বেনী আমীন
প্রতি বছর ২৮ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাপী পালিত হয় বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবস। এর উদ্দেশ্য হলো মানুষ ও প্রাণী উভয়ের জন্য সমন্বিত প্রতিরোধমূলক উদ্যোগের মাধ্যমে এই প্রাণঘাতী রোগটির নির্মূল, রোগ নিয়ন্ত্রণ এবং প্রতিরোধের গুরুত্ব তুলে ধরা। প্রতিরোধযোগ্য রোগ হওয়া সত্ত্বেও এই প্রাচীন ও প্রাণঘাতী রোগটি এখনো বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। বিশেষত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে পথপ্রাণীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় জলাতঙ্ক সংক্রমণের প্রকোপও তুলনামূলকভাবে বেশি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা র তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে প্রায় ৫৯ হাজার মানুষ জলাতঙ্কে মারা যায়, যাদের ৪০% শিশু। জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণ, বিশেষত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে, জনস্বাস্থ্য ও প্রাণী কল্যাণের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
ভয়াবহতা ও প্রতিরোধের মূলমন্ত্র:
জলাতঙ্ক একটি ভাইরাসজনিত রোগ, যা র্যাবিস ভাইরাস দ্বারা সংঘটিত হয় এবং কুকুর/বিড়াল/শেয়াল/বানরসহ গৃহপালিত ও বন্যপ্রাণীর কামড় বা আঁচড়ের মাধ্যমে মানুষের শরীরে ছড়ায়। হু এবং জিএআরসি’র তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর প্রায় ৫৯ হাজার মানুষ জলাতঙ্কে মারা যায়, আর এদের মধ্যে প্রায় ৪০% শিশু।
সমসাময়িক বিশ্বের প্রাচীন রোগগুলোর একটি হিসেবে জলাতঙ্কের উল্লেখ পাওয়া যায় প্রায় চার হাজার বছর আগে। বিখ্যাত বিজ্ঞানী লুই পাস্তুর প্রথম জলাতঙ্ক প্রতিরোধী ভ্যাকসিন আবিষ্কার করেন, যা মানবজাতির জন্য ছিল এক নতুন আশার আলো। তবে একবার উপসর্গ শুরু হলে এই রোগে মৃত্যুই অবধারিত।
জলাতঙ্ক শুধু স্বাস্থ্য খাতে নয়, এটি অর্থনৈতিক ক্ষতিরও কারণ। বিশ্ব অর্থনীতিতে জলাতঙ্কের কারণে প্রতিবছর প্রায় ৮.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতি হয়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট ও সাফল্যের উদ্যোগ:
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণ একটি দীর্ঘমেয়াদি চ্যালেঞ্জ। কারণ পথকুকুরের সংখ্যা বেশি, সচেতনতার অভাব এবং কুসংস্কারের কারণে এ রোগ নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে ওঠে। তবে গত এক দশকে বাংলাদেশ সরকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থার উদ্যোগে মৃত্যুর হার কিছুটা কমেছে। সরকার ‘জলাতঙ্ক নির্মূল কমিটমেন্ট’ ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে প্রধান উদ্যোগগুলো হলোÑ
পথকুকুরের গণটিকাদান কর্মসূচি: প্রতি বছর লাখ লাখ পথকুকুরকে টিকা দেওয়া হয়।
অ্যান্টি-রেবিস ভ্যাকসিন সেন্টার: দেশের বিভিন্ন স্থানে আক্রান্ত মানুষের জন্য বিনামূল্যে ভ্যাকসিন সরবরাহ করা হচ্ছে। এছাড়া স্বাস্থ্য, কৃষি ও পরিবেশ সম্পর্কিত বিভাগগুলোর মধ্যে সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
প্রতিরোধের কার্যকর উপায় ও জরুরি চিকিৎসা:
জলাতঙ্ক প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো টিকাদান। গৃহপালিত প্রাণী ও পথপ্রাণী উভয়কেই নিয়মিত ভ্যাকসিন দেওয়া অপরিহার্য।
প্রাণীর কামড়াক্রান্ত হলে জরুরি প্রতিকারসমূহ হলোÑ
ধৌতকরণ: ক্ষতস্থানে সাবান ও প্রবাহমান পানিতে কমপক্ষে ১৫ মিনিট ধুতে হবে।
পরিষ্কারকরণ: পরিষ্কার করার পর অ্যান্টিসেপ্টিক ব্যবহার করতে হবে।
চিকিৎসা: যত দ্রুত সম্ভব নিকটস্থ হাসপাতালে গিয়ে ভ্যাকসিন নিতে হবে।
কুসংস্কার পরিহার: ‘ঝাড়ফুঁক’ বা ‘প্রচলিত টোটকা’-র উপর নির্ভর না করে দ্রুত আধুনিক চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে।
প্রাণী কল্যাণ ও জলাতঙ্ক নির্মূলের প্রচেষ্টা:
জলাতঙ্ক প্রতিরোধ মানে শুধু মানুষের জীবন বাঁচানো নয়, এটি প্রাণী কল্যাণের সাথেও গভীরভাবে যুক্ত। প্রাণী হত্যা কোনো সমাধান নয়; বরং টিকাদান ও পরিচর্যাই কার্যকর উপায়।
মানবিক পদ্ধতি: জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণের অন্যতম মানবিক পদ্ধতি হলো ক্যাচ নিউটার ভ্যাকসিনেইট রিলিজ। এ প্রক্রিয়ায় পথকুকুরদের ধরে বন্ধ্যাকরণ, টিকাদান শেষে আবার ছেড়ে দেওয়া হয়। এতে সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও সংক্রমণ কমানো সহজ হয়।
সচেতনতা বৃদ্ধি: টিকা দেওয়া কুকুর বা বিড়ালের গলায় চিহ্নিত ট্যাগ ব্যবহার করা, এবং স্কুল ও গ্রামীণ এলাকায় সচেতনতামূলক কার্যক্রম করা জরুরি।
হু, ফাউ এবং জিআরসি যৌথভাবে ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী জলাতঙ্কমুক্ত পৃথিবী গড়ার লক্ষ্যে ‘৩০-এর মধ্যে শূন্য’ ঘোষণা দিয়েছে। এ লক্ষ্য অর্জনে বাংলাদেশেও নিশ্চিত উদ্যোগ প্রয়োজন।
বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবসের অঙ্গীকার হলো: ‘এক পৃথিবী, এক স্বাস্থ্য, শূন্য মৃত্যু’। নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা ও সমন্বিত কার্যক্রমের মাধ্যমেই আমরা এই প্রতিরোধযোগ্য রোগটিকে নির্মূল করতে পারব।
[লেখক: ডিভিএম, এম এস (ফেলো), অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ার কনসালট্যান্ট, হিউম্যান পস্ ইনিশিয়েটিভ]
বেনী আমীন
রোববার, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫
প্রতি বছর ২৮ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাপী পালিত হয় বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবস। এর উদ্দেশ্য হলো মানুষ ও প্রাণী উভয়ের জন্য সমন্বিত প্রতিরোধমূলক উদ্যোগের মাধ্যমে এই প্রাণঘাতী রোগটির নির্মূল, রোগ নিয়ন্ত্রণ এবং প্রতিরোধের গুরুত্ব তুলে ধরা। প্রতিরোধযোগ্য রোগ হওয়া সত্ত্বেও এই প্রাচীন ও প্রাণঘাতী রোগটি এখনো বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। বিশেষত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে পথপ্রাণীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় জলাতঙ্ক সংক্রমণের প্রকোপও তুলনামূলকভাবে বেশি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা র তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর বিশ্বজুড়ে প্রায় ৫৯ হাজার মানুষ জলাতঙ্কে মারা যায়, যাদের ৪০% শিশু। জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণ, বিশেষত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে, জনস্বাস্থ্য ও প্রাণী কল্যাণের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
ভয়াবহতা ও প্রতিরোধের মূলমন্ত্র:
জলাতঙ্ক একটি ভাইরাসজনিত রোগ, যা র্যাবিস ভাইরাস দ্বারা সংঘটিত হয় এবং কুকুর/বিড়াল/শেয়াল/বানরসহ গৃহপালিত ও বন্যপ্রাণীর কামড় বা আঁচড়ের মাধ্যমে মানুষের শরীরে ছড়ায়। হু এবং জিএআরসি’র তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর প্রায় ৫৯ হাজার মানুষ জলাতঙ্কে মারা যায়, আর এদের মধ্যে প্রায় ৪০% শিশু।
সমসাময়িক বিশ্বের প্রাচীন রোগগুলোর একটি হিসেবে জলাতঙ্কের উল্লেখ পাওয়া যায় প্রায় চার হাজার বছর আগে। বিখ্যাত বিজ্ঞানী লুই পাস্তুর প্রথম জলাতঙ্ক প্রতিরোধী ভ্যাকসিন আবিষ্কার করেন, যা মানবজাতির জন্য ছিল এক নতুন আশার আলো। তবে একবার উপসর্গ শুরু হলে এই রোগে মৃত্যুই অবধারিত।
জলাতঙ্ক শুধু স্বাস্থ্য খাতে নয়, এটি অর্থনৈতিক ক্ষতিরও কারণ। বিশ্ব অর্থনীতিতে জলাতঙ্কের কারণে প্রতিবছর প্রায় ৮.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতি হয়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট ও সাফল্যের উদ্যোগ:
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণ একটি দীর্ঘমেয়াদি চ্যালেঞ্জ। কারণ পথকুকুরের সংখ্যা বেশি, সচেতনতার অভাব এবং কুসংস্কারের কারণে এ রোগ নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে ওঠে। তবে গত এক দশকে বাংলাদেশ সরকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থার উদ্যোগে মৃত্যুর হার কিছুটা কমেছে। সরকার ‘জলাতঙ্ক নির্মূল কমিটমেন্ট’ ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে প্রধান উদ্যোগগুলো হলোÑ
পথকুকুরের গণটিকাদান কর্মসূচি: প্রতি বছর লাখ লাখ পথকুকুরকে টিকা দেওয়া হয়।
অ্যান্টি-রেবিস ভ্যাকসিন সেন্টার: দেশের বিভিন্ন স্থানে আক্রান্ত মানুষের জন্য বিনামূল্যে ভ্যাকসিন সরবরাহ করা হচ্ছে। এছাড়া স্বাস্থ্য, কৃষি ও পরিবেশ সম্পর্কিত বিভাগগুলোর মধ্যে সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
প্রতিরোধের কার্যকর উপায় ও জরুরি চিকিৎসা:
জলাতঙ্ক প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো টিকাদান। গৃহপালিত প্রাণী ও পথপ্রাণী উভয়কেই নিয়মিত ভ্যাকসিন দেওয়া অপরিহার্য।
প্রাণীর কামড়াক্রান্ত হলে জরুরি প্রতিকারসমূহ হলোÑ
ধৌতকরণ: ক্ষতস্থানে সাবান ও প্রবাহমান পানিতে কমপক্ষে ১৫ মিনিট ধুতে হবে।
পরিষ্কারকরণ: পরিষ্কার করার পর অ্যান্টিসেপ্টিক ব্যবহার করতে হবে।
চিকিৎসা: যত দ্রুত সম্ভব নিকটস্থ হাসপাতালে গিয়ে ভ্যাকসিন নিতে হবে।
কুসংস্কার পরিহার: ‘ঝাড়ফুঁক’ বা ‘প্রচলিত টোটকা’-র উপর নির্ভর না করে দ্রুত আধুনিক চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে।
প্রাণী কল্যাণ ও জলাতঙ্ক নির্মূলের প্রচেষ্টা:
জলাতঙ্ক প্রতিরোধ মানে শুধু মানুষের জীবন বাঁচানো নয়, এটি প্রাণী কল্যাণের সাথেও গভীরভাবে যুক্ত। প্রাণী হত্যা কোনো সমাধান নয়; বরং টিকাদান ও পরিচর্যাই কার্যকর উপায়।
মানবিক পদ্ধতি: জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণের অন্যতম মানবিক পদ্ধতি হলো ক্যাচ নিউটার ভ্যাকসিনেইট রিলিজ। এ প্রক্রিয়ায় পথকুকুরদের ধরে বন্ধ্যাকরণ, টিকাদান শেষে আবার ছেড়ে দেওয়া হয়। এতে সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও সংক্রমণ কমানো সহজ হয়।
সচেতনতা বৃদ্ধি: টিকা দেওয়া কুকুর বা বিড়ালের গলায় চিহ্নিত ট্যাগ ব্যবহার করা, এবং স্কুল ও গ্রামীণ এলাকায় সচেতনতামূলক কার্যক্রম করা জরুরি।
হু, ফাউ এবং জিআরসি যৌথভাবে ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী জলাতঙ্কমুক্ত পৃথিবী গড়ার লক্ষ্যে ‘৩০-এর মধ্যে শূন্য’ ঘোষণা দিয়েছে। এ লক্ষ্য অর্জনে বাংলাদেশেও নিশ্চিত উদ্যোগ প্রয়োজন।
বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবসের অঙ্গীকার হলো: ‘এক পৃথিবী, এক স্বাস্থ্য, শূন্য মৃত্যু’। নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা ও সমন্বিত কার্যক্রমের মাধ্যমেই আমরা এই প্রতিরোধযোগ্য রোগটিকে নির্মূল করতে পারব।
[লেখক: ডিভিএম, এম এস (ফেলো), অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ার কনসালট্যান্ট, হিউম্যান পস্ ইনিশিয়েটিভ]