alt

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

পরশ্রীকাতরতা: সামাজিক ব্যাধির অদৃশ্য শেকল

কামরুজ্জামান

: রোববার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫

মানুষ মানুষের সাথে বন্ধুত্ব তৈরি করে, মানুষ মানুষকে ভালবাসে। মানুষ মানুষের জন্য জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করে। পৃথিবীতে মানুষের মহানুভবতার গল্প বলে শেষ করা যাবে না। আবার এই মানুষই একজন আরেকজনকে হিংসা করে, একজন আরেকজনকে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে। একজন আরেকজনের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে চরম ক্ষতি করে। আবার কিছু মানুষ কোনো কারণ ছাড়াই পরশ্রীকাতরতায় ভোগে। শুধু পরশ্রীকাতরতায় ভোগে না। যার প্রতি তার পরশ্রীকাতরা সুযোগ পেলে তার চরম ক্ষতি পর্যন্ত করে ফেলে।

পরশ্রীকাতরতা এক ধরনের মানসিক অতৃপ্তির বহিঃপ্রকাশ। অন্যের ভালো কিছু দেখলেই হিংসা করে, পরশ্রীকাতরতায় ভুগতে থাকে। এটা এক ধরনের মানসিক রোগ। কিন্তু অসুবিধা হচ্ছে - এ রোগে পরশ্রী কাতর ব্যক্তির যেমন ক্ষতি হয় তেমনি ক্ষতি হয় যার প্রতি তার এই পরশ্রীকাতর বিদ্বেষ আচরণ তারও। পরশ্রী কাতর ব্যক্তি সবসময় বদনাম করে বেড়ায়। সামাজিকভাবে ক্ষতি করার চেষ্টা করে। পরশ্রীকাতরতায় ভোগা মানুষটিও মানসিক যন্ত্রণায় ভোগে এবং কোনো কোনো পর্যায়ে হীন মানসিকতার পরিচয় দেয়। যা তার চরিত্রকে উন্মেষ করে।

পরশ্রীকাতরতা আসলে কি? পরশ্রীকাতরতা হলো অন্যের উন্নতি, সৌভাগ্য বা ভালো কিছু দেখে তাতে ঈর্ষান্বিত হওয়া এবং তা সহ্য করতে না পারা এক ধরনের মানসিক নেতিবাচক অনুভূতি প্রকাশ করা । সহজ ভাষায়, এটি অন্যের ভালো দেখে তার প্রতি ঘৃণা বা হিংসা প্রকাশ করা। পরশ্রী কাতর ব্যক্তি অন্যের ভালো সহ্য করতে পারে না। যে ব্যক্তি অন্যের ধন-দৌলত, সম্মান, ভালো ফল বা উচ্চ মর্যাদা দেখে ঈর্ষা অনুভব করে, সেই আসলে পরশ্রীকাতর।

অতি সাধারণভাবে বলতে গেলে অন্যের শ্রী দেখে যে কাতর হয় তাকে পরশ্রীকাতর বলে। পরশ্রীকাতরতা একটি অসুখ। এতে ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে হিংসা, বিদ্বেষ, দ্বন্দ্ব, কলহ ও বিবাদ মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পায়। শান্তি ও স্বস্তির জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিষহ। আজকের বাংলাদেশের চিত্র বলে দেয় মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা, কর্তব্যবোধ, সহানুভূতি ও সহমর্মিতা দিনদিন কমছে। খুব আশঙ্কাজনক হারেই কমছে। এর মূলে রয়েছে পরশ্রীকাতরতা।

সেই আদিকাল থেকেই পরশ্রীকাতরতা ও পরনিন্দা এক মারাত্মক সামাজিক ব্যাধি। বর্তমানে ফেসবুকসহ যাবতীয় সোশ্যাল মিডিয়া এ ব্যাধিকে আরও উসকে দিচ্ছে। কেউ মন্দ থাকলে অন্যরা যতটা ব্যথিত হন, ভালো থাকলে তার চেয়ে বেশি ব্যথিত হন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেওয়া পোস্টের নিচে বাহারি শুভেচ্ছা ও শুভকামনা দেখে খুশি হয় ঠিকই কিন্তু প্রকৃত চিত্র ভিন্ন। এগুলো আজকাল মানসিক ব্যাধি এবং সম্পূর্ণ বাহ্যিক লোক দেখানো সামাজিকতায় পরিপূর্ণ। মানুষের ভিতরের প্রকৃত চিত্রটি সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং হিংসা বিদ্বেষে ভরপুর। এটা বুঝা যায় - যখন পদপদবী ও স্বার্থ বিষয়ক কোনো সংশ্লিষ্ট কাজে চাওয়া-পাওয়া শুরু হয় তখনই উল্টে যেতে থাকে সম্পর্ক। বিচ্ছেদে রূপ নেয়। শুরু হয় দ্বন্দ্ব সংঘাতের।

কথা হলো পরশ্রী কাতর কি হতেই হবে? একজন মানুষ কেন পরশ্রী কাতর হয়? কেন একজন মানুষ আরেকজন মানুষের ভালো দেখতে পারে না। কেন একজন মানুষ আরেকজন মানুষের সফলতাকে হিংসা করে। এর বহুবিধ কারণ রয়েছে - কারণগুলো কিছুটা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি এবং মানসিক দৈন্যতার বহিঃপ্রকাশ আর কিছুটা বাহ্যিক আকর্ষণ। বাহ্যিক আকর্ষণ মানুষকে যতটা হীনমন্য করে তারচেয়ে বেশী করে মানুষের ভিতরের প্রবৃত্তি। মানুষের পারিপার্শ্বিক অবস্থা, জন্ম পরিবার ও সমাজ কাঠামো পরশ্রী কাতরতা তৈরি করে। আবার অশিক্ষা কুসংস্কারও পরশ্রীকাতরতা তৈরি করে। তবে প্রকৃত শিক্ষার অভাব মানুষকে হীনমন্যতায় ভোগায়, পরশ্রী কাতর হতে সাহায্য করে। আরও একটি বিষয় হচ্ছে - সঙ্গীর সংস্পর্শ। আমাদের দেশে কথা প্রচলিত আছে। ‘সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে।’ ভালো মানুষের সাথে মিশলে ভালো কিছু শেখা যায়। আর খারাপ মানুষের সঙ্গে মিশলে খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। পরশ্রী কাতর ব্যক্তির সঙ্গী পরশ্রীকাতরতা শিখবে এটাই স্বাভাবিক।

মানুষ তার ভিতরের প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে খুব কমই। যারা পারে তারা শক্তিশালী মনের মানুষ। পৃথিবীতে এখন আর মহামানব নেই। তবে ভালো মানুষ আছে। ভালো মানুষ হয়ে ওঠা কঠিন। বর্তমানে সময়ে ভালো মানুষ হয়ে ওঠা, ভালো হয়ে চলা আরও কঠিন। চাকচিক্য সমাজ, স্যোসাল মিডিয়ার আধিপত্য ও লোক দেখানো সংস্কৃতি আজ আগ্রাসী হয়ে মানব জীবনে প্রভাব ফেলছে। মুহুর্তের মধ্যেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে রঙিন দুনিয়া। মানুষও নিজেকে প্রকাশ করতে চায়, উপস্থাপন করতে চায় আকর্ষণীয় রূপে। মানুষের যা নাই তার চেয়ে বেশি করে প্রকাশ করার মানসিকতা জেকে বসেছে। এটা যেন এক ঠা-া প্রতিযোগিতার লড়াই চলছে। এবং এ লড়াই গিয়ে ঠেকছে পরশ্রীকাতরতায় ও হিংসা বিদ্বেষে।

পরশ্রীকাতরতার ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক প্রভাব মারাত্মক। পরশ্রী কাতর ব্যক্তি শুধু নিজের ক্ষতি করে না অন্য মানুষের ক্ষতিও করে। কখনও কখনও মানুষকে বিপদের মুখে ঠেলে দেয়। এমন সব কথা তৈরি করে যার ফলে পারিবারিক ও সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে কর্মক্ষেত্রে এ সমস্যা বেশি দেখা যায়। একজনের পদোন্নতি হলে অন্যজন হিংসা করে। একজন পদপদবী পেলে আরেকজন পরশ্রী কাতর হয়ে পড়ে। পরশ্রীকাতরতার কারণে অনেকসময় বন্ধুত্বে ফাটল ধরে, সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়। পারিবারিকভাবে এক সদস্য আরেক সদস্যের শত্রুতে পরিণত হয়। সবারই উচিত পরশ্রী কাতর না হওয়া। পরশ্রী কাতর না হয়ে নিজের উন্নতির প্রতি মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। আর এর জন্য কিছু বিষয় অনুসরণ করা প্রয়োজন:

মানসিক দৃঢ়তা : প্রথমে পরশ্রীকাতরতার কুফল সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। আত্মনির্ভরশীল হতে হতে হবে। হতে হবে মানসিকভাবে দৃঢ় চেতনার মানুষ। কারণ আত্মনির্ভরশীল ও মানসিকভাবে শক্তিশালী মানুষ ঈর্ষাকে প্রশ্রয় দেয় না।

অন্যের সাথে তুলনা পরিহার : অন্যের সাথে নিজেকে তুলনা করা বন্ধ করতে হবে । জগতে প্রতিটি মানুষ আলাদা। চিন্তা কর্ম মেধা যোগ্যতা সবই আলাদা। অন্যের সাথে তুলনা না করে নিজের কাজ ও যোগ্যতাকে মূল্যায়ন করা প্রয়োজন।

স্যোসাল মিডিয়ায় কম থাকা: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে দূরে থাকা উচিত । বর্তমানে যারাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশি সংযুক্ত তারা কমবেশি পরশ্রী কাতর। এটা তাদের কথাবার্তায় আচরণে প্রকাশ পায়। তাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ে খুব বেশি মনোযোগ না-হওয়াই উত্তম। হলেও গুরুত্ব কম দিতে হবে। এর ফলে পরশ্রী কাতর হওয়া থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।

ধন্যবাদ এবং প্রশংসা করা : অন্যের ভালো গুণ বা অর্জন দেখলে ঈর্ষা না করে প্রশংসা করুন। যিনি প্রশংসা করতে পারেন, তার জীবনে এটি একটি ইতিবাচক অভ্যাসে পরিণত হয়। নিজের প্রাপ্তির জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করাও পরশ্রীকাতরতা কমাতে সাহায্য করে।

নিজেকে ও নিজের কাজকে ভালোবাসা : নিজের দক্ষতা, ভালো কাজ এবং উন্নতির দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত। সবার আগে নিজের কাজ এবং নিজেকে ভালোবাসা উচিত। নিজেকে এবং নিজের কাজকে ভালোবাসলে অন্যের প্রতি ঈর্ষার পরিবর্তে নিজের প্রতি মহত্ত্ববোধ তৈরি হবে যা অন্যের প্রতি শ্রদ্ধা বাড়িয়ে দিবে।

ইতিবাচক চিন্তা করা : পরশ্রীকাতরতা থেকে মুক্তি পেতে হলে নেতিবাচক চিন্তা বাদ দিয়ে ইতিবাচক চিন্তা করতে হবে। পরনিন্দা থেকে নিজেকে দূরে রাখতে হবে। অন্যের ক্ষতি কামনা না করে নিজের জীবনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে এমন কাজ করতে হবে।

নৈতিক শিক্ষা অর্জন ও নৈতিক কাজ করা : পরিচ্ছন্ন ও ভালো জীবনযাপনের জন্য ধর্মীয় আচারের বিকল্প নেই। পরশ্রী কাতরতা দূর করার জন্য ধর্মীয় জীবনযাপন করতে হবে। কারণ - সকল ধর্মেই পরশ্রী কাতরতা পরিহার করতে বলা হয়েছে।

পরশ্রীকাতরতা মানুষের মানবিক চেতনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। পরশ্রী কাতরতা থেকে বের হয়ে আসা জরুরি। এর জন্য প্রয়োজন প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া। অন্যের সম্পদ, সৌন্দর্য ও যোগ্যতাকে হিংসা না করে নিজেকে ভালোবাসা, নিজের কাজকে সম্মান করা।

[লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ভূগোল বিভাগ, মুক্তিযোদ্ধা কলেজ, ভাওয়ালগড়, গাজীপুর]

ছবি

কৃষি ডেটা ব্যবস্থাপনা

যুক্তরাজ্যে ভর্তি স্থগিতের কুয়াশা: তালা লাগলেও চাবি আমাদের হাতে

শিক্ষকদের কর্মবিরতি: পেশাগত নৈতিকতা ও দায়িত্ববোধ

জাতীয় রক্তগ্রুপ নির্ণয় দিবস

জাল সনদপত্রে শিক্ষকতা

সাধারণ চুক্তিগুলোও গোপনীয় কেন

ছবি

শিশুখাদ্যের নিরাপত্তা: জাতির ভবিষ্যৎ সুরক্ষার প্রথম শর্ত

ছবি

ফিনল্যান্ড কেন সুখী দেশ

ছবি

কৃষকের সংকট ও অর্থনীতির ভবিষ্যৎ

আলু চাষের আধুনিক প্রযুক্তি

ই-বর্জ্য: নীরব বিষে দগ্ধ আমাদের ভবিষ্যৎ

ঢাকার জনপরিসর: আর্ভিং গফম্যানের সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ

আলু চাষের আধুনিক প্রযুক্তি

কলি ফুটিতে চাহে ফোটে না!

কৃষিতে স্মার্ট প্রযুক্তি

রোহিঙ্গা সংকটের টেকসই সমাধানে লোকালাইজেশন অপরিহার্য

আইসিইউ থেকে বাড়ি ফেরা ও খাদের কিনারায় থাকা দেশ

বিচারবহির্ভূত হত্যার দায় কার?

ছবি

ট্রাম্পের ভেনেজুয়েলা কৌশল

অযৌক্তিক দাবি: পেশাগত নৈতিকতার সংকট ও জনপ্রশাসন

সড়ক দুর্ঘটনা এখন জাতীয় সংকট

কেন বাড়ছে দারিদ্র্য?

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পুনর্জন্ম

লবণাক্ততায় ডুবছে উপকূল

বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন ও বাস্তবতা

সড়ক দুর্ঘটনার সমাজতত্ত্ব: আইন প্রয়োগের ব্যর্থতা ও কাঠামোর চক্রাকার পুনরুৎপাদন

ছবি

অস্থির সময় ও অস্থির সমাজের পাঁচালি

ভারতে বামপন্থার পুনর্জাগরণ: ব্যাধি ও প্রতিকার

চিপনির্ভরতা কাটিয়ে চীনের উত্থান

একতার বাতাসে উড়ুক দক্ষিণ এশিয়ার পতাকা

ছবি

স্মরণ: শহীদ ডা. মিলন ও বৈষম্যহীন ব্যবস্থার সংগ্রাম

মনে পুরানো দিনের কথা আসে, মনে আসে, ফিরে আসে...

রাসায়নিক দূষণ ও ক্যান্সারের ঝুঁকি

আছদগঞ্জের শুটকি : অতীতের গৌরব, বর্তমানের দুঃসময়

নবান্নের আনন্দ ও আমনের ফলন

‘প্রশ্ন কোরো না, প্রশ্ন সর্বনাশী’

tab

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

পরশ্রীকাতরতা: সামাজিক ব্যাধির অদৃশ্য শেকল

কামরুজ্জামান

রোববার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫

মানুষ মানুষের সাথে বন্ধুত্ব তৈরি করে, মানুষ মানুষকে ভালবাসে। মানুষ মানুষের জন্য জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করে। পৃথিবীতে মানুষের মহানুভবতার গল্প বলে শেষ করা যাবে না। আবার এই মানুষই একজন আরেকজনকে হিংসা করে, একজন আরেকজনকে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে। একজন আরেকজনের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে চরম ক্ষতি করে। আবার কিছু মানুষ কোনো কারণ ছাড়াই পরশ্রীকাতরতায় ভোগে। শুধু পরশ্রীকাতরতায় ভোগে না। যার প্রতি তার পরশ্রীকাতরা সুযোগ পেলে তার চরম ক্ষতি পর্যন্ত করে ফেলে।

পরশ্রীকাতরতা এক ধরনের মানসিক অতৃপ্তির বহিঃপ্রকাশ। অন্যের ভালো কিছু দেখলেই হিংসা করে, পরশ্রীকাতরতায় ভুগতে থাকে। এটা এক ধরনের মানসিক রোগ। কিন্তু অসুবিধা হচ্ছে - এ রোগে পরশ্রী কাতর ব্যক্তির যেমন ক্ষতি হয় তেমনি ক্ষতি হয় যার প্রতি তার এই পরশ্রীকাতর বিদ্বেষ আচরণ তারও। পরশ্রী কাতর ব্যক্তি সবসময় বদনাম করে বেড়ায়। সামাজিকভাবে ক্ষতি করার চেষ্টা করে। পরশ্রীকাতরতায় ভোগা মানুষটিও মানসিক যন্ত্রণায় ভোগে এবং কোনো কোনো পর্যায়ে হীন মানসিকতার পরিচয় দেয়। যা তার চরিত্রকে উন্মেষ করে।

পরশ্রীকাতরতা আসলে কি? পরশ্রীকাতরতা হলো অন্যের উন্নতি, সৌভাগ্য বা ভালো কিছু দেখে তাতে ঈর্ষান্বিত হওয়া এবং তা সহ্য করতে না পারা এক ধরনের মানসিক নেতিবাচক অনুভূতি প্রকাশ করা । সহজ ভাষায়, এটি অন্যের ভালো দেখে তার প্রতি ঘৃণা বা হিংসা প্রকাশ করা। পরশ্রী কাতর ব্যক্তি অন্যের ভালো সহ্য করতে পারে না। যে ব্যক্তি অন্যের ধন-দৌলত, সম্মান, ভালো ফল বা উচ্চ মর্যাদা দেখে ঈর্ষা অনুভব করে, সেই আসলে পরশ্রীকাতর।

অতি সাধারণভাবে বলতে গেলে অন্যের শ্রী দেখে যে কাতর হয় তাকে পরশ্রীকাতর বলে। পরশ্রীকাতরতা একটি অসুখ। এতে ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে হিংসা, বিদ্বেষ, দ্বন্দ্ব, কলহ ও বিবাদ মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পায়। শান্তি ও স্বস্তির জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিষহ। আজকের বাংলাদেশের চিত্র বলে দেয় মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা, কর্তব্যবোধ, সহানুভূতি ও সহমর্মিতা দিনদিন কমছে। খুব আশঙ্কাজনক হারেই কমছে। এর মূলে রয়েছে পরশ্রীকাতরতা।

সেই আদিকাল থেকেই পরশ্রীকাতরতা ও পরনিন্দা এক মারাত্মক সামাজিক ব্যাধি। বর্তমানে ফেসবুকসহ যাবতীয় সোশ্যাল মিডিয়া এ ব্যাধিকে আরও উসকে দিচ্ছে। কেউ মন্দ থাকলে অন্যরা যতটা ব্যথিত হন, ভালো থাকলে তার চেয়ে বেশি ব্যথিত হন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেওয়া পোস্টের নিচে বাহারি শুভেচ্ছা ও শুভকামনা দেখে খুশি হয় ঠিকই কিন্তু প্রকৃত চিত্র ভিন্ন। এগুলো আজকাল মানসিক ব্যাধি এবং সম্পূর্ণ বাহ্যিক লোক দেখানো সামাজিকতায় পরিপূর্ণ। মানুষের ভিতরের প্রকৃত চিত্রটি সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং হিংসা বিদ্বেষে ভরপুর। এটা বুঝা যায় - যখন পদপদবী ও স্বার্থ বিষয়ক কোনো সংশ্লিষ্ট কাজে চাওয়া-পাওয়া শুরু হয় তখনই উল্টে যেতে থাকে সম্পর্ক। বিচ্ছেদে রূপ নেয়। শুরু হয় দ্বন্দ্ব সংঘাতের।

কথা হলো পরশ্রী কাতর কি হতেই হবে? একজন মানুষ কেন পরশ্রী কাতর হয়? কেন একজন মানুষ আরেকজন মানুষের ভালো দেখতে পারে না। কেন একজন মানুষ আরেকজন মানুষের সফলতাকে হিংসা করে। এর বহুবিধ কারণ রয়েছে - কারণগুলো কিছুটা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি এবং মানসিক দৈন্যতার বহিঃপ্রকাশ আর কিছুটা বাহ্যিক আকর্ষণ। বাহ্যিক আকর্ষণ মানুষকে যতটা হীনমন্য করে তারচেয়ে বেশী করে মানুষের ভিতরের প্রবৃত্তি। মানুষের পারিপার্শ্বিক অবস্থা, জন্ম পরিবার ও সমাজ কাঠামো পরশ্রী কাতরতা তৈরি করে। আবার অশিক্ষা কুসংস্কারও পরশ্রীকাতরতা তৈরি করে। তবে প্রকৃত শিক্ষার অভাব মানুষকে হীনমন্যতায় ভোগায়, পরশ্রী কাতর হতে সাহায্য করে। আরও একটি বিষয় হচ্ছে - সঙ্গীর সংস্পর্শ। আমাদের দেশে কথা প্রচলিত আছে। ‘সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে।’ ভালো মানুষের সাথে মিশলে ভালো কিছু শেখা যায়। আর খারাপ মানুষের সঙ্গে মিশলে খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। পরশ্রী কাতর ব্যক্তির সঙ্গী পরশ্রীকাতরতা শিখবে এটাই স্বাভাবিক।

মানুষ তার ভিতরের প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে খুব কমই। যারা পারে তারা শক্তিশালী মনের মানুষ। পৃথিবীতে এখন আর মহামানব নেই। তবে ভালো মানুষ আছে। ভালো মানুষ হয়ে ওঠা কঠিন। বর্তমানে সময়ে ভালো মানুষ হয়ে ওঠা, ভালো হয়ে চলা আরও কঠিন। চাকচিক্য সমাজ, স্যোসাল মিডিয়ার আধিপত্য ও লোক দেখানো সংস্কৃতি আজ আগ্রাসী হয়ে মানব জীবনে প্রভাব ফেলছে। মুহুর্তের মধ্যেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে রঙিন দুনিয়া। মানুষও নিজেকে প্রকাশ করতে চায়, উপস্থাপন করতে চায় আকর্ষণীয় রূপে। মানুষের যা নাই তার চেয়ে বেশি করে প্রকাশ করার মানসিকতা জেকে বসেছে। এটা যেন এক ঠা-া প্রতিযোগিতার লড়াই চলছে। এবং এ লড়াই গিয়ে ঠেকছে পরশ্রীকাতরতায় ও হিংসা বিদ্বেষে।

পরশ্রীকাতরতার ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক প্রভাব মারাত্মক। পরশ্রী কাতর ব্যক্তি শুধু নিজের ক্ষতি করে না অন্য মানুষের ক্ষতিও করে। কখনও কখনও মানুষকে বিপদের মুখে ঠেলে দেয়। এমন সব কথা তৈরি করে যার ফলে পারিবারিক ও সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে কর্মক্ষেত্রে এ সমস্যা বেশি দেখা যায়। একজনের পদোন্নতি হলে অন্যজন হিংসা করে। একজন পদপদবী পেলে আরেকজন পরশ্রী কাতর হয়ে পড়ে। পরশ্রীকাতরতার কারণে অনেকসময় বন্ধুত্বে ফাটল ধরে, সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়। পারিবারিকভাবে এক সদস্য আরেক সদস্যের শত্রুতে পরিণত হয়। সবারই উচিত পরশ্রী কাতর না হওয়া। পরশ্রী কাতর না হয়ে নিজের উন্নতির প্রতি মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। আর এর জন্য কিছু বিষয় অনুসরণ করা প্রয়োজন:

মানসিক দৃঢ়তা : প্রথমে পরশ্রীকাতরতার কুফল সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। আত্মনির্ভরশীল হতে হতে হবে। হতে হবে মানসিকভাবে দৃঢ় চেতনার মানুষ। কারণ আত্মনির্ভরশীল ও মানসিকভাবে শক্তিশালী মানুষ ঈর্ষাকে প্রশ্রয় দেয় না।

অন্যের সাথে তুলনা পরিহার : অন্যের সাথে নিজেকে তুলনা করা বন্ধ করতে হবে । জগতে প্রতিটি মানুষ আলাদা। চিন্তা কর্ম মেধা যোগ্যতা সবই আলাদা। অন্যের সাথে তুলনা না করে নিজের কাজ ও যোগ্যতাকে মূল্যায়ন করা প্রয়োজন।

স্যোসাল মিডিয়ায় কম থাকা: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে দূরে থাকা উচিত । বর্তমানে যারাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশি সংযুক্ত তারা কমবেশি পরশ্রী কাতর। এটা তাদের কথাবার্তায় আচরণে প্রকাশ পায়। তাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ে খুব বেশি মনোযোগ না-হওয়াই উত্তম। হলেও গুরুত্ব কম দিতে হবে। এর ফলে পরশ্রী কাতর হওয়া থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।

ধন্যবাদ এবং প্রশংসা করা : অন্যের ভালো গুণ বা অর্জন দেখলে ঈর্ষা না করে প্রশংসা করুন। যিনি প্রশংসা করতে পারেন, তার জীবনে এটি একটি ইতিবাচক অভ্যাসে পরিণত হয়। নিজের প্রাপ্তির জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করাও পরশ্রীকাতরতা কমাতে সাহায্য করে।

নিজেকে ও নিজের কাজকে ভালোবাসা : নিজের দক্ষতা, ভালো কাজ এবং উন্নতির দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত। সবার আগে নিজের কাজ এবং নিজেকে ভালোবাসা উচিত। নিজেকে এবং নিজের কাজকে ভালোবাসলে অন্যের প্রতি ঈর্ষার পরিবর্তে নিজের প্রতি মহত্ত্ববোধ তৈরি হবে যা অন্যের প্রতি শ্রদ্ধা বাড়িয়ে দিবে।

ইতিবাচক চিন্তা করা : পরশ্রীকাতরতা থেকে মুক্তি পেতে হলে নেতিবাচক চিন্তা বাদ দিয়ে ইতিবাচক চিন্তা করতে হবে। পরনিন্দা থেকে নিজেকে দূরে রাখতে হবে। অন্যের ক্ষতি কামনা না করে নিজের জীবনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে এমন কাজ করতে হবে।

নৈতিক শিক্ষা অর্জন ও নৈতিক কাজ করা : পরিচ্ছন্ন ও ভালো জীবনযাপনের জন্য ধর্মীয় আচারের বিকল্প নেই। পরশ্রী কাতরতা দূর করার জন্য ধর্মীয় জীবনযাপন করতে হবে। কারণ - সকল ধর্মেই পরশ্রী কাতরতা পরিহার করতে বলা হয়েছে।

পরশ্রীকাতরতা মানুষের মানবিক চেতনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। পরশ্রী কাতরতা থেকে বের হয়ে আসা জরুরি। এর জন্য প্রয়োজন প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া। অন্যের সম্পদ, সৌন্দর্য ও যোগ্যতাকে হিংসা না করে নিজেকে ভালোবাসা, নিজের কাজকে সম্মান করা।

[লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ভূগোল বিভাগ, মুক্তিযোদ্ধা কলেজ, ভাওয়ালগড়, গাজীপুর]

back to top