alt

উপ-সম্পাদকীয়

জ্ঞানতীর্থের সংকট ও গবেষণাবিমুখ উচ্চশিক্ষা

ইমাদুল হক প্রিন্স

: রোববার, ০৩ আগস্ট ২০২৫

বিশ্ববিদ্যালয় শব্দটির প্রতিটি অক্ষরে যেন লুকিয়ে থাকে এক জাতির ভবিষ্যতের ভাষ্য। এটি শুধু ইট-বালুর প্রতিষ্ঠান নয়; বরং একটি জাতির মননের মন্দির, যুক্তির পাঠশালা ও বুদ্ধিবৃত্তিক নির্মাণের সর্বোচ্চ স্তম্ভ। শ্রেণিকক্ষে উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ, গবেষণাগারের প্রতিটি জিজ্ঞাসা, শিক্ষার্থী শিক্ষকের আন্তরিক সংলাপÑএসব মিলেই রচিত হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ।

সংকেত দেয় এক জাতির জ্ঞানের গভীরতা, প্রশ্নে উত্তরে ধ্বনি। যখন বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণার বদলে লেকচারের ঘূর্ণিতে হারিয়ে যায়, তখন সেটি তার আত্মা হারায়। গবেষণাহীন উচ্চশিক্ষা হলো একরকম দিশাহীন যাত্রাÑযার ফলশ্রুতিতে আসে স্থবিরতা, আত্মতুষ্টি আর আন্তর্জাতিক পরিম-লে অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার ভয়।

অধ্যাপকেরা কি আজ আসল বুদ্ধিবৃত্তিক আলোকবাতি, নাকি শুধুই ‘পদ-মহিমায় ভারবাহী’? বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)-এর ২০২৪ সালের প্রতিবেদনে দেখা যায়Ñ দেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের মধ্যে প্রায় ৩১.৮৭% অধ্যাপক, যা যুক্তরাজ্যে মাত্র ১০% এবং যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ২২%। সংখ্যায় যখন দ্বিগুণ, তখন প্রশ্ন জাগেÑএই সঙ্কীর্ণ সংখ্যা কি প্রকৃত মানকে প্রতিফলিত করে?

দুঃখজনকভাবে উত্তরটি খারাপÑনা। ভারতের মতো দেশে যেখানে ৮১.০৩% শিক্ষক পিএইচডিধারী, বাংলাদেশে এই হার দাঁড়িয়েছে মাত্র ৩৮.০৩%। গবেষণার সংখ্যাসূচক গতি নেই, সেই চেয়ে ভয়ঙ্করÑমনোভাবের শূন্যতা। গবেষণা এখন পদোন্নতির পাথেয়, বেতনের আশীর্বাদ, কিংবা সিভির সাজসজ্জার ফাটা কাগজ; অথচ তার প্রকৃত কাজÑজ্ঞান সৃষ্টি। বৈশ্বিকভাবে স্কোপাসের তথ্যমতে ২০২৪ সালে ভারত থেকে ২,৮৭,৮০২, পাকিস্তান থেকে ৩৭,৫২৬, আর বাংলাদেশ থেকে মাত্র ১৫,৪১৩ গবেষণাপত্র প্রকাশ হয়েছে। এই পার্থক্য শুধু সংখ্যা নয়Ñএটি গবেষণার প্রতি মনোভাবের সেই অন্ধকার যাত্রা, যেখানে আমরা অচেতনভাবেই পিছিয়ে যাচ্ছি সীমান্তের বাইরে।

বাংলাদেশে গবেষণা মানে পদোন্নতির ‘টিকিট’, যেখানে পিএইচডি ছাড়া মানুষ ‘অধ্যাপক’ হতে পারেন, যেখানে গবেষণা মানে দুই একটি অনলাইন জার্নালে নাম লেখাÑ সেখানে গবেষণার স্বপ্ন কি সত্যিই জন্ম নেবে? বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে নবায়নযোগ্য শক্তি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, জিন-সম্পাদন, ক্যানসার গবেষণা, ও ব্লু-ইকনোমির দিকে। অথচ আমরা এখনো ব্যস্ত হচ্ছি প্রশ্নেÑ ‘পদোন্নতিতে কয়টা পেপার লাগবে?’ ‘জার্নাল পিয়ার রিভিউড কিনা সেটা কি কেউ খেয়াল করে?’

পদোন্নতিমুখী গবেষণা : মানসিকতাই সংকটেÑ বর্তমানে দেশে গবেষণা যেন একটি করণীয় নয়, বরং কৌশলগত প্রয়োজন। পিএইচডি, এমফিল বা কয়েকটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করলেই অধ্যাপক হওয়া যায়। অথচ এই গবেষণার মান কী, কোথায় তা ছাপা হয়েছে, কতজন উদ্ধৃত করেছেনÑএসব প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই নিয়োগ বা পদোন্নতির প্রক্রিয়ায়। ‘পিয়ার রিভিউড’ শব্দটির আড়ালে কত শত ভুঁইফোঁড় জার্নাল প্রতিদিন জন্ম নিচ্ছে, তার হিসাব কে রাখে? অনেক ক্ষেত্রেই এসব প্রকাশনা হয় নামমাত্র মান বজায় রেখেÑশুধু পদোন্নতির শর্ত পূরণে। ফলে গবেষণা আর জ্ঞান সৃষ্টির পরিবর্তে রূপ নিচ্ছে এক প্রাতিষ্ঠানিক প্রহসনে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুম থেকে প্রশাসনিক ভবন পর্যন্ত : শিক্ষক নাকি ‘চেয়ার-যোদ্ধা’? যে শিক্ষক ক্লাসরুমে ছাত্রের চোখে চোখ রেখে জ্ঞানচর্চা করেন, গবেষণাগারে তাকে উৎসাহিত করেন প্রশ্ন করতে, চিন্তা করতেÑতিনিই তো আদর্শ শিক্ষক; কিন্তু আমাদের দেশে আজ এমন এক ‘শিক্ষক-প্রশাসক’ শ্রেণির উত্থান ঘটেছে, যাঁদের আগ্রহ গবেষণায় নয়, বরং প্রশাসনিক পদে। রেজিস্ট্রার, ডিন, চেয়ারম্যান, প্রক্টর, সহকারী প্রক্টর, প্রভোস্টÑএসব চেয়ারের পেছনে আজ একটি বিস্তৃত প্রতিযোগিতা।

উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তুলনা : কেন আমরা পেছনে? বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকতা শুরুই হয় পিএইচডির পর। সেখানকার সহকারী অধ্যাপক হওয়া মানেÑপ্রকাশনা, প্রকল্প, গবেষণা তহবিল, ছাত্র-সহযোগিতায় সুস্পষ্ট অবদান। আর পদোন্নতির প্রতিটি ধাপে কঠোর মূল্যায়ন পদ্ধতি রয়েছে। আমাদের দেশে গবেষণার মান যাচাই করার কোনো কাঠামো নেই। কোথায় ছাপা হলো, কে রেফার করেছে, কতজন ব্যবহার করেছেÑএসব বিবেচনার বাইরে থেকে যাচ্ছে। এমনকি ইউজিসির নির্দেশনাগুলোও অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে অক্ষরে অক্ষরে মানা হয় না।

আত্মদর্শন : ২০২৬ সালের কিউএস ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র‌্যাংকিং বলছে, বাংলাদেশের মাত্র ১৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ই তালিকাভুক্ত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ৫৮৪তম, বুয়েট ৭৬১-৭৭০, আর নর্থ সাউথ ৯৫১-১০০০-এর মধ্যে। বাকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নাম আছে, কিন্তু র‌্যাংকিং-এ স্কোর নেইÑতারা যেন শুধুই তালিকাভুক্ত, কার্যত অনুপস্থিত। র‌্যাংকিংয়ের এই পশ্চাদপসরণ কেবল গ্লোবাল স্বীকৃতির অভাব নয়Ñএটি গবেষণাভিত্তিক দুর্বলতার প্রতিচ্ছবি। বিশ্ববিদ্যালয় যখন শ্রেণিকক্ষের বাইরে চিন্তা করতে ব্যর্থ হয়, তখন তার অবস্থান এমনই হবে।

সমাধানের খসড়া : আমরা কী করতে পারি? বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে গবেষণাকেন্দ্রিক ও মেধাভিত্তিক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরের জন্য জরুরি কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবেÑ গবেষণার মানভিত্তিক পদোন্নতি নীতি প্রণয়ন : প্রকাশনার সংখ্যা নয়, বরং তার মান, ইম্প্যাক্ট ফ্যাক্টর, গবেষণায় শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও সাইটেশন কাউন্ট পদোন্নতির মূল ভিত্তি হতে হবে।

রিসার্চ ফ্যাকাল্টি গঠন : প্রতিটি বিভাগে নির্দিষ্ট হারে গবেষণায় সম্পৃক্ত শিক্ষক নিয়োগ বাধ্যতামূলক করতে হবে। গবেষণাভিত্তিক শিক্ষকদের জন্য আলাদা ক্যাডার অথবা গবেষণা স্কলারশিপ চালু করা যেতে পারে।

শিক্ষার্থীদের গবেষণায় অন্তর্ভুক্তি : শুধু শ্রেণিকক্ষের পাঠ্যসূচির বাইরে এনে ছাত্রদের গবেষণায় যুক্ত করতে হবে। শিক্ষক-ছাত্র যৌথ গবেষণাকে আনতে হবে মূল্যায়ন কাঠামোর অন্তর্ভুক্তিতে।

রিসার্চ ফান্ড ও বাজেট : বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার জন্য আলাদা বাজেট বরাদ্দ দিতে হবে। প্রকল্পভিত্তিক তহবিল বরাদ্দের পাশাপাশি মান যাচাইয়ের জন্য আলাদা পিয়ার রিভিউ কমিটি গঠন করতে হবে।

স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা : শিক্ষক নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রশাসনিক দায়িত্ব বণ্টনে স্বচ্ছতা আনতে হবে। রাজনৈতিক প্রভাব, তদবির এবং ব্যক্তিগত সম্পর্ক নির্ভরতা বন্ধ করে কঠোর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।

জ্ঞানতীর্থ যেন আবার দীপ্ত হয়ে ওঠে : বাংলাদেশের শিক্ষকরা মেধাবীÑএ বিষয়ে সন্দেহ নেই; কিন্তু সেই মেধা যদি গবেষণায়, চিন্তায়, আর আন্তর্জাতিক আলোচনায় যুক্ত না হয়, তবে তা ক্রমশ নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। শিক্ষক মানেই এক পথপ্রদর্শক, যিনি শিক্ষার্থীকে প্রশ্ন করতে শেখান, তর্ক করতে উদ্বুদ্ধ করেন, অনুসন্ধানকে ভালোবাসতে শেখান।

আজকের এই গবেষণাবিমুখ, চেয়ারমুখী প্রবণতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণশক্তিকে হরণ করছে। তাই এখন প্রয়োজন সাহসী নীতিগত পরিবর্তনেরÑ যেখানে ‘অধ্যাপক’ শব্দটি হবে গৌরব ও দায়িত্বের প্রতীক, যেখানে প্রকাশনা হবে মর্যাদার মানদ-, আর ছাত্রের চোখে সম্মানই হবে শিক্ষকতার আসল সনদ। বিশ্ববিদ্যালয়ের আসল পরিচয় তার গবেষণাকেন্দ্রিক মনোভাব ও মেধাবী মানবসম্পদ গড়ে তোলার ক্ষমতায়। সেটি হারিয়ে গেলে বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে ওঠে কেবল একটি ডিগ্রি বিতরণকারী কারখানাÑ যেখানে শিক্ষার গভীরতা নেই, জ্ঞানের বিস্তার নেই, গবেষণার উদ্দীপনা নেই। তখন জাতিও হারায় ভবিষ্যতের নেতৃত্ব, উদ্ভাবনের শক্তি ও চিন্তার দিগন্ত।

এই মুহূর্তে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দাঁড়িয়ে আছে এক সন্ধিক্ষণে। সামনে দুটো পথÑ একটি আত্মতুষ্টির, অপরটি আত্মশুদ্ধির। আত্মতুষ্টির পথ ধরে এগোলে আমরা হয়তো সংখ্যায় আরও অধ্যাপক পাব, আরও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হবে, আরও চেয়ার পূর্ণ হবেÑকিন্তু তাতে মানের পরিবর্তন হবে না, দেশের বুদ্ধিবৃত্তিক ভিত্তিও দৃঢ় হবে না।

অন্যদিকে আত্মশুদ্ধির পথ কঠিন, তবে একমাত্র সেটিই আমাদের গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে। গবেষণাকেন্দ্রিক সংস্কৃতি, মেধাভিত্তিক নিয়োগ, স্বচ্ছ ও নৈতিক মূল্যায়ন কাঠামো এবং আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন শিক্ষা ও চিন্তার উদ্বোধনই পারে আমাদের উচ্চশিক্ষাকে তার প্রকৃত মর্যাদায় পৌঁছে দিতে।

এটা মনে রাখা জরুরি, একটি জাতি কেবল তখনই সভ্যতার অগ্রদূত হয়ে উঠতে পারে, যখন তার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হয় জ্ঞানচর্চার তীর্থভূমি। যেখানে শিক্ষক থাকেন আলোকবর্তিকা হয়ে, গবেষণাগারে নিরবিচারে ভাবনার অগ্নিস্নানে ছাত্রদের ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রেরণা দিয়ে। যেখানে ‘পদ’ নয়, গবেষণার ‘প্রকাশ’ হয় মর্যাদার মাপকাঠি এবং যেখানে বিশ্ববিদ্যালয় মানে হয় না একটি দপ্তর, বরং হয়ে ওঠে একটি জাতীয় স্বপ্নের নাম। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সামনে এখন সেই স্বপ্নকে বাস্তব করার চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জে জয়ী হতে হলে প্রয়োজন সাহস, সততা এবং সংকল্প। এই সংকল্পই হোক আমাদের উচ্চশিক্ষার নবযাত্রার সূচনা।

[লেখক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়]

আচরণগত অর্থনীতির আয়নায় বাংলাদেশিদের বিদেশযাত্রা

গরিবের ইলিশ শুধুই স্বপ্ন কেন?

চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান : বৈষম্য ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে জাগরণ

শারীরিক শিক্ষা : সুস্থ ও সচেতন প্রজন্ম গড়ার সম্ভাবনা

ছবি

জুলাই অভ্যুত্থান-গাথা : মেঘ থম থম করে

অলৌকিকতা, লৌকিকতা ও বিশ্বাসের বিভ্রান্তি

বিচারপতি গ্রেফতার, শুনানিতে পুলিশের অসহযোগিতা ও কিছু আইনি জিজ্ঞাসা

অপেক্ষার রাজনীতি ও সময়গত বৈষম্য : ঢাকা শহরের প্রেক্ষাপট

বৃক্ষরোপণ হোক পরিবেশ রক্ষার আন্দোলন

আফ্রিকায় রাশিয়ার ভূরাজনৈতিক কৌশল

বিভীষিকাময় দুর্ঘটনা ও করুণ মৃত্যু

কেন এত তরুণ দেশ ছাড়তে চাচ্ছে

রেলওয়ে পরিচালনায় আমলাতন্ত্রের প্রভাব

রম্যগদ্য : ‘গোপালগঞ্জ, বাংলার গোপালগঞ্জ...’

দেশি মাছ রক্ষায় অভয়াশ্রম

আলুর বাজার বিপর্যয় : কৃষকের ভাগ্যে লোকসান

ছবি

নীল নদের পানি নীল নয়

বিশ্ব বাঘ দিবস

ঢাকার কি রিস্ক এনালাইসিস করা আছে?

ছবি

সোনার হরফে লেখা অনন্য শিক্ষকের নাম

পরীক্ষার পর পরীক্ষা, কিন্তু কোথায় মূল্যায়ন ও মূল্যবোধের ভিত্তি?

বৃত্তি পরীক্ষায় কিন্ডারগার্টেন বাদ কেন?

সময়ের স্বৈরতন্ত্র : প্রতীক্ষা, ক্ষমতা ও জীবনের অসমতা

জলবায়ু পরিবর্তন মডেলে গণিতের ব্যবহার

দুর্ঘটনাজনিত দুর্যোগ-পরবর্তী করণীয় কী?

ডেঙ্গু, জিকা আর চিকুনগুনিয়া : একই উৎস, ত্রিমুখী সংকট

কেন থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়ার ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি?

দুর্নীতি নির্মূল করা কি সম্ভব?

দরকার মানসম্মত শিক্ষা

ইসরায়েলের যুদ্ধনীতি ও বিশ্ব নিরাপত্তার সংকট

রম্যগদ্য : ‘বেইমান রাইট ব্রাদার্স’

মানসিক স্বাস্থ্যসেবা : আইনি কাঠামো, সংকট ও সম্ভাবনার দিক

ছবি

বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র

দুর্যোগে অবিবেচকদেরকে কি দায়িত্বশীল ভাবা যায়?

ওয়াসার পদ্মা ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট : এক জীবন্ত বোটানিক্যাল গার্ডেন

রেলপথের দুর্দশা : সমন্বিত পরিকল্পনা না হলে বিপর্যয় অনিবার্য

tab

উপ-সম্পাদকীয়

জ্ঞানতীর্থের সংকট ও গবেষণাবিমুখ উচ্চশিক্ষা

ইমাদুল হক প্রিন্স

রোববার, ০৩ আগস্ট ২০২৫

বিশ্ববিদ্যালয় শব্দটির প্রতিটি অক্ষরে যেন লুকিয়ে থাকে এক জাতির ভবিষ্যতের ভাষ্য। এটি শুধু ইট-বালুর প্রতিষ্ঠান নয়; বরং একটি জাতির মননের মন্দির, যুক্তির পাঠশালা ও বুদ্ধিবৃত্তিক নির্মাণের সর্বোচ্চ স্তম্ভ। শ্রেণিকক্ষে উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ, গবেষণাগারের প্রতিটি জিজ্ঞাসা, শিক্ষার্থী শিক্ষকের আন্তরিক সংলাপÑএসব মিলেই রচিত হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ।

সংকেত দেয় এক জাতির জ্ঞানের গভীরতা, প্রশ্নে উত্তরে ধ্বনি। যখন বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণার বদলে লেকচারের ঘূর্ণিতে হারিয়ে যায়, তখন সেটি তার আত্মা হারায়। গবেষণাহীন উচ্চশিক্ষা হলো একরকম দিশাহীন যাত্রাÑযার ফলশ্রুতিতে আসে স্থবিরতা, আত্মতুষ্টি আর আন্তর্জাতিক পরিম-লে অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার ভয়।

অধ্যাপকেরা কি আজ আসল বুদ্ধিবৃত্তিক আলোকবাতি, নাকি শুধুই ‘পদ-মহিমায় ভারবাহী’? বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)-এর ২০২৪ সালের প্রতিবেদনে দেখা যায়Ñ দেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের মধ্যে প্রায় ৩১.৮৭% অধ্যাপক, যা যুক্তরাজ্যে মাত্র ১০% এবং যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ২২%। সংখ্যায় যখন দ্বিগুণ, তখন প্রশ্ন জাগেÑএই সঙ্কীর্ণ সংখ্যা কি প্রকৃত মানকে প্রতিফলিত করে?

দুঃখজনকভাবে উত্তরটি খারাপÑনা। ভারতের মতো দেশে যেখানে ৮১.০৩% শিক্ষক পিএইচডিধারী, বাংলাদেশে এই হার দাঁড়িয়েছে মাত্র ৩৮.০৩%। গবেষণার সংখ্যাসূচক গতি নেই, সেই চেয়ে ভয়ঙ্করÑমনোভাবের শূন্যতা। গবেষণা এখন পদোন্নতির পাথেয়, বেতনের আশীর্বাদ, কিংবা সিভির সাজসজ্জার ফাটা কাগজ; অথচ তার প্রকৃত কাজÑজ্ঞান সৃষ্টি। বৈশ্বিকভাবে স্কোপাসের তথ্যমতে ২০২৪ সালে ভারত থেকে ২,৮৭,৮০২, পাকিস্তান থেকে ৩৭,৫২৬, আর বাংলাদেশ থেকে মাত্র ১৫,৪১৩ গবেষণাপত্র প্রকাশ হয়েছে। এই পার্থক্য শুধু সংখ্যা নয়Ñএটি গবেষণার প্রতি মনোভাবের সেই অন্ধকার যাত্রা, যেখানে আমরা অচেতনভাবেই পিছিয়ে যাচ্ছি সীমান্তের বাইরে।

বাংলাদেশে গবেষণা মানে পদোন্নতির ‘টিকিট’, যেখানে পিএইচডি ছাড়া মানুষ ‘অধ্যাপক’ হতে পারেন, যেখানে গবেষণা মানে দুই একটি অনলাইন জার্নালে নাম লেখাÑ সেখানে গবেষণার স্বপ্ন কি সত্যিই জন্ম নেবে? বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে নবায়নযোগ্য শক্তি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, জিন-সম্পাদন, ক্যানসার গবেষণা, ও ব্লু-ইকনোমির দিকে। অথচ আমরা এখনো ব্যস্ত হচ্ছি প্রশ্নেÑ ‘পদোন্নতিতে কয়টা পেপার লাগবে?’ ‘জার্নাল পিয়ার রিভিউড কিনা সেটা কি কেউ খেয়াল করে?’

পদোন্নতিমুখী গবেষণা : মানসিকতাই সংকটেÑ বর্তমানে দেশে গবেষণা যেন একটি করণীয় নয়, বরং কৌশলগত প্রয়োজন। পিএইচডি, এমফিল বা কয়েকটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করলেই অধ্যাপক হওয়া যায়। অথচ এই গবেষণার মান কী, কোথায় তা ছাপা হয়েছে, কতজন উদ্ধৃত করেছেনÑএসব প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই নিয়োগ বা পদোন্নতির প্রক্রিয়ায়। ‘পিয়ার রিভিউড’ শব্দটির আড়ালে কত শত ভুঁইফোঁড় জার্নাল প্রতিদিন জন্ম নিচ্ছে, তার হিসাব কে রাখে? অনেক ক্ষেত্রেই এসব প্রকাশনা হয় নামমাত্র মান বজায় রেখেÑশুধু পদোন্নতির শর্ত পূরণে। ফলে গবেষণা আর জ্ঞান সৃষ্টির পরিবর্তে রূপ নিচ্ছে এক প্রাতিষ্ঠানিক প্রহসনে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুম থেকে প্রশাসনিক ভবন পর্যন্ত : শিক্ষক নাকি ‘চেয়ার-যোদ্ধা’? যে শিক্ষক ক্লাসরুমে ছাত্রের চোখে চোখ রেখে জ্ঞানচর্চা করেন, গবেষণাগারে তাকে উৎসাহিত করেন প্রশ্ন করতে, চিন্তা করতেÑতিনিই তো আদর্শ শিক্ষক; কিন্তু আমাদের দেশে আজ এমন এক ‘শিক্ষক-প্রশাসক’ শ্রেণির উত্থান ঘটেছে, যাঁদের আগ্রহ গবেষণায় নয়, বরং প্রশাসনিক পদে। রেজিস্ট্রার, ডিন, চেয়ারম্যান, প্রক্টর, সহকারী প্রক্টর, প্রভোস্টÑএসব চেয়ারের পেছনে আজ একটি বিস্তৃত প্রতিযোগিতা।

উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তুলনা : কেন আমরা পেছনে? বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকতা শুরুই হয় পিএইচডির পর। সেখানকার সহকারী অধ্যাপক হওয়া মানেÑপ্রকাশনা, প্রকল্প, গবেষণা তহবিল, ছাত্র-সহযোগিতায় সুস্পষ্ট অবদান। আর পদোন্নতির প্রতিটি ধাপে কঠোর মূল্যায়ন পদ্ধতি রয়েছে। আমাদের দেশে গবেষণার মান যাচাই করার কোনো কাঠামো নেই। কোথায় ছাপা হলো, কে রেফার করেছে, কতজন ব্যবহার করেছেÑএসব বিবেচনার বাইরে থেকে যাচ্ছে। এমনকি ইউজিসির নির্দেশনাগুলোও অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে অক্ষরে অক্ষরে মানা হয় না।

আত্মদর্শন : ২০২৬ সালের কিউএস ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র‌্যাংকিং বলছে, বাংলাদেশের মাত্র ১৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ই তালিকাভুক্ত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ৫৮৪তম, বুয়েট ৭৬১-৭৭০, আর নর্থ সাউথ ৯৫১-১০০০-এর মধ্যে। বাকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নাম আছে, কিন্তু র‌্যাংকিং-এ স্কোর নেইÑতারা যেন শুধুই তালিকাভুক্ত, কার্যত অনুপস্থিত। র‌্যাংকিংয়ের এই পশ্চাদপসরণ কেবল গ্লোবাল স্বীকৃতির অভাব নয়Ñএটি গবেষণাভিত্তিক দুর্বলতার প্রতিচ্ছবি। বিশ্ববিদ্যালয় যখন শ্রেণিকক্ষের বাইরে চিন্তা করতে ব্যর্থ হয়, তখন তার অবস্থান এমনই হবে।

সমাধানের খসড়া : আমরা কী করতে পারি? বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে গবেষণাকেন্দ্রিক ও মেধাভিত্তিক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরের জন্য জরুরি কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবেÑ গবেষণার মানভিত্তিক পদোন্নতি নীতি প্রণয়ন : প্রকাশনার সংখ্যা নয়, বরং তার মান, ইম্প্যাক্ট ফ্যাক্টর, গবেষণায় শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও সাইটেশন কাউন্ট পদোন্নতির মূল ভিত্তি হতে হবে।

রিসার্চ ফ্যাকাল্টি গঠন : প্রতিটি বিভাগে নির্দিষ্ট হারে গবেষণায় সম্পৃক্ত শিক্ষক নিয়োগ বাধ্যতামূলক করতে হবে। গবেষণাভিত্তিক শিক্ষকদের জন্য আলাদা ক্যাডার অথবা গবেষণা স্কলারশিপ চালু করা যেতে পারে।

শিক্ষার্থীদের গবেষণায় অন্তর্ভুক্তি : শুধু শ্রেণিকক্ষের পাঠ্যসূচির বাইরে এনে ছাত্রদের গবেষণায় যুক্ত করতে হবে। শিক্ষক-ছাত্র যৌথ গবেষণাকে আনতে হবে মূল্যায়ন কাঠামোর অন্তর্ভুক্তিতে।

রিসার্চ ফান্ড ও বাজেট : বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার জন্য আলাদা বাজেট বরাদ্দ দিতে হবে। প্রকল্পভিত্তিক তহবিল বরাদ্দের পাশাপাশি মান যাচাইয়ের জন্য আলাদা পিয়ার রিভিউ কমিটি গঠন করতে হবে।

স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা : শিক্ষক নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রশাসনিক দায়িত্ব বণ্টনে স্বচ্ছতা আনতে হবে। রাজনৈতিক প্রভাব, তদবির এবং ব্যক্তিগত সম্পর্ক নির্ভরতা বন্ধ করে কঠোর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।

জ্ঞানতীর্থ যেন আবার দীপ্ত হয়ে ওঠে : বাংলাদেশের শিক্ষকরা মেধাবীÑএ বিষয়ে সন্দেহ নেই; কিন্তু সেই মেধা যদি গবেষণায়, চিন্তায়, আর আন্তর্জাতিক আলোচনায় যুক্ত না হয়, তবে তা ক্রমশ নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। শিক্ষক মানেই এক পথপ্রদর্শক, যিনি শিক্ষার্থীকে প্রশ্ন করতে শেখান, তর্ক করতে উদ্বুদ্ধ করেন, অনুসন্ধানকে ভালোবাসতে শেখান।

আজকের এই গবেষণাবিমুখ, চেয়ারমুখী প্রবণতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণশক্তিকে হরণ করছে। তাই এখন প্রয়োজন সাহসী নীতিগত পরিবর্তনেরÑ যেখানে ‘অধ্যাপক’ শব্দটি হবে গৌরব ও দায়িত্বের প্রতীক, যেখানে প্রকাশনা হবে মর্যাদার মানদ-, আর ছাত্রের চোখে সম্মানই হবে শিক্ষকতার আসল সনদ। বিশ্ববিদ্যালয়ের আসল পরিচয় তার গবেষণাকেন্দ্রিক মনোভাব ও মেধাবী মানবসম্পদ গড়ে তোলার ক্ষমতায়। সেটি হারিয়ে গেলে বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে ওঠে কেবল একটি ডিগ্রি বিতরণকারী কারখানাÑ যেখানে শিক্ষার গভীরতা নেই, জ্ঞানের বিস্তার নেই, গবেষণার উদ্দীপনা নেই। তখন জাতিও হারায় ভবিষ্যতের নেতৃত্ব, উদ্ভাবনের শক্তি ও চিন্তার দিগন্ত।

এই মুহূর্তে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দাঁড়িয়ে আছে এক সন্ধিক্ষণে। সামনে দুটো পথÑ একটি আত্মতুষ্টির, অপরটি আত্মশুদ্ধির। আত্মতুষ্টির পথ ধরে এগোলে আমরা হয়তো সংখ্যায় আরও অধ্যাপক পাব, আরও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হবে, আরও চেয়ার পূর্ণ হবেÑকিন্তু তাতে মানের পরিবর্তন হবে না, দেশের বুদ্ধিবৃত্তিক ভিত্তিও দৃঢ় হবে না।

অন্যদিকে আত্মশুদ্ধির পথ কঠিন, তবে একমাত্র সেটিই আমাদের গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে। গবেষণাকেন্দ্রিক সংস্কৃতি, মেধাভিত্তিক নিয়োগ, স্বচ্ছ ও নৈতিক মূল্যায়ন কাঠামো এবং আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন শিক্ষা ও চিন্তার উদ্বোধনই পারে আমাদের উচ্চশিক্ষাকে তার প্রকৃত মর্যাদায় পৌঁছে দিতে।

এটা মনে রাখা জরুরি, একটি জাতি কেবল তখনই সভ্যতার অগ্রদূত হয়ে উঠতে পারে, যখন তার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হয় জ্ঞানচর্চার তীর্থভূমি। যেখানে শিক্ষক থাকেন আলোকবর্তিকা হয়ে, গবেষণাগারে নিরবিচারে ভাবনার অগ্নিস্নানে ছাত্রদের ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রেরণা দিয়ে। যেখানে ‘পদ’ নয়, গবেষণার ‘প্রকাশ’ হয় মর্যাদার মাপকাঠি এবং যেখানে বিশ্ববিদ্যালয় মানে হয় না একটি দপ্তর, বরং হয়ে ওঠে একটি জাতীয় স্বপ্নের নাম। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সামনে এখন সেই স্বপ্নকে বাস্তব করার চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জে জয়ী হতে হলে প্রয়োজন সাহস, সততা এবং সংকল্প। এই সংকল্পই হোক আমাদের উচ্চশিক্ষার নবযাত্রার সূচনা।

[লেখক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়]

back to top