alt

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

সময়ের স্বৈরতন্ত্র : প্রতীক্ষা, ক্ষমতা ও জীবনের অসমতা

মতিউর রহমান

: রোববার, ২৭ জুলাই ২০২৫

সময়Ñযা একসময় শুধু একটি নিরপেক্ষ মাত্রা হিসেবে বিবেচিত হতোÑআজ সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে এক নতুন তাৎপর্য লাভ করেছে। পিয়ের বুরদিয়ে এবং ডেভিড হার্ভের যুগান্তকারী কাজগুলোর ভিত্তিতে, সময় এখন শুধু একটি চলমান প্রবাহ নয়; এটি প্রতীকী পুঁজি, ক্ষমতার এক সূক্ষ্ম এবং অদৃশ্য রূপ।

সমাজে বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ সময়কে ভিন্নভাবে উপলব্ধি করে, ভিন্নরূপে ভোগ করে। অপেক্ষাÑযা একসময় নিছক দৈনন্দিন জীবনের একটি অংশ ছিলÑআজ তা হয়ে উঠেছে শ্রেণি, ক্ষমতা ও সামাজিক বৈষম্যের এক তীব্র প্রতীক। অপেক্ষার এই অভিজ্ঞতা আমাদের ব্যক্তিগত জীবন ছাড়িয়ে সমাজের গভীর স্তর পর্যন্ত বিস্তৃত।

আমরা যারা প্রতিদিন অপেক্ষা করিÑব্যাংকের দীর্ঘ লাইনে, হাসপাতালের করিডোরে, সরকারি অফিসের বারান্দায়, অথবা ট্রেন-বাসের কাউন্টারেÑ তাদের প্রতিটি মুহূর্ত যেন কোনো অদৃশ্য শক্তির কাছে আত্মসমর্পণেরই নামান্তর। অপেক্ষার এই অভিজ্ঞতা কখনো ক্লান্তিকর, কখনো অপমানজনক, আবার কখনো নিঃস্ব করার মতো। একজন সাধারণ মানুষ যখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে একটি সাধারণ সেবা পাওয়ার জন্য, তখন তার শারীরিক ও মানসিক শক্তি ক্ষয় হয়, যা তার উৎপাদনশীলতাকে ব্যাহত করে; কিন্তু প্রশ্ন হলোÑ সবাই কি সমানভাবে অপেক্ষা করে? উত্তর হলোÑনা। সমাজে প্রতিটি শ্রেণী ভিন্ন-ভিন্নভাবে সময়ের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করে এবং এই সম্পর্কই তাদের সামাজিক অবস্থানকে আরও দৃঢ় করে।

পিয়ের বুরদিয়ে তার ধ্রুপদী গ্রন্থ ডিস্টিংশনে (১৯৮৪) ব্যাখ্যা করেছিলেন যে, কেবল অর্থনৈতিক পুঁজি নয়, বরং সাংস্কৃতিক ও প্রতীকী পুঁজি সমাজে শ্রেণি কাঠামো গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সময় ব্যবস্থাপনাও এখন প্রতীকী পুঁজির একটি শক্তিশালী রূপ। মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত যারা কর্মক্ষেত্রে নিজেদের সময় ‘মূল্যবান’ প্রমাণ করতে সক্ষম, তারা সাধারণত অপেক্ষা করেন না; বরং তাদের জন্য অপেক্ষা করে থাকে অন্য কেউ। উদাহরণস্বরূপ, একজন কর্পোরেট কর্মকর্তা হয়তো ব্যাংকে লাইনে না দাঁড়িয়েই তার প্রয়োজনীয় সেবা পেয়ে যান, কারণ তার ‘সময়’ মূল্যবান বলে ধরা হয়। তার সামাজিক মর্যাদা এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতা তাকে এই বিশেষ সুবিধা এনে দেয়।

অপরদিকে একজন গার্মেন্ট শ্রমিক, দিনমজুর অথবা গ্রামের একজন দরিদ্র কৃষককে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয় সাধারণ একটি সেবার জন্য, কারণ সমাজ তার সময়কে তেমন গুরুত্ব দেয় না। তাদের শ্রমের মূল্য যেমন কম ধরা হয়, তেমনি তাদের সময়ের মূল্যও সমাজে নির্ধারিত হয় কম। এই অসমতা শুধু সেবাপ্রাপ্তিতে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি তাদের আত্মমর্যাদা এবং সামাজিক অবস্থানের ওপরও প্রভাব ফেলে।

ডেভিড হার্ভে তার প্রভাবশালী গ্রন্থ দ্য কন্ডিশন অব পোস্টমডার্নিটিতে (১৯৮৯) বলেছেন, পুঁজিবাদ কেবল পণ্যই উৎপাদন করে না, বরং সময় এবং স্থানেরও পণ্যায়ন ঘটায়। পোস্টমডার্ন পুঁজিবাদ সময়কে এমনভাবে পুনর্গঠন করেছে, যেখানে অপেক্ষার অর্থ হলোÑক্ষমতা না থাকা। অপেক্ষার এই ‘অর্থনীতি’; মূলত এমন এক ব্যবস্থা তৈরি করে, যেখানে অপেক্ষা করার সামর্থ্য কিংবা সেই সময়কে উৎপাদনে রূপান্তর করার ক্ষমতা নির্ধারণ করে কে কতোটা প্রভাবশালী।

যারা অপেক্ষা করেন, তারা তাদের শ্রম এবং উৎপাদনশীল সময়কে বিনামূল্যে অন্যের হাতে তুলে দিচ্ছেন। এই প্রক্রিয়াটি কেবল ব্যক্তি পর্যায় নয়, বরং সামষ্টিকভাবে একটি অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, কারণ অপেক্ষার কারণে অপচয় হওয়া সময় জাতীয় উৎপাদনশীলতাকে কমিয়ে দেয়। হার্ভে দেখান কিভাবে পুঁজিবাদের দ্রুত বিকাশ এবং বিশ্বায়নের ফলে সময় ও স্থান সংকুচিত হয়ে আসছে (টাইম-স্পেস কম্প্রেশন), কিন্তু এই সংকোচন সমাজের সকল স্তরে সমানভাবে প্রতিফলিত হয় না। যাদের ক্ষমতা আছে, তাদের জন্য সময় যেন আরও দ্রুত চলে; আর যাদের নেই, তাদের জন্য তা স্থবির হয়ে পড়ে।

বাংলাদেশের বাস্তবতা এই তত্ত্বগুলোকে নতুন মাত্রায় প্রকাশ করে। সরকারি অফিসে বা কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির লাইনে যে ধৈর্য নিয়ে অপেক্ষা করতে হয়, তা শুধু নাগরিক কর্তব্য নয়; বরং এটি শ্রেণিগত নিপীড়নের এক স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি। ধনী এবং ক্ষমতাবানদের জন্য রয়েছে ‘ব্যাকডোর’ বা ‘ভিআইপি সার্ভিস’, যেখানে তারা দ্রুত এবং নির্বিঘেœ সেবা পেয়ে যায়, কারণ তাদের সামাজিক প্রভাব এবং অর্থ তাদের এই সুবিধা কিনে দেয়। হাসপাতালের জরুরি বিভাগেও একদিকে অপেক্ষার দীর্ঘ লাইন, অন্যদিকে ‘চেনাজানা’ লোকদের অগ্রাধিকার দেওয়ার সংস্কৃতি বিদ্যমান। এই দ্বৈত বাস্তবতা শুধু প্রশাসনিক দুর্নীতিই নয়, বরং সময়ের ওপর শ্রেণীভিত্তিক দখল প্রতিষ্ঠার নমুনা। এটি প্রমাণ করে যে, সমাজে কিছু মানুষ তাদের সময়কে ক্ষমতার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারে, আর কিছু মানুষ তাদের সময়কে অন্যের দয়ায় ব্যয় করতে বাধ্য হয়। এই ব্যবস্থার ফলে দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষেরা আরও পিছিয়ে পড়ে, কারণ তাদের মূল্যবান সময় নষ্ট হয় এবং তারা ন্যায্য সেবা থেকেও বঞ্চিত হয়।

এই প্রেক্ষাপটে অপেক্ষা হয়ে উঠেছে এক ধরনের ‘মৌন নিপীড়ন’Ñযা উচ্চস্বরে নয়, বরং নীরবে একজন মানুষকে ক্লান্ত করে তোলে, অপমানিত করে, তার মানবিক মর্যাদাকে খর্ব করে। যেমন, একজন দরিদ্র কৃষক যদি সরকারি ভর্তুকির জন্য দিনের পর দিন অফিসে ঘুরে বেড়ান, শুধুমাত্র সামান্য কাগজপত্র জমা দেওয়ার জন্য, আর একজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ঘরে বসেই পরিচিতদের মাধ্যমে সে সুবিধা পেয়ে যান, তাহলে অপেক্ষা কেবল সময় নষ্ট নয়Ñএটি হয়ে যায় সামাজিক অসমতার তীব্র প্রতিফলন। এই অপেক্ষা শুধু ব্যক্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে না, বরং এটি তার পরিবারের ওপরও প্রভাব ফেলে, কারণ অপেক্ষার কারণে তার উপার্জনের সময় কমে যায় এবং তার মনে হতাশা তৈরি হয়। এটি একটি চক্রাকার প্রক্রিয়া যা দরিদ্রদের আরও দরিদ্র করে তোলে এবং ধনীদের ক্ষমতা আরও বৃদ্ধি করে।

সময় এখানে একপ্রকার রাজনৈতিক পুঁজি। কে কাকে অপেক্ষায় রাখবে, আর কে কখন মুক্তি পাবেÑএই সিদ্ধান্ত নির্ধারিত হয় শ্রেণি, পেশা, পরিচিতি ও প্রতীকী ক্ষমতার ভিত্তিতে। এই প্রক্রিয়াটি একটি অদৃশ্য শ্রেণিবিন্যাস তৈরি করে যেখানে সময়কে একটি সম্পদ হিসেবে দেখা হয়। সময়কে যেহেতু পণ্যায়ন করা হয়েছে, সেহেতু অপেক্ষার মাধ্যমে সময়ের ওপর একটি শ্রেণিভিত্তিক নিয়ন্ত্রণও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যারা সময়কে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, তারা সমাজের উচ্চস্তরে অবস্থান করে, আর যাদের সময় অন্যের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, তারা সমাজে প্রান্তিক হয়ে পড়ে। এই নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেই ক্ষমতা প্রবাহিত হয় এবং সামাজিক অসমতা বজায় রাখে।

পিয়ের বুরদিয়ে বলেছিলেন, প্রতীকী সহিংসতা হলো সেই শাসনযন্ত্র, যা অধীনস্ত শ্রেণিকে দমন করে, কিন্তু তারা এটিকে নিয়তির অংশ হিসেবে মেনে নেয়। একইভাবে, অপেক্ষার সংস্কৃতি আমাদের মধ্যে এমন এক আত্মিক বোধ গড়ে তোলে, যা বলেÑ‘গরিব মানুষ তো অপেক্ষা করবেই’, ‘এটা তাদের নিয়তি’। এই ধারণা একদিকে আমাদের বৈষম্যমূলক সমাজব্যবস্থাকে স্থায়িত্ব দেয়, অন্যদিকে অপেক্ষা করার প্রবণতাকে গরিব ও নিম্নশ্রেণির নাগরিকদের অভ্যাসে পরিণত করে। এই প্রক্রিয়াটি এতটাই সূক্ষ্ম যে, অনেকেই এটিকে স্বাভাবিক বলে মেনে নেয়, যা এই বৈষম্যকে আরও গভীর করে। মানুষ মনে করে, এটি তাদের ভাগ্যের অংশ, যখন এটি আসলে একটি কাঠামোগত নিপীড়ন।

বাংলাদেশে এই বাস্তবতা দিনকে দিন আরো জটিল হয়ে উঠছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে ওঠার স্লোগানের পেছনে প্রযুক্তির উন্নতি ঘটলেও, এই উন্নয়ন প্রত্যেক শ্রেণীর নাগরিকের জন্য সমান সুফল বয়ে আনছে না। একজন প্রযুক্তি-সচেতন মধ্যবিত্ত হয়তো মোবাইল অ্যাপ দিয়ে গ্যাস বিল জমা দিচ্ছেন, বা অনলাইনে ট্রেনের টিকিট কাটছেন, যা তার মূল্যবান সময় বাঁচিয়ে দেয়; কিন্তু একজন নিম্মবিত্ত আজও ব্যাংকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকেন টাকা তোলার জন্য, অথবা বিদ্যুৎ বিল দিতে লম্বা লাইনে দাঁড়াতে বাধ্য হন। অর্থাৎ প্রযুক্তিগত সুযোগও অপেক্ষার বৈষম্যকে দূর করতে পারছে না; বরং কখনো কখনো সেটি আরো তীব্র করে তুলছে। কারণ প্রযুক্তির সুবিধাগুলো মূলত যারা প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারে এবং সেগুলোতে প্রবেশাধিকার আছে, তাদের জন্যই সহজলভ্য। যারা এ সুবিধাগুলো থেকে বঞ্চিত, তাদের জন্য জীবন আরও কঠিন হয়ে ওঠে।

এই পরিপ্রেক্ষিতে ‘সময়ের স্বৈরতন্ত্র’ কোনো বিমূর্ত তাত্ত্বিক ধারণা নয়; এটি আমাদের প্রতিদিনের জীবনের ভেতরকার এক সামাজিক বাস্তবতা। সময়কে যারা নিয়ন্ত্রণ করে, তারাই ক্ষমতার মালিক। আর যাদের সময়কে অপেক্ষার মধ্যে আটকে রাখা হয়, তারা সমাজের প্রান্তিক ও নিপীড়িত শ্রেণী। এই স্বৈরতন্ত্র নীরব হলেও এর প্রভাব সুদূরপ্রসারি; যা ব্যক্তির জীবনমান থেকে শুরু করে জাতীয় উৎপাদনশীলতা পর্যন্ত সবকিছুকে প্রভাবিত করে।

তাই প্রতীক্ষা শুধু ধৈর্যের পরীক্ষা নয়; এটি ক্ষমতার নির্মাণ ও অসাম্যের প্রতিফলন। সময় এখন আর সবার জন্য সমান নয়। এটি হয়ে উঠেছে এমন এক পুঁজিবাদী সম্পদ, যার সুষম বণ্টনের দাবি তোলা জরুরি। অপেক্ষার এই সামাজিক-রাজনৈতিক কাঠামো ভাঙতে না পারলে, সমাজের প্রান্তিক মানুষেরা সময় নামক পুঁজির ওপর অধিকার থেকে চিরকাল বঞ্চিতই থেকে যাবেন।

এই স্বৈরতন্ত্র থেকে মুক্তির জন্য প্রয়োজন কাঠামোগত পরিবর্তন, যেখানে সবার জন্য সমান সুযোগ এবং মর্যাদার সঙ্গে সেবা প্রাপ্তি নিশ্চিত হবে। এই পরিবর্তন আনা সম্ভব শুধু তখনই যখন আমরা সময়ের এই অসম বণ্টনকে একটি সামাজিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করব এবং এর বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলব।

[লেখক : গবেষক ও উন্নয়নকর্মী]

জোটের ভোট নাকি ভোটের জোট, কৌশলটা কী?

প্রমাণ তো করতে হবে আমরা হাসিনার চেয়ে ভালো

ছবি

কৃষি ডেটা ব্যবস্থাপনা

যুক্তরাজ্যে ভর্তি স্থগিতের কুয়াশা: তালা লাগলেও চাবি আমাদের হাতে

শিক্ষকদের কর্মবিরতি: পেশাগত নৈতিকতা ও দায়িত্ববোধ

জাতীয় রক্তগ্রুপ নির্ণয় দিবস

জাল সনদপত্রে শিক্ষকতা

সাধারণ চুক্তিগুলোও গোপনীয় কেন

ছবি

শিশুখাদ্যের নিরাপত্তা: জাতির ভবিষ্যৎ সুরক্ষার প্রথম শর্ত

ছবি

ফিনল্যান্ড কেন সুখী দেশ

ছবি

কৃষকের সংকট ও অর্থনীতির ভবিষ্যৎ

আলু চাষের আধুনিক প্রযুক্তি

ই-বর্জ্য: নীরব বিষে দগ্ধ আমাদের ভবিষ্যৎ

ঢাকার জনপরিসর: আর্ভিং গফম্যানের সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ

আলু চাষের আধুনিক প্রযুক্তি

কলি ফুটিতে চাহে ফোটে না!

কৃষিতে স্মার্ট প্রযুক্তি

রোহিঙ্গা সংকটের টেকসই সমাধানে লোকালাইজেশন অপরিহার্য

আইসিইউ থেকে বাড়ি ফেরা ও খাদের কিনারায় থাকা দেশ

বিচারবহির্ভূত হত্যার দায় কার?

ছবি

ট্রাম্পের ভেনেজুয়েলা কৌশল

অযৌক্তিক দাবি: পেশাগত নৈতিকতার সংকট ও জনপ্রশাসন

সড়ক দুর্ঘটনা এখন জাতীয় সংকট

কেন বাড়ছে দারিদ্র্য?

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পুনর্জন্ম

লবণাক্ততায় ডুবছে উপকূল

বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন ও বাস্তবতা

সড়ক দুর্ঘটনার সমাজতত্ত্ব: আইন প্রয়োগের ব্যর্থতা ও কাঠামোর চক্রাকার পুনরুৎপাদন

ছবি

অস্থির সময় ও অস্থির সমাজের পাঁচালি

ভারতে বামপন্থার পুনর্জাগরণ: ব্যাধি ও প্রতিকার

চিপনির্ভরতা কাটিয়ে চীনের উত্থান

একতার বাতাসে উড়ুক দক্ষিণ এশিয়ার পতাকা

ছবি

স্মরণ: শহীদ ডা. মিলন ও বৈষম্যহীন ব্যবস্থার সংগ্রাম

মনে পুরানো দিনের কথা আসে, মনে আসে, ফিরে আসে...

রাসায়নিক দূষণ ও ক্যান্সারের ঝুঁকি

আছদগঞ্জের শুটকি : অতীতের গৌরব, বর্তমানের দুঃসময়

tab

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

সময়ের স্বৈরতন্ত্র : প্রতীক্ষা, ক্ষমতা ও জীবনের অসমতা

মতিউর রহমান

রোববার, ২৭ জুলাই ২০২৫

সময়Ñযা একসময় শুধু একটি নিরপেক্ষ মাত্রা হিসেবে বিবেচিত হতোÑআজ সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে এক নতুন তাৎপর্য লাভ করেছে। পিয়ের বুরদিয়ে এবং ডেভিড হার্ভের যুগান্তকারী কাজগুলোর ভিত্তিতে, সময় এখন শুধু একটি চলমান প্রবাহ নয়; এটি প্রতীকী পুঁজি, ক্ষমতার এক সূক্ষ্ম এবং অদৃশ্য রূপ।

সমাজে বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ সময়কে ভিন্নভাবে উপলব্ধি করে, ভিন্নরূপে ভোগ করে। অপেক্ষাÑযা একসময় নিছক দৈনন্দিন জীবনের একটি অংশ ছিলÑআজ তা হয়ে উঠেছে শ্রেণি, ক্ষমতা ও সামাজিক বৈষম্যের এক তীব্র প্রতীক। অপেক্ষার এই অভিজ্ঞতা আমাদের ব্যক্তিগত জীবন ছাড়িয়ে সমাজের গভীর স্তর পর্যন্ত বিস্তৃত।

আমরা যারা প্রতিদিন অপেক্ষা করিÑব্যাংকের দীর্ঘ লাইনে, হাসপাতালের করিডোরে, সরকারি অফিসের বারান্দায়, অথবা ট্রেন-বাসের কাউন্টারেÑ তাদের প্রতিটি মুহূর্ত যেন কোনো অদৃশ্য শক্তির কাছে আত্মসমর্পণেরই নামান্তর। অপেক্ষার এই অভিজ্ঞতা কখনো ক্লান্তিকর, কখনো অপমানজনক, আবার কখনো নিঃস্ব করার মতো। একজন সাধারণ মানুষ যখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে একটি সাধারণ সেবা পাওয়ার জন্য, তখন তার শারীরিক ও মানসিক শক্তি ক্ষয় হয়, যা তার উৎপাদনশীলতাকে ব্যাহত করে; কিন্তু প্রশ্ন হলোÑ সবাই কি সমানভাবে অপেক্ষা করে? উত্তর হলোÑনা। সমাজে প্রতিটি শ্রেণী ভিন্ন-ভিন্নভাবে সময়ের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করে এবং এই সম্পর্কই তাদের সামাজিক অবস্থানকে আরও দৃঢ় করে।

পিয়ের বুরদিয়ে তার ধ্রুপদী গ্রন্থ ডিস্টিংশনে (১৯৮৪) ব্যাখ্যা করেছিলেন যে, কেবল অর্থনৈতিক পুঁজি নয়, বরং সাংস্কৃতিক ও প্রতীকী পুঁজি সমাজে শ্রেণি কাঠামো গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সময় ব্যবস্থাপনাও এখন প্রতীকী পুঁজির একটি শক্তিশালী রূপ। মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত যারা কর্মক্ষেত্রে নিজেদের সময় ‘মূল্যবান’ প্রমাণ করতে সক্ষম, তারা সাধারণত অপেক্ষা করেন না; বরং তাদের জন্য অপেক্ষা করে থাকে অন্য কেউ। উদাহরণস্বরূপ, একজন কর্পোরেট কর্মকর্তা হয়তো ব্যাংকে লাইনে না দাঁড়িয়েই তার প্রয়োজনীয় সেবা পেয়ে যান, কারণ তার ‘সময়’ মূল্যবান বলে ধরা হয়। তার সামাজিক মর্যাদা এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতা তাকে এই বিশেষ সুবিধা এনে দেয়।

অপরদিকে একজন গার্মেন্ট শ্রমিক, দিনমজুর অথবা গ্রামের একজন দরিদ্র কৃষককে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয় সাধারণ একটি সেবার জন্য, কারণ সমাজ তার সময়কে তেমন গুরুত্ব দেয় না। তাদের শ্রমের মূল্য যেমন কম ধরা হয়, তেমনি তাদের সময়ের মূল্যও সমাজে নির্ধারিত হয় কম। এই অসমতা শুধু সেবাপ্রাপ্তিতে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি তাদের আত্মমর্যাদা এবং সামাজিক অবস্থানের ওপরও প্রভাব ফেলে।

ডেভিড হার্ভে তার প্রভাবশালী গ্রন্থ দ্য কন্ডিশন অব পোস্টমডার্নিটিতে (১৯৮৯) বলেছেন, পুঁজিবাদ কেবল পণ্যই উৎপাদন করে না, বরং সময় এবং স্থানেরও পণ্যায়ন ঘটায়। পোস্টমডার্ন পুঁজিবাদ সময়কে এমনভাবে পুনর্গঠন করেছে, যেখানে অপেক্ষার অর্থ হলোÑক্ষমতা না থাকা। অপেক্ষার এই ‘অর্থনীতি’; মূলত এমন এক ব্যবস্থা তৈরি করে, যেখানে অপেক্ষা করার সামর্থ্য কিংবা সেই সময়কে উৎপাদনে রূপান্তর করার ক্ষমতা নির্ধারণ করে কে কতোটা প্রভাবশালী।

যারা অপেক্ষা করেন, তারা তাদের শ্রম এবং উৎপাদনশীল সময়কে বিনামূল্যে অন্যের হাতে তুলে দিচ্ছেন। এই প্রক্রিয়াটি কেবল ব্যক্তি পর্যায় নয়, বরং সামষ্টিকভাবে একটি অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, কারণ অপেক্ষার কারণে অপচয় হওয়া সময় জাতীয় উৎপাদনশীলতাকে কমিয়ে দেয়। হার্ভে দেখান কিভাবে পুঁজিবাদের দ্রুত বিকাশ এবং বিশ্বায়নের ফলে সময় ও স্থান সংকুচিত হয়ে আসছে (টাইম-স্পেস কম্প্রেশন), কিন্তু এই সংকোচন সমাজের সকল স্তরে সমানভাবে প্রতিফলিত হয় না। যাদের ক্ষমতা আছে, তাদের জন্য সময় যেন আরও দ্রুত চলে; আর যাদের নেই, তাদের জন্য তা স্থবির হয়ে পড়ে।

বাংলাদেশের বাস্তবতা এই তত্ত্বগুলোকে নতুন মাত্রায় প্রকাশ করে। সরকারি অফিসে বা কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির লাইনে যে ধৈর্য নিয়ে অপেক্ষা করতে হয়, তা শুধু নাগরিক কর্তব্য নয়; বরং এটি শ্রেণিগত নিপীড়নের এক স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি। ধনী এবং ক্ষমতাবানদের জন্য রয়েছে ‘ব্যাকডোর’ বা ‘ভিআইপি সার্ভিস’, যেখানে তারা দ্রুত এবং নির্বিঘেœ সেবা পেয়ে যায়, কারণ তাদের সামাজিক প্রভাব এবং অর্থ তাদের এই সুবিধা কিনে দেয়। হাসপাতালের জরুরি বিভাগেও একদিকে অপেক্ষার দীর্ঘ লাইন, অন্যদিকে ‘চেনাজানা’ লোকদের অগ্রাধিকার দেওয়ার সংস্কৃতি বিদ্যমান। এই দ্বৈত বাস্তবতা শুধু প্রশাসনিক দুর্নীতিই নয়, বরং সময়ের ওপর শ্রেণীভিত্তিক দখল প্রতিষ্ঠার নমুনা। এটি প্রমাণ করে যে, সমাজে কিছু মানুষ তাদের সময়কে ক্ষমতার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারে, আর কিছু মানুষ তাদের সময়কে অন্যের দয়ায় ব্যয় করতে বাধ্য হয়। এই ব্যবস্থার ফলে দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষেরা আরও পিছিয়ে পড়ে, কারণ তাদের মূল্যবান সময় নষ্ট হয় এবং তারা ন্যায্য সেবা থেকেও বঞ্চিত হয়।

এই প্রেক্ষাপটে অপেক্ষা হয়ে উঠেছে এক ধরনের ‘মৌন নিপীড়ন’Ñযা উচ্চস্বরে নয়, বরং নীরবে একজন মানুষকে ক্লান্ত করে তোলে, অপমানিত করে, তার মানবিক মর্যাদাকে খর্ব করে। যেমন, একজন দরিদ্র কৃষক যদি সরকারি ভর্তুকির জন্য দিনের পর দিন অফিসে ঘুরে বেড়ান, শুধুমাত্র সামান্য কাগজপত্র জমা দেওয়ার জন্য, আর একজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ঘরে বসেই পরিচিতদের মাধ্যমে সে সুবিধা পেয়ে যান, তাহলে অপেক্ষা কেবল সময় নষ্ট নয়Ñএটি হয়ে যায় সামাজিক অসমতার তীব্র প্রতিফলন। এই অপেক্ষা শুধু ব্যক্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে না, বরং এটি তার পরিবারের ওপরও প্রভাব ফেলে, কারণ অপেক্ষার কারণে তার উপার্জনের সময় কমে যায় এবং তার মনে হতাশা তৈরি হয়। এটি একটি চক্রাকার প্রক্রিয়া যা দরিদ্রদের আরও দরিদ্র করে তোলে এবং ধনীদের ক্ষমতা আরও বৃদ্ধি করে।

সময় এখানে একপ্রকার রাজনৈতিক পুঁজি। কে কাকে অপেক্ষায় রাখবে, আর কে কখন মুক্তি পাবেÑএই সিদ্ধান্ত নির্ধারিত হয় শ্রেণি, পেশা, পরিচিতি ও প্রতীকী ক্ষমতার ভিত্তিতে। এই প্রক্রিয়াটি একটি অদৃশ্য শ্রেণিবিন্যাস তৈরি করে যেখানে সময়কে একটি সম্পদ হিসেবে দেখা হয়। সময়কে যেহেতু পণ্যায়ন করা হয়েছে, সেহেতু অপেক্ষার মাধ্যমে সময়ের ওপর একটি শ্রেণিভিত্তিক নিয়ন্ত্রণও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যারা সময়কে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, তারা সমাজের উচ্চস্তরে অবস্থান করে, আর যাদের সময় অন্যের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, তারা সমাজে প্রান্তিক হয়ে পড়ে। এই নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেই ক্ষমতা প্রবাহিত হয় এবং সামাজিক অসমতা বজায় রাখে।

পিয়ের বুরদিয়ে বলেছিলেন, প্রতীকী সহিংসতা হলো সেই শাসনযন্ত্র, যা অধীনস্ত শ্রেণিকে দমন করে, কিন্তু তারা এটিকে নিয়তির অংশ হিসেবে মেনে নেয়। একইভাবে, অপেক্ষার সংস্কৃতি আমাদের মধ্যে এমন এক আত্মিক বোধ গড়ে তোলে, যা বলেÑ‘গরিব মানুষ তো অপেক্ষা করবেই’, ‘এটা তাদের নিয়তি’। এই ধারণা একদিকে আমাদের বৈষম্যমূলক সমাজব্যবস্থাকে স্থায়িত্ব দেয়, অন্যদিকে অপেক্ষা করার প্রবণতাকে গরিব ও নিম্নশ্রেণির নাগরিকদের অভ্যাসে পরিণত করে। এই প্রক্রিয়াটি এতটাই সূক্ষ্ম যে, অনেকেই এটিকে স্বাভাবিক বলে মেনে নেয়, যা এই বৈষম্যকে আরও গভীর করে। মানুষ মনে করে, এটি তাদের ভাগ্যের অংশ, যখন এটি আসলে একটি কাঠামোগত নিপীড়ন।

বাংলাদেশে এই বাস্তবতা দিনকে দিন আরো জটিল হয়ে উঠছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে ওঠার স্লোগানের পেছনে প্রযুক্তির উন্নতি ঘটলেও, এই উন্নয়ন প্রত্যেক শ্রেণীর নাগরিকের জন্য সমান সুফল বয়ে আনছে না। একজন প্রযুক্তি-সচেতন মধ্যবিত্ত হয়তো মোবাইল অ্যাপ দিয়ে গ্যাস বিল জমা দিচ্ছেন, বা অনলাইনে ট্রেনের টিকিট কাটছেন, যা তার মূল্যবান সময় বাঁচিয়ে দেয়; কিন্তু একজন নিম্মবিত্ত আজও ব্যাংকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকেন টাকা তোলার জন্য, অথবা বিদ্যুৎ বিল দিতে লম্বা লাইনে দাঁড়াতে বাধ্য হন। অর্থাৎ প্রযুক্তিগত সুযোগও অপেক্ষার বৈষম্যকে দূর করতে পারছে না; বরং কখনো কখনো সেটি আরো তীব্র করে তুলছে। কারণ প্রযুক্তির সুবিধাগুলো মূলত যারা প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারে এবং সেগুলোতে প্রবেশাধিকার আছে, তাদের জন্যই সহজলভ্য। যারা এ সুবিধাগুলো থেকে বঞ্চিত, তাদের জন্য জীবন আরও কঠিন হয়ে ওঠে।

এই পরিপ্রেক্ষিতে ‘সময়ের স্বৈরতন্ত্র’ কোনো বিমূর্ত তাত্ত্বিক ধারণা নয়; এটি আমাদের প্রতিদিনের জীবনের ভেতরকার এক সামাজিক বাস্তবতা। সময়কে যারা নিয়ন্ত্রণ করে, তারাই ক্ষমতার মালিক। আর যাদের সময়কে অপেক্ষার মধ্যে আটকে রাখা হয়, তারা সমাজের প্রান্তিক ও নিপীড়িত শ্রেণী। এই স্বৈরতন্ত্র নীরব হলেও এর প্রভাব সুদূরপ্রসারি; যা ব্যক্তির জীবনমান থেকে শুরু করে জাতীয় উৎপাদনশীলতা পর্যন্ত সবকিছুকে প্রভাবিত করে।

তাই প্রতীক্ষা শুধু ধৈর্যের পরীক্ষা নয়; এটি ক্ষমতার নির্মাণ ও অসাম্যের প্রতিফলন। সময় এখন আর সবার জন্য সমান নয়। এটি হয়ে উঠেছে এমন এক পুঁজিবাদী সম্পদ, যার সুষম বণ্টনের দাবি তোলা জরুরি। অপেক্ষার এই সামাজিক-রাজনৈতিক কাঠামো ভাঙতে না পারলে, সমাজের প্রান্তিক মানুষেরা সময় নামক পুঁজির ওপর অধিকার থেকে চিরকাল বঞ্চিতই থেকে যাবেন।

এই স্বৈরতন্ত্র থেকে মুক্তির জন্য প্রয়োজন কাঠামোগত পরিবর্তন, যেখানে সবার জন্য সমান সুযোগ এবং মর্যাদার সঙ্গে সেবা প্রাপ্তি নিশ্চিত হবে। এই পরিবর্তন আনা সম্ভব শুধু তখনই যখন আমরা সময়ের এই অসম বণ্টনকে একটি সামাজিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করব এবং এর বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলব।

[লেখক : গবেষক ও উন্নয়নকর্মী]

back to top