মিহির কুমার রায়
বাংলাদেশের অর্থনীতি গত কিছু বছর ধরে জটিল ও চ্যালেঞ্জপূর্ণ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে মূল্যস্ফীতি যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, তা সাধারণ জনগণের ক্রয়ক্ষমতা, উৎপাদনশীলতা এবং সামাজিক স্থিতিশীলতার উপর সরাসরি প্রভাব ফেলছে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। নীতি সুদহার বৃদ্ধি, নিত্যপণ্যের শুল্কছাড়, বাজার তদারকি এবং আমদানি নীতির পরিবর্তন এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সম্প্রতি নীতি সুদহার ১০ শতাংশে বৃদ্ধি করেছে, যা মূলত ঋণের ব্যয় কমিয়ে বাজারে সরবরাহ নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে নেওয়া হয়েছে। তবে অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করছেন, কেবল সুদহার বৃদ্ধি বা শুল্কছাড় দিয়ে দীর্ঘমেয়াদে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের অভ্যন্তরীণ ও বহিঃস্থ কারণ রয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, আন্তর্জাতিক তেল ও খাদ্যপণ্যের দামের ওঠানামা, বৈশ্বিক সরবরাহ চেইনের জটিলতা এবং অভ্যন্তরীণ উৎপাদন শৃঙ্খলের দুর্বলতাÑ এ বিষয়গুলো বাংলাদেশে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাম্প্রতিক বিশ্লেষণ বলছে, মূল সমস্যা মূলত অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক ব্যবস্থার দুর্বলতায় নিহিত।
গত ২৮ মাস ধরে দেশের মূল্যস্ফীতির হার ৯ শতাংশের ওপরে রয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের বেশি ছিল, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের সার্বিক হার দাঁড়ায় ৯.৭৩ শতাংশে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম চার মাসেও ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা বজায় রয়েছে। ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস করছে এবং প্রকৃত আয় কমাচ্ছে। কম আয়ের মানুষ বিশেষভাবে এই পরিস্থিতিতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
শহর ও গ্রামাঞ্চলে মূল্যস্ফীতির ভিন্নতা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। শহরে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের চাহিদা বেশি হওয়ায় মূল্যস্ফীতি তুলনামূলকভাবে কিছুটা নিয়ন্ত্রিত থাকলেও গ্রামাঞ্চলে খাদ্যমূল্যের প্রভাব বেশি। গ্রামে কৃষি পণ্যের সরবরাহ ও সরাসরি বাজারে পৌঁছানোর খরচের কারণে দাম বেড়ে যায়। বিশেষ করে মৌসুমি খাদ্যপণ্যের চাহিদা ও সরবরাহের অনিশ্চয়তা মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি করে। এছাড়া গ্রামে শুল্ক ও পরিবহন খরচ বৃদ্ধিও দামের ওপর চাপ সৃষ্টি করে।
নিত্যপণ্যের সরবরাহে বাধার কারণেও মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাজারে পণ্যের ঘাটতি থাকলে চাহিদার তুলনায় দাম বেড়ে যায়। সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে যেমন শুল্কছাড়, এলসি মার্জিন ছাড়, ব্যাংক ঋণের সীমা রেহাই ইত্যাদি। তবে এই পদক্ষেপগুলোর সুফল ভোক্তাদের কাছে পৌঁছায় না। অনেক ক্ষেত্রে সুবিধাভোগীরা আগের মতোই সক্রিয় থাকে, আর সিন্ডিকেট বা চাঁদাবাজি দামের নিয়ন্ত্রণে বাধা সৃষ্টি করে।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটও মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। তেল ও খাদ্যপণ্যের বিশ্ববাজারে দাম বেড়ে গেলে দেশের বাজারেও তা প্রভাব ফেলে। আন্তর্জাতিক মুদ্রার মানের ওঠানামা, আমদানি খরচ বৃদ্ধি, বৈদেশিক ঋণ ও বিনিয়োগের অস্থিতিশীলতাÑ এ বিষয়গুলো বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে সরাসরি প্রভাব ফেলে। তবে অভ্যন্তরীণ উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির অভাব, বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা এবং সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আরও বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি সমন্বিত নীতি গ্রহণ করতে হবে। কেবল নীতি সুদহার বৃদ্ধি যথেষ্ট নয়। রাজস্বনীতি, বাজার ব্যবস্থাপনা, সরবরাহ চেইন শৃঙ্খল, প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি এবং সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণÑ এ বিষয়গুলোর সমন্বিত পদক্ষেপ অপরিহার্য। উদাহরণস্বরূপ, পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করতে উৎপাদন পর্যায়ে ঘাটতি থাকলে আমদানি করতে হবে। আমদানি ব্যয় কমাতে শুল্কহার যৌক্তিকভাবে কমানো উচিত। তবে শুল্কছাড়ের সুফল ভোক্তার কাছে পৌঁছাতে কার্যকর তদারকি ও প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে।
সম্প্রতি সরকার বাজারে শৃঙ্খলা ফেরাতে বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করেছে। জেলাগুলোতে ১০ সদস্যের বিশেষ টিম কাজ করছে এবং ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের নেতৃত্বে অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও অভিযানগুলোতে যুক্ত হচ্ছে। এছাড়া কৃষিপণ্যের সরবরাহ বাড়াতে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এসব উদ্যোগ মূলত বাজারে সরবরাহ বাড়িয়ে দামের স্থিতিশীলতা আনার জন্য।
তবে বাস্তবতা হলো, এসব পদক্ষেপ এখনো যথাযথভাবে ফলপ্রসূ হয়নি। পাইকারি ও খুচরা বাজারে পণ্যের দাম স্থিতিশীল হয়নি। উদাহরণস্বরূপ, চালের দাম শুল্কহার কমানোর পরও ১০ দিনের ব্যবধানে মোটা ও মাঝারি চালে বস্তাপ্রতি ৫০-৬০ টাকা বাড়তে দেখা গেছে। অন্যান্য নিত্যপণ্যের দামও প্রভাবিত হয়নি। কৃষি অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মৌসুমি কারণ, বন্যা এবং সরবরাহ চেইনের অসংগতি এসব মূল্যবৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয় একযোগে মুদ্রানীতি ও ঋণনীতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে। নীতি সুদহার বৃদ্ধি করা হলেও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশের আর্থিক ব্যবস্থার জনসম্পৃক্ততা সীমিত। ফলে কেবল সুদহার বৃদ্ধি দিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। কার্যকর বাজার ব্যবস্থাপনা, সিন্ডিকেট বন্ধ, প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি এবং রাজস্বনীতি সংশোধন প্রয়োজন।
রাজস্বনীতির ক্ষেত্রে করজাল বাড়ালে মানুষের ব্যয়যোগ্য আয় কমে। তবে কর আরোপের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে, যাতে নিম্ন ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের ওপর অতিরিক্ত চাপ না পড়ে। সরকার খরচ কমিয়ে উৎপাদনশীল খাতে ব্যয় বাড়ালে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ বৃদ্ধি সম্ভব। এতে বাজারে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসতে পারে।
দক্ষিন এশিয়ার অন্যান্য দেশ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সফল হলেও বাংলাদেশ বারবার ব্যর্থ হচ্ছে। কারণ অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলো সমাধানের পথে গুরুত্ব পায়নি। সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণ করা হলেও বাজেট ছিল সম্প্রসারণমূলক। ফলে বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকার ব্যাংক খাত থেকে ঋণ বৃদ্ধি করেছে, যা বেসরকারি খাতকে কোণঠাসা করেছে।
উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয় এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সমন্বিত পদক্ষেপ জরুরি। মুদ্রানীতি, রাজস্বনীতি ও কার্যকর বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মূল্যস্তর নিচে নামানো সম্ভব। কেবল নীতি সুদহার বৃদ্ধি বা শুল্কছাড় যথেষ্ট নয়। কার্যকর ও সমন্বিত নীতি ছাড়া সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ও দেশের অর্থনীতি আরও দুর্বল হবে।
বর্তমানে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাজারে শৃঙ্খলা ফেরাতে হবে এবং বাজারকে প্রতিযোগিতা সক্ষম করতে তুলতে হবে। নিত্যপণ্যের চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। ঘাটতি থাকলে আমদানি করতে হবে। শুল্কহার যৌক্তিকভাবে কমিয়ে বাজারে প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে। শুল্কছাড়ের সুফল ভোক্তার কাছে পৌঁছানো নিশ্চিত করতে হবে, যাতে সিন্ডিকেট বা সুবিধাভোগীরা দামের উপর প্রভাব বিস্তার করতে না পারে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে রাজস্বনীতির পরিবর্তন। করজালের আওতা বাড়লে মানুষের ব্যয়যোগ্য আয় কমে। তবে কর আরোপের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে, যাতে নিম্ন ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের ওপর অতিরিক্ত চাপ না পড়ে। সরকার খরচ কমিয়ে উৎপাদনশীল খাতে ব্যয় বাড়ালে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ বৃদ্ধি সম্ভব।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলে দেশের অর্থনীতি স্থিতিশীল হতে পারে, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়ে যেতে পারে এবং সামাজিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। সুতরাং, সরকারের উচিত কেবল নীতি সুদহার বৃদ্ধি বা শুল্কছাড়ে মনোনিবেশ না করে, বাজার ব্যবস্থাপনা, সরবরাহ চেইন শৃঙ্খল, প্রতিযোগিতা এবং রাজস্বনীতিÑধষষ এ বিষয়গুলো একযোগে সমন্বয় করে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া।
[লেখক: সাবেক ডিন (ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ) ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি]
মিহির কুমার রায়
বুধবার, ০৮ অক্টোবর ২০২৫
বাংলাদেশের অর্থনীতি গত কিছু বছর ধরে জটিল ও চ্যালেঞ্জপূর্ণ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে মূল্যস্ফীতি যে পর্যায়ে পৌঁছেছে, তা সাধারণ জনগণের ক্রয়ক্ষমতা, উৎপাদনশীলতা এবং সামাজিক স্থিতিশীলতার উপর সরাসরি প্রভাব ফেলছে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। নীতি সুদহার বৃদ্ধি, নিত্যপণ্যের শুল্কছাড়, বাজার তদারকি এবং আমদানি নীতির পরিবর্তন এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সম্প্রতি নীতি সুদহার ১০ শতাংশে বৃদ্ধি করেছে, যা মূলত ঋণের ব্যয় কমিয়ে বাজারে সরবরাহ নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে নেওয়া হয়েছে। তবে অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করছেন, কেবল সুদহার বৃদ্ধি বা শুল্কছাড় দিয়ে দীর্ঘমেয়াদে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের অভ্যন্তরীণ ও বহিঃস্থ কারণ রয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, আন্তর্জাতিক তেল ও খাদ্যপণ্যের দামের ওঠানামা, বৈশ্বিক সরবরাহ চেইনের জটিলতা এবং অভ্যন্তরীণ উৎপাদন শৃঙ্খলের দুর্বলতাÑ এ বিষয়গুলো বাংলাদেশে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাম্প্রতিক বিশ্লেষণ বলছে, মূল সমস্যা মূলত অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক ব্যবস্থার দুর্বলতায় নিহিত।
গত ২৮ মাস ধরে দেশের মূল্যস্ফীতির হার ৯ শতাংশের ওপরে রয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের বেশি ছিল, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের সার্বিক হার দাঁড়ায় ৯.৭৩ শতাংশে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম চার মাসেও ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা বজায় রয়েছে। ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস করছে এবং প্রকৃত আয় কমাচ্ছে। কম আয়ের মানুষ বিশেষভাবে এই পরিস্থিতিতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
শহর ও গ্রামাঞ্চলে মূল্যস্ফীতির ভিন্নতা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। শহরে খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের চাহিদা বেশি হওয়ায় মূল্যস্ফীতি তুলনামূলকভাবে কিছুটা নিয়ন্ত্রিত থাকলেও গ্রামাঞ্চলে খাদ্যমূল্যের প্রভাব বেশি। গ্রামে কৃষি পণ্যের সরবরাহ ও সরাসরি বাজারে পৌঁছানোর খরচের কারণে দাম বেড়ে যায়। বিশেষ করে মৌসুমি খাদ্যপণ্যের চাহিদা ও সরবরাহের অনিশ্চয়তা মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি করে। এছাড়া গ্রামে শুল্ক ও পরিবহন খরচ বৃদ্ধিও দামের ওপর চাপ সৃষ্টি করে।
নিত্যপণ্যের সরবরাহে বাধার কারণেও মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাজারে পণ্যের ঘাটতি থাকলে চাহিদার তুলনায় দাম বেড়ে যায়। সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে যেমন শুল্কছাড়, এলসি মার্জিন ছাড়, ব্যাংক ঋণের সীমা রেহাই ইত্যাদি। তবে এই পদক্ষেপগুলোর সুফল ভোক্তাদের কাছে পৌঁছায় না। অনেক ক্ষেত্রে সুবিধাভোগীরা আগের মতোই সক্রিয় থাকে, আর সিন্ডিকেট বা চাঁদাবাজি দামের নিয়ন্ত্রণে বাধা সৃষ্টি করে।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটও মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। তেল ও খাদ্যপণ্যের বিশ্ববাজারে দাম বেড়ে গেলে দেশের বাজারেও তা প্রভাব ফেলে। আন্তর্জাতিক মুদ্রার মানের ওঠানামা, আমদানি খরচ বৃদ্ধি, বৈদেশিক ঋণ ও বিনিয়োগের অস্থিতিশীলতাÑ এ বিষয়গুলো বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে সরাসরি প্রভাব ফেলে। তবে অভ্যন্তরীণ উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির অভাব, বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা এবং সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আরও বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি সমন্বিত নীতি গ্রহণ করতে হবে। কেবল নীতি সুদহার বৃদ্ধি যথেষ্ট নয়। রাজস্বনীতি, বাজার ব্যবস্থাপনা, সরবরাহ চেইন শৃঙ্খল, প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি এবং সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণÑ এ বিষয়গুলোর সমন্বিত পদক্ষেপ অপরিহার্য। উদাহরণস্বরূপ, পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করতে উৎপাদন পর্যায়ে ঘাটতি থাকলে আমদানি করতে হবে। আমদানি ব্যয় কমাতে শুল্কহার যৌক্তিকভাবে কমানো উচিত। তবে শুল্কছাড়ের সুফল ভোক্তার কাছে পৌঁছাতে কার্যকর তদারকি ও প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে।
সম্প্রতি সরকার বাজারে শৃঙ্খলা ফেরাতে বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করেছে। জেলাগুলোতে ১০ সদস্যের বিশেষ টিম কাজ করছে এবং ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের নেতৃত্বে অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও অভিযানগুলোতে যুক্ত হচ্ছে। এছাড়া কৃষিপণ্যের সরবরাহ বাড়াতে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এসব উদ্যোগ মূলত বাজারে সরবরাহ বাড়িয়ে দামের স্থিতিশীলতা আনার জন্য।
তবে বাস্তবতা হলো, এসব পদক্ষেপ এখনো যথাযথভাবে ফলপ্রসূ হয়নি। পাইকারি ও খুচরা বাজারে পণ্যের দাম স্থিতিশীল হয়নি। উদাহরণস্বরূপ, চালের দাম শুল্কহার কমানোর পরও ১০ দিনের ব্যবধানে মোটা ও মাঝারি চালে বস্তাপ্রতি ৫০-৬০ টাকা বাড়তে দেখা গেছে। অন্যান্য নিত্যপণ্যের দামও প্রভাবিত হয়নি। কৃষি অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মৌসুমি কারণ, বন্যা এবং সরবরাহ চেইনের অসংগতি এসব মূল্যবৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয় একযোগে মুদ্রানীতি ও ঋণনীতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে। নীতি সুদহার বৃদ্ধি করা হলেও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশের আর্থিক ব্যবস্থার জনসম্পৃক্ততা সীমিত। ফলে কেবল সুদহার বৃদ্ধি দিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। কার্যকর বাজার ব্যবস্থাপনা, সিন্ডিকেট বন্ধ, প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি এবং রাজস্বনীতি সংশোধন প্রয়োজন।
রাজস্বনীতির ক্ষেত্রে করজাল বাড়ালে মানুষের ব্যয়যোগ্য আয় কমে। তবে কর আরোপের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে, যাতে নিম্ন ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের ওপর অতিরিক্ত চাপ না পড়ে। সরকার খরচ কমিয়ে উৎপাদনশীল খাতে ব্যয় বাড়ালে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ বৃদ্ধি সম্ভব। এতে বাজারে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসতে পারে।
দক্ষিন এশিয়ার অন্যান্য দেশ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সফল হলেও বাংলাদেশ বারবার ব্যর্থ হচ্ছে। কারণ অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলো সমাধানের পথে গুরুত্ব পায়নি। সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণ করা হলেও বাজেট ছিল সম্প্রসারণমূলক। ফলে বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকার ব্যাংক খাত থেকে ঋণ বৃদ্ধি করেছে, যা বেসরকারি খাতকে কোণঠাসা করেছে।
উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয় এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সমন্বিত পদক্ষেপ জরুরি। মুদ্রানীতি, রাজস্বনীতি ও কার্যকর বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মূল্যস্তর নিচে নামানো সম্ভব। কেবল নীতি সুদহার বৃদ্ধি বা শুল্কছাড় যথেষ্ট নয়। কার্যকর ও সমন্বিত নীতি ছাড়া সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ও দেশের অর্থনীতি আরও দুর্বল হবে।
বর্তমানে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাজারে শৃঙ্খলা ফেরাতে হবে এবং বাজারকে প্রতিযোগিতা সক্ষম করতে তুলতে হবে। নিত্যপণ্যের চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। ঘাটতি থাকলে আমদানি করতে হবে। শুল্কহার যৌক্তিকভাবে কমিয়ে বাজারে প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে। শুল্কছাড়ের সুফল ভোক্তার কাছে পৌঁছানো নিশ্চিত করতে হবে, যাতে সিন্ডিকেট বা সুবিধাভোগীরা দামের উপর প্রভাব বিস্তার করতে না পারে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে রাজস্বনীতির পরিবর্তন। করজালের আওতা বাড়লে মানুষের ব্যয়যোগ্য আয় কমে। তবে কর আরোপের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে, যাতে নিম্ন ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের ওপর অতিরিক্ত চাপ না পড়ে। সরকার খরচ কমিয়ে উৎপাদনশীল খাতে ব্যয় বাড়ালে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ বৃদ্ধি সম্ভব।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলে দেশের অর্থনীতি স্থিতিশীল হতে পারে, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়ে যেতে পারে এবং সামাজিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। সুতরাং, সরকারের উচিত কেবল নীতি সুদহার বৃদ্ধি বা শুল্কছাড়ে মনোনিবেশ না করে, বাজার ব্যবস্থাপনা, সরবরাহ চেইন শৃঙ্খল, প্রতিযোগিতা এবং রাজস্বনীতিÑধষষ এ বিষয়গুলো একযোগে সমন্বয় করে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া।
[লেখক: সাবেক ডিন (ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ) ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি]