয় হতে পারে যা ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ১২,০০০ কোটি টাকা বৎসরে। এই হিসাব কিন্তু প্রায় ১৯ বৎসরের পুরোনো। তাহলে এখনকার পরিমাণে এই টাকার হিসাব করে দেখুন।
ওয়াকফ সম্পত্তি ভারতের সংখ্যালঘু মন্ত্রক নিয়ন্ত্রিত সম্পত্তি। সংখ্যালঘু মন্ত্রী হলেন এক্স অফিসিও চেয়ারম্যান ভারতের কেন্দ্রীয় ওয়াকফ কাউন্সিলের। এই নির্ণায়ক তৈরি হয় ১৯৯৫ সালের ওয়াকফ আইনের ৯ এর ১ নম্বর ধারা অনুযায়ী। কেন্দ্রীয় ওয়াকফ বোর্ডের নিয়ন্ত্রণে আছে রাজ্য ওয়াকফ বোর্ড। সব থেকে নিচে ওয়াকফ সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণে নিযুক্ত ব্যক্তি, যাকে মুতাওয়াল্লি বলা হয়।
প্রত্যেক মুতাওয়াল্লিকে তাদের বার্ষিক আয়ের ৭% রাজ্য ওয়াকফ বোর্ডকে দিতে হয় এবং রাজ্য ওয়াকফ বোর্ডকে সামগ্রিক বার্ষিক আয়ের ১% কেন্দ্রীয় ওয়াকফ কাউন্সিলকে দিতে হয়। এখানে একটি বিপুল অঙ্কের টাকা হস্তান্তরিত হয় কেন্দ্রীয় ওয়াকফ বোর্ডের কাছে।
ঐতিহ্য পরম্পরায় মুতাওয়াল্লিরা ওয়াকফ সম্পত্তির দেখাশোনা করেন। ওয়াকফ সম্পত্তির অধীনে থাকে কৃষি জমি, বাণিজ্যিক জমি, বসত জমি ব্যবহৃত এবং অব্যবহৃত মসজিদ, দরগাহ বা সুুফি সন্তদের মোকবরা, খানকা বা সুফি ভাইদের বাসস্থান অসুর-খানা (বা শিয়া সমাজের শোকের স্থান), কবরখানা, ঈদগাহ বা ঈদের নামাজ পড়ার স্থান ইমাম-বরা বা শিয়াদের প্রার্থনার স্থল।
ঐতিহাসিকভাবে মুতাওয়াল্লিরা এই সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণ করলেও বহু জায়গায় ওয়াকফ সম্পত্তি রাষ্ট্রের হাতে। যেমন হরিয়ানাতে সমস্ত ওয়াকফ সম্পত্তি হরিয়ানা রাজ্য ওয়াকফ বোর্ডের হাতে কারণ ১৯৪৭ হরিয়ানার মুসলমান সমাজের বিরাট অংশ পাকিস্তান চলে যান দাঙ্গার ফলে। যদিও হরিয়ানাতে নূহ জেলাতে মুসলমান মেয়েরা সংখ্যাগরিষ্ঠ।
২০১৩ সালের ওয়াকফ আইন অনুযায়ী একটি তিন সদস্য বিশিষ্ট ওয়াকফ ট্রাইব্যুনাল আছে। যেখানে একজন ইসলামীয় আইনের বিশেষজ্ঞ থাকেন। দুজন মহিলা সদস্য থাকেন সেখানকার রাজ্য ওয়াকফ বোর্ডে। ওয়াকফ সম্পত্তি বিক্রি করা যাবে না এবং ওয়াকফ সম্পত্তি ইজারার সময় ৩ বছর থেকে বাড়িয়ে ৩০ বৎসর করা হয়েছে, উদ্দেশ্য আর্থিক আয় বৃদ্ধি।
কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের ওয়াকফ আইন সংশোধন করে বলা হয়েছে, যে অমুসলমানরা ওয়াকফ বোর্ডের সদস্য হতে পারবেন। সরকার সরাসরি ওয়াকফ সম্পত্তির বিচার করে, তাদের জমির ওপর অধিকার আছে কি না জানাতে পারবেন। জমির ওপর অধিকার কেড়ে নিতে পারবেন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য এই বৎসরে (২০২৫) জানুয়ারি মাসে মধ্যপ্রদেশের উজ্জয়নী শহরে, সরকার ২৫০টি ওয়াকফ সম্পত্তি এবং মসজিদ ভেঙে ৫.৭ একর জমি দখল করেছে মন্দির বানানোর জন্যে।
পূর্বের কংগ্রেস আমলের আইন অনুযায়ী ওয়াকফ সম্পত্তি নিয়ে বিবাদ নিষ্পত্তির জন্যে সরকার একটি ট্রাইব্যুনাল গঠনের সংস্থান ছিল। তাতে একজন বিচারপতি বা আইন বিভাগের অফিসার ছিলেন। একজন সাধারণ অফিসার ছিলেন এবং একজন মুসলিম আইনের বিশেষজ্ঞ থাকবেন।
কিন্তু বর্তমানে বিজেপি যে আইন এনেছে, সেই আইনে মুসলিম আইনের বিশেষজ্ঞরা উপস্থিতির সংস্থান বাতিল করে দেয়া হয়েছে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী এখন প্রায় ৪০,৯৫১টি মামলা নিষ্পত্তির জন্যে ঝুলে আছে আদালতে। তার ভেতরে মুসলমান মুসল্লিরা ৯,৯৪২ মামলা দায়ের করেছেন ওয়াকফ পরিচালন যারা করছেন, তাদের বিরুদ্ধে।
এই আইনের আর একটি বিশেষত্ত্ব হলো ওয়াকফ সম্পত্তি পরিগণিত হয় ব্যবহারের দ্বারা। প্রায় ৫০০ বৎসর ধরে ওয়াকফ সম্পত্তি ব্যবহার হয়ে আসছে যার কোনো দলিল নেই। কারণ পাঁচশ বছর আগে বা দুশো বৎসর আগে এই সম্পত্তির কোনো আইন নেই। প্রায় ষাট ভাগ ওয়াকফ সম্পত্তির কোনো দলিল নেই। কারণ সেই দান হয়েছিল পাঁচশ বৎসর আগে। তার ওপরে সরকরি সম্পত্তি যা ওয়াকফ সম্পত্তি বলে পরিগণিত হতো, তা আর ওয়াকফ সম্পত্তি থাকবে না। উপরন্তু অমুসলমানরা ওয়াকফ কাউন্সিলের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য হতে পারবে।
আরএসএসের রাজনৈতিক লক্ষ্য হলো, হিন্দু ভারত প্রতিষ্ঠা। সেখানে তারা কোনো ধর্মনিরপেক্ষ হিন্দুকেও ঠাঁই দিতে নারাজ। ধার্মিক হিন্দুকে ঠাঁই দিতে নারাজ। জন্মসূত্রে একজন হিন্দু, হিন্দু ধর্মীয়ের ঔদার্য প্রসূত আচরণ করেন, কিন্তু পরধর্মবিদ্বেষী নন। পরমত সহিষ্ণু। তাকেও আরএসএস কখনো নিজেদের সংজ্ঞা অনুযায়ী হিন্দু বলে মনে করে না।
তার পাশাপাশি মুসলমান মুক্ত ভারত- এটা হলো আরএসএসের ঘোষিত অবস্থান। তাদের সামাজিকতার মুখোশ পরা, রাজনৈতিক চিন্তার যিনি স্থপতি সেই, এমএস গোলওয়ালকার, তার সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ তত্ত্বের মধ্যে খুব পরিষ্কারভাবে বলে গেছেন; হিন্দু ভারতে মুসলমানেরা থাকবে হিন্দুদের জিম্মি হয়ে বা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়ে।
নাগরিকত্ব আইন সংশোধন ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে অতীতে নরেন্দ্র মোদি সরকার মুসলমানদের ভারতে বেনাগরিক করার ষড়যন্ত্রের জালটিকে অনেক দূর বিস্তৃত করেছে। ওয়াকফ সংশোধনী আইন হলো মুসলমানদের শুধু বেনাগরিক করাই নয়। তাদের আর্থিকভাবে শক্তিহীন করে দেয়ার একটি বর্বরোচিত হিন্দুত্ববাদী প্রচেষ্টা।
এভাবেই ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানকে ধীরে ধীরে রাজনৈতিক হিন্দু ভারতের সংবিধানে পরিণত করতে চায় হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শক্তি আরএসএস বিজেপি এবং তার বিভিন্ন ধরনের সহযোগীরা। ওয়াকফ সংশোধনীর এই কালো আইনটি সংসদে আলোচনার সময় ভোটদান পর্বে আমরা দেখেছি, পশ্চিমবঙ্গের শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের কয়েকজন সাংসদ উপস্থিত থাকেননি। তারা ভোটদানে বিরত ছিলেন। উপস্থিত না থাকার জন্য তারা এমন ধরনের কিছু ওজর আপত্তি সংবাদ মাধ্যমের সামনে বলেছেন, যা নিতান্ত হাস্যকর। এটা থেকেই বুঝতে পারা যাচ্ছে যে, ধর্মান্ধ সম্প্রদায়িক শক্তি আরএসএস-বিজেপি আর প্রতিযোগিতামূলক সম্প্রদায়িক শক্তি বিহারের নীতীশ কুমারের দল বা পশ্চিমবঙ্গে মমতা ব্যানার্জির দলÑএরা কিভাবে হাতে হাত মিলিয়ে ভারতকে, ধর্মনিরপেক্ষতার সমস্ত স্তম্ভকে মুছে দিয়ে, রাজনৈতিক হিন্দুরাষ্ট্র পরিণত করতে চায়।
[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ ]
গৌতম রায়
শনিবার, ১২ এপ্রিল ২০২৫
ভারতে যে ওয়াকফ আইন ছিল, সেটি ভারত সরকার কর্তৃক দেশের সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়ের জন্য কোনো দয়ার দান ছিল না। ভারতের স্বাধীনতা যখন ব্রিটিশের কাছ থেকে হস্তান্তরিত হয় ৪৭ সালে, সেই হস্তান্তরের চুক্তির মধ্যেই উল্লিখিত ছিল, স্বাধীন ভারতে সংখ্যালঘু মুসলমানসহ অন্যান্য সব ধর্মীয়, ভাষাগত, জাতিগত, সংখ্যালঘু মানুষ; ব্রিটিশ শাসনকালে যেসব ব্যক্তিগত আইনের সুযোগ সুবিধা পাচ্ছেন; স্বাধীন ভারতেও সেই সুযোগ সুবিধে তারা পাবেন। ক্ষমতা হস্তান্তরের চুক্তিতে ব্রিটিশ সরকারের প্রতিনিধি এবং ভারতের তৎকালীন নেতারা যে স্বাক্ষর করেছিলেন তারই ভিত্তিতে মুসলমান সম্প্রদায়ের ব্যক্তিগত আইন আছে। ব্যক্তিগত আইনেরই অংশ হলো এই ওয়াকফ। দীর্ঘদিন ধরে ভারতের বুকে যে সমস্ত দানবীর মুসলমানেরা তাদের নিজেদের সম্প্রদায়ের অর্থ, সামাজিক- সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় উন্নতির জন্য নিজেদের সম্পত্তি ওয়াকফবদ্ধ করেছেন, তার রক্ষণাবেক্ষণ বহমানতা এবং যাদের উদ্দেশ্যে এই ওয়াকফ সম্পত্তির বিলি ব্যবস্থা করা হয়েছে, সেগুলো যাতে সঠিকভাবে ব্যবহৃত হয়, সেই জন্য ওয়াকফ আইন চলে আসছে।
পরবর্তী সময়ে ভারতের সংবিধান যখন গৃহীত হয়, সেটি এই ক্ষমতা হস্তান্তরের চুক্তির ওপর ভিত্তি করেই রচিত হয়েছিল। সেখানে সংখ্যালঘু মুসলমানদের ব্যক্তিগত আইন ওয়াকফসহ সমস্ত কিছু বজায় রাখবার বিষয়টি স্বীকৃতি লাভ করেছে। তাই এখন হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি সংগঠন বিজেপির দাবি অনুযায়ী যদি মুসলমানদের ব্যক্তিগত আইন অস্বীকার করা হয়, তাহলে ক্ষমতা হস্তান্তরের চুক্তিটিকেই অস্বীকার করা হবে। যার ফলে, ভারতের সংবিধানের কার্যত কোনো অস্তিত্ব থাকবে না।
হিন্দুত্ববাদীরা অবশ্য এটাই চায়। ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানকে বাতিল করে, রাজনৈতিক হিন্দু রাষ্ট্রে ভারতকে তারা পরিণত করতে চায়। সেই লক্ষ্যেই তারা দীর্ঘদিন ধরে ওয়াকফ সম্পত্তি ঘিরে, আইন ঘিরে নানা ধরনের কথাবার্তা বলে আসছে। যার জেরে হিন্দু-মুসলমানের বিভাজনের অক্ষরেখাটি আরও বেশি শক্তিশালী হচ্ছে।
ওয়াকফ বোর্ড হলো ধর্মের স্বার্থে সৃষ্টিকর্তার কাছে নিবেদিত সম্পত্তি। এই সম্পত্তি সমাজের গরিব মানুষদের কল্যাণে এবং ধর্মীয় আচরণের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবহৃত হবে। তত্ত্বগতভাবে ওয়াকফ সম্পত্তি কখনো কোনো রকমই হস্তান্তর করা যায় না। এই সম্পত্তির স্থায়িত্ব সামগ্রিক। ওয়াকফ সম্পত্তির মালিকানা হলো মহান আল্লাহর। যেহেতু আল্লাহর পার্থিব সমাজে শারীরিক উপস্থিতি উপলব্ধির বিষয়, তাই সম্পত্তির দেখভালের মালিকানা আসে ওয়াকফ মুতাওয়াল্লির ওপরে।
ভারতে সুলতানি শাসনের বহু থেকেই ওয়াকফ সম্পত্তি ছিল এই অঞ্চলের বিভিন্ন প্রান্তে মুসলমান জনবসতিতে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ভারতের সুলতানি শাসনের আগে সমুদ্র উপকূলে মালাবার, গুজরাট এবং চট্টগ্রাম অঞ্চলে মুসলমান সমাজের বসতি ছিল। ভারতে ইসলাম আসে প্রধানতঃ বাণিজ্য সূত্রে আর সুফি প্রচারকদের প্রচারের মধ্যে দিয়ে।
ব্রিটিশ শাসন আমলে ১৮১০ সালে ওয়াকফ সংক্রান্ত প্রথম আইন প্রণীত হয়। ঐতিহ্য পরপম্পরাই ওয়াকফ সম্পত্তি মুতাওয়াল্লিরা রক্ষণাবেক্ষণ করেন এবং শরিয়া আদালতের কাজিরা সে সম্পর্কে বিচার করেন। ১৮১০ সালে ব্রিটিশরা এই সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রথম আইন প্রণয়ন করে। স্বাধীন ভারতে ১৯৫৪ সালে ওয়াকফ আইন গৃহীত হয়। পরে সেটি সংশোধিত হয় ১৯৫৯ সালে, ১৯৬৪ সালে ১৯৬৯ সালে এবং ১৯৮৪ সালে।
বিজেপি সরকারের সংশোধনী আইনের আগে প্রচলিত ওয়াকফ আইন ১৯৯৫ সালের দ্বারা গৃহীত। এটি ২০১৩ সালে সংশোধিত হয়েছে। এই আইন ৯ টি অধ্যায়ে এবং ১১৩টি ধারায় বিভক্ত।
কেন বিজেপি আইন সংশোধন করছে? এই আইনটি সংশোধনের উদ্দেশ্যে আরএসএস, তার রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপিকে দিয়ে যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রসারিত করছে, সেটি হচ্ছে, মুসলমান মুক্ত ভারত।
তার বাইরেও আরও একটা বিশেষ কারণ লুকিয়ে আছে বিজেপির এই আইন সংশোধনের মধ্যে দিয়ে। সেটি হলো ভারতে মুসলমানদের সম্পত্তি গ্রাস করা। ওয়াকফ সম্পত্তির পরিমাণের মধ্যেই এটা আমরা দেখতে পাব। সাচার কমিটির হিসাব অনুযায়ী ভারতে প্রায় ৪.৯ লাখ নথিকৃত ওয়াকফ বোর্ড রয়েছে।
ওয়াকফ সম্পত্তির নিয়ন্ত্রণে ছয় লাখ একর জমি রয়েছে, যার বাজার মূল্য হলো ৬ হাজার কোটি টাকা। যেহেতু এই বাজার মূল্য হিসাবে প্রায় পঞ্চাশ বছরের পুরানো, এর ২০০৬ সালে বাজারি মূল্য নির্ধারিত হয় ১.২ লাখো কোটি টাকাতে। সাচার কমিটির বিবৃতি অনুযায়ী, ওয়াকফ থেকে থেকে বাৎসরিক আয় হলো ১৬৩ কোটি টাকা, যা তার বাজার মূল্যের শুধু ২.৭%।
যদি এই সম্পত্তি যথাযথ ভাবে ব্যবহৃত হয় তাহলে তার থেকে প্রায় ১০% ন্যূনতম আয় হতে পারে যা ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ১২,০০০ কোটি টাকা বৎসরে। এই হিসাব কিন্তু প্রায় ১৯ বৎসরের পুরোনো। তাহলে এখনকার পরিমাণে এই টাকার হিসাব করে দেখুন।
ওয়াকফ সম্পত্তি ভারতের সংখ্যালঘু মন্ত্রক নিয়ন্ত্রিত সম্পত্তি। সংখ্যালঘু মন্ত্রী হলেন এক্স অফিসিও চেয়ারম্যান ভারতের কেন্দ্রীয় ওয়াকফ কাউন্সিলের। এই নির্ণায়ক তৈরি হয় ১৯৯৫ সালের ওয়াকফ আইনের ৯ এর ১ নম্বর ধারা অনুযায়ী। কেন্দ্রীয় ওয়াকফ বোর্ডের নিয়ন্ত্রণে আছে রাজ্য ওয়াকফ বোর্ড। সব থেকে নিচে ওয়াকফ সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণে নিযুক্ত ব্যক্তি, যাকে মুতাওয়াল্লি বলা হয়।
প্রত্যেক মুতাওয়াল্লিকে তাদের বার্ষিক আয়ের ৭% রাজ্য ওয়াকফ বোর্ডকে দিতে হয় এবং রাজ্য ওয়াকফ বোর্ডকে সামগ্রিক বার্ষিক আয়ের ১% কেন্দ্রীয় ওয়াকফ কাউন্সিলকে দিতে হয়। এখানে একটি বিপুল অঙ্কের টাকা হস্তান্তরিত হয় কেন্দ্রীয় ওয়াকফ বোর্ডের কাছে।
ঐতিহ্য পরম্পরায় মুতাওয়াল্লিরা ওয়াকফ সম্পত্তির দেখাশোনা করেন। ওয়াকফ সম্পত্তির অধীনে থাকে কৃষি জমি, বাণিজ্যিক জমি, বসত জমি ব্যবহৃত এবং অব্যবহৃত মসজিদ, দরগাহ বা সুুফি সন্তদের মোকবরা, খানকা বা সুফি ভাইদের বাসস্থান অসুর-খানা (বা শিয়া সমাজের শোকের স্থান), কবরখানা, ঈদগাহ বা ঈদের নামাজ পড়ার স্থান ইমাম-বরা বা শিয়াদের প্রার্থনার স্থল।
ঐতিহাসিকভাবে মুতাওয়াল্লিরা এই সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণ করলেও বহু জায়গায় ওয়াকফ সম্পত্তি রাষ্ট্রের হাতে। যেমন হরিয়ানাতে সমস্ত ওয়াকফ সম্পত্তি হরিয়ানা রাজ্য ওয়াকফ বোর্ডের হাতে কারণ ১৯৪৭ হরিয়ানার মুসলমান সমাজের বিরাট অংশ পাকিস্তান চলে যান দাঙ্গার ফলে। যদিও হরিয়ানাতে নূহ জেলাতে মুসলমান মেয়েরা সংখ্যাগরিষ্ঠ।
২০১৩ সালের ওয়াকফ আইন অনুযায়ী একটি তিন সদস্য বিশিষ্ট ওয়াকফ ট্রাইব্যুনাল আছে। যেখানে একজন ইসলামীয় আইনের বিশেষজ্ঞ থাকেন। দুজন মহিলা সদস্য থাকেন সেখানকার রাজ্য ওয়াকফ বোর্ডে। ওয়াকফ সম্পত্তি বিক্রি করা যাবে না এবং ওয়াকফ সম্পত্তি ইজারার সময় ৩ বছর থেকে বাড়িয়ে ৩০ বৎসর করা হয়েছে, উদ্দেশ্য আর্থিক আয় বৃদ্ধি।
কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের ওয়াকফ আইন সংশোধন করে বলা হয়েছে, যে অমুসলমানরা ওয়াকফ বোর্ডের সদস্য হতে পারবেন। সরকার সরাসরি ওয়াকফ সম্পত্তির বিচার করে, তাদের জমির ওপর অধিকার আছে কি না জানাতে পারবেন। জমির ওপর অধিকার কেড়ে নিতে পারবেন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য এই বৎসরে (২০২৫) জানুয়ারি মাসে মধ্যপ্রদেশের উজ্জয়নী শহরে, সরকার ২৫০টি ওয়াকফ সম্পত্তি এবং মসজিদ ভেঙে ৫.৭ একর জমি দখল করেছে মন্দির বানানোর জন্যে।
পূর্বের কংগ্রেস আমলের আইন অনুযায়ী ওয়াকফ সম্পত্তি নিয়ে বিবাদ নিষ্পত্তির জন্যে সরকার একটি ট্রাইব্যুনাল গঠনের সংস্থান ছিল। তাতে একজন বিচারপতি বা আইন বিভাগের অফিসার ছিলেন। একজন সাধারণ অফিসার ছিলেন এবং একজন মুসলিম আইনের বিশেষজ্ঞ থাকবেন।
কিন্তু বর্তমানে বিজেপি যে আইন এনেছে, সেই আইনে মুসলিম আইনের বিশেষজ্ঞরা উপস্থিতির সংস্থান বাতিল করে দেয়া হয়েছে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী এখন প্রায় ৪০,৯৫১টি মামলা নিষ্পত্তির জন্যে ঝুলে আছে আদালতে। তার ভেতরে মুসলমান মুসল্লিরা ৯,৯৪২ মামলা দায়ের করেছেন ওয়াকফ পরিচালন যারা করছেন, তাদের বিরুদ্ধে।
এই আইনের আর একটি বিশেষত্ত্ব হলো ওয়াকফ সম্পত্তি পরিগণিত হয় ব্যবহারের দ্বারা। প্রায় ৫০০ বৎসর ধরে ওয়াকফ সম্পত্তি ব্যবহার হয়ে আসছে যার কোনো দলিল নেই। কারণ পাঁচশ বছর আগে বা দুশো বৎসর আগে এই সম্পত্তির কোনো আইন নেই। প্রায় ষাট ভাগ ওয়াকফ সম্পত্তির কোনো দলিল নেই। কারণ সেই দান হয়েছিল পাঁচশ বৎসর আগে। তার ওপরে সরকরি সম্পত্তি যা ওয়াকফ সম্পত্তি বলে পরিগণিত হতো, তা আর ওয়াকফ সম্পত্তি থাকবে না। উপরন্তু অমুসলমানরা ওয়াকফ কাউন্সিলের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য হতে পারবে।
আরএসএসের রাজনৈতিক লক্ষ্য হলো, হিন্দু ভারত প্রতিষ্ঠা। সেখানে তারা কোনো ধর্মনিরপেক্ষ হিন্দুকেও ঠাঁই দিতে নারাজ। ধার্মিক হিন্দুকে ঠাঁই দিতে নারাজ। জন্মসূত্রে একজন হিন্দু, হিন্দু ধর্মীয়ের ঔদার্য প্রসূত আচরণ করেন, কিন্তু পরধর্মবিদ্বেষী নন। পরমত সহিষ্ণু। তাকেও আরএসএস কখনো নিজেদের সংজ্ঞা অনুযায়ী হিন্দু বলে মনে করে না।
তার পাশাপাশি মুসলমান মুক্ত ভারত- এটা হলো আরএসএসের ঘোষিত অবস্থান। তাদের সামাজিকতার মুখোশ পরা, রাজনৈতিক চিন্তার যিনি স্থপতি সেই, এমএস গোলওয়ালকার, তার সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ তত্ত্বের মধ্যে খুব পরিষ্কারভাবে বলে গেছেন; হিন্দু ভারতে মুসলমানেরা থাকবে হিন্দুদের জিম্মি হয়ে বা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়ে।
নাগরিকত্ব আইন সংশোধন ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে অতীতে নরেন্দ্র মোদি সরকার মুসলমানদের ভারতে বেনাগরিক করার ষড়যন্ত্রের জালটিকে অনেক দূর বিস্তৃত করেছে। ওয়াকফ সংশোধনী আইন হলো মুসলমানদের শুধু বেনাগরিক করাই নয়। তাদের আর্থিকভাবে শক্তিহীন করে দেয়ার একটি বর্বরোচিত হিন্দুত্ববাদী প্রচেষ্টা।
এভাবেই ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানকে ধীরে ধীরে রাজনৈতিক হিন্দু ভারতের সংবিধানে পরিণত করতে চায় হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শক্তি আরএসএস বিজেপি এবং তার বিভিন্ন ধরনের সহযোগীরা। ওয়াকফ সংশোধনীর এই কালো আইনটি সংসদে আলোচনার সময় ভোটদান পর্বে আমরা দেখেছি, পশ্চিমবঙ্গের শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের কয়েকজন সাংসদ উপস্থিত থাকেননি। তারা ভোটদানে বিরত ছিলেন। উপস্থিত না থাকার জন্য তারা এমন ধরনের কিছু ওজর আপত্তি সংবাদ মাধ্যমের সামনে বলেছেন, যা নিতান্ত হাস্যকর। এটা থেকেই বুঝতে পারা যাচ্ছে যে, ধর্মান্ধ সম্প্রদায়িক শক্তি আরএসএস-বিজেপি আর প্রতিযোগিতামূলক সম্প্রদায়িক শক্তি বিহারের নীতীশ কুমারের দল বা পশ্চিমবঙ্গে মমতা ব্যানার্জির দলÑএরা কিভাবে হাতে হাত মিলিয়ে ভারতকে, ধর্মনিরপেক্ষতার সমস্ত স্তম্ভকে মুছে দিয়ে, রাজনৈতিক হিন্দুরাষ্ট্র পরিণত করতে চায়।
[লেখক : ভারতীয় ইতিহাসবিদ ]