কামরুজ্জামান
প্রতি বর্ষায় ব্যক্তিগত, প্রাতিষ্ঠানিক ও সরকারি উদ্যোগে দেশে ব্যাপকভাবে বৃক্ষরোপণ করা হয়। কিন্তু এত আয়োজনের পরও বনভূমি ও গাছপালা কমে যাচ্ছে। এর মূল কারণগুলো আমরা কমবেশি জানিÑবৃক্ষ নিধন, বনভূমি দখল, শিল্পায়ন, নগরায়ণ, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, বসতিগ্রহণ এবং সবচেয়ে বড় সমস্যাÑরোপিত বৃক্ষের যতœ না নেয়া। এসবের পাশাপাশি মাটি ও বায়ুদূষণ এবং বনভূমিতে লাগানো আগুনও বৃক্ষ হ্রাসের বড় কারণ।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বাড়ছে। এই সংকট মোকাবিলায় বৃক্ষরোপণ ও বন সংরক্ষণকে ঘিরে নতুন নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেও দরকার একটি কার্যকর সবুজ বিপ্লব। এ বিপ্লবের মূল কথাÑবনভূমি বাড়ানো, রোপিত বৃক্ষের পরিচর্যা নিশ্চিত করা এবং জনগণকে সচেতন করে পরিবেশ রক্ষায় উদ্বুদ্ধ করা।
সবুজ বিপ্লব মূলত কৃষিভিত্তিক একটি ধারণা ছিল, যার উদ্দেশ্য ছিল খাদ্য নিরাপত্তা ও টেকসই কৃষির প্রসার। আজকের দিনে সেই ধারণাকে সম্প্রসারিত করে পরিবেশ সুরক্ষার আন্দোলনে রূপান্তর করা প্রয়োজন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বৃক্ষরোপণের আন্দোলনকে সবুজ বিপ্লবে রূপ দেয়ার এখনই উপযুক্ত সময়।
বর্তমানে দেশের বনভূমি মোট ভূখ-ের মাত্র ৯ শতাংশ। অথচ পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় প্রয়োজন ২৫ শতাংশ বনভূমি। এই প্রেক্ষাপটে বর্ষা ঋতু বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এই সময় মাটি থাকে ভেজা ও উর্বরÑবৃক্ষরোপণের জন্য আদর্শ সময়। কিন্তু শুধু রোপণ করলেই হবে না, প্রয়োজন পরিচর্যা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা। তাই বৃক্ষরোপণের পাশাপাশি উচিত প্রতিটি চারা গাছের চারপাশে বেড়া দেয়া এবং নিয়মিত তদারকি করা। একটি কার্যকর স্লোগান হতে পারেÑচারা গাছ রোপণ করি, বেড়া নিশ্চিত করি।
বাংলাদেশের বনভূমি বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্তÑপাহাড়ি বনভূমি, পাতাঝরা বনভূমি, ম্যানগ্রোভ বন এবং সৃজিত বন। এদের প্রতিটির সংরক্ষণ প্রয়োজন আলাদা কৌশলে। পাহাড়ি ও ম্যানগ্রোভ বন প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অথচ এই বনাঞ্চলে অবৈধ দখল, গাছ কাটা ও দুর্নীতির কারণে ক্ষয় হচ্ছে। এসব কর্মকা-ে জড়িতদের চিহ্নিত করা এবং দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেয়া জরুরি।
বৃক্ষরোপণে গাছের প্রজাতি বেছে নেয়াও গুরুত্বপূর্ণ। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বিদেশি গাছের বদলে দেশীয় ফলদ ও ঔষধি গাছ রোপণের ওপর জোর দেয়া উচিত। এতে মাটির উর্বরতা রক্ষা পাবে, পুষ্টির জোগানও বাড়বে।
দেশজুড়ে বৃক্ষরোপণকে সামাজিক আন্দোলনে রূপ দিতে হবে। বেসরকারি ও সরকারি উদ্যোগে যত বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি হয়, তা যেন শুধুই আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ না থাকে। বৃক্ষ যেন শুধু লাগানো না হয়, বরং যতœ নেয়া হয় তার বেড়ে ওঠার প্রতিটি ধাপে। গাছ লাগানো এবং সুরক্ষার দায়িত্ব প্রত্যেক ব্যক্তিকে নিতে হবে। যদি ১৮ কোটির মধ্যে ১০ কোটি মানুষ একটি করে গাছ লাগিয়ে তার দায়িত্ব নেয়, তবে এক বছরেই পরিবেশে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সম্ভব।
বন বিভাগের জনবল ও সরঞ্জাম আধুনিকায়ন করতে হবে। প্রশিক্ষিত বাহিনী দিয়ে বন রক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। আগুন নেভানোর জন্য বনাঞ্চল সংলগ্ন এলাকায় ফায়ার স্টেশন গড়ে তোলাও সময়ের দাবি।
বৃক্ষরোপণ, সুরক্ষা ও নিধন রোধে প্রচার-প্রচারণা বাড়াতে হবে। স্থানীয় পর্যায়ে মানুষকে সচেতন করতে সেøাগান চালু করা যেতে পারে। যেসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান গাছে পেরেক ঠুকে বিজ্ঞাপন লাগায়, তাদের আইনের আওতায় আনা উচিত। গণমাধ্যমে নিয়মিত প্রচার চালিয়ে জনগণের মধ্যে সচেতনতা তৈরির কাজ আরও জোরদার করা দরকার।
পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বৃক্ষ আমাদের অক্সিজেনের ভা-ার। এই পৃথিবীকে বাসযোগ্য রাখতে হলে ব্যাপকভাবে বৃক্ষরোপণ ও সেগুলোর সুরক্ষা নিশ্চিত করতেই হবে। সবার অংশগ্রহণ ও সচেতনতায় একটি সফল সবুজ বিপ্লব সম্ভব।
[ লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ভূগোল বিভাগ, মুক্তিযোদ্ধা কলেজ, গাজীপুর ]
কামরুজ্জামান
শনিবার, ০২ আগস্ট ২০২৫
প্রতি বর্ষায় ব্যক্তিগত, প্রাতিষ্ঠানিক ও সরকারি উদ্যোগে দেশে ব্যাপকভাবে বৃক্ষরোপণ করা হয়। কিন্তু এত আয়োজনের পরও বনভূমি ও গাছপালা কমে যাচ্ছে। এর মূল কারণগুলো আমরা কমবেশি জানিÑবৃক্ষ নিধন, বনভূমি দখল, শিল্পায়ন, নগরায়ণ, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, বসতিগ্রহণ এবং সবচেয়ে বড় সমস্যাÑরোপিত বৃক্ষের যতœ না নেয়া। এসবের পাশাপাশি মাটি ও বায়ুদূষণ এবং বনভূমিতে লাগানো আগুনও বৃক্ষ হ্রাসের বড় কারণ।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বাড়ছে। এই সংকট মোকাবিলায় বৃক্ষরোপণ ও বন সংরক্ষণকে ঘিরে নতুন নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেও দরকার একটি কার্যকর সবুজ বিপ্লব। এ বিপ্লবের মূল কথাÑবনভূমি বাড়ানো, রোপিত বৃক্ষের পরিচর্যা নিশ্চিত করা এবং জনগণকে সচেতন করে পরিবেশ রক্ষায় উদ্বুদ্ধ করা।
সবুজ বিপ্লব মূলত কৃষিভিত্তিক একটি ধারণা ছিল, যার উদ্দেশ্য ছিল খাদ্য নিরাপত্তা ও টেকসই কৃষির প্রসার। আজকের দিনে সেই ধারণাকে সম্প্রসারিত করে পরিবেশ সুরক্ষার আন্দোলনে রূপান্তর করা প্রয়োজন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বৃক্ষরোপণের আন্দোলনকে সবুজ বিপ্লবে রূপ দেয়ার এখনই উপযুক্ত সময়।
বর্তমানে দেশের বনভূমি মোট ভূখ-ের মাত্র ৯ শতাংশ। অথচ পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় প্রয়োজন ২৫ শতাংশ বনভূমি। এই প্রেক্ষাপটে বর্ষা ঋতু বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এই সময় মাটি থাকে ভেজা ও উর্বরÑবৃক্ষরোপণের জন্য আদর্শ সময়। কিন্তু শুধু রোপণ করলেই হবে না, প্রয়োজন পরিচর্যা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা। তাই বৃক্ষরোপণের পাশাপাশি উচিত প্রতিটি চারা গাছের চারপাশে বেড়া দেয়া এবং নিয়মিত তদারকি করা। একটি কার্যকর স্লোগান হতে পারেÑচারা গাছ রোপণ করি, বেড়া নিশ্চিত করি।
বাংলাদেশের বনভূমি বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্তÑপাহাড়ি বনভূমি, পাতাঝরা বনভূমি, ম্যানগ্রোভ বন এবং সৃজিত বন। এদের প্রতিটির সংরক্ষণ প্রয়োজন আলাদা কৌশলে। পাহাড়ি ও ম্যানগ্রোভ বন প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অথচ এই বনাঞ্চলে অবৈধ দখল, গাছ কাটা ও দুর্নীতির কারণে ক্ষয় হচ্ছে। এসব কর্মকা-ে জড়িতদের চিহ্নিত করা এবং দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেয়া জরুরি।
বৃক্ষরোপণে গাছের প্রজাতি বেছে নেয়াও গুরুত্বপূর্ণ। পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বিদেশি গাছের বদলে দেশীয় ফলদ ও ঔষধি গাছ রোপণের ওপর জোর দেয়া উচিত। এতে মাটির উর্বরতা রক্ষা পাবে, পুষ্টির জোগানও বাড়বে।
দেশজুড়ে বৃক্ষরোপণকে সামাজিক আন্দোলনে রূপ দিতে হবে। বেসরকারি ও সরকারি উদ্যোগে যত বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি হয়, তা যেন শুধুই আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ না থাকে। বৃক্ষ যেন শুধু লাগানো না হয়, বরং যতœ নেয়া হয় তার বেড়ে ওঠার প্রতিটি ধাপে। গাছ লাগানো এবং সুরক্ষার দায়িত্ব প্রত্যেক ব্যক্তিকে নিতে হবে। যদি ১৮ কোটির মধ্যে ১০ কোটি মানুষ একটি করে গাছ লাগিয়ে তার দায়িত্ব নেয়, তবে এক বছরেই পরিবেশে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সম্ভব।
বন বিভাগের জনবল ও সরঞ্জাম আধুনিকায়ন করতে হবে। প্রশিক্ষিত বাহিনী দিয়ে বন রক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। আগুন নেভানোর জন্য বনাঞ্চল সংলগ্ন এলাকায় ফায়ার স্টেশন গড়ে তোলাও সময়ের দাবি।
বৃক্ষরোপণ, সুরক্ষা ও নিধন রোধে প্রচার-প্রচারণা বাড়াতে হবে। স্থানীয় পর্যায়ে মানুষকে সচেতন করতে সেøাগান চালু করা যেতে পারে। যেসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান গাছে পেরেক ঠুকে বিজ্ঞাপন লাগায়, তাদের আইনের আওতায় আনা উচিত। গণমাধ্যমে নিয়মিত প্রচার চালিয়ে জনগণের মধ্যে সচেতনতা তৈরির কাজ আরও জোরদার করা দরকার।
পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় বৃক্ষ আমাদের অক্সিজেনের ভা-ার। এই পৃথিবীকে বাসযোগ্য রাখতে হলে ব্যাপকভাবে বৃক্ষরোপণ ও সেগুলোর সুরক্ষা নিশ্চিত করতেই হবে। সবার অংশগ্রহণ ও সচেতনতায় একটি সফল সবুজ বিপ্লব সম্ভব।
[ লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ভূগোল বিভাগ, মুক্তিযোদ্ধা কলেজ, গাজীপুর ]