মিহির কুমার রায়
ইলিশ আমাদের জাতীয় মাছ। এর টেকসই উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে ২০০৪ সালে ‘হিলশা ফিশারিজ ম্যানেজমেন্ট অ্যাকশন প্ল্যান’ প্রণয়ন করা হয় এবং সেই অনুযায়ী বিভিন্ন সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়। এসব উদ্যোগের ফলেই ইলিশের উৎপাদন অনেক গুণ বেড়েছে। বর্তমানে দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনে ইলিশের অবদান প্রায় ১২ শতাংশ এবং জিডিপিতে ১ শতাংশ। সারা বিশ্বের উৎপাদিত ইলিশের ৮০ শতাংশের বেশি আহরিত হয় বাংলাদেশের নদনদী থেকে। শুধু অর্থনৈতিক দিক থেকেই নয়, ইলিশ উপকূলীয় অঞ্চলের জেলে ও মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের জীবন-জীবিকার অন্যতম প্রধান ভিত্তিও।
প্রায় ৬ লাখ মানুষ সরাসরি ইলিশ আহরণে যুক্ত এবং ২০-২৫ লাখ মানুষ পরিবহন, বিপণন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, নৌকা-জাল তৈরি ও বরফ উৎপাদনসহ বিভিন্নভাবে এই পেশার ওপর নির্ভরশীল। বৈচিত্র্যময় জীবনের অধিকারী ইলিশ মূলত সামুদ্রিক হলেও প্রজননের সময় উজানমুখে স্বাদুপানির নদীতে চলে আসে। এ সময় প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৭১ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে সক্ষম এবং কখনো কখনো ১২০০ কিলোমিটার দূরত্বও অতিক্রম করে। এই দীর্ঘ পথচলার মধ্যেই তার শরীর থেকে লবণাক্ততা কমে গিয়ে স্বাদ বাড়ে।
প্রজননের সময় ইলিশকে নিরাপদে ডিম ছাড়ার সুযোগ দিতে প্রতি বছরই নির্দিষ্ট সময় বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা জারি করে সরকার। এবারও ১৪ এপ্রিল থেকে ১১ জুন পর্যন্ত ৫৮ দিনের নিষেধাজ্ঞা জারি ছিল। এরপর ১২ জুন থেকে মাছ ধরার মৌসুম শুরু হয়। এ সময়টাকেই ইলিশ আহরণের ভরা মৌসুম হিসেবে ধরা হয়। ২০২৫ সালে মা ইলিশ সংরক্ষণ অভিযানে ১৭৮টি উপজেলা নির্ধারণ করা হয়।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০০৪-০৫ অর্থবছরে যেখানে ইলিশ আহরণ হয়েছিল ২ লাখ ৭৫ হাজার মেট্রিক টন, সেখানে ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫ লাখ ৭১ হাজার টনে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কিছুটা কমে তা হয় ৫ লাখ ২৯ হাজার টন হয়। সামগ্রিকভাবে গত দেড় দশকে ইলিশের উৎপাদন দ্বিগুণের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে; কিন্তু উৎপাদন বাড়লেও দাম সাধারণ ক্রেতার নাগালের বাইরে।
আশ্চর্যের বিষয়, মোট আহরণের এক শতাংশেরও কম ইলিশ রফতানি হয়। ৯৯ শতাংশ দেশের বাজারে বিক্রি হলেও প্রতি বছর দাম বাড়ছে গড়ে ৩০ থেকে ৩৩ শতাংশ হারে। কৃষি বিপণন অধিদফতর বলছে, ২০১৬ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রতি কেজি ইলিশের দাম বেড়েছে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা। অর্থাৎ ১৮ বছরে দাম বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ।
জেলেদের ভাষ্যÑ মৌসুম শুরুর পর প্রথম দেড় মাস চাহিদামতো মাছ পাওয়া যায়নি, যার পেছনে আবহাওয়াজনিত সমস্যার ভূমিকা ছিল। তবে জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে এসে নৌকাপ্রতি আহরণ কয়েকগুণ বেড়েছে। চট্টগ্রাম বিভাগের উপকূলীয় জেলাগুলো থেকে সবচেয়ে বেশি ইলিশ ধরা পড়ে। এছাড়া ভোলা, বরিশাল, খুলনা ও চাঁদপুরের নদ-নদীতেও প্রচুর ইলিশ পাওয়া যায়।
তবু বাজারে ইলিশের দাম ক্রেতার সাধ্যের বাইরে। বরিশালের বাজারে দেখা গেছে, এক কেজি বা তার বেশি ওজনের ইলিশ বিক্রি হয়েছে ১৩৭৫ টাকা, মাঝারি সাইজ ১১০০ টাকা, ৫০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ৯০০ টাকা এবং ছোট ইলিশ ৭০০-৭৫০ টাকায়। আড়তে এসব ইলিশ বরফ দিয়ে সংরক্ষণ করে আরও বেশি দামে বিক্রি হয়। পাইকারি বাজারে বড় ইলিশের কেজি ২০০০ থেকে ৩০০০ টাকা পর্যন্ত ওঠে। অথচ সরবরাহে কোনো ঘাটতি নেই।
মূল সমস্যা হলো বাজার ব্যবস্থাপনায়। ব্যবসায়ীদের ‘অদৃশ্য সিন্ডিকেট’ এবং চার-পাঁচ হাত ঘুরে বিক্রি হওয়ার কারণে দাম বাড়ছে কয়েক গুণ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কিছু অসাধু অনলাইন ব্যবসায়ীর প্রতারণা, যারা ইলিশ বিক্রির নামে ক্রেতাদের ঠকাচ্ছে।
একসময় ইলিশ ছিল মধ্যবিত্তের ঘরোয়া মাছ। এখন তা উপলক্ষের খাবারে রূপ নিয়েছে। উচ্চবিত্তের নিত্যভোজ্য হলেও নিম্নবিত্তের কাছে ইলিশ এখন দীর্ঘশ্বাসের নাম, যারা ঈদ বা পূজাতেও হয়তো এক টুকরো ইলিশ খেতে পারে না। যখন কেজিপ্রতি দাম ২৮০০-৩২০০ টাকা ছুঁইছুঁই, তখন প্রশ্ন ওঠেÑ ‘ইলিশ কার?’
তবে আশার কথা হলো, পাবনার তহুরা আজিজ ফাউন্ডেশন একটি অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। শহরের কালাচাঁদপাড়ায় আয়োজিত ‘গরিবের ইলিশ উৎসব’-এ শতাধিক দরিদ্র মানুষকে ইলিশ ভোজ করানো হয়। এটি যেমন উৎসব, তেমনি নীরব প্রতিবাদÑঅর্থনৈতিক বৈষম্য ও বাজার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে।
সরকার প্রতি বছর মা ইলিশ সংরক্ষণে অভিযান চালায়, জাটকা ধরা নিষিদ্ধ করে, আইন করে। কিন্তু সমস্যা হলো, এ উদ্যোগগুলোর ধারাবাহিকতা নেই। আইন প্রয়োগ দুর্বল, সচেতনতা কম। অন্যদিকে অসাধু ব্যবসায়ীরা মুনাফার লোভে ইলিশ হিমাগারে আটকে রেখে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে। নদীমাতৃক এ দেশের মাছের রাজনীতিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। কখনো তা কূটনৈতিক কার্ড, কখনো নির্বাচনী মোহরা। ফলে মাছ হয়ে ওঠে রাজনৈতিক উপকরণ।
আজকের বাস্তবতায় প্রশ্ন জাগেÑ ইলিশ কি শুধু সংখ্যায় বাড়ছে, নাকি তা সামাজিক-বৈষম্যের প্রতীক হয়ে উঠছে? গরিবের ইলিশ কি কেবলই স্বপ্নে থাকবে?
[লেখক : সাবেক ডিন (ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ) ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা]
মিহির কুমার রায়
সোমবার, ০৪ আগস্ট ২০২৫
ইলিশ আমাদের জাতীয় মাছ। এর টেকসই উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে ২০০৪ সালে ‘হিলশা ফিশারিজ ম্যানেজমেন্ট অ্যাকশন প্ল্যান’ প্রণয়ন করা হয় এবং সেই অনুযায়ী বিভিন্ন সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়। এসব উদ্যোগের ফলেই ইলিশের উৎপাদন অনেক গুণ বেড়েছে। বর্তমানে দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনে ইলিশের অবদান প্রায় ১২ শতাংশ এবং জিডিপিতে ১ শতাংশ। সারা বিশ্বের উৎপাদিত ইলিশের ৮০ শতাংশের বেশি আহরিত হয় বাংলাদেশের নদনদী থেকে। শুধু অর্থনৈতিক দিক থেকেই নয়, ইলিশ উপকূলীয় অঞ্চলের জেলে ও মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের জীবন-জীবিকার অন্যতম প্রধান ভিত্তিও।
প্রায় ৬ লাখ মানুষ সরাসরি ইলিশ আহরণে যুক্ত এবং ২০-২৫ লাখ মানুষ পরিবহন, বিপণন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, নৌকা-জাল তৈরি ও বরফ উৎপাদনসহ বিভিন্নভাবে এই পেশার ওপর নির্ভরশীল। বৈচিত্র্যময় জীবনের অধিকারী ইলিশ মূলত সামুদ্রিক হলেও প্রজননের সময় উজানমুখে স্বাদুপানির নদীতে চলে আসে। এ সময় প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৭১ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে সক্ষম এবং কখনো কখনো ১২০০ কিলোমিটার দূরত্বও অতিক্রম করে। এই দীর্ঘ পথচলার মধ্যেই তার শরীর থেকে লবণাক্ততা কমে গিয়ে স্বাদ বাড়ে।
প্রজননের সময় ইলিশকে নিরাপদে ডিম ছাড়ার সুযোগ দিতে প্রতি বছরই নির্দিষ্ট সময় বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা জারি করে সরকার। এবারও ১৪ এপ্রিল থেকে ১১ জুন পর্যন্ত ৫৮ দিনের নিষেধাজ্ঞা জারি ছিল। এরপর ১২ জুন থেকে মাছ ধরার মৌসুম শুরু হয়। এ সময়টাকেই ইলিশ আহরণের ভরা মৌসুম হিসেবে ধরা হয়। ২০২৫ সালে মা ইলিশ সংরক্ষণ অভিযানে ১৭৮টি উপজেলা নির্ধারণ করা হয়।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০০৪-০৫ অর্থবছরে যেখানে ইলিশ আহরণ হয়েছিল ২ লাখ ৭৫ হাজার মেট্রিক টন, সেখানে ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫ লাখ ৭১ হাজার টনে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কিছুটা কমে তা হয় ৫ লাখ ২৯ হাজার টন হয়। সামগ্রিকভাবে গত দেড় দশকে ইলিশের উৎপাদন দ্বিগুণের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে; কিন্তু উৎপাদন বাড়লেও দাম সাধারণ ক্রেতার নাগালের বাইরে।
আশ্চর্যের বিষয়, মোট আহরণের এক শতাংশেরও কম ইলিশ রফতানি হয়। ৯৯ শতাংশ দেশের বাজারে বিক্রি হলেও প্রতি বছর দাম বাড়ছে গড়ে ৩০ থেকে ৩৩ শতাংশ হারে। কৃষি বিপণন অধিদফতর বলছে, ২০১৬ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রতি কেজি ইলিশের দাম বেড়েছে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা। অর্থাৎ ১৮ বছরে দাম বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ।
জেলেদের ভাষ্যÑ মৌসুম শুরুর পর প্রথম দেড় মাস চাহিদামতো মাছ পাওয়া যায়নি, যার পেছনে আবহাওয়াজনিত সমস্যার ভূমিকা ছিল। তবে জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে এসে নৌকাপ্রতি আহরণ কয়েকগুণ বেড়েছে। চট্টগ্রাম বিভাগের উপকূলীয় জেলাগুলো থেকে সবচেয়ে বেশি ইলিশ ধরা পড়ে। এছাড়া ভোলা, বরিশাল, খুলনা ও চাঁদপুরের নদ-নদীতেও প্রচুর ইলিশ পাওয়া যায়।
তবু বাজারে ইলিশের দাম ক্রেতার সাধ্যের বাইরে। বরিশালের বাজারে দেখা গেছে, এক কেজি বা তার বেশি ওজনের ইলিশ বিক্রি হয়েছে ১৩৭৫ টাকা, মাঝারি সাইজ ১১০০ টাকা, ৫০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ৯০০ টাকা এবং ছোট ইলিশ ৭০০-৭৫০ টাকায়। আড়তে এসব ইলিশ বরফ দিয়ে সংরক্ষণ করে আরও বেশি দামে বিক্রি হয়। পাইকারি বাজারে বড় ইলিশের কেজি ২০০০ থেকে ৩০০০ টাকা পর্যন্ত ওঠে। অথচ সরবরাহে কোনো ঘাটতি নেই।
মূল সমস্যা হলো বাজার ব্যবস্থাপনায়। ব্যবসায়ীদের ‘অদৃশ্য সিন্ডিকেট’ এবং চার-পাঁচ হাত ঘুরে বিক্রি হওয়ার কারণে দাম বাড়ছে কয়েক গুণ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কিছু অসাধু অনলাইন ব্যবসায়ীর প্রতারণা, যারা ইলিশ বিক্রির নামে ক্রেতাদের ঠকাচ্ছে।
একসময় ইলিশ ছিল মধ্যবিত্তের ঘরোয়া মাছ। এখন তা উপলক্ষের খাবারে রূপ নিয়েছে। উচ্চবিত্তের নিত্যভোজ্য হলেও নিম্নবিত্তের কাছে ইলিশ এখন দীর্ঘশ্বাসের নাম, যারা ঈদ বা পূজাতেও হয়তো এক টুকরো ইলিশ খেতে পারে না। যখন কেজিপ্রতি দাম ২৮০০-৩২০০ টাকা ছুঁইছুঁই, তখন প্রশ্ন ওঠেÑ ‘ইলিশ কার?’
তবে আশার কথা হলো, পাবনার তহুরা আজিজ ফাউন্ডেশন একটি অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। শহরের কালাচাঁদপাড়ায় আয়োজিত ‘গরিবের ইলিশ উৎসব’-এ শতাধিক দরিদ্র মানুষকে ইলিশ ভোজ করানো হয়। এটি যেমন উৎসব, তেমনি নীরব প্রতিবাদÑঅর্থনৈতিক বৈষম্য ও বাজার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে।
সরকার প্রতি বছর মা ইলিশ সংরক্ষণে অভিযান চালায়, জাটকা ধরা নিষিদ্ধ করে, আইন করে। কিন্তু সমস্যা হলো, এ উদ্যোগগুলোর ধারাবাহিকতা নেই। আইন প্রয়োগ দুর্বল, সচেতনতা কম। অন্যদিকে অসাধু ব্যবসায়ীরা মুনাফার লোভে ইলিশ হিমাগারে আটকে রেখে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে। নদীমাতৃক এ দেশের মাছের রাজনীতিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। কখনো তা কূটনৈতিক কার্ড, কখনো নির্বাচনী মোহরা। ফলে মাছ হয়ে ওঠে রাজনৈতিক উপকরণ।
আজকের বাস্তবতায় প্রশ্ন জাগেÑ ইলিশ কি শুধু সংখ্যায় বাড়ছে, নাকি তা সামাজিক-বৈষম্যের প্রতীক হয়ে উঠছে? গরিবের ইলিশ কি কেবলই স্বপ্নে থাকবে?
[লেখক : সাবেক ডিন (ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ) ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা]