জিয়াউদ্দীন আহমেদ
২১ জুলাই ২০২৫-বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি শোকাবহ দিন। ঢাকার উত্তরার দিয়াবাড়ী এলাকায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাসে বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়। মাত্র ১২ মিনিট আকাশে ছিল চীনের তৈরি এফটি-৭ বিজিআই যুদ্ধ বিমানটি। দুর্ঘটনায় হতাহত হয়েছেন শিক্ষার্থী, শিক্ষক, আয়া এবং অভিভাবক। এই দুর্ঘটনায় সরকারি হিসাবে এই কলাম লেখার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত ৩৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। বিমান থেকে জীবিত বেরিয়ে এলেও শেষ পর্যন্ত বিমানের পাইলটও বাঁচতে পারেননি। শিক্ষানবিশ হলেও পাইলট অনভিজ্ঞ নন, এর আগে তার একাধিকবার বিমান উড্ডয়ন করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। অনেক বিশেষজ্ঞের অভিমত, যান্ত্রিক ত্রুটিই বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার মূল কারণ। এমনও হতে পারে শেষ মুহূর্তে পাইলট অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, কারণ তিনি গ্রাউন্ডে থাকা তার উড্ডয়ন তদারকি-কর্মকর্তার ‘তুমি বেরিয়ে এসো’ বা ‘ইজেক্ট’ করার নির্দেশের উত্তর দেননি। অথবা বিমান নিয়ন্ত্রণে এত ব্যস্ত ছিলেন যে, উত্তর দেয়া সম্ভব হয়নি।
অগ্নিদগ্ধ অনেকের মরদেহ শনাক্ত করা যায়নি, পরিচয় শনাক্ত করতে ডিএনএ পরীক্ষার প্রয়োজন হয়েছে। ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস মাত্রার তাপে আমরা হা-হুতাশ করতে থাকি, বিধ্বস্ত বিমানের ১২০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস মাত্রার তাপে শিশুগুলো নিশ্চয়ই গলে গিয়েছে। লোহা গলানোর জন্যও এই মাত্রার তাপ লাগে না। সন্তানের খোঁজে মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজনের ছোটাছুটিতে সেদিন মাইলস্টোনের আঙ্গিনায় এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের সৃষ্টি হয়েছিল। যাদের স্কুলের আঙ্গিনায় খুঁজে পাওয়া যায়নি তাদের ছবি নিয়ে মা-বাবা এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ছুটে বেড়িয়েছেন। বিমান বিধ্বস্তের কারণ অনুসন্ধানের নিমিত্তে বিমানবাহিনীর পক্ষ থেকে উচ্চপর্যায়ের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির রিপোর্ট আসার আগেই অনেকে বিভিন্ন সিদ্ধান্তমূলক বক্তব্য দেয়া শুরু করেছেন। বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতির এই ঢাকা শহরে প্রশিক্ষণ বিমান পরিচালনা ঝুঁকিপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও কেন তা সাগরের উপরে বা নির্জন এলাকায় সরিয়ে নেয়া হচ্ছে না তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। কিন্তু ছোট্ট এই বাংলাদেশে নির্জন এলাকা খুঁজে পাওয়া যাবে কি? পরিবেশ দূষণ হওয়ার আশঙ্কা থাকায় এই দেশে পাহাড় কাটা যায় না, গাছ কাটা নিষেধ, সুন্দরবন দূষিত হবে বলে রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে বাধা আসে, জলাশয় ভরাট আইনবিরুদ্ধ, জনগণের বাধার মুখে আড়িয়াল বিলে বিমানবন্দর নির্মাণ করা গেল না, ফসলি জমিতে কারখানা করা যায় না, এত প্রতিবন্ধকতায় যুদ্ধ বিমান দিয়ে প্রশিক্ষণ নেয়ার নির্জন জায়গা খুঁজে নেয়া যাবে কি? অতি সম্প্রতি একটি এফ-৩৫ যুদ্ধ বিমান বিধ্বস্ত হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রে লক্ষ কোটি কিলোমিটার বিরাণভূমি থাকায় জনমানব, পশু-পাখি, খেত-খামার কিছুই নষ্ট হয়নি। শুধু প্রশিক্ষণ বিমান কেন, যাত্রীবাহী বিমানও জনবসতির ওপর বিধ্বস্ত হতে পারে। বিমানের ওঠা-নামার সময় বেশি দুর্ঘটনা হয়; তাই সব বিমানবন্দর সরিয়ে নেয়ার বিরাণভূমি কই?
২০১৩ সালে চীন থেকে কেনা এই বিমানটি পুরনো নকশাভিত্তিক বিমান, রাশিয়ার মিগ-২১ এর ১৯৫০-৬০ দশকের ডিজাইনের ওপর ভিত্তি করে এই বিমান তৈরি হয়েছে। প্রযুক্তিগতভাবে পুরনো হলেও পাকিস্তান এই বিমানের প্রধান ক্রেতা। এক ইঞ্জিন বিশিষ্ট বিধায় নিরাপত্তা ঝুঁকি একটু বেশি, তবে শব্দের চেয়ে দ্বিগুণ গতিতে চলার সক্ষমতা রয়েছে বিমানটির। চীন এই বিমানের উৎপাদক হলেও এখন তারা এই বিমান আর তৈরি করে না। জাতি হিসেবে আমরা এত গরিব যে, বেশি দামের উন্নত প্রযুক্তির বিমান কেনার সামর্থ্য নেই। তাই আমাদের অধিকাংশ যাত্রিবাহী বিমানই সেকেন্ডহ্যান্ড, রাস্তায় চলমান বেশিরভাগ কার রিকন্ডিশনড বা সেকেন্ডহ্যান্ড, প্রাইভেট সেক্টরে আমদানি করা প্রায় সব প্রিন্টিং মেশিনই ‘সেকেন্ড হ্যান্ড’, আমরা অপরিচিত বিদেশি লোকের ব্যবহৃত পোশাক বাজার থেকে কিনে নির্দ্বিধায় পরি, যে রাশিয়ান ট্যাংক ১৯৭৩ সালে ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে বিপর্যস্ত সেই ট্যাংকই ১৯৭৪ সালে মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত বাংলাদেশকে দান করেন, আমাদের দুটি সাবমেরিনও সেকেন্ডহ্যান্ড। আমাদের নতুন কেনার সামর্থ্য না থাকায় বিমানের লাইফ টাইম শেষ হয়ে যাওয়ার পরও এক্সটেনশন দিয়ে চালাতে হয়। তাই বোধ হয় বিশ্বের প্রায় সব এয়ারলাইন বাংলাদেশ রুটে তাদের পুরাতন বিমানটি ব্যবহার করে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দুইদিন ঢুকিনি, শিশুগুলোর মর্মান্তিক মৃত্যুর কাহিনী আর নিতে পারছিলাম না। আগুনে দগ্ধ শায়ান পরদিন আবার স্কুলে আসার প্রত্যাশায় স্কুল-ব্যাগটি কাঁধে তুলে নিতে ভুলেনি, কিন্তু হাসপাতালে বাবার হাতের স্পর্শে ভয় পেলেও মৃত্যু ঠেকাতে পারেনি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দুই ভাই এক বোনের হাসি-খুশি একটি ছবি দেখে সবাই কাঁদল- তিনজনই আগুনে দগ্ধ হয়ে চিরতরে বিদায় নিয়েছে। দেখলাম, আগুনে পোড়া দগ্ধ শরীর নিয়ে একটি শিশু স্কুলের মাঠের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে একা হেঁটে যাচ্ছে, আশপাশে এত মানুষ, কিন্তু কেউ কেন তাকে ধরছে না তা আমার কাছে অদ্ভুত ঠেকেছে। অনেক কষ্টে পাওয়া একটি টেস্টটিউব শিক্ষার্থীও আগুনে ঝলসে মারা গেল। মৃত্যুকে বরণ করে নেয়া চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র আয়মানের গগলস পরা একটি ছবি আমার আমৃত্যু চোখে ভাসবে। নাজিয়া তার মৃত্যুর মুখে দগ্ধ শরীর নিয়েও উদ্ধার করতে আসা আন্টির কাছে প্রথমেই জানতে চেয়েছে ছোট ভাই নাফি সুস্থ কিনা; উত্তর শুনে মনে হলো ছোট ভাইয়ের সুস্থ থাকার সংবাদ নাজিয়াকে নিশ্চিত মৃত্যু বরণ করতে সাহসী করেছে। দমকল বাহিনীর বাধা ঠেলে যে সতীর্থ ভেতরে ঢুকে মৃত্যুপথযাত্রী বন্ধুর শেষ কথা, ‘জানি বন্ধু তুই আমার মৃত্যুর পূর্বে একবার হলেও কাছে আসবি’ শুনে অশ্রুসিক্ত হয়নি এমন কঠিন হৃদয়ের কেউ এখনো জন্মায়নি। জন্মদিনে স্কুল ছুটির ঠিক পূর্ব মুহূর্তে যে মা কেক হাতে সন্তানের ছুটে আসার অপেক্ষায় ছিলেন সেই মায়ের হাতে যখন সেই সন্তানের লাশ ওঠে তখন সারা পৃথিবী কাঁদে। আরও অনেক শিশু শিক্ষার্থীর করুণ মৃত্যু প্রধান উপদেষ্টাসহ আমাদের সবাইকে হতবাক করেছে।
স্কুল আঙ্গিনায় অনেক শিশুর পোড়া মাংসের শুধু স্তূপ দেখেছি, আগুনে যখন পুড়ছিল তখনও হয়তো ‘মা মা’ বলে তারা চিৎকার করছিল; ভেবেছিল, এক্ষুণি মা এসে তাদের রক্ষা করবে, বাবা আগুন নিভিয়ে দেবে, ভাই কাঁধে তুলে নেবে, বোন পানি ঢালবে। কিন্তু হলো না, শিশুগুলো বাঁচার প্রত্যাশা নিয়েই মরে গেল। দুঃখের বিষয়, সেদিন রাতেই সরকার এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের জাতির অভিভাবকরা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে হলুদ রংয়ের জুসে ঠোঁট লাগিয়ে ঐকমত্যের বিজয়ের হাসি জাতিকে উপহার দিলেন। লজ্জা আমার, আপনার, সবার। মৃত শিশুগুলো নিশ্চয় স্বপ্ন দেখত, যেমন দেখেন আমাদের প্রধান উপদেষ্টা। স্বপ্নের মোহময় আবেশে শিশুগুলোও হয়তো কখনো আকাশের তারা এনে বন্ধুর খোঁপায় পরিয়ে দিয়েছে, ভেবেছে চাঁদের বুড়িমার কাছে দৈত্য-দানবের অনেক গল্প আছে; স্বপ্ন দেখেছে বরফাচ্ছিত হিমালয় পর্বতের চূড়ায় ওঠার, সমুদ্রসৈকতে গিয়ে নুড়ি কুড়ানোর, বিশ্বের দীর্ঘতম জলপ্রপাত নায়াগ্রা দেখার, চিকিৎসক হয়ে গাজার শিশুদের সেবা করার। কিন্তু বিধ্বস্ত বিমান তাদের অপ্রস্ফুটিত স্বপ্নগুলো তছনছ করে দিল।
শিশু হত্যা পৃথিবীর সর্বত্র হচ্ছে। দুইশত কোটি মুসলমান রাত-দিন কান্না করেও গাজায় হাজার হাজার শিশুর মৃত্যু থামাতে পারছে না। বড়দের হিংসা, বিদ্বেষ আর যুদ্ধের মাঝে পড়ে শিশুরা মরবে কেন? মরবে এই কারণেই যে, আমাদের মতো গরিবদেরও রণসজ্জায় সজ্জিত হতে বাসনা জাগে, বাসনা জাগে বলেই সমুদ্র পাহারা দেয়ার জন্য সেকেন্ডহ্যান্ড সাবমেরিন কিনি, মেয়াদোত্তীর্ণ যুদ্ধবিমান দিয়ে রণকৌশল শিখি। কিন্তু ইরানের আধুনিক অস্ত্রও যে যুদ্ধ জয়ের জন্য উপযোগী বিবেচিত হয়নি সে ব্যাপারে খেয়াল রাখি না। আমেরিকার যে অত্যাধুনিক বিমান ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা নীরবে নিস্তব্ধে ধ্বংস করল সেই বিমানের চেহারা ইতঃপূর্বে অনেক সমরবিদও দেখেছেন কিনা সন্দেহ। পারমাণবিক শক্তিধর পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে তিন দিনের সীমিত যুদ্ধেই ক্লান্ত। ১৯৭১ সালে তেজগাঁও বিমানবন্দরে মাত্র কয়েকটি বোমা পড়েছিল এবং তাতেই পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানের আকাশযুদ্ধ থেমে যায়। ১৯৬৫ সালে মাত্র সতের দিনের যুদ্ধে পাকিস্তান এবং ভারতের অর্থনীতিতে ধস নেমেছিল। আমাদের হতদরিদ্ররা ডাস্টবিন থেকে এখনো খাবার খুঁজে খায়, খাবারের সন্ধানে হাজার হাজার যুবক ডিঙি নৌকায় সাগর-মহাসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে ডুবে মরে, ধনী মুসলিম ‘উম্মাহরা’ আজও আমাদের ডাকে ‘মিসকিন’। আমরা দেখেছি, ইরাক, ইরান, লিবিয়ার তেল বিক্রির সব অর্থ অস্ত্র ক্রয়ের পেছনে ব্যয় হয়েছে, কিন্তু সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে পারেনি। সৌদি আরব অস্ত্রের পেছনে হাজার হাজার কোটি ডলার ব্যয় করছে, তারপরও বাঁচার জন্য ইসরায়েলের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হচ্ছে। তেলসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থান তলানিতে, শুধু অস্ত্রের ঘাটতি নয়, কারও সঙ্গে যুদ্ধ করার অর্থনৈতিক ভিতও বাংলাদেশের নেই।
শিশুদের বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য। শিশুরা সর্বক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পায়। বহু বছর আগে ইতালির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শুধু একটি শিশুর প্রাণ রক্ষায় সরকারের ব্যর্থতায় টিভিতে এসে জাতির কাছে ক্ষমা চেয়ে বক্তব্য রেখেছিলেন। ইতালির রাজধানী রোমে একটি শিশু স্যুয়ারেজ লাইনে পড়ে যায়, রাষ্ট্রের সর্বশক্তি নিয়োগ করেও শিশুটি উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। তিনি আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘জ্ঞান ও প্রযুক্তির চরম বিকাশ ঘটা সত্ত্বেও নর্দমায় পড়ে যাওয়া একটি শিশু উদ্ধার করতে আমরা পারিনি, জনগণের অভিভাবক হিসেবে আমার এই অক্ষমতার জন্য আমি জাতির কাছে ক্ষমাপ্রার্থী’। ২০০৯ সালে সুইডেনের বিমানবাহিনীর অনুশীলনের সময় যুদ্ধ বিমানের আওয়াজে এক ফার্মের ৩১টি মুরগির বাচ্চা আতঙ্কে মারা যায় এবং কৃষকের কাছ থেকে অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিমানবাহিনী থেকে ক্ষতিপূরণ পরিশোধ করা হয়, বাচ্চাগুলো বড় হলে কী পরিমাণ ডিম দিত বা ডিম থেকে বাচ্চা ফুটে কত বড় হতো সেই প্রক্রিয়ায় দাম হিসাব করে ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়। আর আমরা জনগণ থেকে চাঁদা তুলে ক্ষতিপূরণ দেয়ার কথা ভাবি। কিন্তু জীবনের কি ক্ষতিপূরণ হয়?
সিঙ্গাপুর, চীন এবং ভারত থেকে আগত ২১ জন চিকিৎসক ও নার্স আমাদের ডাক্তার-নার্সের সঙ্গে মিলে আমাদের বার্ন হাসপাতালে আগুনে দগ্ধদের চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন। এই দুর্যোগে জাতির জন্য আপদ হচ্ছে- উপদেষ্টা, সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা; তারা কেন বিশাল কর্মীবহর নিয়ে মাইলস্টোন স্কুল এবং হাসপাতালে গিয়ে উদ্ধারকর্মী ও চিকিৎসকদের কাছে খোঁজখবর নিয়েছিলেন তা খোলা মাঠে এসে বক্তৃতা দিয়ে বোঝালে কৃতার্থ হব। এই করুণ পরিস্থিতিতেও লাশ গুমের অভিযোগ উঠেছে। সরকারের ওপর বিশ্বাস এবং আস্থার অভাব হলে এমন হয়, পাকিস্তান আমল থেকেই লাশ গুমের অভিযোগ শুনে আসছি। কোন মিডিয়া মবের ভয়ে এবং স্বভাবগত কারণে এখনো সঠিক সংবাদ পরিবেশন করছে না। সমস্যা আরও আছে, চার দলের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠকে মাইলস্টোন দুর্ঘটনার অধিক মৃত্যু ঐক্যবদ্ধভাবে ঠেকানোর সংকল্প নেই, আছে ‘আওয়ামী ফ্যাসিবাদ’ প্রতিহত করার দৃঢ় প্রত্যয়। এই মর্মান্তিক ও বিপর্যয়কর অবস্থায় ফ্যাসিবাদ এলো কোত্থেকে? সেই আগের পুরনো রাজনৈতিক খেলা, কোন পরিবর্তন নেই।
বিপর্যয়কর অবস্থার মোকাবিলায় দশ-পনের মিনিটের মধ্যেই সেনাবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ছাত্র-জনতা। কিন্তু ফার্স্ট এইড হিসেবে কাউকে দগ্ধ শরীরে পানি ঢালতে দেখা গেল না, দেখা গেল না হেলিকপ্টারে দগ্ধ শিশুদের হাসপাতালে নিতে। সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও সমন্বয়ের অভাব। এমন একটি বিমর্ষ অবস্থায় মাইলস্টোনের ছাত্র সূর্য সতীর্থদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে তারপর নিজেকে রক্ষা করেছে। অন্যদিকে শিক্ষিকা মাহরীন চৌধুরী, মাসুকা বেগম নিজেদের জীবন দিয়ে অনেক শিশুকে বাঁচিয়েছেন, মাহফুজা খাতুনও নিজে দগ্ধ শরীর নিয়ে বাচ্চাদের বাঁচিয়েছেন, তিনি লাইফ সাপোর্টে এখনো মৃত্যুর সঙ্গে সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। আরও কয়েকজন শিক্ষক মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। আজ সবার কাছে তারাই আদর্শ শিক্ষক, তারাই সত্যিকার মা-বাবা, তারাই আজ জাতীয় বীর। নিহত দুই শিক্ষককে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা দেয়ার সিদ্ধান্ত পরার্থে আমাদের অনুপ্রাণিত করবে।
[লেখক : সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক ]
জিয়াউদ্দীন আহমেদ
শনিবার, ০২ আগস্ট ২০২৫
২১ জুলাই ২০২৫-বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি শোকাবহ দিন। ঢাকার উত্তরার দিয়াবাড়ী এলাকায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাসে বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়। মাত্র ১২ মিনিট আকাশে ছিল চীনের তৈরি এফটি-৭ বিজিআই যুদ্ধ বিমানটি। দুর্ঘটনায় হতাহত হয়েছেন শিক্ষার্থী, শিক্ষক, আয়া এবং অভিভাবক। এই দুর্ঘটনায় সরকারি হিসাবে এই কলাম লেখার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত ৩৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। বিমান থেকে জীবিত বেরিয়ে এলেও শেষ পর্যন্ত বিমানের পাইলটও বাঁচতে পারেননি। শিক্ষানবিশ হলেও পাইলট অনভিজ্ঞ নন, এর আগে তার একাধিকবার বিমান উড্ডয়ন করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। অনেক বিশেষজ্ঞের অভিমত, যান্ত্রিক ত্রুটিই বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার মূল কারণ। এমনও হতে পারে শেষ মুহূর্তে পাইলট অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, কারণ তিনি গ্রাউন্ডে থাকা তার উড্ডয়ন তদারকি-কর্মকর্তার ‘তুমি বেরিয়ে এসো’ বা ‘ইজেক্ট’ করার নির্দেশের উত্তর দেননি। অথবা বিমান নিয়ন্ত্রণে এত ব্যস্ত ছিলেন যে, উত্তর দেয়া সম্ভব হয়নি।
অগ্নিদগ্ধ অনেকের মরদেহ শনাক্ত করা যায়নি, পরিচয় শনাক্ত করতে ডিএনএ পরীক্ষার প্রয়োজন হয়েছে। ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস মাত্রার তাপে আমরা হা-হুতাশ করতে থাকি, বিধ্বস্ত বিমানের ১২০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস মাত্রার তাপে শিশুগুলো নিশ্চয়ই গলে গিয়েছে। লোহা গলানোর জন্যও এই মাত্রার তাপ লাগে না। সন্তানের খোঁজে মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজনের ছোটাছুটিতে সেদিন মাইলস্টোনের আঙ্গিনায় এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের সৃষ্টি হয়েছিল। যাদের স্কুলের আঙ্গিনায় খুঁজে পাওয়া যায়নি তাদের ছবি নিয়ে মা-বাবা এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ছুটে বেড়িয়েছেন। বিমান বিধ্বস্তের কারণ অনুসন্ধানের নিমিত্তে বিমানবাহিনীর পক্ষ থেকে উচ্চপর্যায়ের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির রিপোর্ট আসার আগেই অনেকে বিভিন্ন সিদ্ধান্তমূলক বক্তব্য দেয়া শুরু করেছেন। বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতির এই ঢাকা শহরে প্রশিক্ষণ বিমান পরিচালনা ঝুঁকিপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও কেন তা সাগরের উপরে বা নির্জন এলাকায় সরিয়ে নেয়া হচ্ছে না তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। কিন্তু ছোট্ট এই বাংলাদেশে নির্জন এলাকা খুঁজে পাওয়া যাবে কি? পরিবেশ দূষণ হওয়ার আশঙ্কা থাকায় এই দেশে পাহাড় কাটা যায় না, গাছ কাটা নিষেধ, সুন্দরবন দূষিত হবে বলে রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে বাধা আসে, জলাশয় ভরাট আইনবিরুদ্ধ, জনগণের বাধার মুখে আড়িয়াল বিলে বিমানবন্দর নির্মাণ করা গেল না, ফসলি জমিতে কারখানা করা যায় না, এত প্রতিবন্ধকতায় যুদ্ধ বিমান দিয়ে প্রশিক্ষণ নেয়ার নির্জন জায়গা খুঁজে নেয়া যাবে কি? অতি সম্প্রতি একটি এফ-৩৫ যুদ্ধ বিমান বিধ্বস্ত হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রে লক্ষ কোটি কিলোমিটার বিরাণভূমি থাকায় জনমানব, পশু-পাখি, খেত-খামার কিছুই নষ্ট হয়নি। শুধু প্রশিক্ষণ বিমান কেন, যাত্রীবাহী বিমানও জনবসতির ওপর বিধ্বস্ত হতে পারে। বিমানের ওঠা-নামার সময় বেশি দুর্ঘটনা হয়; তাই সব বিমানবন্দর সরিয়ে নেয়ার বিরাণভূমি কই?
২০১৩ সালে চীন থেকে কেনা এই বিমানটি পুরনো নকশাভিত্তিক বিমান, রাশিয়ার মিগ-২১ এর ১৯৫০-৬০ দশকের ডিজাইনের ওপর ভিত্তি করে এই বিমান তৈরি হয়েছে। প্রযুক্তিগতভাবে পুরনো হলেও পাকিস্তান এই বিমানের প্রধান ক্রেতা। এক ইঞ্জিন বিশিষ্ট বিধায় নিরাপত্তা ঝুঁকি একটু বেশি, তবে শব্দের চেয়ে দ্বিগুণ গতিতে চলার সক্ষমতা রয়েছে বিমানটির। চীন এই বিমানের উৎপাদক হলেও এখন তারা এই বিমান আর তৈরি করে না। জাতি হিসেবে আমরা এত গরিব যে, বেশি দামের উন্নত প্রযুক্তির বিমান কেনার সামর্থ্য নেই। তাই আমাদের অধিকাংশ যাত্রিবাহী বিমানই সেকেন্ডহ্যান্ড, রাস্তায় চলমান বেশিরভাগ কার রিকন্ডিশনড বা সেকেন্ডহ্যান্ড, প্রাইভেট সেক্টরে আমদানি করা প্রায় সব প্রিন্টিং মেশিনই ‘সেকেন্ড হ্যান্ড’, আমরা অপরিচিত বিদেশি লোকের ব্যবহৃত পোশাক বাজার থেকে কিনে নির্দ্বিধায় পরি, যে রাশিয়ান ট্যাংক ১৯৭৩ সালে ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে বিপর্যস্ত সেই ট্যাংকই ১৯৭৪ সালে মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত বাংলাদেশকে দান করেন, আমাদের দুটি সাবমেরিনও সেকেন্ডহ্যান্ড। আমাদের নতুন কেনার সামর্থ্য না থাকায় বিমানের লাইফ টাইম শেষ হয়ে যাওয়ার পরও এক্সটেনশন দিয়ে চালাতে হয়। তাই বোধ হয় বিশ্বের প্রায় সব এয়ারলাইন বাংলাদেশ রুটে তাদের পুরাতন বিমানটি ব্যবহার করে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দুইদিন ঢুকিনি, শিশুগুলোর মর্মান্তিক মৃত্যুর কাহিনী আর নিতে পারছিলাম না। আগুনে দগ্ধ শায়ান পরদিন আবার স্কুলে আসার প্রত্যাশায় স্কুল-ব্যাগটি কাঁধে তুলে নিতে ভুলেনি, কিন্তু হাসপাতালে বাবার হাতের স্পর্শে ভয় পেলেও মৃত্যু ঠেকাতে পারেনি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দুই ভাই এক বোনের হাসি-খুশি একটি ছবি দেখে সবাই কাঁদল- তিনজনই আগুনে দগ্ধ হয়ে চিরতরে বিদায় নিয়েছে। দেখলাম, আগুনে পোড়া দগ্ধ শরীর নিয়ে একটি শিশু স্কুলের মাঠের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে একা হেঁটে যাচ্ছে, আশপাশে এত মানুষ, কিন্তু কেউ কেন তাকে ধরছে না তা আমার কাছে অদ্ভুত ঠেকেছে। অনেক কষ্টে পাওয়া একটি টেস্টটিউব শিক্ষার্থীও আগুনে ঝলসে মারা গেল। মৃত্যুকে বরণ করে নেয়া চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র আয়মানের গগলস পরা একটি ছবি আমার আমৃত্যু চোখে ভাসবে। নাজিয়া তার মৃত্যুর মুখে দগ্ধ শরীর নিয়েও উদ্ধার করতে আসা আন্টির কাছে প্রথমেই জানতে চেয়েছে ছোট ভাই নাফি সুস্থ কিনা; উত্তর শুনে মনে হলো ছোট ভাইয়ের সুস্থ থাকার সংবাদ নাজিয়াকে নিশ্চিত মৃত্যু বরণ করতে সাহসী করেছে। দমকল বাহিনীর বাধা ঠেলে যে সতীর্থ ভেতরে ঢুকে মৃত্যুপথযাত্রী বন্ধুর শেষ কথা, ‘জানি বন্ধু তুই আমার মৃত্যুর পূর্বে একবার হলেও কাছে আসবি’ শুনে অশ্রুসিক্ত হয়নি এমন কঠিন হৃদয়ের কেউ এখনো জন্মায়নি। জন্মদিনে স্কুল ছুটির ঠিক পূর্ব মুহূর্তে যে মা কেক হাতে সন্তানের ছুটে আসার অপেক্ষায় ছিলেন সেই মায়ের হাতে যখন সেই সন্তানের লাশ ওঠে তখন সারা পৃথিবী কাঁদে। আরও অনেক শিশু শিক্ষার্থীর করুণ মৃত্যু প্রধান উপদেষ্টাসহ আমাদের সবাইকে হতবাক করেছে।
স্কুল আঙ্গিনায় অনেক শিশুর পোড়া মাংসের শুধু স্তূপ দেখেছি, আগুনে যখন পুড়ছিল তখনও হয়তো ‘মা মা’ বলে তারা চিৎকার করছিল; ভেবেছিল, এক্ষুণি মা এসে তাদের রক্ষা করবে, বাবা আগুন নিভিয়ে দেবে, ভাই কাঁধে তুলে নেবে, বোন পানি ঢালবে। কিন্তু হলো না, শিশুগুলো বাঁচার প্রত্যাশা নিয়েই মরে গেল। দুঃখের বিষয়, সেদিন রাতেই সরকার এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের জাতির অভিভাবকরা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে হলুদ রংয়ের জুসে ঠোঁট লাগিয়ে ঐকমত্যের বিজয়ের হাসি জাতিকে উপহার দিলেন। লজ্জা আমার, আপনার, সবার। মৃত শিশুগুলো নিশ্চয় স্বপ্ন দেখত, যেমন দেখেন আমাদের প্রধান উপদেষ্টা। স্বপ্নের মোহময় আবেশে শিশুগুলোও হয়তো কখনো আকাশের তারা এনে বন্ধুর খোঁপায় পরিয়ে দিয়েছে, ভেবেছে চাঁদের বুড়িমার কাছে দৈত্য-দানবের অনেক গল্প আছে; স্বপ্ন দেখেছে বরফাচ্ছিত হিমালয় পর্বতের চূড়ায় ওঠার, সমুদ্রসৈকতে গিয়ে নুড়ি কুড়ানোর, বিশ্বের দীর্ঘতম জলপ্রপাত নায়াগ্রা দেখার, চিকিৎসক হয়ে গাজার শিশুদের সেবা করার। কিন্তু বিধ্বস্ত বিমান তাদের অপ্রস্ফুটিত স্বপ্নগুলো তছনছ করে দিল।
শিশু হত্যা পৃথিবীর সর্বত্র হচ্ছে। দুইশত কোটি মুসলমান রাত-দিন কান্না করেও গাজায় হাজার হাজার শিশুর মৃত্যু থামাতে পারছে না। বড়দের হিংসা, বিদ্বেষ আর যুদ্ধের মাঝে পড়ে শিশুরা মরবে কেন? মরবে এই কারণেই যে, আমাদের মতো গরিবদেরও রণসজ্জায় সজ্জিত হতে বাসনা জাগে, বাসনা জাগে বলেই সমুদ্র পাহারা দেয়ার জন্য সেকেন্ডহ্যান্ড সাবমেরিন কিনি, মেয়াদোত্তীর্ণ যুদ্ধবিমান দিয়ে রণকৌশল শিখি। কিন্তু ইরানের আধুনিক অস্ত্রও যে যুদ্ধ জয়ের জন্য উপযোগী বিবেচিত হয়নি সে ব্যাপারে খেয়াল রাখি না। আমেরিকার যে অত্যাধুনিক বিমান ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা নীরবে নিস্তব্ধে ধ্বংস করল সেই বিমানের চেহারা ইতঃপূর্বে অনেক সমরবিদও দেখেছেন কিনা সন্দেহ। পারমাণবিক শক্তিধর পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে তিন দিনের সীমিত যুদ্ধেই ক্লান্ত। ১৯৭১ সালে তেজগাঁও বিমানবন্দরে মাত্র কয়েকটি বোমা পড়েছিল এবং তাতেই পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানের আকাশযুদ্ধ থেমে যায়। ১৯৬৫ সালে মাত্র সতের দিনের যুদ্ধে পাকিস্তান এবং ভারতের অর্থনীতিতে ধস নেমেছিল। আমাদের হতদরিদ্ররা ডাস্টবিন থেকে এখনো খাবার খুঁজে খায়, খাবারের সন্ধানে হাজার হাজার যুবক ডিঙি নৌকায় সাগর-মহাসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে ডুবে মরে, ধনী মুসলিম ‘উম্মাহরা’ আজও আমাদের ডাকে ‘মিসকিন’। আমরা দেখেছি, ইরাক, ইরান, লিবিয়ার তেল বিক্রির সব অর্থ অস্ত্র ক্রয়ের পেছনে ব্যয় হয়েছে, কিন্তু সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে পারেনি। সৌদি আরব অস্ত্রের পেছনে হাজার হাজার কোটি ডলার ব্যয় করছে, তারপরও বাঁচার জন্য ইসরায়েলের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হচ্ছে। তেলসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থান তলানিতে, শুধু অস্ত্রের ঘাটতি নয়, কারও সঙ্গে যুদ্ধ করার অর্থনৈতিক ভিতও বাংলাদেশের নেই।
শিশুদের বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য। শিশুরা সর্বক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পায়। বহু বছর আগে ইতালির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শুধু একটি শিশুর প্রাণ রক্ষায় সরকারের ব্যর্থতায় টিভিতে এসে জাতির কাছে ক্ষমা চেয়ে বক্তব্য রেখেছিলেন। ইতালির রাজধানী রোমে একটি শিশু স্যুয়ারেজ লাইনে পড়ে যায়, রাষ্ট্রের সর্বশক্তি নিয়োগ করেও শিশুটি উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। তিনি আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘জ্ঞান ও প্রযুক্তির চরম বিকাশ ঘটা সত্ত্বেও নর্দমায় পড়ে যাওয়া একটি শিশু উদ্ধার করতে আমরা পারিনি, জনগণের অভিভাবক হিসেবে আমার এই অক্ষমতার জন্য আমি জাতির কাছে ক্ষমাপ্রার্থী’। ২০০৯ সালে সুইডেনের বিমানবাহিনীর অনুশীলনের সময় যুদ্ধ বিমানের আওয়াজে এক ফার্মের ৩১টি মুরগির বাচ্চা আতঙ্কে মারা যায় এবং কৃষকের কাছ থেকে অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিমানবাহিনী থেকে ক্ষতিপূরণ পরিশোধ করা হয়, বাচ্চাগুলো বড় হলে কী পরিমাণ ডিম দিত বা ডিম থেকে বাচ্চা ফুটে কত বড় হতো সেই প্রক্রিয়ায় দাম হিসাব করে ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়। আর আমরা জনগণ থেকে চাঁদা তুলে ক্ষতিপূরণ দেয়ার কথা ভাবি। কিন্তু জীবনের কি ক্ষতিপূরণ হয়?
সিঙ্গাপুর, চীন এবং ভারত থেকে আগত ২১ জন চিকিৎসক ও নার্স আমাদের ডাক্তার-নার্সের সঙ্গে মিলে আমাদের বার্ন হাসপাতালে আগুনে দগ্ধদের চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন। এই দুর্যোগে জাতির জন্য আপদ হচ্ছে- উপদেষ্টা, সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা; তারা কেন বিশাল কর্মীবহর নিয়ে মাইলস্টোন স্কুল এবং হাসপাতালে গিয়ে উদ্ধারকর্মী ও চিকিৎসকদের কাছে খোঁজখবর নিয়েছিলেন তা খোলা মাঠে এসে বক্তৃতা দিয়ে বোঝালে কৃতার্থ হব। এই করুণ পরিস্থিতিতেও লাশ গুমের অভিযোগ উঠেছে। সরকারের ওপর বিশ্বাস এবং আস্থার অভাব হলে এমন হয়, পাকিস্তান আমল থেকেই লাশ গুমের অভিযোগ শুনে আসছি। কোন মিডিয়া মবের ভয়ে এবং স্বভাবগত কারণে এখনো সঠিক সংবাদ পরিবেশন করছে না। সমস্যা আরও আছে, চার দলের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠকে মাইলস্টোন দুর্ঘটনার অধিক মৃত্যু ঐক্যবদ্ধভাবে ঠেকানোর সংকল্প নেই, আছে ‘আওয়ামী ফ্যাসিবাদ’ প্রতিহত করার দৃঢ় প্রত্যয়। এই মর্মান্তিক ও বিপর্যয়কর অবস্থায় ফ্যাসিবাদ এলো কোত্থেকে? সেই আগের পুরনো রাজনৈতিক খেলা, কোন পরিবর্তন নেই।
বিপর্যয়কর অবস্থার মোকাবিলায় দশ-পনের মিনিটের মধ্যেই সেনাবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ছাত্র-জনতা। কিন্তু ফার্স্ট এইড হিসেবে কাউকে দগ্ধ শরীরে পানি ঢালতে দেখা গেল না, দেখা গেল না হেলিকপ্টারে দগ্ধ শিশুদের হাসপাতালে নিতে। সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও সমন্বয়ের অভাব। এমন একটি বিমর্ষ অবস্থায় মাইলস্টোনের ছাত্র সূর্য সতীর্থদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে তারপর নিজেকে রক্ষা করেছে। অন্যদিকে শিক্ষিকা মাহরীন চৌধুরী, মাসুকা বেগম নিজেদের জীবন দিয়ে অনেক শিশুকে বাঁচিয়েছেন, মাহফুজা খাতুনও নিজে দগ্ধ শরীর নিয়ে বাচ্চাদের বাঁচিয়েছেন, তিনি লাইফ সাপোর্টে এখনো মৃত্যুর সঙ্গে সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। আরও কয়েকজন শিক্ষক মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। আজ সবার কাছে তারাই আদর্শ শিক্ষক, তারাই সত্যিকার মা-বাবা, তারাই আজ জাতীয় বীর। নিহত দুই শিক্ষককে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা দেয়ার সিদ্ধান্ত পরার্থে আমাদের অনুপ্রাণিত করবে।
[লেখক : সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক ]