আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার
বাংলাদেশসহ আজকের পৃথিবী এক ভয়াবহ পরিবেশ সংকটের যুগে প্রবেশ করেছে, যার প্রভাব মানব সভ্যতার অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে। বায়ুদূষণ, পানিদূষণ, শব্দদূষণ, বননিধন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, খরা, নদীভাঙন, মিঠাপানির অভাব, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এসব প্রাকৃতিক বিপর্যয় এখন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে দ্রুত নগরায়ণ, শিল্পায়ন ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাপে পরিবেশের ভারসাম্য মারাত্মকভাবে নষ্ট হচ্ছে। ঢাকাসহ দেশের প্রধান শহরগুলোতে বায়ুর মান প্রায় সারাবছরই অস্বাস্থ্যকর পর্যায়ে থাকে, শিল্পবর্জ্য নদীতে ফেলা হয়, নদীগুলো দখল ও দূষণে মৃতপ্রায়, প্লাস্টিক বর্জ্য ও যানবাহনের ধোঁয়া প্রতিনিয়ত মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়াচ্ছে। পরিবেশের এই অবনতির প্রভাবে জীববৈচিত্র?্য হারিয়ে যাচ্ছে, আর প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারে দেখা দিচ্ছে চরম অসামঞ্জস্য। এই পরিস্থিতিতে পরিবেশ বিষয়ক সংস্কার এখন কেবল একটি বিকল্প নয়, বরং টিকে থাকার অনিবার্য শর্ত। পরিবেশ সংরক্ষণ, ব্যবস্থাপনা ও নীতিনির্ধারণে মৌলিক পরিবর্তন আনাই এখন সময়ের দাবি।
ঢাকা বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম দূষিত শহর হিসেবে পরিচিত। বায়ুমান সূচক এখন প্রায় সারাবছরই ‘অস্বাস্থ্যকর’ পর্যায়ে থাকছে। বায়ুদূষণ এখন শুধু স্বাস্থ্যঝুঁকিই নয়, বরং সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণও হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতি বছর হাজারো মানুষ শ্বাসকষ্ট, ফুসফুসের রোগ, হৃদরোগ ও ক্যানসারের মতো জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। শিল্পকারখানার অপরিশোধিত বর্জ্য নদীতে ফেলে দেওয়ার ফলে নদীগুলো জীববৈচিত্র হারাচ্ছে এবং কৃষিকাজেও প্রভাব ফেলছে। হাওড়ে বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হচ্ছে, সিলেটের এক অনবদ্য সৌন্দর্য সাদা পাথর লুট হয়ে যাচ্ছে। আবার, বন কেটে তৈরি হচ্ছে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র বা খেলার মাঠ।
প্লাস্টিক বর্জ্যের ভয়াবহতা এতটাই বেড়েছে যে, শহর ও গ্রাম উভয় জায়গায় জলাবদ্ধতা, ড্রেনেজ সমস্যা এবং মাটি ও পানিদূষণ ক্রমাগত বাড়ছে। ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, খরা, নদীভাঙন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি-সবকিছুই দেশের মানুষের জীবনযাত্রাকে ক্রমাগত বিপন্ন করে তুলছে। অতিরিক্ত বননিধন, অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন, এবং খনিজ সম্পদের অব্যবস্থাপনা পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করছে। এদেশের জীববৈচিত্র?্যও ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসছে। সুন্দরবনের বাঘ, হাওরের মাছ, পাহাড়ি অঞ্চলের প্রাণিকুল এই সবকিছুই আজ বিপন্ন। পরিবেশ নীতি ও সংরক্ষণ ব্যবস্থায় আধুনিক বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাব এ প্রক্রিয়াকে আরও ত্বরান্বিত করছে। এসব সংকটের মূল কারণ হলো অকার্যকর পরিবেশ আইন, দুর্বল প্রশাসনিক কাঠামো এবং জনগণের অজ্ঞতা।
বাংলাদেশের মতো জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ দেশে পরিবেশ সংস্কার মানে হলো একটি টেকসই ভবিষ্যতের ভিত্তি স্থাপন। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে, কৃষিজমি অনুর্বর হয়ে যাচ্ছে, ও হাজার হাজার মানুষ জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হচ্ছে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিদ্যমান পরিবেশ আইন ও নীতিমালা নতুনভাবে পর্যালোচনা ও হালনাগাদ করা জরুরি। ১৯৯৫ সালের পরিবেশ সংরক্ষণ আইন আজকের বাস্তবতার সঙ্গে অনেকাংশে বেমানান। তাই শিল্পবর্জ্য নিয়ন্ত্রণ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার, ও জলবায়ু সহনশীল অবকাঠামো নির্মাণের মতো আধুনিক নীতিমালা যুক্ত করা প্রয়োজন।
প্রাতিষ্ঠানিকভাবে একটি একীভূত ও ক্ষমতাসম্পন্ন “জাতীয় পরিবেশ কমিশন” গঠন করা যেতে পারে, যা নীতি প্রণয়ন, বাস্তবায়ন, মনিটরিং এবং মূল্যায়নের দায়িত্ব পালন করবে। পরিবেশ অধিদপ্তর, স্থানীয় সরকার, কৃষি, পানি সম্পদ ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয় জোরদার করতে হবে। পরিবেশ সুরক্ষায় সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি জরুরি। পাশাপাশি “সবুজ অর্থনীতি” গড়ে তুলতে হবে, যেখানে উন্নয়ন প্রকল্পের সাথে পরিবেশ সংরক্ষণ একটি অপরিহার্য অংশ হিসেবে বিবেচিত হবে। অর্থনৈতিক সংস্কারের অংশ হিসেবে দূষণকারী শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের উপর পরিবেশ কর আরোপ করা যেতে পারে, যাতে তারা পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহারে উৎসাহিত হয়। একই সঙ্গে ‘পলুশন কমপেনসেশন ফান্ড’ বা ‘পলুটারস পে প্রিন্সিপালস’ গঠন করে পরিবেশ ক্ষতির ক্ষতিপূরণ আদায় করা যেতে পারে। সরকারি বাজেটে ‘গ্রিন ফিসকল পলিসি’ অন্তর্ভুক্ত করা হলে পরিবেশবান্ধব প্রকল্পে অর্থায়ন বাড়ানো সম্ভব হবে। প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন পরিবেশ সংস্কারে নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রিমোট সেন্সিং, এবং ভূ-তথ্য ব্যবস্থা ব্যবহার করে বায়ু, পানি ও মাটির মান নিরীক্ষা করা যেতে পারে। এভাবে পরিবেশ দূষণের উৎস নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম দ্রুততর করা সম্ভব। পাশাপাশি নবায়নযোগ্য শক্তি যেমন সৌরবিদ্যুৎ, বায়ুশক্তি ও বায়োগ্যাসের ব্যবহার বাড়াতে হবে। শহরে বর্জ্য পৃথকীকরণ ও পুনর্ব্যবহার ব্যবস্থা চালু করা এবং শিল্পাঞ্চলে বর্জ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ বাধ্যতামূলক করতে হবে।
পরিবেশ সংস্কারের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো শিক্ষা ও সচেতনতা। পরিবেশ শিক্ষা প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে পাঠ্যক্রমের অবিচ্ছেদ্য অংশ হতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘এনভায়রেনমেন্টাল গভর্নেন্স’, ‘সাসটেইনেবিলিটি স্টাডিজ’ বা ‘ক্লাইমেট পলিসি’ বিষয়ে পড়াশোনা ও গবেষণাকে উৎসাহিত করতে হবে। একই সঙ্গে গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, এবং স্থানীয় সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের মাধ্যমে জনসচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন। জনগণকে বুঝতে হবে যে পরিবেশ রক্ষা কোনো একক সংস্থা বা সরকারের দায়িত্ব নয়, এটি আমাদের সবার দায়িত্ব। স্থানীয় সরকার ও জনগণের অংশগ্রহণ পরিবেশ সংস্কারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। “সবুজ ইউনিয়ন”বা “ইকো-ভিলেজ” প্রকল্পের মাধ্যমে স্থানীয় পর্যায়ে বৃক্ষরোপণ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, নদী ও খাল পুনরুদ্ধার, এবং পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে পরিবেশবান্ধব কৃষি পদ্ধতি, যেমন জৈব সার ব্যবহার, পানি সাশ্রয়ী সেচ ব্যবস্থা ও মাটি সংরক্ষণ প্রযুক্তি প্রবর্তন করা দরকার। পরিবেশ সংস্কার সফল করতে গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের ভূমিকাও অনস্বীকার্য। সংবাদমাধ্যম পরিবেশ দূষণ, বননিধন বা নদী দখলের মতো অপরাধের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে পারে। এনজিওগুলো স্থানীয় পর্যায়ে পরিবেশ শিক্ষা, বনায়ন ও জীববৈচিত্র?্য সংরক্ষণে সহযোগিতা করতে পারে। আন্তর্জাতিক সহযোগিতাও এই সংস্কারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বাপা, পবা ও বেলা এর মতো নাগরিক সংস্থার কার্যক্রম বৃদ্ধি পরিবেশ রক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। বাংলাদেশকে জলবায়ু অর্থায়ন এবং প্রযুক্তি স্থানান্তরের বৈশ্বিক প্রক্রিয়ায় আরও সক্রিয় হতে হবে, যাতে আন্তর্জাতিক তহবিল ও জ্ঞান বিনিময়ের মাধ্যমে জাতীয় সক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
পরিবেশ সংরক্ষণ এখন কেবল একটি নৈতিক বা মানবিক দায়িত্ব নয়, বরং টেকসই উন্নয়ন ও জাতীয় অগ্রগতির মৌলিক ভিত্তি। উন্নয়ন ও পরিবেশ একে অপরের পরিপূরক, যখন উন্নয়ন কার্যক্রমে পরিবেশকে উপেক্ষা করা হয়, তখন সেই উন্নয়ন টেকসই থাকে না। বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় পরিবেশ বিষয়ক সংস্কার একটি জরুরি ও অনিবার্য পদক্ষেপ, যেখানে আইন, নীতি, প্রতিষ্ঠান, অর্থনীতি, শিক্ষা ও প্রযুক্তি সকল ক্ষেত্রেই সমন্বিত পরিবর্তন প্রয়োজন। এ সংস্কারের মূল উদ্দেশ্য হবে “উন্নয়ন ও পরিবেশের মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা”এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ে তোলা। বাংলাদেশ যদি নবায়নযোগ্য শক্তি, সবুজ অর্থনীতি, পরিবেশবান্ধব নগর পরিকল্পনা এবং জনগণভিত্তিক পরিবেশ ব্যবস্থাপনায় অগ্রসর হয়, তবে এটি একবিংশ শতাব্দীর জলবায়ু-সংকট মোকাবিলায় বিশ্বের জন্য এক অনন্য উদাহরণ হয়ে উঠবে। টেকসই উন্নয়ন মানেই কেবল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নয়, বরং আমাদেরকে এমন একটি জীবনব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, যেখানে মানুষ ও প্রকৃতি সমানভাবে বেঁচে থাকতে পারে এক সবুজ, নিরাপদ ও সমৃদ্ধ পৃথিবীতে।
[লেখক: ডিন, বিজ্ঞান অনুষদ; অধ্যাপক, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি]
আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার
বৃহস্পতিবার, ২৩ অক্টোবর ২০২৫
বাংলাদেশসহ আজকের পৃথিবী এক ভয়াবহ পরিবেশ সংকটের যুগে প্রবেশ করেছে, যার প্রভাব মানব সভ্যতার অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে। বায়ুদূষণ, পানিদূষণ, শব্দদূষণ, বননিধন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, খরা, নদীভাঙন, মিঠাপানির অভাব, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এসব প্রাকৃতিক বিপর্যয় এখন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে দ্রুত নগরায়ণ, শিল্পায়ন ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাপে পরিবেশের ভারসাম্য মারাত্মকভাবে নষ্ট হচ্ছে। ঢাকাসহ দেশের প্রধান শহরগুলোতে বায়ুর মান প্রায় সারাবছরই অস্বাস্থ্যকর পর্যায়ে থাকে, শিল্পবর্জ্য নদীতে ফেলা হয়, নদীগুলো দখল ও দূষণে মৃতপ্রায়, প্লাস্টিক বর্জ্য ও যানবাহনের ধোঁয়া প্রতিনিয়ত মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়াচ্ছে। পরিবেশের এই অবনতির প্রভাবে জীববৈচিত্র?্য হারিয়ে যাচ্ছে, আর প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারে দেখা দিচ্ছে চরম অসামঞ্জস্য। এই পরিস্থিতিতে পরিবেশ বিষয়ক সংস্কার এখন কেবল একটি বিকল্প নয়, বরং টিকে থাকার অনিবার্য শর্ত। পরিবেশ সংরক্ষণ, ব্যবস্থাপনা ও নীতিনির্ধারণে মৌলিক পরিবর্তন আনাই এখন সময়ের দাবি।
ঢাকা বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম দূষিত শহর হিসেবে পরিচিত। বায়ুমান সূচক এখন প্রায় সারাবছরই ‘অস্বাস্থ্যকর’ পর্যায়ে থাকছে। বায়ুদূষণ এখন শুধু স্বাস্থ্যঝুঁকিই নয়, বরং সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণও হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতি বছর হাজারো মানুষ শ্বাসকষ্ট, ফুসফুসের রোগ, হৃদরোগ ও ক্যানসারের মতো জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। শিল্পকারখানার অপরিশোধিত বর্জ্য নদীতে ফেলে দেওয়ার ফলে নদীগুলো জীববৈচিত্র হারাচ্ছে এবং কৃষিকাজেও প্রভাব ফেলছে। হাওড়ে বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হচ্ছে, সিলেটের এক অনবদ্য সৌন্দর্য সাদা পাথর লুট হয়ে যাচ্ছে। আবার, বন কেটে তৈরি হচ্ছে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র বা খেলার মাঠ।
প্লাস্টিক বর্জ্যের ভয়াবহতা এতটাই বেড়েছে যে, শহর ও গ্রাম উভয় জায়গায় জলাবদ্ধতা, ড্রেনেজ সমস্যা এবং মাটি ও পানিদূষণ ক্রমাগত বাড়ছে। ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, খরা, নদীভাঙন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি-সবকিছুই দেশের মানুষের জীবনযাত্রাকে ক্রমাগত বিপন্ন করে তুলছে। অতিরিক্ত বননিধন, অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন, এবং খনিজ সম্পদের অব্যবস্থাপনা পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করছে। এদেশের জীববৈচিত্র?্যও ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসছে। সুন্দরবনের বাঘ, হাওরের মাছ, পাহাড়ি অঞ্চলের প্রাণিকুল এই সবকিছুই আজ বিপন্ন। পরিবেশ নীতি ও সংরক্ষণ ব্যবস্থায় আধুনিক বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির অভাব এ প্রক্রিয়াকে আরও ত্বরান্বিত করছে। এসব সংকটের মূল কারণ হলো অকার্যকর পরিবেশ আইন, দুর্বল প্রশাসনিক কাঠামো এবং জনগণের অজ্ঞতা।
বাংলাদেশের মতো জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ দেশে পরিবেশ সংস্কার মানে হলো একটি টেকসই ভবিষ্যতের ভিত্তি স্থাপন। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে, কৃষিজমি অনুর্বর হয়ে যাচ্ছে, ও হাজার হাজার মানুষ জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হচ্ছে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিদ্যমান পরিবেশ আইন ও নীতিমালা নতুনভাবে পর্যালোচনা ও হালনাগাদ করা জরুরি। ১৯৯৫ সালের পরিবেশ সংরক্ষণ আইন আজকের বাস্তবতার সঙ্গে অনেকাংশে বেমানান। তাই শিল্পবর্জ্য নিয়ন্ত্রণ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার, ও জলবায়ু সহনশীল অবকাঠামো নির্মাণের মতো আধুনিক নীতিমালা যুক্ত করা প্রয়োজন।
প্রাতিষ্ঠানিকভাবে একটি একীভূত ও ক্ষমতাসম্পন্ন “জাতীয় পরিবেশ কমিশন” গঠন করা যেতে পারে, যা নীতি প্রণয়ন, বাস্তবায়ন, মনিটরিং এবং মূল্যায়নের দায়িত্ব পালন করবে। পরিবেশ অধিদপ্তর, স্থানীয় সরকার, কৃষি, পানি সম্পদ ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয় জোরদার করতে হবে। পরিবেশ সুরক্ষায় সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি জরুরি। পাশাপাশি “সবুজ অর্থনীতি” গড়ে তুলতে হবে, যেখানে উন্নয়ন প্রকল্পের সাথে পরিবেশ সংরক্ষণ একটি অপরিহার্য অংশ হিসেবে বিবেচিত হবে। অর্থনৈতিক সংস্কারের অংশ হিসেবে দূষণকারী শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের উপর পরিবেশ কর আরোপ করা যেতে পারে, যাতে তারা পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহারে উৎসাহিত হয়। একই সঙ্গে ‘পলুশন কমপেনসেশন ফান্ড’ বা ‘পলুটারস পে প্রিন্সিপালস’ গঠন করে পরিবেশ ক্ষতির ক্ষতিপূরণ আদায় করা যেতে পারে। সরকারি বাজেটে ‘গ্রিন ফিসকল পলিসি’ অন্তর্ভুক্ত করা হলে পরিবেশবান্ধব প্রকল্পে অর্থায়ন বাড়ানো সম্ভব হবে। প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন পরিবেশ সংস্কারে নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রিমোট সেন্সিং, এবং ভূ-তথ্য ব্যবস্থা ব্যবহার করে বায়ু, পানি ও মাটির মান নিরীক্ষা করা যেতে পারে। এভাবে পরিবেশ দূষণের উৎস নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম দ্রুততর করা সম্ভব। পাশাপাশি নবায়নযোগ্য শক্তি যেমন সৌরবিদ্যুৎ, বায়ুশক্তি ও বায়োগ্যাসের ব্যবহার বাড়াতে হবে। শহরে বর্জ্য পৃথকীকরণ ও পুনর্ব্যবহার ব্যবস্থা চালু করা এবং শিল্পাঞ্চলে বর্জ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ বাধ্যতামূলক করতে হবে।
পরিবেশ সংস্কারের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো শিক্ষা ও সচেতনতা। পরিবেশ শিক্ষা প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে পাঠ্যক্রমের অবিচ্ছেদ্য অংশ হতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘এনভায়রেনমেন্টাল গভর্নেন্স’, ‘সাসটেইনেবিলিটি স্টাডিজ’ বা ‘ক্লাইমেট পলিসি’ বিষয়ে পড়াশোনা ও গবেষণাকে উৎসাহিত করতে হবে। একই সঙ্গে গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, এবং স্থানীয় সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের মাধ্যমে জনসচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন। জনগণকে বুঝতে হবে যে পরিবেশ রক্ষা কোনো একক সংস্থা বা সরকারের দায়িত্ব নয়, এটি আমাদের সবার দায়িত্ব। স্থানীয় সরকার ও জনগণের অংশগ্রহণ পরিবেশ সংস্কারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। “সবুজ ইউনিয়ন”বা “ইকো-ভিলেজ” প্রকল্পের মাধ্যমে স্থানীয় পর্যায়ে বৃক্ষরোপণ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, নদী ও খাল পুনরুদ্ধার, এবং পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে পরিবেশবান্ধব কৃষি পদ্ধতি, যেমন জৈব সার ব্যবহার, পানি সাশ্রয়ী সেচ ব্যবস্থা ও মাটি সংরক্ষণ প্রযুক্তি প্রবর্তন করা দরকার। পরিবেশ সংস্কার সফল করতে গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের ভূমিকাও অনস্বীকার্য। সংবাদমাধ্যম পরিবেশ দূষণ, বননিধন বা নদী দখলের মতো অপরাধের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে পারে। এনজিওগুলো স্থানীয় পর্যায়ে পরিবেশ শিক্ষা, বনায়ন ও জীববৈচিত্র?্য সংরক্ষণে সহযোগিতা করতে পারে। আন্তর্জাতিক সহযোগিতাও এই সংস্কারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বাপা, পবা ও বেলা এর মতো নাগরিক সংস্থার কার্যক্রম বৃদ্ধি পরিবেশ রক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। বাংলাদেশকে জলবায়ু অর্থায়ন এবং প্রযুক্তি স্থানান্তরের বৈশ্বিক প্রক্রিয়ায় আরও সক্রিয় হতে হবে, যাতে আন্তর্জাতিক তহবিল ও জ্ঞান বিনিময়ের মাধ্যমে জাতীয় সক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
পরিবেশ সংরক্ষণ এখন কেবল একটি নৈতিক বা মানবিক দায়িত্ব নয়, বরং টেকসই উন্নয়ন ও জাতীয় অগ্রগতির মৌলিক ভিত্তি। উন্নয়ন ও পরিবেশ একে অপরের পরিপূরক, যখন উন্নয়ন কার্যক্রমে পরিবেশকে উপেক্ষা করা হয়, তখন সেই উন্নয়ন টেকসই থাকে না। বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় পরিবেশ বিষয়ক সংস্কার একটি জরুরি ও অনিবার্য পদক্ষেপ, যেখানে আইন, নীতি, প্রতিষ্ঠান, অর্থনীতি, শিক্ষা ও প্রযুক্তি সকল ক্ষেত্রেই সমন্বিত পরিবর্তন প্রয়োজন। এ সংস্কারের মূল উদ্দেশ্য হবে “উন্নয়ন ও পরিবেশের মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা”এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ে তোলা। বাংলাদেশ যদি নবায়নযোগ্য শক্তি, সবুজ অর্থনীতি, পরিবেশবান্ধব নগর পরিকল্পনা এবং জনগণভিত্তিক পরিবেশ ব্যবস্থাপনায় অগ্রসর হয়, তবে এটি একবিংশ শতাব্দীর জলবায়ু-সংকট মোকাবিলায় বিশ্বের জন্য এক অনন্য উদাহরণ হয়ে উঠবে। টেকসই উন্নয়ন মানেই কেবল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নয়, বরং আমাদেরকে এমন একটি জীবনব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, যেখানে মানুষ ও প্রকৃতি সমানভাবে বেঁচে থাকতে পারে এক সবুজ, নিরাপদ ও সমৃদ্ধ পৃথিবীতে।
[লেখক: ডিন, বিজ্ঞান অনুষদ; অধ্যাপক, পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি]