শেখর ভট্টাচার্য
জুলাই অভ্যুত্থানে আঁকা একটি দেয়াল-চিত্র
ভিন্নমত প্রকাশের স্বাধীনতা কিংবা মতপ্রকাশের স্বাভাবিক পথ যখন সংকুচিত হয়ে আসে তখন আমাদের সামনে এসে উপস্থিত হন ফ্রাঙ্কো ম্যারিক আরোয়েট ভলতেয়ার। যিনি বিশ্বব্যাপী ভলতেয়ার নামেই পরিচিত। গণতন্ত্রের প্রাথমিক শিক্ষার শ্রেণিকক্ষে তার নাম সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়ে থাকে; কারণ গণতন্ত্রের ভিত্তি হলো মানুষের মতপ্রকাশের অধিকার।
ভলতেয়ার অষ্টাদশ শতকের সবচেয়ে প্রভাবশালী ফরাসি সাহিত্যিক, ইতিহাসবিদ ও দার্শনিক। ভলতেয়ারের যে উক্তি মানুষকে চিরকাল উজ্জীবিত করে রাখবে এবং সকল কালে সকল সমাজে যা প্রাসঙ্গিক হয়ে থাকবে তা হলো, ‘তোমার মতের সঙ্গে আমি হয়তো একমত নাও হতে পারি; কিন্তু তোমার মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য আমি আমার জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করে যাব।’ ভলতেয়ারের এই উক্তির প্রাসঙ্গিকতা গণতন্ত্রকামি সমাজ ও রাষ্ট্রের নাগরিকদের কাছে অনন্তকাল থেকে যাবে বলে বিশ্বাস করি। তার এই উক্তিটি এতোই ব্যবহৃত যে মত প্রকাশের স্বাধীনতা সামান্য বাধাগ্রস্ত হলে মানুষ তার এই মানবিক বাণী কে স্মরণ করতে বাধ্য হন।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে উচ্চস্বরে অন্যের মতামতকে বাতিল করে দিতে কিংবা উপড়ে ফেলে দিতে নানা স্তরের নেতাদের আহ্বান শুনতে পাওয়া যায়। প্রশ্ন হলোÑ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় যদি শত ফুল ফোটানোর অর্থাৎ শত মতপ্রকাশের আদর্শ পরিবেশ তৈরির প্রচেষ্টা না থাকে তাহলে ভিন্ন মত প্রকাশকে রুদ্ধ করে দিতে সদম্ভ বক্তব্য প্রকাশ কী যৌক্তিক।
গণতান্ত্রিক পরিবেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শর্ত মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। মত প্রকাশের স্বাধীনতা যখন সংকুচিত কিংবা বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে তখন অশ্লীল, বেলাগাম মতামত, বক্তব্য কিংবা স্লোগান হিসাবে উচ্চারিত হয়ে থাকে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রেও সীমা নির্ধারিত করা আছে। এই স্বাধীনতার সীমার কথা রাজনীতি বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা জেনে থাকেন উনিশ শতকের দার্শনিক স্টুয়ার্ট মিলের কাছ থেকে। এই চিন্তাটিও বহুল ব্যবহৃত এবং আলোচিত। সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক কার্যক্রম লক্ষ্য করলে মিলের উক্তিটিকে শুধু প্রাসঙ্গিকই মনে হবে না, মনে হবে অবশ্য অনুসরণীয় রাজনৈতিক মতদর্শন। মিল বলেছিলেন, একজন ব্যক্তির নিজেকে প্রকাশ করার অধিকার ততদূর পর্যন্ত যতদূর পর্যন্ত তা অন্য ব্যক্তির ক্ষতির কারণ না হয়। আবার মিল এটাও বলেছিলেন যে, স্বাধীনতার এই মূলনীতি যদি মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে চিন্তা করি তাহলে যে কোনো একটি মতকে স্তব্ধ করে দেওয়ার অর্থ হতে পারে সত্যকে স্তব্ধ করার শামিল।
ভিন্নমতকে উচ্চতর মত দিয়ে লাগামে নিয়ে আসতে হয়। এক্ষেত্রে জোর জবরদস্তি লাগাম নয়, অন্যের মতামতের প্রতি সম্মান, শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে উচ্চতর রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবেশ তৈরির প্রচেষ্টার মাধ্যমে সমাজে রাজনৈতিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করাই হলো রাজনীতির ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরা।
মতামতের সঙ্গে সংলাপ করতে হয়, সংঘাত নয়। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপরেই গণতন্ত্র চর্চার শক্তি দাঁড়িয়ে থাকে। সবার মত-আলোচনা-সমালোচনা না শুনলে গণতন্ত্র ব্যবস্থাপনার অন্যতম স্তম্ভ যে জবাবদিহি তা আর থাকে না। যে কোন পক্ষকে স্তব্ধ করে দিলে সেই পক্ষের মতামত শোনা থেকে নাগরিক সমাজ বঞ্চিত হয়। যে গোষ্ঠী বা দল স্তব্ধ হয়ে যায় সেই স্তব্ধতা থেকে তিল তিল করে ঘৃণা, দ্রোহের জন্ম নেয়। সংলাপের পরিবেশ বিরাজ করতে থাকলে যে কোন দল বা গোষ্ঠীর ইতিবাচক বা নেতিবাচক মতামত নাগরিক সমাজ কিংবা সরকারের নিকট সহজেই পৌছে যায়। সকল পক্ষ যখন সকল পক্ষের মতামতকে অনুধাবন করতে পারে তখন সংঘাত, প্রতিহিংসার সম্ভাবনা কমে আসে।
দুঃখের বিষয় আমরা গত কয়েক দশক থেকে দেখতে পাচ্ছি আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সহিষ্ণুতা ক্রমাগত কমে আসছে আমরা পরস্পরকে নির্মূল, নিশ্চিহ্ন করতে উদ্ধ্বত হচ্ছি। মনে রাখতে হবে বিশ্বরাজনীতির ইতিহাসে কোন সমাজ বা রাষ্ট্র আজ পর্যন্ত বিরোধী গোষ্ঠীকে নির্মূল করে দিয়ে গণতন্ত্রের পথ সুগম করতে পারেনি বরঞ্চ নিজেদের শক্তিক্ষয় করে নিজেরাই নির্মুল হয়ে গেছে। মানুষকে তার কথাটা বলতে দিতে হবে এটি যেমন সত্যি, আবার কেউ এমন ‘যা-তা’ বলতে পারবেন না, যা অন্যের অধিকারকে ক্ষুণœ করে। যেমন কেউ যদি অনলাইনে একজন প্রান্তিকীকৃত জাতিগত বা ধর্মীয় বা লিঙ্গ পরিচয়ের মানুষের সম্পর্কে ভুল তথ্য দেয় বা ছড়ায় তাহলে সেটি শাস্তিযোগ্য হবে, কারণ ভুল তথ্য বা অপতথ্য ছড়িয়ে দেওয়াও অপরাধ! ভুল তথ্য বা মিস-ইনফরমেশন আর অপতথ্য বা ডিজইনফরমেশন দুই জিনিস হলেও উভয়েই নাগরিকের অধিকার ক্ষুণœ করতে ব্যবহৃত হতে পারে। ভুল তথ্য কেউ কেউ না জেনেও ছড়াতে পারেন। তবে অপতথ্য তৈরি করতে হয়, বিনিয়োগ লাগে। অপতথ্য প্রচার দ-নীয়। আইনের শাসন থাকলে সে শাস্তি বিধানে আগের নিবর্তনমূলক আইন ব্যবহার না করে ভিন্ন আইনি ব্যবস্থায় যেতে হবে। ফলে মতপ্রকাশের অধিকার যদি অন্যের অধিকার হরণ করে, তবে সেটি অপরাধ হয়। পার্থক্যটা অনেক বড় না হলেও একেবারে কমও না।
ফ্রিডম হাউস ইনডেক্স (২০২৪) অনুযায়ী, বাংলাদেশ সাংবাদিকদের জন্য ‘খুব সংকটপূর্ণ’ একটি দেশ, যেখানে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা আংশিক। এর কারণ হয়তো এই যে, গত সরকারের আমলের নিবর্তনমূলক আইনগুলো, যেমন- আইসিটি আইন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বা সাইবার নিরাপত্তা আইনগুলো প্রণয়ন ও সেগুলোর নিপীড়নমূলক প্রয়োগ এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে ছিল, যা ক্ষমতায় থাকা সরকার ছাড়া আর কাউকে নিরাপত্তা দেয়নি। বরং এ আইনগুলো দিয়ে নাগরিকের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ এবং সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠ রোধ করা হয়েছিল বছরের পর বছর। সামাজিক মাধ্যমে সরকারের যেকোনো সমালোচনা এসব আইনের বলে যে কাউকে কারান্তরীণ করা ছিলো সহজ। মতামতকে কারান্তরীণ না করে মতামতকে মুক্ত করে দিলে মতামত তার যোগ্য স্থান নিতে পারে।
মতপ্রকাশের স্বাধীনতা যখন হুমকির সম্মুখীন হয় তখন রাজনৈতিক ও সামাজিক বলয় নীরবতার সংস্কৃতির আচ্ছাদনে আচ্ছাদিত হয়ে যায়। নীরবতার সংস্কৃতি যে কোন শাসক দলের জন্য অত্যন্ত ভীতিকর একটি রাজনৈতিক, সামাজিক অবস্থা। নীরবতার সংস্কৃতি যখন সমাজে বহমান থাকে তখন শাসকদের শাসনের আরশিতে নাগরিকের মুখ দেখা গেলেও মনোভাব আঁচ করা কঠিন হয়ে যায়। নাগরিক মনোভাবকে অনুধাবন না করে কিংবা ভুলভাবে পাঠ করলে শাসকদের সরকার পরিচালনা ভুল হতে বাধ্য। এই ভুল থেকেই অপশাসন, দুঃশাসন নেমে আসে। যদিও সরকারকে ধারণা দেয়া হয় নাগরিকেরা সুশাসনের সুবাতাসে অত্যন্ত আনন্দিত, সন্তুষ্ট।
বৈষম্যের প্রতি বিরোধিতা করেই কিন্তু চব্বিশের গণআন্দোলনের সূচনা হয়েছিলো। স্লোগান উঠেছিলো ‘বঙ্গবন্ধুর বাংলায় বৈষম্যের ঠাঁই নাই।’ নিপীড়িত প্রান্তিক মানুষদের সব চেয়ে বড় স্বপ্ন হলো বৈষম্য হ্রাস করে একটি সমতার সমাজ গড়া। সমাজের গহীনের এই স্বপ্নকে অনুধাবন করতে হলে আমাদের সবার মতামতকে শুনতে হবে। সমাজে প্রতি দিন মানুষ সম্বেত সুরে কথা বলতে থাকে। উচ্চবিত্ত, প্রভাবশালী, সমাজ নিয়ন্ত্রকদের কথা শুনে আমরা অভ্যস্ত। রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত যাদের নিম্নস্বর শাসকদের কিংবা রাজনৈতিক দলগুলোর কানে পৌঁছতে শত বাধা, শত বেগ পোহাতে হয় সেই বাধাকে সরিয়ে দেয়া। এই যে আমরা প্রতিদিন বলে থাকি জনগণের চাওয়া পাওয়ার কথা ভাবতে হবে। জনগণ! কোন জনগণ। কার জনগণ। আমরা যে জনগণের প্রতিনিধিত্ব করি সে জনগণ হলো ক্ষমতার মসনদের ধারে কাছে থাকা প্রভাব বিস্তারকারী জনগণ।
এবার সময় হয়েছে সকল আন্দোলন, বিপ্লবে যে ‘জনগণ’ রক্ত ঝরায়, তাদের সামনে নিয়ে আসার। আমরা যাদের সামনে দেখে থাকি তারা হচ্ছে মুখোশ আর আমরা যাদের দেখিনা তারা হলো মুখ। আমরা যাদের ত্যাগকে পুঁজি করে শাসক দল হতে চাই, শাসনের নামে দুঃশাসন চালিয়ে যাই সেই জনগণকে এবার কেন্দ্রে দেখতে চাই। যদি তা সম্ভব করা যায় তাহলে শত বছরের বঞ্চনা, শোষণের অবসান করে প্রকৃত অর্থে আমরা প্রান্তজনের স্বপ্নসারথি হতে পারবো।
[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]
শেখর ভট্টাচার্য
জুলাই অভ্যুত্থানে আঁকা একটি দেয়াল-চিত্র
বুধবার, ০৬ আগস্ট ২০২৫
ভিন্নমত প্রকাশের স্বাধীনতা কিংবা মতপ্রকাশের স্বাভাবিক পথ যখন সংকুচিত হয়ে আসে তখন আমাদের সামনে এসে উপস্থিত হন ফ্রাঙ্কো ম্যারিক আরোয়েট ভলতেয়ার। যিনি বিশ্বব্যাপী ভলতেয়ার নামেই পরিচিত। গণতন্ত্রের প্রাথমিক শিক্ষার শ্রেণিকক্ষে তার নাম সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়ে থাকে; কারণ গণতন্ত্রের ভিত্তি হলো মানুষের মতপ্রকাশের অধিকার।
ভলতেয়ার অষ্টাদশ শতকের সবচেয়ে প্রভাবশালী ফরাসি সাহিত্যিক, ইতিহাসবিদ ও দার্শনিক। ভলতেয়ারের যে উক্তি মানুষকে চিরকাল উজ্জীবিত করে রাখবে এবং সকল কালে সকল সমাজে যা প্রাসঙ্গিক হয়ে থাকবে তা হলো, ‘তোমার মতের সঙ্গে আমি হয়তো একমত নাও হতে পারি; কিন্তু তোমার মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য আমি আমার জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করে যাব।’ ভলতেয়ারের এই উক্তির প্রাসঙ্গিকতা গণতন্ত্রকামি সমাজ ও রাষ্ট্রের নাগরিকদের কাছে অনন্তকাল থেকে যাবে বলে বিশ্বাস করি। তার এই উক্তিটি এতোই ব্যবহৃত যে মত প্রকাশের স্বাধীনতা সামান্য বাধাগ্রস্ত হলে মানুষ তার এই মানবিক বাণী কে স্মরণ করতে বাধ্য হন।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে উচ্চস্বরে অন্যের মতামতকে বাতিল করে দিতে কিংবা উপড়ে ফেলে দিতে নানা স্তরের নেতাদের আহ্বান শুনতে পাওয়া যায়। প্রশ্ন হলোÑ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় যদি শত ফুল ফোটানোর অর্থাৎ শত মতপ্রকাশের আদর্শ পরিবেশ তৈরির প্রচেষ্টা না থাকে তাহলে ভিন্ন মত প্রকাশকে রুদ্ধ করে দিতে সদম্ভ বক্তব্য প্রকাশ কী যৌক্তিক।
গণতান্ত্রিক পরিবেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শর্ত মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। মত প্রকাশের স্বাধীনতা যখন সংকুচিত কিংবা বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে তখন অশ্লীল, বেলাগাম মতামত, বক্তব্য কিংবা স্লোগান হিসাবে উচ্চারিত হয়ে থাকে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রেও সীমা নির্ধারিত করা আছে। এই স্বাধীনতার সীমার কথা রাজনীতি বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা জেনে থাকেন উনিশ শতকের দার্শনিক স্টুয়ার্ট মিলের কাছ থেকে। এই চিন্তাটিও বহুল ব্যবহৃত এবং আলোচিত। সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক কার্যক্রম লক্ষ্য করলে মিলের উক্তিটিকে শুধু প্রাসঙ্গিকই মনে হবে না, মনে হবে অবশ্য অনুসরণীয় রাজনৈতিক মতদর্শন। মিল বলেছিলেন, একজন ব্যক্তির নিজেকে প্রকাশ করার অধিকার ততদূর পর্যন্ত যতদূর পর্যন্ত তা অন্য ব্যক্তির ক্ষতির কারণ না হয়। আবার মিল এটাও বলেছিলেন যে, স্বাধীনতার এই মূলনীতি যদি মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে চিন্তা করি তাহলে যে কোনো একটি মতকে স্তব্ধ করে দেওয়ার অর্থ হতে পারে সত্যকে স্তব্ধ করার শামিল।
ভিন্নমতকে উচ্চতর মত দিয়ে লাগামে নিয়ে আসতে হয়। এক্ষেত্রে জোর জবরদস্তি লাগাম নয়, অন্যের মতামতের প্রতি সম্মান, শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে উচ্চতর রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবেশ তৈরির প্রচেষ্টার মাধ্যমে সমাজে রাজনৈতিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করাই হলো রাজনীতির ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরা।
মতামতের সঙ্গে সংলাপ করতে হয়, সংঘাত নয়। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপরেই গণতন্ত্র চর্চার শক্তি দাঁড়িয়ে থাকে। সবার মত-আলোচনা-সমালোচনা না শুনলে গণতন্ত্র ব্যবস্থাপনার অন্যতম স্তম্ভ যে জবাবদিহি তা আর থাকে না। যে কোন পক্ষকে স্তব্ধ করে দিলে সেই পক্ষের মতামত শোনা থেকে নাগরিক সমাজ বঞ্চিত হয়। যে গোষ্ঠী বা দল স্তব্ধ হয়ে যায় সেই স্তব্ধতা থেকে তিল তিল করে ঘৃণা, দ্রোহের জন্ম নেয়। সংলাপের পরিবেশ বিরাজ করতে থাকলে যে কোন দল বা গোষ্ঠীর ইতিবাচক বা নেতিবাচক মতামত নাগরিক সমাজ কিংবা সরকারের নিকট সহজেই পৌছে যায়। সকল পক্ষ যখন সকল পক্ষের মতামতকে অনুধাবন করতে পারে তখন সংঘাত, প্রতিহিংসার সম্ভাবনা কমে আসে।
দুঃখের বিষয় আমরা গত কয়েক দশক থেকে দেখতে পাচ্ছি আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সহিষ্ণুতা ক্রমাগত কমে আসছে আমরা পরস্পরকে নির্মূল, নিশ্চিহ্ন করতে উদ্ধ্বত হচ্ছি। মনে রাখতে হবে বিশ্বরাজনীতির ইতিহাসে কোন সমাজ বা রাষ্ট্র আজ পর্যন্ত বিরোধী গোষ্ঠীকে নির্মূল করে দিয়ে গণতন্ত্রের পথ সুগম করতে পারেনি বরঞ্চ নিজেদের শক্তিক্ষয় করে নিজেরাই নির্মুল হয়ে গেছে। মানুষকে তার কথাটা বলতে দিতে হবে এটি যেমন সত্যি, আবার কেউ এমন ‘যা-তা’ বলতে পারবেন না, যা অন্যের অধিকারকে ক্ষুণœ করে। যেমন কেউ যদি অনলাইনে একজন প্রান্তিকীকৃত জাতিগত বা ধর্মীয় বা লিঙ্গ পরিচয়ের মানুষের সম্পর্কে ভুল তথ্য দেয় বা ছড়ায় তাহলে সেটি শাস্তিযোগ্য হবে, কারণ ভুল তথ্য বা অপতথ্য ছড়িয়ে দেওয়াও অপরাধ! ভুল তথ্য বা মিস-ইনফরমেশন আর অপতথ্য বা ডিজইনফরমেশন দুই জিনিস হলেও উভয়েই নাগরিকের অধিকার ক্ষুণœ করতে ব্যবহৃত হতে পারে। ভুল তথ্য কেউ কেউ না জেনেও ছড়াতে পারেন। তবে অপতথ্য তৈরি করতে হয়, বিনিয়োগ লাগে। অপতথ্য প্রচার দ-নীয়। আইনের শাসন থাকলে সে শাস্তি বিধানে আগের নিবর্তনমূলক আইন ব্যবহার না করে ভিন্ন আইনি ব্যবস্থায় যেতে হবে। ফলে মতপ্রকাশের অধিকার যদি অন্যের অধিকার হরণ করে, তবে সেটি অপরাধ হয়। পার্থক্যটা অনেক বড় না হলেও একেবারে কমও না।
ফ্রিডম হাউস ইনডেক্স (২০২৪) অনুযায়ী, বাংলাদেশ সাংবাদিকদের জন্য ‘খুব সংকটপূর্ণ’ একটি দেশ, যেখানে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা আংশিক। এর কারণ হয়তো এই যে, গত সরকারের আমলের নিবর্তনমূলক আইনগুলো, যেমন- আইসিটি আইন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বা সাইবার নিরাপত্তা আইনগুলো প্রণয়ন ও সেগুলোর নিপীড়নমূলক প্রয়োগ এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে ছিল, যা ক্ষমতায় থাকা সরকার ছাড়া আর কাউকে নিরাপত্তা দেয়নি। বরং এ আইনগুলো দিয়ে নাগরিকের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ এবং সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠ রোধ করা হয়েছিল বছরের পর বছর। সামাজিক মাধ্যমে সরকারের যেকোনো সমালোচনা এসব আইনের বলে যে কাউকে কারান্তরীণ করা ছিলো সহজ। মতামতকে কারান্তরীণ না করে মতামতকে মুক্ত করে দিলে মতামত তার যোগ্য স্থান নিতে পারে।
মতপ্রকাশের স্বাধীনতা যখন হুমকির সম্মুখীন হয় তখন রাজনৈতিক ও সামাজিক বলয় নীরবতার সংস্কৃতির আচ্ছাদনে আচ্ছাদিত হয়ে যায়। নীরবতার সংস্কৃতি যে কোন শাসক দলের জন্য অত্যন্ত ভীতিকর একটি রাজনৈতিক, সামাজিক অবস্থা। নীরবতার সংস্কৃতি যখন সমাজে বহমান থাকে তখন শাসকদের শাসনের আরশিতে নাগরিকের মুখ দেখা গেলেও মনোভাব আঁচ করা কঠিন হয়ে যায়। নাগরিক মনোভাবকে অনুধাবন না করে কিংবা ভুলভাবে পাঠ করলে শাসকদের সরকার পরিচালনা ভুল হতে বাধ্য। এই ভুল থেকেই অপশাসন, দুঃশাসন নেমে আসে। যদিও সরকারকে ধারণা দেয়া হয় নাগরিকেরা সুশাসনের সুবাতাসে অত্যন্ত আনন্দিত, সন্তুষ্ট।
বৈষম্যের প্রতি বিরোধিতা করেই কিন্তু চব্বিশের গণআন্দোলনের সূচনা হয়েছিলো। স্লোগান উঠেছিলো ‘বঙ্গবন্ধুর বাংলায় বৈষম্যের ঠাঁই নাই।’ নিপীড়িত প্রান্তিক মানুষদের সব চেয়ে বড় স্বপ্ন হলো বৈষম্য হ্রাস করে একটি সমতার সমাজ গড়া। সমাজের গহীনের এই স্বপ্নকে অনুধাবন করতে হলে আমাদের সবার মতামতকে শুনতে হবে। সমাজে প্রতি দিন মানুষ সম্বেত সুরে কথা বলতে থাকে। উচ্চবিত্ত, প্রভাবশালী, সমাজ নিয়ন্ত্রকদের কথা শুনে আমরা অভ্যস্ত। রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত যাদের নিম্নস্বর শাসকদের কিংবা রাজনৈতিক দলগুলোর কানে পৌঁছতে শত বাধা, শত বেগ পোহাতে হয় সেই বাধাকে সরিয়ে দেয়া। এই যে আমরা প্রতিদিন বলে থাকি জনগণের চাওয়া পাওয়ার কথা ভাবতে হবে। জনগণ! কোন জনগণ। কার জনগণ। আমরা যে জনগণের প্রতিনিধিত্ব করি সে জনগণ হলো ক্ষমতার মসনদের ধারে কাছে থাকা প্রভাব বিস্তারকারী জনগণ।
এবার সময় হয়েছে সকল আন্দোলন, বিপ্লবে যে ‘জনগণ’ রক্ত ঝরায়, তাদের সামনে নিয়ে আসার। আমরা যাদের সামনে দেখে থাকি তারা হচ্ছে মুখোশ আর আমরা যাদের দেখিনা তারা হলো মুখ। আমরা যাদের ত্যাগকে পুঁজি করে শাসক দল হতে চাই, শাসনের নামে দুঃশাসন চালিয়ে যাই সেই জনগণকে এবার কেন্দ্রে দেখতে চাই। যদি তা সম্ভব করা যায় তাহলে শত বছরের বঞ্চনা, শোষণের অবসান করে প্রকৃত অর্থে আমরা প্রান্তজনের স্বপ্নসারথি হতে পারবো।
[লেখক : প্রাবন্ধিক ও উন্নয়ন গবেষক]