ফজলে রাব্বি মোহাম্মদ আহ্সান
বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য বিদেশ গমন দিন দিন কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে পড়ছে। একের পর এক দেশ বাংলাদেশিদের ‘অন-অ্যারাইভাল‘ ভিসা বাতিল করে দিচ্ছে। সীমিত করে দিয়েছে ভ্রমণ ভিসার সুযোগও। ইন্দোনেশিয়া, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, এমনকি শ্রীলংকার মতো তুলনামূলক ছোট ও পর্যটননির্ভর দেশগুলো পর্যন্ত এখন বাংলাদেশিদের জন্য কঠোর শর্ত জুড়ে দিচ্ছে। নতুন দেশও মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।
আচরণগত অর্থনীতির লেন্সে বা পরকলায় বেশকিছু ধারণার ভিত্তিতে বাংলাদেশিদের বিদেশগমনের এ অন্তরায় বা বাধাসমূহকে বিশ্লেষণ করা যাকÑ কিছু বাংলাদেশি নাগরিকের অবৈধ অভিবাসন বা ভিসা শর্ত লঙ্ঘনের ঘটনাকে সমগ্র জাতির জন্য সাধারণীকরণ করা হচ্ছে। যেমন- শ্রীলঙ্কা বা ইন্দোনেশিয়ার সরকার অল্প কয়েকজন অপরাধীর কারণে সমস্ত বাংলাদেশিদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপে উদ্যত। দেশগুলো বাংলাদেশিদের সম্পর্কে নেতিবাচক সংবাদ; যেমন- অনুমোদনহীন অতিরিক্ত অবস্থান, অবৈধ কাজে নিয়োজন, ইত্যাদিকে বেশি গুরুত্বারোপ করে যা নীতিনির্ধারকদের সিদ্ধান্ত বা সিদ্ধান্তসমূহকে ঋণাত্মকভাবে প্রভাবিত করে।
একটি দেশ যেমন- মালয়েশিয়া যখন বাংলাদেশিদের ভিসা নীতি কঠোর করে, অন্য দেশগুলোও ‘অনুসরণের মানসিকতা‘ নিয়ে একই পথ বেছে নেয়। উদাহরণস্বরূপ, থাইল্যান্ড বা ভিয়েতনামের নীতি-নির্ধারকরা মনে করতে পারে যে, অন্যান্য দেশ যদি নিষেধাজ্ঞা দেয় তবে আমাদেরও সতর্ক হওয়া উচিত। এটি ‘তথ্য ঢেউ’ এর উদাহরণ। যেখানে সীমিত তথ্যের ভিত্তিতে অন্যদের অনুসরণ করা হয়।
পর্যটননির্ভর দেশগুলো যেমন- কম্বোডিয়া বা শ্রীলঙ্কা অর্থনৈতিক ক্ষতির ভয় থেকে কঠোর নীতি নেয়। তারা মনে করে, কিছু বাংলাদেশি পর্যটক যদি অবৈধভাবে কাজে যোগ দেয় বা অপরাধ করে তাহলে তাদের দেশের অর্থনীতি ও নিরাপত্তার জন্য ‘দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি’ বয়ে আনবে। বাংলাদেশিদের ভিসা দেওয়াকে একটি ‘উচ্চ ঝুঁকি’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যদিও প্রকৃত সংখ্যায় অপরাধীর হার কম।
আচরণগত অর্থনীতিতে ‘ট্রাস্ট’ বা বিশ্বাস একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য ভিসা শর্ত কঠিন হওয়ার পেছনে ‘প্রাতিষ্ঠানিক অবিশ্বাস’ কাজ করে। উদাহরণস্বরূপ- ডকুমেন্ট জালিয়াতির ঘটনা, যেমন: নকল ‘ব্যাংক স্টেটমেন্ট’। ভিসার শর্তাবলী লঙ্ঘন, ভ্রমণ ভিসায় গিয়ে কাজ করা ইত্যাদি। এ অবিশ্বাস পরিচালন ব্যয় বাড়ায়। ফলে দেশগুলো অতিরিক্ত শর্ত আরোপ করে। কিছু এজেন্ট, ভিসা কনসালট্যান্ট, এয়ারলাইন্স বাংলাদেশিদের ভুল তথ্য দিয়ে বিদেশে পাঠায়; যা গন্তব্য দেশের জন্য ঝুঁকি তৈরি করে। এতে গন্তব্য দেশগুলো প্রতিরক্ষামূলক নীতি গ্রহণ করে।
বাংলাদেশিদের ভ্রমণে বাধার মূল কারণ কতিপয় অপরাধীর কর্মকা-ের সমষ্টিগত ফলাফল। বৈশ্বিকভাবে ‘মাইগ্রেশন কন্ট্রোল’ বা অভিবাসন নিয়ন্ত্রন বাড়ছে। যা ন্যায্য ও অন্যায্য উভয় প্রকার নাগরিককে প্রভাবিত করে।
এক্ষেত্রে যদি ডকুমেন্ট ভেরিফিকেশন ডিজিটালাইজেশন যেমন- ‘ব্লকচেইন’ ভিত্তিক জীবন-বৃত্তান্ত মূল্যায়ন করা হয় বা দূতাবাসগুলোর সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়, তবে গন্তব্য দেশ বা দেশসমূহের অযাচিত যন্ত্রনাকর পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ মিলবে। দেশের ভাবমূর্তি রক্ষায় কূটনৈতিক প্রচেষ্টা যদি আরো জোরদার করা হয় তবে অনেক ক্ষেত্রেই বিদেশ ভ্রমণের প্যারা বা যন্ত্রনা থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব।
নাগরিক সচেতনতায় ভিসা শর্ত মেনে চলার বিষয়ে গণসচেতনতা তৈরি, অবৈধ এজেন্টদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ, শ্রম বা কর্মসংস্থানের জন্য বিকল্প বাজার অন্বেষণ করা জরুরি হয়ে পড়ছে। যেসব দেশে এখনও ভিসানীতিতে শিথিলতা আছে, যেমন: আজারবাইজান, জর্জিয়া, সেসব দেশগুলোতে পর্যটন বা ব্যবসায়িক সুযোগ গ্রহণ করা। যা পরবর্তীতে কর্মসংস্থানে সুদূরপ্রসারি প্রভাব ফেলতে সক্ষম।
পরিশেষে আচরণগত অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশিদের বিদেশগমনে এ বাধা বা অন্তরায়সমূহের পেছনে ‘স্টেরিওটাইপিং বা সাধারণীকরণ’, ‘হার্ড ইফেক্ট বা দল তথা পক্ষভুক্ত করা’, ‘লস এভারশন’ এবং ‘ট্রাস্ট ডেফিসিট’ বা ‘অবিশ্বাস তথা সন্দেহ প্রবণতা’ প্রধান ভূমিকা রাখছে। এ সমস্যা সমাধানে ব্যক্তি সচেতনতা ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। তবেই বাংলাদেশিদের জন্য বিদেশ ভ্রমণে মুক্তি মিলবে কঠোর শর্তের বেড়াজাল বা হয়রানি থেকে।
[লেখক : ডেপুটি চিফ (প্লানিং), ঢাকা ওয়াসা]
ফজলে রাব্বি মোহাম্মদ আহ্সান
সোমবার, ০৪ আগস্ট ২০২৫
বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য বিদেশ গমন দিন দিন কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে পড়ছে। একের পর এক দেশ বাংলাদেশিদের ‘অন-অ্যারাইভাল‘ ভিসা বাতিল করে দিচ্ছে। সীমিত করে দিয়েছে ভ্রমণ ভিসার সুযোগও। ইন্দোনেশিয়া, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, এমনকি শ্রীলংকার মতো তুলনামূলক ছোট ও পর্যটননির্ভর দেশগুলো পর্যন্ত এখন বাংলাদেশিদের জন্য কঠোর শর্ত জুড়ে দিচ্ছে। নতুন দেশও মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।
আচরণগত অর্থনীতির লেন্সে বা পরকলায় বেশকিছু ধারণার ভিত্তিতে বাংলাদেশিদের বিদেশগমনের এ অন্তরায় বা বাধাসমূহকে বিশ্লেষণ করা যাকÑ কিছু বাংলাদেশি নাগরিকের অবৈধ অভিবাসন বা ভিসা শর্ত লঙ্ঘনের ঘটনাকে সমগ্র জাতির জন্য সাধারণীকরণ করা হচ্ছে। যেমন- শ্রীলঙ্কা বা ইন্দোনেশিয়ার সরকার অল্প কয়েকজন অপরাধীর কারণে সমস্ত বাংলাদেশিদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপে উদ্যত। দেশগুলো বাংলাদেশিদের সম্পর্কে নেতিবাচক সংবাদ; যেমন- অনুমোদনহীন অতিরিক্ত অবস্থান, অবৈধ কাজে নিয়োজন, ইত্যাদিকে বেশি গুরুত্বারোপ করে যা নীতিনির্ধারকদের সিদ্ধান্ত বা সিদ্ধান্তসমূহকে ঋণাত্মকভাবে প্রভাবিত করে।
একটি দেশ যেমন- মালয়েশিয়া যখন বাংলাদেশিদের ভিসা নীতি কঠোর করে, অন্য দেশগুলোও ‘অনুসরণের মানসিকতা‘ নিয়ে একই পথ বেছে নেয়। উদাহরণস্বরূপ, থাইল্যান্ড বা ভিয়েতনামের নীতি-নির্ধারকরা মনে করতে পারে যে, অন্যান্য দেশ যদি নিষেধাজ্ঞা দেয় তবে আমাদেরও সতর্ক হওয়া উচিত। এটি ‘তথ্য ঢেউ’ এর উদাহরণ। যেখানে সীমিত তথ্যের ভিত্তিতে অন্যদের অনুসরণ করা হয়।
পর্যটননির্ভর দেশগুলো যেমন- কম্বোডিয়া বা শ্রীলঙ্কা অর্থনৈতিক ক্ষতির ভয় থেকে কঠোর নীতি নেয়। তারা মনে করে, কিছু বাংলাদেশি পর্যটক যদি অবৈধভাবে কাজে যোগ দেয় বা অপরাধ করে তাহলে তাদের দেশের অর্থনীতি ও নিরাপত্তার জন্য ‘দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি’ বয়ে আনবে। বাংলাদেশিদের ভিসা দেওয়াকে একটি ‘উচ্চ ঝুঁকি’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যদিও প্রকৃত সংখ্যায় অপরাধীর হার কম।
আচরণগত অর্থনীতিতে ‘ট্রাস্ট’ বা বিশ্বাস একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য ভিসা শর্ত কঠিন হওয়ার পেছনে ‘প্রাতিষ্ঠানিক অবিশ্বাস’ কাজ করে। উদাহরণস্বরূপ- ডকুমেন্ট জালিয়াতির ঘটনা, যেমন: নকল ‘ব্যাংক স্টেটমেন্ট’। ভিসার শর্তাবলী লঙ্ঘন, ভ্রমণ ভিসায় গিয়ে কাজ করা ইত্যাদি। এ অবিশ্বাস পরিচালন ব্যয় বাড়ায়। ফলে দেশগুলো অতিরিক্ত শর্ত আরোপ করে। কিছু এজেন্ট, ভিসা কনসালট্যান্ট, এয়ারলাইন্স বাংলাদেশিদের ভুল তথ্য দিয়ে বিদেশে পাঠায়; যা গন্তব্য দেশের জন্য ঝুঁকি তৈরি করে। এতে গন্তব্য দেশগুলো প্রতিরক্ষামূলক নীতি গ্রহণ করে।
বাংলাদেশিদের ভ্রমণে বাধার মূল কারণ কতিপয় অপরাধীর কর্মকা-ের সমষ্টিগত ফলাফল। বৈশ্বিকভাবে ‘মাইগ্রেশন কন্ট্রোল’ বা অভিবাসন নিয়ন্ত্রন বাড়ছে। যা ন্যায্য ও অন্যায্য উভয় প্রকার নাগরিককে প্রভাবিত করে।
এক্ষেত্রে যদি ডকুমেন্ট ভেরিফিকেশন ডিজিটালাইজেশন যেমন- ‘ব্লকচেইন’ ভিত্তিক জীবন-বৃত্তান্ত মূল্যায়ন করা হয় বা দূতাবাসগুলোর সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়, তবে গন্তব্য দেশ বা দেশসমূহের অযাচিত যন্ত্রনাকর পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ মিলবে। দেশের ভাবমূর্তি রক্ষায় কূটনৈতিক প্রচেষ্টা যদি আরো জোরদার করা হয় তবে অনেক ক্ষেত্রেই বিদেশ ভ্রমণের প্যারা বা যন্ত্রনা থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব।
নাগরিক সচেতনতায় ভিসা শর্ত মেনে চলার বিষয়ে গণসচেতনতা তৈরি, অবৈধ এজেন্টদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ, শ্রম বা কর্মসংস্থানের জন্য বিকল্প বাজার অন্বেষণ করা জরুরি হয়ে পড়ছে। যেসব দেশে এখনও ভিসানীতিতে শিথিলতা আছে, যেমন: আজারবাইজান, জর্জিয়া, সেসব দেশগুলোতে পর্যটন বা ব্যবসায়িক সুযোগ গ্রহণ করা। যা পরবর্তীতে কর্মসংস্থানে সুদূরপ্রসারি প্রভাব ফেলতে সক্ষম।
পরিশেষে আচরণগত অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশিদের বিদেশগমনে এ বাধা বা অন্তরায়সমূহের পেছনে ‘স্টেরিওটাইপিং বা সাধারণীকরণ’, ‘হার্ড ইফেক্ট বা দল তথা পক্ষভুক্ত করা’, ‘লস এভারশন’ এবং ‘ট্রাস্ট ডেফিসিট’ বা ‘অবিশ্বাস তথা সন্দেহ প্রবণতা’ প্রধান ভূমিকা রাখছে। এ সমস্যা সমাধানে ব্যক্তি সচেতনতা ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। তবেই বাংলাদেশিদের জন্য বিদেশ ভ্রমণে মুক্তি মিলবে কঠোর শর্তের বেড়াজাল বা হয়রানি থেকে।
[লেখক : ডেপুটি চিফ (প্লানিং), ঢাকা ওয়াসা]