আনোয়ারুল হক
কপালে বাঁধা ‘সবুজ জমিনে লাল সূর্যের পতাকাকে’ রণসজ্জা বানিয়ে আর ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসির’ জাতীয় সঙ্গীতকে রণসঙ্গীতে পরিণত করে যারা রাজপথ কাঁপিয়েছিলেন সেই লাখো লাখো তরুণরাই বিজয় উল্লাসে গেয়ে ওঠেনÑ ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি...’
মেঘ থম থম করে / জল থৈ থৈ করে কিছু নেই নেই / ভাঙ্গনের যে নেই পারাপার / তুমি আমি সব একাকার...।
ভুপেন হাজারিকার লেখা ও গাওয়া অসাধারণ এবং ঐতিহাসিক এই গানটির কথা সবাই জানেন। ১৯৭৭ সালে মুক্তি পাওয়া আলমগীর কবীর পরিচালিত ‘সীমানা পেরিয়ে’ ছবির জন্য তৈরি হয়েছিল এই গানটি। রক্ত, অশ্রু, বীরত্বগাথা আর বিজয়োল্লাসের জুলাই জাগরণের সাথে যেন এ গানের ভাবার্থ মিলে যায় আবার এক বছর পরে আজ সেই জাগরণের যে পরিস্থিতি তার সাথেও মিলে একাকার।
‘মেঘ থম থম করে’Ñ কথাটি এক ঝড় উঠার ইঙ্গিত দেয়। এটি জীবনের বিষাদ এবং আসন্ন পরিবর্তনের পূর্বাভাসকেও তুলে ধরে। গানে জীবনের এক গভীর উপলব্ধিকে তুলে ধরে এটা বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে যে, মানুষ বিপর্যয়ের মাঝেও শান্তি ও একাত্মতা খুঁজে বেড়ায়। সবকিছু ভেঙে চুরমার হয়ে গেলেও মানুষ যে একে-অপরের সাথে মিশে যেতে চায়, সেই আকাক্সক্ষাটিও গানটিতে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। ‘চোখ ছল ছল করে’ শুধুমাত্র চোখের জল ফেলা নয়, এটি মনের গভীর অনুভূতির প্রতিচ্ছবি। এটি মানুষের ভেতরের আবেগগুলোকে বাইরে প্রকাশ করার একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।
২০২৪-এর জুলাইয়ের কোটা আন্দোলনকে শুরুতে নিরীহ আন্দোলনই মনে হয়েছিল। কিন্তু যেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে আন্দোলনকারীদের ওপর হেলমেট লীগের বর্বরোচিত হামলা এবং হামলায় আহত ছাত্রীদের রক্তাক্ত চেহারা বারবার টিভির পর্দায় ভেসে উঠতে লাগলো এবং হামলাকারীদের এক বিভৎস কুৎসিত রূপ সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে ছড়িয়ে পড়লো তখনই মনে হলো ‘মেঘ থম থম করে’। তা আরো নিশ্চিত করলেন দু হাত প্রসারিত করে দাঁড়ানো একের পর এক গুলিতে বিদ্ধ আবু সাইদÑ যেন ‘বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়’। এরপর থেকে পানিওয়ালা মুগ্ধের গুলিবিদ্ধ ছবি, রিকশার পাদানিতে রাখা গুলি বিদ্ধ গোলাম নাফিজ কিংবা গুলিতে এক চোখের কর্নিয়া ও আর এক চোখের রেটিনা ফেটে যাওয়া নরসিংদীর ছাত্র মোজাম্মেল হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে যখন বলে ‘অন্তত একটা চোখ যদি ভালো থাকতো পরীক্ষা দিতে পারতাম’ অথবা হেলিকপ্টার থেকে গুলি করে শিশু হত্যার ছবি দেখে ‘চোখ ছলছল করে’ জেগে ওঠল গোটা বাংলাদেশ।
স্বৈরাচার পতনের একদফা আন্দোলনে অকুতভয় সাধারণ ছাত্র ছাত্রীরা এবং ক্ষেত্র বিশেষে শ্রমজীবী তরুণরা বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো রাজপথে নেমে এলো। শিক্ষক, অভিভাবকরাও ছাত্রদের পাশে দাঁড়ালেন। এক যুগেরও বেশি সময় যাবত গণতন্ত্রহীনতায় মানুষের মাঝে জন্ম নেয়া ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটলো। প্রতিটি মৃত্যু আন্দোলনকে আরো শক্তিশালী করে তুললো। বুলেট আর বুটের তলায় পিষ্ট ছাত্র জনতা জীবনকে ভালোবাসবে বলে জীবন বিলিয়ে দেয়ার এক ইতিহাস সৃষ্টি করলো। শেখ হাসিনার শাসন দীর্ঘায়িত হলে আমাদের সন্তানেরা আরো বিপুল সংখ্যায় মারা পড়বেÑ শুধু এই এক যুক্তিতেও আওয়ামী সরকারের প্রতি নমনীয় বা সমর্থক বিরাট সংখ্যক মানুষও সরকারের বিদায় কামনা করেন।
অভ্যুত্থান বিজয় অর্জনের মধ্য দিয়ে হলো এক নতুন ভোরের সূচনা। ‘রাত ঘুম ঘুম ঘোরে জাগে ঐ/রোদ ঝলমল করে দেখ ঐ / ঝড়ো হাওয়া ভেঙ্গে দিলো মিথ্যে তাসের ঘর’। কপালে বাঁধা ‘সবুজ জমিনে লাল সূর্যের পতাকাকে’ রণসজ্জা বানিয়ে আর ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসির’ জাতীয় সঙ্গীতকে রণসঙ্গীতে পরিনত করে যারা রাজপথ কাঁপিয়েছিলেন সেই লাখো লাখো তরুণরাই বিজয় উল্লাসে গেয়ে ওঠেন, ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি...’।
কিন্তু ভোরটা সকাল হতে না হতেই এবং বিজয়ী ছাত্র জনতা ঘরে ফিরতেই দেয়ালে দেয়ালে আঁকা স্বপ্নগুলো ফিকে হতে শুরু করলো। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে, হানাদার বাহিনীর গণহত্যা, বুদ্ধিজীবী হত্যা, সংখ্যালঘু নিধন, নারী ধর্ষণসহ সকল অপরাধের সহযোগী রাজনৈতিক শক্তি সমূহ ছাত্র সমন্বয়কদের একাংশের কাঁধে ভর করে অনেকটা গাজীর বেশে হাজির হলো। তারা মুছে ফেলতে লাগলো একের পর এক মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি। বিভাজনের এক শক্তিকে বিদায় করার পর হিংস্র এবং উন্মত্ত চেহারা নিয়ে নতুন এক বিভাজনের শক্তি আবির্ভূত হলো অন্তর্বর্তী সরকারের প্রচ্ছন্ন সমর্থন বা সহায়তায়। স্বৈরতন্ত্রের বদলে মবতন্ত্র, মামলাতন্ত্র, নব্য চাঁদাবাজতন্ত্র তথা সমন্বয়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার এক অবিরাম প্রচেষ্টা শুরু হলো। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে উগ্রবাদী শক্তির কর্মকা-ে পতিত স্বৈরাচারের পরিবর্তিত রূপ দেখে, বিরামহীন দখলবাজি চাঁদাবাজি দেখে আন্দোলনে শামিল ছাত্র জনতা নিজেদের গুটিয়ে নিলো।
অন্যদিকে গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পরও শেখ হাসিনা, তার দল বা কর্মী-সমর্থকের মধ্যে কোনো অনুতাপ-অনুশোচনা নেই। আন্দোলন দমনে যে নিষ্ঠুরতার পরিচয় শেখ হাসিনা দিলেন তা কি কোনো সুস্থ মানুষ দিতে পারে? তার কাছে যদি গোয়েন্দা তথ্য থেকেও থাকে যে আন্দোলনকারীদের নেতৃত্বের মাঝে নাশকতা সৃষ্টিকারী গোষ্ঠীও রয়েছে তারপরেও কি রাজপথে নেমে আসা লক্ষ লক্ষ সাধারণ ছাত্রছাত্রী, তরুণ-তরুণীর বিরুদ্ধে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দেয়া যায়? হেলিকপ্টার থেকে গুলি করার নির্দেশ দেয়া যায়? আর সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারীদের নির্বিচার গুলি চালিয়ে হত্যা করা হলে, সুযোগ পেলে কোন দেশে সরকারি স্থাপনায় হামলা হয় না? আমাদের দেশে ’৬৯ বা ’৯০-এ গণঅভ্যুত্থানে হয়নি? আমার তো আজও চোখের সামনে ভাসে খুলনায় ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের মিছিলকে ছত্রভঙ্গ করতে যখন গুলি চালানো হলো এবং গুলিবিদ্ধ হাদিস শহীদ হলেন, বিক্ষুদ্ধ ছাত্র জনতা তৎকালীন এসডিও কাউতের সরকারি বাসভবন আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয় এবং পুলিশ বাহিনী দূরে সরে যেতে বাধ্য হয়। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ হয়নি? প্রায় দশ বছরের সেই আন্দোলনে কতজন শহীদ হয়েছেন? কিন্তু ২০২৪-এ যে নৃশংসতা দেখানো হলো তার সুনির্দিষ্ট প্রমাণ তার নিজের কেনা ‘পেগাসাস’ থেকেই বের হচ্ছে; যা তাকে ও তার দলকে বিচারের মুখোমুখি করেছে এবং এক গভীর অনিশ্চয়তার গিরীখাদে ফেলে দিয়েছে। এত কিছুর পরেও তারা আগের রূপেই ফিরতে চান!
পতিত শক্তি না হয় দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে যা খুশি করছে।কিন্তু অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারীরা এবং অন্তর্বর্তী সরকার কোন পথে? শহুরে মধ্যবিত্ত ও তরুণ এক্টিভিস্টদের একাংশ এবারের অভ্যুত্থানের মাঝে বিপ্লবী রূপান্তরের এক ইউটোপীয় সম্ভাবনা দেখছিলেন। কিন্তু সাধারণ ছাত্র জনতা নিজ নিজ বোধের জায়গা থেকে লড়াই করেছে, সুনির্দিষ্ট কোনো রাজনৈতিক শক্তি বা কোনো মাস্টার মাইন্ডের ডাকেই যে সব ধরনের মানুষ জুলাইয়ের আন্দোলনে নেমেছিল এমনটা নয়। সমন্বয়কদেরও কেউ এমন ক্যারিশম্যাটিক ছিলেন না যে তাদের ডাকে তাদের ছাত্র সংগঠন ও কোটা বিরোধী আন্দোলনের কর্মীরা ছাড়া সাধারণ ছাত্র ও মানুষ রাজপথে নেমে এসেছিলেন। মানুষ শুধুমাত্র ছাত্র আন্দোলনকারী নেতৃত্বের মাধ্যমে কর্মসূচি জেনেছে এবং সেটাই অনুসরন করেছে। আবার যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খালি করে দেওয়া হয়েছে, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্র ছাত্রীরা ‘ফেলো ফিলিংস’ থেকে এবং নির্মম হত্যাকা-ের প্রতিবাদে রাজপথে নেমে এসেছে, আন্দোলনকে পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছে। সুতরাং এ আন্দোলনে কারোই ‘মুই কি হনুরে’ ভাবার সুযোগ নেই। যদিও অনেকেই তা ভেবে ধরাকে সরা জ্ঞান করছেন। একদিকে মুখে বিপ্লবী বুলি অন্যদিকে ‘কোটি টাকার নিচে নাকি কোনো কথা নেই’।
স্বৈরাচারী শাসকের পরিবর্তনের এক দফা ছাড়া কোনো মূর্ত রাজনৈতিক এজেন্ডা মানুষের সামনে ছিলো না। বিমূর্ত নানা আকাংখা নানা মানুষের মাঝে বা সমন্বয়কদের মধ্যে থাকতে পারে। কিন্তু সে সব আকাক্সক্ষা সার্বজনীন হয়ে ওঠেনি। এমনকি আন্দোলনের দিনগুলোতেও উচ্চারিত হয়নি। পুরনো ব্যবস্থাকে বদল করে সমাজের আমুল পরিবর্তন করার মতো কোনো বিপ্লব বা অভ্যুত্থান দেশে হয়নি। সেটার জন্য প্রয়োজন আরো দীর্ঘ সংগ্রাম, আরো দীর্ঘ পথ হাঁটা। ক্ষমতার অলিন্দের বাইওে থেকে দীর্ঘ পথ হাঁটতে ছাত্র সমন্বয়করা বা নতুন দলের নেতারা রাজি নন। জুলাই ঘোষণা বা সনদ যাই বলা হোক না কেনো মূল লক্ষ্য ক্ষমতা বা ক্ষমতার অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দুনিয়ার সাথে আগে থেকেই হাসিনা সরকারের এক ধরনের বৈরীতা ছিল। এ অভ্যুত্থানের আগে থেকেই লীগ বিরোধী নানা শক্তির সাথে তারা সংযোগ রাখছিলো। সুতরাং একদিকে তাদের ডিপস্টেট এবং অন্যদিকে দেশের সিভিল মিলিটারি বুরোক্রেসি রাষ্ট্র কাঠামোয় তাদের ‘স্টেক’ বড় করতে এ ধরনের অভ্যুত্থানে ভূমিকা রাখতে চাইবে, এটাই স্বাভাবিক। সব মিলিয়ে ক্ষমতার কাঠামোতে একাধিক টিম। তাদের নানা মত, নানা পথ। শেষ পর্যন্ত কি ঘটবে বলা মুশকিল একমাত্র উপদেষ্টা আসিফ নজরুল অলরাউন্ডার হিসেবে সব টিমেই খেলে থাকেন। হয়তো বা তার জানা থাকতে পারে!
এ ধরনের এক জটিল পরিস্থিতিতেই পালিত হচ্ছে জুলাই অভ্যুত্থানের বার্ষিকী। অভ্যুত্থানের প্রধান আকাক্সক্ষা গণতন্ত্রে উত্তরণ যত বিলম্বিত হচ্ছে তত বেশি করে বিভ্রান্তি ও ছন্দ পতন হচ্ছে। তত বেশি করে এক মুক্ত মানবিক বৈষম্যমুক্ত সমাজ বিনির্মানের আকাংখার বিপরীতে প্রতিক্রিয়াশীল পুনর্নির্মাণের আশঙ্কা সৃষ্টি হচ্ছে। দেশের সংবিধানের মর্মবস্তু পাল্টে দেওয়ার অশুভ শক্তি, নারীকে সমঅধিকার দেওয়ার বিপরীতে পর্দার আড়ালে রাখার শক্তি এবং ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু বিদ্বেষী শক্তি মাথায় ‘সবুজ জমিনে লাল সূর্যের পতাকার’ পট্টি বেঁধে অভিনয় করছে এবং মানুষকে বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলে দিয়ে কোশেস করছে পাকিস্তানি চাঁদ তারা মার্কা পতাকার আদর্শ প্রতিষ্ঠার। তাদের এই প্রতিক্রিয়াশীল পুনর্নিমানের প্রচেষ্টায় বন্ধু হিসাবে নতুন দলের ও অন্তর্বর্তী সরকারের একাংশের প্রচ্ছন্ন সমর্থন পেয়ে তারা হয়ে উঠছে বেপরোয়া।
এসব কারণেই আবার গুমোট পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। অভ্যুত্থানের শক্তিগুলোর মধ্যে নানা বিষয়ে অনৈক্য তৈরি হয়েছে। শেখ হাসিনার বিএনপি জামায়াত শিবির জুজুর মতো ড. ইউনূসও বেকায়দায় পড়লেই পতিত শক্তির জুজুর ভয় দেখিয়ে সবাইকে বশে রাখতে চান। তাহলে কি ভুল হাতে পড়ে গেলো জুলাই অভ্যুত্থান! যদি তা ভুল হাতে পড়েও যদি ঘটে উল্টো যাত্রা তার পরেও ছাত্র তরুণরা যেভাবে দলে দলে নেমে এসেছিল রাজপথের লড়াইয়ের ময়দানে সে লড়াই কোনদিন খাটো হবে না। যদিও শুধুমাত্র আন্দোলনই নয় পর্দার আড়ালের নানা কূটকৌশলের কাছেও হাসিনাকে হার মানতে হয়। তারপরেও জুলাই আন্দোলনে মানুষের যে আত্মদান তার মাহাত্ম্যও কখনই কমবে না; কিন্তু বছর পার না হতেই যে আবার ‘মেঘ থম থম করে’! আসলেই কি ‘ভাঙ্গনের নেই পারাপার!’
[লেখক : সাবেক ছাত্র নেতা]
আনোয়ারুল হক
কপালে বাঁধা ‘সবুজ জমিনে লাল সূর্যের পতাকাকে’ রণসজ্জা বানিয়ে আর ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসির’ জাতীয় সঙ্গীতকে রণসঙ্গীতে পরিণত করে যারা রাজপথ কাঁপিয়েছিলেন সেই লাখো লাখো তরুণরাই বিজয় উল্লাসে গেয়ে ওঠেনÑ ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি...’
রোববার, ০৩ আগস্ট ২০২৫
মেঘ থম থম করে / জল থৈ থৈ করে কিছু নেই নেই / ভাঙ্গনের যে নেই পারাপার / তুমি আমি সব একাকার...।
ভুপেন হাজারিকার লেখা ও গাওয়া অসাধারণ এবং ঐতিহাসিক এই গানটির কথা সবাই জানেন। ১৯৭৭ সালে মুক্তি পাওয়া আলমগীর কবীর পরিচালিত ‘সীমানা পেরিয়ে’ ছবির জন্য তৈরি হয়েছিল এই গানটি। রক্ত, অশ্রু, বীরত্বগাথা আর বিজয়োল্লাসের জুলাই জাগরণের সাথে যেন এ গানের ভাবার্থ মিলে যায় আবার এক বছর পরে আজ সেই জাগরণের যে পরিস্থিতি তার সাথেও মিলে একাকার।
‘মেঘ থম থম করে’Ñ কথাটি এক ঝড় উঠার ইঙ্গিত দেয়। এটি জীবনের বিষাদ এবং আসন্ন পরিবর্তনের পূর্বাভাসকেও তুলে ধরে। গানে জীবনের এক গভীর উপলব্ধিকে তুলে ধরে এটা বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে যে, মানুষ বিপর্যয়ের মাঝেও শান্তি ও একাত্মতা খুঁজে বেড়ায়। সবকিছু ভেঙে চুরমার হয়ে গেলেও মানুষ যে একে-অপরের সাথে মিশে যেতে চায়, সেই আকাক্সক্ষাটিও গানটিতে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। ‘চোখ ছল ছল করে’ শুধুমাত্র চোখের জল ফেলা নয়, এটি মনের গভীর অনুভূতির প্রতিচ্ছবি। এটি মানুষের ভেতরের আবেগগুলোকে বাইরে প্রকাশ করার একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।
২০২৪-এর জুলাইয়ের কোটা আন্দোলনকে শুরুতে নিরীহ আন্দোলনই মনে হয়েছিল। কিন্তু যেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে আন্দোলনকারীদের ওপর হেলমেট লীগের বর্বরোচিত হামলা এবং হামলায় আহত ছাত্রীদের রক্তাক্ত চেহারা বারবার টিভির পর্দায় ভেসে উঠতে লাগলো এবং হামলাকারীদের এক বিভৎস কুৎসিত রূপ সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে ছড়িয়ে পড়লো তখনই মনে হলো ‘মেঘ থম থম করে’। তা আরো নিশ্চিত করলেন দু হাত প্রসারিত করে দাঁড়ানো একের পর এক গুলিতে বিদ্ধ আবু সাইদÑ যেন ‘বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়’। এরপর থেকে পানিওয়ালা মুগ্ধের গুলিবিদ্ধ ছবি, রিকশার পাদানিতে রাখা গুলি বিদ্ধ গোলাম নাফিজ কিংবা গুলিতে এক চোখের কর্নিয়া ও আর এক চোখের রেটিনা ফেটে যাওয়া নরসিংদীর ছাত্র মোজাম্মেল হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে যখন বলে ‘অন্তত একটা চোখ যদি ভালো থাকতো পরীক্ষা দিতে পারতাম’ অথবা হেলিকপ্টার থেকে গুলি করে শিশু হত্যার ছবি দেখে ‘চোখ ছলছল করে’ জেগে ওঠল গোটা বাংলাদেশ।
স্বৈরাচার পতনের একদফা আন্দোলনে অকুতভয় সাধারণ ছাত্র ছাত্রীরা এবং ক্ষেত্র বিশেষে শ্রমজীবী তরুণরা বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো রাজপথে নেমে এলো। শিক্ষক, অভিভাবকরাও ছাত্রদের পাশে দাঁড়ালেন। এক যুগেরও বেশি সময় যাবত গণতন্ত্রহীনতায় মানুষের মাঝে জন্ম নেয়া ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটলো। প্রতিটি মৃত্যু আন্দোলনকে আরো শক্তিশালী করে তুললো। বুলেট আর বুটের তলায় পিষ্ট ছাত্র জনতা জীবনকে ভালোবাসবে বলে জীবন বিলিয়ে দেয়ার এক ইতিহাস সৃষ্টি করলো। শেখ হাসিনার শাসন দীর্ঘায়িত হলে আমাদের সন্তানেরা আরো বিপুল সংখ্যায় মারা পড়বেÑ শুধু এই এক যুক্তিতেও আওয়ামী সরকারের প্রতি নমনীয় বা সমর্থক বিরাট সংখ্যক মানুষও সরকারের বিদায় কামনা করেন।
অভ্যুত্থান বিজয় অর্জনের মধ্য দিয়ে হলো এক নতুন ভোরের সূচনা। ‘রাত ঘুম ঘুম ঘোরে জাগে ঐ/রোদ ঝলমল করে দেখ ঐ / ঝড়ো হাওয়া ভেঙ্গে দিলো মিথ্যে তাসের ঘর’। কপালে বাঁধা ‘সবুজ জমিনে লাল সূর্যের পতাকাকে’ রণসজ্জা বানিয়ে আর ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসির’ জাতীয় সঙ্গীতকে রণসঙ্গীতে পরিনত করে যারা রাজপথ কাঁপিয়েছিলেন সেই লাখো লাখো তরুণরাই বিজয় উল্লাসে গেয়ে ওঠেন, ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি...’।
কিন্তু ভোরটা সকাল হতে না হতেই এবং বিজয়ী ছাত্র জনতা ঘরে ফিরতেই দেয়ালে দেয়ালে আঁকা স্বপ্নগুলো ফিকে হতে শুরু করলো। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে, হানাদার বাহিনীর গণহত্যা, বুদ্ধিজীবী হত্যা, সংখ্যালঘু নিধন, নারী ধর্ষণসহ সকল অপরাধের সহযোগী রাজনৈতিক শক্তি সমূহ ছাত্র সমন্বয়কদের একাংশের কাঁধে ভর করে অনেকটা গাজীর বেশে হাজির হলো। তারা মুছে ফেলতে লাগলো একের পর এক মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি। বিভাজনের এক শক্তিকে বিদায় করার পর হিংস্র এবং উন্মত্ত চেহারা নিয়ে নতুন এক বিভাজনের শক্তি আবির্ভূত হলো অন্তর্বর্তী সরকারের প্রচ্ছন্ন সমর্থন বা সহায়তায়। স্বৈরতন্ত্রের বদলে মবতন্ত্র, মামলাতন্ত্র, নব্য চাঁদাবাজতন্ত্র তথা সমন্বয়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার এক অবিরাম প্রচেষ্টা শুরু হলো। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে উগ্রবাদী শক্তির কর্মকা-ে পতিত স্বৈরাচারের পরিবর্তিত রূপ দেখে, বিরামহীন দখলবাজি চাঁদাবাজি দেখে আন্দোলনে শামিল ছাত্র জনতা নিজেদের গুটিয়ে নিলো।
অন্যদিকে গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পরও শেখ হাসিনা, তার দল বা কর্মী-সমর্থকের মধ্যে কোনো অনুতাপ-অনুশোচনা নেই। আন্দোলন দমনে যে নিষ্ঠুরতার পরিচয় শেখ হাসিনা দিলেন তা কি কোনো সুস্থ মানুষ দিতে পারে? তার কাছে যদি গোয়েন্দা তথ্য থেকেও থাকে যে আন্দোলনকারীদের নেতৃত্বের মাঝে নাশকতা সৃষ্টিকারী গোষ্ঠীও রয়েছে তারপরেও কি রাজপথে নেমে আসা লক্ষ লক্ষ সাধারণ ছাত্রছাত্রী, তরুণ-তরুণীর বিরুদ্ধে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দেয়া যায়? হেলিকপ্টার থেকে গুলি করার নির্দেশ দেয়া যায়? আর সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারীদের নির্বিচার গুলি চালিয়ে হত্যা করা হলে, সুযোগ পেলে কোন দেশে সরকারি স্থাপনায় হামলা হয় না? আমাদের দেশে ’৬৯ বা ’৯০-এ গণঅভ্যুত্থানে হয়নি? আমার তো আজও চোখের সামনে ভাসে খুলনায় ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের মিছিলকে ছত্রভঙ্গ করতে যখন গুলি চালানো হলো এবং গুলিবিদ্ধ হাদিস শহীদ হলেন, বিক্ষুদ্ধ ছাত্র জনতা তৎকালীন এসডিও কাউতের সরকারি বাসভবন আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয় এবং পুলিশ বাহিনী দূরে সরে যেতে বাধ্য হয়। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ হয়নি? প্রায় দশ বছরের সেই আন্দোলনে কতজন শহীদ হয়েছেন? কিন্তু ২০২৪-এ যে নৃশংসতা দেখানো হলো তার সুনির্দিষ্ট প্রমাণ তার নিজের কেনা ‘পেগাসাস’ থেকেই বের হচ্ছে; যা তাকে ও তার দলকে বিচারের মুখোমুখি করেছে এবং এক গভীর অনিশ্চয়তার গিরীখাদে ফেলে দিয়েছে। এত কিছুর পরেও তারা আগের রূপেই ফিরতে চান!
পতিত শক্তি না হয় দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে যা খুশি করছে।কিন্তু অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারীরা এবং অন্তর্বর্তী সরকার কোন পথে? শহুরে মধ্যবিত্ত ও তরুণ এক্টিভিস্টদের একাংশ এবারের অভ্যুত্থানের মাঝে বিপ্লবী রূপান্তরের এক ইউটোপীয় সম্ভাবনা দেখছিলেন। কিন্তু সাধারণ ছাত্র জনতা নিজ নিজ বোধের জায়গা থেকে লড়াই করেছে, সুনির্দিষ্ট কোনো রাজনৈতিক শক্তি বা কোনো মাস্টার মাইন্ডের ডাকেই যে সব ধরনের মানুষ জুলাইয়ের আন্দোলনে নেমেছিল এমনটা নয়। সমন্বয়কদেরও কেউ এমন ক্যারিশম্যাটিক ছিলেন না যে তাদের ডাকে তাদের ছাত্র সংগঠন ও কোটা বিরোধী আন্দোলনের কর্মীরা ছাড়া সাধারণ ছাত্র ও মানুষ রাজপথে নেমে এসেছিলেন। মানুষ শুধুমাত্র ছাত্র আন্দোলনকারী নেতৃত্বের মাধ্যমে কর্মসূচি জেনেছে এবং সেটাই অনুসরন করেছে। আবার যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খালি করে দেওয়া হয়েছে, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্র ছাত্রীরা ‘ফেলো ফিলিংস’ থেকে এবং নির্মম হত্যাকা-ের প্রতিবাদে রাজপথে নেমে এসেছে, আন্দোলনকে পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছে। সুতরাং এ আন্দোলনে কারোই ‘মুই কি হনুরে’ ভাবার সুযোগ নেই। যদিও অনেকেই তা ভেবে ধরাকে সরা জ্ঞান করছেন। একদিকে মুখে বিপ্লবী বুলি অন্যদিকে ‘কোটি টাকার নিচে নাকি কোনো কথা নেই’।
স্বৈরাচারী শাসকের পরিবর্তনের এক দফা ছাড়া কোনো মূর্ত রাজনৈতিক এজেন্ডা মানুষের সামনে ছিলো না। বিমূর্ত নানা আকাংখা নানা মানুষের মাঝে বা সমন্বয়কদের মধ্যে থাকতে পারে। কিন্তু সে সব আকাক্সক্ষা সার্বজনীন হয়ে ওঠেনি। এমনকি আন্দোলনের দিনগুলোতেও উচ্চারিত হয়নি। পুরনো ব্যবস্থাকে বদল করে সমাজের আমুল পরিবর্তন করার মতো কোনো বিপ্লব বা অভ্যুত্থান দেশে হয়নি। সেটার জন্য প্রয়োজন আরো দীর্ঘ সংগ্রাম, আরো দীর্ঘ পথ হাঁটা। ক্ষমতার অলিন্দের বাইওে থেকে দীর্ঘ পথ হাঁটতে ছাত্র সমন্বয়করা বা নতুন দলের নেতারা রাজি নন। জুলাই ঘোষণা বা সনদ যাই বলা হোক না কেনো মূল লক্ষ্য ক্ষমতা বা ক্ষমতার অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দুনিয়ার সাথে আগে থেকেই হাসিনা সরকারের এক ধরনের বৈরীতা ছিল। এ অভ্যুত্থানের আগে থেকেই লীগ বিরোধী নানা শক্তির সাথে তারা সংযোগ রাখছিলো। সুতরাং একদিকে তাদের ডিপস্টেট এবং অন্যদিকে দেশের সিভিল মিলিটারি বুরোক্রেসি রাষ্ট্র কাঠামোয় তাদের ‘স্টেক’ বড় করতে এ ধরনের অভ্যুত্থানে ভূমিকা রাখতে চাইবে, এটাই স্বাভাবিক। সব মিলিয়ে ক্ষমতার কাঠামোতে একাধিক টিম। তাদের নানা মত, নানা পথ। শেষ পর্যন্ত কি ঘটবে বলা মুশকিল একমাত্র উপদেষ্টা আসিফ নজরুল অলরাউন্ডার হিসেবে সব টিমেই খেলে থাকেন। হয়তো বা তার জানা থাকতে পারে!
এ ধরনের এক জটিল পরিস্থিতিতেই পালিত হচ্ছে জুলাই অভ্যুত্থানের বার্ষিকী। অভ্যুত্থানের প্রধান আকাক্সক্ষা গণতন্ত্রে উত্তরণ যত বিলম্বিত হচ্ছে তত বেশি করে বিভ্রান্তি ও ছন্দ পতন হচ্ছে। তত বেশি করে এক মুক্ত মানবিক বৈষম্যমুক্ত সমাজ বিনির্মানের আকাংখার বিপরীতে প্রতিক্রিয়াশীল পুনর্নির্মাণের আশঙ্কা সৃষ্টি হচ্ছে। দেশের সংবিধানের মর্মবস্তু পাল্টে দেওয়ার অশুভ শক্তি, নারীকে সমঅধিকার দেওয়ার বিপরীতে পর্দার আড়ালে রাখার শক্তি এবং ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু বিদ্বেষী শক্তি মাথায় ‘সবুজ জমিনে লাল সূর্যের পতাকার’ পট্টি বেঁধে অভিনয় করছে এবং মানুষকে বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলে দিয়ে কোশেস করছে পাকিস্তানি চাঁদ তারা মার্কা পতাকার আদর্শ প্রতিষ্ঠার। তাদের এই প্রতিক্রিয়াশীল পুনর্নিমানের প্রচেষ্টায় বন্ধু হিসাবে নতুন দলের ও অন্তর্বর্তী সরকারের একাংশের প্রচ্ছন্ন সমর্থন পেয়ে তারা হয়ে উঠছে বেপরোয়া।
এসব কারণেই আবার গুমোট পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। অভ্যুত্থানের শক্তিগুলোর মধ্যে নানা বিষয়ে অনৈক্য তৈরি হয়েছে। শেখ হাসিনার বিএনপি জামায়াত শিবির জুজুর মতো ড. ইউনূসও বেকায়দায় পড়লেই পতিত শক্তির জুজুর ভয় দেখিয়ে সবাইকে বশে রাখতে চান। তাহলে কি ভুল হাতে পড়ে গেলো জুলাই অভ্যুত্থান! যদি তা ভুল হাতে পড়েও যদি ঘটে উল্টো যাত্রা তার পরেও ছাত্র তরুণরা যেভাবে দলে দলে নেমে এসেছিল রাজপথের লড়াইয়ের ময়দানে সে লড়াই কোনদিন খাটো হবে না। যদিও শুধুমাত্র আন্দোলনই নয় পর্দার আড়ালের নানা কূটকৌশলের কাছেও হাসিনাকে হার মানতে হয়। তারপরেও জুলাই আন্দোলনে মানুষের যে আত্মদান তার মাহাত্ম্যও কখনই কমবে না; কিন্তু বছর পার না হতেই যে আবার ‘মেঘ থম থম করে’! আসলেই কি ‘ভাঙ্গনের নেই পারাপার!’
[লেখক : সাবেক ছাত্র নেতা]