শাহ মো. জিয়াউদ্দিন
বাংলাদেশে বর্তমানে বহুল প্রচলিত একটি শব্দ হলো ‘মব জাস্টিস’। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে শুরু হয় এই মব জাস্টিস নামক কার্যক্রম। এই কার্যক্রম প্রকৃত অর্থে কতটা বিচারব্যবস্থার সঙ্গে সম্পূরক বা সামঞ্জস্যপূর্ণ, অথবা সভ্য সমাজে প্রচলিতÑ এটা জানা জরুরি। মবের ঘটনায় বাংলাদেশে বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। ‘মব জাস্টিস’ বিশ্বের অনেক দেশে চলে আসছে।
‘মব’ শব্দটি সাধারণত ‘ভিড়’ বা ‘জনতা’ অর্থে ব্যবহৃত হয়, বিশেষ করে যখন সেই ভিড় কোনো ধ্বংসাত্মক বা বিশৃঙ্খল কাজে লিপ্ত থাকে। এটি একটি অনিয়ন্ত্রিত জনতাকে বোঝায়, যারা সহিংস বা আক্রমণাত্মক আচরণ করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনো জনতা উত্তেজিত হয়ে কোনো দোকানে ভাঙচুর চালায়, তবে সেই পরিস্থিতিকে ‘মব অ্যাটাক’ বা ‘মব অ্যাকশন’ বলা যেতে পারে। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে, ‘মব রুল’ বা ‘মব লিঞ্চিং’ বলতে ভিড়ের দ্বারা আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার মতো ঘটনা বোঝায়। সংক্ষেপে, ‘মব’ এমন একটি ভিড়কে বোঝায় যা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন এবং যাদের আচরণ ধ্বংসাত্মক বা বিশৃঙ্খল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক সর্বজনীন ঘোষণার মতে, মব জাস্টিস মানবাধিকারের বড় লঙ্ঘন। ঘোষণার ১০ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ ট্রাইব্যুনালের অধীনে সবার সমতার ভিত্তিতে ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে। আর ঘোষণার ১১ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, আদালতে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত অভিযুক্ত ব্যক্তিকে নিরপরাধ হিসেবে গণ্য করতে হবে। একই সঙ্গে বিচারের সময় অভিযুক্ত ব্যক্তির আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ থাকতে হবে।
বাংলাদেশের সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সব নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।‘ মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস)-এর হিসাব অনুযায়ী, গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর সাত মাসে গণপিটুনিতে অন্তত ১১৯ জন নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন ৭৪ জন। আর গত ১০ বছরে গণপিটুনিতে মোট ৭৯২ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘটনা ঘটেছে ২০২৪ সালেÑ শুধু ওই বছরেই ১৭৯ জন নিহত হয়েছেন।
বিবিসির এক তথ্য থেকে আরও জানা যায়, বাংলাদেশে একের পর এক ‘মব ভায়োলেন্স’ বা ‘দলবদ্ধ বিশৃঙ্খলা’ সৃষ্টির ঘটনায় জনমনে আতঙ্ক ও ভয়ের পরিবেশ তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলোর হিসাবে, গত ছয় মাসে অন্তত ১৪১টি মব-সংক্রান্ত ঘটনায় ৮৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। দেশের রাজনীতিতে মব ইস্যু নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা বা ন্যারেটিভ দেয়া হচ্ছে। কোনো কোনো রাজনৈতিক দল মব বা দলবদ্ধ বিশৃঙ্খলার ঘটনাগুলোকে ‘জনরোষ’ হিসেবে বর্ণনা করছে। এমনকি প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব মবকে ক্ষুব্ধ মানুষের ‘প্রেসার গ্রুপ’ বলে অভিহিত করেছেন, যা নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। তাঁদের যুক্তি, পতিত আওয়ামী লীগের সাড়ে পনেরো বছরের শাসনে রাজনীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নির্যাতিতদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে কিছু ঘটনা ঘটছে।
তবে ভিন্ন ন্যারেটিভও রয়েছে রাজনীতিতে। কোনো কোনো রাজনীতিক মনে করেন, অন্তর্বর্তী সরকার তাদের ১১ মাসের শাসনে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়েছে। সে কারণেই মবের জবরদস্তি বেড়েছে। বর্তমানে প্রভাবশালী দলগুলোর মধ্যে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী এবং জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ছাত্র নেতৃত্বের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-র বিরুদ্ধেও মবের বহু ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ আছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার কিছু বক্তব্য মবকে সমর্থন করে বলে অনেকে মনে করেন। রাজনীতিতে মব নিয়ে ভিন্ন ব্যাখ্যা, বক্তব্য বা ন্যারেটিভ যাই থাকুক না কেনÑপরিস্থিতি যে উদ্বেগজনক, সে ব্যাপারে দলগুলোর মধ্যে দ্বিমত নেই।
মব নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না হলে দেশে পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হয়ে পড়তে পারেÑ এমন আশঙ্কার কথাও বলছেন অনেক রাজনীতিক। এটা চলতে থাকলে পরিস্থিতি মারাত্মক হওয়ার কারণ হলো, মব জাস্টিস এক ধরনের বিচারব্যবস্থা, যেখানে কোনো ব্যক্তি বা দলের বিচার করার জন্য আইনের আশ্রয় নেয়া হয় না। দেখা যাচ্ছে, জনতা নিজেরাই মারধর বা শাস্তির ব্যবস্থা করছে। এর পেছনে থাকতে পারে বিভিন্ন কারণ, যেমনÑ পুলিশের প্রতি অবিশ্বাস, দ্রুত বিচার না পাওয়া, অথবা সামাজিক অস্থিরতা। বাংলাদেশে গ্রামাঞ্চল ও শহরÑ দুই জায়গাতেই মাঝে মাঝে মব জাস্টিসের ঘটনা ঘটে থাকে, যেখানে উত্তেজিত জনতা চোর বা অন্য কোনো অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে মারধর করে।
তবে মব জাস্টিস আইন ও বিচারব্যবস্থার পরিপন্থী এবং এটি একটি গুরুতর অপরাধ। এর ক্ষতিকর প্রভাব হলোÑ মব জাস্টিস সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে এবং মানুষের মধ্যে ভয়ের পরিবেশ তৈরি করে। নিরীহ মানুষও এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মব জাস্টিস একটি অনাকাক্সিক্ষত এবং বেআইনি কাজ, যা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়।
‘জাস্টিস’ শব্দটি ন্যায় বা বিচারের অর্থে ব্যবহৃত হয়। এটি একটি নৈতিক ও আইনি ধারণা, যা সমাজে ন্যায় ও সাম্য প্রতিষ্ঠা করে। সাধারণভাবে, জাস্টিস হলো ন্যায়বিচার। বিচারব্যবস্থায় প্রত্যেক ব্যক্তির অধিকার রক্ষা করা হয় এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে দোষী ব্যক্তিকে শাস্তি ও নির্দোষ ব্যক্তিকে মুক্তি দেয়া হয়। বিচারব্যবস্থায় সমাজের সব স্তরের মানুষের প্রতি সমান আচরণ করা হয় এবং সুযোগের সমতা নিশ্চিত করা হয়।
অন্যদিকে ‘মব জাস্টিস’ বা জনতার বিচার একটি ভিন্ন ধারণা, যা সমাজে বিশৃঙ্খলা তৈরি করে। মব জাস্টিস হলোÑ যখন কোনো ব্যক্তি বা দলের প্রতি সন্দেহবশত উত্তেজিত জনতা আইন নিজের হাতে তুলে নেয় এবং অভিযুক্তকে মারধর বা শাস্তি দেয়, যা আইনের শাসনের পরিপন্থী। তাই রাষ্ট্রকে সমাজে জাস্টিস প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যা সমাজের শান্তি, শৃঙ্খলা ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করবে। সুতরাং রাষ্ট্রের আইন দ্বারা মব বন্ধ করা জরুরি।
মব জাস্টিসের ইতিহাস থেকে জানা যায়, অতীতে এ ধরনের অনেক ঘটনা ঘটেছে। পৃথিবীতে যখন মানুষ সামাজিক ব্যবস্থায় বসবাস শুরু করে, তখন থেকেই মব জাস্টিস ছিল। তখনকার সমাজে লিখিত কোনো আইন ছিল না। বিচার চলত সম্প্রদায়ভিত্তিক রীতিনীতির ওপর। অপরাধের জন্য কোনো ব্যক্তিকে কী শাস্তি দেয়া হবে, সে সিদ্ধান্ত নিতেন সম্প্রদায়ের সদস্যরা মিলে। এসব শাস্তি ছিল নৃশংস এবং জনসমক্ষে কার্যকর করা হতোÑ উদ্দেশ্য ছিল অপরাধ যেন ভবিষ্যৎতে আর না ঘটে।
বিগত শতকগুলোতেও বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে মব জাস্টিসের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে বহুল আলোচিত ঘটনা হলোÑ ১৬৯২ ও ১৬৯৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটসে ২০ জনকে মৃত্যুদ- দেয়া। হিস্ট্রি চ্যানেলের তথ্যানুযায়ী, কালো জাদুর অভিযোগ তুলে তাদের ‘ডাইনি’ আখ্যা দেয়া হয়েছিল। তাদের মৃত্যুদ-ের পেছনে কাজ করেছিল কুসংস্কার, জনরোষের ভয় ও ধর্মীয় উগ্রবাদ।
ইউরোপে ফরাসি বিপ্লবের সময় (১৭৮৯-১৭৯৯) যে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছিল, তার একটি বড় বৈশিষ্ট্য ছিল মব জাস্টিস। সে সময় প্যারিসের বাস্তিল দুর্গে হামলা চালিয়েছিল উচ্ছৃঙ্খল জনতা। অনেক মানুষকে শিরñেদ করে হত্যা করা হয়েছিল।
এছাড়া বড় জাতিগত হত্যা, গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, চূড়ান্ত দুর্নীতি ইত্যাদি ঘটনার পর উত্তেজিত মানুষের হাতে অভিযুক্তদের নিপীড়ন বা হত্যার নজির বিশ্বের নানা দেশে রয়েছে। যেমন, রিলিফ ওয়েবের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছেÑ ১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডা গণহত্যার পর ওই ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে অনেককে হত্যা করেছিল উত্তেজিত জনতা।
একটি মব সৃষ্টি হওয়া মানে ভবিষ্যৎতের জন্য আরেকটি মব তৈরির বীজ বপন করা। বাংলাদেশে সাধারণত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের ওপর ভিত্তি করেই মব সৃষ্টি হয়। সুতরাং ক্ষমতার পালাবদলে এটা চলতেই থাকবে, যদি আইনের শাসন যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠা করা না যায়। আরেকটি বিষয় মনে রাখা জরুরি, তা হলোÑ মবকে জাস্টিস বলা উচিত নয়। কারণ মবকে যদি জাস্টিস বলা হয়, তাহলে জাস্টিস শব্দটাই হয়ে যাবে অবমাননাকর।
[লেখক: উন্নয়নকর্মী]
শাহ মো. জিয়াউদ্দিন
বৃহস্পতিবার, ১৪ আগস্ট ২০২৫
বাংলাদেশে বর্তমানে বহুল প্রচলিত একটি শব্দ হলো ‘মব জাস্টিস’। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে শুরু হয় এই মব জাস্টিস নামক কার্যক্রম। এই কার্যক্রম প্রকৃত অর্থে কতটা বিচারব্যবস্থার সঙ্গে সম্পূরক বা সামঞ্জস্যপূর্ণ, অথবা সভ্য সমাজে প্রচলিতÑ এটা জানা জরুরি। মবের ঘটনায় বাংলাদেশে বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। ‘মব জাস্টিস’ বিশ্বের অনেক দেশে চলে আসছে।
‘মব’ শব্দটি সাধারণত ‘ভিড়’ বা ‘জনতা’ অর্থে ব্যবহৃত হয়, বিশেষ করে যখন সেই ভিড় কোনো ধ্বংসাত্মক বা বিশৃঙ্খল কাজে লিপ্ত থাকে। এটি একটি অনিয়ন্ত্রিত জনতাকে বোঝায়, যারা সহিংস বা আক্রমণাত্মক আচরণ করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনো জনতা উত্তেজিত হয়ে কোনো দোকানে ভাঙচুর চালায়, তবে সেই পরিস্থিতিকে ‘মব অ্যাটাক’ বা ‘মব অ্যাকশন’ বলা যেতে পারে। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে, ‘মব রুল’ বা ‘মব লিঞ্চিং’ বলতে ভিড়ের দ্বারা আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার মতো ঘটনা বোঝায়। সংক্ষেপে, ‘মব’ এমন একটি ভিড়কে বোঝায় যা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন এবং যাদের আচরণ ধ্বংসাত্মক বা বিশৃঙ্খল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক সর্বজনীন ঘোষণার মতে, মব জাস্টিস মানবাধিকারের বড় লঙ্ঘন। ঘোষণার ১০ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ ট্রাইব্যুনালের অধীনে সবার সমতার ভিত্তিতে ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে। আর ঘোষণার ১১ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, আদালতে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত অভিযুক্ত ব্যক্তিকে নিরপরাধ হিসেবে গণ্য করতে হবে। একই সঙ্গে বিচারের সময় অভিযুক্ত ব্যক্তির আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ থাকতে হবে।
বাংলাদেশের সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সব নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।‘ মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস)-এর হিসাব অনুযায়ী, গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর সাত মাসে গণপিটুনিতে অন্তত ১১৯ জন নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন ৭৪ জন। আর গত ১০ বছরে গণপিটুনিতে মোট ৭৯২ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘটনা ঘটেছে ২০২৪ সালেÑ শুধু ওই বছরেই ১৭৯ জন নিহত হয়েছেন।
বিবিসির এক তথ্য থেকে আরও জানা যায়, বাংলাদেশে একের পর এক ‘মব ভায়োলেন্স’ বা ‘দলবদ্ধ বিশৃঙ্খলা’ সৃষ্টির ঘটনায় জনমনে আতঙ্ক ও ভয়ের পরিবেশ তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলোর হিসাবে, গত ছয় মাসে অন্তত ১৪১টি মব-সংক্রান্ত ঘটনায় ৮৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। দেশের রাজনীতিতে মব ইস্যু নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা বা ন্যারেটিভ দেয়া হচ্ছে। কোনো কোনো রাজনৈতিক দল মব বা দলবদ্ধ বিশৃঙ্খলার ঘটনাগুলোকে ‘জনরোষ’ হিসেবে বর্ণনা করছে। এমনকি প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব মবকে ক্ষুব্ধ মানুষের ‘প্রেসার গ্রুপ’ বলে অভিহিত করেছেন, যা নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। তাঁদের যুক্তি, পতিত আওয়ামী লীগের সাড়ে পনেরো বছরের শাসনে রাজনীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নির্যাতিতদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে কিছু ঘটনা ঘটছে।
তবে ভিন্ন ন্যারেটিভও রয়েছে রাজনীতিতে। কোনো কোনো রাজনীতিক মনে করেন, অন্তর্বর্তী সরকার তাদের ১১ মাসের শাসনে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়েছে। সে কারণেই মবের জবরদস্তি বেড়েছে। বর্তমানে প্রভাবশালী দলগুলোর মধ্যে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী এবং জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ছাত্র নেতৃত্বের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-র বিরুদ্ধেও মবের বহু ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ আছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার কিছু বক্তব্য মবকে সমর্থন করে বলে অনেকে মনে করেন। রাজনীতিতে মব নিয়ে ভিন্ন ব্যাখ্যা, বক্তব্য বা ন্যারেটিভ যাই থাকুক না কেনÑপরিস্থিতি যে উদ্বেগজনক, সে ব্যাপারে দলগুলোর মধ্যে দ্বিমত নেই।
মব নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না হলে দেশে পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হয়ে পড়তে পারেÑ এমন আশঙ্কার কথাও বলছেন অনেক রাজনীতিক। এটা চলতে থাকলে পরিস্থিতি মারাত্মক হওয়ার কারণ হলো, মব জাস্টিস এক ধরনের বিচারব্যবস্থা, যেখানে কোনো ব্যক্তি বা দলের বিচার করার জন্য আইনের আশ্রয় নেয়া হয় না। দেখা যাচ্ছে, জনতা নিজেরাই মারধর বা শাস্তির ব্যবস্থা করছে। এর পেছনে থাকতে পারে বিভিন্ন কারণ, যেমনÑ পুলিশের প্রতি অবিশ্বাস, দ্রুত বিচার না পাওয়া, অথবা সামাজিক অস্থিরতা। বাংলাদেশে গ্রামাঞ্চল ও শহরÑ দুই জায়গাতেই মাঝে মাঝে মব জাস্টিসের ঘটনা ঘটে থাকে, যেখানে উত্তেজিত জনতা চোর বা অন্য কোনো অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে মারধর করে।
তবে মব জাস্টিস আইন ও বিচারব্যবস্থার পরিপন্থী এবং এটি একটি গুরুতর অপরাধ। এর ক্ষতিকর প্রভাব হলোÑ মব জাস্টিস সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে এবং মানুষের মধ্যে ভয়ের পরিবেশ তৈরি করে। নিরীহ মানুষও এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মব জাস্টিস একটি অনাকাক্সিক্ষত এবং বেআইনি কাজ, যা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়।
‘জাস্টিস’ শব্দটি ন্যায় বা বিচারের অর্থে ব্যবহৃত হয়। এটি একটি নৈতিক ও আইনি ধারণা, যা সমাজে ন্যায় ও সাম্য প্রতিষ্ঠা করে। সাধারণভাবে, জাস্টিস হলো ন্যায়বিচার। বিচারব্যবস্থায় প্রত্যেক ব্যক্তির অধিকার রক্ষা করা হয় এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে দোষী ব্যক্তিকে শাস্তি ও নির্দোষ ব্যক্তিকে মুক্তি দেয়া হয়। বিচারব্যবস্থায় সমাজের সব স্তরের মানুষের প্রতি সমান আচরণ করা হয় এবং সুযোগের সমতা নিশ্চিত করা হয়।
অন্যদিকে ‘মব জাস্টিস’ বা জনতার বিচার একটি ভিন্ন ধারণা, যা সমাজে বিশৃঙ্খলা তৈরি করে। মব জাস্টিস হলোÑ যখন কোনো ব্যক্তি বা দলের প্রতি সন্দেহবশত উত্তেজিত জনতা আইন নিজের হাতে তুলে নেয় এবং অভিযুক্তকে মারধর বা শাস্তি দেয়, যা আইনের শাসনের পরিপন্থী। তাই রাষ্ট্রকে সমাজে জাস্টিস প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যা সমাজের শান্তি, শৃঙ্খলা ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করবে। সুতরাং রাষ্ট্রের আইন দ্বারা মব বন্ধ করা জরুরি।
মব জাস্টিসের ইতিহাস থেকে জানা যায়, অতীতে এ ধরনের অনেক ঘটনা ঘটেছে। পৃথিবীতে যখন মানুষ সামাজিক ব্যবস্থায় বসবাস শুরু করে, তখন থেকেই মব জাস্টিস ছিল। তখনকার সমাজে লিখিত কোনো আইন ছিল না। বিচার চলত সম্প্রদায়ভিত্তিক রীতিনীতির ওপর। অপরাধের জন্য কোনো ব্যক্তিকে কী শাস্তি দেয়া হবে, সে সিদ্ধান্ত নিতেন সম্প্রদায়ের সদস্যরা মিলে। এসব শাস্তি ছিল নৃশংস এবং জনসমক্ষে কার্যকর করা হতোÑ উদ্দেশ্য ছিল অপরাধ যেন ভবিষ্যৎতে আর না ঘটে।
বিগত শতকগুলোতেও বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে মব জাস্টিসের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে বহুল আলোচিত ঘটনা হলোÑ ১৬৯২ ও ১৬৯৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটসে ২০ জনকে মৃত্যুদ- দেয়া। হিস্ট্রি চ্যানেলের তথ্যানুযায়ী, কালো জাদুর অভিযোগ তুলে তাদের ‘ডাইনি’ আখ্যা দেয়া হয়েছিল। তাদের মৃত্যুদ-ের পেছনে কাজ করেছিল কুসংস্কার, জনরোষের ভয় ও ধর্মীয় উগ্রবাদ।
ইউরোপে ফরাসি বিপ্লবের সময় (১৭৮৯-১৭৯৯) যে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছিল, তার একটি বড় বৈশিষ্ট্য ছিল মব জাস্টিস। সে সময় প্যারিসের বাস্তিল দুর্গে হামলা চালিয়েছিল উচ্ছৃঙ্খল জনতা। অনেক মানুষকে শিরñেদ করে হত্যা করা হয়েছিল।
এছাড়া বড় জাতিগত হত্যা, গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, চূড়ান্ত দুর্নীতি ইত্যাদি ঘটনার পর উত্তেজিত মানুষের হাতে অভিযুক্তদের নিপীড়ন বা হত্যার নজির বিশ্বের নানা দেশে রয়েছে। যেমন, রিলিফ ওয়েবের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছেÑ ১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডা গণহত্যার পর ওই ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে অনেককে হত্যা করেছিল উত্তেজিত জনতা।
একটি মব সৃষ্টি হওয়া মানে ভবিষ্যৎতের জন্য আরেকটি মব তৈরির বীজ বপন করা। বাংলাদেশে সাধারণত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের ওপর ভিত্তি করেই মব সৃষ্টি হয়। সুতরাং ক্ষমতার পালাবদলে এটা চলতেই থাকবে, যদি আইনের শাসন যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠা করা না যায়। আরেকটি বিষয় মনে রাখা জরুরি, তা হলোÑ মবকে জাস্টিস বলা উচিত নয়। কারণ মবকে যদি জাস্টিস বলা হয়, তাহলে জাস্টিস শব্দটাই হয়ে যাবে অবমাননাকর।
[লেখক: উন্নয়নকর্মী]