alt

opinion » post-editorial

‘আল্লাহ তুই দেহিস’: এ কোন ঘৃণার আগুন, ছড়িয়ে গেল সবখানে!

আনোয়ারুল হক

: রোববার, ১২ অক্টোবর ২০২৫
image

রাশেদ খান মেনন। তার দুটি হাতও পেছনে হাতকড়া পরা অবস্থায়।

‘মানুষ ফেরেশতা নয়, আবার শয়তানও নয়; ফেরেশতা ও শয়তানের মাঝামাঝি একটি প্রাণী। প্রতিহিংসা ও ক্রোধে আচ্ছন্ন হলে মানুষের মধ্যে শয়তান বা জিনের আছর হয় যা মানুষকে পাপ ও মিথ্যার প্রতি প্রলুব্ধ করে।’ ইসলামের অনেক প-িত এভাবেই ক্রোধ ও প্রতিহিংসা সম্পর্কে সতর্ক করে থাকেন। প্রকৃতপক্ষে ক্রোধ, প্রতিহিংসা মানুষের মনের প্রদীপকে নিভিয়ে দেয়।

ময়মনসিংহের তারাকান্দা উপজেলার হালিম ফকিরের ‘আল্লাহ তুই দেহিস’ আর্তনাদ শুনে এটাই মনে হয় সাম্প্রতিক সময়ে ইসলামপন্থার দাবীদার তথাকথিত ‘তৌহিদী জনতা’ অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে ক্রোধ, প্রতিহিংসায় এক বর্বরতার রাজত্ব কায়েম করেছেন। বিনা বাধায় জোর করে হালিম ফকিরের চুল কেটে দেয়ার মতো বেআইনি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী ঘটনা তো একটার পর একটা ঘটেই চলেছে যা সমাজে ভীতি, আতঙ্ক ও নিরাপত্তাহীনতার পরিবেশ সৃষ্টি করছে। সরকার, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নির্বিকার। আর ‘তৌহিদী জনতা’ তো কোরআন হাদিসও মানছেন না। হাদিসে বলা হয়েছে সে-ই প্রকৃত বীর, যে রাগের সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করিতে পারে। এবং যে-ব্যক্তি ক্রোধ দমন করিয়া রাখে, খোদাতা’আলা তাহার হৃদয় ইমান ও শান্তি দ্বারা পূর্ণ করেন। শান্তিতে নোবেলজয়ী প্রধান উপদেষ্টার সরকারই যখন ক্রোধ প্রতিহিংসা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না তখন আর কাকে কী বলবেন!

প্রবীণ রাজনীতিক রাশেদ খান মেননকে গত ৮ অক্টোবর আদালতে হাজির করে বনানী থানার একটি হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর অনুমতি চেয়ে সিএমএম আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটার তার আবেদন জানান। আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট শাহজাহান হত্যা মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানোর অনুমতি দেন। এরপরে হয়তো আরেকদিন হাজির করে রিমান্ডের আবেদনও জানানো হবে। ৮২ বছরের রাশেদ খান মেননকে ডজন খানেক খুনের মামলায় ইতোমধ্যে প্রায় ৮২ দিন রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। এটা কি আইনের শাসন ও সুশাসন, নাকি ক্রোধ আর প্রতিহিংসা?

জুলাই অভ্যুত্থানে সংঘটিত প্রতিটি হত্যাকা-ের, পতিত সরকারের আমলের প্রতিটি গুম খুনের এবং সীমাহীন আর্থিক লুন্ঠনের বিচার হতে হবে। কিন্তু যার যা অপরাধ সে অপরাধে তার বিচার হোক। একটার পর একটা ভিত্তিহীন হত্যা মামলা দিয়ে, ৮২ বছরের প্রবীণ মানুষটির হাত পেছনে নিয়ে হাতকড়া পড়িয়ে যে আচরণ করা হচ্ছে তা প্রতিহিংসা আর আক্রোশ ছাড়া ভিন্ন কিছু নয়। হাতকড়া পড়ানোর বিষয়ে পুলিশ প্রবিধানের ৩৩০ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে বা তদন্তস্থলে পাঠানোর জন্য পুলিশ বন্দীর পালানো রোধে যা প্রয়োজন, তার চেয়ে বেশি কড়াকড়ি উচিত নয়। এতে আরও বলা হয়েছে, বয়স বা দুর্বলতার কারণে যাদের নিরাপত্তা রক্ষা করা সহজ ও নিরাপদ, তাদের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি করা উচিত হবে না। এই বিধান কি মানা হচ্ছে, না আদালতেও আসামী প্রতিহিংসার শিকার হচ্ছেন? অন্যকে শাস্তি দিতে গিয়ে নিজেরা যেন আগের মতোই মনুষ্যত্বকে ত্যাগ করে পশুত্বকে ধারণ করছি।

রাশেদ খান মেনন ১৯৬২-র শিক্ষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম মুখ হয়ে ওঠেন। এবং ১৯৬৩-৬৪ বর্ষে ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হন। ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান সংগঠনেও তিনি অসামান্য ভূমিকা পালন করেন। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। পাকিস্তান আমলে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় তাকে সাত বছর সশ্রম কারাদ- দেয়া হয়েছিল। স্বাধীন দেশে সামরিক শাসনবিরোধী দীর্ঘ সংগ্রামেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

বাম ঘরানার ১১ টি রাজনৈতিক দলের জোট ভেঙে ২০০৪ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটে তার ও তার পার্টির অংশগ্রহণ ছিলো তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এই সিদ্ধান্ত দেশের বুকে বৃহত্তর বাম ঐক্য বিকশিত করার সুযোগকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। রাশেদ খান মেনন প্রগতিশীল মহলে নিন্দিত হন, তার ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষুণ হয়। পার্টিও বিভক্ত হয়ে যায়। তবে এটাও মনে রাখা প্রয়োজন ওয়ার্কার্স পার্টি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় যখন মুক্তিযুদ্ধবিরোধী জামায়াতে ইসলাম রাষ্ট্র ক্ষমতার অংশীদারিত্ব পেয়েছিল। তার এই রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বা রাজনৈতিক বিচ্যুতি আর যাই হোক ফৌজদারী অপরাধ নয়। জনশ্রুতি আছে অনিয়ম বা দুর্নীতিতে তার সংশ্লিষ্টতা ছিলো। সেটা যদি হয়ে থাকে বা মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য থাকাকালীন কোনো অনিয়ম ও ক্ষমতার অপব্যবহার হয়ে থাকলে সে অপরাধের বিচার হোক। একটার পর একটা তথাকথিত খুনের মামলা দিয়ে তাকে কেন ন্যায়বিচার থেকে এবং জামিন পাওয়ার আইনি অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হবে? গ্রেফতারকৃত অধিকাংশ রাজনীতিকের একই অবস্থা। ইউনূস সরকারও বিচার ও আইনকে শেখ হাসিনার সরকারের ন্যায় নিজেদের মতো করে ব্যবহার করছেন। এ কেমন নতুন বন্দোবস্ত! এ কেমন ‘নতুন স্বাধীনতা’! বিষ্ময়ের সাথে লক্ষ্য করছি এই অমানবিক ও অন্যায় আচরনের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলি এমনকি সেই ষাটের দশক থেকে শুরু করে নব্বই দশক পর্যন্ত যারা মেননের সাথে একসাথে জানবাজি রেখে লড়াই করেছেন শুধুমাত্র রাজনৈতিক মত ভিন্নতার কারনে তারাও নিশ্চুপ। যেমনটা অনেকেই নিশ্চুপ ছিলেন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে বিগত সরকারের অন্যায় ও অমানবিক আচরণ করার সময়ে। রাজনৈতিক আচরণে ন্যায় অন্যায়ের ব্যবধানও কি ক্রমশ লোপ পাচ্ছে?

অতি সম্প্রতি আইন করা হ’ল ট্রাইব্যুনালে কেউ অভিযুক্ত হলেই তিনি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার যোগ্যতা হারাবেন। অর্থাৎ অভিযুক্ত হওয়া মানেই দোষী প্রমাণিত হওয়া। বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় আইনের মধ্যে ‘রাজনীতি’ ঢুকে গিয়েছে। অর্থাৎ ক্ষমতাসীনরা যাকেই ঘৃণা ও আক্রোশ বশত নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে চাইবেন তাকেই আপাতত অভিযুক্ত হিসেবে ট্রাইব্যুনালে মামলা ঠুকে দেবেন। আবার অভিযুক্ত করার ভয় দেখিয়ে ক্ষমতাসীনদের সমর্থনপুষ্ট দলে ভাগানোর সুযোগও থাকছে। দেশ কি কার্যত কোনো গণতান্ত্রিক উত্তরনের পথে আছে, না নতুন বন্দোবস্তের নামে নতুন দুঃশাসনের পথে অগ্রসর হচ্ছে!

জামায়াত থেকে বের হয়ে এসে গড়া নতুন রাজনৈতিক দল এবি পার্টির নেতা ব্যারিস্টার ফুয়াদের একটা আলোচনা ডাকসু নির্বাচনের কয়েকদিন পরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শুনছিলাম। শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে তিনি বললেন “দেখেছেন দেখেছেন কয়দিনের মধ্যে ‘মেঘমল্লার বসুরা’ জেগে উঠেছে!” তিনি আরো বললেন সূর্যসেন, প্রীতিলতাদের নামে কেন এত হল? ছায়ানট, উদিচীর তৎপরতা কেনো এখনো দেখতে হয়? তার এসব কথার মানে বুঝতে অসুবিধা হয় না। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের কারও কারও ভিতর থেকে যেমন ‘প্রাক্তন আওয়ামী লীগার’ বেরিয়ে আসতে চাইছে, কোনো কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের ভিতর থেকে তেমনি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বেরিয়ে আসতে চাইছে। ব্যারিস্টার ফুয়াদের আলোচনার সার কথা হচ্ছে তিনি ছায়ানট, উদিচী এবং মেঘমল্লারদের মধ্যে ‘আওয়ামী ভূত’ এবং ‘ভারতীয় অনুপ্রবেশ’ দেখতে পাচ্ছেন।আর এটাও বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় ‘মেঘমল্লার’ নামে তিনি বামপন্থীদেরই নিশানা করেছেন। শুধু ব্যারিস্টার ফুয়াদ নন জামায়াত, হেফাজত, চরমোনাই এমনকি এনসিপিরও একাংশ এই ধরনের মনোভাব পোষণ করে। তারই ফলশ্রুতিতে চারুকলার বকুলতলা কিংবা গেন্ডারিয়ার কচিকাঁচার মেলার মাঠে আয়োজিত শরৎ উৎসব পালন করতে দেয়া হলো না। এমনকি ক’দিন আগে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের মিলনায়তনে আয়োজিত ‘রবীন্দ্র স্মরণ দ্রোহে, জাগরণে রবীন্দ্রনাথ’ শীর্ষক কবিতা আবৃত্তির অনুষ্ঠান ১০-১২ জনের মব উল্লম্ফনে বাতিল করতে হয়।

২৫ বছরের পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক ধরনের শাসন শোষণের বিরুদ্ধে যে সমস্ত রাজনৈতিক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী লড়াই করেছে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শামিল হয়েছে আজ এই অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে তারা সবাই এই পাকিস্তান ভেঙে যাওয়ার বেদনায় আচ্ছন্ন গোষ্ঠীর ঘৃণা আর আক্রোশের নিশানায় আছে। বামপন্থীরা ‘উগ্র ডানপন্থি শক্তির আস্ফালন প্রতিরোধ ও পুরাতন কর্তৃত্ববাদী দুঃশাসনের পুনরাবৃত্তি রুখতে’ যে আহ্বান জানাচ্ছেন তা কার্যকর শক্তি হিসেবে দাঁড় করাতে হলে ব্যারিষ্টার ফুয়াদের মতো সবকিছুতে আওয়ামী সন্দেহ বাতিক না হয়ে, মুক্তিযুদ্ধ ও ধর্মনিরপেক্ষতা প্রীতিকে আওয়ামী প্রীতি না ভেবে সমাজের সকল প্রগতিশীল ও উদার গণতন্ত্রীদের এ সংগ্রামে শামিল করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের আওয়ামী বয়ানে আচ্ছন্ন বা বিভ্রান্ত মানুষকেও টেনে আনতে হবে জনমুক্তির বয়ানে।এ কথা ভুলে গেলে চলবে না, মুক্তিযুদ্ধ এবং এর সাংস্কৃতিক ভাবাদর্শ আমাদের স্বাধীন সত্তার অংশ।

উগ্র ডানপন্থী শক্তি একা নয়, অন্তর্বর্তী সরকারের কাছ থেকে এবং দেশী-বিদেশী নানা শক্তির কাছ থেকেই তারা মদত পাচ্ছে। দেশের এই ক্রান্তিকালে নতুন বন্দোবস্তের নামে যখন প্রতিহিংসা ও বদলা-ই মুখ্য হয়ে উঠেছে, ব্যালটের পরিবর্তে ঐকমত্যের নামে অন্তর্বর্তী সরকার তাদের সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রক্ষমতার শক্তি দিয়ে একতরফাভাবে জনগণের উপর চাপিয়ে দিতে চাইছে, দেশের জন্মবিরোধী শক্তিকে সাথে নিয়ে গর্বভরে বিশ্ব মঞ্চের সর্বোচ্চ দরবারে শামিল হচ্ছেন Ñ সে ধরনের এক জটিল ও প্রতিকূল পরিস্থিতিতে দেশের প্রগতিমুখী গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের প্রয়োজনে বামপন্থীদেরই গড়ে তুলতে হবে নতুন-পুরাতন কতৃত্ববাদ ও দুঃশাসন বিরোধী সকল শ্রেণী-পেশার মানুষের এক ব্যাপকতর সমাবেশ। তা করতে ব্যর্থ হলে ছড়িয়ে পড়া ঘৃণার আগুনের সামনে দাঁড়িয়ে দেশবাসীকেই ‘আল্লাহ তুই দেহিস’ এর মতো আর্তনাদ করতে হতে পারে।

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

[লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা]

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: অবক্ষয়ের চোরাবালিতে আলোর দিশারী

অটোমেশন ও দেশের যুব কর্মসংস্থানের ভবিষ্যৎ

দুর্যোগে ভয় নয়, প্রস্তুতিই শক্তি

বৈষম্যহীন সমাজের স্বপ্ন

চেকের মামলায় আসামী যেসব ডিফেন্স নিয়ে খালাস পেতে পারেন

খেলনাশিল্প: সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ

ছবি

প্রান্তিক মানুষের হৃদয়ে ফিরে আসা কালো মেঘ

গীর্জায় হামলার নেপথ্যে কী?

সংঘের শতবর্ষের রাজনৈতিক তাৎপর্য

দুর্নীতি আর চাঁদাবাজি রাজনৈতিক-সংস্কৃতির অংশ

বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস

বাংলার সংস্কৃতি : উৎস, বিবর্তন ও বর্তমান সমাজ-মনন

রম্যগদ্য: শিক্ষা সহজ, বিদ্যা কঠিন

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় জনগণের ভূমিকা উপেক্ষিত

শ্রমজীবী মানুষের শোভন কর্মসংস্থান

মূল্যস্ফীতি মোকাবেলায় বাংলাদেশের বাস্তবতা

প্রবারণার আলোয় আলোকিত হোক মানবজাতি

অস্ত্র নিয়ন্ত্রণে ওয়াশিংটনের শেষ সুযোগ?

পাহাড় থেকে সমতল: আদিবাসী নারীর নিরাপত্তা

সোশ্যাল মিডিয়ার ‘লাইক’ সংস্কৃতি: আসক্তি নাকি নতুন যোগাযোগ?

জাতিসংঘে রোহিঙ্গা ইস্যু

মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক পরিবর্তন: আমরা কী শিক্ষা নিতে পারি

রম্যগদ্য: “কেশ ফ্যালায় ভাই, কেশ ফ্যালায়...”

লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থীর অধিকার: বিসিএস ও শিক্ষা ক্যাডারের বৈষম্য

ন্যাশনাল গ্যালারি : রঙতুলির মহাসমুদ্রে একদিন

যুব শক্তি বনাম বেকারত্ব

প্রযুক্তি, আর্থিক পরিকল্পনা ও গণিতের ব্যবহার

ফরাসি বিপ্লব: বৈষম্য নিরসনে সামগ্রিক মুক্তির প্রেরণা

অন্তর্বর্তী সরকারের নিউইয়র্ক সফর

প্রবীণদের যত্ন: নৈতিক দায়িত্ব থেকে সামাজিক শক্তি নির্মাণ

জনস্বাস্থ্য রক্ষায় তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের অপরিহার্যতা

জনমিতিক সুবিধা: স্বপ্নের দশক ও নীতিগত সংস্কারের অপরিহার্যতা

বিদ্যালয় ও মাঠ দখলের বিরুদ্ধে আদিবাসীদের সংগ্রাম

শিক্ষাসংস্কারে চাই সুস্পষ্ট লক্ষ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা

ভারতে এসআইআর বিতর্ক

কীটনাশক: জনস্বাস্থ্যের হুমকি

tab

opinion » post-editorial

‘আল্লাহ তুই দেহিস’: এ কোন ঘৃণার আগুন, ছড়িয়ে গেল সবখানে!

আনোয়ারুল হক

image

রাশেদ খান মেনন। তার দুটি হাতও পেছনে হাতকড়া পরা অবস্থায়।

রোববার, ১২ অক্টোবর ২০২৫

‘মানুষ ফেরেশতা নয়, আবার শয়তানও নয়; ফেরেশতা ও শয়তানের মাঝামাঝি একটি প্রাণী। প্রতিহিংসা ও ক্রোধে আচ্ছন্ন হলে মানুষের মধ্যে শয়তান বা জিনের আছর হয় যা মানুষকে পাপ ও মিথ্যার প্রতি প্রলুব্ধ করে।’ ইসলামের অনেক প-িত এভাবেই ক্রোধ ও প্রতিহিংসা সম্পর্কে সতর্ক করে থাকেন। প্রকৃতপক্ষে ক্রোধ, প্রতিহিংসা মানুষের মনের প্রদীপকে নিভিয়ে দেয়।

ময়মনসিংহের তারাকান্দা উপজেলার হালিম ফকিরের ‘আল্লাহ তুই দেহিস’ আর্তনাদ শুনে এটাই মনে হয় সাম্প্রতিক সময়ে ইসলামপন্থার দাবীদার তথাকথিত ‘তৌহিদী জনতা’ অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে ক্রোধ, প্রতিহিংসায় এক বর্বরতার রাজত্ব কায়েম করেছেন। বিনা বাধায় জোর করে হালিম ফকিরের চুল কেটে দেয়ার মতো বেআইনি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী ঘটনা তো একটার পর একটা ঘটেই চলেছে যা সমাজে ভীতি, আতঙ্ক ও নিরাপত্তাহীনতার পরিবেশ সৃষ্টি করছে। সরকার, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নির্বিকার। আর ‘তৌহিদী জনতা’ তো কোরআন হাদিসও মানছেন না। হাদিসে বলা হয়েছে সে-ই প্রকৃত বীর, যে রাগের সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করিতে পারে। এবং যে-ব্যক্তি ক্রোধ দমন করিয়া রাখে, খোদাতা’আলা তাহার হৃদয় ইমান ও শান্তি দ্বারা পূর্ণ করেন। শান্তিতে নোবেলজয়ী প্রধান উপদেষ্টার সরকারই যখন ক্রোধ প্রতিহিংসা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না তখন আর কাকে কী বলবেন!

প্রবীণ রাজনীতিক রাশেদ খান মেননকে গত ৮ অক্টোবর আদালতে হাজির করে বনানী থানার একটি হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর অনুমতি চেয়ে সিএমএম আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটার তার আবেদন জানান। আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট শাহজাহান হত্যা মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানোর অনুমতি দেন। এরপরে হয়তো আরেকদিন হাজির করে রিমান্ডের আবেদনও জানানো হবে। ৮২ বছরের রাশেদ খান মেননকে ডজন খানেক খুনের মামলায় ইতোমধ্যে প্রায় ৮২ দিন রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। এটা কি আইনের শাসন ও সুশাসন, নাকি ক্রোধ আর প্রতিহিংসা?

জুলাই অভ্যুত্থানে সংঘটিত প্রতিটি হত্যাকা-ের, পতিত সরকারের আমলের প্রতিটি গুম খুনের এবং সীমাহীন আর্থিক লুন্ঠনের বিচার হতে হবে। কিন্তু যার যা অপরাধ সে অপরাধে তার বিচার হোক। একটার পর একটা ভিত্তিহীন হত্যা মামলা দিয়ে, ৮২ বছরের প্রবীণ মানুষটির হাত পেছনে নিয়ে হাতকড়া পড়িয়ে যে আচরণ করা হচ্ছে তা প্রতিহিংসা আর আক্রোশ ছাড়া ভিন্ন কিছু নয়। হাতকড়া পড়ানোর বিষয়ে পুলিশ প্রবিধানের ৩৩০ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে বা তদন্তস্থলে পাঠানোর জন্য পুলিশ বন্দীর পালানো রোধে যা প্রয়োজন, তার চেয়ে বেশি কড়াকড়ি উচিত নয়। এতে আরও বলা হয়েছে, বয়স বা দুর্বলতার কারণে যাদের নিরাপত্তা রক্ষা করা সহজ ও নিরাপদ, তাদের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি করা উচিত হবে না। এই বিধান কি মানা হচ্ছে, না আদালতেও আসামী প্রতিহিংসার শিকার হচ্ছেন? অন্যকে শাস্তি দিতে গিয়ে নিজেরা যেন আগের মতোই মনুষ্যত্বকে ত্যাগ করে পশুত্বকে ধারণ করছি।

রাশেদ খান মেনন ১৯৬২-র শিক্ষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম মুখ হয়ে ওঠেন। এবং ১৯৬৩-৬৪ বর্ষে ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হন। ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান সংগঠনেও তিনি অসামান্য ভূমিকা পালন করেন। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। পাকিস্তান আমলে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় তাকে সাত বছর সশ্রম কারাদ- দেয়া হয়েছিল। স্বাধীন দেশে সামরিক শাসনবিরোধী দীর্ঘ সংগ্রামেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

বাম ঘরানার ১১ টি রাজনৈতিক দলের জোট ভেঙে ২০০৪ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটে তার ও তার পার্টির অংশগ্রহণ ছিলো তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এই সিদ্ধান্ত দেশের বুকে বৃহত্তর বাম ঐক্য বিকশিত করার সুযোগকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। রাশেদ খান মেনন প্রগতিশীল মহলে নিন্দিত হন, তার ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষুণ হয়। পার্টিও বিভক্ত হয়ে যায়। তবে এটাও মনে রাখা প্রয়োজন ওয়ার্কার্স পার্টি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় যখন মুক্তিযুদ্ধবিরোধী জামায়াতে ইসলাম রাষ্ট্র ক্ষমতার অংশীদারিত্ব পেয়েছিল। তার এই রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বা রাজনৈতিক বিচ্যুতি আর যাই হোক ফৌজদারী অপরাধ নয়। জনশ্রুতি আছে অনিয়ম বা দুর্নীতিতে তার সংশ্লিষ্টতা ছিলো। সেটা যদি হয়ে থাকে বা মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য থাকাকালীন কোনো অনিয়ম ও ক্ষমতার অপব্যবহার হয়ে থাকলে সে অপরাধের বিচার হোক। একটার পর একটা তথাকথিত খুনের মামলা দিয়ে তাকে কেন ন্যায়বিচার থেকে এবং জামিন পাওয়ার আইনি অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হবে? গ্রেফতারকৃত অধিকাংশ রাজনীতিকের একই অবস্থা। ইউনূস সরকারও বিচার ও আইনকে শেখ হাসিনার সরকারের ন্যায় নিজেদের মতো করে ব্যবহার করছেন। এ কেমন নতুন বন্দোবস্ত! এ কেমন ‘নতুন স্বাধীনতা’! বিষ্ময়ের সাথে লক্ষ্য করছি এই অমানবিক ও অন্যায় আচরনের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলি এমনকি সেই ষাটের দশক থেকে শুরু করে নব্বই দশক পর্যন্ত যারা মেননের সাথে একসাথে জানবাজি রেখে লড়াই করেছেন শুধুমাত্র রাজনৈতিক মত ভিন্নতার কারনে তারাও নিশ্চুপ। যেমনটা অনেকেই নিশ্চুপ ছিলেন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে বিগত সরকারের অন্যায় ও অমানবিক আচরণ করার সময়ে। রাজনৈতিক আচরণে ন্যায় অন্যায়ের ব্যবধানও কি ক্রমশ লোপ পাচ্ছে?

অতি সম্প্রতি আইন করা হ’ল ট্রাইব্যুনালে কেউ অভিযুক্ত হলেই তিনি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার যোগ্যতা হারাবেন। অর্থাৎ অভিযুক্ত হওয়া মানেই দোষী প্রমাণিত হওয়া। বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় আইনের মধ্যে ‘রাজনীতি’ ঢুকে গিয়েছে। অর্থাৎ ক্ষমতাসীনরা যাকেই ঘৃণা ও আক্রোশ বশত নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে চাইবেন তাকেই আপাতত অভিযুক্ত হিসেবে ট্রাইব্যুনালে মামলা ঠুকে দেবেন। আবার অভিযুক্ত করার ভয় দেখিয়ে ক্ষমতাসীনদের সমর্থনপুষ্ট দলে ভাগানোর সুযোগও থাকছে। দেশ কি কার্যত কোনো গণতান্ত্রিক উত্তরনের পথে আছে, না নতুন বন্দোবস্তের নামে নতুন দুঃশাসনের পথে অগ্রসর হচ্ছে!

জামায়াত থেকে বের হয়ে এসে গড়া নতুন রাজনৈতিক দল এবি পার্টির নেতা ব্যারিস্টার ফুয়াদের একটা আলোচনা ডাকসু নির্বাচনের কয়েকদিন পরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শুনছিলাম। শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে তিনি বললেন “দেখেছেন দেখেছেন কয়দিনের মধ্যে ‘মেঘমল্লার বসুরা’ জেগে উঠেছে!” তিনি আরো বললেন সূর্যসেন, প্রীতিলতাদের নামে কেন এত হল? ছায়ানট, উদিচীর তৎপরতা কেনো এখনো দেখতে হয়? তার এসব কথার মানে বুঝতে অসুবিধা হয় না। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের কারও কারও ভিতর থেকে যেমন ‘প্রাক্তন আওয়ামী লীগার’ বেরিয়ে আসতে চাইছে, কোনো কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের ভিতর থেকে তেমনি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বেরিয়ে আসতে চাইছে। ব্যারিস্টার ফুয়াদের আলোচনার সার কথা হচ্ছে তিনি ছায়ানট, উদিচী এবং মেঘমল্লারদের মধ্যে ‘আওয়ামী ভূত’ এবং ‘ভারতীয় অনুপ্রবেশ’ দেখতে পাচ্ছেন।আর এটাও বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় ‘মেঘমল্লার’ নামে তিনি বামপন্থীদেরই নিশানা করেছেন। শুধু ব্যারিস্টার ফুয়াদ নন জামায়াত, হেফাজত, চরমোনাই এমনকি এনসিপিরও একাংশ এই ধরনের মনোভাব পোষণ করে। তারই ফলশ্রুতিতে চারুকলার বকুলতলা কিংবা গেন্ডারিয়ার কচিকাঁচার মেলার মাঠে আয়োজিত শরৎ উৎসব পালন করতে দেয়া হলো না। এমনকি ক’দিন আগে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের মিলনায়তনে আয়োজিত ‘রবীন্দ্র স্মরণ দ্রোহে, জাগরণে রবীন্দ্রনাথ’ শীর্ষক কবিতা আবৃত্তির অনুষ্ঠান ১০-১২ জনের মব উল্লম্ফনে বাতিল করতে হয়।

২৫ বছরের পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক ধরনের শাসন শোষণের বিরুদ্ধে যে সমস্ত রাজনৈতিক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী লড়াই করেছে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শামিল হয়েছে আজ এই অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে তারা সবাই এই পাকিস্তান ভেঙে যাওয়ার বেদনায় আচ্ছন্ন গোষ্ঠীর ঘৃণা আর আক্রোশের নিশানায় আছে। বামপন্থীরা ‘উগ্র ডানপন্থি শক্তির আস্ফালন প্রতিরোধ ও পুরাতন কর্তৃত্ববাদী দুঃশাসনের পুনরাবৃত্তি রুখতে’ যে আহ্বান জানাচ্ছেন তা কার্যকর শক্তি হিসেবে দাঁড় করাতে হলে ব্যারিষ্টার ফুয়াদের মতো সবকিছুতে আওয়ামী সন্দেহ বাতিক না হয়ে, মুক্তিযুদ্ধ ও ধর্মনিরপেক্ষতা প্রীতিকে আওয়ামী প্রীতি না ভেবে সমাজের সকল প্রগতিশীল ও উদার গণতন্ত্রীদের এ সংগ্রামে শামিল করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের আওয়ামী বয়ানে আচ্ছন্ন বা বিভ্রান্ত মানুষকেও টেনে আনতে হবে জনমুক্তির বয়ানে।এ কথা ভুলে গেলে চলবে না, মুক্তিযুদ্ধ এবং এর সাংস্কৃতিক ভাবাদর্শ আমাদের স্বাধীন সত্তার অংশ।

উগ্র ডানপন্থী শক্তি একা নয়, অন্তর্বর্তী সরকারের কাছ থেকে এবং দেশী-বিদেশী নানা শক্তির কাছ থেকেই তারা মদত পাচ্ছে। দেশের এই ক্রান্তিকালে নতুন বন্দোবস্তের নামে যখন প্রতিহিংসা ও বদলা-ই মুখ্য হয়ে উঠেছে, ব্যালটের পরিবর্তে ঐকমত্যের নামে অন্তর্বর্তী সরকার তাদের সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রক্ষমতার শক্তি দিয়ে একতরফাভাবে জনগণের উপর চাপিয়ে দিতে চাইছে, দেশের জন্মবিরোধী শক্তিকে সাথে নিয়ে গর্বভরে বিশ্ব মঞ্চের সর্বোচ্চ দরবারে শামিল হচ্ছেন Ñ সে ধরনের এক জটিল ও প্রতিকূল পরিস্থিতিতে দেশের প্রগতিমুখী গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের প্রয়োজনে বামপন্থীদেরই গড়ে তুলতে হবে নতুন-পুরাতন কতৃত্ববাদ ও দুঃশাসন বিরোধী সকল শ্রেণী-পেশার মানুষের এক ব্যাপকতর সমাবেশ। তা করতে ব্যর্থ হলে ছড়িয়ে পড়া ঘৃণার আগুনের সামনে দাঁড়িয়ে দেশবাসীকেই ‘আল্লাহ তুই দেহিস’ এর মতো আর্তনাদ করতে হতে পারে।

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

[লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা]

back to top