alt

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

‘প্রশ্ন কোরো না, প্রশ্ন সর্বনাশী’

গাজী তারেক আজিজ

: সোমবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৫

বাংলাদেশের রাজনীতির বর্তমান পরিস্থিতি এমন এক অবস্থায় পৌঁছেছে যেখানে প্রশ্ন করা নিজেই বিপদের আগুন

জ্বালানোর সমতুল্য। প্রশ্নের শব্দগুলো যেন রাষ্ট্রের করিডরে গর্জনের মতো প্রতিধ্বনি করছে, প্রশাসনের চোখে

শঙ্কার ছাপ ফেলছে, আর দলীয় রাজনীতির মধুর হাসি মুহূর্তেই তীব্র সতর্কবার্তায় পরিণত হচ্ছে।

রাজনীতির সবচেয়ে বড় সঙ্কট হলো আস্থাহীনতা। দলগুলো যেন আস্থার ব্যবসায়ী, জনগণ সেই ব্যবসার ভোক্তা

এই রাষ্ট্রযন্ত্রের অঘোষিত শর্তই যেন হয়ে দাঁড়িয়েছে, প্রশ্ন করা নিষিদ্ধ। “প্রশ্ন কোরো না, প্রশ্ন সর্বনাশী” এটি

শুধুই কোনো গান নয়, বরং দেশের রাজনীতির নীরব সংবিধান। নাগরিকরা এই অদৃশ্য বিধির শিকার হলেও তা প্রতিদিন অনুভব করছে, কারণ প্রশ্নের চাপে কখনও শাসক, কখনও বিরোধী সবার স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া দমন।

গত কয়েক মাসে দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নাটকীয় মোড় নিয়েছে। একটি অংশে আছে শাসন পতনের পর ক্ষমতার শূন্যস্থান পূরণের তৎপরতা, অন্যদিকে রাস্তায়, গ্রামে এবং শহরের কোনায় মব ভায়োলেন্সের অগ্নিকুণ্ডে পুড়ছে সাধারণ মানুষের জীবন। আগুন নিভার আগে নেতা ও দলগুলো ক্ষমতার ছকে নিজেদের অবস্থান পাকাপোক্ত করার দিকে ব্যস্ত। মানুষের জীবন যেন এখন অপ্রয়োজনীয় ব্যস্ততার পটভূমি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা জানে, নেতারা বারবার বদলায়, কিন্তু রাজনৈতিক সংস্কৃতি তার ধারা বদলায় না। জনগণ শুধু জনগণই থাকে, দুর্বৃত্তরা নেতা হয়ে রাষ্ট্র লুটে নেয়! এ যেনো লুটপাটের মচ্ছব।

ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা পরামর্শক, উপদেষ্টা ও কৌশলবিদদের মুখে শুনতে পাওয়া যায় একই রকম কথা- স্থিতি দরকার, শৃঙ্খলা দরকার, সময় দরকার। মানুষ ভাবে, তারা আমলাতন্ত্রের পোশাক পরে রাজনীতি করছে, রাজনীতির পোশাক পরে করছে আমলাতন্ত্র। কারণ, রাস্তায় আগুন লাগলে তারা মাঠে নামেন না, শুধু মাইকে শান্ত থাকার আহ্বান জানান। কিন্তু এই শান্তি মানুষের আসে না, জীবন নিরাপদ হয় না।

অন্যদিকে, জনগণের ক্ষোভ নীরব আগুনে ধীরে ধীরে জ্বলছে। সরকার পতনের পর যে উল্লাস দেখা দিয়েছিল, তা

দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। উল্লাসটি অল্প সময়ের মধ্যে উদ্বেগে, উদ্বেগ-শঙ্কায়, শঙ্কা-অস্থিরতায় রূপ নিয়েছে। মানুষের

মনে প্রশ্ন জন্মেছে- কেন সরকার পতনের পরেও জীবন সহজ হচ্ছে না? কেন রাজনৈতিক পরিবর্তনের নামেই বাস্তব জীবনের সংকট বাড়ছে? মব ভায়োলেন্স, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ এসব যেন রাজনীতির অজস্র নির্মমতা।

আমাদের শুধু দেখেই যেতে হবে! এ-ও যেন নিয়তি! আমরাও যেন মেনে নিয়েছি। আফসোস দিন যায় পরিস্থিতি বদলায় না।

রাস্তার যে কিশোর আগুন ধরাচ্ছে, সে কোন দলের তা স্পষ্ট নয়। রাজনৈতিক দলগুলোর বক্তব্যও বিভক্ত। কেউ বলে, আগুন আগের সরকারের রেখে যাওয়া। কেউ বলে, আমরা নিষ্পাপ। সাধারণ মানুষ বুঝতে পারছে, রাজনীতি এখন সুবিধা ও প্রতিশোধের খেলায় পরিণত হয়েছে। এখানে কোনো ন্যায়, কোনো নীতি নেই। ক্ষমতার খেলা চলছে, মানুষের জীবন অনিশ্চিত। অনিশ্চয়তারই নিশ্চয়তা দেয়া আছে এখানে, যেখানে মানুষ নিশ্চয়তা ভুলে গেছে। ভুলে যায়!

রাজনীতির সবচেয়ে বড় সঙ্কট হলো আস্থাহীনতা। দলগুলো যেন আস্থার ব্যবসায়ী, জনগণ সেই ব্যবসার ভোক্তা।

আজ যে দল গণতন্ত্রের মন্ত্র পড়ে, কাল ক্ষমতায় এসে বিরোধীদের গলা টিপে ধরছে। যে দল মব ভায়োলেন্সের

বিরুদ্ধে মানববন্ধন করছে, তারা কাল একই ভায়োলেন্সকে “অভিযোগ প্রমাণিত নয়” বলে হালকা করে। মানুষ তাই প্রশ্ন করতে শিখেছে- প্রশ্ন করলেই বিপদ।

এই সঙ্কট একদিনে তৈরি হয়নি। ধারাবাহিকতার অপশাসন, কেন্দ্রীকরণ, প্রশাসনের সঙ্গে দলীয় জোট, বিচার

ব্যবস্থায় অনিয়ম, এসব মিলে এমন একটি কাঠামো তৈরি হয়েছিল যা সরকার পতনের পর ধসে পড়েছে। পতনের ধসে চাপা পড়েছে রাজনীতির দায়বদ্ধতা। নতুন ক্ষমতাশালীরা মুখে বলে জনগণ কেন্দ্রিকতার কথা, কিন্তু মাঠে তাদের অগ্রাধিকার হলো নিজেদের অবস্থান শক্ত করা। আর এসব দশকের পর দশকের চিত্র। কেউ প্রত্যক্ষভাবে করছে, কেউ একে অপরের ওপর ভর দিয়ে করে যাচ্ছে। কিন্তু কেউই দায় নিতে নারাজ। চলতে থাকে দায় চাপানোর দৃঢ়

রাজনৈতিক খেল।

গণতন্ত্রের পরীক্ষা এখন হচ্ছে ক্ষমতার ভাগাভাগি। দলগুলো যত বেশি বিরোধী অবস্থানে দাঁড়ায়, তত বেশি ক্ষমতার সম্ভাবনার কাছে আসে। মানুষ তাই রাজনৈতিক নাটককে দর্শকের চোখে দেখে। মঞ্চে যুদ্ধ, ব্যাকস্টেজে চা-সিগারেট, এই দুই ধারা চলে। এক দল গেলে আরেক দলের সাম্রাজ্য দখলের হিড়িক। এর বলী হয় জনতা। অথচ সবাই আন্দোলনে জনতাকে পুঁজি করে স্লোগান দেয়, ক্ষমতা না জনতা? তারাই আবার বলে, জনতা জনতা। কিন্তু জনতাকে ঢাল বা বর্ম বানিয়ে আখেরে সবাই ক্ষমতার পূজারী। দিনশেষে ক্ষমতা-ই তাদের সব। জনতা তুচ্ছ!

প্রশ্ন করা মানুষের মৌলিক অধিকার, কিন্তু সেটি এখন ঝুঁকি। রাজনীতির ভাষা প্রতিনিয়ত বলে, অতিরিক্ত প্রশ্ন বিপদ ডেকে আনে। কিন্তু প্রশ্নই হলো জনগণের ভরসা। প্রশ্নই জবাবদিহির জন্ম দেয়। প্রশ্নই রাষ্ট্রকে সতর্ক রাখে। প্রশ্নই নেতাকে মানুষ কেন্দ্রিক করে, তোষামোদকারী নয়। আবার কখনো কখনো শাসকগোষ্ঠী কোন অভিযোগ তো নয়ই, সাধারণ প্রশ্নও কানে তোলে না। সেক্ষেত্রে তারা বধির সাজতে পছন্দ করে।

এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে দুশ্চিন্তার বিষয় হলো রাজনৈতিক দলগুলোর মনোভাব। তারা এখনো নিজেদের অবস্থান

পোক্ত করতে ব্যস্ত। গণতন্ত্র, মানবাধিকার, স্বচ্ছতা- এসবের কথা মুখে বললেও তারা মাঠে প্রমাণ করতে চায় না।

মানুষের জীবন, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, মৌলিক-মানবাধিকার, জবাবদিহি ব্যবস্থা, স্বচ্ছ মনোভাব, বিচার প্রাপ্তির

সাংবিধানিক নিশ্চয়তা, বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা, এসব এখনো তাদের জন্য কেবল ব্যাকগ্রাউন্ড।

মানুষ খেয়াল করে, রাজনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে জীবনযাত্রা পরিবর্তন হয় না। বরং পতনের পর অস্থিরতা বেশি

হয়। সরকার পরিবর্তিত হলেও প্রশাসন, রাজনৈতিক সংস্কৃতি, সামাজিক অভ্যাস, সব একই থাকে। ক্ষমতা বদলানোর খেলা মানুষকে দেখায় নাট্যরূপে, কিন্তু বাস্তবে পরিবর্তন আসে না। অথচ পরিবর্তনের ধোঁয়া তুলে সেই পরিবর্তন বা সংস্কারকেই নির্বাসনে পাঠাতে এতটুকুও সময়ক্ষেপণ করে না। সংস্কারের সংস্কার দরকারি হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু কার হাতে অর্পণ করা যাবে সেই দায়িত্ব? অথবা কে নেবে সেই ভার নিজ কাঁধে তুলে? আমাদের এমনই এক হতভাগ্য।

এই রাজনীতির অস্থিরতা বাড়ছে শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত। বাজারে মূল্যস্ফীতি, গ্যাস-বিদ্যুতের অস্থিতিশীলতা,

নিরাপত্তাহীনতা। লাগামহীন দুর্নীতির রাশ টানবে কে? এসব সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে দুর্বিষহ করে

তুলেছে। রাজনৈতিক দলগুলো মঞ্চে যতই আকর্ষণীয় ভাষণ দিক, মানুষের জীবনমানে বক্তৃতার কোনো প্রভাব পড়ছে না। তাই মানুষের প্রশ্ন, “আমরা কি নিরাপদ?” যতই অব্যাহত থাকে, নেতারা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। তারা বলেন, সময় লাগবে। সময় দিয়ে মানুষ ক্ষয়ে যাচ্ছে, সহনশীলতা হারাচ্ছে, জীবন ঝুঁকির মধ্যে যাচ্ছে। সবাইকে সময় দিতে হয়!

এ সময়ের ঘোড়া দৌড়ে, সংস্কার হয় না, উল্টো প্রতিশোধস্পৃহায় স্বরুপ ফিরে পেতে মরিয়া হয়ে পড়ে রাজনৈতিক দল ও দলের নেতারা। তা না হলে, ৫ আগস্টে সরকার পতনের পর এত এত গায়েবি মামলায় বাণিজ্য কি করে হয়? প্রশ্ন তোলা যাবে না। যেসব মামলায় অ্যাডভোকেট, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, সাংবাদিক, রাজনীতিক, সুশীল তথা অসহায় অরাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ, ব্যবসায়ী কেউ-ই বাদ যায়নি। এসব নিয়েও প্রশ্ন তোলা যায় না। ঢালাও অভিযোগের গতানুগতিক তদন্ত ও তদন্তের প্রক্রিয়া নিয়েও প্রশ্ন তোলা যায় না। তুললেও কেউ কানে নেয় না। রাষ্ট্র ক্ষমতাশালীদের বধির হতে শিখিয়েছে অভিযোগ শোনার ক্ষেত্রে। নিন্দা ঠিকই শুনতে পায়, দমন করতে সর্বস্ব উজাড় করে লেগে যায়। সেই পুরনো পথের পথিক!

জাতীয় সমঝোতার চাহিদা এই সময়ে সবচেয়ে প্রবল। কিন্তু দলগুলো নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে ব্যস্ত।

গণতন্ত্রের সহজতম ব্যাখ্যা হলো, সহমতের রাজনীতি। এখানে সহমত তৈরি হয় কেবল তখনই, যখন ক্ষমতার

ভাগাভাগির সুযোগ থাকে। জনগণ রাজনৈতিক সহমতের স্বপ্ন দেখে, কিন্তু বাস্তবে দেখছে ক্ষমতার জন্য নাটক। মত-অভিমত, ভিন্নমত সবকিছু পিষ্ট করতে চায় নির্দলীয় সরকারও। আদতে নির্দলীয় কিছু কি আছে? না না প্রশ্ন করছি না। মত প্রকাশের অধিকারের নামে প্রশ্ন করা বারণ অঘোষিত ভাবে।

দেশ যে প্রশ্ন করার অধিকার হারাচ্ছে, তা চরম বিপদের সংকেত। প্রশ্নের অধিকার রক্ষা না হলে গণতন্ত্র টিকে

থাকতে পারে না। সাংবাদিক, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, সাধারণ নাগরিক- সবাই জানে, প্রশ্ন করা ঝুঁকিপূর্ণ। কতজন

সাংবাদিক কলম ধরে লিখতে লিখতে ভেঙে গেছে, কতজন শিক্ষক ক্লাসে নিরাপদ ভাষার ব্যবহার করছে, এই হিসাব সরকারি খাতায় নেই।

নতুন ক্ষমতাশালীদের দাবি, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার হচ্ছে। কিন্তু গণতন্ত্রের প্রথম শর্ত হলো, প্রশ্নের স্বাধীনতা। সেখানে এখনো বহু ফাঁক, বহু চ্যালেঞ্জ। যারা গতকাল মঞ্চে দাঁড়িয়ে জবাবদিহির কথা বলেছিল, আজ তারা সংসদে প্রোটোকলের মধ্যেই হাঁটছে। যারা গতকাল কঠোর শাসন করছিল, তারা আজ মানবিকতার কথা বলছে। এই মায়াবী রূপান্তর মানুষকে শেখায়, রাজনীতির মূল শিক্ষা হলো ভুলে যাওয়ার ক্ষমতা। ভুলে গেলে স্বস্তি, ভুলে গেলে উন্নতি, ভুলে গেলে দল বদলানো যায়। আর তা-ই কি নিকট অতীত দূরবর্তী অতীতকে ভুলিয়ে দেয়।

কিন্তু বাস্তবতা ভুলে যায় না। বাজারের দাম কমছে না, বিদ্যুৎ-গ্যাসের অস্থিতিশীলতা কমছে না, নিরাপত্তাহীনতা

বাড়ছে। রাজনৈতিক দলগুলো মঞ্চে যতই বক্তৃতা দিক, মানুষের পকেটে কোনো প্রভাব নেই। তাই মানুষ প্রশ্ন করে, “বদল আসবে কি?” “উন্নতি কি আসবে?” নেতারা বলেন, “সময় লাগবে।” অথচ সময় মানুষের জীবনে ক্ষয় ঘটাচ্ছে। আর কত সময় লাগবে? তা-ও সুনির্দিষ্ট হোক।

রাজনীতির এই অস্থিরতার শেষ কোথায় কারও জানা নেই। দেশের নাগরিকরা চায় সত্যিকারের স্থিতি। স্থিতি মানে

নিরাপত্তা, স্বস্তি, অধিকার, জবাবদিহি। কিন্তু দলগুলো এখনো নিজেদের পুনর্গঠনে ব্যস্ত। মানুষ দর্শক, তাদের

হাতে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। শুধু গভীর দীর্ঘশ্বাস এবং দহনমাখা অপেক্ষা। শাসক তথা রাজনীতিবিদদেরও

বোধগম্যতা থাকতে হবে, জনগণেরও ধৈর্যচ্যুতি ঘটে।

সবিশেষ, রাজনৈতিক পরিবর্তনের ইতিহাস বলে, যে সমাজে প্রশ্নের মূল্য নেই, সেখানে স্থিতি টিকে না। যে রাষ্ট্র

প্রশ্নকে ভয় পায়, সে রাষ্ট্র নিজের প্রতিচ্ছবিকেই ভয় পায়। যে রাজনীতি প্রশ্নকে অবজ্ঞা করে, তা টিকে থাকে

কেবল মানুষের ভয় ধরে রাখার মাধ্যমে। তবু আশা আছে। মানুষের মনে প্রশ্নের আগুন এখনও আছে। যে দিন মানুষ বলবে, “প্রশ্ন করাই আমার অধিকার”, সেদিন রাজনীতি বদলে যাবে। আর সেই দিন, গানের লাইনটি, “প্রশ্ন কোরো না, প্রশ্ন সর্বনাশী,” বদলে যাবে। তখন প্রশ্নই হবে মুক্তির কণ্ঠ, গণতন্ত্রের প্রেরণা এবং দেশের সত্যিকারের উন্নতির মূল। ক্ষমতার ইতিহাস যতবারই নিজেদের নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছে, সত্যের ইতিহাস সবসময় প্রশ্নের পাশে দাঁড়িয়েছে। মানুষ আজও অপেক্ষা করছে। একদিন সেই মুক্তির প্রশ্ন উঠবে, এবং তখনই রাজনীতি শিখবে- প্রশ্নই সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তি।

[লেখক: অ্যাডভোকেট, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ফেনী]

নবান্নের আনন্দ ও আমনের ফলন

ভূমিকম্প, অর্থনৈতিক চাপ এবং অনিশ্চয়তা: মানসিকতার নতুন অর্থনীতি

নবম পে স্কেল ও এর আর্থসামাজিক প্রভাব

মৃত্যুদণ্ড, তারপর...

জমির ভুয়া দলিল কীভাবে বাতিল করবেন?

জুলাই সনদ আদিবাসীদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি

ব্যাংকের দুরবস্থা থামানো যাচ্ছে না কেন

আমন ধানে ব্রাউন প্ল্যান্টহপারের প্রাদুর্ভাব

বৈষম্য, অপচয় ও খাদ্যনিরাপত্তার সংকট

“বাঙালি আমরা, নহিতো...”

নারী নির্যাতন, মানসিক স্বাস্থ্য এবং সমাজের দায়

কাঁপছে ডলারের সিংহাসন

ত্রিশতম জলবায়ু সম্মেলন : প্রতীকী প্রদর্শনী, নাকি বৈশ্বিক জলবায়ু রাজনীতির বাঁক নেওয়ার মুহূর্ত?

অপরিণত নবজাতক : ঝুঁকি, প্রতিরোধ ও যত্নের জরুরি বাস্তবতা

বাংলাদেশী উত্তরাধিকার: প্রবাস-জীবন ও আমাদের সংস্কৃতি

রাজনীতিতে ভাষার সহনীয় প্রয়োগ

ভারত : এসআইআর এবং সাম্প্রদায়িক বিভাজন

মনে কী দ্বিধা নিয়ে...

নিরাপদ সড়ক ভাবনা

অপরিকল্পিত বাঁধ-শিল্পায়নে বিপর্যস্ত বরেন্দ্র কৃষি

ছবি

মামদানি দেখালেন নেতৃত্বের মূল পরিচয় কী

চেকের মামলায় বৈধ বিনিময়, লেনদেন, দেনা-পাওনা প্রমাণ ছাড়া আর জেল নয়

নবাগত শিক্ষকদের পেশাগত ভাবনা

মাদকাসক্তি: শুধু নিরাময় নয়, চাই সমাজ ব্যবস্থার সংস্কার

আমেরিকার “নো কিংস” আন্দোলন

ঘি তো আমাদের লাগবেই, নো হাংকি পাংকি!

“মামদানি না জামদানি...”

ভাষার বৈচিত্র্য রক্ষায় নীরব বিপ্লব

উপাত্ত সুরক্ষা আইন : গোপনীয়তা রক্ষা নাকি রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ?

সমতা কি ন্যায্যতা নিশ্চিত করে?

ডেঙ্গু সংকট দূরদৃষ্টির ব্যর্থতা

ষাটের দশকে বামপন্থী ভাবনার উত্থান ও বিবর্তন

দেখিতে পাও না তুমি মৃত্যুদূত দাঁড়ায়েছে দ্বারে!

বায়ুর অপর নাম জীবন

ছবি

হাওরের জীবন ও সংস্কৃতি

বিখণ্ডিত আত্মপরিচয়: তরল সহানুভূতিতে নৈতিক মূলধনের সমাজতত্ত্ব

tab

মতামত » উপ-সম্পাদকীয়

‘প্রশ্ন কোরো না, প্রশ্ন সর্বনাশী’

গাজী তারেক আজিজ

সোমবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৫

বাংলাদেশের রাজনীতির বর্তমান পরিস্থিতি এমন এক অবস্থায় পৌঁছেছে যেখানে প্রশ্ন করা নিজেই বিপদের আগুন

জ্বালানোর সমতুল্য। প্রশ্নের শব্দগুলো যেন রাষ্ট্রের করিডরে গর্জনের মতো প্রতিধ্বনি করছে, প্রশাসনের চোখে

শঙ্কার ছাপ ফেলছে, আর দলীয় রাজনীতির মধুর হাসি মুহূর্তেই তীব্র সতর্কবার্তায় পরিণত হচ্ছে।

রাজনীতির সবচেয়ে বড় সঙ্কট হলো আস্থাহীনতা। দলগুলো যেন আস্থার ব্যবসায়ী, জনগণ সেই ব্যবসার ভোক্তা

এই রাষ্ট্রযন্ত্রের অঘোষিত শর্তই যেন হয়ে দাঁড়িয়েছে, প্রশ্ন করা নিষিদ্ধ। “প্রশ্ন কোরো না, প্রশ্ন সর্বনাশী” এটি

শুধুই কোনো গান নয়, বরং দেশের রাজনীতির নীরব সংবিধান। নাগরিকরা এই অদৃশ্য বিধির শিকার হলেও তা প্রতিদিন অনুভব করছে, কারণ প্রশ্নের চাপে কখনও শাসক, কখনও বিরোধী সবার স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া দমন।

গত কয়েক মাসে দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নাটকীয় মোড় নিয়েছে। একটি অংশে আছে শাসন পতনের পর ক্ষমতার শূন্যস্থান পূরণের তৎপরতা, অন্যদিকে রাস্তায়, গ্রামে এবং শহরের কোনায় মব ভায়োলেন্সের অগ্নিকুণ্ডে পুড়ছে সাধারণ মানুষের জীবন। আগুন নিভার আগে নেতা ও দলগুলো ক্ষমতার ছকে নিজেদের অবস্থান পাকাপোক্ত করার দিকে ব্যস্ত। মানুষের জীবন যেন এখন অপ্রয়োজনীয় ব্যস্ততার পটভূমি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা জানে, নেতারা বারবার বদলায়, কিন্তু রাজনৈতিক সংস্কৃতি তার ধারা বদলায় না। জনগণ শুধু জনগণই থাকে, দুর্বৃত্তরা নেতা হয়ে রাষ্ট্র লুটে নেয়! এ যেনো লুটপাটের মচ্ছব।

ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা পরামর্শক, উপদেষ্টা ও কৌশলবিদদের মুখে শুনতে পাওয়া যায় একই রকম কথা- স্থিতি দরকার, শৃঙ্খলা দরকার, সময় দরকার। মানুষ ভাবে, তারা আমলাতন্ত্রের পোশাক পরে রাজনীতি করছে, রাজনীতির পোশাক পরে করছে আমলাতন্ত্র। কারণ, রাস্তায় আগুন লাগলে তারা মাঠে নামেন না, শুধু মাইকে শান্ত থাকার আহ্বান জানান। কিন্তু এই শান্তি মানুষের আসে না, জীবন নিরাপদ হয় না।

অন্যদিকে, জনগণের ক্ষোভ নীরব আগুনে ধীরে ধীরে জ্বলছে। সরকার পতনের পর যে উল্লাস দেখা দিয়েছিল, তা

দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। উল্লাসটি অল্প সময়ের মধ্যে উদ্বেগে, উদ্বেগ-শঙ্কায়, শঙ্কা-অস্থিরতায় রূপ নিয়েছে। মানুষের

মনে প্রশ্ন জন্মেছে- কেন সরকার পতনের পরেও জীবন সহজ হচ্ছে না? কেন রাজনৈতিক পরিবর্তনের নামেই বাস্তব জীবনের সংকট বাড়ছে? মব ভায়োলেন্স, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ এসব যেন রাজনীতির অজস্র নির্মমতা।

আমাদের শুধু দেখেই যেতে হবে! এ-ও যেন নিয়তি! আমরাও যেন মেনে নিয়েছি। আফসোস দিন যায় পরিস্থিতি বদলায় না।

রাস্তার যে কিশোর আগুন ধরাচ্ছে, সে কোন দলের তা স্পষ্ট নয়। রাজনৈতিক দলগুলোর বক্তব্যও বিভক্ত। কেউ বলে, আগুন আগের সরকারের রেখে যাওয়া। কেউ বলে, আমরা নিষ্পাপ। সাধারণ মানুষ বুঝতে পারছে, রাজনীতি এখন সুবিধা ও প্রতিশোধের খেলায় পরিণত হয়েছে। এখানে কোনো ন্যায়, কোনো নীতি নেই। ক্ষমতার খেলা চলছে, মানুষের জীবন অনিশ্চিত। অনিশ্চয়তারই নিশ্চয়তা দেয়া আছে এখানে, যেখানে মানুষ নিশ্চয়তা ভুলে গেছে। ভুলে যায়!

রাজনীতির সবচেয়ে বড় সঙ্কট হলো আস্থাহীনতা। দলগুলো যেন আস্থার ব্যবসায়ী, জনগণ সেই ব্যবসার ভোক্তা।

আজ যে দল গণতন্ত্রের মন্ত্র পড়ে, কাল ক্ষমতায় এসে বিরোধীদের গলা টিপে ধরছে। যে দল মব ভায়োলেন্সের

বিরুদ্ধে মানববন্ধন করছে, তারা কাল একই ভায়োলেন্সকে “অভিযোগ প্রমাণিত নয়” বলে হালকা করে। মানুষ তাই প্রশ্ন করতে শিখেছে- প্রশ্ন করলেই বিপদ।

এই সঙ্কট একদিনে তৈরি হয়নি। ধারাবাহিকতার অপশাসন, কেন্দ্রীকরণ, প্রশাসনের সঙ্গে দলীয় জোট, বিচার

ব্যবস্থায় অনিয়ম, এসব মিলে এমন একটি কাঠামো তৈরি হয়েছিল যা সরকার পতনের পর ধসে পড়েছে। পতনের ধসে চাপা পড়েছে রাজনীতির দায়বদ্ধতা। নতুন ক্ষমতাশালীরা মুখে বলে জনগণ কেন্দ্রিকতার কথা, কিন্তু মাঠে তাদের অগ্রাধিকার হলো নিজেদের অবস্থান শক্ত করা। আর এসব দশকের পর দশকের চিত্র। কেউ প্রত্যক্ষভাবে করছে, কেউ একে অপরের ওপর ভর দিয়ে করে যাচ্ছে। কিন্তু কেউই দায় নিতে নারাজ। চলতে থাকে দায় চাপানোর দৃঢ়

রাজনৈতিক খেল।

গণতন্ত্রের পরীক্ষা এখন হচ্ছে ক্ষমতার ভাগাভাগি। দলগুলো যত বেশি বিরোধী অবস্থানে দাঁড়ায়, তত বেশি ক্ষমতার সম্ভাবনার কাছে আসে। মানুষ তাই রাজনৈতিক নাটককে দর্শকের চোখে দেখে। মঞ্চে যুদ্ধ, ব্যাকস্টেজে চা-সিগারেট, এই দুই ধারা চলে। এক দল গেলে আরেক দলের সাম্রাজ্য দখলের হিড়িক। এর বলী হয় জনতা। অথচ সবাই আন্দোলনে জনতাকে পুঁজি করে স্লোগান দেয়, ক্ষমতা না জনতা? তারাই আবার বলে, জনতা জনতা। কিন্তু জনতাকে ঢাল বা বর্ম বানিয়ে আখেরে সবাই ক্ষমতার পূজারী। দিনশেষে ক্ষমতা-ই তাদের সব। জনতা তুচ্ছ!

প্রশ্ন করা মানুষের মৌলিক অধিকার, কিন্তু সেটি এখন ঝুঁকি। রাজনীতির ভাষা প্রতিনিয়ত বলে, অতিরিক্ত প্রশ্ন বিপদ ডেকে আনে। কিন্তু প্রশ্নই হলো জনগণের ভরসা। প্রশ্নই জবাবদিহির জন্ম দেয়। প্রশ্নই রাষ্ট্রকে সতর্ক রাখে। প্রশ্নই নেতাকে মানুষ কেন্দ্রিক করে, তোষামোদকারী নয়। আবার কখনো কখনো শাসকগোষ্ঠী কোন অভিযোগ তো নয়ই, সাধারণ প্রশ্নও কানে তোলে না। সেক্ষেত্রে তারা বধির সাজতে পছন্দ করে।

এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে দুশ্চিন্তার বিষয় হলো রাজনৈতিক দলগুলোর মনোভাব। তারা এখনো নিজেদের অবস্থান

পোক্ত করতে ব্যস্ত। গণতন্ত্র, মানবাধিকার, স্বচ্ছতা- এসবের কথা মুখে বললেও তারা মাঠে প্রমাণ করতে চায় না।

মানুষের জীবন, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, মৌলিক-মানবাধিকার, জবাবদিহি ব্যবস্থা, স্বচ্ছ মনোভাব, বিচার প্রাপ্তির

সাংবিধানিক নিশ্চয়তা, বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা, এসব এখনো তাদের জন্য কেবল ব্যাকগ্রাউন্ড।

মানুষ খেয়াল করে, রাজনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে জীবনযাত্রা পরিবর্তন হয় না। বরং পতনের পর অস্থিরতা বেশি

হয়। সরকার পরিবর্তিত হলেও প্রশাসন, রাজনৈতিক সংস্কৃতি, সামাজিক অভ্যাস, সব একই থাকে। ক্ষমতা বদলানোর খেলা মানুষকে দেখায় নাট্যরূপে, কিন্তু বাস্তবে পরিবর্তন আসে না। অথচ পরিবর্তনের ধোঁয়া তুলে সেই পরিবর্তন বা সংস্কারকেই নির্বাসনে পাঠাতে এতটুকুও সময়ক্ষেপণ করে না। সংস্কারের সংস্কার দরকারি হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু কার হাতে অর্পণ করা যাবে সেই দায়িত্ব? অথবা কে নেবে সেই ভার নিজ কাঁধে তুলে? আমাদের এমনই এক হতভাগ্য।

এই রাজনীতির অস্থিরতা বাড়ছে শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত। বাজারে মূল্যস্ফীতি, গ্যাস-বিদ্যুতের অস্থিতিশীলতা,

নিরাপত্তাহীনতা। লাগামহীন দুর্নীতির রাশ টানবে কে? এসব সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে দুর্বিষহ করে

তুলেছে। রাজনৈতিক দলগুলো মঞ্চে যতই আকর্ষণীয় ভাষণ দিক, মানুষের জীবনমানে বক্তৃতার কোনো প্রভাব পড়ছে না। তাই মানুষের প্রশ্ন, “আমরা কি নিরাপদ?” যতই অব্যাহত থাকে, নেতারা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। তারা বলেন, সময় লাগবে। সময় দিয়ে মানুষ ক্ষয়ে যাচ্ছে, সহনশীলতা হারাচ্ছে, জীবন ঝুঁকির মধ্যে যাচ্ছে। সবাইকে সময় দিতে হয়!

এ সময়ের ঘোড়া দৌড়ে, সংস্কার হয় না, উল্টো প্রতিশোধস্পৃহায় স্বরুপ ফিরে পেতে মরিয়া হয়ে পড়ে রাজনৈতিক দল ও দলের নেতারা। তা না হলে, ৫ আগস্টে সরকার পতনের পর এত এত গায়েবি মামলায় বাণিজ্য কি করে হয়? প্রশ্ন তোলা যাবে না। যেসব মামলায় অ্যাডভোকেট, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, সাংবাদিক, রাজনীতিক, সুশীল তথা অসহায় অরাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ, ব্যবসায়ী কেউ-ই বাদ যায়নি। এসব নিয়েও প্রশ্ন তোলা যায় না। ঢালাও অভিযোগের গতানুগতিক তদন্ত ও তদন্তের প্রক্রিয়া নিয়েও প্রশ্ন তোলা যায় না। তুললেও কেউ কানে নেয় না। রাষ্ট্র ক্ষমতাশালীদের বধির হতে শিখিয়েছে অভিযোগ শোনার ক্ষেত্রে। নিন্দা ঠিকই শুনতে পায়, দমন করতে সর্বস্ব উজাড় করে লেগে যায়। সেই পুরনো পথের পথিক!

জাতীয় সমঝোতার চাহিদা এই সময়ে সবচেয়ে প্রবল। কিন্তু দলগুলো নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে ব্যস্ত।

গণতন্ত্রের সহজতম ব্যাখ্যা হলো, সহমতের রাজনীতি। এখানে সহমত তৈরি হয় কেবল তখনই, যখন ক্ষমতার

ভাগাভাগির সুযোগ থাকে। জনগণ রাজনৈতিক সহমতের স্বপ্ন দেখে, কিন্তু বাস্তবে দেখছে ক্ষমতার জন্য নাটক। মত-অভিমত, ভিন্নমত সবকিছু পিষ্ট করতে চায় নির্দলীয় সরকারও। আদতে নির্দলীয় কিছু কি আছে? না না প্রশ্ন করছি না। মত প্রকাশের অধিকারের নামে প্রশ্ন করা বারণ অঘোষিত ভাবে।

দেশ যে প্রশ্ন করার অধিকার হারাচ্ছে, তা চরম বিপদের সংকেত। প্রশ্নের অধিকার রক্ষা না হলে গণতন্ত্র টিকে

থাকতে পারে না। সাংবাদিক, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, সাধারণ নাগরিক- সবাই জানে, প্রশ্ন করা ঝুঁকিপূর্ণ। কতজন

সাংবাদিক কলম ধরে লিখতে লিখতে ভেঙে গেছে, কতজন শিক্ষক ক্লাসে নিরাপদ ভাষার ব্যবহার করছে, এই হিসাব সরকারি খাতায় নেই।

নতুন ক্ষমতাশালীদের দাবি, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার হচ্ছে। কিন্তু গণতন্ত্রের প্রথম শর্ত হলো, প্রশ্নের স্বাধীনতা। সেখানে এখনো বহু ফাঁক, বহু চ্যালেঞ্জ। যারা গতকাল মঞ্চে দাঁড়িয়ে জবাবদিহির কথা বলেছিল, আজ তারা সংসদে প্রোটোকলের মধ্যেই হাঁটছে। যারা গতকাল কঠোর শাসন করছিল, তারা আজ মানবিকতার কথা বলছে। এই মায়াবী রূপান্তর মানুষকে শেখায়, রাজনীতির মূল শিক্ষা হলো ভুলে যাওয়ার ক্ষমতা। ভুলে গেলে স্বস্তি, ভুলে গেলে উন্নতি, ভুলে গেলে দল বদলানো যায়। আর তা-ই কি নিকট অতীত দূরবর্তী অতীতকে ভুলিয়ে দেয়।

কিন্তু বাস্তবতা ভুলে যায় না। বাজারের দাম কমছে না, বিদ্যুৎ-গ্যাসের অস্থিতিশীলতা কমছে না, নিরাপত্তাহীনতা

বাড়ছে। রাজনৈতিক দলগুলো মঞ্চে যতই বক্তৃতা দিক, মানুষের পকেটে কোনো প্রভাব নেই। তাই মানুষ প্রশ্ন করে, “বদল আসবে কি?” “উন্নতি কি আসবে?” নেতারা বলেন, “সময় লাগবে।” অথচ সময় মানুষের জীবনে ক্ষয় ঘটাচ্ছে। আর কত সময় লাগবে? তা-ও সুনির্দিষ্ট হোক।

রাজনীতির এই অস্থিরতার শেষ কোথায় কারও জানা নেই। দেশের নাগরিকরা চায় সত্যিকারের স্থিতি। স্থিতি মানে

নিরাপত্তা, স্বস্তি, অধিকার, জবাবদিহি। কিন্তু দলগুলো এখনো নিজেদের পুনর্গঠনে ব্যস্ত। মানুষ দর্শক, তাদের

হাতে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। শুধু গভীর দীর্ঘশ্বাস এবং দহনমাখা অপেক্ষা। শাসক তথা রাজনীতিবিদদেরও

বোধগম্যতা থাকতে হবে, জনগণেরও ধৈর্যচ্যুতি ঘটে।

সবিশেষ, রাজনৈতিক পরিবর্তনের ইতিহাস বলে, যে সমাজে প্রশ্নের মূল্য নেই, সেখানে স্থিতি টিকে না। যে রাষ্ট্র

প্রশ্নকে ভয় পায়, সে রাষ্ট্র নিজের প্রতিচ্ছবিকেই ভয় পায়। যে রাজনীতি প্রশ্নকে অবজ্ঞা করে, তা টিকে থাকে

কেবল মানুষের ভয় ধরে রাখার মাধ্যমে। তবু আশা আছে। মানুষের মনে প্রশ্নের আগুন এখনও আছে। যে দিন মানুষ বলবে, “প্রশ্ন করাই আমার অধিকার”, সেদিন রাজনীতি বদলে যাবে। আর সেই দিন, গানের লাইনটি, “প্রশ্ন কোরো না, প্রশ্ন সর্বনাশী,” বদলে যাবে। তখন প্রশ্নই হবে মুক্তির কণ্ঠ, গণতন্ত্রের প্রেরণা এবং দেশের সত্যিকারের উন্নতির মূল। ক্ষমতার ইতিহাস যতবারই নিজেদের নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছে, সত্যের ইতিহাস সবসময় প্রশ্নের পাশে দাঁড়িয়েছে। মানুষ আজও অপেক্ষা করছে। একদিন সেই মুক্তির প্রশ্ন উঠবে, এবং তখনই রাজনীতি শিখবে- প্রশ্নই সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তি।

[লেখক: অ্যাডভোকেট, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ফেনী]

back to top