এম এ হোসাইন
আন্তর্জাতিক রাজনীতি মূলত স্বার্থের খেলাÑ বন্ধুত্বের নয়। স্বার্থ যখন পাল্টায়, মিত্রতাও বদলে যায়। সাম্প্রতিক সময়ে এর এক জীবন্ত উদাহরণ দেখা যাচ্ছে ভারত-চীন-মার্কিন সম্পর্কের নতুন সমীকরণে। ২০২৪ সালের শেষ দিক থেকে ভারতের পররাষ্ট্রনীতি ধীরে ধীরে কিন্তু স্পষ্টভাবে পুনর্বিন্যাস শুরু করেছে। লক্ষ্য পরিষ্কারÑমার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা কমানো এবং চীনের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্মূল্যায়ন। এটি দুর্বলতার পরিচয় নয়; এটি এক প্রয়োজনীয় বেঁচে থাকার কৌশল।
দীর্ঘদিন ধরে ভারত সূক্ষ্ম ভারসাম্যের কূটনীতি চালিয়ে এসেছেÑ ওয়াশিংটনের সঙ্গে কৌশলগত ঘনিষ্ঠতা বজায় রেখে একই সঙ্গে চীনের সঙ্গে সীমান্ত উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণে রাখা। কিন্তু ডনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে মার্কিন নীতির অস্থিরতা সেই ভারসাম্যকে নাড়া দিয়েছে। ২০২৫ সালের জুলাইয়ে রাশিয়ান জ্বালানি কেনা অব্যাহত রাখায় ট্রাম্প ভারতীয় পণ্যের ওপর ২৫% শুল্কারোপ করেন। মাত্র এক মাস পর তিনি আরও ২৫% শুল্কযোগ করেনÑ যা কার্যত শাস্তি দেয়ার সমান। বার্তাটি স্পষ্ট ছিল: ‘মার্কিন নির্দেশ অমান্য করলে শাস্তি, আনুগত্য দেখালেও পুরস্কার নেই।’
এটি ছিল ভারতের জন্য এক সতর্কবার্তা। হঠাৎ করে শুল্ক বাড়ানো যায়, কিন্তু সরবরাহ চেইন পুনর্গঠন করতে লাগে অনেক বছর। ফলে ওয়াশিংটন ক্রমেই অনিশ্চিত সঙ্গীতে পরিণত হচ্ছিলÑযার সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত পরিকল্পনা করা কঠিন।
ভারত-মার্কিন ঘনিষ্ঠতার পেছনে ছিল একটি বড় কারণÑচীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব এবং আগ্রাসী সীমান্ত নীতি। ২০২০ সালের গালওয়ান উপত্যকায় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর ভারত চীনের তিনশ’রও বেশি অ্যাপ নিষিদ্ধ করে, বিনিয়োগে কড়া নিয়ন্ত্রণ আনে, সীমান্তে সেনা মোতায়েন বাড়ায়। তখন সম্পর্ক ছিল মুখোমুখি সংঘাতের।
কিন্তু ইতিহাস বলেÑ শত্রুতা স্থায়ী নয়। ২০২৪ সালের অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং পাঁচ বছর পর প্রথমবার মুখোমুখি হন। যদিও গালওয়ানের ক্ষত মুছে যায়নি, এই বৈঠক সীমিত এক গলনের সূচনা করে। চীন তীর্থযাত্রা পথ খুলে দেয়, পর্যটক ভিসা পুনরায় চালু করে, সাংস্কৃতিক বিনিময় ফের শুরু হয়। ভারতও নির্দিষ্ট কিছু সীমান্ত এলাকায় টহল পুনরায় শুরু করে।
এর পেছনে ছিল বাস্তব হিসাব। বিশ্বব্যাপী ইলেকট্রনিক্স উৎপাদনের ৬০% নিয়ন্ত্রণ করে চীন। ভারতীয় কোম্পানিগুলো ইতোমধ্যেই প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলার ক্ষতির মুখে পড়েছিল চীনা সরবরাহ বন্ধ থাকায়। তাই চীনকে সম্পূর্ণ বাদ দেয়া অর্থনৈতিক আত্মঘাতী পদক্ষেপ হতো।
পাশ্চাত্যের সমালোচকরা বলছেন, এটি নাকি চীনের কাছে ভারতের নতিস্বীকার। আসলে, এটি কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন রক্ষার পদক্ষেপ। যুক্তরাষ্ট্র যখন ক্রমেই শর্তসাপেক্ষ ও লেনদেননির্ভর সম্পর্কের দিকে যাচ্ছে, তখন ভারতের লক্ষ্য হলোÑ কাউকে একচ্ছত্র ভরসা না করা এবং নিজের অর্থনৈতিক স্বার্থ ও সীমান্ত নিরাপত্তা দুই-ই রক্ষা করা।
ট্রাম্প প্রশাসন কেবল শুল্ক নয়, জ্বালানি আমদানির ওপর দ্বিতীয় পর্যায়ের নিষেধাজ্ঞার হুমকি দিয়েছে, গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি ও সামরিক সরঞ্জামের ছাড়পত্র বিলম্বিত করেছে। এমনকি পাকিস্তানের সামরিক শাসকের সঙ্গে ভারতের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর তুলনা করতেও দ্বিধা করেনিÑ যা কেবল অবমাননাকরই নয়, কৌশলগত অজ্ঞতার প্রমাণ।
এমন পরিস্থিতিতে দিল্লি বুঝে গেছে, ওয়াশিংটন ভারতের অপরিহার্য অংশীদার নয়, বরং নিজস্ব বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় তাকে একটি ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করতে চায়। ফলে বিকল্প খোঁজা ছাড়া উপায় নেইÑ আর সেই বিকল্পের নাম বেইজিং।
চীনের সঙ্গে সম্পর্ক সহজ নয়Ñ অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তিতে তার প্রাধান্য সুস্পষ্ট, সীমান্ত এখনও উত্তপ্ত। তবুও চীন কিছু পূর্বানুমেয় ধারা বজায় রাখেÑসংঘাত থাকলেও হঠাৎ নীতি বদলে দেয় না। যুক্তরাষ্ট্রের নীতির উল্টো স্রোতের তুলনায় এটি ভারতের জন্য তুলনামূলক স্থিতিশীল।
ভারতের ইতিহাসেও এই সতর্কতা নতুন নয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্যে পাকিস্তানের পক্ষে দাঁড়িয়ে নৌবহর পাঠিয়েছিল বঙ্গোপসাগরে। তখনও শিক্ষা ছিলÑ মার্কিন সমর্থন মুহূর্তে হারিয়ে যেতে পারে। আজ, সেই অবিশ্বাস নতুন রূপে ফিরে এসেছে।
বর্তমানে ভারতের কৌশল হলোÑ যেখানে সামান্য ছাড় দিয়ে উত্তেজনা কমানো যায়, তা করা; যেখানে জাতীয় স্বার্থে অটল থাকা জরুরি, সেখানে দৃঢ় থাকা; এবং সর্বোপরিÑসম্ভাব্য সব বিকল্প খোলা রাখা। এর মধ্যে রয়েছে জাপান, অস্ট্রেলিয়া, আসিয়ান দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করা, যারা চীনের প্রভাব নিয়ে উদ্বিগ্ন হলেও যুক্তরাষ্ট্রের অস্থির নীতির ওপর ভরসা করতে চায় না।
আজকের বাস্তবতা হলোÑ শীতল যুদ্ধ-পরবর্তী যুগে যতটা স্থায়ী জোটের নিশ্চয়তা ছিল, এখন তা আর নেই। যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনে রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্রক্সি যুদ্ধে লিপ্ত এবং মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলকে অর্থ ও অস্ত্র সরবরাহ করছে। তার কূটনৈতিক মনোযোগ ছড়িয়ে গেছে, এবং বন্ধুদের প্রতিও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে।
ভারতের বেইজিংমুখী সতর্ক অগ্রযাত্রা কোনো মতাদর্শিক সিদ্ধান্ত নয়। এটি সেই উপলব্ধি যে, বৈশ্বিক দাবার খেলায় টিকে থাকতে হলে নমনীয় হতে হবে। সঠিক সময়ে ছাড় দিতে হবে, প্রয়োজনে শক্ত অবস্থানে দাঁড়াতে হবে, এবং সব সময়ে জাতীয় স্বার্থকেই কেন্দ্রবিন্দুতে রাখতে হবে।
এটি দুর্বলতা নয়; এটি প্রজ্ঞা। এমন এক সময়ে যখন মিত্রতার চুক্তি শর্তহীন নয়, সবচেয়ে বিপজ্জনক অবস্থান হলো এমন কারও সঙ্গে অতিরিক্ত ঘনিষ্ঠ হওয়া, যে আপনাকে অপরিহার্য মনে করে না। তাই ভারতের কৌশল হলোÑ প্রয়োজন হলে পুরনো প্রতিদ্বন্দ্বীর হাত ধরা, তবে চোখ খোলা রেখে এবং নিজের বিকল্প অক্ষত রেখে।
যদি যুক্তরাষ্ট্র সত্যিই ভারতকে ধরে রাখতে চাইত, তবে তাকে দিল্লির কৌশলগত স্বাধীনতাকে সম্মান করতে হতো, এবং নীতিতে ধারাবাহিকতা আনতে হতো। কিন্তু সেই পরিবর্তনের সম্ভাবনা ক্ষীণ। তাই আপাতত ভারতকে তার পুরনো প্রতিদ্বন্দ্বীর দ্বারস্থ হতে হচ্ছেÑমাথা নত করে, কিন্তু চোখে অস্থিরতা আর অনিশ্চয়তার ছায়া নিয়ে।
[লেখক: প্রাবন্ধিক]
এম এ হোসাইন
বৃহস্পতিবার, ১৪ আগস্ট ২০২৫
আন্তর্জাতিক রাজনীতি মূলত স্বার্থের খেলাÑ বন্ধুত্বের নয়। স্বার্থ যখন পাল্টায়, মিত্রতাও বদলে যায়। সাম্প্রতিক সময়ে এর এক জীবন্ত উদাহরণ দেখা যাচ্ছে ভারত-চীন-মার্কিন সম্পর্কের নতুন সমীকরণে। ২০২৪ সালের শেষ দিক থেকে ভারতের পররাষ্ট্রনীতি ধীরে ধীরে কিন্তু স্পষ্টভাবে পুনর্বিন্যাস শুরু করেছে। লক্ষ্য পরিষ্কারÑমার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা কমানো এবং চীনের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্মূল্যায়ন। এটি দুর্বলতার পরিচয় নয়; এটি এক প্রয়োজনীয় বেঁচে থাকার কৌশল।
দীর্ঘদিন ধরে ভারত সূক্ষ্ম ভারসাম্যের কূটনীতি চালিয়ে এসেছেÑ ওয়াশিংটনের সঙ্গে কৌশলগত ঘনিষ্ঠতা বজায় রেখে একই সঙ্গে চীনের সঙ্গে সীমান্ত উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণে রাখা। কিন্তু ডনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে মার্কিন নীতির অস্থিরতা সেই ভারসাম্যকে নাড়া দিয়েছে। ২০২৫ সালের জুলাইয়ে রাশিয়ান জ্বালানি কেনা অব্যাহত রাখায় ট্রাম্প ভারতীয় পণ্যের ওপর ২৫% শুল্কারোপ করেন। মাত্র এক মাস পর তিনি আরও ২৫% শুল্কযোগ করেনÑ যা কার্যত শাস্তি দেয়ার সমান। বার্তাটি স্পষ্ট ছিল: ‘মার্কিন নির্দেশ অমান্য করলে শাস্তি, আনুগত্য দেখালেও পুরস্কার নেই।’
এটি ছিল ভারতের জন্য এক সতর্কবার্তা। হঠাৎ করে শুল্ক বাড়ানো যায়, কিন্তু সরবরাহ চেইন পুনর্গঠন করতে লাগে অনেক বছর। ফলে ওয়াশিংটন ক্রমেই অনিশ্চিত সঙ্গীতে পরিণত হচ্ছিলÑযার সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত পরিকল্পনা করা কঠিন।
ভারত-মার্কিন ঘনিষ্ঠতার পেছনে ছিল একটি বড় কারণÑচীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব এবং আগ্রাসী সীমান্ত নীতি। ২০২০ সালের গালওয়ান উপত্যকায় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর ভারত চীনের তিনশ’রও বেশি অ্যাপ নিষিদ্ধ করে, বিনিয়োগে কড়া নিয়ন্ত্রণ আনে, সীমান্তে সেনা মোতায়েন বাড়ায়। তখন সম্পর্ক ছিল মুখোমুখি সংঘাতের।
কিন্তু ইতিহাস বলেÑ শত্রুতা স্থায়ী নয়। ২০২৪ সালের অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং পাঁচ বছর পর প্রথমবার মুখোমুখি হন। যদিও গালওয়ানের ক্ষত মুছে যায়নি, এই বৈঠক সীমিত এক গলনের সূচনা করে। চীন তীর্থযাত্রা পথ খুলে দেয়, পর্যটক ভিসা পুনরায় চালু করে, সাংস্কৃতিক বিনিময় ফের শুরু হয়। ভারতও নির্দিষ্ট কিছু সীমান্ত এলাকায় টহল পুনরায় শুরু করে।
এর পেছনে ছিল বাস্তব হিসাব। বিশ্বব্যাপী ইলেকট্রনিক্স উৎপাদনের ৬০% নিয়ন্ত্রণ করে চীন। ভারতীয় কোম্পানিগুলো ইতোমধ্যেই প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলার ক্ষতির মুখে পড়েছিল চীনা সরবরাহ বন্ধ থাকায়। তাই চীনকে সম্পূর্ণ বাদ দেয়া অর্থনৈতিক আত্মঘাতী পদক্ষেপ হতো।
পাশ্চাত্যের সমালোচকরা বলছেন, এটি নাকি চীনের কাছে ভারতের নতিস্বীকার। আসলে, এটি কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন রক্ষার পদক্ষেপ। যুক্তরাষ্ট্র যখন ক্রমেই শর্তসাপেক্ষ ও লেনদেননির্ভর সম্পর্কের দিকে যাচ্ছে, তখন ভারতের লক্ষ্য হলোÑ কাউকে একচ্ছত্র ভরসা না করা এবং নিজের অর্থনৈতিক স্বার্থ ও সীমান্ত নিরাপত্তা দুই-ই রক্ষা করা।
ট্রাম্প প্রশাসন কেবল শুল্ক নয়, জ্বালানি আমদানির ওপর দ্বিতীয় পর্যায়ের নিষেধাজ্ঞার হুমকি দিয়েছে, গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি ও সামরিক সরঞ্জামের ছাড়পত্র বিলম্বিত করেছে। এমনকি পাকিস্তানের সামরিক শাসকের সঙ্গে ভারতের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর তুলনা করতেও দ্বিধা করেনিÑ যা কেবল অবমাননাকরই নয়, কৌশলগত অজ্ঞতার প্রমাণ।
এমন পরিস্থিতিতে দিল্লি বুঝে গেছে, ওয়াশিংটন ভারতের অপরিহার্য অংশীদার নয়, বরং নিজস্ব বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় তাকে একটি ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করতে চায়। ফলে বিকল্প খোঁজা ছাড়া উপায় নেইÑ আর সেই বিকল্পের নাম বেইজিং।
চীনের সঙ্গে সম্পর্ক সহজ নয়Ñ অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তিতে তার প্রাধান্য সুস্পষ্ট, সীমান্ত এখনও উত্তপ্ত। তবুও চীন কিছু পূর্বানুমেয় ধারা বজায় রাখেÑসংঘাত থাকলেও হঠাৎ নীতি বদলে দেয় না। যুক্তরাষ্ট্রের নীতির উল্টো স্রোতের তুলনায় এটি ভারতের জন্য তুলনামূলক স্থিতিশীল।
ভারতের ইতিহাসেও এই সতর্কতা নতুন নয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্যে পাকিস্তানের পক্ষে দাঁড়িয়ে নৌবহর পাঠিয়েছিল বঙ্গোপসাগরে। তখনও শিক্ষা ছিলÑ মার্কিন সমর্থন মুহূর্তে হারিয়ে যেতে পারে। আজ, সেই অবিশ্বাস নতুন রূপে ফিরে এসেছে।
বর্তমানে ভারতের কৌশল হলোÑ যেখানে সামান্য ছাড় দিয়ে উত্তেজনা কমানো যায়, তা করা; যেখানে জাতীয় স্বার্থে অটল থাকা জরুরি, সেখানে দৃঢ় থাকা; এবং সর্বোপরিÑসম্ভাব্য সব বিকল্প খোলা রাখা। এর মধ্যে রয়েছে জাপান, অস্ট্রেলিয়া, আসিয়ান দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করা, যারা চীনের প্রভাব নিয়ে উদ্বিগ্ন হলেও যুক্তরাষ্ট্রের অস্থির নীতির ওপর ভরসা করতে চায় না।
আজকের বাস্তবতা হলোÑ শীতল যুদ্ধ-পরবর্তী যুগে যতটা স্থায়ী জোটের নিশ্চয়তা ছিল, এখন তা আর নেই। যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনে রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্রক্সি যুদ্ধে লিপ্ত এবং মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলকে অর্থ ও অস্ত্র সরবরাহ করছে। তার কূটনৈতিক মনোযোগ ছড়িয়ে গেছে, এবং বন্ধুদের প্রতিও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে।
ভারতের বেইজিংমুখী সতর্ক অগ্রযাত্রা কোনো মতাদর্শিক সিদ্ধান্ত নয়। এটি সেই উপলব্ধি যে, বৈশ্বিক দাবার খেলায় টিকে থাকতে হলে নমনীয় হতে হবে। সঠিক সময়ে ছাড় দিতে হবে, প্রয়োজনে শক্ত অবস্থানে দাঁড়াতে হবে, এবং সব সময়ে জাতীয় স্বার্থকেই কেন্দ্রবিন্দুতে রাখতে হবে।
এটি দুর্বলতা নয়; এটি প্রজ্ঞা। এমন এক সময়ে যখন মিত্রতার চুক্তি শর্তহীন নয়, সবচেয়ে বিপজ্জনক অবস্থান হলো এমন কারও সঙ্গে অতিরিক্ত ঘনিষ্ঠ হওয়া, যে আপনাকে অপরিহার্য মনে করে না। তাই ভারতের কৌশল হলোÑ প্রয়োজন হলে পুরনো প্রতিদ্বন্দ্বীর হাত ধরা, তবে চোখ খোলা রেখে এবং নিজের বিকল্প অক্ষত রেখে।
যদি যুক্তরাষ্ট্র সত্যিই ভারতকে ধরে রাখতে চাইত, তবে তাকে দিল্লির কৌশলগত স্বাধীনতাকে সম্মান করতে হতো, এবং নীতিতে ধারাবাহিকতা আনতে হতো। কিন্তু সেই পরিবর্তনের সম্ভাবনা ক্ষীণ। তাই আপাতত ভারতকে তার পুরনো প্রতিদ্বন্দ্বীর দ্বারস্থ হতে হচ্ছেÑমাথা নত করে, কিন্তু চোখে অস্থিরতা আর অনিশ্চয়তার ছায়া নিয়ে।
[লেখক: প্রাবন্ধিক]