আনোয়ারুল হক
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের বার্ষিকীতে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ পাঠ করেছেন। অন্তর্বর্তী সরকার গত এক বছরে নিরপেক্ষতা অবলম্বন করতে পারেনি, হেলে পড়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও দেশের সংবিধানের মর্মবস্তুর বিরোধিতাকারী গোষ্ঠীর দিকে। তেমনি জুলাই ঘোষণাপত্রেও তাদের বক্তব্যকে প্রাধান্য দিতে যেয়ে ঐ গোষ্ঠীকে পুরোপুরি খুশি করতে না পারলেও দেশের ইতিহাসকে জগাখিচুড়ি বানিয়ে ফেলেছে। ঘোষণাপত্রের শুরুতে ১নং বয়ান থেকেই এ বিকৃতি শুরু হয়েছে। বয়ানে বলা হয়েছে ‘এই ভূখ-ের মানুষ দীর্ঘ ২৩ বছর পাকিস্তানের স্বৈরশাসকদের বঞ্চনা ও শোষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল এবং নির্বিচার গণহত্যার বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করে জাতীয় মুক্তির লক্ষ্যে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিল’। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী ১৯৭০ সালের নির্বাচনের গণরায়কে উপেক্ষা ও অস্বীকার করে গণহত্যার পথ অবলম্বন করায় পূর্ব বাংলার মানুষ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে- দিবালোকের মতো স্পষ্ট এ বিষয়টি কৌশলে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।
জাতীয় সম্পদের যেমন কোন একক মালিকানা থাকে না একটা দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়কও স্ত্রী, পুত্র, কন্যার মালিকানায় থাকেন না বা তাদের পরিচয়ে পরিচিত হন না- তা যতই তারা তার নাম ব্যবহার বা অপব্যবহার করুক না কেন। তার পরিচিতি দেশের স্থপতি হিসেবেই। কিন্তু জুলাই ঘোষণার সব আয়োজন যেনো শেখ মুজিবকে ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে দেয়ার জন্য। কেনো?
কেন এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে? তাও খুবই পরিষ্কার। ঘোষণাপত্রে ২৩ বছরের সংগ্রামের যে কথা বলা হয়েছে, শেখ মুজিবর রহমান ও তার দল আওয়ামী লীগ সেই সুদীর্ঘ সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং পরিণতিতে ১৯৭০-এর গণরায়ে শেখ মুজিব স্বাধীনতা সংগ্রামের অবিসংবাদিতা নেতা হিসেবে ইতিহাসে প্রতিষ্ঠিত হন এবং এক অতুলনীয় জনপ্রিয়তা নিয়ে তিনি স্বাধীন দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। তার গোটা শাসনকালই অর্থাৎ ’৭২ থেকে ’৭৫ একদলীয় শাসনব্যবস্থা নয়। কিন্তু ঘোষণাপত্রে কৌশলে সেটাই বলার চেষ্টা হয়েছে। ঘোষণাপত্রে ১৯৭১ পরবর্তী ‘জনগণের আকাক্সক্ষা পূরণে আওয়ামী লীগের ব্যর্থতার’ দায় ‘সংবিধানের খসড়া তৈরির প্রক্রিয়া ও কাঠামোর দুর্বলতার’ ওপর চাপানোর চেষ্টা করা হয়েছে যা বিগত ৫৪ বছরে কখনোই বলা হয়নি এবং কোনো দলের রাজনৈতিক এজেন্ডায় ছিল না। কৌশলে সংবিধানের মর্মবস্তুতে আঘাত হানতে জুলাই ঘোষণার নামে এসব প্রশ্ন উত্থাপন করা হচ্ছে।
এ কথা ঠিক, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান স্বাধীনতা পরবর্তীতে কিছুটা কর্তৃত্ববাদী মনোভাব নিয়ে চলছিলেন এবং একপর্যায়ে একদলীয় শাসন ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। আবার এ কথাও ঠিক জাতীয়ভাবে শুধু একটি মাত্র দল গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত মুজিব পরীক্ষামূলকভাবে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হিসেবেই নিয়েছিলেন। তৎকালীন বিশ্ব পরিস্থিতিতে তৃতীয় বিশ্বের বেশ কিছু দেশ প্রগতিমুখীন যাত্রাকে নিশ্চিত করতে এ ধরনের পথে অগ্রসর হয়েছিলো। শেষ পর্যন্ত কোনো দেশের জন্যই তা ভালো ফল বয়ে আনেনি। বাংলাদেশের জন্যও নয়। বরং ইতিহাসের নৃশংসতম এক হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে তিনি স্বপরিবারে নিহত হলেন।
জুলাই ঘোষণাপত্রে ১৯৭৫ সালের আগস্টে দেশের স্থপতি এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান নেতা শেখ মুজিবর রহমানকে স্বপরিবারে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়নি। অথচ এই হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে সামরিক শাসনের সূত্রপাত হয়েছিল। উল্লেখ নেই স্বাধীনতা সংগ্রামের আরেক নায়ক তাজউদ্দীন আহমেদসহ জেলখানায় স্বাধীন বাংলার অস্থায়ী বিপ্লবী সরকারের চার নেতা হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও। অথচ এসবের মাধ্যমেই সূত্রপাত ঘটে দেশে ক্যু-পাল্টা ক্যুসহ অসংখ্য সামরিক কর্মকর্তা হত্যাযজ্ঞের ঘটনা, যা থেকে রেহাই পাননি তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানও।
অন্তর্বর্তী সরকার ও তার বিদেশি পরামর্শক ইতিহাসের এ বিকৃতি যে ইচ্ছাকৃত করেছেন তার প্রমাণ দিলেন প্রধান উপদেষ্টার অতিকথন প্রিয় প্রেস সচিব। তিনি ঘোষণা করলেন ১৫ আগস্ট কেউ কর্মসূচি পালন করলে আইনানুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবর রহমানকে হত্যার দিনে কেউ তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে পারবেন না, দেশে কি এমন কোনো আইন আছে? নাই। তবে মব আস্ফালন আছে যা গত বছর ১৫ আগস্টে দেখা গেছে। তবে কি এই সরকার শেষ পর্যন্ত মব আস্ফালনকারীদের সরকারে পরিণত হচ্ছে? সেটা হতে চাইলে হন। তবে তার আগে ‘মুজিববাদের জনক’ কে নিয়ে গুণকীর্তনের অভিযোগে উপদেষ্টা আসিফ নজরুল এবং এনসিপির দুই সিপাহসালার হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সারজিস আলমকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। এ সকল ‘মুজিববাদী’ সরকারে এবং এনসিপিতে ঘাপটি মেরে বসে আছে কিনা কে জানে!
রাজনীতি বড়ই বিচিত্র। একটু ভালোভাবে লক্ষ্য করলেই বুঝা যায় কিভাবে সুদূর প্যারিসে বসে একজন বাংলাদেশি ‘বিপ্লবী ইউটিউবার’ তার কৌশলী কনটেন্টের মাধ্যমে প্রতিদিন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) ভোটব্যাংক বৃদ্ধির কাজ করে যাচ্ছেন। উল্লেখিত ‘তিন মুজিববাদী’ ও পতিত শক্তির পক্ষে কৌশলে কাজ করছেন কিনা কে জানে!
আওয়ামী লীগ দেশের ইতিহাসকে একটি মাত্র বয়ানে আটকে রেখেছিল। চব্বিশের অভ্যুত্থানের পরে সমন্বয়করা যে ব্যাখা-বিবৃতি দিয়েছিলেন সেখানে এককেন্দ্রিকতার বদলে ইতিহাসের বহুমাত্রিক তালাশের কথা বলা হয়েছিল। এখনকি সেই বহুমাত্রিকতা বাদ দিয়ে ড. ইউনূস ও এনসিপির এককেন্দ্রিক স্তুতিই শুধু চলবে? অন্তর্বর্তী সরকারের তো এই সহজ বিষয়টি না বুঝার কোনো কারণ নেই যে, জাতীয় সম্পদের যেমন কোন একক মালিকানা থাকে না একটা দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়কও স্ত্রী, পুত্র, কন্যার মালিকানায় থাকেন না বা তাদের পরিচয়ে পরিচিত হন না- তা যতই তারা তার নাম ব্যবহার বা অপব্যবহার করুক না কেন। তার পরিচিতি দেশের স্থপতি হিসেবেই। কিন্তু জুলাই ঘোষণার সব আয়োজন যেনো শেখ মুজিবকে ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে দেয়ার জন্য। কেনো? কারণ একটাই। যারা সরকারের চালিকাশক্তি হিসেবে পেছন থেকে আছে, দৃশ্যত তাদের আক্রোশ কর্তৃত্ববাদী আওয়ামী লীগ বা হাসিনা রেজিমের চেয়ে ’৭১ এর ওপর বেশি। শুধু মুখ ফুটে বলতে পারছে না ’৭১-এর আগেই ভালো ছিলাম!
জুলাই ঘোষণাপত্রের বয়ান শুনে মনে হয়েছে আওয়ামী লীগ এবং শেখ হাসিনা এখনও রাষ্ট্র ক্ষমতায় এবং বিরোধী দলীয় ঐক্যজোট বিরোধী আন্দোলনকে অগ্রসর করার লক্ষ্যে কর্মসূচি ঘোষণা করছে। ঘোষণাপত্রে একতরফাভাবে বলা হয়েছে ১/১১’র পেছনের ‘ষড়যন্ত্রমূলক ব্যবস্থা’ আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় এনেছিল। অথচ তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে নিজ পক্ষে রাখার জন্য বিচারপতিদের চাকরির বয়স সীমা বাড়িয়ে রাজনীতির মাঠে এক সংঘাতমূলক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে ১/১১ ডেকে আনতে প্রধান ভূমিকা রাখে। এ রকম অসংখ্য ইতিহাস বিকৃতির এক বয়ান নোবেল লরিয়েট পঠিত ঘোষণাপত্রে উঠে এসেছে- যা নতুন করে বিভাজন সৃষ্টির ঘোষণা হিসেবেই পরিচিতি অর্জন করবে।
আলোচনা হচ্ছিল শেখ মুজিবকে ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে ফেলার জুলাই ঘোষণা নিয়ে। এই ঘোষণাকারীরা মনে করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা মানেই বাই ডিফল্ট আওয়ামী লীগের প্রতি আনুগত্য। শেখ হাসিনার বয়ানও কিন্তু অনেকটা তাই।তাহলে হাসিনার সঙ্গে তাদের পার্থক্য কী? শেখ মুজিবুর রহমানকে নিজের ও আওয়ামী লীগের নিজস্ব সম্পত্তি বানিয়ে শেখ হাসিনা মুজিবের প্রতি অবিচার করেছেন। তার নিজের করা অপরাধগুলোর ছায়ায় মুজিব স্মৃতি অনেকটা ঢাকা পড়ে গেছে। তার পরেও মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান নেতা। মানুষ কি শতভাগ শুদ্ধ হয়? শেখ মুজিবও শতভাগ শুদ্ধ ছিলেন না। তবুও তিনিই স্বাধীনতার নায়ক। এদেশের মানুষ তার ডাকে স্বাধীনতার মরণপণ যুদ্ধের জন্য তৈরি হয়েছিল। মুজিব প্রয়ান দিবসে তার প্রতি নিষ্ঠুর হবেন না। সে রাতের সেই নিষ্ঠুর ঘাতকেরা কিন্তু শেষ পর্যন্ত জিততে পারেনি!
[লেখক : সাবেক ছাত্র নেতা]
আনোয়ারুল হক
বৃহস্পতিবার, ১৪ আগস্ট ২০২৫
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের বার্ষিকীতে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ পাঠ করেছেন। অন্তর্বর্তী সরকার গত এক বছরে নিরপেক্ষতা অবলম্বন করতে পারেনি, হেলে পড়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও দেশের সংবিধানের মর্মবস্তুর বিরোধিতাকারী গোষ্ঠীর দিকে। তেমনি জুলাই ঘোষণাপত্রেও তাদের বক্তব্যকে প্রাধান্য দিতে যেয়ে ঐ গোষ্ঠীকে পুরোপুরি খুশি করতে না পারলেও দেশের ইতিহাসকে জগাখিচুড়ি বানিয়ে ফেলেছে। ঘোষণাপত্রের শুরুতে ১নং বয়ান থেকেই এ বিকৃতি শুরু হয়েছে। বয়ানে বলা হয়েছে ‘এই ভূখ-ের মানুষ দীর্ঘ ২৩ বছর পাকিস্তানের স্বৈরশাসকদের বঞ্চনা ও শোষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল এবং নির্বিচার গণহত্যার বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করে জাতীয় মুক্তির লক্ষ্যে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিল’। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী ১৯৭০ সালের নির্বাচনের গণরায়কে উপেক্ষা ও অস্বীকার করে গণহত্যার পথ অবলম্বন করায় পূর্ব বাংলার মানুষ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে- দিবালোকের মতো স্পষ্ট এ বিষয়টি কৌশলে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।
জাতীয় সম্পদের যেমন কোন একক মালিকানা থাকে না একটা দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়কও স্ত্রী, পুত্র, কন্যার মালিকানায় থাকেন না বা তাদের পরিচয়ে পরিচিত হন না- তা যতই তারা তার নাম ব্যবহার বা অপব্যবহার করুক না কেন। তার পরিচিতি দেশের স্থপতি হিসেবেই। কিন্তু জুলাই ঘোষণার সব আয়োজন যেনো শেখ মুজিবকে ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে দেয়ার জন্য। কেনো?
কেন এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে? তাও খুবই পরিষ্কার। ঘোষণাপত্রে ২৩ বছরের সংগ্রামের যে কথা বলা হয়েছে, শেখ মুজিবর রহমান ও তার দল আওয়ামী লীগ সেই সুদীর্ঘ সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং পরিণতিতে ১৯৭০-এর গণরায়ে শেখ মুজিব স্বাধীনতা সংগ্রামের অবিসংবাদিতা নেতা হিসেবে ইতিহাসে প্রতিষ্ঠিত হন এবং এক অতুলনীয় জনপ্রিয়তা নিয়ে তিনি স্বাধীন দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। তার গোটা শাসনকালই অর্থাৎ ’৭২ থেকে ’৭৫ একদলীয় শাসনব্যবস্থা নয়। কিন্তু ঘোষণাপত্রে কৌশলে সেটাই বলার চেষ্টা হয়েছে। ঘোষণাপত্রে ১৯৭১ পরবর্তী ‘জনগণের আকাক্সক্ষা পূরণে আওয়ামী লীগের ব্যর্থতার’ দায় ‘সংবিধানের খসড়া তৈরির প্রক্রিয়া ও কাঠামোর দুর্বলতার’ ওপর চাপানোর চেষ্টা করা হয়েছে যা বিগত ৫৪ বছরে কখনোই বলা হয়নি এবং কোনো দলের রাজনৈতিক এজেন্ডায় ছিল না। কৌশলে সংবিধানের মর্মবস্তুতে আঘাত হানতে জুলাই ঘোষণার নামে এসব প্রশ্ন উত্থাপন করা হচ্ছে।
এ কথা ঠিক, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান স্বাধীনতা পরবর্তীতে কিছুটা কর্তৃত্ববাদী মনোভাব নিয়ে চলছিলেন এবং একপর্যায়ে একদলীয় শাসন ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। আবার এ কথাও ঠিক জাতীয়ভাবে শুধু একটি মাত্র দল গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত মুজিব পরীক্ষামূলকভাবে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হিসেবেই নিয়েছিলেন। তৎকালীন বিশ্ব পরিস্থিতিতে তৃতীয় বিশ্বের বেশ কিছু দেশ প্রগতিমুখীন যাত্রাকে নিশ্চিত করতে এ ধরনের পথে অগ্রসর হয়েছিলো। শেষ পর্যন্ত কোনো দেশের জন্যই তা ভালো ফল বয়ে আনেনি। বাংলাদেশের জন্যও নয়। বরং ইতিহাসের নৃশংসতম এক হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে তিনি স্বপরিবারে নিহত হলেন।
জুলাই ঘোষণাপত্রে ১৯৭৫ সালের আগস্টে দেশের স্থপতি এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান নেতা শেখ মুজিবর রহমানকে স্বপরিবারে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়নি। অথচ এই হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে সামরিক শাসনের সূত্রপাত হয়েছিল। উল্লেখ নেই স্বাধীনতা সংগ্রামের আরেক নায়ক তাজউদ্দীন আহমেদসহ জেলখানায় স্বাধীন বাংলার অস্থায়ী বিপ্লবী সরকারের চার নেতা হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও। অথচ এসবের মাধ্যমেই সূত্রপাত ঘটে দেশে ক্যু-পাল্টা ক্যুসহ অসংখ্য সামরিক কর্মকর্তা হত্যাযজ্ঞের ঘটনা, যা থেকে রেহাই পাননি তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানও।
অন্তর্বর্তী সরকার ও তার বিদেশি পরামর্শক ইতিহাসের এ বিকৃতি যে ইচ্ছাকৃত করেছেন তার প্রমাণ দিলেন প্রধান উপদেষ্টার অতিকথন প্রিয় প্রেস সচিব। তিনি ঘোষণা করলেন ১৫ আগস্ট কেউ কর্মসূচি পালন করলে আইনানুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবর রহমানকে হত্যার দিনে কেউ তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে পারবেন না, দেশে কি এমন কোনো আইন আছে? নাই। তবে মব আস্ফালন আছে যা গত বছর ১৫ আগস্টে দেখা গেছে। তবে কি এই সরকার শেষ পর্যন্ত মব আস্ফালনকারীদের সরকারে পরিণত হচ্ছে? সেটা হতে চাইলে হন। তবে তার আগে ‘মুজিববাদের জনক’ কে নিয়ে গুণকীর্তনের অভিযোগে উপদেষ্টা আসিফ নজরুল এবং এনসিপির দুই সিপাহসালার হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সারজিস আলমকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। এ সকল ‘মুজিববাদী’ সরকারে এবং এনসিপিতে ঘাপটি মেরে বসে আছে কিনা কে জানে!
রাজনীতি বড়ই বিচিত্র। একটু ভালোভাবে লক্ষ্য করলেই বুঝা যায় কিভাবে সুদূর প্যারিসে বসে একজন বাংলাদেশি ‘বিপ্লবী ইউটিউবার’ তার কৌশলী কনটেন্টের মাধ্যমে প্রতিদিন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) ভোটব্যাংক বৃদ্ধির কাজ করে যাচ্ছেন। উল্লেখিত ‘তিন মুজিববাদী’ ও পতিত শক্তির পক্ষে কৌশলে কাজ করছেন কিনা কে জানে!
আওয়ামী লীগ দেশের ইতিহাসকে একটি মাত্র বয়ানে আটকে রেখেছিল। চব্বিশের অভ্যুত্থানের পরে সমন্বয়করা যে ব্যাখা-বিবৃতি দিয়েছিলেন সেখানে এককেন্দ্রিকতার বদলে ইতিহাসের বহুমাত্রিক তালাশের কথা বলা হয়েছিল। এখনকি সেই বহুমাত্রিকতা বাদ দিয়ে ড. ইউনূস ও এনসিপির এককেন্দ্রিক স্তুতিই শুধু চলবে? অন্তর্বর্তী সরকারের তো এই সহজ বিষয়টি না বুঝার কোনো কারণ নেই যে, জাতীয় সম্পদের যেমন কোন একক মালিকানা থাকে না একটা দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়কও স্ত্রী, পুত্র, কন্যার মালিকানায় থাকেন না বা তাদের পরিচয়ে পরিচিত হন না- তা যতই তারা তার নাম ব্যবহার বা অপব্যবহার করুক না কেন। তার পরিচিতি দেশের স্থপতি হিসেবেই। কিন্তু জুলাই ঘোষণার সব আয়োজন যেনো শেখ মুজিবকে ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে দেয়ার জন্য। কেনো? কারণ একটাই। যারা সরকারের চালিকাশক্তি হিসেবে পেছন থেকে আছে, দৃশ্যত তাদের আক্রোশ কর্তৃত্ববাদী আওয়ামী লীগ বা হাসিনা রেজিমের চেয়ে ’৭১ এর ওপর বেশি। শুধু মুখ ফুটে বলতে পারছে না ’৭১-এর আগেই ভালো ছিলাম!
জুলাই ঘোষণাপত্রের বয়ান শুনে মনে হয়েছে আওয়ামী লীগ এবং শেখ হাসিনা এখনও রাষ্ট্র ক্ষমতায় এবং বিরোধী দলীয় ঐক্যজোট বিরোধী আন্দোলনকে অগ্রসর করার লক্ষ্যে কর্মসূচি ঘোষণা করছে। ঘোষণাপত্রে একতরফাভাবে বলা হয়েছে ১/১১’র পেছনের ‘ষড়যন্ত্রমূলক ব্যবস্থা’ আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় এনেছিল। অথচ তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে নিজ পক্ষে রাখার জন্য বিচারপতিদের চাকরির বয়স সীমা বাড়িয়ে রাজনীতির মাঠে এক সংঘাতমূলক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে ১/১১ ডেকে আনতে প্রধান ভূমিকা রাখে। এ রকম অসংখ্য ইতিহাস বিকৃতির এক বয়ান নোবেল লরিয়েট পঠিত ঘোষণাপত্রে উঠে এসেছে- যা নতুন করে বিভাজন সৃষ্টির ঘোষণা হিসেবেই পরিচিতি অর্জন করবে।
আলোচনা হচ্ছিল শেখ মুজিবকে ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে ফেলার জুলাই ঘোষণা নিয়ে। এই ঘোষণাকারীরা মনে করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা মানেই বাই ডিফল্ট আওয়ামী লীগের প্রতি আনুগত্য। শেখ হাসিনার বয়ানও কিন্তু অনেকটা তাই।তাহলে হাসিনার সঙ্গে তাদের পার্থক্য কী? শেখ মুজিবুর রহমানকে নিজের ও আওয়ামী লীগের নিজস্ব সম্পত্তি বানিয়ে শেখ হাসিনা মুজিবের প্রতি অবিচার করেছেন। তার নিজের করা অপরাধগুলোর ছায়ায় মুজিব স্মৃতি অনেকটা ঢাকা পড়ে গেছে। তার পরেও মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান নেতা। মানুষ কি শতভাগ শুদ্ধ হয়? শেখ মুজিবও শতভাগ শুদ্ধ ছিলেন না। তবুও তিনিই স্বাধীনতার নায়ক। এদেশের মানুষ তার ডাকে স্বাধীনতার মরণপণ যুদ্ধের জন্য তৈরি হয়েছিল। মুজিব প্রয়ান দিবসে তার প্রতি নিষ্ঠুর হবেন না। সে রাতের সেই নিষ্ঠুর ঘাতকেরা কিন্তু শেষ পর্যন্ত জিততে পারেনি!
[লেখক : সাবেক ছাত্র নেতা]