মাহফুজ আলম
বাংলাদেশ বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম আম উৎপাদনকারী দেশ, যার বার্ষিক উৎপাদন প্রায় ২৪ লাখ মেট্রিক টন। রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সাতক্ষীরাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে উৎপাদিত হিমসাগর, হাড়িভাঙ্গা, আম্রপালি প্রভৃতি জাতের আমের স্বাদ, গন্ধ ও মান আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যাপকভাবে সমাদৃত। তবে বিপুল উৎপাদন সত্ত্বেও বৈশ্বিক রপ্তানি বাজারে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ অপ্রতুল। ২০২২ সালে মাত্র ১,৭৫৭ টন আম রপ্তানি হয়েছে, যা মোট উৎপাদনের তুলনায় অত্যন্ত নগণ্য। তবে, এই বিপুল উৎপাদনের তুলনায় রপ্তানি পরিমাণ অত্যন্ত কম, যা ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মাত্র ১,৩২১ টনে নেমে এসেছে ।
আম রপ্তানিতে বাংলাদেশের সম্ভাবনা যেমন ব্যাপক, তেমনি রয়েছে নানাবিধ চ্যালেঞ্জ, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক মানদ-ে উত্তীর্ণ হওয়ার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা, কীটপতঙ্গ সমস্যা, পরবর্তী পর্যায়ের অব্যবস্থাপনা, ও রপ্তানিযোগ্য অবকাঠামোর অভাব। তবুও সুশৃঙ্খল নীতি গ্রহণ, প্রযুক্তি ও অবকাঠামো উন্নয়ন এবং কৃষকদের সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে আম রপ্তানি খাতকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের একটি শক্তিশালী খাতে পরিণত করা সম্ভব। এই প্রতিবেদনে আম রপ্তানি খাতের বর্তমান অবস্থা, বিদ্যমান প্রতিবন্ধকতা, ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা এবং টেকসই উন্নয়নের জন্য করণীয় বিষয়ে বিশ্লেষণ উপস্থাপন করা হয়েছে।
উৎপাদন ও রপ্তানি পরিসংখ্যান
বাংলাদেশ আম উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। দেশের প্রধান আম উৎপাদন অঞ্চল হিসেবে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, সাতক্ষীরা ও দিনাজপুর অঞ্চল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ অঞ্চলের উর্বর মাটি ও অনুকূল জলবায়ু আম চাষের জন্য আদর্শ পরিবেশ সৃষ্টি করে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশে প্রায় ২৫ লাখ মেট্রিক টন আম উৎপাদিত হয়েছে, যা পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় উৎপাদনে স্থিতিশীলতা বজায় রাখলেও রপ্তানি পরিমাণে ছিল উল্লেখযোগ্য পতন। রপ্তানির পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে মাত্র ১,৩২১ টন আম রপ্তানি হয়েছে, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ৩,১০০ টনের তুলনায় প্রায় ৫৭% হ্রাস পেয়েছে। এ বিপুল পরিমাণ উৎপাদনের বিপরীতে এত স্বল্প রপ্তানি অত্যন্ত হতাশাজনক এবং রপ্তানি ব্যবস্থার কাঠামোগত দুর্বলতা, অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা এবং আন্তর্জাতিক মানদ- পূরণে ঘাটতির ইঙ্গিত দেয়।
রপ্তানি গন্তব্য ও নতুন বাজার
বর্তমানে বাংলাদেশ ৩৮টি দেশে আম রপ্তানি করছে। এ তালিকায় যুক্তরাজ্য, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সিঙ্গাপুর ও ইতালির মতো গুরুত্বপূর্ণ বাজার রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহে বাংলাদেশি আমের চাহিদা বেশি হলেও ইউরোপীয় দেশগুলোতেও ধীরে ধীরে এর গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে। ২০২৪ সালে চীনের সঙ্গে ফাইটোস্যানিটারি প্রোটোকল স্বাক্ষরের মাধ্যমে একটি নতুন ও সম্ভাবনাময় বিশাল বাজারে প্রবেশের দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে। চীনা বাজারে প্রবেশ শুধু রপ্তানির পরিমাণ বাড়াবে না, বরং বাংলাদেশের আম খাতের আন্তর্জাতিক অবস্থানকে আরও দৃঢ় করবে।
রপ্তানিযোগ্য আমের জাত ও বৈচিত্র্য
বাংলাদেশে প্রায় ৭২টি আমের জাত চাষ করা হয়। এর মধ্যে রপ্তানিযোগ্য জাত হিসেবে হিমসাগর, ল্যাংড়া, খিরসাপাত, আম্রপালি ও হাড়িভাঙ্গা উল্লেখযোগ্য। এ জাতের আমগুলো স্বাদ, গন্ধ ও গুণমানে অতুলনীয়, যা আন্তর্জাতিক ভোক্তাদের কাছে ব্যাপকভাবে সমাদৃত। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, ২০১৯ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জের খিরসাপাত আম ভৌগোলিক নির্দেশক স্বীকৃতি লাভ করে, যা আন্তর্জাতিক বাজারে এর স্বতন্ত্রতা ও ব্র্যান্ড ভ্যালু বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
প্রধান চ্যালেঞ্জসমূহ গুড অ্যাগ্রিকালচারাল প্র্যাকটিস ও সার্টিফিকেশন ঘাটতি
রপ্তানিযোগ্য ফলমূল উৎপাদনে আন্তর্জাতিক মানদ-ের অন্যতম শর্ত হলো গুড অ্যাগ্রিকালচারাল প্র্যাকটিস অনুসরণ ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত সার্টিফিকেশন প্রাপ্তি। তবে বাংলাদেশের অধিকাংশ আমচাষি এখনও এঅচভিত্তিক উৎপাদন পদ্ধতি অনুসরণ করেন না। এই ঘাটতির ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও উত্তর আমেরিকার মতো উচ্চ মানসম্পন্ন বাজারে প্রবেশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এছাড়া সার্টিফিকেশন পদ্ধতির জটিলতা, প্রশিক্ষণের অভাব ও সচেতনতার ঘাটতির কারণেও কৃষকরা এ প্রক্রিয়ায় আগ্রহ দেখাতে পারেন না। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশের পথে এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবন্ধকতা হিসেবে এটি থেকে যাচ্ছে।
ফলমাছি ও অন্যান্য কীটপতঙ্গ সমস্যা
বাংলাদেশে আম উৎপাদনের ক্ষেত্রে একটি গুরুতর সমস্যা হলো ফলমাছির আক্রমণ। এ কীটের কারণে আমের গুণগত মান হ্রাস পায় এবং এতে ছিদ্র হয়ে যাওয়ার ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে গ্রহণযোগ্যতা কমে যায়। বিশেষ করে ইউরোপ ও চীনসহ উন্নত দেশগুলো ফলমাছি নিয়ন্ত্রণে কড়া স্যানিটারি অ্যান্ড ফাইটোস্যানিটারি মানদ- আরোপ করে থাকে, যা পূরণে ব্যর্থ হলে রপ্তানি বাতিলের সম্ভাবনা থাকে। ফলমাছি নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত পোকা ব্যবস্থাপনা এবং আধুনিক বালাইনাশক ব্যবস্থাপনা জরুরি।
কোল্ড চেইন বা ঠা-া-শৃঙ্খল অবকাঠামোর অভাব
রপ্তানির জন্য ফলমূল দীর্ঘ সময় সংরক্ষণ এবং পরিবহনের ক্ষেত্রে ঠা-া-শৃঙ্খল বা কোল্ড চেইনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বাংলাদেশের আম উৎপাদন এলাকায় প্রয়োজনীয় হিমাগার বা কোল্ড স্টোরেজের অভাব রয়েছে। এছাড়া বিমানবন্দরে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত কার্গো হ্যান্ডলিং সুবিধারও ঘাটতি রয়েছে, ফলে রপ্তানির সময় ফলের মান হ্রাস পায়। এই অব্যবস্থাপনার কারণে অনেক সময় রপ্তানিকারকরা অর্ডার বাতিল করতে বাধ্য হন।
উচ্চ পরিবহন ব্যয় ও লজিস্টিক সমস্যা
বাংলাদেশ থেকে আম রপ্তানির ক্ষেত্রে বিমান পরিবহন অন্যতম মাধ্যম। তবে ফ্রেইট চার্জ অত্যন্ত বেশি হওয়ায় রপ্তানিকারকদের মুনাফা মার্জিন কমে যায়। পাশাপাশি আম রপ্তানিতে বিশেষায়িত কার্গো বিমানের সংখ্যা কম এবং সময়মতো বুকিং নিশ্চিত করা কঠিন, যা সময়মতো পণ্য পৌঁছাতে বাধা সৃষ্টি করে। এসব সমস্যার ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতামূলক দামে আম সরবরাহ করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব
জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের কৃষি খাতে একটি দীর্ঘমেয়াদি চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অতিরিক্ত গরম, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত এবং খরার কারণে আমের ফুল ফোটা এবং ফলন ব্যাহত হচ্ছে। কিছু অঞ্চলে গাছ অকালেই ফল ঝরিয়ে দিচ্ছে, আবার কোথাও আম পরিপক্ব হতে সময় নিচ্ছে বেশি। এছাড়া বেড়ে যাওয়া সেচের প্রয়োজনীয়তা উৎপাদন ব্যয় বাড়াচ্ছে, যা কৃষকদের আর্থিকভাবে চাপের মুখে ফেলছে। এই প্রভাব থেকে উত্তরণে জলবায়ু সহনশীল জাত উদ্ভাবন ও চাষে নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার অপরিহার্য।
সম্ভাবনা ও সুযোগসমূহ
বাংলাদেশের আম রপ্তানি খাতে সম্ভাবনা বিপুল, তবে তা যথাযথভাবে কাজে লাগাতে হলে বিদ্যমান সুযোগগুলোর দক্ষ ব্যবস্থাপনা এবং প্রাতিষ্ঠানিক সমর্থন প্রয়োজন।
গুড অ্যাগ্রিকালচারাল প্র্যাকটিস গ্রহণ ও প্রশিক্ষণ
আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশের জন্য এঅচ অনুসরণ একটি অপরিহার্য শর্ত। কৃষকদের এঅচ-সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ ও সচেতনতামূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে তারা নিরাপদ এবং টেকসই কৃষিপ্রযুক্তি গ্রহণে সক্ষম হবেন। সরকার ও বেসরকারি উদ্যোগে জিএপি সার্টিফিকেশন সুবিধা সম্প্রসারণ করা গেলে ইউরোপ, জাপানসহ উচ্চ মানসম্পন্ন বাজারে প্রবেশের দ্বার আরও উন্মুক্ত হবে।
মূল্য সংযোজন ও প্রক্রিয়াজাত পণ্য
আমের কাঁচা রূপের পাশাপাশি প্রক্রিয়াজাত পণ্য যেমনÑশুকনো আম, আমের জ্যাম, জুস, পিউরি ইত্যাদি তৈরি করে তা রপ্তানি করা হলে বৈচিত্র্য সৃষ্টি হবে এবং রপ্তানি আয় বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে।
এছাড়া প্রক্রিয়াজাত পণ্যের সংরক্ষণকাল বেশি হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে এর সরবরাহ স্থিতিশীল রাখা সহজ হবে।
নতুন বাজারে প্রবেশ
চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন দেশে আমের চাহিদা রয়েছে। চীনের সঙ্গে ফাইটোস্যানিটারি চুক্তি, জাপানের কঠোর মান পূরণের লক্ষ্যে পরিকল্পনা, এবং ইউরোপে বিশেষ জাতের জিআই স্বীকৃত আম সরবরাহ করে বাংলাদেশ নতুন বাজারে রপ্তানি বহুগুণে বাড়াতে পারে।
প্রযুক্তি ও ট্রেসেবিলিটি সিস্টেম
ই-ট্রেসেবিলিটি এবং ব্লকচেইন প্রযুক্তির মাধ্যমে আমের উৎপাদন, সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও পরিবহনের প্রতিটি ধাপের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা সম্ভব। এটি আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের আস্থা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এবং রপ্তানি বাজারে বাংলাদেশের অবস্থান সুদৃঢ় করবে।
ভবিষ্যৎ করণীয় ও সুপারিশ নীতিগত সহায়তা ও প্রণোদনা
রপ্তানিকারকদের উৎসাহিত করতে হলে আম রপ্তানির জন্য আলাদা নীতিমালা প্রণয়ন, সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা এবং ভর্তুকি প্রদান অত্যন্ত জরুরি। সরকারিভাবে কৃষকদের সহায়তা প্রদান ও আম রপ্তানিকে বিশেষ কৃষি খাত হিসেবে ঘোষণা করাও কার্যকর পদক্ষেপ হতে পারে।
অবকাঠামো উন্নয়ন
ঠা-া সংরক্ষণাগার, আধুনিক প্যাকেজিং সুবিধা এবং তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন আমের মান বজায় রাখতে সাহায্য করবে। এছাড়া বিমানবন্দর ও রপ্তানি কেন্দ্রে ফলমূলের জন্য আলাদা কোল্ড হ্যান্ডলিং জোন স্থাপন প্রয়োজন।
গবেষণা ও উন্নয়ন
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় সহনশীল জাত উদ্ভাবন এবং আধুনিক চাষ ব্যবস্থার প্রচলনে গবেষণা বাড়ানো জরুরি। কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে।
আন্তর্জাতিক মানদ- পূরণ
এঅচ, ঐঅঈঈচ, ওঝঙ-২২০০০ ইত্যাদি মানদ- পূরণের মাধ্যমে বাংলাদেশের আম আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠতে পারে। এজন্য সার্টিফিকেশন প্রক্রিয়া সহজীকরণ ও প্রশিক্ষণের সুযোগ বাড়ানো দরকার। বাংলাদেশের আম রপ্তানি খাতে রয়েছে বিপুল সম্ভাবনা, তবে তা পুরোপুরি কাজে লাগাতে হলে প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, কাঠামোগত উন্নয়ন, প্রযুক্তির ব্যবহার এবং নীতিগত সহায়তা। কাঁচামালের গুণগত মান রক্ষা থেকে শুরু করে প্রক্রিয়াজাতকরণ, ট্রেসেবিলিটি এবং বাজার বৈচিত্র্য সবকিছুতেই প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ। কৃষক, রপ্তানিকারক, সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে এ খাতকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একটি লাভজনক ও টেকসই খাতে রূপান্তর করা সম্ভব। বাংলাদেশের আম বিশ্ব বাজারে একটি নির্ভরযোগ্য ও ব্র্যান্ডেড পণ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হোক এটাই সবার প্রত্যাশা।
[লেখক : প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, শস্য বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল]
মাহফুজ আলম
শনিবার, ১৪ জুন ২০২৫
বাংলাদেশ বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম আম উৎপাদনকারী দেশ, যার বার্ষিক উৎপাদন প্রায় ২৪ লাখ মেট্রিক টন। রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সাতক্ষীরাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে উৎপাদিত হিমসাগর, হাড়িভাঙ্গা, আম্রপালি প্রভৃতি জাতের আমের স্বাদ, গন্ধ ও মান আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যাপকভাবে সমাদৃত। তবে বিপুল উৎপাদন সত্ত্বেও বৈশ্বিক রপ্তানি বাজারে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ অপ্রতুল। ২০২২ সালে মাত্র ১,৭৫৭ টন আম রপ্তানি হয়েছে, যা মোট উৎপাদনের তুলনায় অত্যন্ত নগণ্য। তবে, এই বিপুল উৎপাদনের তুলনায় রপ্তানি পরিমাণ অত্যন্ত কম, যা ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মাত্র ১,৩২১ টনে নেমে এসেছে ।
আম রপ্তানিতে বাংলাদেশের সম্ভাবনা যেমন ব্যাপক, তেমনি রয়েছে নানাবিধ চ্যালেঞ্জ, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক মানদ-ে উত্তীর্ণ হওয়ার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা, কীটপতঙ্গ সমস্যা, পরবর্তী পর্যায়ের অব্যবস্থাপনা, ও রপ্তানিযোগ্য অবকাঠামোর অভাব। তবুও সুশৃঙ্খল নীতি গ্রহণ, প্রযুক্তি ও অবকাঠামো উন্নয়ন এবং কৃষকদের সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে আম রপ্তানি খাতকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের একটি শক্তিশালী খাতে পরিণত করা সম্ভব। এই প্রতিবেদনে আম রপ্তানি খাতের বর্তমান অবস্থা, বিদ্যমান প্রতিবন্ধকতা, ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা এবং টেকসই উন্নয়নের জন্য করণীয় বিষয়ে বিশ্লেষণ উপস্থাপন করা হয়েছে।
উৎপাদন ও রপ্তানি পরিসংখ্যান
বাংলাদেশ আম উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। দেশের প্রধান আম উৎপাদন অঞ্চল হিসেবে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, সাতক্ষীরা ও দিনাজপুর অঞ্চল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ অঞ্চলের উর্বর মাটি ও অনুকূল জলবায়ু আম চাষের জন্য আদর্শ পরিবেশ সৃষ্টি করে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশে প্রায় ২৫ লাখ মেট্রিক টন আম উৎপাদিত হয়েছে, যা পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় উৎপাদনে স্থিতিশীলতা বজায় রাখলেও রপ্তানি পরিমাণে ছিল উল্লেখযোগ্য পতন। রপ্তানির পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে মাত্র ১,৩২১ টন আম রপ্তানি হয়েছে, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ৩,১০০ টনের তুলনায় প্রায় ৫৭% হ্রাস পেয়েছে। এ বিপুল পরিমাণ উৎপাদনের বিপরীতে এত স্বল্প রপ্তানি অত্যন্ত হতাশাজনক এবং রপ্তানি ব্যবস্থার কাঠামোগত দুর্বলতা, অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা এবং আন্তর্জাতিক মানদ- পূরণে ঘাটতির ইঙ্গিত দেয়।
রপ্তানি গন্তব্য ও নতুন বাজার
বর্তমানে বাংলাদেশ ৩৮টি দেশে আম রপ্তানি করছে। এ তালিকায় যুক্তরাজ্য, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সিঙ্গাপুর ও ইতালির মতো গুরুত্বপূর্ণ বাজার রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহে বাংলাদেশি আমের চাহিদা বেশি হলেও ইউরোপীয় দেশগুলোতেও ধীরে ধীরে এর গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে। ২০২৪ সালে চীনের সঙ্গে ফাইটোস্যানিটারি প্রোটোকল স্বাক্ষরের মাধ্যমে একটি নতুন ও সম্ভাবনাময় বিশাল বাজারে প্রবেশের দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে। চীনা বাজারে প্রবেশ শুধু রপ্তানির পরিমাণ বাড়াবে না, বরং বাংলাদেশের আম খাতের আন্তর্জাতিক অবস্থানকে আরও দৃঢ় করবে।
রপ্তানিযোগ্য আমের জাত ও বৈচিত্র্য
বাংলাদেশে প্রায় ৭২টি আমের জাত চাষ করা হয়। এর মধ্যে রপ্তানিযোগ্য জাত হিসেবে হিমসাগর, ল্যাংড়া, খিরসাপাত, আম্রপালি ও হাড়িভাঙ্গা উল্লেখযোগ্য। এ জাতের আমগুলো স্বাদ, গন্ধ ও গুণমানে অতুলনীয়, যা আন্তর্জাতিক ভোক্তাদের কাছে ব্যাপকভাবে সমাদৃত। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, ২০১৯ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জের খিরসাপাত আম ভৌগোলিক নির্দেশক স্বীকৃতি লাভ করে, যা আন্তর্জাতিক বাজারে এর স্বতন্ত্রতা ও ব্র্যান্ড ভ্যালু বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
প্রধান চ্যালেঞ্জসমূহ গুড অ্যাগ্রিকালচারাল প্র্যাকটিস ও সার্টিফিকেশন ঘাটতি
রপ্তানিযোগ্য ফলমূল উৎপাদনে আন্তর্জাতিক মানদ-ের অন্যতম শর্ত হলো গুড অ্যাগ্রিকালচারাল প্র্যাকটিস অনুসরণ ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত সার্টিফিকেশন প্রাপ্তি। তবে বাংলাদেশের অধিকাংশ আমচাষি এখনও এঅচভিত্তিক উৎপাদন পদ্ধতি অনুসরণ করেন না। এই ঘাটতির ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও উত্তর আমেরিকার মতো উচ্চ মানসম্পন্ন বাজারে প্রবেশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এছাড়া সার্টিফিকেশন পদ্ধতির জটিলতা, প্রশিক্ষণের অভাব ও সচেতনতার ঘাটতির কারণেও কৃষকরা এ প্রক্রিয়ায় আগ্রহ দেখাতে পারেন না। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশের পথে এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবন্ধকতা হিসেবে এটি থেকে যাচ্ছে।
ফলমাছি ও অন্যান্য কীটপতঙ্গ সমস্যা
বাংলাদেশে আম উৎপাদনের ক্ষেত্রে একটি গুরুতর সমস্যা হলো ফলমাছির আক্রমণ। এ কীটের কারণে আমের গুণগত মান হ্রাস পায় এবং এতে ছিদ্র হয়ে যাওয়ার ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে গ্রহণযোগ্যতা কমে যায়। বিশেষ করে ইউরোপ ও চীনসহ উন্নত দেশগুলো ফলমাছি নিয়ন্ত্রণে কড়া স্যানিটারি অ্যান্ড ফাইটোস্যানিটারি মানদ- আরোপ করে থাকে, যা পূরণে ব্যর্থ হলে রপ্তানি বাতিলের সম্ভাবনা থাকে। ফলমাছি নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত পোকা ব্যবস্থাপনা এবং আধুনিক বালাইনাশক ব্যবস্থাপনা জরুরি।
কোল্ড চেইন বা ঠা-া-শৃঙ্খল অবকাঠামোর অভাব
রপ্তানির জন্য ফলমূল দীর্ঘ সময় সংরক্ষণ এবং পরিবহনের ক্ষেত্রে ঠা-া-শৃঙ্খল বা কোল্ড চেইনের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু বাংলাদেশের আম উৎপাদন এলাকায় প্রয়োজনীয় হিমাগার বা কোল্ড স্টোরেজের অভাব রয়েছে। এছাড়া বিমানবন্দরে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত কার্গো হ্যান্ডলিং সুবিধারও ঘাটতি রয়েছে, ফলে রপ্তানির সময় ফলের মান হ্রাস পায়। এই অব্যবস্থাপনার কারণে অনেক সময় রপ্তানিকারকরা অর্ডার বাতিল করতে বাধ্য হন।
উচ্চ পরিবহন ব্যয় ও লজিস্টিক সমস্যা
বাংলাদেশ থেকে আম রপ্তানির ক্ষেত্রে বিমান পরিবহন অন্যতম মাধ্যম। তবে ফ্রেইট চার্জ অত্যন্ত বেশি হওয়ায় রপ্তানিকারকদের মুনাফা মার্জিন কমে যায়। পাশাপাশি আম রপ্তানিতে বিশেষায়িত কার্গো বিমানের সংখ্যা কম এবং সময়মতো বুকিং নিশ্চিত করা কঠিন, যা সময়মতো পণ্য পৌঁছাতে বাধা সৃষ্টি করে। এসব সমস্যার ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতামূলক দামে আম সরবরাহ করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব
জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের কৃষি খাতে একটি দীর্ঘমেয়াদি চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অতিরিক্ত গরম, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত এবং খরার কারণে আমের ফুল ফোটা এবং ফলন ব্যাহত হচ্ছে। কিছু অঞ্চলে গাছ অকালেই ফল ঝরিয়ে দিচ্ছে, আবার কোথাও আম পরিপক্ব হতে সময় নিচ্ছে বেশি। এছাড়া বেড়ে যাওয়া সেচের প্রয়োজনীয়তা উৎপাদন ব্যয় বাড়াচ্ছে, যা কৃষকদের আর্থিকভাবে চাপের মুখে ফেলছে। এই প্রভাব থেকে উত্তরণে জলবায়ু সহনশীল জাত উদ্ভাবন ও চাষে নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার অপরিহার্য।
সম্ভাবনা ও সুযোগসমূহ
বাংলাদেশের আম রপ্তানি খাতে সম্ভাবনা বিপুল, তবে তা যথাযথভাবে কাজে লাগাতে হলে বিদ্যমান সুযোগগুলোর দক্ষ ব্যবস্থাপনা এবং প্রাতিষ্ঠানিক সমর্থন প্রয়োজন।
গুড অ্যাগ্রিকালচারাল প্র্যাকটিস গ্রহণ ও প্রশিক্ষণ
আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশের জন্য এঅচ অনুসরণ একটি অপরিহার্য শর্ত। কৃষকদের এঅচ-সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ ও সচেতনতামূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে তারা নিরাপদ এবং টেকসই কৃষিপ্রযুক্তি গ্রহণে সক্ষম হবেন। সরকার ও বেসরকারি উদ্যোগে জিএপি সার্টিফিকেশন সুবিধা সম্প্রসারণ করা গেলে ইউরোপ, জাপানসহ উচ্চ মানসম্পন্ন বাজারে প্রবেশের দ্বার আরও উন্মুক্ত হবে।
মূল্য সংযোজন ও প্রক্রিয়াজাত পণ্য
আমের কাঁচা রূপের পাশাপাশি প্রক্রিয়াজাত পণ্য যেমনÑশুকনো আম, আমের জ্যাম, জুস, পিউরি ইত্যাদি তৈরি করে তা রপ্তানি করা হলে বৈচিত্র্য সৃষ্টি হবে এবং রপ্তানি আয় বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে।
এছাড়া প্রক্রিয়াজাত পণ্যের সংরক্ষণকাল বেশি হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে এর সরবরাহ স্থিতিশীল রাখা সহজ হবে।
নতুন বাজারে প্রবেশ
চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন দেশে আমের চাহিদা রয়েছে। চীনের সঙ্গে ফাইটোস্যানিটারি চুক্তি, জাপানের কঠোর মান পূরণের লক্ষ্যে পরিকল্পনা, এবং ইউরোপে বিশেষ জাতের জিআই স্বীকৃত আম সরবরাহ করে বাংলাদেশ নতুন বাজারে রপ্তানি বহুগুণে বাড়াতে পারে।
প্রযুক্তি ও ট্রেসেবিলিটি সিস্টেম
ই-ট্রেসেবিলিটি এবং ব্লকচেইন প্রযুক্তির মাধ্যমে আমের উৎপাদন, সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও পরিবহনের প্রতিটি ধাপের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা সম্ভব। এটি আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের আস্থা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এবং রপ্তানি বাজারে বাংলাদেশের অবস্থান সুদৃঢ় করবে।
ভবিষ্যৎ করণীয় ও সুপারিশ নীতিগত সহায়তা ও প্রণোদনা
রপ্তানিকারকদের উৎসাহিত করতে হলে আম রপ্তানির জন্য আলাদা নীতিমালা প্রণয়ন, সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা এবং ভর্তুকি প্রদান অত্যন্ত জরুরি। সরকারিভাবে কৃষকদের সহায়তা প্রদান ও আম রপ্তানিকে বিশেষ কৃষি খাত হিসেবে ঘোষণা করাও কার্যকর পদক্ষেপ হতে পারে।
অবকাঠামো উন্নয়ন
ঠা-া সংরক্ষণাগার, আধুনিক প্যাকেজিং সুবিধা এবং তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন আমের মান বজায় রাখতে সাহায্য করবে। এছাড়া বিমানবন্দর ও রপ্তানি কেন্দ্রে ফলমূলের জন্য আলাদা কোল্ড হ্যান্ডলিং জোন স্থাপন প্রয়োজন।
গবেষণা ও উন্নয়ন
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় সহনশীল জাত উদ্ভাবন এবং আধুনিক চাষ ব্যবস্থার প্রচলনে গবেষণা বাড়ানো জরুরি। কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে।
আন্তর্জাতিক মানদ- পূরণ
এঅচ, ঐঅঈঈচ, ওঝঙ-২২০০০ ইত্যাদি মানদ- পূরণের মাধ্যমে বাংলাদেশের আম আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠতে পারে। এজন্য সার্টিফিকেশন প্রক্রিয়া সহজীকরণ ও প্রশিক্ষণের সুযোগ বাড়ানো দরকার। বাংলাদেশের আম রপ্তানি খাতে রয়েছে বিপুল সম্ভাবনা, তবে তা পুরোপুরি কাজে লাগাতে হলে প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, কাঠামোগত উন্নয়ন, প্রযুক্তির ব্যবহার এবং নীতিগত সহায়তা। কাঁচামালের গুণগত মান রক্ষা থেকে শুরু করে প্রক্রিয়াজাতকরণ, ট্রেসেবিলিটি এবং বাজার বৈচিত্র্য সবকিছুতেই প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ। কৃষক, রপ্তানিকারক, সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে এ খাতকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একটি লাভজনক ও টেকসই খাতে রূপান্তর করা সম্ভব। বাংলাদেশের আম বিশ্ব বাজারে একটি নির্ভরযোগ্য ও ব্র্যান্ডেড পণ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হোক এটাই সবার প্রত্যাশা।
[লেখক : প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, শস্য বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল]