alt

opinion » post-editorial

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: অবক্ষয়ের চোরাবালিতে আলোর দিশারী

মাহরুফ চৌধুরী

: সোমবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৫

শিক্ষা, সাহিত্য, শিল্প ও সংস্কৃতির বিস্তীর্ণ অঙ্গনে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম এমন এক আলোকবর্তিকা, যার নাম উচ্চারণেই জ্বলে ওঠে এক নৈতিক ও মননশীল দীপ্তি। আমাদের জাগতিক জীবনে তার মৃত্যু কেবল এক প্রতিভাবান শিক্ষক, সাহিত্যিক, সমালোচক বা চিন্তাবিদের প্রয়াণ নয়; এ যেন এক প্রজ্ঞাময় যুগের অবসান। তিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থেই এমন এক অধ্যাপক, যিনি পা-িত্যকে সীমাবদ্ধ রাখেননি পাঠ্যবইয়ের পাতায়। ফলে তার প্রতিটি ক্লাসরুম ছিল এক মুক্ত চিন্তার কর্মশালা, যেখানে জ্ঞানের সঙ্গে যুক্ত হত মানবিকতা, নৈতিক বোধ ও সাংস্কৃতিক সংবেদনশীলতা। তার পাঠ ছিল একধরনের শ্রেয়চেতনার আলোকিত সাধনা যেখানে শিক্ষার্থী কেবল তথ্য অর্জন করত না, বরং আত্মসচেতনতা, মানবিক বোধ ও স্বাধীন চিন্তার প্রশিক্ষণ লাভ করত। বিশ্ববিদ্যালয়ের কঠোর রাজনৈতিক ক্ষমতাকেন্দ্রিক কাঠামোর মধ্যেও তিনি ছিলেন মুক্তচিন্তার অনুশীলক ও অভিভাবক, যিনি তার শিক্ষার্থীদের শিখিয়েছেন জ্ঞান মানে শুধু তথ্য কিংবা তত্ত্ব মুখস্থ করা নয়, বরং প্রশ্ন তোলা, যুক্তি নির্মাণ ও ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান নেওয়া। এই গুণেই সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বাংলাদেশের বৌদ্ধিক পরিসরে হয়ে উঠেছিলেন এক অনন্য উপস্থিতি; ভদ্রতা ও নম্রতায় হৃদ্য প্রজ্ঞা, সততা ও মানবিকতার এক দীপ্ত প্রতীক।

শ্রেণিকক্ষে কিংবা যে কোনো বক্তৃতার মঞ্চে সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের উপস্থিতি ছিল যেন এক বৌদ্ধিক উদ্যাপন। তার শ্রেণিকক্ষে বক্তৃতা ছিল কেবল পাঠ নয়; ছিল শিক্ষার্থী বা অংশগ্রহণকারিদের জন্য চিন্তার জাগরণ, নৈতিকতার অনুশীলন, আর মানবিকতার প্রশিক্ষণ। শিক্ষার্থীরা মুগ্ধ হতো তার কণ্ঠে, তার শব্দচয়ন ও ব্যাখ্যার গভীরতায়; প্রতিটি বক্তৃতায় তিনি যেন সত্য, সৌন্দর্য ও কল্যাণের এক অনন্য মেলবন্ধন ঘটাতেন। তিনি ছিলেন সেই শিক্ষক, যিনি কেবল জ্ঞানের সরবরাহকারী নন, বরং শ্রেয়চেতনার প্রেরণাদাতা হিসেবে যিনি শিখিয়েছেন সততা, যুক্তিবোধ এবং সহমর্মিতার মর্মার্থ। তার পাঠদানে বিশ্বসাহিত্যের চরিত্ররা যেমন জীবন্ত হয়ে উঠত, তেমনি সমাজ, রাজনীতি ও নৈতিকতার জটিল প্রশ্নও আলোচিত হতো গভীর দার্শনিক ও নান্দনিক দৃষ্টিকোণ থেকে। তিনি ছিলেন এমন এক শিক্ষক, যিনি জ্ঞানকে কেবল বৌদ্ধিক অর্জন নয়, বরং আত্মার বিকাশ হিসেবে দেখতেন। এক অর্থে, তার শ্রেণিকক্ষে পাঠদান ছিল সক্রেটিসের ‘ডায়ালগ’-এর আধুনিক প্রতিরূপ যেখানে প্রশ্ন ছিল জ্ঞানের সূচনা, আর আলোচনাই ছিল মানবতার পথে যাত্রার আয়োজন।

১৯৯৫ সালের দিকে ইংরেজি শেখার একটি বিশেষ কোর্সে তাকে পেয়েছিলাম শিক্ষক হিসেবে। তার সরাসরি ছাত্র হওয়ার যে সৌভাগ্য আমার হয়েছিল, সেটিই ছিল এক অনন্য অভিজ্ঞতা। একোর্সে অংশগ্রহণ করার মধ্য দিয়ে একজন শিক্ষক নয়, সমকালীন চিন্তাচেতনার তুলনায় প্রাগ্রসর একজন গভীর মানবিক চেতনার চিন্তাবিদকে জানার অভিজ্ঞতা। অল্প কয়েকটি পাঠেই বুঝে গিয়েছিলাম, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম জ্ঞানকে কখনো শিক্ষকতার পেশায় কিংবা শ্রেণিকক্ষের পরিসীমায় বন্দি রাখেননি; তিনি তাকে জীবনের এক নৈতিক অনুশাসন, এক মানবিক সাধনা হিসেবে ধারণ করেছিলেন। তার শ্রেণিকক্ষের বাইরে, তার ব্যক্তিগত কক্ষে একান্ত সাক্ষাতের অভিজ্ঞতা আমার মনে এক গভীর ও স্থায়ী ছাপ রেখে গেছে। ভাষা ও সাহিত্যের আলোচনার পাশাপাশি সমকালীন শিল্প, সংস্কৃতি ও রাজনীতি নিয়ে তার গভীর বিশ্লেষণ দেখিয়েছে যে কীভাবে একজন প্রকৃত বুদ্ধিজীবী সমাজের প্রতিটি পরিবর্তনকে আত্মস্থ করেন, তা নিয়ে ভাবেন এবং তার নৈতিক তাৎপর্য অনুসন্ধান করেন।

তার কক্ষে বসে কথা বলার অভিজ্ঞতা ছিল যেন এক উন্মুক্ত জ্ঞানের জগতে প্রবেশের মতো, যেখানে অহংকার, প্রতিদ্বন্দ্বিতা বা মানসিক প্রতিরোধের কোনো স্থান নেই। সেখানে শুধু ছিল জ্ঞানের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা, শিক্ষার্থীর প্রতি আন্তরিক মমতা এবং চিন্তার অনন্ত দিগন্তে অবারিত আহ্বান। তিনি প্রতিটি আলাপচারিতাকে এক ধরনের শিক্ষার অঙ্গ হিসেবে দেখতেন যেখানে প্রশ্ন তোলা, মতামত শোনা এবং ভাবনার নতুন দিক উন্মোচন করা ছিল পাঠের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তার এই সংলাপমুখী পদ্ধতিই শিক্ষার্থীদেরকে আত্মবিশ্বাসী করে তোলে, তাদের ভেতরে নিহিত সম্ভাবনার আলোকে জাগ্রত করে। সে কক্ষে বসে বোঝা যেত সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বিশ্বাস করতেন যে, প্রতিটি শিক্ষার্থী এক সম্ভাবনাময় সত্তা এবং তার দায়িত্ব হলো সেই সম্ভাবনাকে আবিষ্কার করে আলোকিত করা। তার বিনয়, মানবিকতা ও বিনিময়ভিত্তিক শিক্ষাদর্শন শিক্ষার্থীর মননশীলতার আকাশকে প্রসারিত করত এবং জ্ঞানকে কেবল তথ্যের সঞ্চয় নয়, বরং জীবনচর্চার এক শিল্প হিসেবে উপলব্ধি করাত। সেই থেকে আমার কাছে তিনি রয়ে গেছেন এক কাক্সিক্ষত শিক্ষাগুরুর প্রতীক; একজন বিনয়ী, আন্তরিক ও আলোকিত শিক্ষক হিসেবে যিনি কেবল আমাদেরকে ইংরেজি ভাষাই শেখাতেন না, বরং দিতেন জীবনকে বোঝার ও উপলব্ধি করার নিত্যনতুন সূত্র।

সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের সাহিত্যকর্মে যেমন প্রতিফলিত হয়েছে সমাজবীক্ষণের সূক্ষ্ম দৃষ্টি ও নৈতিক চেতনার পরিশীলন, তেমনি তার শিক্ষকতাও ছিল গভীর মানবিক মূল্যবোধে আবিষ্ট। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, সাহিত্য কেবল কল্পনার রূপ বা ভাষার কারুকাজ নয়; এটি মানুষের আত্মাকে স্পর্শ করার এক নৈতিক অনুশীলন, যা পাঠককে করে তোলে সংবেদনশীল, ন্যায়ের পক্ষে দৃঢ় এবং মানবিকতার পথে দায়বদ্ধ। তাই সাহিত্যের পাঠে তিনি শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করতেন শুধু কাহিনির কাঠামো বা চরিত্র বিশ্লেষণে নয়, বরং পাঠের অন্তর্নিহিত নৈতিক তাৎপর্য অনুধাবনে। আর সে কারণেই শিক্ষার্থীদের মতে, তার শ্রেণিকক্ষে সাহিত্য হয়ে উঠত এক আধ্যাত্মিক যাত্রা যেখানে তারা আবিষ্কার করত জীবনের জটিল সত্য, সামাজিক বৈষম্যের নির্মমতা এবং নৈতিক দায়িত্বের মর্মবেদনা। তার মতে, ‘ভালো সাহিত্য আমাদের শেখায় আমরা মানুষ, এবং এই মানুষ হওয়াটাই এক অনন্ত সাধনা’। এই দৃষ্টিভঙ্গিই তাকে প্রথাগত পন্ডিত বা শিক্ষকের সীমা অতিক্রম করে এক জীবনদ্রষ্টা গুরুর মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে। তার সাহিত্যচর্চা ও শিক্ষকতা পরস্পরকে পরিপূর্ণ করেছে যাতে একদিকে ছিল চিন্তার স্বাধীনতা, অন্যদিকে ছিল নৈতিক বোধের শুদ্ধতা। তাই তিনি কেবল ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক ছিলেন না; তিনি ছিলেন জীবন পাঠেরও এক উজ্জ্বল দিশারি।

বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষায়ই সমান স্বচ্ছন্দ ও সাবলীল সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ছিলেন এক বিরল দ্বিভাষিক সৃষ্টিশীল মননের অধিকারী। তাই তার অনুবাদে বিশ্বসাহিত্যের রচনাগুলো যেন নতুন প্রাণ পেত। তার হাতে ভাষা হয়ে উঠত কেবল যোগাযোগের মাধ্যম নয়, ভাব ও অনুভূতির সেতুবন্ধন। তার অনুবাদে পাঠক আবিষ্কার করত এক অভূতপূর্ব সামঞ্জস্য তথা ভাষার সৌন্দর্য, চিন্তার গভীরতা এবং নৈতিক সংবেদনশীলতার অনবদ্য মেলবন্ধন। তিনি অনুবাদকে কেবল কারিগরি প্রয়াস হিসেবে দেখেননি; দেখেছেন এক মানবিক দায়িত্ব হিসেবে যার মাধ্যমে বিশ্বমানবতার চেতনা পৌঁছে যায় আমাদের সংস্কৃতির ভেতরেও। তার এই আন্তঃসাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গিই অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে সমকালীন তরুণ লেখকদের। তার লেখার শৈলী, ভাবনার প্রজ্ঞা ও দৃষ্টিভঙ্গির স্বচ্ছতা অনেক নবীন সাহিত্যিক ও সাহিত্য সমালোচকের কাছে হয়ে উঠেছে এক ধরনের দিকনির্দেশনা। তারা দেখেছেন, কীভাবে সাহিত্য ও শিল্প হতে পারে নৈতিক অবস্থান নেওয়ার ক্ষেত্র, কীভাবে অনুবাদ হতে পারে এক সাংস্কৃতিক সংলাপের প্রক্রিয়া। এইভাবেই সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম কেবল একজন অনুবাদক, সাহিত্যিক কিংবা সমালোচক নন, বরং এক সেতুবন্ধন নির্মাতা হিসেবে যিনি ভাষা ও সংস্কৃতির সীমা অতিক্রম করে মানবতার অভিন্ন সুরকে শ্রদ্ধার সঙ্গে তুলে ধরেছেন।

তার সহকর্মী ও ছাত্রছাত্রীরাসহ শুভানুধ্যায়ীরা যেভাবে স্মরণ করেছেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলামকে, তাতে প্রতিফলিত হয় এক মানবিক চরিত্রের বিরল স্বচ্ছতা- অসাধারণ বিনয়, কঠোর নৈতিকতা, সততার প্রতি অটল বিশ্বাস, এবং জ্ঞানের প্রতি আজীবন নিষ্ঠা। এই গুণগুলোই তাকে আলাদা করে তুলেছিল এমন এক সময়ে, যখন জ্ঞান অনেকাংশে পেশাগত প্রতিযোগিতা, সাফল্যের মাপকাঠি বা আত্মপ্রদর্শনের হাতিয়ার হয়ে উঠছে। তিনি নিবৃতচারি ও নিরহংকারি চারিত্রিক স্বভাবে এসব প্রবণতার বাইরে অবস্থান করে জ্ঞানচর্চাকে দেখেছেন মানবমুক্তির এক নিরন্তর যাত্রা হিসেবে। সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের কাছে জ্ঞান ছিল না ক্ষমতা অর্জনের উপকরণ, বরং আত্মশুদ্ধি ও সামষ্টিক কল্যাণে সামাজিক ন্যায়ের পথ। তিনি বিশ্বাস করতেন, জ্ঞান যদি মানুষকে বিনয়ী না করে, তবে তা কেবল বুদ্ধির খেলা- আলো নয়, অন্ধকারেরই আরেক রূপ। তার জীবন ছিল সেই বিশ্বাসের বাস্তব রূপায়ণ যেখানে শিক্ষকতা ছিল এক নৈতিক সাধনা আর পাঠদান ছিল আত্ম-উন্নয়ন ও মানবমুক্তির দিকনির্দেশনা। তিনি প্রমাণ করেছেন, প্রকৃত প্রজ্ঞা অহংকারে নয়, বিনয়ে; প্রতিযোগিতায় নয়, সহযোগিতায়; এবং নিজেকে নয়, অন্যকে জাগিয়ে তোলার মধ্যেই নিহিত।

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ছিলেন এমন এক শিক্ষক যিনি নৈতিকতাকে সীমাবদ্ধ রাখেননি ব্যক্তিগত সততার গ-িতে। তার কাছে নৈতিকতা মানে ছিল সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান, এবং মানবকল্যাণের প্রতি প্রতিশ্রুতি। তিনি তার ছাত্রদের শিখিয়েছেন যে, জ্ঞান যদি সমাজকে স্পর্শ না করে, তবে তা অসম্পূর্ণ; আর শিক্ষিত হওয়া মানে কেবল তথ্য জানা নয়, বরং সেই তথ্যের নৈতিক প্রয়োগ জানা ও সে অনুসারে কাজ করা। তার এক বিখ্যাত উপদেশ, ‘শিক্ষিত হওয়া মানে কেবল তথ্য জানা নয়, বরং সঠিক প্রশ্ন করতে পারা’ শিক্ষার্থীদের কাছে তার শিক্ষকতার দর্শনের মর্মবাণী হিসেবে অনুরণিত হতে থাকবে জীবনের শেষ দিন অবধি। এই এক বাক্যের ভেতরেই নিহিত তার শিক্ষাচিন্তার সারবস্তু তথা শিক্ষা হলো প্রশ্নের সাহস, নৈতিক অবস্থানের দৃঢ়তা, এবং সত্য অনুসন্ধানের এক অন্তহীন যাত্রা। তিনি চেয়েছিলেন এমন এক প্রজন্ম গড়ে তুলতে, যারা মুখস্থ বিদ্যায় নয়, বরং সমালোচনামূলক চিন্তা ও মানবিক দায়িত্ববোধে আলোকিত হবে। তার শ্রেণিকক্ষে তাই প্রতিটি পাঠই ছিল সমাজ, সত্য ও ন্যায়ের প্রতি নতুন প্রজন্মের জন্য দিকনির্দেশনা ও কল্যাণময় ভবিষ্যতের হাতছানি।

শিক্ষক, সাহিত্যিক, সমালোচক ও নৈতিক চেতনার দিকনির্দেশক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম একজন প্রজ্ঞাময় অধ্যাপক হিসেবে জীবনের প্রতিটি পাঠে শিক্ষার্থীদের ভেতরে আলো জ্বালিয়েছেন। তাই তার মৃত্যু যেন জাতীয় জীবনে প্রভাববিস্তারকারি এক আলোকবর্তিকার নিভে যাওয়া। কিন্তু বিরোধসাপেক্ষে (প্যারাডক্সিক্যালি), এই নিভে যাওয়া আলোই রেখে গেছে অসংখ্য আলোকরেখা, যা আমাদের ভবিষ্যতের পথচলায় পাথেয় হয়ে থাকবে। সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম কেবল এক শিক্ষক ছিলেন না, জাতীয় সংস্কৃতির ফল্গুধারায় ছিলেন এক বৌদ্ধিক ও নৈতিক আলোকস্রোত, যিনি দেখিয়েছেন যে জ্ঞানের আসল উদ্দেশ্য কেবল জানার আনন্দ নয়, বরং সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানোর সাহস। আজ যখন সমাজে নৈতিক অবক্ষয়, অসহিষ্ণুতা, আত্মকেন্দ্রিকতা ও ভোগবাদ ক্রমশ প্রাধান্য পাচ্ছে, তখন তার জীবন ও চিন্তা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, জ্ঞান যদি নৈতিকতার সঙ্গে যুক্ত না হয়, তবে তা মানুষকে মুক্ত করে না, বরং আরও বন্দি করে। তার বৌদ্ধিক উত্তরাধিকার তাই আমাদের জন্য এক নৈতিক মানচিত্র যেখানে শিক্ষা মানে কেবল পেশাগত প্রস্তুতি নয়, বরং মানবমুক্তির এক নীরব সাধনা। তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন, কিন্তু তার চিন্তার দীপ্তি, মানবিকতার উষ্ণতা, আর নৈতিকতার সাহস আজও আমাদের শেখায় কীভাবে অন্ধকারেও গভীর আত্মপ্রত্যয়ে আলো জ্বালিয়ে রাখা যায়।

তিনি এখন আর শারীরিকভাবে আমাদের মাঝে বেঁচে নেই; কিন্তু তার লেখনী, শ্রেণিকক্ষের স্মৃতি, উচ্চারণের মায়াময় ধ্বনি, হাস্যোজ্জ্বল মুখ তার অগণিত শিক্ষার্থীদের মনোজগতে বাকী জীবনও জীবন্ত, স্পন্দমান থাকবে। তার ব্যবহৃত প্রতিটি বাক্য, তার ধরিয়ে দেওয়া প্রতিটি চিন্তাসূত্র শিক্ষার্থীদের জীবনে তার উপস্থিতির সাক্ষ্য বহন করে। তাই সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ছিলেন এবং থাকবেন এক মননশীলতার বাতিঘর হয়ে। তিনি দেখিয়েছেন একজন প্রকৃত শিক্ষক কেবল পাঠ্যবইয়ের জ্ঞান দেন না, বরং শিক্ষার্থীর ভেতরে জ্ঞানের আলো জ্বালান; এমন এক আলো, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম অতিক্রম করে জ্ঞান বিকাশ ও বিস্তারের ছিলছিলায় মানবতার দিকনির্দেশনা হয়ে থাকে। তিনি আমাদের শিখিয়ে গেছেন, শিক্ষকতা কোনো পেশা নয়; এটি এক নৈতিক দায় ও প্রতিশ্রুতি, এক মানবিক অঙ্গীকার। তার কর্মময় জীবনের উদাহরণগুলো আমাদেরকে মনে করিয়ে দেয়, এক জন শিক্ষক যদি সত্যনিষ্ঠা, যুক্তিবোধ ও সহমর্মিতায় দৃঢ় থাকেন, তবে তিনি শুধু তার শিক্ষার্থীদের নয়, পুরো জাতিকেও আলোকিত করতে পারেন। সেই অর্থে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম কেবল একজন শিক্ষক, সাহিত্যিক, সমালোচক কিংবা অনুবাদকই নন, তিনি বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে এক অনন্য চেতনার স্থপতি যিনি অবক্ষয়ের চোরাবালিতেও আলো জ্বেলে গেছেন নীরবে, সুন্দর ও সমৃদ্ধ আগামীর অবিচল বিশ্বাসে। আর তার উত্তরসূরিদের দায় এখন সেই আলোকে বয়ে বেড়ানো, আর সেই আলোয় জাতিকে আলোকিত করে তোলার।

[লেখক: ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি, ইউনিভার্সিটি অব রোহ্যাম্পটন, যুক্তরাজ্য]

অটোমেশন ও দেশের যুব কর্মসংস্থানের ভবিষ্যৎ

দুর্যোগে ভয় নয়, প্রস্তুতিই শক্তি

বৈষম্যহীন সমাজের স্বপ্ন

ছবি

‘আল্লাহ তুই দেহিস’: এ কোন ঘৃণার আগুন, ছড়িয়ে গেল সবখানে!

চেকের মামলায় আসামী যেসব ডিফেন্স নিয়ে খালাস পেতে পারেন

খেলনাশিল্প: সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ

ছবি

প্রান্তিক মানুষের হৃদয়ে ফিরে আসা কালো মেঘ

গীর্জায় হামলার নেপথ্যে কী?

সংঘের শতবর্ষের রাজনৈতিক তাৎপর্য

দুর্নীতি আর চাঁদাবাজি রাজনৈতিক-সংস্কৃতির অংশ

বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস

বাংলার সংস্কৃতি : উৎস, বিবর্তন ও বর্তমান সমাজ-মনন

রম্যগদ্য: শিক্ষা সহজ, বিদ্যা কঠিন

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় জনগণের ভূমিকা উপেক্ষিত

শ্রমজীবী মানুষের শোভন কর্মসংস্থান

মূল্যস্ফীতি মোকাবেলায় বাংলাদেশের বাস্তবতা

প্রবারণার আলোয় আলোকিত হোক মানবজাতি

অস্ত্র নিয়ন্ত্রণে ওয়াশিংটনের শেষ সুযোগ?

পাহাড় থেকে সমতল: আদিবাসী নারীর নিরাপত্তা

সোশ্যাল মিডিয়ার ‘লাইক’ সংস্কৃতি: আসক্তি নাকি নতুন যোগাযোগ?

জাতিসংঘে রোহিঙ্গা ইস্যু

মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক পরিবর্তন: আমরা কী শিক্ষা নিতে পারি

রম্যগদ্য: “কেশ ফ্যালায় ভাই, কেশ ফ্যালায়...”

লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থীর অধিকার: বিসিএস ও শিক্ষা ক্যাডারের বৈষম্য

ন্যাশনাল গ্যালারি : রঙতুলির মহাসমুদ্রে একদিন

যুব শক্তি বনাম বেকারত্ব

প্রযুক্তি, আর্থিক পরিকল্পনা ও গণিতের ব্যবহার

ফরাসি বিপ্লব: বৈষম্য নিরসনে সামগ্রিক মুক্তির প্রেরণা

অন্তর্বর্তী সরকারের নিউইয়র্ক সফর

প্রবীণদের যত্ন: নৈতিক দায়িত্ব থেকে সামাজিক শক্তি নির্মাণ

জনস্বাস্থ্য রক্ষায় তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের অপরিহার্যতা

জনমিতিক সুবিধা: স্বপ্নের দশক ও নীতিগত সংস্কারের অপরিহার্যতা

বিদ্যালয় ও মাঠ দখলের বিরুদ্ধে আদিবাসীদের সংগ্রাম

শিক্ষাসংস্কারে চাই সুস্পষ্ট লক্ষ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা

ভারতে এসআইআর বিতর্ক

কীটনাশক: জনস্বাস্থ্যের হুমকি

tab

opinion » post-editorial

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: অবক্ষয়ের চোরাবালিতে আলোর দিশারী

মাহরুফ চৌধুরী

সোমবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৫

শিক্ষা, সাহিত্য, শিল্প ও সংস্কৃতির বিস্তীর্ণ অঙ্গনে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম এমন এক আলোকবর্তিকা, যার নাম উচ্চারণেই জ্বলে ওঠে এক নৈতিক ও মননশীল দীপ্তি। আমাদের জাগতিক জীবনে তার মৃত্যু কেবল এক প্রতিভাবান শিক্ষক, সাহিত্যিক, সমালোচক বা চিন্তাবিদের প্রয়াণ নয়; এ যেন এক প্রজ্ঞাময় যুগের অবসান। তিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থেই এমন এক অধ্যাপক, যিনি পা-িত্যকে সীমাবদ্ধ রাখেননি পাঠ্যবইয়ের পাতায়। ফলে তার প্রতিটি ক্লাসরুম ছিল এক মুক্ত চিন্তার কর্মশালা, যেখানে জ্ঞানের সঙ্গে যুক্ত হত মানবিকতা, নৈতিক বোধ ও সাংস্কৃতিক সংবেদনশীলতা। তার পাঠ ছিল একধরনের শ্রেয়চেতনার আলোকিত সাধনা যেখানে শিক্ষার্থী কেবল তথ্য অর্জন করত না, বরং আত্মসচেতনতা, মানবিক বোধ ও স্বাধীন চিন্তার প্রশিক্ষণ লাভ করত। বিশ্ববিদ্যালয়ের কঠোর রাজনৈতিক ক্ষমতাকেন্দ্রিক কাঠামোর মধ্যেও তিনি ছিলেন মুক্তচিন্তার অনুশীলক ও অভিভাবক, যিনি তার শিক্ষার্থীদের শিখিয়েছেন জ্ঞান মানে শুধু তথ্য কিংবা তত্ত্ব মুখস্থ করা নয়, বরং প্রশ্ন তোলা, যুক্তি নির্মাণ ও ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান নেওয়া। এই গুণেই সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বাংলাদেশের বৌদ্ধিক পরিসরে হয়ে উঠেছিলেন এক অনন্য উপস্থিতি; ভদ্রতা ও নম্রতায় হৃদ্য প্রজ্ঞা, সততা ও মানবিকতার এক দীপ্ত প্রতীক।

শ্রেণিকক্ষে কিংবা যে কোনো বক্তৃতার মঞ্চে সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের উপস্থিতি ছিল যেন এক বৌদ্ধিক উদ্যাপন। তার শ্রেণিকক্ষে বক্তৃতা ছিল কেবল পাঠ নয়; ছিল শিক্ষার্থী বা অংশগ্রহণকারিদের জন্য চিন্তার জাগরণ, নৈতিকতার অনুশীলন, আর মানবিকতার প্রশিক্ষণ। শিক্ষার্থীরা মুগ্ধ হতো তার কণ্ঠে, তার শব্দচয়ন ও ব্যাখ্যার গভীরতায়; প্রতিটি বক্তৃতায় তিনি যেন সত্য, সৌন্দর্য ও কল্যাণের এক অনন্য মেলবন্ধন ঘটাতেন। তিনি ছিলেন সেই শিক্ষক, যিনি কেবল জ্ঞানের সরবরাহকারী নন, বরং শ্রেয়চেতনার প্রেরণাদাতা হিসেবে যিনি শিখিয়েছেন সততা, যুক্তিবোধ এবং সহমর্মিতার মর্মার্থ। তার পাঠদানে বিশ্বসাহিত্যের চরিত্ররা যেমন জীবন্ত হয়ে উঠত, তেমনি সমাজ, রাজনীতি ও নৈতিকতার জটিল প্রশ্নও আলোচিত হতো গভীর দার্শনিক ও নান্দনিক দৃষ্টিকোণ থেকে। তিনি ছিলেন এমন এক শিক্ষক, যিনি জ্ঞানকে কেবল বৌদ্ধিক অর্জন নয়, বরং আত্মার বিকাশ হিসেবে দেখতেন। এক অর্থে, তার শ্রেণিকক্ষে পাঠদান ছিল সক্রেটিসের ‘ডায়ালগ’-এর আধুনিক প্রতিরূপ যেখানে প্রশ্ন ছিল জ্ঞানের সূচনা, আর আলোচনাই ছিল মানবতার পথে যাত্রার আয়োজন।

১৯৯৫ সালের দিকে ইংরেজি শেখার একটি বিশেষ কোর্সে তাকে পেয়েছিলাম শিক্ষক হিসেবে। তার সরাসরি ছাত্র হওয়ার যে সৌভাগ্য আমার হয়েছিল, সেটিই ছিল এক অনন্য অভিজ্ঞতা। একোর্সে অংশগ্রহণ করার মধ্য দিয়ে একজন শিক্ষক নয়, সমকালীন চিন্তাচেতনার তুলনায় প্রাগ্রসর একজন গভীর মানবিক চেতনার চিন্তাবিদকে জানার অভিজ্ঞতা। অল্প কয়েকটি পাঠেই বুঝে গিয়েছিলাম, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম জ্ঞানকে কখনো শিক্ষকতার পেশায় কিংবা শ্রেণিকক্ষের পরিসীমায় বন্দি রাখেননি; তিনি তাকে জীবনের এক নৈতিক অনুশাসন, এক মানবিক সাধনা হিসেবে ধারণ করেছিলেন। তার শ্রেণিকক্ষের বাইরে, তার ব্যক্তিগত কক্ষে একান্ত সাক্ষাতের অভিজ্ঞতা আমার মনে এক গভীর ও স্থায়ী ছাপ রেখে গেছে। ভাষা ও সাহিত্যের আলোচনার পাশাপাশি সমকালীন শিল্প, সংস্কৃতি ও রাজনীতি নিয়ে তার গভীর বিশ্লেষণ দেখিয়েছে যে কীভাবে একজন প্রকৃত বুদ্ধিজীবী সমাজের প্রতিটি পরিবর্তনকে আত্মস্থ করেন, তা নিয়ে ভাবেন এবং তার নৈতিক তাৎপর্য অনুসন্ধান করেন।

তার কক্ষে বসে কথা বলার অভিজ্ঞতা ছিল যেন এক উন্মুক্ত জ্ঞানের জগতে প্রবেশের মতো, যেখানে অহংকার, প্রতিদ্বন্দ্বিতা বা মানসিক প্রতিরোধের কোনো স্থান নেই। সেখানে শুধু ছিল জ্ঞানের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা, শিক্ষার্থীর প্রতি আন্তরিক মমতা এবং চিন্তার অনন্ত দিগন্তে অবারিত আহ্বান। তিনি প্রতিটি আলাপচারিতাকে এক ধরনের শিক্ষার অঙ্গ হিসেবে দেখতেন যেখানে প্রশ্ন তোলা, মতামত শোনা এবং ভাবনার নতুন দিক উন্মোচন করা ছিল পাঠের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তার এই সংলাপমুখী পদ্ধতিই শিক্ষার্থীদেরকে আত্মবিশ্বাসী করে তোলে, তাদের ভেতরে নিহিত সম্ভাবনার আলোকে জাগ্রত করে। সে কক্ষে বসে বোঝা যেত সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বিশ্বাস করতেন যে, প্রতিটি শিক্ষার্থী এক সম্ভাবনাময় সত্তা এবং তার দায়িত্ব হলো সেই সম্ভাবনাকে আবিষ্কার করে আলোকিত করা। তার বিনয়, মানবিকতা ও বিনিময়ভিত্তিক শিক্ষাদর্শন শিক্ষার্থীর মননশীলতার আকাশকে প্রসারিত করত এবং জ্ঞানকে কেবল তথ্যের সঞ্চয় নয়, বরং জীবনচর্চার এক শিল্প হিসেবে উপলব্ধি করাত। সেই থেকে আমার কাছে তিনি রয়ে গেছেন এক কাক্সিক্ষত শিক্ষাগুরুর প্রতীক; একজন বিনয়ী, আন্তরিক ও আলোকিত শিক্ষক হিসেবে যিনি কেবল আমাদেরকে ইংরেজি ভাষাই শেখাতেন না, বরং দিতেন জীবনকে বোঝার ও উপলব্ধি করার নিত্যনতুন সূত্র।

সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের সাহিত্যকর্মে যেমন প্রতিফলিত হয়েছে সমাজবীক্ষণের সূক্ষ্ম দৃষ্টি ও নৈতিক চেতনার পরিশীলন, তেমনি তার শিক্ষকতাও ছিল গভীর মানবিক মূল্যবোধে আবিষ্ট। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, সাহিত্য কেবল কল্পনার রূপ বা ভাষার কারুকাজ নয়; এটি মানুষের আত্মাকে স্পর্শ করার এক নৈতিক অনুশীলন, যা পাঠককে করে তোলে সংবেদনশীল, ন্যায়ের পক্ষে দৃঢ় এবং মানবিকতার পথে দায়বদ্ধ। তাই সাহিত্যের পাঠে তিনি শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করতেন শুধু কাহিনির কাঠামো বা চরিত্র বিশ্লেষণে নয়, বরং পাঠের অন্তর্নিহিত নৈতিক তাৎপর্য অনুধাবনে। আর সে কারণেই শিক্ষার্থীদের মতে, তার শ্রেণিকক্ষে সাহিত্য হয়ে উঠত এক আধ্যাত্মিক যাত্রা যেখানে তারা আবিষ্কার করত জীবনের জটিল সত্য, সামাজিক বৈষম্যের নির্মমতা এবং নৈতিক দায়িত্বের মর্মবেদনা। তার মতে, ‘ভালো সাহিত্য আমাদের শেখায় আমরা মানুষ, এবং এই মানুষ হওয়াটাই এক অনন্ত সাধনা’। এই দৃষ্টিভঙ্গিই তাকে প্রথাগত পন্ডিত বা শিক্ষকের সীমা অতিক্রম করে এক জীবনদ্রষ্টা গুরুর মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে। তার সাহিত্যচর্চা ও শিক্ষকতা পরস্পরকে পরিপূর্ণ করেছে যাতে একদিকে ছিল চিন্তার স্বাধীনতা, অন্যদিকে ছিল নৈতিক বোধের শুদ্ধতা। তাই তিনি কেবল ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক ছিলেন না; তিনি ছিলেন জীবন পাঠেরও এক উজ্জ্বল দিশারি।

বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষায়ই সমান স্বচ্ছন্দ ও সাবলীল সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ছিলেন এক বিরল দ্বিভাষিক সৃষ্টিশীল মননের অধিকারী। তাই তার অনুবাদে বিশ্বসাহিত্যের রচনাগুলো যেন নতুন প্রাণ পেত। তার হাতে ভাষা হয়ে উঠত কেবল যোগাযোগের মাধ্যম নয়, ভাব ও অনুভূতির সেতুবন্ধন। তার অনুবাদে পাঠক আবিষ্কার করত এক অভূতপূর্ব সামঞ্জস্য তথা ভাষার সৌন্দর্য, চিন্তার গভীরতা এবং নৈতিক সংবেদনশীলতার অনবদ্য মেলবন্ধন। তিনি অনুবাদকে কেবল কারিগরি প্রয়াস হিসেবে দেখেননি; দেখেছেন এক মানবিক দায়িত্ব হিসেবে যার মাধ্যমে বিশ্বমানবতার চেতনা পৌঁছে যায় আমাদের সংস্কৃতির ভেতরেও। তার এই আন্তঃসাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গিই অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে সমকালীন তরুণ লেখকদের। তার লেখার শৈলী, ভাবনার প্রজ্ঞা ও দৃষ্টিভঙ্গির স্বচ্ছতা অনেক নবীন সাহিত্যিক ও সাহিত্য সমালোচকের কাছে হয়ে উঠেছে এক ধরনের দিকনির্দেশনা। তারা দেখেছেন, কীভাবে সাহিত্য ও শিল্প হতে পারে নৈতিক অবস্থান নেওয়ার ক্ষেত্র, কীভাবে অনুবাদ হতে পারে এক সাংস্কৃতিক সংলাপের প্রক্রিয়া। এইভাবেই সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম কেবল একজন অনুবাদক, সাহিত্যিক কিংবা সমালোচক নন, বরং এক সেতুবন্ধন নির্মাতা হিসেবে যিনি ভাষা ও সংস্কৃতির সীমা অতিক্রম করে মানবতার অভিন্ন সুরকে শ্রদ্ধার সঙ্গে তুলে ধরেছেন।

তার সহকর্মী ও ছাত্রছাত্রীরাসহ শুভানুধ্যায়ীরা যেভাবে স্মরণ করেছেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলামকে, তাতে প্রতিফলিত হয় এক মানবিক চরিত্রের বিরল স্বচ্ছতা- অসাধারণ বিনয়, কঠোর নৈতিকতা, সততার প্রতি অটল বিশ্বাস, এবং জ্ঞানের প্রতি আজীবন নিষ্ঠা। এই গুণগুলোই তাকে আলাদা করে তুলেছিল এমন এক সময়ে, যখন জ্ঞান অনেকাংশে পেশাগত প্রতিযোগিতা, সাফল্যের মাপকাঠি বা আত্মপ্রদর্শনের হাতিয়ার হয়ে উঠছে। তিনি নিবৃতচারি ও নিরহংকারি চারিত্রিক স্বভাবে এসব প্রবণতার বাইরে অবস্থান করে জ্ঞানচর্চাকে দেখেছেন মানবমুক্তির এক নিরন্তর যাত্রা হিসেবে। সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের কাছে জ্ঞান ছিল না ক্ষমতা অর্জনের উপকরণ, বরং আত্মশুদ্ধি ও সামষ্টিক কল্যাণে সামাজিক ন্যায়ের পথ। তিনি বিশ্বাস করতেন, জ্ঞান যদি মানুষকে বিনয়ী না করে, তবে তা কেবল বুদ্ধির খেলা- আলো নয়, অন্ধকারেরই আরেক রূপ। তার জীবন ছিল সেই বিশ্বাসের বাস্তব রূপায়ণ যেখানে শিক্ষকতা ছিল এক নৈতিক সাধনা আর পাঠদান ছিল আত্ম-উন্নয়ন ও মানবমুক্তির দিকনির্দেশনা। তিনি প্রমাণ করেছেন, প্রকৃত প্রজ্ঞা অহংকারে নয়, বিনয়ে; প্রতিযোগিতায় নয়, সহযোগিতায়; এবং নিজেকে নয়, অন্যকে জাগিয়ে তোলার মধ্যেই নিহিত।

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ছিলেন এমন এক শিক্ষক যিনি নৈতিকতাকে সীমাবদ্ধ রাখেননি ব্যক্তিগত সততার গ-িতে। তার কাছে নৈতিকতা মানে ছিল সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান, এবং মানবকল্যাণের প্রতি প্রতিশ্রুতি। তিনি তার ছাত্রদের শিখিয়েছেন যে, জ্ঞান যদি সমাজকে স্পর্শ না করে, তবে তা অসম্পূর্ণ; আর শিক্ষিত হওয়া মানে কেবল তথ্য জানা নয়, বরং সেই তথ্যের নৈতিক প্রয়োগ জানা ও সে অনুসারে কাজ করা। তার এক বিখ্যাত উপদেশ, ‘শিক্ষিত হওয়া মানে কেবল তথ্য জানা নয়, বরং সঠিক প্রশ্ন করতে পারা’ শিক্ষার্থীদের কাছে তার শিক্ষকতার দর্শনের মর্মবাণী হিসেবে অনুরণিত হতে থাকবে জীবনের শেষ দিন অবধি। এই এক বাক্যের ভেতরেই নিহিত তার শিক্ষাচিন্তার সারবস্তু তথা শিক্ষা হলো প্রশ্নের সাহস, নৈতিক অবস্থানের দৃঢ়তা, এবং সত্য অনুসন্ধানের এক অন্তহীন যাত্রা। তিনি চেয়েছিলেন এমন এক প্রজন্ম গড়ে তুলতে, যারা মুখস্থ বিদ্যায় নয়, বরং সমালোচনামূলক চিন্তা ও মানবিক দায়িত্ববোধে আলোকিত হবে। তার শ্রেণিকক্ষে তাই প্রতিটি পাঠই ছিল সমাজ, সত্য ও ন্যায়ের প্রতি নতুন প্রজন্মের জন্য দিকনির্দেশনা ও কল্যাণময় ভবিষ্যতের হাতছানি।

শিক্ষক, সাহিত্যিক, সমালোচক ও নৈতিক চেতনার দিকনির্দেশক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম একজন প্রজ্ঞাময় অধ্যাপক হিসেবে জীবনের প্রতিটি পাঠে শিক্ষার্থীদের ভেতরে আলো জ্বালিয়েছেন। তাই তার মৃত্যু যেন জাতীয় জীবনে প্রভাববিস্তারকারি এক আলোকবর্তিকার নিভে যাওয়া। কিন্তু বিরোধসাপেক্ষে (প্যারাডক্সিক্যালি), এই নিভে যাওয়া আলোই রেখে গেছে অসংখ্য আলোকরেখা, যা আমাদের ভবিষ্যতের পথচলায় পাথেয় হয়ে থাকবে। সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম কেবল এক শিক্ষক ছিলেন না, জাতীয় সংস্কৃতির ফল্গুধারায় ছিলেন এক বৌদ্ধিক ও নৈতিক আলোকস্রোত, যিনি দেখিয়েছেন যে জ্ঞানের আসল উদ্দেশ্য কেবল জানার আনন্দ নয়, বরং সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানোর সাহস। আজ যখন সমাজে নৈতিক অবক্ষয়, অসহিষ্ণুতা, আত্মকেন্দ্রিকতা ও ভোগবাদ ক্রমশ প্রাধান্য পাচ্ছে, তখন তার জীবন ও চিন্তা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, জ্ঞান যদি নৈতিকতার সঙ্গে যুক্ত না হয়, তবে তা মানুষকে মুক্ত করে না, বরং আরও বন্দি করে। তার বৌদ্ধিক উত্তরাধিকার তাই আমাদের জন্য এক নৈতিক মানচিত্র যেখানে শিক্ষা মানে কেবল পেশাগত প্রস্তুতি নয়, বরং মানবমুক্তির এক নীরব সাধনা। তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন, কিন্তু তার চিন্তার দীপ্তি, মানবিকতার উষ্ণতা, আর নৈতিকতার সাহস আজও আমাদের শেখায় কীভাবে অন্ধকারেও গভীর আত্মপ্রত্যয়ে আলো জ্বালিয়ে রাখা যায়।

তিনি এখন আর শারীরিকভাবে আমাদের মাঝে বেঁচে নেই; কিন্তু তার লেখনী, শ্রেণিকক্ষের স্মৃতি, উচ্চারণের মায়াময় ধ্বনি, হাস্যোজ্জ্বল মুখ তার অগণিত শিক্ষার্থীদের মনোজগতে বাকী জীবনও জীবন্ত, স্পন্দমান থাকবে। তার ব্যবহৃত প্রতিটি বাক্য, তার ধরিয়ে দেওয়া প্রতিটি চিন্তাসূত্র শিক্ষার্থীদের জীবনে তার উপস্থিতির সাক্ষ্য বহন করে। তাই সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম ছিলেন এবং থাকবেন এক মননশীলতার বাতিঘর হয়ে। তিনি দেখিয়েছেন একজন প্রকৃত শিক্ষক কেবল পাঠ্যবইয়ের জ্ঞান দেন না, বরং শিক্ষার্থীর ভেতরে জ্ঞানের আলো জ্বালান; এমন এক আলো, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম অতিক্রম করে জ্ঞান বিকাশ ও বিস্তারের ছিলছিলায় মানবতার দিকনির্দেশনা হয়ে থাকে। তিনি আমাদের শিখিয়ে গেছেন, শিক্ষকতা কোনো পেশা নয়; এটি এক নৈতিক দায় ও প্রতিশ্রুতি, এক মানবিক অঙ্গীকার। তার কর্মময় জীবনের উদাহরণগুলো আমাদেরকে মনে করিয়ে দেয়, এক জন শিক্ষক যদি সত্যনিষ্ঠা, যুক্তিবোধ ও সহমর্মিতায় দৃঢ় থাকেন, তবে তিনি শুধু তার শিক্ষার্থীদের নয়, পুরো জাতিকেও আলোকিত করতে পারেন। সেই অর্থে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম কেবল একজন শিক্ষক, সাহিত্যিক, সমালোচক কিংবা অনুবাদকই নন, তিনি বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে এক অনন্য চেতনার স্থপতি যিনি অবক্ষয়ের চোরাবালিতেও আলো জ্বেলে গেছেন নীরবে, সুন্দর ও সমৃদ্ধ আগামীর অবিচল বিশ্বাসে। আর তার উত্তরসূরিদের দায় এখন সেই আলোকে বয়ে বেড়ানো, আর সেই আলোয় জাতিকে আলোকিত করে তোলার।

[লেখক: ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি, ইউনিভার্সিটি অব রোহ্যাম্পটন, যুক্তরাজ্য]

back to top