মিহির কুমার রায়
বাংলাদেশ আলু উৎপাদনে বিশ্বের সপ্তম অবস্থানে থাকলেও, এখানকার আলুচাষিরা আজও ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত। দেশে বছরে গড়ে একজন মানুষ ৫১.৫ কেজি আলু খানÑবিশ্বে যার অবস্থান ৪৪তম। বিপুল উৎপাদনের পরও বাংলাদেশ আলু রপ্তানিতে শীর্ষ ১৫ দেশের তালিকায় নেই। এ বাস্তবতায় প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে প্রশ্নÑউৎপাদনের তুলনায় বাজারে দাম পড়ে যাচ্ছে কেন?
বাংলাদেশ কোল্ডস্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএসএ) তথ্যমতে, চলতি বছর দেশে এক কোটি ৩০ লাখ টন আলু উৎপাদিত হয়েছে, যা চাহিদার চেয়ে ৪০ লাখ টন বেশি। অথচ এই উদ্বৃত্ত আলু বাজারে তুলতে গিয়ে দাম ধসে পড়েছে। হিমাগার ফটকে কেজিপ্রতি দাম ১৩ থেকে ১৫ টাকা হলেও কৃষকের উৎপাদন খরচ, কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের হিসাবেই, কেজিতে ১৪ টাকা। কৃষকরা জানান, তাদের প্রকৃত খরচ ২৫ টাকা পর্যন্ত উঠেছে। অর্থাৎ লোকসান কেজিপ্রতি ১০ টাকার মতো।
গত পাঁচ বছরের বাজারচিত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, এক মৌসুমে উৎপাদন বেশি হলে দাম পড়ে, ফলে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হন; পরের বছর উৎপাদন কমে গেলে আবার দাম বেড়ে যায়। ২০২২-২৩ সালে উৎপাদন ছিল এক কোটি ৪ লাখ টন। সরকার খুচরায় দাম নির্ধারণ করলেও বাস্তবে চট্টগ্রামের বাজারে তা ৪৫ টাকায় উঠেছিল। ফলে ক্রেতা ও চাষি উভয়ই চাপে পড়ে।
২০২৪-২৫ মৌসুমে রেকর্ড পরিমাণ আলু উৎপাদনের পর, এবার সংকটে পড়েছেন চাষিরা। উৎপাদন খরচ উঠছে না। হিমাগার খরচ যোগ করে ২৫ টাকা মূল্যে উৎপাদিত আলু বিক্রি করতে হচ্ছে ১৩-১৫ টাকায়। কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, এমন পরিস্থিতি থাকলে অনেকেই আগামী মৌসুমে আলুচাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেনÑফলে ভবিষ্যতে আবারও বাজার অস্থির হতে পারে।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, গত এক মাসে খুচরায় আলুর দাম ১১.১১ শতাংশ বেড়েছে, তবে গত বছরের তুলনায় কমেছে ৫৬.৯০ শতাংশ। দেশের বিভিন্ন জেলায় হিমাগার ফটকে আলুর দাম ১২ থেকে ১৩ টাকা এবং খুচরায় ১৪ থেকে ২০ টাকার মধ্যে থাকছে। ঢাকায় তা আরও বেশি।
রপ্তানির চিত্রও হতাশাজনক। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি আলু খাওয়া হয় বেলারুশে (১৬০ কেজি), এরপর ইউক্রেন, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান ও উজবেকিস্তান। কিন্তু বাংলাদেশ সেসব দেশে রপ্তানি করে না। আমাদের প্রধান রপ্তানি গন্তব্য মালয়েশিয়া (৮০%), এরপর সিঙ্গাপুর, নেপাল, শ্রীলংকা ও মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশ। অথচ মালয়েশিয়ার অবস্থান ১০৯তম।
২০২১ সালে যেখানে ৬৮ হাজার টন আলু রপ্তানি হয়েছিল, ২০২৩ সালে তা নেমে আসে ৩৩ হাজার টনে। ২০২৪ সালে তা আরও কমে ১২ হাজার টনে দাঁড়ায়। অবশ্য চলতি মৌসুমে এ পর্যন্ত ৭০ হাজার টন রপ্তানির তথ্য পাওয়া গেছে, কিন্তু এখানে মৌসুমি অস্থিরতা প্রকট। ২০২৩ সালে যখন ভোক্তারা বেশি দাম দিয়ে কিনছিলেন, তখন রপ্তানি কম ছিল। ২০২৪ সালে যখন কৃষক লোকসানে, তখন রপ্তানি বেড়েছে। এই চক্র থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
এই সংকটের সমাধানে বিসিএসএ সরকারের কাছে কয়েকটি প্রস্তাব দিয়েছে। সেগুলো হচ্ছেÑহিমাগার ফটকে ন্যূনতম বিক্রয়মূল্য ২৫ টাকা নির্ধারণ করা। সরকারের ওএমএস কার্যক্রমে চালের পাশাপাশি ১০ কেজি করে আলু সরবরাহ। আলু ভর্তুকির জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ। টিসিবির মাধ্যমে ট্রাকসেল চালু। কৃষকের উৎপাদিত আলু সরাসরি বিপণনে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের কার্যক্রম সক্রিয় করা। অহিমায়িত মডেল ঘরের বিস্তার ঘটানো।
‘অহিমায়িত মডেল ঘর’ একটি বিজ্ঞানসম্মত ক্ষুদ্র হিমাগার, যার মাধ্যমে কৃষক নিজের উৎপাদিত আলু ঘরে রেখে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত সংরক্ষণ করতে পারেন। প্রতিটি ঘরে ২৫-৩০ টন আলু রাখা যায়। এতে বছরে দেড় থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত হিমাগার খরচ বাঁচাতে পারেন একজন কৃষক। এসব ঘরে সংরক্ষিত আলুতে পচন, গন্ধ বা মিষ্টি হওয়ার ঝুঁকি নেই।
এখন সময় এসেছে দীর্ঘমেয়াদি বাজার নীতির। সরকার যদি কৃষকের পাশে না দাঁড়ায়, আগামীতে আলুচাষ মুখ থুবড়ে পড়বে। খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চাইলে চাষির ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। দেশজ উদ্ভাবন ও কৃষকের মঙ্গলÑএই দুইয়ের সমন্বয়েই হতে পারে আলু সমস্যা সমাধানের বাস্তব পথ।
[ লেখক : সাবেক ডিন (ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ) ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা ]
মিহির কুমার রায়
বুধবার, ৩০ জুলাই ২০২৫
বাংলাদেশ আলু উৎপাদনে বিশ্বের সপ্তম অবস্থানে থাকলেও, এখানকার আলুচাষিরা আজও ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত। দেশে বছরে গড়ে একজন মানুষ ৫১.৫ কেজি আলু খানÑবিশ্বে যার অবস্থান ৪৪তম। বিপুল উৎপাদনের পরও বাংলাদেশ আলু রপ্তানিতে শীর্ষ ১৫ দেশের তালিকায় নেই। এ বাস্তবতায় প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে প্রশ্নÑউৎপাদনের তুলনায় বাজারে দাম পড়ে যাচ্ছে কেন?
বাংলাদেশ কোল্ডস্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএসএ) তথ্যমতে, চলতি বছর দেশে এক কোটি ৩০ লাখ টন আলু উৎপাদিত হয়েছে, যা চাহিদার চেয়ে ৪০ লাখ টন বেশি। অথচ এই উদ্বৃত্ত আলু বাজারে তুলতে গিয়ে দাম ধসে পড়েছে। হিমাগার ফটকে কেজিপ্রতি দাম ১৩ থেকে ১৫ টাকা হলেও কৃষকের উৎপাদন খরচ, কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের হিসাবেই, কেজিতে ১৪ টাকা। কৃষকরা জানান, তাদের প্রকৃত খরচ ২৫ টাকা পর্যন্ত উঠেছে। অর্থাৎ লোকসান কেজিপ্রতি ১০ টাকার মতো।
গত পাঁচ বছরের বাজারচিত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, এক মৌসুমে উৎপাদন বেশি হলে দাম পড়ে, ফলে কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হন; পরের বছর উৎপাদন কমে গেলে আবার দাম বেড়ে যায়। ২০২২-২৩ সালে উৎপাদন ছিল এক কোটি ৪ লাখ টন। সরকার খুচরায় দাম নির্ধারণ করলেও বাস্তবে চট্টগ্রামের বাজারে তা ৪৫ টাকায় উঠেছিল। ফলে ক্রেতা ও চাষি উভয়ই চাপে পড়ে।
২০২৪-২৫ মৌসুমে রেকর্ড পরিমাণ আলু উৎপাদনের পর, এবার সংকটে পড়েছেন চাষিরা। উৎপাদন খরচ উঠছে না। হিমাগার খরচ যোগ করে ২৫ টাকা মূল্যে উৎপাদিত আলু বিক্রি করতে হচ্ছে ১৩-১৫ টাকায়। কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, এমন পরিস্থিতি থাকলে অনেকেই আগামী মৌসুমে আলুচাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেনÑফলে ভবিষ্যতে আবারও বাজার অস্থির হতে পারে।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, গত এক মাসে খুচরায় আলুর দাম ১১.১১ শতাংশ বেড়েছে, তবে গত বছরের তুলনায় কমেছে ৫৬.৯০ শতাংশ। দেশের বিভিন্ন জেলায় হিমাগার ফটকে আলুর দাম ১২ থেকে ১৩ টাকা এবং খুচরায় ১৪ থেকে ২০ টাকার মধ্যে থাকছে। ঢাকায় তা আরও বেশি।
রপ্তানির চিত্রও হতাশাজনক। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি আলু খাওয়া হয় বেলারুশে (১৬০ কেজি), এরপর ইউক্রেন, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান ও উজবেকিস্তান। কিন্তু বাংলাদেশ সেসব দেশে রপ্তানি করে না। আমাদের প্রধান রপ্তানি গন্তব্য মালয়েশিয়া (৮০%), এরপর সিঙ্গাপুর, নেপাল, শ্রীলংকা ও মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশ। অথচ মালয়েশিয়ার অবস্থান ১০৯তম।
২০২১ সালে যেখানে ৬৮ হাজার টন আলু রপ্তানি হয়েছিল, ২০২৩ সালে তা নেমে আসে ৩৩ হাজার টনে। ২০২৪ সালে তা আরও কমে ১২ হাজার টনে দাঁড়ায়। অবশ্য চলতি মৌসুমে এ পর্যন্ত ৭০ হাজার টন রপ্তানির তথ্য পাওয়া গেছে, কিন্তু এখানে মৌসুমি অস্থিরতা প্রকট। ২০২৩ সালে যখন ভোক্তারা বেশি দাম দিয়ে কিনছিলেন, তখন রপ্তানি কম ছিল। ২০২৪ সালে যখন কৃষক লোকসানে, তখন রপ্তানি বেড়েছে। এই চক্র থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
এই সংকটের সমাধানে বিসিএসএ সরকারের কাছে কয়েকটি প্রস্তাব দিয়েছে। সেগুলো হচ্ছেÑহিমাগার ফটকে ন্যূনতম বিক্রয়মূল্য ২৫ টাকা নির্ধারণ করা। সরকারের ওএমএস কার্যক্রমে চালের পাশাপাশি ১০ কেজি করে আলু সরবরাহ। আলু ভর্তুকির জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ। টিসিবির মাধ্যমে ট্রাকসেল চালু। কৃষকের উৎপাদিত আলু সরাসরি বিপণনে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের কার্যক্রম সক্রিয় করা। অহিমায়িত মডেল ঘরের বিস্তার ঘটানো।
‘অহিমায়িত মডেল ঘর’ একটি বিজ্ঞানসম্মত ক্ষুদ্র হিমাগার, যার মাধ্যমে কৃষক নিজের উৎপাদিত আলু ঘরে রেখে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত সংরক্ষণ করতে পারেন। প্রতিটি ঘরে ২৫-৩০ টন আলু রাখা যায়। এতে বছরে দেড় থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত হিমাগার খরচ বাঁচাতে পারেন একজন কৃষক। এসব ঘরে সংরক্ষিত আলুতে পচন, গন্ধ বা মিষ্টি হওয়ার ঝুঁকি নেই।
এখন সময় এসেছে দীর্ঘমেয়াদি বাজার নীতির। সরকার যদি কৃষকের পাশে না দাঁড়ায়, আগামীতে আলুচাষ মুখ থুবড়ে পড়বে। খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চাইলে চাষির ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। দেশজ উদ্ভাবন ও কৃষকের মঙ্গলÑএই দুইয়ের সমন্বয়েই হতে পারে আলু সমস্যা সমাধানের বাস্তব পথ।
[ লেখক : সাবেক ডিন (ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ) ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা ]