এমএ হোসাইন
রাশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট এবং বর্তমান নিরাপত্তা পরিষদের ডেপুটি চেয়ারম্যান দিমিত্রি মেদভেদেভ, গত ২৭ জুলাই দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত লিবারেশন মুভমেন্টস সামিট-এ এক বার্তায় যে ঘোষণা দেন, তা একদিকে পূর্বানুমেয়, অন্যদিকে স্পষ্টভাবে রাজনৈতিক : রাশিয়া আফ্রিকার নব্য উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পাশে থাকবে এবং একটি বহুমেরু বিশ্বের পক্ষে অবস্থান নেবে। শুনতে মহৎ মনে হলেও, এই বক্তব্যের পেছনের যুক্তি, ইতিহাস ও ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা বিশ্লেষণ করলে চিত্রটা অনেক জটিল হয়ে ওঠে।
এই সম্মেলনে আফ্রিকার স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী এবং বর্তমানে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেনÑদক্ষিণ আফ্রিকার এএনসি, জিম্বাবুয়ের জানু-পিএফ, মোজাম্বিকের ফ্রেলিমো, নামিবিয়ার সোয়াপো এবং তানজানিয়ার চামা চা মাপিন্ডুজি (সিসিএম)। মেদভেদেভ এসব দলকে সার্বভৌমত্ব ও উন্নয়নের রক্ষক হিসেবে প্রশংসা করেন এবং বলেন, তারা শুধুই ঐতিহাসিক নয়, বরং ভবিষ্যৎ বিশ্বের নতুন ভারসাম্য গঠনে গুরুত্বপূর্ণ শক্তি। তবে ইতিহাসের স্মৃতি আর বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতা সব সময় এক সুরে বাজে না।
নিঃসন্দেহে, রাশিয়ার আফ্রিকান কৌশল এমন এক মনস্তত্ত্বে খেলে যাচ্ছে, যা পশ্চিমা উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের অতীত নিয়ে গভীর অসন্তোষ বহন করে। অনেক আফ্রিকান দেশের জন্য রাজনৈতিক স্বাধীনতা কখনোই অর্থনৈতিক মুক্তির পথে পুরোপুরি রূপান্তরিত হয়নি। উপনিবেশিক শক্তির প্রস্থান সত্ত্বেও বহুজাতিক করপোরেশন এখনো সম্পদ আহরণ করে এবং মুনাফা ফেরত নিয়ে যায়, যখন সাধারণ মানুষ দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রে বন্দী থাকে।
এই বাস্তবতাকে কেন্দ্র করেই রাশিয়া পশ্চিমা আধিপত্যবাদের সমালোচক হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করছে। মেদভেদেভের বক্তব্যে ‘নব্য উপনিবেশবাদের মতাদর্শিকদের’ বিরুদ্ধে বারবার তীর ছোড়া হয়েছে। রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভও একাধিকবার আফ্রিকায় পশ্চিমা করপোরেট কর্মকা-কে “শোষণমূলক” বলেছেন।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, রাশিয়া কি সত্যিই আফ্রিকার জন্য মুক্তির পথ?
নব্য উপনিবেশবাদ যদি হয় সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলোর ওপর অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ, তাহলে রাশিয়ার সাম্প্রতিক কর্মকা-ও এ নিরীক্ষার বাইরে থাকতে পারে না। আফ্রিকায় রাশিয়ার প্রভাব বাড়ছেÑসেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকে ওয়াগনার গ্রুপের উপস্থিতি, মালি ও বুরকিনা ফাসোর সঙ্গে সামরিক সম্পর্ক, অস্ত্রচুক্তি, এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তা চুক্তি। এসব চুক্তি প্রায়শই অস্বচ্ছ ও একতরফা।
রাশিয়ার এসব ‘সহযোগিতা’ কি সত্যিই মুক্তির প্রতিশ্রুতি দেয়, না কি কেবল পশ্চিমের বিকল্প আধিপত্য স্থাপন করছে?
আফ্রিকান দেশগুলো নিঃসন্দেহে পুতুল নয়। তারা নানা বাস্তবতার মধ্যে পথ খুঁজছেÑচীনের বিনিয়োগ, রাশিয়ার নিরাপত্তা, উপসাগরীয় অর্থ, ও পশ্চিমা অনুদান একসঙ্গে সামলাতে শিখছে। এ এক বহুমাত্রিক কূটনীতি। পশ্চিম যদি শর্ত আরোপ করে, রাশিয়া তা করে নাÑএটাই এখন অনেক শাসকের কাছে সুবিধাজনক। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে, এর ফলে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং উন্নয়ন কতটা সম্ভব, সেটিই বড় প্রশ্ন।
লিবারেশন মুভমেন্টস সামিট এক গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিয়েছেÑআফ্রিকা এখন আর পেছনে তাকাতে চায় না। তারা রাজনৈতিক মুক্তির পরে এখন চায় অর্থনৈতিক সমতা ও সম্পদের ওপর অধিকার। দক্ষিণ আফ্রিকার এএনসি’র কোষাধ্যক্ষ গয়েন রামোকগোপা বলেছেন, “রাজনৈতিক মুক্তি যথেষ্ট নয়। এখন দরকার অর্থনৈতিক মুক্তি। ”
কিন্তু অর্থনৈতিক মুক্তি কি রাশিয়ার সহায়তায় সম্ভব? নাকি এটি আরেকটি বন্ধনে আটকা পড়ার নামান্তর?
আমরা যদি ইতিহাস দেখি, সোভিয়েত ইউনিয়নের সময়ে অনেক আফ্রিকান রাষ্ট্র মস্কোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিল। কিন্তু সেই সহায়তা ততটা দীর্ঘস্থায়ী ছিল না। সোভিয়েত পতনের পর অনেক সহযোগিতা বন্ধ হয়ে যায়। আজকের রাশিয়া ঠিক কতটা দীর্ঘমেয়াদি অংশীদার হতে চায়, তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।
রাশিয়ার বর্তমান অবস্থানও সেই সন্দেহকে শক্ত করে। ইউক্রেনে যুদ্ধ, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা, এবং আন্তর্জাতিক নিঃসঙ্গতা পেরিয়ে মস্কো এখন আফ্রিকাকে বিকল্প বাজার, কূটনৈতিক মিত্র এবং আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের মঞ্চ হিসেবে দেখছে। মেদভেদেভের বক্তব্য তাই কেবল ‘ভ্রাতৃত্ব’ নয়, বরং ‘রাজনৈতিক কৌশল’।
তবুও, পশ্চিমা বিশ্বকে এ নিয়ে স্বস্তিতে থাকার সুযোগ নেই। আফ্রিকায় তাদের দীর্ঘদিনের উন্নয়ন সহায়তা, মানবাধিকার বক্তৃতা, ও ঋণনীতি প্রায়শই দ্বিমুখী বলেই প্রতিভাত হয়েছে। যখন পশ্চিমারা মানবাধিকার শেখায়, অথচ কর্পোরেট দৃষ্টিভঙ্গিতে দেশ শোষণ করে, তখন তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হয়। এই বিশ্বাসঘাতকতার শূন্যস্থান পূরণ করতে চায় রাশিয়া।
পশ্চিমা দেশগুলোর উচিত শুধু রাশিয়ার সমালোচনা করা নয়, বরং একটি বাস্তবিক, ন্যায্য ও সহমর্মী অংশীদারিত্বের পথ তৈরি করা। উদাহরণস্বরূপÑআফ্রিকান ঋণ পুনর্গঠন, নিজস্ব শিল্প গড়ে তোলার সহায়তা, এবং শুধু রাষ্ট্রনায়কদের নয়, বরং নাগরিক সমাজকে সম্পৃক্ত করা।
আফ্রিকার জন্য সঠিক পথ পশ্চিম বা পূর্ব নয়Ñবরং কৌশলগত নিরপেক্ষতা। একাধিক অংশীদার থেকে লাভ আদায়ের দক্ষতা অর্জনই ভবিষ্যতের চাবিকাঠি। বহুমেরু বিশ্ব যদি সত্যিই পারস্পরিক সম্মান ও অন্তর্ভুক্তিতে গড়ে ওঠে, তবে তা হতে পারে মুক্তির পথ। কিন্তু যদি তা নতুন এক শাসনের মোড়কে পুরনো আধিপত্যবাদ হয়ে ওঠে, তাহলে তা হবে আরও একটি ব্যর্থতার নামান্তর।
মেদভেদেভের বক্তব্য বৃহত্তর ভূরাজনৈতিক পুনর্গঠনেরই প্রতিফলন। আফ্রিকা মহাদেশ এখনও উপনিবেশবাদীর ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছে, আর সেই প্রেক্ষাপটে ইতিহাস ও আদর্শকে হাতিয়ার করে নিজেকে ‘পছন্দের অংশীদার’ হিসেবে উপস্থাপন করছে রাশিয়া। তবে শুধু বক্তব্য দিয়ে দায় মুক্তি পাওয়া যায় না। এক সময়কার মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেয়া আন্দোলনগুলোÑযেগুলো এখন শাসকদলে রূপান্তরিতÑতাদেরই নির্ধারণ করতে হবে, রাশিয়া কেবল নতুন প্রণয়প্রার্থী, না কি একটি ভিন্ন ও বিকল্প পথের প্রস্তাবক। তাদের এই সিদ্ধান্তই নির্ধারণ করবে, বহুমেরুর বিশ্ব কি তাদের ক্ষমতায়নের পথ খুলে দেবে, নাকি তা হবে কেবল নতুন মুখোশে পুরোনো নির্ভরশীলতার আরেক সংস্করণ।
[ লেখক : প্রাবন্ধিক ]
এমএ হোসাইন
শনিবার, ০২ আগস্ট ২০২৫
রাশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট এবং বর্তমান নিরাপত্তা পরিষদের ডেপুটি চেয়ারম্যান দিমিত্রি মেদভেদেভ, গত ২৭ জুলাই দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত লিবারেশন মুভমেন্টস সামিট-এ এক বার্তায় যে ঘোষণা দেন, তা একদিকে পূর্বানুমেয়, অন্যদিকে স্পষ্টভাবে রাজনৈতিক : রাশিয়া আফ্রিকার নব্য উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পাশে থাকবে এবং একটি বহুমেরু বিশ্বের পক্ষে অবস্থান নেবে। শুনতে মহৎ মনে হলেও, এই বক্তব্যের পেছনের যুক্তি, ইতিহাস ও ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা বিশ্লেষণ করলে চিত্রটা অনেক জটিল হয়ে ওঠে।
এই সম্মেলনে আফ্রিকার স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী এবং বর্তমানে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেনÑদক্ষিণ আফ্রিকার এএনসি, জিম্বাবুয়ের জানু-পিএফ, মোজাম্বিকের ফ্রেলিমো, নামিবিয়ার সোয়াপো এবং তানজানিয়ার চামা চা মাপিন্ডুজি (সিসিএম)। মেদভেদেভ এসব দলকে সার্বভৌমত্ব ও উন্নয়নের রক্ষক হিসেবে প্রশংসা করেন এবং বলেন, তারা শুধুই ঐতিহাসিক নয়, বরং ভবিষ্যৎ বিশ্বের নতুন ভারসাম্য গঠনে গুরুত্বপূর্ণ শক্তি। তবে ইতিহাসের স্মৃতি আর বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতা সব সময় এক সুরে বাজে না।
নিঃসন্দেহে, রাশিয়ার আফ্রিকান কৌশল এমন এক মনস্তত্ত্বে খেলে যাচ্ছে, যা পশ্চিমা উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের অতীত নিয়ে গভীর অসন্তোষ বহন করে। অনেক আফ্রিকান দেশের জন্য রাজনৈতিক স্বাধীনতা কখনোই অর্থনৈতিক মুক্তির পথে পুরোপুরি রূপান্তরিত হয়নি। উপনিবেশিক শক্তির প্রস্থান সত্ত্বেও বহুজাতিক করপোরেশন এখনো সম্পদ আহরণ করে এবং মুনাফা ফেরত নিয়ে যায়, যখন সাধারণ মানুষ দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রে বন্দী থাকে।
এই বাস্তবতাকে কেন্দ্র করেই রাশিয়া পশ্চিমা আধিপত্যবাদের সমালোচক হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করছে। মেদভেদেভের বক্তব্যে ‘নব্য উপনিবেশবাদের মতাদর্শিকদের’ বিরুদ্ধে বারবার তীর ছোড়া হয়েছে। রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভও একাধিকবার আফ্রিকায় পশ্চিমা করপোরেট কর্মকা-কে “শোষণমূলক” বলেছেন।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, রাশিয়া কি সত্যিই আফ্রিকার জন্য মুক্তির পথ?
নব্য উপনিবেশবাদ যদি হয় সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলোর ওপর অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ, তাহলে রাশিয়ার সাম্প্রতিক কর্মকা-ও এ নিরীক্ষার বাইরে থাকতে পারে না। আফ্রিকায় রাশিয়ার প্রভাব বাড়ছেÑসেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকে ওয়াগনার গ্রুপের উপস্থিতি, মালি ও বুরকিনা ফাসোর সঙ্গে সামরিক সম্পর্ক, অস্ত্রচুক্তি, এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তা চুক্তি। এসব চুক্তি প্রায়শই অস্বচ্ছ ও একতরফা।
রাশিয়ার এসব ‘সহযোগিতা’ কি সত্যিই মুক্তির প্রতিশ্রুতি দেয়, না কি কেবল পশ্চিমের বিকল্প আধিপত্য স্থাপন করছে?
আফ্রিকান দেশগুলো নিঃসন্দেহে পুতুল নয়। তারা নানা বাস্তবতার মধ্যে পথ খুঁজছেÑচীনের বিনিয়োগ, রাশিয়ার নিরাপত্তা, উপসাগরীয় অর্থ, ও পশ্চিমা অনুদান একসঙ্গে সামলাতে শিখছে। এ এক বহুমাত্রিক কূটনীতি। পশ্চিম যদি শর্ত আরোপ করে, রাশিয়া তা করে নাÑএটাই এখন অনেক শাসকের কাছে সুবিধাজনক। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে, এর ফলে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং উন্নয়ন কতটা সম্ভব, সেটিই বড় প্রশ্ন।
লিবারেশন মুভমেন্টস সামিট এক গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিয়েছেÑআফ্রিকা এখন আর পেছনে তাকাতে চায় না। তারা রাজনৈতিক মুক্তির পরে এখন চায় অর্থনৈতিক সমতা ও সম্পদের ওপর অধিকার। দক্ষিণ আফ্রিকার এএনসি’র কোষাধ্যক্ষ গয়েন রামোকগোপা বলেছেন, “রাজনৈতিক মুক্তি যথেষ্ট নয়। এখন দরকার অর্থনৈতিক মুক্তি। ”
কিন্তু অর্থনৈতিক মুক্তি কি রাশিয়ার সহায়তায় সম্ভব? নাকি এটি আরেকটি বন্ধনে আটকা পড়ার নামান্তর?
আমরা যদি ইতিহাস দেখি, সোভিয়েত ইউনিয়নের সময়ে অনেক আফ্রিকান রাষ্ট্র মস্কোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিল। কিন্তু সেই সহায়তা ততটা দীর্ঘস্থায়ী ছিল না। সোভিয়েত পতনের পর অনেক সহযোগিতা বন্ধ হয়ে যায়। আজকের রাশিয়া ঠিক কতটা দীর্ঘমেয়াদি অংশীদার হতে চায়, তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।
রাশিয়ার বর্তমান অবস্থানও সেই সন্দেহকে শক্ত করে। ইউক্রেনে যুদ্ধ, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা, এবং আন্তর্জাতিক নিঃসঙ্গতা পেরিয়ে মস্কো এখন আফ্রিকাকে বিকল্প বাজার, কূটনৈতিক মিত্র এবং আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের মঞ্চ হিসেবে দেখছে। মেদভেদেভের বক্তব্য তাই কেবল ‘ভ্রাতৃত্ব’ নয়, বরং ‘রাজনৈতিক কৌশল’।
তবুও, পশ্চিমা বিশ্বকে এ নিয়ে স্বস্তিতে থাকার সুযোগ নেই। আফ্রিকায় তাদের দীর্ঘদিনের উন্নয়ন সহায়তা, মানবাধিকার বক্তৃতা, ও ঋণনীতি প্রায়শই দ্বিমুখী বলেই প্রতিভাত হয়েছে। যখন পশ্চিমারা মানবাধিকার শেখায়, অথচ কর্পোরেট দৃষ্টিভঙ্গিতে দেশ শোষণ করে, তখন তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হয়। এই বিশ্বাসঘাতকতার শূন্যস্থান পূরণ করতে চায় রাশিয়া।
পশ্চিমা দেশগুলোর উচিত শুধু রাশিয়ার সমালোচনা করা নয়, বরং একটি বাস্তবিক, ন্যায্য ও সহমর্মী অংশীদারিত্বের পথ তৈরি করা। উদাহরণস্বরূপÑআফ্রিকান ঋণ পুনর্গঠন, নিজস্ব শিল্প গড়ে তোলার সহায়তা, এবং শুধু রাষ্ট্রনায়কদের নয়, বরং নাগরিক সমাজকে সম্পৃক্ত করা।
আফ্রিকার জন্য সঠিক পথ পশ্চিম বা পূর্ব নয়Ñবরং কৌশলগত নিরপেক্ষতা। একাধিক অংশীদার থেকে লাভ আদায়ের দক্ষতা অর্জনই ভবিষ্যতের চাবিকাঠি। বহুমেরু বিশ্ব যদি সত্যিই পারস্পরিক সম্মান ও অন্তর্ভুক্তিতে গড়ে ওঠে, তবে তা হতে পারে মুক্তির পথ। কিন্তু যদি তা নতুন এক শাসনের মোড়কে পুরনো আধিপত্যবাদ হয়ে ওঠে, তাহলে তা হবে আরও একটি ব্যর্থতার নামান্তর।
মেদভেদেভের বক্তব্য বৃহত্তর ভূরাজনৈতিক পুনর্গঠনেরই প্রতিফলন। আফ্রিকা মহাদেশ এখনও উপনিবেশবাদীর ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছে, আর সেই প্রেক্ষাপটে ইতিহাস ও আদর্শকে হাতিয়ার করে নিজেকে ‘পছন্দের অংশীদার’ হিসেবে উপস্থাপন করছে রাশিয়া। তবে শুধু বক্তব্য দিয়ে দায় মুক্তি পাওয়া যায় না। এক সময়কার মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেয়া আন্দোলনগুলোÑযেগুলো এখন শাসকদলে রূপান্তরিতÑতাদেরই নির্ধারণ করতে হবে, রাশিয়া কেবল নতুন প্রণয়প্রার্থী, না কি একটি ভিন্ন ও বিকল্প পথের প্রস্তাবক। তাদের এই সিদ্ধান্তই নির্ধারণ করবে, বহুমেরুর বিশ্ব কি তাদের ক্ষমতায়নের পথ খুলে দেবে, নাকি তা হবে কেবল নতুন মুখোশে পুরোনো নির্ভরশীলতার আরেক সংস্করণ।
[ লেখক : প্রাবন্ধিক ]