জুবাইয়া বিন্তে কবির
জীবন টিকে থাকে খাদ্যের ওপর। মানুষের মৌলিক চাহিদার তালিকায় খাদ্যই সর্বাগ্রে, কারণ অন্নই জীবনের প্রাণস্বর। অথচ বিস্ময়ের বিষয়-আজ পৃথিবীতে খাদ্য উৎপাদনের প্রাচুর্য থাকলেও, কোটি কোটি মানুষ প্রতিদিন ক্ষুধার যন্ত্রণায় কাতর। পৃথিবীতে যত খাদ্য উৎপাদিত হয়, তা দিয়ে বৈশ্বিক জনসংখ্যার দেড়গুণ মানুষকে আহার করানো সম্ভব। তবু আজও প্রায় ৭৮৩ মিলিয়ন মানুষ অভুক্ত, আর বিশ্বের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ ভুগছে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায়। কেন এমন বৈষম্য এর মূল কারণ উৎপাদনের ঘাটতি নয়, বরং অপচয়, অব্যবস্থাপনা ও অসম বণ্টন। পৃথিবীর মোট উৎপাদিত খাদ্যের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ নষ্ট বা অপচয় হয়-যার পরিমাণ দৈনিক ১ বিলিয়ন মিল। বছরে এই ক্ষতির অর্থমূল্য দাঁড়ায় প্রায় ১ ট্রিলিয়ন ডলার। শুধু অর্থ নয়, এর সঙ্গে নষ্ট হয় মূল্যবান জমি, পানি, শ্রম ও শক্তি-নষ্ট হয় মানবতার চেতনা। খাদ্য পচনের ফলে নির্গত গ্রিনহাউস গ্যাসের অংশ প্রায় ১০ শতাংশ; অর্থাৎ, খাদ্য অপচয় কেবল মানবিক নয়, পরিবেশগত বিপর্যয়েরও এক বড় উৎস।
বাংলাদেশের উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়া খাদ্য সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বড় বাধা। পরিকাঠামোগত দুর্বলতা, অপর্যাপ্ত শীতল শৃঙ্খল, অদক্ষ পরিবহন, এবং কৃষিপণ্যের প্রক্রিয়াজাতকরণে অনীহা-সব মিলিয়ে অপচয়ের হার এখানে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য বর্জ্য সূচক প্রতিবেদন ২০২৪ অনুযায়ী, বাংলাদেশে বছরে ১৪ দশমিক ১০ মিলিয়ন টন খাদ্য অপচয় হয়, যা তিন বছর আগের তুলনায় ৩৩ শতাংশ বেশি। জনপ্রতি অপচয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮২ কেজি, যা যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র বা চীনের চেয়েও বেশি। প্রতি বছর দেশে উৎপাদিত কৃষিপণ্যের প্রায় এক-তৃতীয়াংশই বাজারে পৌঁছাতে পারে না। ফলে জিডিপির ৪ শতাংশ সমমূল্যের ক্ষতি হয় কৃষক ও জাতীয় অর্থনীতিতে। অথচ এই অপচয় রোধ করা গেলে বাংলাদেশের মানুষকে অনায়াসে চার মাস পর্যন্ত খাওয়ানো যেত-এ এক নির্মম পরিহাস।
স্বাধীনতার পর আমাদের কৃষিক্ষেত্রে যে বিপ্লব ঘটেছে, তা নিঃসন্দেহে আশাব্যঞ্জক। ১৯৭২-৭৩ সালে দেশের খাদ্যশস্য উৎপাদন ছিল ১ কোটি ১০ লাখ টন; এখন তা বেড়ে ৫ কোটি টনেরও বেশি। কিন্তু উৎপাদনের এই সাফল্যের সাথেও পাল্লা দিয়েছে অপচয়ের দুঃসহ বাস্তবতা। কারণ উৎপাদন থেকে ভোক্তা পর্যায় পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে ক্ষতির ছায়া ঘনিয়ে থাকে-কখনো ফসলে পোকামাকড়ের আক্রমণ, কখনো সঠিক সময়ে সংগ্রহ না করা, কখনো পরিবহনে নষ্ট হওয়া। ফলমূল, সবজি, দুধ ও মাছের ক্ষেত্রে অপচয়ের হার সর্বাধিক। এক গবেষণায় দেখা গেছে-ধানের ক্ষেত্রে ২৩ শতাংশ, গমে ১৭, মসুরে ২৭, কলায় ২০, আলুতে ২২, পেঁয়াজে ৩০, মাছের ক্ষেত্রে ৩৬ শতাংশ পর্যন্ত খাদ্য নষ্ট হয়। অথচ এসব পণ্যই আমাদের জনগণের প্রতিদিনের আহারের অপরিহার্য অংশ।
শহরে বিয়েবাড়ি, রেস্টুরেন্ট কিংবা সামাজিক অনুষ্ঠানে যে পরিমাণ খাদ্য অব্যবহৃত অবস্থায় ময়লার ভাগাড়ে ফেলা হয়, তা সত্যিই বেদনাদায়ক। অন্যদিকে গ্রামের দরিদ্র পরিবারগুলো দুই বেলা আহার জোগাতে হিমশিম খায়। এই বৈপরীত্য কেবল অর্থনীতির নয়, আমাদের বিবেকেরও প্রশ্ন তোলে। একসময় আমাদের গ্রামীণ সমাজে অপচয় ছিল লজ্জার বিষয়। অগ্রহায়ণ মাসে ফসল কাটার পর মাঠে ছিটকে থাকা ধান শিশুরা কুড়িয়ে আনত, গৃহিণীরা প্রতিটি দানা সযত্নে তুলত। আজ সেই সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে। আধুনিকতার ছোঁয়ায় আমরা যেন কৃতজ্ঞতা ও সংযম-এই দুটি মানবিক গুণ হারাতে বসেছি। অপচয় রোধে আধুনিক প্রযুক্তি যেমন প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন সচেতনতা ও মূল্যবোধের নবজাগরণ। সরকার ও বেসরকারি খাতের পাশাপাশি নাগরিক সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। কৃষিপণ্যের সংগ্রহ, সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিপণনে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এবং কৃষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণই পারে পরিস্থিতি পাল্টাতে।
আজ আমরা যখন অর্ধেক খাওয়া খাবার বিনা দ্বিধায় ফেলে দিই, তখন কেবল খাদ্য নয়-ঐশ্বরিক অনুগ্রহও অপচয় করি। মনে রাখা দরকার, প্রতিবেশীর ক্ষুধা আমাদেরই ব্যর্থতা। খাদ্য অপচয় তাই কেবল অর্থনীতি বা পরিবেশের নয়, এক গভীর মানবিক ও ধর্মীয় দায়ও বটে। প্রতিটি দানা খাদ্য কোনো কৃষকের ঘামের প্রতীক।
[লেখক: প্রশিক্ষক, গ্রন্থাগার ও তথ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, বরিশাল]
জুবাইয়া বিন্তে কবির
বৃহস্পতিবার, ২৩ অক্টোবর ২০২৫
জীবন টিকে থাকে খাদ্যের ওপর। মানুষের মৌলিক চাহিদার তালিকায় খাদ্যই সর্বাগ্রে, কারণ অন্নই জীবনের প্রাণস্বর। অথচ বিস্ময়ের বিষয়-আজ পৃথিবীতে খাদ্য উৎপাদনের প্রাচুর্য থাকলেও, কোটি কোটি মানুষ প্রতিদিন ক্ষুধার যন্ত্রণায় কাতর। পৃথিবীতে যত খাদ্য উৎপাদিত হয়, তা দিয়ে বৈশ্বিক জনসংখ্যার দেড়গুণ মানুষকে আহার করানো সম্ভব। তবু আজও প্রায় ৭৮৩ মিলিয়ন মানুষ অভুক্ত, আর বিশ্বের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ ভুগছে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায়। কেন এমন বৈষম্য এর মূল কারণ উৎপাদনের ঘাটতি নয়, বরং অপচয়, অব্যবস্থাপনা ও অসম বণ্টন। পৃথিবীর মোট উৎপাদিত খাদ্যের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ নষ্ট বা অপচয় হয়-যার পরিমাণ দৈনিক ১ বিলিয়ন মিল। বছরে এই ক্ষতির অর্থমূল্য দাঁড়ায় প্রায় ১ ট্রিলিয়ন ডলার। শুধু অর্থ নয়, এর সঙ্গে নষ্ট হয় মূল্যবান জমি, পানি, শ্রম ও শক্তি-নষ্ট হয় মানবতার চেতনা। খাদ্য পচনের ফলে নির্গত গ্রিনহাউস গ্যাসের অংশ প্রায় ১০ শতাংশ; অর্থাৎ, খাদ্য অপচয় কেবল মানবিক নয়, পরিবেশগত বিপর্যয়েরও এক বড় উৎস।
বাংলাদেশের উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়া খাদ্য সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বড় বাধা। পরিকাঠামোগত দুর্বলতা, অপর্যাপ্ত শীতল শৃঙ্খল, অদক্ষ পরিবহন, এবং কৃষিপণ্যের প্রক্রিয়াজাতকরণে অনীহা-সব মিলিয়ে অপচয়ের হার এখানে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য বর্জ্য সূচক প্রতিবেদন ২০২৪ অনুযায়ী, বাংলাদেশে বছরে ১৪ দশমিক ১০ মিলিয়ন টন খাদ্য অপচয় হয়, যা তিন বছর আগের তুলনায় ৩৩ শতাংশ বেশি। জনপ্রতি অপচয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮২ কেজি, যা যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র বা চীনের চেয়েও বেশি। প্রতি বছর দেশে উৎপাদিত কৃষিপণ্যের প্রায় এক-তৃতীয়াংশই বাজারে পৌঁছাতে পারে না। ফলে জিডিপির ৪ শতাংশ সমমূল্যের ক্ষতি হয় কৃষক ও জাতীয় অর্থনীতিতে। অথচ এই অপচয় রোধ করা গেলে বাংলাদেশের মানুষকে অনায়াসে চার মাস পর্যন্ত খাওয়ানো যেত-এ এক নির্মম পরিহাস।
স্বাধীনতার পর আমাদের কৃষিক্ষেত্রে যে বিপ্লব ঘটেছে, তা নিঃসন্দেহে আশাব্যঞ্জক। ১৯৭২-৭৩ সালে দেশের খাদ্যশস্য উৎপাদন ছিল ১ কোটি ১০ লাখ টন; এখন তা বেড়ে ৫ কোটি টনেরও বেশি। কিন্তু উৎপাদনের এই সাফল্যের সাথেও পাল্লা দিয়েছে অপচয়ের দুঃসহ বাস্তবতা। কারণ উৎপাদন থেকে ভোক্তা পর্যায় পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে ক্ষতির ছায়া ঘনিয়ে থাকে-কখনো ফসলে পোকামাকড়ের আক্রমণ, কখনো সঠিক সময়ে সংগ্রহ না করা, কখনো পরিবহনে নষ্ট হওয়া। ফলমূল, সবজি, দুধ ও মাছের ক্ষেত্রে অপচয়ের হার সর্বাধিক। এক গবেষণায় দেখা গেছে-ধানের ক্ষেত্রে ২৩ শতাংশ, গমে ১৭, মসুরে ২৭, কলায় ২০, আলুতে ২২, পেঁয়াজে ৩০, মাছের ক্ষেত্রে ৩৬ শতাংশ পর্যন্ত খাদ্য নষ্ট হয়। অথচ এসব পণ্যই আমাদের জনগণের প্রতিদিনের আহারের অপরিহার্য অংশ।
শহরে বিয়েবাড়ি, রেস্টুরেন্ট কিংবা সামাজিক অনুষ্ঠানে যে পরিমাণ খাদ্য অব্যবহৃত অবস্থায় ময়লার ভাগাড়ে ফেলা হয়, তা সত্যিই বেদনাদায়ক। অন্যদিকে গ্রামের দরিদ্র পরিবারগুলো দুই বেলা আহার জোগাতে হিমশিম খায়। এই বৈপরীত্য কেবল অর্থনীতির নয়, আমাদের বিবেকেরও প্রশ্ন তোলে। একসময় আমাদের গ্রামীণ সমাজে অপচয় ছিল লজ্জার বিষয়। অগ্রহায়ণ মাসে ফসল কাটার পর মাঠে ছিটকে থাকা ধান শিশুরা কুড়িয়ে আনত, গৃহিণীরা প্রতিটি দানা সযত্নে তুলত। আজ সেই সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে। আধুনিকতার ছোঁয়ায় আমরা যেন কৃতজ্ঞতা ও সংযম-এই দুটি মানবিক গুণ হারাতে বসেছি। অপচয় রোধে আধুনিক প্রযুক্তি যেমন প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন সচেতনতা ও মূল্যবোধের নবজাগরণ। সরকার ও বেসরকারি খাতের পাশাপাশি নাগরিক সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। কৃষিপণ্যের সংগ্রহ, সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিপণনে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এবং কৃষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণই পারে পরিস্থিতি পাল্টাতে।
আজ আমরা যখন অর্ধেক খাওয়া খাবার বিনা দ্বিধায় ফেলে দিই, তখন কেবল খাদ্য নয়-ঐশ্বরিক অনুগ্রহও অপচয় করি। মনে রাখা দরকার, প্রতিবেশীর ক্ষুধা আমাদেরই ব্যর্থতা। খাদ্য অপচয় তাই কেবল অর্থনীতি বা পরিবেশের নয়, এক গভীর মানবিক ও ধর্মীয় দায়ও বটে। প্রতিটি দানা খাদ্য কোনো কৃষকের ঘামের প্রতীক।
[লেখক: প্রশিক্ষক, গ্রন্থাগার ও তথ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, বরিশাল]