alt

উপ-সম্পাদকীয়

নীল নদের পানি নীল নয়

আনোয়ারুল হক

: বুধবার, ৩০ জুলাই ২০২৫
image

১৯৭১ সালে প্রশিক্ষণ শেষে রাজাকারদের মার্চপাস্ট

শৈশবকালে আমরা পড়েছি নীল নদ আফ্রিকা মহাদেশে অবস্থিত বিশ্বের দীর্ঘতম নদী। এর অববাহিকাজুড়ে গড়ে উঠেছে যে সভ্যতা বিশেষ করে মিসরীয় সভ্যতার জন্য নীল নদ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। জমি সেচের জন্য নীল নদের প্লাবিত পানি মিসরীয়দের কৃষিকাজে খুবই সহায়ক ছিল। মিসরকে বলা হয় নীল নদের দেশ। নগর সভ্যতার শুরু মিসরে। এসব আমাদের ক্লাসে পড়ানো হতো। কিন্তু নীল নদের পানি যে নীল নয়, এটা সম্ভবত পড়ানো হয়নি। এটা প্রথম জানলাম বড় বেলায় মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর জনসভায় গিয়ে। মওলানা তার বক্তব্যে বলেছিলেন ‘নীল নদের পানি যেমন নীল নয়, তেমনি জামায়াতে ইসলামীও ইসলাম নয়।’

নীল নদের পানি কেনো নীল নয়? নীল নদে প্রচুর পরিমাণে কাদা জমা হতো। বিশেষ করে ইথিওপিয়ার উচ্চভূমি থেকে প্রচুর পলি, কাদা এবং উর্বর মাটি এই নদে এসে মেশে। এ কারণে পানি ঘোলা হয়ে যায়। তাছাড়া এই প্যাক-কাদা সূর্যের আলোকরশ্মিকে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে দেয়, যার ফলে পানি ঘোলা বা বাদামি দেখা যায়।

ঠিক তেমনি আবুল আলা মওদুদি প্রতিষ্ঠিত জামায়াতে ইসলামী লাহোর থেকে পাঠানকোট অতঃপর রাওয়ালপিন্ডি হয়ে বাংলাদেশে আসার পথে মওদুদিবাদের প্যাক, কাদা, জঞ্জালে পূর্ণ হয়ে আর ইসলাম থাকেনি। আসলেই এটা কোন ইসলাম নয় বরং এটা হলো মওদুদিবাদ। আর সেই মওদুদিবাদ থেকে বের হতে না পারার কারণেই জামায়াত ‘ইসলামের জামায়াত’ না হয়ে ইসলাম ধর্মকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তাদের মতো করে ব্যবহার করা একটি রাজনৈতিক দল মাত্র।

দেশের আলেমগণও বিভিন্ন সময়ে এ বিষয়ে দেশবাসীকে সতর্ক করেছেন। যেমন শাইখুল হাদিস মাওলানা আজিজুল হক বলেছিলেন, আবুল আ’লা মওদুদি ও তার দল জামায়াতে ইসলামীকে খারেজীদের অনুরূপ একটি ফেরকা ও মুসলিম সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী হিসেবে দেখা যায়। হাটহাজারী মাদ্রাসার মহাপরিচালক শাহ আহমদ শফী সাহেব বলেছিলেন, ‘জামায়াত-শিবিরের সাথে আমাদের বিরোধ আকিদাগত। এতে বিশ্বের সকল হক্কানী আলেম একমত।’ আর বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেছেন, ‘যে মাদ্রাসায় পড়েছি, সেখানে জামায়াত নেতাদের ভ্রান্ত আকিদার অনুসারী হিসেবে গণ্য করা হতো। আর জামায়াত নেতাদের ফাঁসিকে দেখা হতো তাদের আলেম ও সহি ইসলাম বিরোধিতার ফসল হিসেবে। জামায়াতকে আমরা ছোটবেলা থেকে আলেম-ওলামাবিরোধী হিসেবেই জেনে এসেছি।’ তিনি আরো বলেছেন, ‘জামায়াত যুদ্ধাপরাধের সহযোগী শক্তি ছিলো।’

যুদ্ধকালীন অভিন্ন সামরিক কমান্ডে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী এবং জামায়াতের বাহিনীগুলো (রাজাকার, আলবদর, আলশামস) পরিচালিত হতো। পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জারিকৃত অর্ডিন্যান্স অনুসারে নিজামী এবং মুজাহিদসহ জামায়াতের যারাই রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর নেতৃত্বে বা কমান্ডে ছিলেন তারা পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর কর্তা ব্যক্তিতে পরিণত হন এবং ইতিহাসের বর্বরতম গণহত্যার সাথে জড়িত হন। এবং আজ পর্যন্ত জামায়াত এ নিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা বা অনুশোচনা প্রকাশ করেনি। এমনকি গ্রেফতার হওয়ার ২৯ দিন আগেও জামায়াতের আমির গোলাম আযম বলেছিলেন ‘আমি বা জামায়াত এমন কিছু করি নাই, যার জন্য ক্ষমা চাইতে হবে।’

তারপরেও ‘২৪-এর ৫ আগস্টের পরে অনেকে আশা করেছিলেন জামায়াতে ইসলামী দল হিসাবে ১৯৭১ সালে তাদের কৃত-অপরাধের জন্য জাতির কাছে ক্ষমা চেয়ে হয়তোবা বহুত্ববাদী এক নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তে শামিল হওয়ার জন্য উদ্যোগ নেবে। বিশেষত জামায়াত তার গঠনতন্ত্র কিছু সংশোধন করায় তাদের এ ধারণা বা আশাবাদ সৃষ্টি হয়। নির্বাচন কমিশনে সর্বশেষ দাখিলকৃত জামায়াতের গঠনতন্ত্রে ‘আল্লাহ প্রদত্ত ও রসূল প্রদর্শিত ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থার’ কথা বাদ দিয়ে ‘গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার’ কথা বলা হয়েছে। ‘জিহাদ’ বাদ দিয়ে ‘নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ন্যায় ও ইনসাফ ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা’ লক্ষ্য হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে। যদিও জামায়াত আইন প্রণয়নে জনপ্রতিনিধিদের নিরঙ্কুশ ক্ষমতাকে স্বীকার করে না। ধর্ম বর্ণ লিঙ্গে কোন বৈষম্য চলবে না- এটাও মানতে চায় না।

যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসির দ-প্রাপ্ত জামায়াত নেতা আজহারুল ইসলাম বেকসুর খালাস পাওয়ার পরে জামায়াত আমির ডা. শফিকুর রহমান সংবাদ সম্মেলনে ইনিয়ে-বিনিয়ে অস্পষ্ট কি যেন বলার চেষ্টা করেন। তিনি বলেছেন, ‘জামায়াত ভুলত্রুটির ঊর্ধ্বে নয়। জামায়াতের কোনো সিদ্ধান্তে কেউ কষ্ট পেয়ে থাকলে ক্ষমা করে দেবেন।’ অনেকে আশা করেছিলেন তিনি এ অস্পষ্টতার হয়তো নিরসন করবেন তাদের জাতীয় সমাবেশে। একে তো তারা ঘোষণা দিলেন সমাবেশ করবেন ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ঐতিহাসিক কেনো? সোহরাওয়ার্দী উদ্যান মানেই তো সেই ৭ মার্চ- ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম...’। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান মানেই তো ১৬ ডিসেম্বরে জামায়াত ইসলাম সমর্থিত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণ, আর বাংলাদেশের স্বাধীনতা। তাই হয়তোবা কেউ কেউ ধারণা করেছিলেন ওই ঐতিহাসিক স্থানে দাঁড়িয়েই সবমিলিয়ে শতকোটি টাকা ব্যয়ের মহাসমাবেশ থেকে জামায়াতে ইসলামী ৭১ সালে তাদের মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধের জন্য জাতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে বিভাজনের রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসার ঘোষণা দিতে পারে।

কিন্তু না; নিছক শোডাউন, পুরোনো রাজনীতি এবং জাতীয় নির্বাচনে পিআর পদ্ধতির দাবি তুলে ধরা ছাড়া নতুনত্ব কিছু খুঁজে পাওয়া গেলো না। বরং তারা গঠনতন্ত্রের সংশোধনী ভুলে গিয়ে সংবিধান ও রাষ্ট্রকেই ধর্মভিত্তিক করার আওয়াজ উত্থাপন করেছে। জামায়াত পুরানো রাজনীতি তথা মওদুদিবাদ থেকে বেরিয়ে না আসতে পারলে শুধু শোডাউন করে এবং বড় সংগঠন শক্তি নিয়েও লাখো শহীদের রক্তেস্নাত বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিভাজন, সাম্প্রদায়িক উষ্কানি সৃষ্টি ও নারী বিদ্বেষ ছড়ানো ছাড়া ইতিবাচক কোনো কাজে আসবে না। এই শোডাউন এবং ভোটের রাজনীতিতে তাদের অবস্থান তো আমরা পাকিস্তান আমল থেকেই দেখে আসছি। ১৯৭০ সালেও জামায়াতের এবং ইসলামী ছাত্র সংঘের (পরিবর্তিত নাম শিবির) এ ধরনের বড়ো সমাবেশ দেখেছি। ১৯৭০ সালে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নিকটবর্তী জাতীয় নির্বাচনেও জামায়াত ৬.৭% ভোট পেয়েছিল। তবে বিস্ময়করভাবে জামায়াত বগুড়া জেলায় ২০% ভোট পেয়েছিল। ফলে বগুড়ার আকাশের চাঁদে মাওলানা সাঈদিকে দেখতে পাওয়াটা অসম্ভব নয়! যাই হোক অন্যান্য পাকিস্তানপন্থি দল পেয়েছিল আরো প্রায় ৬%। অর্থাৎ সব মিলিয়ে পাকিস্তানপন্থিদের পূর্ব পাকিস্তানে ভোট ছিলো প্রায় ১৩%। আজও তাদের জমায়েত ও ভোট সংখ্যা তুলনামূলক একই জায়গায় আছে।

পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের আমির গোলাম আযম মুক্তিযুদ্ধের সময়ে সঠিকভাবেই বলেছিলেন, দেশ পরিবর্তিত হলেও, জামায়াত ও ‘ইসলাম’পন্থিরা শহীদ হতে পারে কিন্তু পরিবর্তিত হবে না। তার প্রমাণ তো আমার নিজ চোখে দেখা। আমার স্কুল ও কলেজ জীবনের সহপাঠী এক মেধাবী বন্ধু কলেজে ইসলামী ছাত্রসংঘে যোগ দেন, ছাত্র সংসদ নির্বাচনে সংঘ থেকে প্রার্থীও হয়েছিলেন। তার আপন সহোদর ভাইকে ’৭১-এ পাকিস্তানি সেনারা নির্মমভাবে হত্যা করে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পাঁচ বছর পার না হতেই যখন ছাত্রসংঘ শিবির হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে দেখি আমার বন্ধু ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র শিবিরের মিছিলে।

জামায়াত ও ছাত্রসংঘের কেউই পরিবর্তিত হননি, উল্লেখযোগ্য এক সমর্থক গোষ্ঠী নিয়ে মনে-প্রাণে ‘পাকিস্তানি আদর্শপন্থি’ হিসেবে রয়ে গেছেন। তাই ’৭১-এর অপরাধের জন্য ক্ষমা চাওয়া তো দূরের কথা, তাদের কোনো আত্মসমালোচনাও নেই। বরং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের উত্থান পর্বে জনআকাক্সক্ষা বিরোধী ভূমিকা পালন ও পাক সামরিক বাহিনীর সহযোগী হিসেবে নেতৃত্ব দেয়ার পরেও গোলাম আজম আইনি-বেআইনিভাবে একটানা ২২ বছর বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামীর শীর্ষপদে আসীন ছিলেন।

অথচ দেশের স্বাধীনতার পর বুদ্ধিজীবী হত্যাকা-ের যে সকল নথিপত্র উদ্ধার হয়েছিল সেগুলো পর্যালোচনা করে দেখা যায় গোলাম আযম ছিলেন বুদ্ধিজীবী হত্যার অন্যতম কুশীলব। ’৭১ সালে রাও ফরমান আলীর নিকট বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা ও তালিকা তিনিই তুলে দিয়েছিলেন এবং সে অনুযায়ী রাজাকার-বদর বাহিনীকে নির্দেশনাও দিয়েছিলেন।

দুনিয়ায় কিন্তু এমন আরেকটি ধর্মভিত্তিক দল খুঁজে পাওয়া যাবে না, যে দল নিজ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধিতা করেছে। তারপরেও ’৭১-এর প্রশ্ন মীমাংসা না করে বাংলাদেশে কেন জামায়াতের এত বাড়-বাড়ন্ত? প্রথমত দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের প্রশ্রয়। আওয়ামী লীগের সাথে তাদের সম্পর্ক বৈরী, আর বিএনপির সাথে অবৈরী। বৈরী সম্পর্ক থাকলেও আওয়ামী লীগ তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীকে মোকাবেলায় বিভিন্ন সময়ে জামায়াতকে ব্যবহার করতে চেয়েছে এবং কখনও কখনও তাতে সফল হয়েছে। কিন্তু এ সফলতা ছিলো কার্যত তাদের ব্যর্থতা এবং উল্টো জামায়াতের সফলতা। জেনারেল জিয়া স্বাধীনতার পরে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল গড়ার সুযোগ দেয়ায় বিএনপির সাথে জামায়াতের সম্পর্ক সবসময় অবৈরীই আছে। তবে জিয়া রাজনৈতিক ভারসাম্য নিজ অনুকূলে রাখতে তাদের যেভাবে কুশলতার সাথে ব্যবহার করেছেন পরবর্তী নেতৃত্ব সেভাবে কুশলী হতে না পারায় উল্টো জামায়াত দ্বারা তারা ব্যবহৃত হয়েছেন এবং মন্ত্রিপরিষদেও জায়গা দিতে হয়েছে। এভাবেই স্বাধীন দেশেও তারা মোটাতাজা হয়েছে।

দ্বিতীয়ত এর সাথে যুক্ত হয়েছিলো পেট্রো ডলার। পেট্রো ডলারের বদৌলতে স্বাধীন দেশে জামায়াত ধীরে ধীরে বিশাল আর্থিক ও সামাজিক অবকাঠামো গড়ে তোলে। মসজিদ মিশন, ইসলাম প্রচার সমিতি, এডুকেশন সোসাইটি, দারুল আরাবিয়া ও দারুল ইফফাত, মওদুদি একাডেমি, সোনার বাংলা প্রকাশনী, আধুনিক প্রকাশনী, আল ফালাহ প্রিন্টিং প্রেস, দারুল ইসলাম ট্রাস্ট, তামিরুল মিল্লাত ট্রাস্ট, মারুফ একাডেমি, ফয়সল ইনস্টিটিউট, মানারাত স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি এবং ইবনে সিনা ট্রাস্টের সাথে যুক্ত অসংখ্য প্রতিষ্ঠান জামায়াত নিয়ন্ত্রিত ও মালিকানাধীন হওয়ায় আর্থিকভাবে জামায়াত দেশের যেকোনো দল অপেক্ষা শক্তিশালী। এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে লাখ লাখ ছাত্রছাত্রীকে বৃত্তি দিয়ে, আর্থিক সহযোগিতা করে, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে এবং একই সাথে ধর্মীয় অনুভূতিকে ব্যবহার করে স্বাধীন দেশেও সব আমলেই তারা সংগঠন শক্তি প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে বৃদ্ধি করেছে। কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা এবং পাকিস্তানি বাহিনীর খুন, হত্যা, ধর্ষণে সহযোগিতা করায় তাদের মাথানত করেই চলতে হতো।

তবে এবারে ড. ইউনূস সরকারের আমলে ’৭১-এর প্রশ্ন মীমাংসা না করেই তারা যে সুযোগ পেয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পরে আর কখনই তারা তা পায়নি। শুধু জামায়াতই নয় এ সরকারের আমলে দেশের রাজনীতিতে দক্ষিণপন্থা ও ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির ধারা এক উগ্রমূর্তি নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। স্বৈরাচার ফ্যাসিবাদ বিরোধীতা তাদের কাছে অছিলা মাত্র। তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে যা কিছু প্রগতিমুখীন অর্জন, যার অনেকটাই ম্লান হয়ে গিয়েছিল গত একযুগের স্বেচ্ছাচারিতায়, অবশিষ্টটুকুও তারা শেষ করে দিতে চায়। পরিস্থিতি এমন জায়গায় গেছে যে বিএনপি মহাসচিবকে পর্যন্ত উগ্র দক্ষিণপন্থা ও মৌলবাদের উত্থান নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করতে হচ্ছে।

উগ্র দক্ষিণপন্থা বিকশিত হয়েছে হিন্দুবিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িকতাকে লালন করে এবং দেশের রাজনীতি, অর্থনীতিতে অযাচিত ভারতীয় হস্তক্ষেপ ও মোদি সরকারের হিন্দুত্ববাদ যাকে আরো উষ্কে দিয়েছে। মৌলবাদ ধর্মের অপব্যাখ্যা করে বাঙালি সংস্কৃতি, আদিবাসী সংস্কৃতির বৈচিত্র্য ও নারী ক্ষমতায়নকে ইসলাম বিরোধী ফতোয়া দিয়ে তার উগ্রতা প্রকাশ করে আসছে। সাম্প্রদায়িকতা, নারীবিদ্বেষ এবং বাঙালি ও আদিবাসীদের শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিদ্বেষকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা না করে কখনো তাদের তোয়াজ করে, কিছু সুবিধা দিয়ে আবার কখনো আইনবহির্ভূত দমনপীড়ন চালিয়ে পতিত আওয়ামী সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রচেষ্টা মৌলবাদীদের আরও শক্তি জুগিয়েছে। বিশেষত এক সুদীর্ঘ সময় দেশের বুকে গণতন্ত্রহীনতায় এবং একদিকে বামপন্থি শক্তির দুর্বলতা অন্যদিকে মধ্যপন্থি প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলকে চরম দমন পীড়নের মাধ্যমে নিঃশেষ করে দেয়ার যে প্রচেষ্টা আওয়ামী সরকার চালিয়েছিল তার ফলাফল চরম দক্ষিণপন্থার উত্থান।

দেশে গণতন্ত্র উত্তোরণ যত বিলম্বিত হবে চরম দক্ষিণপন্থা তত শক্তি অর্জন করবে। আজ জামায়াত-হেফাজত আর চরমোনাই নিয়ে ড. ইউনূস যত ঘন ঘন চা কফি খান না কেন এসব উগ্রবাদী শক্তি এবং তার সমর্থনপুষ্ট নতুন দলের উগ্রবাদীরা পরিস্থিতিকে এমনভাবে ঘোলাটে করছে যে, তারা তার সারা জীবনের অর্জনকে ধুলায় মিশিয়ে দিতে পারে। দুনিয়ায় এমন কোনো রাজনৈতিক শক্তি নেই যাদের সাময়িকভাবে হলেও পশ্চিমা দুনিয়া তাদের স্বার্থে মদত দেয় না। কিন্তু একথাও তো আমরা জানি, ভিয়েতনামের যুদ্ধে আমেরিকা নাকানি-চুবানি খেয়ে যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর মিত্র আমেরিকা সম্পর্কে দক্ষিণ ভিয়েতনামের ফার্স্ট লেডি সেই বিখ্যাত উক্তি করে বলেছিলেন, ‘আমেরিকা যার বন্ধু তার আর কোনো শত্রুর দরকার নেই।’ আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আশরাফ গানি ক্ষমতাচ্যুত হয়ে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রসহ বিদেশি রাষ্ট্রগুলোকে বিশ্বাস করাই ছিল আমার একমাত্র ভুল। আমাকে বলির পাঁঠা করা হয়েছে।’ পশ্চিমারা আজ জামায়াতী জামদানি উপহার পেয়ে গদ গদ হয়ে তাদের সাথে বৈঠক করছে, পত্রিকায় বিগলিত হাসি দিয়ে ছবি প্রকাশ করছে। আর ইসলামী ব্যাংক হাসিনা আমলের মতোই ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে।

গত আগস্টে যখন ড. ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পদে বসেছিলেন, একাধিক সমীক্ষা অনুযায়ী তখন তার জনপ্রিয়তা ছিল প্রায় ৯০ শতাংশ; কিন্তু ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে সেই জনপ্রিয়তা নেমে এসেছিল ৭০ শতাংশে। এখন তা নাকি দাঁড়িয়েছে ৫০ শতাংশে। নিজের হাজার কোটি টাকার ট্যাক্স মওকুফ করা নিয়ে, একটার পর একটা নতুন প্রতিষ্ঠানের অনুমতি নিয়ে তিনি তার ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করছেন। এমনকি জুলাই শহীদদের পরিবার এসব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। ‘নিয়োগ কর্তাদেরই’ জেলে পুরতে ও রিমান্ডে নিতে হচ্ছে। এবারের আন্দোলনের অন্যতম মুখ উমামা বলেছেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শেষ পর্যন্ত পরিণত হয়েছিলো ‘মানি মেকিং মেশিনে’ এবং তার শেকড় অনেক গভীরে। ছাত্র উপদেষ্টাদের প্রশ্রয়ে এসব চলেছে এবং চলছে। আর উপদেষ্টা মাহফুজ আলম তো একেবারে বোমা ফাটিয়ে দিলেন। তিনি বলেছেন- নতুন দলের (অর্থাৎ এনসিপি) মহারথীদের একটা সার্কেলের সবাই দুর্নীতিগ্রস্ত (অবশ্য অজানা কারণে স্ট্যাটাস পরিবর্তন করে নতুন দলের স্থানে বিভিন্ন দল লিখেছেন)। এরপর ড. ইউনূস কি বলবেন? এই দুর্নীতিগ্রস্তদের মুখে ‘জুলাই ঘোষণা’ মানুষের কাছে নিছক কাগজের টুকরা ছাড়া আর আর কোনো গুরুত্ব বহন করবে? তাই উগ্রবাদী ও মৌলবাদী শক্তির কাছে মাথা নত না করে বা নদীর পানি দেখলেই তাকে নীল না মনে করে দেশকে এক গভীর অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তি দিতে কোনো যদি বা কিন্তু ছাড়াই ব্যালটের মাধ্যমে দেশের ভাগ্য দেশের মানুষকে নির্ধারণের সুযোগ দিতে হবে। এক দশকেরও অধিককাল যাবত মানুষ একটি ভালো নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করে আছে।

[লেখক : সাবেক ছাত্র নেতা]

দেশি মাছ রক্ষায় অভয়াশ্রম

আলুর বাজার বিপর্যয় : কৃষকের ভাগ্যে লোকসান

বিশ্ব বাঘ দিবস

ঢাকার কি রিস্ক এনালাইসিস করা আছে?

ছবি

সোনার হরফে লেখা অনন্য শিক্ষকের নাম

পরীক্ষার পর পরীক্ষা, কিন্তু কোথায় মূল্যায়ন ও মূল্যবোধের ভিত্তি?

বৃত্তি পরীক্ষায় কিন্ডারগার্টেন বাদ কেন?

সময়ের স্বৈরতন্ত্র : প্রতীক্ষা, ক্ষমতা ও জীবনের অসমতা

জলবায়ু পরিবর্তন মডেলে গণিতের ব্যবহার

দুর্ঘটনাজনিত দুর্যোগ-পরবর্তী করণীয় কী?

ডেঙ্গু, জিকা আর চিকুনগুনিয়া : একই উৎস, ত্রিমুখী সংকট

কেন থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়ার ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি?

দুর্নীতি নির্মূল করা কি সম্ভব?

দরকার মানসম্মত শিক্ষা

ইসরায়েলের যুদ্ধনীতি ও বিশ্ব নিরাপত্তার সংকট

রম্যগদ্য : ‘বেইমান রাইট ব্রাদার্স’

মানসিক স্বাস্থ্যসেবা : আইনি কাঠামো, সংকট ও সম্ভাবনার দিক

ছবি

বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র

দুর্যোগে অবিবেচকদেরকে কি দায়িত্বশীল ভাবা যায়?

ওয়াসার পদ্মা ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট : এক জীবন্ত বোটানিক্যাল গার্ডেন

রেলপথের দুর্দশা : সমন্বিত পরিকল্পনা না হলে বিপর্যয় অনিবার্য

বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র নাকি ক্ষমতার অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ?

পিরোজপুরের স্কুলটির ফলাফল বিপর্যয় এবং আচরণগত অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ

কোনো শাসকই অপরাজেয় নয়

পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি : বাঙালিকে রুচির দৈন্যে টেনে নামানো হচ্ছে

জনসংখ্যা ও যুবশক্তির চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

রাষ্ট্রের কাছে স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা চাই

পার্বত্য চট্টগ্রাম : প্রাকৃতিক সম্পদ ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা

ইউরেশিয়ায় তৃতীয় বিকল্প গালফ কূটনীতি

‘বিপ্লবী সংস্কার’ কি সম্ভব

রম্যগদ্য : ‘ব্যাংক, ব্যাংক নয়’

মবতন্ত্রের জয়

ডিজিটাল ক্লান্তি ও ‘সর্বক্ষণ সক্রিয়’ সংস্কৃতির শ্রেণীগত রাজনীতি

ছবি

বোধের স্ফূরণ, না ‘মেটিকুলাস ডিজাইন’?

এসএসসিতে গণিত বিষয়ে ফল বিপর্যয় : কারণ ও উত্তরণের উপায়

দক্ষ মানবসম্পদ ও সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার

tab

উপ-সম্পাদকীয়

নীল নদের পানি নীল নয়

আনোয়ারুল হক

image

১৯৭১ সালে প্রশিক্ষণ শেষে রাজাকারদের মার্চপাস্ট

বুধবার, ৩০ জুলাই ২০২৫

শৈশবকালে আমরা পড়েছি নীল নদ আফ্রিকা মহাদেশে অবস্থিত বিশ্বের দীর্ঘতম নদী। এর অববাহিকাজুড়ে গড়ে উঠেছে যে সভ্যতা বিশেষ করে মিসরীয় সভ্যতার জন্য নীল নদ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। জমি সেচের জন্য নীল নদের প্লাবিত পানি মিসরীয়দের কৃষিকাজে খুবই সহায়ক ছিল। মিসরকে বলা হয় নীল নদের দেশ। নগর সভ্যতার শুরু মিসরে। এসব আমাদের ক্লাসে পড়ানো হতো। কিন্তু নীল নদের পানি যে নীল নয়, এটা সম্ভবত পড়ানো হয়নি। এটা প্রথম জানলাম বড় বেলায় মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর জনসভায় গিয়ে। মওলানা তার বক্তব্যে বলেছিলেন ‘নীল নদের পানি যেমন নীল নয়, তেমনি জামায়াতে ইসলামীও ইসলাম নয়।’

নীল নদের পানি কেনো নীল নয়? নীল নদে প্রচুর পরিমাণে কাদা জমা হতো। বিশেষ করে ইথিওপিয়ার উচ্চভূমি থেকে প্রচুর পলি, কাদা এবং উর্বর মাটি এই নদে এসে মেশে। এ কারণে পানি ঘোলা হয়ে যায়। তাছাড়া এই প্যাক-কাদা সূর্যের আলোকরশ্মিকে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে দেয়, যার ফলে পানি ঘোলা বা বাদামি দেখা যায়।

ঠিক তেমনি আবুল আলা মওদুদি প্রতিষ্ঠিত জামায়াতে ইসলামী লাহোর থেকে পাঠানকোট অতঃপর রাওয়ালপিন্ডি হয়ে বাংলাদেশে আসার পথে মওদুদিবাদের প্যাক, কাদা, জঞ্জালে পূর্ণ হয়ে আর ইসলাম থাকেনি। আসলেই এটা কোন ইসলাম নয় বরং এটা হলো মওদুদিবাদ। আর সেই মওদুদিবাদ থেকে বের হতে না পারার কারণেই জামায়াত ‘ইসলামের জামায়াত’ না হয়ে ইসলাম ধর্মকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে তাদের মতো করে ব্যবহার করা একটি রাজনৈতিক দল মাত্র।

দেশের আলেমগণও বিভিন্ন সময়ে এ বিষয়ে দেশবাসীকে সতর্ক করেছেন। যেমন শাইখুল হাদিস মাওলানা আজিজুল হক বলেছিলেন, আবুল আ’লা মওদুদি ও তার দল জামায়াতে ইসলামীকে খারেজীদের অনুরূপ একটি ফেরকা ও মুসলিম সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী হিসেবে দেখা যায়। হাটহাজারী মাদ্রাসার মহাপরিচালক শাহ আহমদ শফী সাহেব বলেছিলেন, ‘জামায়াত-শিবিরের সাথে আমাদের বিরোধ আকিদাগত। এতে বিশ্বের সকল হক্কানী আলেম একমত।’ আর বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেছেন, ‘যে মাদ্রাসায় পড়েছি, সেখানে জামায়াত নেতাদের ভ্রান্ত আকিদার অনুসারী হিসেবে গণ্য করা হতো। আর জামায়াত নেতাদের ফাঁসিকে দেখা হতো তাদের আলেম ও সহি ইসলাম বিরোধিতার ফসল হিসেবে। জামায়াতকে আমরা ছোটবেলা থেকে আলেম-ওলামাবিরোধী হিসেবেই জেনে এসেছি।’ তিনি আরো বলেছেন, ‘জামায়াত যুদ্ধাপরাধের সহযোগী শক্তি ছিলো।’

যুদ্ধকালীন অভিন্ন সামরিক কমান্ডে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী এবং জামায়াতের বাহিনীগুলো (রাজাকার, আলবদর, আলশামস) পরিচালিত হতো। পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জারিকৃত অর্ডিন্যান্স অনুসারে নিজামী এবং মুজাহিদসহ জামায়াতের যারাই রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর নেতৃত্বে বা কমান্ডে ছিলেন তারা পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর কর্তা ব্যক্তিতে পরিণত হন এবং ইতিহাসের বর্বরতম গণহত্যার সাথে জড়িত হন। এবং আজ পর্যন্ত জামায়াত এ নিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা বা অনুশোচনা প্রকাশ করেনি। এমনকি গ্রেফতার হওয়ার ২৯ দিন আগেও জামায়াতের আমির গোলাম আযম বলেছিলেন ‘আমি বা জামায়াত এমন কিছু করি নাই, যার জন্য ক্ষমা চাইতে হবে।’

তারপরেও ‘২৪-এর ৫ আগস্টের পরে অনেকে আশা করেছিলেন জামায়াতে ইসলামী দল হিসাবে ১৯৭১ সালে তাদের কৃত-অপরাধের জন্য জাতির কাছে ক্ষমা চেয়ে হয়তোবা বহুত্ববাদী এক নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তে শামিল হওয়ার জন্য উদ্যোগ নেবে। বিশেষত জামায়াত তার গঠনতন্ত্র কিছু সংশোধন করায় তাদের এ ধারণা বা আশাবাদ সৃষ্টি হয়। নির্বাচন কমিশনে সর্বশেষ দাখিলকৃত জামায়াতের গঠনতন্ত্রে ‘আল্লাহ প্রদত্ত ও রসূল প্রদর্শিত ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থার’ কথা বাদ দিয়ে ‘গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার’ কথা বলা হয়েছে। ‘জিহাদ’ বাদ দিয়ে ‘নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ন্যায় ও ইনসাফ ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা’ লক্ষ্য হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে। যদিও জামায়াত আইন প্রণয়নে জনপ্রতিনিধিদের নিরঙ্কুশ ক্ষমতাকে স্বীকার করে না। ধর্ম বর্ণ লিঙ্গে কোন বৈষম্য চলবে না- এটাও মানতে চায় না।

যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসির দ-প্রাপ্ত জামায়াত নেতা আজহারুল ইসলাম বেকসুর খালাস পাওয়ার পরে জামায়াত আমির ডা. শফিকুর রহমান সংবাদ সম্মেলনে ইনিয়ে-বিনিয়ে অস্পষ্ট কি যেন বলার চেষ্টা করেন। তিনি বলেছেন, ‘জামায়াত ভুলত্রুটির ঊর্ধ্বে নয়। জামায়াতের কোনো সিদ্ধান্তে কেউ কষ্ট পেয়ে থাকলে ক্ষমা করে দেবেন।’ অনেকে আশা করেছিলেন তিনি এ অস্পষ্টতার হয়তো নিরসন করবেন তাদের জাতীয় সমাবেশে। একে তো তারা ঘোষণা দিলেন সমাবেশ করবেন ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ঐতিহাসিক কেনো? সোহরাওয়ার্দী উদ্যান মানেই তো সেই ৭ মার্চ- ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম...’। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান মানেই তো ১৬ ডিসেম্বরে জামায়াত ইসলাম সমর্থিত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণ, আর বাংলাদেশের স্বাধীনতা। তাই হয়তোবা কেউ কেউ ধারণা করেছিলেন ওই ঐতিহাসিক স্থানে দাঁড়িয়েই সবমিলিয়ে শতকোটি টাকা ব্যয়ের মহাসমাবেশ থেকে জামায়াতে ইসলামী ৭১ সালে তাদের মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধের জন্য জাতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে বিভাজনের রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসার ঘোষণা দিতে পারে।

কিন্তু না; নিছক শোডাউন, পুরোনো রাজনীতি এবং জাতীয় নির্বাচনে পিআর পদ্ধতির দাবি তুলে ধরা ছাড়া নতুনত্ব কিছু খুঁজে পাওয়া গেলো না। বরং তারা গঠনতন্ত্রের সংশোধনী ভুলে গিয়ে সংবিধান ও রাষ্ট্রকেই ধর্মভিত্তিক করার আওয়াজ উত্থাপন করেছে। জামায়াত পুরানো রাজনীতি তথা মওদুদিবাদ থেকে বেরিয়ে না আসতে পারলে শুধু শোডাউন করে এবং বড় সংগঠন শক্তি নিয়েও লাখো শহীদের রক্তেস্নাত বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিভাজন, সাম্প্রদায়িক উষ্কানি সৃষ্টি ও নারী বিদ্বেষ ছড়ানো ছাড়া ইতিবাচক কোনো কাজে আসবে না। এই শোডাউন এবং ভোটের রাজনীতিতে তাদের অবস্থান তো আমরা পাকিস্তান আমল থেকেই দেখে আসছি। ১৯৭০ সালেও জামায়াতের এবং ইসলামী ছাত্র সংঘের (পরিবর্তিত নাম শিবির) এ ধরনের বড়ো সমাবেশ দেখেছি। ১৯৭০ সালে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নিকটবর্তী জাতীয় নির্বাচনেও জামায়াত ৬.৭% ভোট পেয়েছিল। তবে বিস্ময়করভাবে জামায়াত বগুড়া জেলায় ২০% ভোট পেয়েছিল। ফলে বগুড়ার আকাশের চাঁদে মাওলানা সাঈদিকে দেখতে পাওয়াটা অসম্ভব নয়! যাই হোক অন্যান্য পাকিস্তানপন্থি দল পেয়েছিল আরো প্রায় ৬%। অর্থাৎ সব মিলিয়ে পাকিস্তানপন্থিদের পূর্ব পাকিস্তানে ভোট ছিলো প্রায় ১৩%। আজও তাদের জমায়েত ও ভোট সংখ্যা তুলনামূলক একই জায়গায় আছে।

পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের আমির গোলাম আযম মুক্তিযুদ্ধের সময়ে সঠিকভাবেই বলেছিলেন, দেশ পরিবর্তিত হলেও, জামায়াত ও ‘ইসলাম’পন্থিরা শহীদ হতে পারে কিন্তু পরিবর্তিত হবে না। তার প্রমাণ তো আমার নিজ চোখে দেখা। আমার স্কুল ও কলেজ জীবনের সহপাঠী এক মেধাবী বন্ধু কলেজে ইসলামী ছাত্রসংঘে যোগ দেন, ছাত্র সংসদ নির্বাচনে সংঘ থেকে প্রার্থীও হয়েছিলেন। তার আপন সহোদর ভাইকে ’৭১-এ পাকিস্তানি সেনারা নির্মমভাবে হত্যা করে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পাঁচ বছর পার না হতেই যখন ছাত্রসংঘ শিবির হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে দেখি আমার বন্ধু ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র শিবিরের মিছিলে।

জামায়াত ও ছাত্রসংঘের কেউই পরিবর্তিত হননি, উল্লেখযোগ্য এক সমর্থক গোষ্ঠী নিয়ে মনে-প্রাণে ‘পাকিস্তানি আদর্শপন্থি’ হিসেবে রয়ে গেছেন। তাই ’৭১-এর অপরাধের জন্য ক্ষমা চাওয়া তো দূরের কথা, তাদের কোনো আত্মসমালোচনাও নেই। বরং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের উত্থান পর্বে জনআকাক্সক্ষা বিরোধী ভূমিকা পালন ও পাক সামরিক বাহিনীর সহযোগী হিসেবে নেতৃত্ব দেয়ার পরেও গোলাম আজম আইনি-বেআইনিভাবে একটানা ২২ বছর বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামীর শীর্ষপদে আসীন ছিলেন।

অথচ দেশের স্বাধীনতার পর বুদ্ধিজীবী হত্যাকা-ের যে সকল নথিপত্র উদ্ধার হয়েছিল সেগুলো পর্যালোচনা করে দেখা যায় গোলাম আযম ছিলেন বুদ্ধিজীবী হত্যার অন্যতম কুশীলব। ’৭১ সালে রাও ফরমান আলীর নিকট বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা ও তালিকা তিনিই তুলে দিয়েছিলেন এবং সে অনুযায়ী রাজাকার-বদর বাহিনীকে নির্দেশনাও দিয়েছিলেন।

দুনিয়ায় কিন্তু এমন আরেকটি ধর্মভিত্তিক দল খুঁজে পাওয়া যাবে না, যে দল নিজ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধিতা করেছে। তারপরেও ’৭১-এর প্রশ্ন মীমাংসা না করে বাংলাদেশে কেন জামায়াতের এত বাড়-বাড়ন্ত? প্রথমত দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের প্রশ্রয়। আওয়ামী লীগের সাথে তাদের সম্পর্ক বৈরী, আর বিএনপির সাথে অবৈরী। বৈরী সম্পর্ক থাকলেও আওয়ামী লীগ তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীকে মোকাবেলায় বিভিন্ন সময়ে জামায়াতকে ব্যবহার করতে চেয়েছে এবং কখনও কখনও তাতে সফল হয়েছে। কিন্তু এ সফলতা ছিলো কার্যত তাদের ব্যর্থতা এবং উল্টো জামায়াতের সফলতা। জেনারেল জিয়া স্বাধীনতার পরে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল গড়ার সুযোগ দেয়ায় বিএনপির সাথে জামায়াতের সম্পর্ক সবসময় অবৈরীই আছে। তবে জিয়া রাজনৈতিক ভারসাম্য নিজ অনুকূলে রাখতে তাদের যেভাবে কুশলতার সাথে ব্যবহার করেছেন পরবর্তী নেতৃত্ব সেভাবে কুশলী হতে না পারায় উল্টো জামায়াত দ্বারা তারা ব্যবহৃত হয়েছেন এবং মন্ত্রিপরিষদেও জায়গা দিতে হয়েছে। এভাবেই স্বাধীন দেশেও তারা মোটাতাজা হয়েছে।

দ্বিতীয়ত এর সাথে যুক্ত হয়েছিলো পেট্রো ডলার। পেট্রো ডলারের বদৌলতে স্বাধীন দেশে জামায়াত ধীরে ধীরে বিশাল আর্থিক ও সামাজিক অবকাঠামো গড়ে তোলে। মসজিদ মিশন, ইসলাম প্রচার সমিতি, এডুকেশন সোসাইটি, দারুল আরাবিয়া ও দারুল ইফফাত, মওদুদি একাডেমি, সোনার বাংলা প্রকাশনী, আধুনিক প্রকাশনী, আল ফালাহ প্রিন্টিং প্রেস, দারুল ইসলাম ট্রাস্ট, তামিরুল মিল্লাত ট্রাস্ট, মারুফ একাডেমি, ফয়সল ইনস্টিটিউট, মানারাত স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি এবং ইবনে সিনা ট্রাস্টের সাথে যুক্ত অসংখ্য প্রতিষ্ঠান জামায়াত নিয়ন্ত্রিত ও মালিকানাধীন হওয়ায় আর্থিকভাবে জামায়াত দেশের যেকোনো দল অপেক্ষা শক্তিশালী। এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে লাখ লাখ ছাত্রছাত্রীকে বৃত্তি দিয়ে, আর্থিক সহযোগিতা করে, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে এবং একই সাথে ধর্মীয় অনুভূতিকে ব্যবহার করে স্বাধীন দেশেও সব আমলেই তারা সংগঠন শক্তি প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে বৃদ্ধি করেছে। কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা এবং পাকিস্তানি বাহিনীর খুন, হত্যা, ধর্ষণে সহযোগিতা করায় তাদের মাথানত করেই চলতে হতো।

তবে এবারে ড. ইউনূস সরকারের আমলে ’৭১-এর প্রশ্ন মীমাংসা না করেই তারা যে সুযোগ পেয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পরে আর কখনই তারা তা পায়নি। শুধু জামায়াতই নয় এ সরকারের আমলে দেশের রাজনীতিতে দক্ষিণপন্থা ও ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির ধারা এক উগ্রমূর্তি নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। স্বৈরাচার ফ্যাসিবাদ বিরোধীতা তাদের কাছে অছিলা মাত্র। তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে যা কিছু প্রগতিমুখীন অর্জন, যার অনেকটাই ম্লান হয়ে গিয়েছিল গত একযুগের স্বেচ্ছাচারিতায়, অবশিষ্টটুকুও তারা শেষ করে দিতে চায়। পরিস্থিতি এমন জায়গায় গেছে যে বিএনপি মহাসচিবকে পর্যন্ত উগ্র দক্ষিণপন্থা ও মৌলবাদের উত্থান নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করতে হচ্ছে।

উগ্র দক্ষিণপন্থা বিকশিত হয়েছে হিন্দুবিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িকতাকে লালন করে এবং দেশের রাজনীতি, অর্থনীতিতে অযাচিত ভারতীয় হস্তক্ষেপ ও মোদি সরকারের হিন্দুত্ববাদ যাকে আরো উষ্কে দিয়েছে। মৌলবাদ ধর্মের অপব্যাখ্যা করে বাঙালি সংস্কৃতি, আদিবাসী সংস্কৃতির বৈচিত্র্য ও নারী ক্ষমতায়নকে ইসলাম বিরোধী ফতোয়া দিয়ে তার উগ্রতা প্রকাশ করে আসছে। সাম্প্রদায়িকতা, নারীবিদ্বেষ এবং বাঙালি ও আদিবাসীদের শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিদ্বেষকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা না করে কখনো তাদের তোয়াজ করে, কিছু সুবিধা দিয়ে আবার কখনো আইনবহির্ভূত দমনপীড়ন চালিয়ে পতিত আওয়ামী সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রচেষ্টা মৌলবাদীদের আরও শক্তি জুগিয়েছে। বিশেষত এক সুদীর্ঘ সময় দেশের বুকে গণতন্ত্রহীনতায় এবং একদিকে বামপন্থি শক্তির দুর্বলতা অন্যদিকে মধ্যপন্থি প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলকে চরম দমন পীড়নের মাধ্যমে নিঃশেষ করে দেয়ার যে প্রচেষ্টা আওয়ামী সরকার চালিয়েছিল তার ফলাফল চরম দক্ষিণপন্থার উত্থান।

দেশে গণতন্ত্র উত্তোরণ যত বিলম্বিত হবে চরম দক্ষিণপন্থা তত শক্তি অর্জন করবে। আজ জামায়াত-হেফাজত আর চরমোনাই নিয়ে ড. ইউনূস যত ঘন ঘন চা কফি খান না কেন এসব উগ্রবাদী শক্তি এবং তার সমর্থনপুষ্ট নতুন দলের উগ্রবাদীরা পরিস্থিতিকে এমনভাবে ঘোলাটে করছে যে, তারা তার সারা জীবনের অর্জনকে ধুলায় মিশিয়ে দিতে পারে। দুনিয়ায় এমন কোনো রাজনৈতিক শক্তি নেই যাদের সাময়িকভাবে হলেও পশ্চিমা দুনিয়া তাদের স্বার্থে মদত দেয় না। কিন্তু একথাও তো আমরা জানি, ভিয়েতনামের যুদ্ধে আমেরিকা নাকানি-চুবানি খেয়ে যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর মিত্র আমেরিকা সম্পর্কে দক্ষিণ ভিয়েতনামের ফার্স্ট লেডি সেই বিখ্যাত উক্তি করে বলেছিলেন, ‘আমেরিকা যার বন্ধু তার আর কোনো শত্রুর দরকার নেই।’ আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আশরাফ গানি ক্ষমতাচ্যুত হয়ে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রসহ বিদেশি রাষ্ট্রগুলোকে বিশ্বাস করাই ছিল আমার একমাত্র ভুল। আমাকে বলির পাঁঠা করা হয়েছে।’ পশ্চিমারা আজ জামায়াতী জামদানি উপহার পেয়ে গদ গদ হয়ে তাদের সাথে বৈঠক করছে, পত্রিকায় বিগলিত হাসি দিয়ে ছবি প্রকাশ করছে। আর ইসলামী ব্যাংক হাসিনা আমলের মতোই ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে।

গত আগস্টে যখন ড. ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পদে বসেছিলেন, একাধিক সমীক্ষা অনুযায়ী তখন তার জনপ্রিয়তা ছিল প্রায় ৯০ শতাংশ; কিন্তু ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে সেই জনপ্রিয়তা নেমে এসেছিল ৭০ শতাংশে। এখন তা নাকি দাঁড়িয়েছে ৫০ শতাংশে। নিজের হাজার কোটি টাকার ট্যাক্স মওকুফ করা নিয়ে, একটার পর একটা নতুন প্রতিষ্ঠানের অনুমতি নিয়ে তিনি তার ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করছেন। এমনকি জুলাই শহীদদের পরিবার এসব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। ‘নিয়োগ কর্তাদেরই’ জেলে পুরতে ও রিমান্ডে নিতে হচ্ছে। এবারের আন্দোলনের অন্যতম মুখ উমামা বলেছেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শেষ পর্যন্ত পরিণত হয়েছিলো ‘মানি মেকিং মেশিনে’ এবং তার শেকড় অনেক গভীরে। ছাত্র উপদেষ্টাদের প্রশ্রয়ে এসব চলেছে এবং চলছে। আর উপদেষ্টা মাহফুজ আলম তো একেবারে বোমা ফাটিয়ে দিলেন। তিনি বলেছেন- নতুন দলের (অর্থাৎ এনসিপি) মহারথীদের একটা সার্কেলের সবাই দুর্নীতিগ্রস্ত (অবশ্য অজানা কারণে স্ট্যাটাস পরিবর্তন করে নতুন দলের স্থানে বিভিন্ন দল লিখেছেন)। এরপর ড. ইউনূস কি বলবেন? এই দুর্নীতিগ্রস্তদের মুখে ‘জুলাই ঘোষণা’ মানুষের কাছে নিছক কাগজের টুকরা ছাড়া আর আর কোনো গুরুত্ব বহন করবে? তাই উগ্রবাদী ও মৌলবাদী শক্তির কাছে মাথা নত না করে বা নদীর পানি দেখলেই তাকে নীল না মনে করে দেশকে এক গভীর অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তি দিতে কোনো যদি বা কিন্তু ছাড়াই ব্যালটের মাধ্যমে দেশের ভাগ্য দেশের মানুষকে নির্ধারণের সুযোগ দিতে হবে। এক দশকেরও অধিককাল যাবত মানুষ একটি ভালো নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করে আছে।

[লেখক : সাবেক ছাত্র নেতা]

back to top