প্রতি বছর ২৯ জুলাই বিশ্বব্যাপী পালিত হয় বিশ্ব বাঘ দিবস। দিবসটি উদযাপনের মূল লক্ষ্য বাঘ সংরক্ষণ বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং বাঘ রক্ষায় নীতিনির্ধারক, বিজ্ঞানী, স্থানীয় জনগোষ্ঠী ও পরিবেশকর্মীদের মধ্যে সমন্বিত প্রচেষ্টা জোরদার করা। বাংলাদেশও প্রতি বছরের ন্যায় এবারও বাঘ দিবস পালন করছে বিশেষ কর্মসূচির মাধ্যমে। এবারের প্রতিপাদ্য “বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি, সুন্দরবনের সমৃদ্ধি”Ñএই সেøাগান শুধু একটি বার্তা নয়, এটি একটি প্রমাণিত বাস্তবতা। কারণ বাংলাদেশ ইতোমধ্যে বাঘ সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য অর্জন করেছে, যা দক্ষিণ এশিয়ায় একটি উদাহরণ হয়ে উঠেছে।

বাঘ সংরক্ষণের গুরুত্ব অপরিসীম। বাঘ একটি ‘আমব্রেলা স্পেসিজ’ যার অর্থ হলো, বাঘকে সংরক্ষণ করলে তার বিস্তীর্ণ আবাসস্থলও সংরক্ষিত হয়, যা পরোক্ষভাবে সেই অঞ্চলের অসংখ্য উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রজাতিকে সুরক্ষা দেয়। সুন্দরবনের মতো একটি জটিল ও সংবেদনশীল প্রতিবেশ ব্যবস্থার জন্য বাঘের উপস্থিতি অত্যাবশ্যক। বাঘের অভাবে হরিণ ও শূকরের সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যেতে পারে, যা বনের বৃক্ষলতা ও চারাগাছের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং দীর্ঘমেয়াদে বনের কাঠামো ও উদ্ভিদবৈচিত্র্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ফলস্বরূপ, সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য ও এর প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিঘিœত হয়, যা শুধু বনের ওপর নির্ভরশীল প্রাণীদের জীবনকেই নয়, বরং সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকাকেও হুমকির মুখে ফেলে। তাই বলা হয়, “বাঘ বাঁচলে বন বাঁচে, বন বাঁচলে মানুষ বাঁচে।” বাঘ সংরক্ষণ মানে সুন্দরবন সংরক্ষণ, আর সুন্দরবন সংরক্ষণ মানে বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলের পরিবেশ, প্রতিবেশ এবং অর্থনীতির স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা।

২০২৪ সালের সর্বশেষ বাঘ জরিপে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ১২৫টি পাওয়া গেছে, যা ২০১৮ সালের তুলনায় ৯.৬৫ শতাংশ এবং ২০১৫ সালের তুলনায় ১৭.৯২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই জরিপে প্রতি ১০০ বর্গকিলোমিটারে বাঘের ঘনত্ব ২.৬৪ পাওয়া গেছে, যা বাঘের জন্য একটি স্বাস্থ্যকর পরিবেশের ইঙ্গিত বহন করে। জরিপটি ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের মার্চ পর্যন্ত পরিচালিত হয়, যেখানে ৬০৫টি গ্রিডে ১,২১০টি ক্যামেরা বসিয়ে ৩১৮ দিন ধরে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এই ক্যামেরাগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাঘের ছবি এবং ১০ সেকেন্ডের ভিডিও ধারণ করেছে, যা থেকে প্রায় ১০ লক্ষাধিক ছবি ও ভিডিও বিশ্লেষণ করে ৭,২৯৭টি বাঘের ছবি পাওয়া গেছে। এই বিশাল তথ্যভা-ার ভারত, নিউজিল্যান্ড এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে যাচাই-বাছাই করে বাঘের সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়েছে।

সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধির পেছনে চোরাশিকার ও বনদস্যুতা নিয়ন্ত্রণ একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ; ২০১৮ সাল থেকে সুন্দরবন দস্যুমুক্ত হওয়ায় বাঘের প্রধান খাদ্য হরিণের অবাধ বিচরণ ও সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, যা বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে। জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত তিন মাস সুন্দরবনে সব ধরনের পাস-পারমিট বন্ধ রাখায় বন্যপ্রাণীরা নির্বিঘেœ বিচরণ করতে পারছে এবং আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর স্মার্ট ও ফুট প্যাট্রোলিং চোরাশিকার রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখছে। সরকারের একক প্রচেষ্টা নয়, বরং স্থানীয় জনগোষ্ঠী, বিশেষজ্ঞ, পরিবেশবাদী সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীদের সম্মিলিত উদ্যোগে এই সফলতা এসেছে, যেখানে কমিউনিটি প্যাট্রল টিম এবং বন বিভাগ কর্তৃক পরিচালিত স্মার্ট পেট্রোলিং ব্যবস্থা চোরাশিকার প্রতিরোধে বিশেষ কার্যকর ভূমিকা রেখেছে; এছাড়াও সচেতনতা কার্যক্রম ও বিকল্প জীবিকার সুযোগ তৈরির মাধ্যমে স্থানীয়দের বনের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে বাঘের নিরাপদ আবাস নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে।

তবে বাঘ সংরক্ষণে আমরা যতই এগিয়ে যাই না কেন, সামনে রয়েছে অনেক চ্যালেঞ্জ। সুন্দরবনে চোরা শিকার এখনো পুরোপুরি নির্মূল হয়নি। আন্তর্জাতিক বন্যপ্রাণী পাচার চক্র এখনো সক্রিয়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সুন্দরবনের পরিবেশে বিরূপ প্রভাব পড়ছেÑলবণাক্ততা বাড়ছে, খাড়ি ও খাল শুকিয়ে যাচ্ছে, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে বন ধ্বংস হচ্ছে। এছাড়া বাঘ ও মানুষের মধ্যে দ্বন্দ্বও একটি বড় সমস্যা, বিশেষ করে যখন বাঘ লোকালয়ে ঢুকে পড়ে বা মানুষ অবৈধভাবে বনে প্রবেশ করে। এইসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকারের পাশাপাশি সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষের সচেতনতা ও অংশগ্রহণ প্রয়োজন।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে বাংলাদেশ টাইগার অ্যাকশন প্ল্যান (২০১৮-২০২৭) প্রণয়ন করেছে, যার আওতায় বাঘ সংরক্ষণ, গবেষণা, নজরদারি এবং বাঘ-মানুষ দ্বন্দ্ব হ্রাসে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। সুন্দরবনে নির্বিচারে নৌযান চলাচল, বিষ দিয়ে মাছ ধরা এবং বনজ সম্পদ আহরণ বন্ধে কঠোর নজরদারি অব্যাহত রয়েছে। পাশাপাশি বন বিভাগের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য আধুনিক সরঞ্জাম ও প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। বিশ্ব বাঘ দিবস ২০২৫ উদযাপন উপলক্ষ্যে সরকার বিভিন্ন সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এসব আয়োজনের মাধ্যমে জনগণকে জানানো হচ্ছেÑবাঘ সংরক্ষণ শুধু বন বা বন্যপ্রাণীর বিষয় নয়, এটি আমাদের সবার টিকে থাকার সঙ্গে জড়িত।

এই সময়ে আমাদের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন হলো পরিবেশ সংরক্ষণকে একটি জাতীয় আন্দোলনে পরিণত করা, যাতে শিশু থেকে প্রবীণÑসবার মধ্যে বাঘ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ বিষয়ে সচেতনতা তৈরি হয়। গণমাধ্যম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় নেতা, জনপ্রতিনিধি, এবং নাগরিক সমাজÑসবাইকে নিয়ে এই কাজটিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে হবে। কারণ বাঘ রক্ষায় আজকের পদক্ষেপই আগামী প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারে।

স্মরণ রাখতে হবে, একটি দেশ তার প্রাকৃতিক সম্পদ হারালে শুধু পরিবেশগত ক্ষতিই নয়, অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তাও চরমভাবে বিঘিœত হয়। সুন্দরবনের বাঘ শুধু একটি বন্যপ্রাণী নয়Ñএটি আমাদের জলবায়ু সহনশীলতা, প্রতিবেশগত স্থিতিশীলতা, এবং উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর জীবিকার অন্যতম রক্ষাকবচ। তাই, বাঘ বাঁচানো মানেই দেশের পরিবেশ রক্ষা করা। “বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি, সুন্দরবনের সমৃদ্ধি”-এই প্রতিপাদ্য যেন শুধু একটি বার্তা না হয়ে ওঠে, বরং হয়ে উঠুক আমাদের প্রতিদিনের অঙ্গীকার। আসুন, সবাই মিলে হাত রাখি হাতে, বাঘ রক্ষায় দৃঢ় হই, সুন্দরবন বাঁচাই, বাংলাদেশকে রক্ষা করি।

[লেখক : জনসংযোগ কর্মকর্তা, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়]