মাহফুজ আলম
ব্রাউন প্ল্যান্টহপার দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সেচনির্ভর ও বৃষ্টিনির্ভর ধান উৎপাদন ব্যবস্থার অন্যতম বিধ্বংসী কীট হিসেবে পুনরায় আবির্ভূত হয়েছে। বাংলাদেশে আমন মৌসুমে এ কীটের বারবার প্রাদুর্ভাব ক্রমেই উদ্বেগজনক রূপ নিচ্ছে, এবং ২০২৫ সালও এর ব্যতিক্রম নয়। উচ্চ আর্দ্রতা, দীর্ঘস্থায়ী মেঘাচ্ছন্ন আবহাওয়া, বিলম্বিত বর্ষা সমাপনী এবং অতিরিক্ত নাইট্রোজেন সার প্রয়োগ ব্রাউন প্ল্যান্টহপারের সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। ফ্লোয়েম-রস শোষণকারী কীট হিসেবে বিপিএইচ সরাসরি ক্ষতি করে গাছের রস শোষণের মাধ্যমে, যার ফলে হপারবার্ন দেখা দেয়।
এসব সম্মিলিত ক্ষতি জাতীয় ধান উৎপাদনের স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলছে-এক সময়ে যখন খাদ্য নিরাপত্তার চাপ ক্রমাগত বাড়ছে। ২০২৫ সালের আমন মৌসুমে হাওর অঞ্চল, মধ্যাঞ্চলীয় সমতলভূমি এবং উপকূলীয় এলাকার কিছু অংশসহ দেশের প্রধান ধান উৎপাদন অঞ্চলে অস্বাভাবিক মাত্রার ব্রাউন প্ল্যান্টহপার আক্রমণ রেকর্ড করা হয়েছে। ক্ষুদ্র কৃষকেরা, যারা আমন ধানের ওপর খাদ্য ও আয়ের প্রধান উৎস হিসেবে নির্ভরশীল, সবচেয়ে
পরিচিতি:
ব্রাউন প্ল্যান্ট হপার একটি মারাত্মক ক্ষতিকর পোকা যা ধান উৎপাদনে ব্যাপক ক্ষতি করে। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার গ্রীষ্মম-লীয় অঞ্চলে, বিশেষত বাংলাদেশ, ভারত, চীন, থাইল্যান্ড এবং ফিলিপাইনে এটি ধানের অন্যতম প্রধান শত্রু হিসেবে বিবেচিত। ধান এ অঞ্চলের প্রধান খাদ্যশস্য হওয়ায় এর আক্রমণ খাদ্য উৎপাদনে গুরুতর হুমকি সৃষ্টি করে এবং ফসলের ক্ষতির কারণে খাদ্য নিরাপত্তায় সংকট দেখা দিতে পারে।
জীবনচক্র:
ব্রাউন প্ল্যান্ট হপার ছোট আকারের বাদামী রঙের একটি পোকা। পূর্ণবয়স্ক অবস্থায় এদের দেহের দৈর্ঘ্য প্রায় ৩-৪ মিমি এবং এরা সাধারণত ডানাওয়ালা বা নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে ডানাবিহীন হতে পারে। এদের জীবনচক্রের তিনটি প্রধান ধাপ রয়েছে: ডিম, নিম্ফ এবং পূর্ণবয়স্ক। একবারে একটি পূর্ণবয়স্ক মাদি পোকা ২০০ থেকে ৩০০টি ডিম পাড়তে সক্ষম, যা গাছের কা- বা পাতার নিচে পাতা হয়। ডিম ফুটে নিম্ফ বের হয় এবং তারা ধান গাছে বসবাস করে। নিম্ফ অবস্থা থেকে পূর্ণবয়স্ক অবস্থায় পরিণত হতে প্রায় ২-৩ সপ্তাহ সময় লাগে এবং প্রতিকূল আবহাওয়া এবং খাদ্যের প্রাচুর্যের কারণে এরা দ্রুত বংশবৃদ্ধি করতে পারে।
এর আক্রমণ ও ক্ষতির প্রকৃতি:
১. রস শোষণ এবং পুষ্টি হ্রাস: এই পোকার নিম্ফ ও প্রাপ্তবয়স্ক পোকা তাদের স্টাইলেট ধান গাছের শিরা কলায় প্রবেশ করিয়ে রস শোষণ করে, যা গাছের গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান হ্রাস করে। নিয়মিত রস শোষণের ফলে গাছ দুর্বল হয়ে পড়ে এবং স্বালোকসংশ্লেষণের মতো মৌলিক কার্যক্রম সঠিকভাবে সম্পাদন করতে অক্ষম হয়। এর ফলে গাছের পানি ও পুষ্টি ধারণ ক্ষমতা হ্রাস পায়, গাছ দুর্বল হয়ে পড়ে এবং শুকিয়ে যায়। এই অবস্থাকে ্য়ঁড়ঃ;হপার বার্ন্য়ঁড়ঃ; বলা হয়, যা ধানের পুরো ক্ষেতকে শুকিয়ে ফেলতে পারে।
২. ভাইরাস সংক্রমণ: ব্রাউন প্ল্যান্ট হপার গ্রাসি স্টান্ট ভাইরাস এবং র্যাগড স্টান্ট ভাইরাসের বাহক হিসেবে কাজ করে। এটি ধানের গ্রাসি স্টান্ট ভাইরাস এবং র্যাগড স্টান্ট ভাইরাস রোগ ছড়ায়, যা গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত করে।
৩. ফসলের ক্ষতি ও আর্থিক ক্ষতি: ব্রাউন প্ল্যান্ট হপার-এর মারাত্মক আক্রমণ কুশি থেকে শিষ গঠনের পর্যায়ে ফসলের উৎপাদনশীলতা ৮০-১০০% পর্যন্ত কমাতে পারে। এটি বিশেষত বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে আমন ধান প্রধান খাদ্যশস্য এবং বাৎসরিক ধান উৎপাদনের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। বাংলাদেশে ডঊডঈএইচ এর প্রাদুর্ভাব ধান উৎপাদনে ভয়াবহ ক্ষতি সৃষ্টি করতে পারে, যা কৃষকদের আয়কে সরাসরি প্রভাবিত করে এবং দেশের খাদ্য সংকটের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। ২০২৪ সালে এর কারণে উৎপাদনশীলতার এই হ্রাস লক্ষ ডলারের অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ হতে পারে, যা বিশেষত ছোট কৃষকদের।
৪। জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকি: ধান বাংলাদেশের প্রধান খাদ্যশস্য এবং এই পোকার কারণে ব্যাপক ফসলহানি জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকি স্বরূপ। ২০২৪ সালে এর প্রাদুর্ভাব তীব্র হওয়ায় ধানের সরবরাহ হ্রাস পাওয়ায় দাম বৃদ্ধি পেতে পারে, যা নিম্ন আয়ের ভোক্তাদের জন্য ক্রয়ক্ষমতাকে প্রভাবিত করতে পারে। পাশাপাশি, এর প্রাদুর্ভাব খাদ্য সরবরাহে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে, যা বাংলাদেশের আমদানিকৃত ধানের উপর নির্ভরশীলতা বাড়িয়ে তোলে।
দমন ব্যবস্থাপনা
১. মনিটরিং
এই পোকার প্রাথমিক সনাক্তকরণ এবং ফসলের ক্ষতি কমানোর জন্য নিয়মিত পর্যবেক্ষণ অত্যন্ত জরুরি। বীজতলা বা মাঠে প্রতিদিন বা সাপ্তাহিক পর্যবেক্ষণ এবং কান্ড ও পানির পৃষ্ঠ পরিদর্শন করার পরামর্শ দেওয়া হয়। পুরোনো গাছগুলিকে টোকা দেওয়ার মতো বিভিন্ন পদ্ধতি সনাক্তকরণে সহায়ক। দুধ আসা পর্যন্ত ফসলের জন্য ডঊডঈএইচ বা হোয়াইট-ব্যাকড প্ল্যান্ট হপার অনুসন্ধান করতে হবে।
২. পরিচর্যা
শস্যাবর্তন: ধান চাষের পরিবর্তে কিছু সময় অন্য ফসল চাষ করা যেতে পারে, যা ব্রাউন প্ল্যান্ট হপার এর বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত করে।
ক্ষেত পরিচ্ছন্ন রাখা: ক্ষেতের আগাছা নিয়মিত পরিষ্কার করা প্রয়োজন যাতে ব্রাউন প্ল্যান্ট হপারের আবাসস্থল কমে যায়।
৩. যান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ
হ্যান্ড পিকিং: ছোট পরিসরে হপার গুলোকে হাত দিয়ে তুলে ধরা বা ধ্বংস করা সম্ভব।
আলোক ফাঁদ: আক্রমণ প্রাথমিক পর্যায়ে থাকলে আলোক ফাঁদ স্থাপন করে পোকা আকৃষ্ট করা এবং ধ্বংস করা সম্ভব।
৪. জৈবিক নিয়ন্ত্রণ
প্রাকৃতিক শত্রুদের ব্যবহার: ব্রাউন প্ল্যান্ট হপার এর প্রাকৃতিক শত্রু যেমন মিরিড বাগ, মাকড়সা এবং ডিম প্যারাসিটয়েড ইত্যাদি ধান ক্ষেতে ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে, যারা হপার খেয়ে ফেলতে সক্ষম।
ছত্রাক: ছত্রাক যেমন বিউভেরিয়া ব্যাসিয়ানা এবং মেটারিজিয়াম অ্যানিসোপিলিয়ে ব্যবহার করে হপার নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে।
৪. রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণ
কীটনাশক ব্যবহার: ক্ষেত্রবিশেষে অনুমোদিত কীটনাশক (ডাইমেথোয়েট ৬০ইসি ১ লিটার/হেক্টর, ডায়াজিনন ৬০ইসি ১ লিটার/হেক্টর, ইমামেকটিন বেনজয়েট ৫এসজি ১ কেজি/হেক্টর) প্রয়োগ করে ব্রাউন প্ল্যান্ট হপার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। তবে কীটনাশক ব্যবহারের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে, যেন পরিবেশ ও অন্যান্য উপকারী প্রাণীর উপর নেতিবাচক প্রভাব না ফেলে।
৫. সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা
এটি একটি সামগ্রিক পদ্ধতি যেখানে পরিচর্যা, যান্ত্রিক, জৈবিক ও রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির সংমিশ্রণ ব্যবহার করা হয়। এই পদ্ধতিতে ধান ক্ষেতের পরিবেশ উপযোগী করে তোলা হয়, যাতে ব্রাউন প্ল্যান্ট হপার সহ অন্যান্য ক্ষতিকর পোকামাকড়ের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে থাকে।
উপসংহার
২০২৫ সালের পোকার আক্রমণ বাংলাদেশের নিবিড়ভাবে আবাদ হওয়া এলাকাগুলোতে ফলন ক্ষতি ছিল অত্যন্ত মারাত্মক, যা অধিক স্থিতিশীল উৎপাদন পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তাকে আরও জোরালো করে। টেকসই প্রশমনের মূল ভিত্তি হলো রোগ-পোকার সহনশীল জাতের ব্যবহার, সুষম পুষ্টি ব্যবস্থাপনা, প্রাকৃতিক শত্রুর আবাস সংরক্ষণ এবং কীটনাশকের বিচক্ষণ ব্যবহার-যা হপারবার্ন ও পুনরুত্থান প্রতিরোধে সহায়ক। খাদ্য নিরাপত্তা সুরক্ষায় আগাম সতর্কবার্তা ব্যবস্থা, কৃষক প্রশিক্ষণ এবং সমন্বিত জাতীয় প্রতিক্রিয়া ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করা অত্যন্ত জরুরি। ভবিষ্যৎ প্রাদুর্ভাব মোকাবেলায় সক্রিয়, বাস্তুতন্ত্রভিত্তিক ব্যবস্থাপনাই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য প্রতিরক্ষা হিসেবে প্রমাণিত হবে।
লেখক: পরিচালক (জনশক্তি ও প্রশিক্ষণ), বিএআরসি]
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
মাহফুজ আলম
বৃহস্পতিবার, ২০ নভেম্বর ২০২৫
ব্রাউন প্ল্যান্টহপার দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সেচনির্ভর ও বৃষ্টিনির্ভর ধান উৎপাদন ব্যবস্থার অন্যতম বিধ্বংসী কীট হিসেবে পুনরায় আবির্ভূত হয়েছে। বাংলাদেশে আমন মৌসুমে এ কীটের বারবার প্রাদুর্ভাব ক্রমেই উদ্বেগজনক রূপ নিচ্ছে, এবং ২০২৫ সালও এর ব্যতিক্রম নয়। উচ্চ আর্দ্রতা, দীর্ঘস্থায়ী মেঘাচ্ছন্ন আবহাওয়া, বিলম্বিত বর্ষা সমাপনী এবং অতিরিক্ত নাইট্রোজেন সার প্রয়োগ ব্রাউন প্ল্যান্টহপারের সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। ফ্লোয়েম-রস শোষণকারী কীট হিসেবে বিপিএইচ সরাসরি ক্ষতি করে গাছের রস শোষণের মাধ্যমে, যার ফলে হপারবার্ন দেখা দেয়।
এসব সম্মিলিত ক্ষতি জাতীয় ধান উৎপাদনের স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলছে-এক সময়ে যখন খাদ্য নিরাপত্তার চাপ ক্রমাগত বাড়ছে। ২০২৫ সালের আমন মৌসুমে হাওর অঞ্চল, মধ্যাঞ্চলীয় সমতলভূমি এবং উপকূলীয় এলাকার কিছু অংশসহ দেশের প্রধান ধান উৎপাদন অঞ্চলে অস্বাভাবিক মাত্রার ব্রাউন প্ল্যান্টহপার আক্রমণ রেকর্ড করা হয়েছে। ক্ষুদ্র কৃষকেরা, যারা আমন ধানের ওপর খাদ্য ও আয়ের প্রধান উৎস হিসেবে নির্ভরশীল, সবচেয়ে
পরিচিতি:
ব্রাউন প্ল্যান্ট হপার একটি মারাত্মক ক্ষতিকর পোকা যা ধান উৎপাদনে ব্যাপক ক্ষতি করে। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার গ্রীষ্মম-লীয় অঞ্চলে, বিশেষত বাংলাদেশ, ভারত, চীন, থাইল্যান্ড এবং ফিলিপাইনে এটি ধানের অন্যতম প্রধান শত্রু হিসেবে বিবেচিত। ধান এ অঞ্চলের প্রধান খাদ্যশস্য হওয়ায় এর আক্রমণ খাদ্য উৎপাদনে গুরুতর হুমকি সৃষ্টি করে এবং ফসলের ক্ষতির কারণে খাদ্য নিরাপত্তায় সংকট দেখা দিতে পারে।
জীবনচক্র:
ব্রাউন প্ল্যান্ট হপার ছোট আকারের বাদামী রঙের একটি পোকা। পূর্ণবয়স্ক অবস্থায় এদের দেহের দৈর্ঘ্য প্রায় ৩-৪ মিমি এবং এরা সাধারণত ডানাওয়ালা বা নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে ডানাবিহীন হতে পারে। এদের জীবনচক্রের তিনটি প্রধান ধাপ রয়েছে: ডিম, নিম্ফ এবং পূর্ণবয়স্ক। একবারে একটি পূর্ণবয়স্ক মাদি পোকা ২০০ থেকে ৩০০টি ডিম পাড়তে সক্ষম, যা গাছের কা- বা পাতার নিচে পাতা হয়। ডিম ফুটে নিম্ফ বের হয় এবং তারা ধান গাছে বসবাস করে। নিম্ফ অবস্থা থেকে পূর্ণবয়স্ক অবস্থায় পরিণত হতে প্রায় ২-৩ সপ্তাহ সময় লাগে এবং প্রতিকূল আবহাওয়া এবং খাদ্যের প্রাচুর্যের কারণে এরা দ্রুত বংশবৃদ্ধি করতে পারে।
এর আক্রমণ ও ক্ষতির প্রকৃতি:
১. রস শোষণ এবং পুষ্টি হ্রাস: এই পোকার নিম্ফ ও প্রাপ্তবয়স্ক পোকা তাদের স্টাইলেট ধান গাছের শিরা কলায় প্রবেশ করিয়ে রস শোষণ করে, যা গাছের গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান হ্রাস করে। নিয়মিত রস শোষণের ফলে গাছ দুর্বল হয়ে পড়ে এবং স্বালোকসংশ্লেষণের মতো মৌলিক কার্যক্রম সঠিকভাবে সম্পাদন করতে অক্ষম হয়। এর ফলে গাছের পানি ও পুষ্টি ধারণ ক্ষমতা হ্রাস পায়, গাছ দুর্বল হয়ে পড়ে এবং শুকিয়ে যায়। এই অবস্থাকে ্য়ঁড়ঃ;হপার বার্ন্য়ঁড়ঃ; বলা হয়, যা ধানের পুরো ক্ষেতকে শুকিয়ে ফেলতে পারে।
২. ভাইরাস সংক্রমণ: ব্রাউন প্ল্যান্ট হপার গ্রাসি স্টান্ট ভাইরাস এবং র্যাগড স্টান্ট ভাইরাসের বাহক হিসেবে কাজ করে। এটি ধানের গ্রাসি স্টান্ট ভাইরাস এবং র্যাগড স্টান্ট ভাইরাস রোগ ছড়ায়, যা গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত করে।
৩. ফসলের ক্ষতি ও আর্থিক ক্ষতি: ব্রাউন প্ল্যান্ট হপার-এর মারাত্মক আক্রমণ কুশি থেকে শিষ গঠনের পর্যায়ে ফসলের উৎপাদনশীলতা ৮০-১০০% পর্যন্ত কমাতে পারে। এটি বিশেষত বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে আমন ধান প্রধান খাদ্যশস্য এবং বাৎসরিক ধান উৎপাদনের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। বাংলাদেশে ডঊডঈএইচ এর প্রাদুর্ভাব ধান উৎপাদনে ভয়াবহ ক্ষতি সৃষ্টি করতে পারে, যা কৃষকদের আয়কে সরাসরি প্রভাবিত করে এবং দেশের খাদ্য সংকটের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। ২০২৪ সালে এর কারণে উৎপাদনশীলতার এই হ্রাস লক্ষ ডলারের অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ হতে পারে, যা বিশেষত ছোট কৃষকদের।
৪। জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকি: ধান বাংলাদেশের প্রধান খাদ্যশস্য এবং এই পোকার কারণে ব্যাপক ফসলহানি জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকি স্বরূপ। ২০২৪ সালে এর প্রাদুর্ভাব তীব্র হওয়ায় ধানের সরবরাহ হ্রাস পাওয়ায় দাম বৃদ্ধি পেতে পারে, যা নিম্ন আয়ের ভোক্তাদের জন্য ক্রয়ক্ষমতাকে প্রভাবিত করতে পারে। পাশাপাশি, এর প্রাদুর্ভাব খাদ্য সরবরাহে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে, যা বাংলাদেশের আমদানিকৃত ধানের উপর নির্ভরশীলতা বাড়িয়ে তোলে।
দমন ব্যবস্থাপনা
১. মনিটরিং
এই পোকার প্রাথমিক সনাক্তকরণ এবং ফসলের ক্ষতি কমানোর জন্য নিয়মিত পর্যবেক্ষণ অত্যন্ত জরুরি। বীজতলা বা মাঠে প্রতিদিন বা সাপ্তাহিক পর্যবেক্ষণ এবং কান্ড ও পানির পৃষ্ঠ পরিদর্শন করার পরামর্শ দেওয়া হয়। পুরোনো গাছগুলিকে টোকা দেওয়ার মতো বিভিন্ন পদ্ধতি সনাক্তকরণে সহায়ক। দুধ আসা পর্যন্ত ফসলের জন্য ডঊডঈএইচ বা হোয়াইট-ব্যাকড প্ল্যান্ট হপার অনুসন্ধান করতে হবে।
২. পরিচর্যা
শস্যাবর্তন: ধান চাষের পরিবর্তে কিছু সময় অন্য ফসল চাষ করা যেতে পারে, যা ব্রাউন প্ল্যান্ট হপার এর বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত করে।
ক্ষেত পরিচ্ছন্ন রাখা: ক্ষেতের আগাছা নিয়মিত পরিষ্কার করা প্রয়োজন যাতে ব্রাউন প্ল্যান্ট হপারের আবাসস্থল কমে যায়।
৩. যান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ
হ্যান্ড পিকিং: ছোট পরিসরে হপার গুলোকে হাত দিয়ে তুলে ধরা বা ধ্বংস করা সম্ভব।
আলোক ফাঁদ: আক্রমণ প্রাথমিক পর্যায়ে থাকলে আলোক ফাঁদ স্থাপন করে পোকা আকৃষ্ট করা এবং ধ্বংস করা সম্ভব।
৪. জৈবিক নিয়ন্ত্রণ
প্রাকৃতিক শত্রুদের ব্যবহার: ব্রাউন প্ল্যান্ট হপার এর প্রাকৃতিক শত্রু যেমন মিরিড বাগ, মাকড়সা এবং ডিম প্যারাসিটয়েড ইত্যাদি ধান ক্ষেতে ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে, যারা হপার খেয়ে ফেলতে সক্ষম।
ছত্রাক: ছত্রাক যেমন বিউভেরিয়া ব্যাসিয়ানা এবং মেটারিজিয়াম অ্যানিসোপিলিয়ে ব্যবহার করে হপার নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে।
৪. রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণ
কীটনাশক ব্যবহার: ক্ষেত্রবিশেষে অনুমোদিত কীটনাশক (ডাইমেথোয়েট ৬০ইসি ১ লিটার/হেক্টর, ডায়াজিনন ৬০ইসি ১ লিটার/হেক্টর, ইমামেকটিন বেনজয়েট ৫এসজি ১ কেজি/হেক্টর) প্রয়োগ করে ব্রাউন প্ল্যান্ট হপার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। তবে কীটনাশক ব্যবহারের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে, যেন পরিবেশ ও অন্যান্য উপকারী প্রাণীর উপর নেতিবাচক প্রভাব না ফেলে।
৫. সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা
এটি একটি সামগ্রিক পদ্ধতি যেখানে পরিচর্যা, যান্ত্রিক, জৈবিক ও রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির সংমিশ্রণ ব্যবহার করা হয়। এই পদ্ধতিতে ধান ক্ষেতের পরিবেশ উপযোগী করে তোলা হয়, যাতে ব্রাউন প্ল্যান্ট হপার সহ অন্যান্য ক্ষতিকর পোকামাকড়ের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে থাকে।
উপসংহার
২০২৫ সালের পোকার আক্রমণ বাংলাদেশের নিবিড়ভাবে আবাদ হওয়া এলাকাগুলোতে ফলন ক্ষতি ছিল অত্যন্ত মারাত্মক, যা অধিক স্থিতিশীল উৎপাদন পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তাকে আরও জোরালো করে। টেকসই প্রশমনের মূল ভিত্তি হলো রোগ-পোকার সহনশীল জাতের ব্যবহার, সুষম পুষ্টি ব্যবস্থাপনা, প্রাকৃতিক শত্রুর আবাস সংরক্ষণ এবং কীটনাশকের বিচক্ষণ ব্যবহার-যা হপারবার্ন ও পুনরুত্থান প্রতিরোধে সহায়ক। খাদ্য নিরাপত্তা সুরক্ষায় আগাম সতর্কবার্তা ব্যবস্থা, কৃষক প্রশিক্ষণ এবং সমন্বিত জাতীয় প্রতিক্রিয়া ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করা অত্যন্ত জরুরি। ভবিষ্যৎ প্রাদুর্ভাব মোকাবেলায় সক্রিয়, বাস্তুতন্ত্রভিত্তিক ব্যবস্থাপনাই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য প্রতিরক্ষা হিসেবে প্রমাণিত হবে।
লেখক: পরিচালক (জনশক্তি ও প্রশিক্ষণ), বিএআরসি]