মতিউর রহমান
দেশে ২১ নভেম্বর ২০২৫ সালের ভূমিকম্প শুধু একটি প্রাকৃতিক ঘটনা ছিল না; এটি সমগ্র সমাজকে নাড়া দেওয়া এক আবেগতাত্ত্বিক অভিঘাত হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সমাজতত্ত্বের আধুনিক ধারণা-বিশেষত ‘ইমোশন ইকোনমি’-অনুসারে, ভয়, চাপ, উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তা এখন আর কেবল ব্যক্তিগত অনুভূতি নয়; বরং এগুলো সামাজিক কাঠামোর উৎপন্ন শক্তি, যা সরাসরি অর্থনীতি, রাজনীতি, নগরজীবন এবং প্রযুক্তি ব্যবহারের ধরনকে প্রভাবিত করে।
ভয়, চাপ, উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তা এখন আর কেবল ব্যক্তিগত অনুভূতি নয়; বরং এগুলো সামাজিক কাঠামোর উৎপন্ন শক্তি, যা সরাসরি অর্থনীতি, রাজনীতি, নগরজীবন এবং প্রযুক্তি ব্যবহারের ধরনকে প্রভাবিত করে
বাংলাদেশে ভূমিকম্প-পরবর্তী সময়টায় এই আবেগতাত্ত্বিক শক্তিগুলোর প্রভাব আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, বিশেষত যখন দেশটি একই সঙ্গে রেকর্ড মূল্যস্ফীতি, কর্মসংস্থানের সংকট, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও জলবায়ু-ঝুঁকির মতো বহুমাত্রিক চাপের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছে। একটি সমাজে যেখানে অনিশ্চয়তা জীবনের নিত্যসঙ্গী, সেখানে জনগণের মানসিক অবস্থা সমস্ত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তের চালিকাশক্তি হয়ে ওঠে। ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্ট আতঙ্ক এবং বিদ্যমান অর্থনৈতিক চাপ মিলে একটি নতুন ‘মানসিকতার অর্থনীতি’ তৈরি করেছে, যা আমাদের সামাজিক স্থিতিশীলতার ভিত্তিকে দুর্বল করছে।
ঢাকার মতো পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ এবং অবকাঠামোগতভাবে দুর্বল শহরে ভূমিকম্পের অভিঘাত ভয়ের বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। বহুতল ভবনে বসবাসকারী মানুষের জন্য হঠাৎ দুলে ওঠা ফ্লোর কেবল একটি ক্ষণস্থায়ী শারীরিক ঝুঁকি নয়, এটি গভীর মনস্তাত্ত্বিক আতঙ্কের উৎস। ভবনটির নির্মাণমান নিয়ে সন্দেহ, মালিকের দায়িত্বহীনতা, অতিরিক্ত ফ্লোর সংযোজন, অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার দুর্বলতা-সব মিলিয়ে তাদের মানসিক নিরাপত্তা ক্রমাগত ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। ভূমিকম্পের পর সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত নামতে না পারা প্রবীণ মানুষ, চলাফেরা সীমিত এমন অসুস্থ ব্যক্তি বা শ্বাসকষ্টে ভোগা বাসিন্দাদের অসহায়তা এই আতঙ্ককে আরও তীব্র করে তোলে। তাদের ক্ষেত্রে, জীবন রক্ষার ক্ষমতা নিজেদের হাতে নেই-এই উপলব্ধিই সবচেয়ে বড় মানসিক বোঝা, যা মানুষ-সৃষ্ট ভৌত দুর্বলতার ওপর নির্ভরশীল।
ভূমিকম্পের ভয় সমাজের প্রতিটি সংবেদনশীল গোষ্ঠীকে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায় আঘাত করে, এবং এর প্রভাব অর্থনীতিতে অনুভূত হয়। স্কুলগামী শিশুরা এই আকস্মিক কাঁপুনিকে ‘জীবনহানির আশঙ্কা’ হিসেবে উপলব্ধি করে, যা দীর্ঘমেয়াদি পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস-এ রূপ নিতে পারে। অভিভাবকেরা তখন স্কুল ভবনের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে সন্তানদের স্কুলে পাঠানো কমিয়ে দিতে পারেন, যা শিক্ষা-অর্থনীতির ওপর প্রভাব ফেলে।
অন্যদিকে, হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের জন্য ভূমিকম্পের অভিজ্ঞতা ভিন্ন এক সামাজিক ভয়। তাদের নড়াচড়ার স্বাধীনতা নেই, আর চিকিৎসা সরঞ্জাম, অক্সিজেন লাইন বা লাইফ-সাপোর্ট ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা বাস্তব আতঙ্ক সৃষ্টি করে। এটি স্বাস্থ্যসেবার প্রতি কাঠামোগত আস্থাহীনতাকে আরও প্রকট করে তোলে এবং জরুরি স্বাস্থ্যখাতে অতিরিক্ত বিনিয়োগের চাপ তৈরি করে। শিল্প কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের মনে রানা প্লাজার স্মৃতি এখনও তাজা; তাই সামান্য দোলনাও সেখানে গণ-উৎকণ্ঠার ঢেউ তোলে, যা দ্রুত গুজব ও হুড়োহুড়িতে পরিণত হয়ে উৎপাদন ব্যাহত করে। এই আতঙ্ক কেবল শ্রমিকের নয়, বরং সমগ্র শিল্প খাতের জন্য এক নতুন অনিশ্চয়তার পুঁজি তৈরি করে, যা বিদেশী ক্রেতাদের আস্থাকেও চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে।
ব্রিজ, কালভার্ট, ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল ভায়াডাক্ট, পুরান শহরের নড়বড়ে ভবন, অনিয়ন্ত্রিত গ্যাস লাইনে আগুন লাগার আশঙ্কা-সব মিলিয়ে নগরবাসীর মনে একটি মৌলিক প্রশ্ন জাগে: “এই শহর কি আদৌ নিরাপদ? এই অবকাঠামোতে আমার জীবন কতটা সুরক্ষিত?” এই প্রশ্নটি কেবল দুর্যোগসংক্রান্ত নয়; বরং এটি নগর-অবকাঠামোর দীর্ঘমেয়াদি অবহেলা, দুর্নীতি, পরিকল্পনাহীনতা ও লাগামহীন জনঘনত্বের চাপের ফসল। যখন কোটি কোটি টাকা ব্যয় করেও নাগরিকেরা একটি নিরাপদ শহর পান না, তখন এই ভৌত দুর্বলতা তাদের মানসিক নিরাপত্তার ওপর সরাসরি আঘাত করে। এই হতাশা এবং অবিশ্বাসই আবেগের অর্থনীতিকে চালিত করার মূল শক্তি, যা সরকারকে দীর্ঘমেয়াদি ও ব্যয়বহুল সংস্কারের দিকে ঠেলে দেয়।
ইমোশন ইকোনমি তত্ত্ব অনুসারে, যে সমাজে কাঠামোগত অনিশ্চয়তা বেশি, সেই সমাজে জনগণের আবেগও হয়ে ওঠে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তের চালিকাশক্তি। আজকের বাংলাদেশে ভূমিকম্প-উদ্ভূত আতঙ্ক শুধু মুহূর্তিক প্রতিক্রিয়া নয়; এটি বিদ্যমান অর্থনৈতিক ও সামাজিক চাপের সঙ্গে মিশে এক বৃহত্তর আবেগতাত্ত্বিক কাঠামো তৈরি করছে। এই আবেগতাত্ত্বিক কাঠামো তিনভাবে কাজ করে, যা অর্থনীতি ও রাজনীতিতে স্পষ্ট প্রভাব ফেলে: প্রথমত, এটি মানুষের ঝুঁকি-উপলব্ধিকে প্রতিনিয়ত বাড়িয়ে দিয়ে সমাজে স্থায়ী উদ্বেগের পরিবেশ তৈরি করে।নাগরিকেরা এখন তাদের স্বাভাবিক জীবনেও অতিরিক্ত ঝুঁকি দেখতে শুরু করেন, যা রিয়েল এস্টেট বাজারের মতো ক্ষেত্রগুলোতে মন্দা তৈরি করতে পারে।
দ্বিতীয়ত, এটি অনলাইন স্পেসকে তথ্য-ভ্রান্তি ছড়িয়ে দেওয়ার উর্বর জায়গায় রূপান্তরিত করে, যেখানে গুজব, মিথ্যা সতর্কতা, ভুয়া বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বা ‘আরো বড় ভূমিকম্প আসছে’-এমন বয়ান আতঙ্কের আগুনে ঘি ঢালে। তথ্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারানো এবং সরকারি তথ্যের প্রতি অবিশ্বাস উদ্বেগের একটি বড় উৎস। তৃতীয়ত, এই আবেগগুলো অর্থনীতি ও রাজনীতিকে প্রভাবিত করতে শুরু করে। মানুষ ভোগ কমায়, জরুরি জিনিস মজুত করতে শুরু করে, অপ্রয়োজনীয় বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ মনে হয়, পরিবারগুলো তরল সঞ্চয়কে অগ্রাধিকার দেয়। অন্যদিকে, এটি রাজনৈতিক আস্থাহীনতা বাড়িয়ে সরকারের স্থিতিশীলতাকে চ্যালেঞ্জ জানায়।
গ্রামীণ ও ছোট শহরের বাসিন্দাদের ওপর ভূমিকম্পের প্রভাব আরেকভাবে দেখা যায়। তারা সরাসরি উচ্চ ভবনের ঝুঁকিতে না থাকলেও তথ্য-ঘটনার অনিশ্চয়তা ও গুজবের চাপ তাদের মানসিক অস্থিরতা বাড়ায়। নদীভাঙন, ঘূর্ণিঝড়, খরা ও বন্যার মতো জলবায়ু-ঝুঁকিতে অভ্যস্ত জনগোষ্ঠীর কাছে ভূমিকম্প একটি নতুন, অচেনা এবং নিয়ন্ত্রণহীন ভয়। ফলে দেশে একটি আবেগতাত্ত্বিক বিভাজন জন্ম নেয়-যেখানে নগরবাসীর ভয় অবকাঠামোগত এবং কাঠামোগত দুর্বলতা-কেন্দ্রিক, আর গ্রামীণ মানুষের ভয় তথ্য-অনিশ্চয়তা ও জলবায়ু-ঝুঁকির সঙ্গে মিলেমিশে যায়। এই দ্বিমুখী আবেগ ব্যবস্থাপনার জন্য প্রয়োজন ভিন্ন ভিন্ন নীতি, যা তাদের স্থানীয় জ্ঞানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
সংকটকালে সামাজিক পুঁজি বা কমিউনিটি নেটওয়ার্ক অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারত। কিন্তু নগরের জীবন এমনভাবে ছিন্নভিন্ন যে প্রতিবেশী সম্পর্ক দুর্বল, আস্থার অভাব প্রকট, এবং কেউ সংকটে পড়লে সাহায্যের হাত বাড়ানো আগের চেয়ে কঠিন। সাম্প্রতিক ভূমিকম্পে বহু মানুষ দেখেছে, তারা দৌড়ে নিচে নেমেও কারো খোঁজ জানাতে সক্ষম হয়নি, কিংবা প্রতিবেশীর সহায়তার উপর নির্ভর করতে পারেনি। এই সামাজিক বিচ্ছিন্নতা এবং একাকিত্বও একটি বড় চাপ, যা ইমোশন ইকোনমির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। যখন ব্যক্তিগত পর্যায়ে সহায়তার আশ্বাস থাকে না, তখন সমস্ত সুরক্ষার জন্য রাষ্ট্রের ওপর চাপ আরও বহুগুণ বেড়ে যায়, এবং রাষ্ট্র যদি সেই চাপ সামলাতে না পারে, তবে জনগণের হতাশা চরম পর্যায়ে পৌঁছায়।
প্রতিদিনের চাপ, ব্যয়, ভোগান্তি ও ঝুঁকির মধ্যে বাস করা নাগরিকেরা নিরাপত্তাহীনতার স্থায়ী অনুভূতি নিয়ে বড় হচ্ছে। এই অবস্থায় মানুষের মনস্তাত্ত্বিক স্থিতিস্থাপকতা দুর্বল হয়ে পড়ে। এই দুর্বল স্থিতিস্থাপকতা সম্মিলিতভাবে ‘ফাইট-ফ্লাইট-ফ্রিজ’ প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়। কেউ আতঙ্কে দৌড়ে বেরিয়ে যান (ফ্লাইট), কেউ বা গুজব বা তথ্যের জন্য মরিয়া হয়ে অনুসন্ধান করেন (ফাইট), আবার কেউ হতভম্ব হয়ে স্থির হয়ে যান (ফ্রিজ)। এই আচরণ সমষ্টিগতভাবে সংক্রমিত হয়, তৈরি করে সম্মিলিত আতঙ্ক।
এই সবই বাংলাদেশে ইমোশন ইকোনমির বাস্তব চিত্র সামনে আনে-একটি সমাজ যেখানে আবেগ আর ব্যক্তিগত নয়, বরং রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা, নগর ব্যবস্থাপনা, দুর্যোগ প্রস্তুতি, স্বাস্থ্যনীতি, মিডিয়া আচরণ এবং রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণকে প্রভাবিত করে। এই আবেগ-চাপ উপেক্ষা করা মানে দেশের অর্থনীতি ও সমাজের বাস্তবতাকে উপেক্ষা করা।
ভূমিকম্প-উদ্ভূত আতঙ্ক বাংলাদেশের জন্য এক নতুন সামাজিক বার্তা বহন করে। উন্নয়ন শুধু সেতু-ফ্লাইওভার তৈরির বিষয় নয়, বরং একটি নিরাপদ, পরিকল্পিত, মানবিক নগর ও সমাজ গড়ে তোলার ব্যাপার। মানুষের মানসিক নিরাপত্তা রক্ষাই আগামী দিনে রাষ্ট্রের অন্যতম বড় নীতি-চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠবে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শুধু ফিজিক্যাল অবকাঠামো মজবুত করলেই চলবে না; প্রয়োজন একটি সমন্বিত উদ্যোগ: তথ্য-ব্যবস্থার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, দুর্যোগ-পরবর্তী ট্রমা মোকাবিলা এবং মানসিক স্থিতিস্থাপকতা বৃদ্ধিতে রাষ্ট্রীয়ভাবে বিনিয়োগ করা।
একই সঙ্গে সামাজিক পুঁজি পুনরুদ্ধার এবং নির্মাণ তদারকি ও পরিকল্পনার ক্ষেত্রে দুর্নীতি রোধ করে জনগণের হারানো আস্থা পুনর্গঠন করা আবশ্যক। কারণ, যে সমাজে আবেগ অস্থির, সেখানে স্থিতিশীলতা, আস্থা ও টেকসই উন্নয়ন কোনো কিছুই দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না। আবেগের রাজনীতিকে বুঝে, মানুষের মানসিকতাকে সুরক্ষা দিয়েই ভবিষ্যতের নিরাপদ বাংলাদেশ গড়তে হবে।
[লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী]
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
মতিউর রহমান
সোমবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৫
দেশে ২১ নভেম্বর ২০২৫ সালের ভূমিকম্প শুধু একটি প্রাকৃতিক ঘটনা ছিল না; এটি সমগ্র সমাজকে নাড়া দেওয়া এক আবেগতাত্ত্বিক অভিঘাত হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সমাজতত্ত্বের আধুনিক ধারণা-বিশেষত ‘ইমোশন ইকোনমি’-অনুসারে, ভয়, চাপ, উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তা এখন আর কেবল ব্যক্তিগত অনুভূতি নয়; বরং এগুলো সামাজিক কাঠামোর উৎপন্ন শক্তি, যা সরাসরি অর্থনীতি, রাজনীতি, নগরজীবন এবং প্রযুক্তি ব্যবহারের ধরনকে প্রভাবিত করে।
ভয়, চাপ, উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তা এখন আর কেবল ব্যক্তিগত অনুভূতি নয়; বরং এগুলো সামাজিক কাঠামোর উৎপন্ন শক্তি, যা সরাসরি অর্থনীতি, রাজনীতি, নগরজীবন এবং প্রযুক্তি ব্যবহারের ধরনকে প্রভাবিত করে
বাংলাদেশে ভূমিকম্প-পরবর্তী সময়টায় এই আবেগতাত্ত্বিক শক্তিগুলোর প্রভাব আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, বিশেষত যখন দেশটি একই সঙ্গে রেকর্ড মূল্যস্ফীতি, কর্মসংস্থানের সংকট, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও জলবায়ু-ঝুঁকির মতো বহুমাত্রিক চাপের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছে। একটি সমাজে যেখানে অনিশ্চয়তা জীবনের নিত্যসঙ্গী, সেখানে জনগণের মানসিক অবস্থা সমস্ত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তের চালিকাশক্তি হয়ে ওঠে। ভূমিকম্পের ফলে সৃষ্ট আতঙ্ক এবং বিদ্যমান অর্থনৈতিক চাপ মিলে একটি নতুন ‘মানসিকতার অর্থনীতি’ তৈরি করেছে, যা আমাদের সামাজিক স্থিতিশীলতার ভিত্তিকে দুর্বল করছে।
ঢাকার মতো পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ এবং অবকাঠামোগতভাবে দুর্বল শহরে ভূমিকম্পের অভিঘাত ভয়ের বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। বহুতল ভবনে বসবাসকারী মানুষের জন্য হঠাৎ দুলে ওঠা ফ্লোর কেবল একটি ক্ষণস্থায়ী শারীরিক ঝুঁকি নয়, এটি গভীর মনস্তাত্ত্বিক আতঙ্কের উৎস। ভবনটির নির্মাণমান নিয়ে সন্দেহ, মালিকের দায়িত্বহীনতা, অতিরিক্ত ফ্লোর সংযোজন, অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার দুর্বলতা-সব মিলিয়ে তাদের মানসিক নিরাপত্তা ক্রমাগত ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। ভূমিকম্পের পর সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত নামতে না পারা প্রবীণ মানুষ, চলাফেরা সীমিত এমন অসুস্থ ব্যক্তি বা শ্বাসকষ্টে ভোগা বাসিন্দাদের অসহায়তা এই আতঙ্ককে আরও তীব্র করে তোলে। তাদের ক্ষেত্রে, জীবন রক্ষার ক্ষমতা নিজেদের হাতে নেই-এই উপলব্ধিই সবচেয়ে বড় মানসিক বোঝা, যা মানুষ-সৃষ্ট ভৌত দুর্বলতার ওপর নির্ভরশীল।
ভূমিকম্পের ভয় সমাজের প্রতিটি সংবেদনশীল গোষ্ঠীকে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায় আঘাত করে, এবং এর প্রভাব অর্থনীতিতে অনুভূত হয়। স্কুলগামী শিশুরা এই আকস্মিক কাঁপুনিকে ‘জীবনহানির আশঙ্কা’ হিসেবে উপলব্ধি করে, যা দীর্ঘমেয়াদি পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস-এ রূপ নিতে পারে। অভিভাবকেরা তখন স্কুল ভবনের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে সন্তানদের স্কুলে পাঠানো কমিয়ে দিতে পারেন, যা শিক্ষা-অর্থনীতির ওপর প্রভাব ফেলে।
অন্যদিকে, হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের জন্য ভূমিকম্পের অভিজ্ঞতা ভিন্ন এক সামাজিক ভয়। তাদের নড়াচড়ার স্বাধীনতা নেই, আর চিকিৎসা সরঞ্জাম, অক্সিজেন লাইন বা লাইফ-সাপোর্ট ভেঙে পড়ার সম্ভাবনা বাস্তব আতঙ্ক সৃষ্টি করে। এটি স্বাস্থ্যসেবার প্রতি কাঠামোগত আস্থাহীনতাকে আরও প্রকট করে তোলে এবং জরুরি স্বাস্থ্যখাতে অতিরিক্ত বিনিয়োগের চাপ তৈরি করে। শিল্প কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের মনে রানা প্লাজার স্মৃতি এখনও তাজা; তাই সামান্য দোলনাও সেখানে গণ-উৎকণ্ঠার ঢেউ তোলে, যা দ্রুত গুজব ও হুড়োহুড়িতে পরিণত হয়ে উৎপাদন ব্যাহত করে। এই আতঙ্ক কেবল শ্রমিকের নয়, বরং সমগ্র শিল্প খাতের জন্য এক নতুন অনিশ্চয়তার পুঁজি তৈরি করে, যা বিদেশী ক্রেতাদের আস্থাকেও চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে।
ব্রিজ, কালভার্ট, ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল ভায়াডাক্ট, পুরান শহরের নড়বড়ে ভবন, অনিয়ন্ত্রিত গ্যাস লাইনে আগুন লাগার আশঙ্কা-সব মিলিয়ে নগরবাসীর মনে একটি মৌলিক প্রশ্ন জাগে: “এই শহর কি আদৌ নিরাপদ? এই অবকাঠামোতে আমার জীবন কতটা সুরক্ষিত?” এই প্রশ্নটি কেবল দুর্যোগসংক্রান্ত নয়; বরং এটি নগর-অবকাঠামোর দীর্ঘমেয়াদি অবহেলা, দুর্নীতি, পরিকল্পনাহীনতা ও লাগামহীন জনঘনত্বের চাপের ফসল। যখন কোটি কোটি টাকা ব্যয় করেও নাগরিকেরা একটি নিরাপদ শহর পান না, তখন এই ভৌত দুর্বলতা তাদের মানসিক নিরাপত্তার ওপর সরাসরি আঘাত করে। এই হতাশা এবং অবিশ্বাসই আবেগের অর্থনীতিকে চালিত করার মূল শক্তি, যা সরকারকে দীর্ঘমেয়াদি ও ব্যয়বহুল সংস্কারের দিকে ঠেলে দেয়।
ইমোশন ইকোনমি তত্ত্ব অনুসারে, যে সমাজে কাঠামোগত অনিশ্চয়তা বেশি, সেই সমাজে জনগণের আবেগও হয়ে ওঠে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তের চালিকাশক্তি। আজকের বাংলাদেশে ভূমিকম্প-উদ্ভূত আতঙ্ক শুধু মুহূর্তিক প্রতিক্রিয়া নয়; এটি বিদ্যমান অর্থনৈতিক ও সামাজিক চাপের সঙ্গে মিশে এক বৃহত্তর আবেগতাত্ত্বিক কাঠামো তৈরি করছে। এই আবেগতাত্ত্বিক কাঠামো তিনভাবে কাজ করে, যা অর্থনীতি ও রাজনীতিতে স্পষ্ট প্রভাব ফেলে: প্রথমত, এটি মানুষের ঝুঁকি-উপলব্ধিকে প্রতিনিয়ত বাড়িয়ে দিয়ে সমাজে স্থায়ী উদ্বেগের পরিবেশ তৈরি করে।নাগরিকেরা এখন তাদের স্বাভাবিক জীবনেও অতিরিক্ত ঝুঁকি দেখতে শুরু করেন, যা রিয়েল এস্টেট বাজারের মতো ক্ষেত্রগুলোতে মন্দা তৈরি করতে পারে।
দ্বিতীয়ত, এটি অনলাইন স্পেসকে তথ্য-ভ্রান্তি ছড়িয়ে দেওয়ার উর্বর জায়গায় রূপান্তরিত করে, যেখানে গুজব, মিথ্যা সতর্কতা, ভুয়া বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বা ‘আরো বড় ভূমিকম্প আসছে’-এমন বয়ান আতঙ্কের আগুনে ঘি ঢালে। তথ্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারানো এবং সরকারি তথ্যের প্রতি অবিশ্বাস উদ্বেগের একটি বড় উৎস। তৃতীয়ত, এই আবেগগুলো অর্থনীতি ও রাজনীতিকে প্রভাবিত করতে শুরু করে। মানুষ ভোগ কমায়, জরুরি জিনিস মজুত করতে শুরু করে, অপ্রয়োজনীয় বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ মনে হয়, পরিবারগুলো তরল সঞ্চয়কে অগ্রাধিকার দেয়। অন্যদিকে, এটি রাজনৈতিক আস্থাহীনতা বাড়িয়ে সরকারের স্থিতিশীলতাকে চ্যালেঞ্জ জানায়।
গ্রামীণ ও ছোট শহরের বাসিন্দাদের ওপর ভূমিকম্পের প্রভাব আরেকভাবে দেখা যায়। তারা সরাসরি উচ্চ ভবনের ঝুঁকিতে না থাকলেও তথ্য-ঘটনার অনিশ্চয়তা ও গুজবের চাপ তাদের মানসিক অস্থিরতা বাড়ায়। নদীভাঙন, ঘূর্ণিঝড়, খরা ও বন্যার মতো জলবায়ু-ঝুঁকিতে অভ্যস্ত জনগোষ্ঠীর কাছে ভূমিকম্প একটি নতুন, অচেনা এবং নিয়ন্ত্রণহীন ভয়। ফলে দেশে একটি আবেগতাত্ত্বিক বিভাজন জন্ম নেয়-যেখানে নগরবাসীর ভয় অবকাঠামোগত এবং কাঠামোগত দুর্বলতা-কেন্দ্রিক, আর গ্রামীণ মানুষের ভয় তথ্য-অনিশ্চয়তা ও জলবায়ু-ঝুঁকির সঙ্গে মিলেমিশে যায়। এই দ্বিমুখী আবেগ ব্যবস্থাপনার জন্য প্রয়োজন ভিন্ন ভিন্ন নীতি, যা তাদের স্থানীয় জ্ঞানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
সংকটকালে সামাজিক পুঁজি বা কমিউনিটি নেটওয়ার্ক অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারত। কিন্তু নগরের জীবন এমনভাবে ছিন্নভিন্ন যে প্রতিবেশী সম্পর্ক দুর্বল, আস্থার অভাব প্রকট, এবং কেউ সংকটে পড়লে সাহায্যের হাত বাড়ানো আগের চেয়ে কঠিন। সাম্প্রতিক ভূমিকম্পে বহু মানুষ দেখেছে, তারা দৌড়ে নিচে নেমেও কারো খোঁজ জানাতে সক্ষম হয়নি, কিংবা প্রতিবেশীর সহায়তার উপর নির্ভর করতে পারেনি। এই সামাজিক বিচ্ছিন্নতা এবং একাকিত্বও একটি বড় চাপ, যা ইমোশন ইকোনমির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। যখন ব্যক্তিগত পর্যায়ে সহায়তার আশ্বাস থাকে না, তখন সমস্ত সুরক্ষার জন্য রাষ্ট্রের ওপর চাপ আরও বহুগুণ বেড়ে যায়, এবং রাষ্ট্র যদি সেই চাপ সামলাতে না পারে, তবে জনগণের হতাশা চরম পর্যায়ে পৌঁছায়।
প্রতিদিনের চাপ, ব্যয়, ভোগান্তি ও ঝুঁকির মধ্যে বাস করা নাগরিকেরা নিরাপত্তাহীনতার স্থায়ী অনুভূতি নিয়ে বড় হচ্ছে। এই অবস্থায় মানুষের মনস্তাত্ত্বিক স্থিতিস্থাপকতা দুর্বল হয়ে পড়ে। এই দুর্বল স্থিতিস্থাপকতা সম্মিলিতভাবে ‘ফাইট-ফ্লাইট-ফ্রিজ’ প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়। কেউ আতঙ্কে দৌড়ে বেরিয়ে যান (ফ্লাইট), কেউ বা গুজব বা তথ্যের জন্য মরিয়া হয়ে অনুসন্ধান করেন (ফাইট), আবার কেউ হতভম্ব হয়ে স্থির হয়ে যান (ফ্রিজ)। এই আচরণ সমষ্টিগতভাবে সংক্রমিত হয়, তৈরি করে সম্মিলিত আতঙ্ক।
এই সবই বাংলাদেশে ইমোশন ইকোনমির বাস্তব চিত্র সামনে আনে-একটি সমাজ যেখানে আবেগ আর ব্যক্তিগত নয়, বরং রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা, নগর ব্যবস্থাপনা, দুর্যোগ প্রস্তুতি, স্বাস্থ্যনীতি, মিডিয়া আচরণ এবং রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণকে প্রভাবিত করে। এই আবেগ-চাপ উপেক্ষা করা মানে দেশের অর্থনীতি ও সমাজের বাস্তবতাকে উপেক্ষা করা।
ভূমিকম্প-উদ্ভূত আতঙ্ক বাংলাদেশের জন্য এক নতুন সামাজিক বার্তা বহন করে। উন্নয়ন শুধু সেতু-ফ্লাইওভার তৈরির বিষয় নয়, বরং একটি নিরাপদ, পরিকল্পিত, মানবিক নগর ও সমাজ গড়ে তোলার ব্যাপার। মানুষের মানসিক নিরাপত্তা রক্ষাই আগামী দিনে রাষ্ট্রের অন্যতম বড় নীতি-চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠবে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শুধু ফিজিক্যাল অবকাঠামো মজবুত করলেই চলবে না; প্রয়োজন একটি সমন্বিত উদ্যোগ: তথ্য-ব্যবস্থার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, দুর্যোগ-পরবর্তী ট্রমা মোকাবিলা এবং মানসিক স্থিতিস্থাপকতা বৃদ্ধিতে রাষ্ট্রীয়ভাবে বিনিয়োগ করা।
একই সঙ্গে সামাজিক পুঁজি পুনরুদ্ধার এবং নির্মাণ তদারকি ও পরিকল্পনার ক্ষেত্রে দুর্নীতি রোধ করে জনগণের হারানো আস্থা পুনর্গঠন করা আবশ্যক। কারণ, যে সমাজে আবেগ অস্থির, সেখানে স্থিতিশীলতা, আস্থা ও টেকসই উন্নয়ন কোনো কিছুই দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না। আবেগের রাজনীতিকে বুঝে, মানুষের মানসিকতাকে সুরক্ষা দিয়েই ভবিষ্যতের নিরাপদ বাংলাদেশ গড়তে হবে।
[লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী]