মিহির কুমার রায়
এসেছে অগ্রহায়ণ, হিমেল হেমন্তের দিন। এই সময়টিই নবান্নের মৌসুম-বাঙালির কৃষিভিত্তিক জীবনের সবচেয়ে প্রাচীন উৎসব। নতুন আমন ধান কাটার পর সেই ধানের চাল দিয়ে নবান্ন আয়োজন করা হয়। হিন্দু লোককথায় দিনটি ধরা হয় বার্ষিক মাঙ্গলিক দিন হিসেবে। নতুন চালের ভাত, পিঠাপুলি আর নানা রান্নায় মুখর হয়ে ওঠে গ্রাম-জনপদ। মেয়েরা অনেক জায়গায় বাবার বাড়ি আসে নাইওর হিসেবে। কোথাও নতুন ভাত মুখে দেওয়ার আগে দোয়া, মসজিদে শিন্নি দেওয়ার প্রচলন আছে। হিন্দু কৃষকের ঘরে চলে পূজার আয়োজন। তারা নতুন অন্ন পিতৃপুরুষ, দেবতা, কাকসহ জীবজন্তুকে উৎসর্গ করেন, তারপর নিজেরা নবান্ন গ্রহণ করেন। ‘কাকবলি’ নামে পরিচিত এই নৈবেদ্যকে লোকবিশ্বাসে মৃতের আত্মার খাদ্য বলে মনে করা হয়।
ঢাকা, চট্টগ্রামসহ সারা দেশে এখন নবান্ন উৎসবের আয়োজন চলছে। অগ্রহায়ণের প্রথম দিনকে ‘আদি নববর্ষ’ হিসেবে ঘোষণা করেছে ডাকসু। বহু এলাকায় বসেছে গ্রামীণ মেলা, যা মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে। কৃষক ঘরে তুলছেন “রাশি রাশি সোনার ধান”। কুয়াশা মোড়া সকাল, ধান ভাঙার শব্দ, ঢেঁকির তালে মুখর বাড়িঘর-এসব মিলিয়ে হেমন্তের এক বিশেষ সৌরভ ছড়িয়ে পড়ে। যদিও যান্ত্রিকতার কারণে এখন আর ঢেঁকির শব্দ শোনা যায় না, তবুও উৎসবের আনন্দ হারিয়ে যায়নি।
হেমন্ত এলে শুরু হয় খেজুরের রস সংগ্রহ। নতুন রস আর নতুন চালের পিঠার স্বাদ বাঙালির সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ। লোকগবেষকেরা মনে করেন, কৃষিপ্রথা চালুর পর থেকেই চলে আসছে এই নবান্ন উৎসব। অগ্রহায়ণ একসময় বাংলা বছরের প্রথম মাস ছিল-‘অগ্র’ মানে প্রথম, ‘হায়ণ’ মানে মাস।
নবান্নের এই উৎসব কেবল কৃষকের নয়-বাংলার সার্বজনীন সংস্কৃতির অংশ। আমাদের দায়িত্ব, এই আবহমান সংস্কৃতি রক্ষা করা এবং অসাম্প্রদায়িক এক সোনার বাংলা গড়ে তোলা।
নতুন আমন ধানের সুগন্ধে এখন ভরে উঠেছে দেশের কৃষক-আঙিনা। ধান কাটা ও মাড়াইয়ে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন কৃষকেরা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, দেশে এখন পর্যন্ত ৬০-৭০ শতাংশ জমির ধান কাটা শেষ হয়েছে। হাট-বাজার ভরে গেছে নতুন ধানে।
যদিও অতিবৃষ্টি, বন্যা ও জলাবদ্ধতার কারণে কিছু এলাকায় ক্ষতি হয়েছে, তবে সামগ্রিকভাবে ফলন ভালো। উৎপাদনের সঠিক হিসাব জানতে পুরো ধান কাটা শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। কৃষকেরা বলছেন, বাজারে যে দাম পাচ্ছেন তাতে তারা সন্তুষ্ট।
২০২৫-২৬ মৌসুমে আমনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫৭ লাখ হেক্টর জমিতে চাষ, অনুমিত উৎপাদন প্রায় ১ কোটি ৭৮ লাখ মেট্রিক টন। দিনাজপুর, সুনামগঞ্জ, চট্টগ্রাম, নেত্রকোনা-এ ধরনের বেশ কয়েকটি জেলায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি জমিতে আমন চাষ হয়েছে। বিগত কয়েক বছর ধরেই হেক্টরপ্রতি উৎপাদন বাড়ছে।
এখন স্বল্প ও মধ্যম মেয়াদি আমনের ধান কাটায় ব্যস্ত কৃষকরা-বিশেষ করে নরসিংদী, রায়পুরা, মনোহরদী, বেলাব, শিবপুরাঞ্চলে ধান কাটা উৎসবের আমেজ তৈরি হয়েছে। সময়মতো বৃষ্টি হওয়ায় ধানের ফলন ভালো হয়েছে, জানান কর্মকর্তারা।
অনেক কৃষক নিজেদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করে বলেছেন, কোথাও কোথাও ইঁদুরের আক্রমণে ক্ষতি হলেও সামগ্রিকভাবে ফলন ভালো। কেউ পাচ্ছেন একরপ্রতি ৪০-৫২ মণ পর্যন্ত ধান। কোথাও কারেন্ট পোকার আক্রমণে ফলন কম, তবে দাম ভালো পাওয়ায় কৃষকদের লাভ হচ্ছে।
রায়গঞ্জ, শিলমান্দী, সিরাজগঞ্জ-বেশির ভাগ জায়গায় ধান কাটা ৬৫ শতাংশ সম্পন্ন। দু’সপ্তাহের মধ্যে বাকিটাও শেষ হবে বলে কৃষি অফিস জানাচ্ছে। নয়া জাতের ব্রিধান ১০৩, ১০৮, ১১০ ইত্যাদি এবং সঠিক সময়ে বালাই নিয়ন্ত্রণের কারণে ফলন বেশি হয়েছে। যদিও শুরুতে অতিবৃষ্টিতে কয়েকটি অঞ্চলে চাষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, তারপরও মোট উৎপাদন ভালোই হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
[লেখক: সাবেক ডিন (ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ) ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা]
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
মিহির কুমার রায়
সোমবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৫
এসেছে অগ্রহায়ণ, হিমেল হেমন্তের দিন। এই সময়টিই নবান্নের মৌসুম-বাঙালির কৃষিভিত্তিক জীবনের সবচেয়ে প্রাচীন উৎসব। নতুন আমন ধান কাটার পর সেই ধানের চাল দিয়ে নবান্ন আয়োজন করা হয়। হিন্দু লোককথায় দিনটি ধরা হয় বার্ষিক মাঙ্গলিক দিন হিসেবে। নতুন চালের ভাত, পিঠাপুলি আর নানা রান্নায় মুখর হয়ে ওঠে গ্রাম-জনপদ। মেয়েরা অনেক জায়গায় বাবার বাড়ি আসে নাইওর হিসেবে। কোথাও নতুন ভাত মুখে দেওয়ার আগে দোয়া, মসজিদে শিন্নি দেওয়ার প্রচলন আছে। হিন্দু কৃষকের ঘরে চলে পূজার আয়োজন। তারা নতুন অন্ন পিতৃপুরুষ, দেবতা, কাকসহ জীবজন্তুকে উৎসর্গ করেন, তারপর নিজেরা নবান্ন গ্রহণ করেন। ‘কাকবলি’ নামে পরিচিত এই নৈবেদ্যকে লোকবিশ্বাসে মৃতের আত্মার খাদ্য বলে মনে করা হয়।
ঢাকা, চট্টগ্রামসহ সারা দেশে এখন নবান্ন উৎসবের আয়োজন চলছে। অগ্রহায়ণের প্রথম দিনকে ‘আদি নববর্ষ’ হিসেবে ঘোষণা করেছে ডাকসু। বহু এলাকায় বসেছে গ্রামীণ মেলা, যা মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে। কৃষক ঘরে তুলছেন “রাশি রাশি সোনার ধান”। কুয়াশা মোড়া সকাল, ধান ভাঙার শব্দ, ঢেঁকির তালে মুখর বাড়িঘর-এসব মিলিয়ে হেমন্তের এক বিশেষ সৌরভ ছড়িয়ে পড়ে। যদিও যান্ত্রিকতার কারণে এখন আর ঢেঁকির শব্দ শোনা যায় না, তবুও উৎসবের আনন্দ হারিয়ে যায়নি।
হেমন্ত এলে শুরু হয় খেজুরের রস সংগ্রহ। নতুন রস আর নতুন চালের পিঠার স্বাদ বাঙালির সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ। লোকগবেষকেরা মনে করেন, কৃষিপ্রথা চালুর পর থেকেই চলে আসছে এই নবান্ন উৎসব। অগ্রহায়ণ একসময় বাংলা বছরের প্রথম মাস ছিল-‘অগ্র’ মানে প্রথম, ‘হায়ণ’ মানে মাস।
নবান্নের এই উৎসব কেবল কৃষকের নয়-বাংলার সার্বজনীন সংস্কৃতির অংশ। আমাদের দায়িত্ব, এই আবহমান সংস্কৃতি রক্ষা করা এবং অসাম্প্রদায়িক এক সোনার বাংলা গড়ে তোলা।
নতুন আমন ধানের সুগন্ধে এখন ভরে উঠেছে দেশের কৃষক-আঙিনা। ধান কাটা ও মাড়াইয়ে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন কৃষকেরা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, দেশে এখন পর্যন্ত ৬০-৭০ শতাংশ জমির ধান কাটা শেষ হয়েছে। হাট-বাজার ভরে গেছে নতুন ধানে।
যদিও অতিবৃষ্টি, বন্যা ও জলাবদ্ধতার কারণে কিছু এলাকায় ক্ষতি হয়েছে, তবে সামগ্রিকভাবে ফলন ভালো। উৎপাদনের সঠিক হিসাব জানতে পুরো ধান কাটা শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। কৃষকেরা বলছেন, বাজারে যে দাম পাচ্ছেন তাতে তারা সন্তুষ্ট।
২০২৫-২৬ মৌসুমে আমনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫৭ লাখ হেক্টর জমিতে চাষ, অনুমিত উৎপাদন প্রায় ১ কোটি ৭৮ লাখ মেট্রিক টন। দিনাজপুর, সুনামগঞ্জ, চট্টগ্রাম, নেত্রকোনা-এ ধরনের বেশ কয়েকটি জেলায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি জমিতে আমন চাষ হয়েছে। বিগত কয়েক বছর ধরেই হেক্টরপ্রতি উৎপাদন বাড়ছে।
এখন স্বল্প ও মধ্যম মেয়াদি আমনের ধান কাটায় ব্যস্ত কৃষকরা-বিশেষ করে নরসিংদী, রায়পুরা, মনোহরদী, বেলাব, শিবপুরাঞ্চলে ধান কাটা উৎসবের আমেজ তৈরি হয়েছে। সময়মতো বৃষ্টি হওয়ায় ধানের ফলন ভালো হয়েছে, জানান কর্মকর্তারা।
অনেক কৃষক নিজেদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করে বলেছেন, কোথাও কোথাও ইঁদুরের আক্রমণে ক্ষতি হলেও সামগ্রিকভাবে ফলন ভালো। কেউ পাচ্ছেন একরপ্রতি ৪০-৫২ মণ পর্যন্ত ধান। কোথাও কারেন্ট পোকার আক্রমণে ফলন কম, তবে দাম ভালো পাওয়ায় কৃষকদের লাভ হচ্ছে।
রায়গঞ্জ, শিলমান্দী, সিরাজগঞ্জ-বেশির ভাগ জায়গায় ধান কাটা ৬৫ শতাংশ সম্পন্ন। দু’সপ্তাহের মধ্যে বাকিটাও শেষ হবে বলে কৃষি অফিস জানাচ্ছে। নয়া জাতের ব্রিধান ১০৩, ১০৮, ১১০ ইত্যাদি এবং সঠিক সময়ে বালাই নিয়ন্ত্রণের কারণে ফলন বেশি হয়েছে। যদিও শুরুতে অতিবৃষ্টিতে কয়েকটি অঞ্চলে চাষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, তারপরও মোট উৎপাদন ভালোই হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
[লেখক: সাবেক ডিন (ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ) ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা]