মাহতাব হোসাইন মাজেদ
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত ২০১১ সালের জরিপে দেখা গেছে, দেশের ৮৭ শতাংশ নারী স্বামীর মাধ্যমে কোনো না কোনো ধরনের নির্যাতনের শিকার হন। জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, বাংলাদেশে ৬০ শতাংশ বিবাহিত নারী জীবনের কোনো না কোনো সময়ে স্বামী অথবা তার পরিবারের সদস্যদের নির্যাতন ভোগেন। পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০-এর বিভিন্ন ধারায় দেশে মোট ১২,৭৬৯টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেক মামলা ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে দায়ের হয়েছে ৬,২০২টি।
মামলার বিস্তারিত বিবরণে দেখা যায়, ধর্ষণের অভিযোগে ৪,৩৩২টি এবং ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে ১,৮৭০টি মামলা করা হয়েছে। অন্যদিকে যৌতুকের কারণে নির্যাতনের ঘটনায় ৩,২০৮টি, দাহ্য পদার্থ নিক্ষেপের কারণে ৪৭টি, অপহরণের ঘটনায় ৩,২৮৭টি এবং শিশু পণবন্দী রাখার অভিযোগে ২৫টি মামলা হয়েছে। বিচারপ্রক্রিয়ার তথ্য অনুযায়ী, যৌতুকের কারণে ১৩৬ নারী, ধর্ষণের পর ১২ নারী ও ১১ শিশুকে হত্যা করা হয়েছে।
বিশ্বজুড়ে নারীদের প্রতি সহিংসতার মাত্রা উদ্বেগজনক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, সাত শতাংশ নারী সরাসরি ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন এবং প্রতি ১০০ জন নারীর মধ্যে সাতজন যৌন নিপীড়নের সম্মুখীন হচ্ছেন। উন্নত এবং অনুন্নত দেশ সবখানেই নারীর প্রতি সহিংসতার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়, যা মানবতার জন্য লজ্জাজনক।
দেশের বিভিন্ন সংগঠন আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন বিরোধী দিবস উপলক্ষে নানা কর্মসূচি পালন করে থাকলেও, বাস্তবতা হলো নারীর প্রতি সহিংসতা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মাসভিত্তিক মামলার সংখ্যাও দেখায়, আগস্ট মাস ছাড়া অন্য সব মাসেই মামলা সংখ্যা ছিল বেশি, যার মধ্যে জুলাই মাসেও নারী ও শিশু নির্যাতনের হার ছিল উঁচু।
নারীর প্রতি সহিংসতার মূল কারণ হিসেবে ক্ষমতার অপব্যবহার, প্রশাসনের উদাসীনতা, সামাজিক সংস্কৃতির বৈষম্য, নারীদের নীরবতা এবং ‘ভাগ্য বলে মেনে নেয়া’ মনোভাবকে চিহ্নিত করা যায়। তাই এই সমস্যা রোধে আমাদের মানসিকতা পরিবর্তনের জরুরি প্রয়োজন। দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে পারলেই আমরা নারীর প্রতি সহিংসতা কমিয়ে আনতে পারব।
নারী নির্যাতন রোধে তরুণ-যুবসমাজকে সচেতন ও সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে। বাল্যবিবাহ বন্ধে অভিভাবক, শিক্ষক, রাজনৈতিক নেতা ও সমাজের অন্য সবার ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা প্রয়োজন। পিতৃতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও নারী নির্যাতনকে সমর্থনকারী সামাজিক মূল্যবোধ ভাঙতে জাতীয় নীতি ও কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ জরুরি। বাংলাদেশের সংবিধানে নারী ও পুরুষের সমঅধিকার নিশ্চিত থাকলেও, বাস্তবে নারীর প্রতি সহিংসতা কমেনি। প্রণীত আইনগুলো যথাযথ বাস্তবায়নের অভাবে নির্যাতনের মাত্রা বাড়ছে।
যৌতুক নিরোধ আইন (১৯৮০) ও নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন (২০০০, সংশোধনী ২০০৩) নারী নির্যাতন প্রতিরোধের প্রধান আইন হলেও, আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা ও ত্রুটির কারণে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ কঠিন হয়ে পড়েছে। শুধু আইন তৈরি করলেই অপরাধ রোধ হয় না; সঠিক প্রয়োগ, দ্রুত বিচার ও সাজা নিশ্চিত করাটাই মূল কথা।
আইনের প্রয়োগে অসমতা বিদ্যমান। একই অপরাধে কারো ফাঁসি, কারো খালাস, কিংবা নিরপরাধের সাজা পাওয়া যায়, যা ন্যায়বিচারের পরিপন্থি। তাই স্বচ্ছ ও ন্যায়সঙ্গত বিচারপ্রক্রিয়া নিশ্চিত করা প্রয়োজন, যেখানে অপরাধীরা শাস্তি পাবে এবং নিরপরাধ কেউ বঞ্চিত হবে না।
আইনের অপব্যবহারও বড় সমস্যা। প্রায়ই প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে বা প্রতিশোধ নিতে মিথ্যা মামলা হয়, যা বিচারপ্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে। মিথ্যা মামলার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে আইনের যথার্থ প্রয়োগ ও সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত হয়।
মামলার প্রক্রিয়া ও খরচের ভয়ে অনেক নির্যাতিতা নারী ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হন। এতে সচেতনতা বৃদ্ধি, আইনি সহায়তা এবং সামাজিক সমর্থন প্রয়োজন। নারী নির্যাতন প্রতিরোধে প্রশাসনকে সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে এবং জনগণকে সচেতন করতে হবে।
নারীর অবদানের মূল্যায়ন করে দাম্পত্য জীবনে সম্পত্তিতে নারীর অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। নারী নির্যাতন রোধে সমাজের পুরুষদের মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন অত্যাবশ্যক। সামাজিক সচেতনতা ও অংশগ্রহণ ছাড়া এই সমস্যার সমাধান অসম্ভব।
সবশেষে, নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ করতে হলে শুধু আইন নয়, মানসিকতা পরিবর্তন, সচেতনতা বৃদ্ধি, দ্রুত ও সুষ্ঠু বিচার, সামাজিক সমর্থন ও প্রশাসনিক জোরালো পদক্ষেপ একসঙ্গে গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে তরুণ সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে, কারণ তারা সমাজের পরিবর্তনের প্রধান চালিকা শক্তি। তাহলে আমরা একটি স্বাভাবিক, সুস্থ ও ন্যায়সংগত সমাজ গড়ে তুলতে পারব।
[লেখক : প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি]
মাহতাব হোসাইন মাজেদ
সোমবার, ১১ আগস্ট ২০২৫
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত ২০১১ সালের জরিপে দেখা গেছে, দেশের ৮৭ শতাংশ নারী স্বামীর মাধ্যমে কোনো না কোনো ধরনের নির্যাতনের শিকার হন। জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, বাংলাদেশে ৬০ শতাংশ বিবাহিত নারী জীবনের কোনো না কোনো সময়ে স্বামী অথবা তার পরিবারের সদস্যদের নির্যাতন ভোগেন। পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০-এর বিভিন্ন ধারায় দেশে মোট ১২,৭৬৯টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় অর্ধেক মামলা ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে দায়ের হয়েছে ৬,২০২টি।
মামলার বিস্তারিত বিবরণে দেখা যায়, ধর্ষণের অভিযোগে ৪,৩৩২টি এবং ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে ১,৮৭০টি মামলা করা হয়েছে। অন্যদিকে যৌতুকের কারণে নির্যাতনের ঘটনায় ৩,২০৮টি, দাহ্য পদার্থ নিক্ষেপের কারণে ৪৭টি, অপহরণের ঘটনায় ৩,২৮৭টি এবং শিশু পণবন্দী রাখার অভিযোগে ২৫টি মামলা হয়েছে। বিচারপ্রক্রিয়ার তথ্য অনুযায়ী, যৌতুকের কারণে ১৩৬ নারী, ধর্ষণের পর ১২ নারী ও ১১ শিশুকে হত্যা করা হয়েছে।
বিশ্বজুড়ে নারীদের প্রতি সহিংসতার মাত্রা উদ্বেগজনক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, সাত শতাংশ নারী সরাসরি ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন এবং প্রতি ১০০ জন নারীর মধ্যে সাতজন যৌন নিপীড়নের সম্মুখীন হচ্ছেন। উন্নত এবং অনুন্নত দেশ সবখানেই নারীর প্রতি সহিংসতার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়, যা মানবতার জন্য লজ্জাজনক।
দেশের বিভিন্ন সংগঠন আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন বিরোধী দিবস উপলক্ষে নানা কর্মসূচি পালন করে থাকলেও, বাস্তবতা হলো নারীর প্রতি সহিংসতা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মাসভিত্তিক মামলার সংখ্যাও দেখায়, আগস্ট মাস ছাড়া অন্য সব মাসেই মামলা সংখ্যা ছিল বেশি, যার মধ্যে জুলাই মাসেও নারী ও শিশু নির্যাতনের হার ছিল উঁচু।
নারীর প্রতি সহিংসতার মূল কারণ হিসেবে ক্ষমতার অপব্যবহার, প্রশাসনের উদাসীনতা, সামাজিক সংস্কৃতির বৈষম্য, নারীদের নীরবতা এবং ‘ভাগ্য বলে মেনে নেয়া’ মনোভাবকে চিহ্নিত করা যায়। তাই এই সমস্যা রোধে আমাদের মানসিকতা পরিবর্তনের জরুরি প্রয়োজন। দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে পারলেই আমরা নারীর প্রতি সহিংসতা কমিয়ে আনতে পারব।
নারী নির্যাতন রোধে তরুণ-যুবসমাজকে সচেতন ও সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে। বাল্যবিবাহ বন্ধে অভিভাবক, শিক্ষক, রাজনৈতিক নেতা ও সমাজের অন্য সবার ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা প্রয়োজন। পিতৃতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও নারী নির্যাতনকে সমর্থনকারী সামাজিক মূল্যবোধ ভাঙতে জাতীয় নীতি ও কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ জরুরি। বাংলাদেশের সংবিধানে নারী ও পুরুষের সমঅধিকার নিশ্চিত থাকলেও, বাস্তবে নারীর প্রতি সহিংসতা কমেনি। প্রণীত আইনগুলো যথাযথ বাস্তবায়নের অভাবে নির্যাতনের মাত্রা বাড়ছে।
যৌতুক নিরোধ আইন (১৯৮০) ও নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন (২০০০, সংশোধনী ২০০৩) নারী নির্যাতন প্রতিরোধের প্রধান আইন হলেও, আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা ও ত্রুটির কারণে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ কঠিন হয়ে পড়েছে। শুধু আইন তৈরি করলেই অপরাধ রোধ হয় না; সঠিক প্রয়োগ, দ্রুত বিচার ও সাজা নিশ্চিত করাটাই মূল কথা।
আইনের প্রয়োগে অসমতা বিদ্যমান। একই অপরাধে কারো ফাঁসি, কারো খালাস, কিংবা নিরপরাধের সাজা পাওয়া যায়, যা ন্যায়বিচারের পরিপন্থি। তাই স্বচ্ছ ও ন্যায়সঙ্গত বিচারপ্রক্রিয়া নিশ্চিত করা প্রয়োজন, যেখানে অপরাধীরা শাস্তি পাবে এবং নিরপরাধ কেউ বঞ্চিত হবে না।
আইনের অপব্যবহারও বড় সমস্যা। প্রায়ই প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে বা প্রতিশোধ নিতে মিথ্যা মামলা হয়, যা বিচারপ্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে। মিথ্যা মামলার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে আইনের যথার্থ প্রয়োগ ও সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত হয়।
মামলার প্রক্রিয়া ও খরচের ভয়ে অনেক নির্যাতিতা নারী ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হন। এতে সচেতনতা বৃদ্ধি, আইনি সহায়তা এবং সামাজিক সমর্থন প্রয়োজন। নারী নির্যাতন প্রতিরোধে প্রশাসনকে সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে এবং জনগণকে সচেতন করতে হবে।
নারীর অবদানের মূল্যায়ন করে দাম্পত্য জীবনে সম্পত্তিতে নারীর অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। নারী নির্যাতন রোধে সমাজের পুরুষদের মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন অত্যাবশ্যক। সামাজিক সচেতনতা ও অংশগ্রহণ ছাড়া এই সমস্যার সমাধান অসম্ভব।
সবশেষে, নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ করতে হলে শুধু আইন নয়, মানসিকতা পরিবর্তন, সচেতনতা বৃদ্ধি, দ্রুত ও সুষ্ঠু বিচার, সামাজিক সমর্থন ও প্রশাসনিক জোরালো পদক্ষেপ একসঙ্গে গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে তরুণ সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে, কারণ তারা সমাজের পরিবর্তনের প্রধান চালিকা শক্তি। তাহলে আমরা একটি স্বাভাবিক, সুস্থ ও ন্যায়সংগত সমাজ গড়ে তুলতে পারব।
[লেখক : প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি]