alt

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

বৈষম্য, অপচয় ও খাদ্যনিরাপত্তার সংকট

মিহির কুমার রায়

: বৃহস্পতিবার, ২০ নভেম্বর ২০২৫

ক্ষুধা কোনো অনিবার্য প্রাকৃতিক অবস্থা নয়; এটি সরকার ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সেইসব সিদ্ধান্তের ফল, যেখানে বৈষম্যের প্রতি চোখ ফেরানোকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। যে বৈশ্বিক ব্যবস্থা ৬৭৩ মিলিয়ন মানুষের পর্যাপ্ত খাদ্যের অধিকার অস্বীকার করে, সেই একই ব্যবস্থা মাত্র ৩ হাজার বিলিয়নিয়ারকে বৈশ্বিক মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১৪.৬ শতাংশ সম্পদের মালিকানা ধরে রাখতে সক্ষম করে। এই চরম বৈষম্য দেখিয়ে দেয়-মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণে সম্পদের ঘাটতি নেই; ঘাটতি রয়েছে সুষ্ঠু বণ্টন, ন্যায়সঙ্গত ব্যবস্থাপনা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার।

অপচয় রোধে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার যেমন জরুরি, তেমনি জরুরি নাগরিক সচেতনতা ও মূল্যবোধের পুনর্জাগরণ। কৃষিপণ্যের সংগ্রহ, সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিপণনে প্রযুক্তির ব্যবহার এবং কৃষকদের প্রশিক্ষণই পারে পরিস্থিতি বদলাতে। আমরা যখন অর্ধেক খাওয়া খাবার অবহেলায় ফেলে দিই, তখন কেবল খাদ্য নয়-ঐশ্বরিক অনুগ্রহও অপচয় করি। মনে রাখা দরকার, প্রতিবেশীর ক্ষুধা আমাদেরই ব্যর্থতা

জীবন টিকে থাকে খাদ্যের ওপর। মানুষের মৌলিক চাহিদার তালিকায় খাদ্যই সর্বাগ্রে, কারণ অন্নই জীবনের প্রাণশ্বর। অথচ বিস্ময়ের বিষয়-পৃথিবীতে খাদ্য উৎপাদনের প্রাচুর্য থাকা সত্ত্বেও কোটি কোটি মানুষ প্রতিদিন ক্ষুধার যন্ত্রণায় কাতর। পৃথিবীতে যত খাদ্য উৎপাদিত হয়, তা দিয়ে বৈশ্বিক জনসংখ্যার দেড় গুণ মানুষকে আহার করানো সম্ভব। তবু প্রায় ৭৮৩ মিলিয়ন মানুষ আজও অভুক্ত, আর বিশ্বের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ ভুগছে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায়। এর মূল কারণ উৎপাদনের ঘাটতি নয়; বরং অপচয়, অব্যবস্থাপনা ও অসম বণ্টন।

বিশ্বে উৎপাদিত খাদ্যের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ নষ্ট বা অপচয় হয়-যার পরিমাণ দৈনিক প্রায় ১ বিলিয়ন মিল। বছরে এই ক্ষতির আর্থিক মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ১ ট্রিলিয়ন ডলার। শুধু অর্থ নয়, এর সঙ্গে নষ্ট হয় জমি, পানি, শ্রম, শক্তি-নষ্ট হয় মানবতার চেতনা। খাদ্য পচন থেকে উৎপন্ন গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের হারও প্রায় ১০ শতাংশ। ব্রাজিল তার জি-২০ সভাপতিত্বের সময় ক্ষুধা ও দারিদ্রতা যার বিরুদ্ধে ‘গ্লোবাল অ্যালায়েন্স অ্যাগেইনস্ট হাংগার অ্যান্ড প্রোভার্টি’ প্রস্তাব করে। উদ্যোগটিতে ইতোমধ্যে ১০৩টি দেশসহ ২০০ সদস্য রয়েছে। এটি কেবল অভিজ্ঞতা বিনিময়ের প্ল্যাটফর্ম নয়; বরং সম্পদ একত্রিত করা, প্রতিশ্রুতি সুরক্ষিত করা এবং রাষ্ট্রগুলোকে বৈষম্য হ্রাসে কার্যকর নীতি বাস্তবায়নে সহায়তা করাই এর লক্ষ্য।

ব্রাজিলের অভিজ্ঞতা আরও গুরুত্বপূর্ণ। দেশটি যখন ২০২৩ সালে ক্ষুধার বিরুদ্ধে লড়াইকে সরকারি অগ্রাধিকার দেয়, দ্রুত ফল পাওয়া যায়। কিন্তু বাংলাদেশসহ বহু দেশ এখনো খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার তীব্র চাপের মধ্যে রয়েছে। গ্লোবাল রিপোর্ট অন ফুড ক্রাইসিস (জিআরএফসি) অনুযায়ী, ২০১৬-২০২৪ সাল পর্যন্ত যেসব দেশ তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার উচ্চস্তরে ছিল, সেখানে বাংলাদেশ ছিল তৃতীয় অবস্থানে-নাইজেরিয়া, সুদান ও কঙ্গোর পরেই।

বাংলাদেশের প্রায় চার কোটি মানুষ বহুমাত্রিক দারিদ্র র মধ্যে বসবাস করে। গ্রামে এই হার শহরের তুলনায় দ্বিগুণ। প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় শিশুদের দারিদ্রতা বেশি উদ্বেগজনক। বর্তমানে দেশের প্রায় ৩১ শতাংশ মানুষ খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে এবং ৬৩ শতাংশ মানুষ প্রয়োজনীয় পুষ্টিমানসমৃদ্ধ খাবার পায় না। দারিদ্রতা, ক্ষুধা ও বৈষম্য তাই আরও প্রকট হয়ে উঠছে। এর অন্যতম কারণ খাদ্যপণ্যের অপচয়। বাংলাদেশ খাদ্য অপচয়ের ক্ষেত্রে এশিয়ার শীর্ষ ৫ দেশের একটি-বছরে উৎপাদিত খাদ্যের প্রায় ৩৪ শতাংশ নষ্ট হয়ে যায়।

ইউএনইপির ‘ফুড ওয়েস্ট ইনডেক্স ২০২৪’ ও জিআরএফসি-২০২৫ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বাংলাদেশে একটি পরিবার বছরে গড়ে ৮২ কেজি খাদ্য অপচয় করে। এ তালিকায় শীর্ষে রয়েছে মালদ্বীপ (২০৭ কেজি), এরপর পাকিস্তান (১৩০), আফগানিস্তান (১২৭), নেপাল (৯৩) ইত্যাদি।

বিশ্ব খাদ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের প্রধান খাদ্য চাল-এটির পোস্টহার্ভেস্ট পর্যায়ে ধান নষ্ট হয় ১৭.৮০ শতাংশ। ফসল কাটার পরপরই কৃষক, মধ্যস্বত্বভোগী ও মিলার পর্যায়ে অপচয় বেশি হয়। ফল-শাকসবজির অপচয়ের হার আরও বেশি-১৭ থেকে ৩২ শতাংশ পর্যন্ত। দুধ, মাংস, মাছ-সবখানেই অপচয় উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে।

ধনী পরিবারে অপচয়ের হার বেশি, আর দরিদ্র পরিবারে কম-এটিও গবেষণায় উঠে এসেছে। উচ্চ আয়ের পরিবারের সদস্যরা প্রতি বছর ২৬ থেকে ১০৪ কেজি খাদ্য অপচয় করে।

একসময় গ্রামীণ সমাজে খাদ্য অপচয় লজ্জার বিষয় ছিল। অগ্রহায়ণে ফসল কাটার পর মাঠে ছিটকে থাকা ধান শিশুরা কুড়িয়ে আনত; গৃহিণীরা প্রতিটি দানা সযত্নে তুলত। আজ সেই সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে। আধুনিকতার ছোঁয়ায় কৃতজ্ঞতা ও সংযম-এই দুই মানবিক গুণ যেন ক্ষয়ে যাচ্ছে।

অপচয় রোধে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার যেমন জরুরি, তেমনি জরুরি নাগরিক সচেতনতা ও মূল্যবোধের পুনর্জাগরণ। কৃষিপণ্যের সংগ্রহ, সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিপণনে প্রযুক্তির ব্যবহার এবং কৃষকদের প্রশিক্ষণই পারে পরিস্থিতি বদলাতে। আমরা যখন অর্ধেক খাওয়া খাবার অবহেলায় ফেলে দিই, তখন কেবল খাদ্য নয়-ঐশ্বরিক অনুগ্রহও অপচয় করি। মনে রাখা দরকার, প্রতিবেশীর ক্ষুধা আমাদেরই ব্যর্থতা।

খাদ্য অপচয় তাই কেবল অর্থনীতি বা পরিবেশের সমস্যা নয়; এটি গভীর মানবিক ও নৈতিক দায়। প্রতিটি দানা খাদ্য কৃষকের ঘামের প্রতীক। এর লাগাম টানা জরুরি-নচেত খাদ্যনিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে, আর্থিক ক্ষতি বাড়বে, পরিবেশের ওপর বাড়বে বিরূপ প্রভাব।

এ অবস্থায় খাদ্য অপচয় ও ক্ষতি রোধে সরকার, বেসরকারি খাত ও নাগরিক সমাজের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, সংরক্ষণ ও পরিবহনব্যবস্থায় আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ, কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমেই এই সংকট উত্তরণের পথ তৈরি হতে পারে।

[লেখক: সাবেক ডিন (ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ) ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা]

আমন ধানে ব্রাউন প্ল্যান্টহপারের প্রাদুর্ভাব

“বাঙালি আমরা, নহিতো...”

নারী নির্যাতন, মানসিক স্বাস্থ্য এবং সমাজের দায়

কাঁপছে ডলারের সিংহাসন

ত্রিশতম জলবায়ু সম্মেলন : প্রতীকী প্রদর্শনী, নাকি বৈশ্বিক জলবায়ু রাজনীতির বাঁক নেওয়ার মুহূর্ত?

অপরিণত নবজাতক : ঝুঁকি, প্রতিরোধ ও যত্নের জরুরি বাস্তবতা

বাংলাদেশী উত্তরাধিকার: প্রবাস-জীবন ও আমাদের সংস্কৃতি

রাজনীতিতে ভাষার সহনীয় প্রয়োগ

ভারত : এসআইআর এবং সাম্প্রদায়িক বিভাজন

মনে কী দ্বিধা নিয়ে...

নিরাপদ সড়ক ভাবনা

অপরিকল্পিত বাঁধ-শিল্পায়নে বিপর্যস্ত বরেন্দ্র কৃষি

ছবি

মামদানি দেখালেন নেতৃত্বের মূল পরিচয় কী

চেকের মামলায় বৈধ বিনিময়, লেনদেন, দেনা-পাওনা প্রমাণ ছাড়া আর জেল নয়

নবাগত শিক্ষকদের পেশাগত ভাবনা

মাদকাসক্তি: শুধু নিরাময় নয়, চাই সমাজ ব্যবস্থার সংস্কার

আমেরিকার “নো কিংস” আন্দোলন

ঘি তো আমাদের লাগবেই, নো হাংকি পাংকি!

“মামদানি না জামদানি...”

ভাষার বৈচিত্র্য রক্ষায় নীরব বিপ্লব

উপাত্ত সুরক্ষা আইন : গোপনীয়তা রক্ষা নাকি রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ?

সমতা কি ন্যায্যতা নিশ্চিত করে?

ডেঙ্গু সংকট দূরদৃষ্টির ব্যর্থতা

ষাটের দশকে বামপন্থী ভাবনার উত্থান ও বিবর্তন

দেখিতে পাও না তুমি মৃত্যুদূত দাঁড়ায়েছে দ্বারে!

বায়ুর অপর নাম জীবন

ছবি

হাওরের জীবন ও সংস্কৃতি

বিখণ্ডিত আত্মপরিচয়: তরল সহানুভূতিতে নৈতিক মূলধনের সমাজতত্ত্ব

প্রভাষকের ‘প্রভা’ যখন ‘শোক’: শিক্ষা ক্যাডারে পদোন্নতি বঞ্চনা

যুদ্ধ বিরতি গাজাবাসীর জন্য জরুরি ছিল

লবলং খালের মৃত্যু: স্মৃতিতে নদী, বাস্তবে দূষণ

বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা: অর্থনৈতিক স্থিতির পূর্বশর্ত

হায় যম! আর কতক্ষণ, হবে অপেক্ষা করিতে মোরে?

পোশাক শিল্প : অগ্রগতি ও শ্রমিকের অধিকার

গণভোটের রাজনৈতিক গুরুত্ব

বামঘরানার বাটখারা...

tab

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

বৈষম্য, অপচয় ও খাদ্যনিরাপত্তার সংকট

মিহির কুমার রায়

বৃহস্পতিবার, ২০ নভেম্বর ২০২৫

ক্ষুধা কোনো অনিবার্য প্রাকৃতিক অবস্থা নয়; এটি সরকার ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সেইসব সিদ্ধান্তের ফল, যেখানে বৈষম্যের প্রতি চোখ ফেরানোকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। যে বৈশ্বিক ব্যবস্থা ৬৭৩ মিলিয়ন মানুষের পর্যাপ্ত খাদ্যের অধিকার অস্বীকার করে, সেই একই ব্যবস্থা মাত্র ৩ হাজার বিলিয়নিয়ারকে বৈশ্বিক মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১৪.৬ শতাংশ সম্পদের মালিকানা ধরে রাখতে সক্ষম করে। এই চরম বৈষম্য দেখিয়ে দেয়-মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণে সম্পদের ঘাটতি নেই; ঘাটতি রয়েছে সুষ্ঠু বণ্টন, ন্যায়সঙ্গত ব্যবস্থাপনা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার।

অপচয় রোধে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার যেমন জরুরি, তেমনি জরুরি নাগরিক সচেতনতা ও মূল্যবোধের পুনর্জাগরণ। কৃষিপণ্যের সংগ্রহ, সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিপণনে প্রযুক্তির ব্যবহার এবং কৃষকদের প্রশিক্ষণই পারে পরিস্থিতি বদলাতে। আমরা যখন অর্ধেক খাওয়া খাবার অবহেলায় ফেলে দিই, তখন কেবল খাদ্য নয়-ঐশ্বরিক অনুগ্রহও অপচয় করি। মনে রাখা দরকার, প্রতিবেশীর ক্ষুধা আমাদেরই ব্যর্থতা

জীবন টিকে থাকে খাদ্যের ওপর। মানুষের মৌলিক চাহিদার তালিকায় খাদ্যই সর্বাগ্রে, কারণ অন্নই জীবনের প্রাণশ্বর। অথচ বিস্ময়ের বিষয়-পৃথিবীতে খাদ্য উৎপাদনের প্রাচুর্য থাকা সত্ত্বেও কোটি কোটি মানুষ প্রতিদিন ক্ষুধার যন্ত্রণায় কাতর। পৃথিবীতে যত খাদ্য উৎপাদিত হয়, তা দিয়ে বৈশ্বিক জনসংখ্যার দেড় গুণ মানুষকে আহার করানো সম্ভব। তবু প্রায় ৭৮৩ মিলিয়ন মানুষ আজও অভুক্ত, আর বিশ্বের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ ভুগছে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায়। এর মূল কারণ উৎপাদনের ঘাটতি নয়; বরং অপচয়, অব্যবস্থাপনা ও অসম বণ্টন।

বিশ্বে উৎপাদিত খাদ্যের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ নষ্ট বা অপচয় হয়-যার পরিমাণ দৈনিক প্রায় ১ বিলিয়ন মিল। বছরে এই ক্ষতির আর্থিক মূল্য দাঁড়ায় প্রায় ১ ট্রিলিয়ন ডলার। শুধু অর্থ নয়, এর সঙ্গে নষ্ট হয় জমি, পানি, শ্রম, শক্তি-নষ্ট হয় মানবতার চেতনা। খাদ্য পচন থেকে উৎপন্ন গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের হারও প্রায় ১০ শতাংশ। ব্রাজিল তার জি-২০ সভাপতিত্বের সময় ক্ষুধা ও দারিদ্রতা যার বিরুদ্ধে ‘গ্লোবাল অ্যালায়েন্স অ্যাগেইনস্ট হাংগার অ্যান্ড প্রোভার্টি’ প্রস্তাব করে। উদ্যোগটিতে ইতোমধ্যে ১০৩টি দেশসহ ২০০ সদস্য রয়েছে। এটি কেবল অভিজ্ঞতা বিনিময়ের প্ল্যাটফর্ম নয়; বরং সম্পদ একত্রিত করা, প্রতিশ্রুতি সুরক্ষিত করা এবং রাষ্ট্রগুলোকে বৈষম্য হ্রাসে কার্যকর নীতি বাস্তবায়নে সহায়তা করাই এর লক্ষ্য।

ব্রাজিলের অভিজ্ঞতা আরও গুরুত্বপূর্ণ। দেশটি যখন ২০২৩ সালে ক্ষুধার বিরুদ্ধে লড়াইকে সরকারি অগ্রাধিকার দেয়, দ্রুত ফল পাওয়া যায়। কিন্তু বাংলাদেশসহ বহু দেশ এখনো খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার তীব্র চাপের মধ্যে রয়েছে। গ্লোবাল রিপোর্ট অন ফুড ক্রাইসিস (জিআরএফসি) অনুযায়ী, ২০১৬-২০২৪ সাল পর্যন্ত যেসব দেশ তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার উচ্চস্তরে ছিল, সেখানে বাংলাদেশ ছিল তৃতীয় অবস্থানে-নাইজেরিয়া, সুদান ও কঙ্গোর পরেই।

বাংলাদেশের প্রায় চার কোটি মানুষ বহুমাত্রিক দারিদ্র র মধ্যে বসবাস করে। গ্রামে এই হার শহরের তুলনায় দ্বিগুণ। প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় শিশুদের দারিদ্রতা বেশি উদ্বেগজনক। বর্তমানে দেশের প্রায় ৩১ শতাংশ মানুষ খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে এবং ৬৩ শতাংশ মানুষ প্রয়োজনীয় পুষ্টিমানসমৃদ্ধ খাবার পায় না। দারিদ্রতা, ক্ষুধা ও বৈষম্য তাই আরও প্রকট হয়ে উঠছে। এর অন্যতম কারণ খাদ্যপণ্যের অপচয়। বাংলাদেশ খাদ্য অপচয়ের ক্ষেত্রে এশিয়ার শীর্ষ ৫ দেশের একটি-বছরে উৎপাদিত খাদ্যের প্রায় ৩৪ শতাংশ নষ্ট হয়ে যায়।

ইউএনইপির ‘ফুড ওয়েস্ট ইনডেক্স ২০২৪’ ও জিআরএফসি-২০২৫ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বাংলাদেশে একটি পরিবার বছরে গড়ে ৮২ কেজি খাদ্য অপচয় করে। এ তালিকায় শীর্ষে রয়েছে মালদ্বীপ (২০৭ কেজি), এরপর পাকিস্তান (১৩০), আফগানিস্তান (১২৭), নেপাল (৯৩) ইত্যাদি।

বিশ্ব খাদ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের প্রধান খাদ্য চাল-এটির পোস্টহার্ভেস্ট পর্যায়ে ধান নষ্ট হয় ১৭.৮০ শতাংশ। ফসল কাটার পরপরই কৃষক, মধ্যস্বত্বভোগী ও মিলার পর্যায়ে অপচয় বেশি হয়। ফল-শাকসবজির অপচয়ের হার আরও বেশি-১৭ থেকে ৩২ শতাংশ পর্যন্ত। দুধ, মাংস, মাছ-সবখানেই অপচয় উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে।

ধনী পরিবারে অপচয়ের হার বেশি, আর দরিদ্র পরিবারে কম-এটিও গবেষণায় উঠে এসেছে। উচ্চ আয়ের পরিবারের সদস্যরা প্রতি বছর ২৬ থেকে ১০৪ কেজি খাদ্য অপচয় করে।

একসময় গ্রামীণ সমাজে খাদ্য অপচয় লজ্জার বিষয় ছিল। অগ্রহায়ণে ফসল কাটার পর মাঠে ছিটকে থাকা ধান শিশুরা কুড়িয়ে আনত; গৃহিণীরা প্রতিটি দানা সযত্নে তুলত। আজ সেই সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে। আধুনিকতার ছোঁয়ায় কৃতজ্ঞতা ও সংযম-এই দুই মানবিক গুণ যেন ক্ষয়ে যাচ্ছে।

অপচয় রোধে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার যেমন জরুরি, তেমনি জরুরি নাগরিক সচেতনতা ও মূল্যবোধের পুনর্জাগরণ। কৃষিপণ্যের সংগ্রহ, সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিপণনে প্রযুক্তির ব্যবহার এবং কৃষকদের প্রশিক্ষণই পারে পরিস্থিতি বদলাতে। আমরা যখন অর্ধেক খাওয়া খাবার অবহেলায় ফেলে দিই, তখন কেবল খাদ্য নয়-ঐশ্বরিক অনুগ্রহও অপচয় করি। মনে রাখা দরকার, প্রতিবেশীর ক্ষুধা আমাদেরই ব্যর্থতা।

খাদ্য অপচয় তাই কেবল অর্থনীতি বা পরিবেশের সমস্যা নয়; এটি গভীর মানবিক ও নৈতিক দায়। প্রতিটি দানা খাদ্য কৃষকের ঘামের প্রতীক। এর লাগাম টানা জরুরি-নচেত খাদ্যনিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে, আর্থিক ক্ষতি বাড়বে, পরিবেশের ওপর বাড়বে বিরূপ প্রভাব।

এ অবস্থায় খাদ্য অপচয় ও ক্ষতি রোধে সরকার, বেসরকারি খাত ও নাগরিক সমাজের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, সংরক্ষণ ও পরিবহনব্যবস্থায় আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ, কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমেই এই সংকট উত্তরণের পথ তৈরি হতে পারে।

[লেখক: সাবেক ডিন (ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ) ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা]

back to top