বাবুল রবিদাস
বাংলা ভাষায় ‘অলৌকিক’ শব্দটি সাধারণত এমন কিছু ঘটনার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়, যা আমাদের স্বাভাবিক অভিজ্ঞতা ও বৈজ্ঞানিক যুক্তির সীমা ছাড়িয়ে যায়। এর ইংরেজি প্রতিশব্দ সুপার ন্যাচারাল বা প্যারানরমাল। পক্ষান্তরে ‘লৌকিক’ শব্দটি র্যাশনাল, লজিক্যাল বা ন্যাচারাল অর্থে ব্যবহৃত হয়, যা বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে ব্যাখ্যা করা যায়।
অনেক সময়ই আমরা কোনো ঘটনার প্রাকৃতিক ব্যাখ্যা খুঁজে না পেলে সেটিকে অলৌকিক বলে ধরে নিই; কিন্তু বিজ্ঞানের আলোয় অনুসন্ধান চালালে দেখা যায়, অলৌকিক বলে মনে হওয়া ঘটনাগুলোর পেছনেও রয়েছে বাস্তব, লৌকিক ব্যাখ্যা। অলৌকিকতায় বিশ্বাস অনেক সময় জন্ম নেয় সমাজে প্রচলিত কুসংস্কার, ভ্রান্ত শিক্ষা এবং মানসিক বিভ্রান্তির ফলে। কিছু মানুষ অতিপ্রাকৃত অভিজ্ঞতা বা অলৌকিক অনুভূতির দাবি করে থাকেন, কিন্তু সেটি হতে পারে একধরনের বিভ্রান্তি বা মনস্তাত্ত্বিক প্রতিক্রিয়া।
এই প্রসঙ্গে আমাদের তিনটি মানসিক অবস্থার কথা জানতে হবেÑ বিভ্রম, মতিভ্রম এবং ভ্রান্ত অন্ধবিশ্বাস।
ভ্রমাত্মক অনুভূতি বা বিভ্রম হলো ইন্দ্রিয়ের এমন এক বিকৃতি, যেখানে বাস্তবতাকে ভুলভাবে অনুভব করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, মাটিতে পড়ে থাকা দড়িকে সাপ মনে করা কিংবা ছায়াকে ভূত ভাবা। চোখের আলো প্রবেশের তারতম্য বা মস্তিষ্কের ত্রুটির কারণে এমন বিভ্রম ঘটে থাকে। ম্যাজিশিয়ানরা ইচ্ছাকৃতভাবে এই বিভ্রম সৃষ্টি করে মানুষকে তাক লাগিয়ে দেন।
মতিভ্রম বা হ্যালুসিনেশন হলো এমন এক অনুভব, যা বাস্তবে অস্তিত্বহীন। কেউ গলায় শব্দ শুনতে পান অথচ আশপাশে কেউ নেই, কিংবা নিস্প্রাণ বস্তুকে জীবন্ত মনে করেন। যেমন কেউ মনে করছেন তালগাছের মতো বড় এক দৈত্য সামনে দাঁড়িয়ে আছে বা ফোনের তার ছেঁড়া থাকার পরেও প্রিয়জনের কণ্ঠ শুনতে পাচ্ছেন। এটি ইন্দ্রিয়ের স্বাভাবিক কার্যক্রমে বিঘœ ঘটার ফলে ঘটে থাকে।
ভ্রান্ত অন্ধবিশ্বাস হলো এমন এক দৃঢ়বিশ্বাস, যা প্রমাণ ও যুক্তির মুখে পড়েও বদলায় না। কেউ যদি বিশ্বাস করেনÑ মন্ত্র পড়ে সাপ মারা যায়, বা গভীর সাধনায় ‘মা মখিনী’ দেখা দেনÑ তবে সেটিকে ডেলুশন বলা হয়। ভ্রান্ত বিশ্বাসীরা সাধারণত তাদের এই অভিজ্ঞতাগুলোকে আধ্যাত্মিক রূপ দিয়ে বাস্তব বলে বিশ্বাস করতে শুরু করেন। এই বিশ্বাস এতটাই দৃঢ় হয় যে, বিজ্ঞানের তথ্যপ্রমাণ দিয়েও সেটি ভাঙা কঠিন।
অন্ধবিশ্বাস থেকে জন্ম নেওয়া মতিভ্রম সমাজে ভয়ানক পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে পারে। যেমন- ভারতের বিহার রাজ্যে কালো জাদুর অভিযোগে এক পরিবারের পাঁচজনকে পিটিয়ে ও পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে। এ ধরনের ঘটনা বিভ্রান্তি থেকে জন্ম নেয় এবং সামাজিক বিপর্যয় ডেকে আনে।
আধুনিক যুগে বিজ্ঞানের বিস্ময়কর আবিষ্কার আমাদের পুরোনো বহু ভ্রান্ত ধারণার অবসান ঘটিয়েছে। একসময় আমরা ভাবতাম সূর্য উঠে আবার অস্ত যায়, কিন্তু বিজ্ঞান জানায়Ñ পৃথিবীই সূর্যের চারপাশে ঘোরে। এমনকি চাঁদে খরগোশ আছে, কিংবা বুড়ি চরকায় সুতো কাটেÑ এই বিশ্বাসগুলোকেও আমরা বিজ্ঞান দিয়ে অস্বীকার করতে শিখেছি।
বিশ্বাস হচ্ছে যাচাই-বিহীন জ্ঞান। সমাজে প্রচলিত কুসংস্কার, ম্যাজিক, টেলিপ্যাথি, দিব্যদৃষ্টি, গুণিন, ওঝা কিংবা নানা ধরনের তথাকথিত অলৌকিকতা আসলে আমাদের সীমিত বোধশক্তির ব্যাখ্যাহীন চিত্র। এগুলোর সবকিছুর পেছনেই রয়েছে জনসাধারণের অজ্ঞাত, কিন্তু লৌকিক কারণ।
তাই সমাজ থেকে কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস দূর করতে হলে চাই জ্ঞান, বিজ্ঞান এবং যুক্তিভিত্তিক চিন্তাচর্চা। কবি নজরুল বলেছিলেনÑ ‘থাকবো নাকো বদ্ধ ঘরে, দেখবো এবার জগতটাকে’। আমরাও এই মনোভাব গ্রহণ করে বিজ্ঞানসম্মত ও প্রগতিশীল চিন্তার সমাজ গড়ে তুলতে পারি।
বিশ্বে এখন প্রায় ১৯০ কোটি মানুষ কোনো ধর্মে বিশ্বাসী নয়। পিউ রিসার্চ সেন্টারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছেÑ পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় ২৪ শতাংশ মানুষ নাস্তিক বা ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তায় বিশ্বাসী। এ সংখ্যাই প্রমাণ করে, মানুষ অলৌকিকতার মোহ কাটিয়ে যুক্তির পথে হাঁটছে।
অলৌকিকতার নামে যে বিভ্রান্তি সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে, তা লৌকিক ব্যাখ্যার মধ্য দিয়েই নির্মূল করা সম্ভব। আমাদের প্রয়োজন সচেতনতা, বিজ্ঞানমনস্কতা এবং প্রশ্ন করার সাহস। অজ্ঞতার অন্ধকারে নয়, যুক্তি ও জ্ঞানের আলোয় সমাজকে আলোকিত করাই হোক আমাদের লক্ষ্য।
[লেখক : আইনজীবী, জজ কোর্ট, জয়পুরহাট]
বাবুল রবিদাস
শনিবার, ০২ আগস্ট ২০২৫
বাংলা ভাষায় ‘অলৌকিক’ শব্দটি সাধারণত এমন কিছু ঘটনার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়, যা আমাদের স্বাভাবিক অভিজ্ঞতা ও বৈজ্ঞানিক যুক্তির সীমা ছাড়িয়ে যায়। এর ইংরেজি প্রতিশব্দ সুপার ন্যাচারাল বা প্যারানরমাল। পক্ষান্তরে ‘লৌকিক’ শব্দটি র্যাশনাল, লজিক্যাল বা ন্যাচারাল অর্থে ব্যবহৃত হয়, যা বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে ব্যাখ্যা করা যায়।
অনেক সময়ই আমরা কোনো ঘটনার প্রাকৃতিক ব্যাখ্যা খুঁজে না পেলে সেটিকে অলৌকিক বলে ধরে নিই; কিন্তু বিজ্ঞানের আলোয় অনুসন্ধান চালালে দেখা যায়, অলৌকিক বলে মনে হওয়া ঘটনাগুলোর পেছনেও রয়েছে বাস্তব, লৌকিক ব্যাখ্যা। অলৌকিকতায় বিশ্বাস অনেক সময় জন্ম নেয় সমাজে প্রচলিত কুসংস্কার, ভ্রান্ত শিক্ষা এবং মানসিক বিভ্রান্তির ফলে। কিছু মানুষ অতিপ্রাকৃত অভিজ্ঞতা বা অলৌকিক অনুভূতির দাবি করে থাকেন, কিন্তু সেটি হতে পারে একধরনের বিভ্রান্তি বা মনস্তাত্ত্বিক প্রতিক্রিয়া।
এই প্রসঙ্গে আমাদের তিনটি মানসিক অবস্থার কথা জানতে হবেÑ বিভ্রম, মতিভ্রম এবং ভ্রান্ত অন্ধবিশ্বাস।
ভ্রমাত্মক অনুভূতি বা বিভ্রম হলো ইন্দ্রিয়ের এমন এক বিকৃতি, যেখানে বাস্তবতাকে ভুলভাবে অনুভব করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, মাটিতে পড়ে থাকা দড়িকে সাপ মনে করা কিংবা ছায়াকে ভূত ভাবা। চোখের আলো প্রবেশের তারতম্য বা মস্তিষ্কের ত্রুটির কারণে এমন বিভ্রম ঘটে থাকে। ম্যাজিশিয়ানরা ইচ্ছাকৃতভাবে এই বিভ্রম সৃষ্টি করে মানুষকে তাক লাগিয়ে দেন।
মতিভ্রম বা হ্যালুসিনেশন হলো এমন এক অনুভব, যা বাস্তবে অস্তিত্বহীন। কেউ গলায় শব্দ শুনতে পান অথচ আশপাশে কেউ নেই, কিংবা নিস্প্রাণ বস্তুকে জীবন্ত মনে করেন। যেমন কেউ মনে করছেন তালগাছের মতো বড় এক দৈত্য সামনে দাঁড়িয়ে আছে বা ফোনের তার ছেঁড়া থাকার পরেও প্রিয়জনের কণ্ঠ শুনতে পাচ্ছেন। এটি ইন্দ্রিয়ের স্বাভাবিক কার্যক্রমে বিঘœ ঘটার ফলে ঘটে থাকে।
ভ্রান্ত অন্ধবিশ্বাস হলো এমন এক দৃঢ়বিশ্বাস, যা প্রমাণ ও যুক্তির মুখে পড়েও বদলায় না। কেউ যদি বিশ্বাস করেনÑ মন্ত্র পড়ে সাপ মারা যায়, বা গভীর সাধনায় ‘মা মখিনী’ দেখা দেনÑ তবে সেটিকে ডেলুশন বলা হয়। ভ্রান্ত বিশ্বাসীরা সাধারণত তাদের এই অভিজ্ঞতাগুলোকে আধ্যাত্মিক রূপ দিয়ে বাস্তব বলে বিশ্বাস করতে শুরু করেন। এই বিশ্বাস এতটাই দৃঢ় হয় যে, বিজ্ঞানের তথ্যপ্রমাণ দিয়েও সেটি ভাঙা কঠিন।
অন্ধবিশ্বাস থেকে জন্ম নেওয়া মতিভ্রম সমাজে ভয়ানক পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে পারে। যেমন- ভারতের বিহার রাজ্যে কালো জাদুর অভিযোগে এক পরিবারের পাঁচজনকে পিটিয়ে ও পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে। এ ধরনের ঘটনা বিভ্রান্তি থেকে জন্ম নেয় এবং সামাজিক বিপর্যয় ডেকে আনে।
আধুনিক যুগে বিজ্ঞানের বিস্ময়কর আবিষ্কার আমাদের পুরোনো বহু ভ্রান্ত ধারণার অবসান ঘটিয়েছে। একসময় আমরা ভাবতাম সূর্য উঠে আবার অস্ত যায়, কিন্তু বিজ্ঞান জানায়Ñ পৃথিবীই সূর্যের চারপাশে ঘোরে। এমনকি চাঁদে খরগোশ আছে, কিংবা বুড়ি চরকায় সুতো কাটেÑ এই বিশ্বাসগুলোকেও আমরা বিজ্ঞান দিয়ে অস্বীকার করতে শিখেছি।
বিশ্বাস হচ্ছে যাচাই-বিহীন জ্ঞান। সমাজে প্রচলিত কুসংস্কার, ম্যাজিক, টেলিপ্যাথি, দিব্যদৃষ্টি, গুণিন, ওঝা কিংবা নানা ধরনের তথাকথিত অলৌকিকতা আসলে আমাদের সীমিত বোধশক্তির ব্যাখ্যাহীন চিত্র। এগুলোর সবকিছুর পেছনেই রয়েছে জনসাধারণের অজ্ঞাত, কিন্তু লৌকিক কারণ।
তাই সমাজ থেকে কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস দূর করতে হলে চাই জ্ঞান, বিজ্ঞান এবং যুক্তিভিত্তিক চিন্তাচর্চা। কবি নজরুল বলেছিলেনÑ ‘থাকবো নাকো বদ্ধ ঘরে, দেখবো এবার জগতটাকে’। আমরাও এই মনোভাব গ্রহণ করে বিজ্ঞানসম্মত ও প্রগতিশীল চিন্তার সমাজ গড়ে তুলতে পারি।
বিশ্বে এখন প্রায় ১৯০ কোটি মানুষ কোনো ধর্মে বিশ্বাসী নয়। পিউ রিসার্চ সেন্টারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছেÑ পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় ২৪ শতাংশ মানুষ নাস্তিক বা ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তায় বিশ্বাসী। এ সংখ্যাই প্রমাণ করে, মানুষ অলৌকিকতার মোহ কাটিয়ে যুক্তির পথে হাঁটছে।
অলৌকিকতার নামে যে বিভ্রান্তি সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে, তা লৌকিক ব্যাখ্যার মধ্য দিয়েই নির্মূল করা সম্ভব। আমাদের প্রয়োজন সচেতনতা, বিজ্ঞানমনস্কতা এবং প্রশ্ন করার সাহস। অজ্ঞতার অন্ধকারে নয়, যুক্তি ও জ্ঞানের আলোয় সমাজকে আলোকিত করাই হোক আমাদের লক্ষ্য।
[লেখক : আইনজীবী, জজ কোর্ট, জয়পুরহাট]