রায়হান হোসাইন
সুস্থতা মানব জীবনের এক অনন্য আশীর্বাদ। একটি সুস্থ দেহ কেবল দৈনন্দিন জীবনযাপনকেই সহজ করে না, বরং তা ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজÑ সব ক্ষেত্রেই ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে। সুস্থতার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে মানুষ প্রাচীনকাল থেকেই সচেতন। রোমান কবি জুভেনাল তার বিখ্যাত উক্তিতে বলেছিলেন, ‘সুস্থ শরীরে সুন্দর মন।’ প্রখ্যাত দার্শনিক অ্যারিস্টোটলও একইভাবে বলেছিলেন, ‘সুস্থ দেহেই বাস করে সুস্থ মন।’ এই উক্তিগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের মধ্যে রয়েছে গভীর আন্তঃসম্পর্ক। যখন শরীর সুস্থ থাকে, তখন মনও সচল, প্রফুল্ল ও কর্মক্ষম থাকে। ফলে ব্যক্তির সার্বিক বিকাশ ত্বরান্বিত হয়।
দার্শনিক প্লেটো ছিলেন শারীরিক শিক্ষার অগ্রপথিকদের একজন। তিনি প্রথম উপলব্ধি করেন যে, শারীরিক সুস্থতা মানুষের জ্ঞানচর্চা ও চিন্তনশীলতার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তার মতে, মানুষের সামগ্রিক বিকাশের জন্য কেবল মানসিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক অনুশীলন যথেষ্ট নয়; প্রয়োজন সুসংগঠিত ও পরিকল্পিত শরীরচর্চা। এই দৃষ্টিভঙ্গি আজকের দিনে এসে আরও বাস্তবতা পেয়েছে, বিশেষ করে যখন প্রযুক্তি আমাদের জীবনকে একদিকে সহজতর করেছে, অন্যদিকে বহু ক্ষেত্রেই মানবিক যোগাযোগ ও শারীরিক সক্রিয়তাকে কমিয়ে দিয়েছে।
আধুনিক শারীরিক শিক্ষা আর কেবল ক্রীড়া বা শরীরচর্চা শেখানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। এটি এখন একটি পূর্ণাঙ্গ একাডেমিক শাখা, যার লক্ষ্য হলো ব্যক্তির শারীরিক, মানসিক, সামাজিক এবং বৌদ্ধিক বিকাশ। ‘শরীরের মাধ্যমে শিক্ষা’Ñএই ধারণার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে সমকালীন শারীরিক শিক্ষা দর্শন। এটি এমন একটি বিষয়, যা পাঠ্যবইয়ের জ্ঞানের বাইরে গিয়ে জীবনের সঙ্গে শিক্ষার্থীর বাস্তব সম্পর্ক গড়ে তোলে। যেমনÑ দৈনন্দিন জীবনে সুশৃঙ্খলতা, সময়জ্ঞান, স্বাস্থ্য সচেতনতা, নেতৃত্ব, পারস্পরিক সহযোগিতা ইত্যাদি গুণাবলী গঠনে শারীরিক শিক্ষার ভূমিকা অপরিসীম।
কিন্তু আজকের বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে শারীরিক শিক্ষা যেন আরও জরুরি হয়ে উঠেছে। প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতির ফলে বর্তমান প্রজন্ম বেশিরভাগ সময় কাটাচ্ছে মোবাইল, কম্পিউটার বা ট্যাবলেট স্ক্রিনের সামনে। বিশেষ করে শিশু ও কিশোররা অনলাইন গেম, সোশ্যাল মিডিয়া কিংবা ইউটিউব-নির্ভর জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। মাঠে ছুটে যাওয়ার জায়গায় তারা এখন ভার্চুয়াল দুনিয়ায় ডুবে থাকে। এতে শরীরচর্চার অভাব তো হচ্ছেই, তার চেয়েও বড় কথা হচ্ছেÑতারা হারাচ্ছে বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা ও পারস্পরিক যোগাযোগের দক্ষতা। এর ফলে তারা একদিকে যেমন শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে, অন্যদিকে মানসিকভাবে বিচ্ছিন্ন, হতাশ ও আবেগতাড়িত হয়ে উঠছে।
শুধু তাই নয়, পড়ালেখার চাপে, পরীক্ষার দৌড়ে এবং প্রতিযোগিতার ভিড়ে আজকের শিক্ষার্থীরা হারিয়ে ফেলছে নিজের স্বাভাবিক বেড়ে ওঠার আনন্দ। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত স্কুল, কোচিং, প্রাইভেটÑএই চক্রে তারা একপ্রকার দমবন্ধ জীবনযাপন করছে। কাক্সিক্ষত ফল না পেলে হতাশায় ভুগছে, আত্মবিশ্বাস হারাচ্ছে এবং কখনো কখনো আত্মহত্যার পথও বেছে নিচ্ছেÑযা সমাজের জন্য গভীর উদ্বেগের বিষয়।
এ বাস্তবতায় শারীরিক শিক্ষা হয়ে উঠতে পারে এক শক্তিশালী প্রতিরোধ ব্যবস্থা। এটি শুধু শরীরকে সক্রিয় রাখে না, বরং মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষা করে, হতাশা ও অবসাদ দূর করে, আত্মনিয়ন্ত্রণ ও সহনশীলতা গড়ে তোলে। এর পাঠ্যবিষয়ে অন্তর্ভুক্ত থাকেÑশারীরিক সুস্থতা, মানসিক স্বাস্থ্য, পুষ্টি, মাদক বিরোধী শিক্ষা, বয়ঃসন্ধিকাল সম্পর্কিত সচেতনতা, সামাজিক আচরণ, দলগত কাজের গুরুত্ব, এবং আরও অনেক জীবনঘনিষ্ঠ বিষয়।
উচ্চতর পর্যায়ে শারীরিক শিক্ষা একটি বৈজ্ঞানিক বিষয়ে রূপ নেয়। এখানে পড়ানো হয় জীববিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, দর্শন, বায়োমেকানিক্স, কিনেসিওলজি, ব্যবস্থাপনা, ক্রীড়া বিজ্ঞান ও পুষ্টিবিজ্ঞান ইত্যাদি। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শারীরিক শিক্ষা ও ক্রীড়া বিজ্ঞান বিষয়ে রয়েছে অনার্স, মাস্টার্স, এমপিএড, এমফিল ও পিএইচডির মতো উচ্চতর ডিগ্রি। ফলে এটি শুধু মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের একটি সহায়ক বিষয় নয়, বরং পেশাগত ও গবেষণাভিত্তিক একটি সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলোÑশারীরিক শিক্ষা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ইতিবাচক জীবনদৃষ্টি গড়ে তোলে। এটি ব্যক্তিকে পরিশ্রমী, শৃঙ্খলাপরায়ণ, নেতৃত্বদানে সক্ষম এবং সুস্থ দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন করে গড়ে তোলে। সমাজে গঠনমূলক ভূমিকা পালনের জন্য একজন সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতেও সহায়তা করে শারীরিক শিক্ষা।
সুতরাং, একবিংশ শতাব্দীর প্রযুক্তিনির্ভর, চাপে পরিপূর্ণ ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত সমাজে শারীরিক শিক্ষা হয়ে উঠতে পারে একটি কার্যকর প্রতিষেধক। এটি শুধু একটি বিষয় নয়, বরং একটি জীবন্ত দর্শনÑযার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা অর্জন করতে পারে সুস্থ, সচেতন ও দক্ষ জীবন গঠনের চাবিকাঠি। তাই সময় এসেছে শারীরিক শিক্ষাকে আমাদের শিক্ষানীতির মূলধারায় এনে এর গুরুত্বকে পূর্ণ মর্যাদা দেওয়ার।
[লেখক : প্রভাষক, সরকারি শারীরিক শিক্ষা কলেজ, বরিশাল]
রায়হান হোসাইন
রোববার, ০৩ আগস্ট ২০২৫
সুস্থতা মানব জীবনের এক অনন্য আশীর্বাদ। একটি সুস্থ দেহ কেবল দৈনন্দিন জীবনযাপনকেই সহজ করে না, বরং তা ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজÑ সব ক্ষেত্রেই ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে। সুস্থতার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে মানুষ প্রাচীনকাল থেকেই সচেতন। রোমান কবি জুভেনাল তার বিখ্যাত উক্তিতে বলেছিলেন, ‘সুস্থ শরীরে সুন্দর মন।’ প্রখ্যাত দার্শনিক অ্যারিস্টোটলও একইভাবে বলেছিলেন, ‘সুস্থ দেহেই বাস করে সুস্থ মন।’ এই উক্তিগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের মধ্যে রয়েছে গভীর আন্তঃসম্পর্ক। যখন শরীর সুস্থ থাকে, তখন মনও সচল, প্রফুল্ল ও কর্মক্ষম থাকে। ফলে ব্যক্তির সার্বিক বিকাশ ত্বরান্বিত হয়।
দার্শনিক প্লেটো ছিলেন শারীরিক শিক্ষার অগ্রপথিকদের একজন। তিনি প্রথম উপলব্ধি করেন যে, শারীরিক সুস্থতা মানুষের জ্ঞানচর্চা ও চিন্তনশীলতার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তার মতে, মানুষের সামগ্রিক বিকাশের জন্য কেবল মানসিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক অনুশীলন যথেষ্ট নয়; প্রয়োজন সুসংগঠিত ও পরিকল্পিত শরীরচর্চা। এই দৃষ্টিভঙ্গি আজকের দিনে এসে আরও বাস্তবতা পেয়েছে, বিশেষ করে যখন প্রযুক্তি আমাদের জীবনকে একদিকে সহজতর করেছে, অন্যদিকে বহু ক্ষেত্রেই মানবিক যোগাযোগ ও শারীরিক সক্রিয়তাকে কমিয়ে দিয়েছে।
আধুনিক শারীরিক শিক্ষা আর কেবল ক্রীড়া বা শরীরচর্চা শেখানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। এটি এখন একটি পূর্ণাঙ্গ একাডেমিক শাখা, যার লক্ষ্য হলো ব্যক্তির শারীরিক, মানসিক, সামাজিক এবং বৌদ্ধিক বিকাশ। ‘শরীরের মাধ্যমে শিক্ষা’Ñএই ধারণার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে সমকালীন শারীরিক শিক্ষা দর্শন। এটি এমন একটি বিষয়, যা পাঠ্যবইয়ের জ্ঞানের বাইরে গিয়ে জীবনের সঙ্গে শিক্ষার্থীর বাস্তব সম্পর্ক গড়ে তোলে। যেমনÑ দৈনন্দিন জীবনে সুশৃঙ্খলতা, সময়জ্ঞান, স্বাস্থ্য সচেতনতা, নেতৃত্ব, পারস্পরিক সহযোগিতা ইত্যাদি গুণাবলী গঠনে শারীরিক শিক্ষার ভূমিকা অপরিসীম।
কিন্তু আজকের বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে শারীরিক শিক্ষা যেন আরও জরুরি হয়ে উঠেছে। প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতির ফলে বর্তমান প্রজন্ম বেশিরভাগ সময় কাটাচ্ছে মোবাইল, কম্পিউটার বা ট্যাবলেট স্ক্রিনের সামনে। বিশেষ করে শিশু ও কিশোররা অনলাইন গেম, সোশ্যাল মিডিয়া কিংবা ইউটিউব-নির্ভর জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। মাঠে ছুটে যাওয়ার জায়গায় তারা এখন ভার্চুয়াল দুনিয়ায় ডুবে থাকে। এতে শরীরচর্চার অভাব তো হচ্ছেই, তার চেয়েও বড় কথা হচ্ছেÑতারা হারাচ্ছে বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা ও পারস্পরিক যোগাযোগের দক্ষতা। এর ফলে তারা একদিকে যেমন শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে, অন্যদিকে মানসিকভাবে বিচ্ছিন্ন, হতাশ ও আবেগতাড়িত হয়ে উঠছে।
শুধু তাই নয়, পড়ালেখার চাপে, পরীক্ষার দৌড়ে এবং প্রতিযোগিতার ভিড়ে আজকের শিক্ষার্থীরা হারিয়ে ফেলছে নিজের স্বাভাবিক বেড়ে ওঠার আনন্দ। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত স্কুল, কোচিং, প্রাইভেটÑএই চক্রে তারা একপ্রকার দমবন্ধ জীবনযাপন করছে। কাক্সিক্ষত ফল না পেলে হতাশায় ভুগছে, আত্মবিশ্বাস হারাচ্ছে এবং কখনো কখনো আত্মহত্যার পথও বেছে নিচ্ছেÑযা সমাজের জন্য গভীর উদ্বেগের বিষয়।
এ বাস্তবতায় শারীরিক শিক্ষা হয়ে উঠতে পারে এক শক্তিশালী প্রতিরোধ ব্যবস্থা। এটি শুধু শরীরকে সক্রিয় রাখে না, বরং মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষা করে, হতাশা ও অবসাদ দূর করে, আত্মনিয়ন্ত্রণ ও সহনশীলতা গড়ে তোলে। এর পাঠ্যবিষয়ে অন্তর্ভুক্ত থাকেÑশারীরিক সুস্থতা, মানসিক স্বাস্থ্য, পুষ্টি, মাদক বিরোধী শিক্ষা, বয়ঃসন্ধিকাল সম্পর্কিত সচেতনতা, সামাজিক আচরণ, দলগত কাজের গুরুত্ব, এবং আরও অনেক জীবনঘনিষ্ঠ বিষয়।
উচ্চতর পর্যায়ে শারীরিক শিক্ষা একটি বৈজ্ঞানিক বিষয়ে রূপ নেয়। এখানে পড়ানো হয় জীববিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, দর্শন, বায়োমেকানিক্স, কিনেসিওলজি, ব্যবস্থাপনা, ক্রীড়া বিজ্ঞান ও পুষ্টিবিজ্ঞান ইত্যাদি। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শারীরিক শিক্ষা ও ক্রীড়া বিজ্ঞান বিষয়ে রয়েছে অনার্স, মাস্টার্স, এমপিএড, এমফিল ও পিএইচডির মতো উচ্চতর ডিগ্রি। ফলে এটি শুধু মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের একটি সহায়ক বিষয় নয়, বরং পেশাগত ও গবেষণাভিত্তিক একটি সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলোÑশারীরিক শিক্ষা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ইতিবাচক জীবনদৃষ্টি গড়ে তোলে। এটি ব্যক্তিকে পরিশ্রমী, শৃঙ্খলাপরায়ণ, নেতৃত্বদানে সক্ষম এবং সুস্থ দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন করে গড়ে তোলে। সমাজে গঠনমূলক ভূমিকা পালনের জন্য একজন সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতেও সহায়তা করে শারীরিক শিক্ষা।
সুতরাং, একবিংশ শতাব্দীর প্রযুক্তিনির্ভর, চাপে পরিপূর্ণ ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত সমাজে শারীরিক শিক্ষা হয়ে উঠতে পারে একটি কার্যকর প্রতিষেধক। এটি শুধু একটি বিষয় নয়, বরং একটি জীবন্ত দর্শনÑযার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা অর্জন করতে পারে সুস্থ, সচেতন ও দক্ষ জীবন গঠনের চাবিকাঠি। তাই সময় এসেছে শারীরিক শিক্ষাকে আমাদের শিক্ষানীতির মূলধারায় এনে এর গুরুত্বকে পূর্ণ মর্যাদা দেওয়ার।
[লেখক : প্রভাষক, সরকারি শারীরিক শিক্ষা কলেজ, বরিশাল]