শতদল বড়ুয়া
রসনাবিলাসে শুটকির কোনো তুলনা নেই। চট্টগ্রামের শুটকি দেশ-বিদেশে পরিচিত এক সুস্বাদু খাদ্য। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের অগ্নিমূল্যের আঁচ শুটকির বাজারেও লেগেছে, তবে চট্টগ্রামের এমন কোনো পরিবার নেই যারা শুটকি খায় না। ভোজনবিলাসী হোক বা সীমিত সামর্থ্যের মানুষ-শুটকি সবারই প্রিয়। শুটকির দাম যেভাবে বাড়ছে, মনে হয় ভবিষ্যতে তা শিশুদের পাঠ্যবইয়ের বিরল দ্রব্যের তালিকায় স্থান পেতে পারে। দাম বাড়ার পেছনে যথেষ্ট কারণও রয়েছে। সরেজমিনে যে অভিজ্ঞতা পাওয়া যায়, তা কোনোভাবেই আশাব্যঞ্জক নয়।
শুটকি পট্টির জন্মকথা : চট্টগ্রাম নগরের আছদগঞ্জ বর্তমানে শুটকি পট্টি নামে পরিচিত। প্রায় দেড়শো বছর আগে নজুমিয়া সওদাগর ও নগেন্দ্রলাল বড়ুয়া কপার্স সূতা এবং পাহাড়ি রবিশস্যের ব্যবসা করতেন। কর্ণফুলীর তীরে একটি নতুন চর দেখা দিলে তারা সেটি লিজ নেওয়ার উদ্যোগ নেন। নগেন্দ্রলাল বড়ুয়া পারিবারিক কারণে অর্থ দিতে না পারলেও নজুমিয়া সওদাগর পিছিয়ে যাননি। তিনি হাটহাজারীর খন্দকিয়া গ্রামের হরেকৃষ্ণ মহাজনকে সঙ্গে নিয়ে চর লিজ নেন। শুরুতে ছোট দুই-একটি ঘর তুলে ব্যবসা শুরু হয়। পরে নগেন্দ্রলাল বড়ুয়াও যুক্ত হন। ব্যবসার মূল উদ্যোক্তা দুজন হলেও মতের অমিল ছিল না। নজুমিয়া সওদাগর ও নগেন্দ্রলাল বড়ুয়া তাঁদের আত্মীয়স্বজন ও গ্রামের মানুষদের ব্যবসায় যুক্ত করেন। এভাবেই কর্ণফুলীর চরটি ধীরে ধীরে শুটকি পট্টি বা আছদগঞ্জ নামে পরিচিত হয়। আছদগঞ্জ নামের উৎস নির্দিষ্টভাবে জানা যায়নি। ব্রিটিশ আমলে বৌদ্ধ সম্প্রদায় এখানে ব্যবসায় সবচেয়ে সক্রিয় ছিল। মুসলমানরাও টিকে থাকলেও হিন্দু সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ কমে আসে। তবে তিন সম্প্রদায়ের মধ্যে জাতিগত বিভেদ ছিল না; বরং সহযোগিতা ও আন্তরিকতা ছিল প্রশংসনীয়। তাঁদের অঙ্গীকার ছিল-“প্রয়োজনে জীবন দেবো, কিন্তু ব্যবসার মান অক্ষুণ্য রাখব।”
শুটকি ব্যবসার প্রথম যুগ : নোয়াপাড়া, মোহরা, কধুরখীল, চরণদ্বীপ, কালুরঘাট, শিকলবাহা, জুলধা-এলাকার জেলেরা সাগরে মাছ ধরতেন। প্রয়োজনের মাছ বিক্রি করে বাকি মাছ রোদে শুকিয়ে রাখতেন। আছদগঞ্জের ব্যবসায়ীরা নৌকায় এসব জায়গায় গিয়ে শুটকি কিনে আনতেন এবং আড়তে বিক্রি করতেন।
শুটকি তৈরির সময় ও প্রক্রিয়া : কার্তিকের শেষ থেকে ফাল্গুনের শেষ পর্যন্ত তিন-চার মাস শুটকি তৈরির মৌসুম। আগে ইঞ্জিনবোট না থাকায় কাঠের নৌকায় ১০০–১৫০ মাঝিমাল্লা সাগরে যেতেন। মাছ ধরে তীরে এনে রোদে শুকানো হতো। জলদাশ সম্প্রদায় এ কাজে দক্ষ হওয়ায় তাঁদের চাহিদা ছিল বেশি। তবে খরচের তুলনায় আয় কম হওয়ায় তাঁদের জীবনযাপন ছিল কষ্টকর।
বহরদার ও তাদের গল্প : যাঁদের একাধিক বোট থাকত, তাঁরা ‘বহরদার’ নামে পরিচিত হতেন। “জাল যার, মাছ তার”-এই নীতিতে বেশি জালের মালিক বেশি মাছ পেতেন। শুটকি ব্যবসার অনেক গল্পের একটি হলো: এক বহরদার সুন্দরবনের নদীতে জাল ফেলতে গিয়ে হঠাৎ বাঘের আক্রমণে নিখোঁজ হয়ে যান। জেলেরা বাঘটিকে ‘মামা’ বলে সম্বোধন করত-এও এই অঞ্চলের চিরাচরিত প্রথা।
শুটকি বন্দরের সূচনা : পাকিস্তান আমলে শুটকি পট্টিতে ‘বন্দর’ বা আড়ত ব্যবস্থার সূচনা হয়। এতে শুটকি ব্যবসা দুইভাগে বিভক্ত হয়-আড়তদার ও খুচরা ব্যবসায়ী। জেলেরা ও বোট মালিকরা শুটকি আড়তে এনে বিক্রি করত, আর খুচরা ব্যবসায়ীরা সেখান থেকে কিনে শহর কিংবা মফস্বলে সরবরাহ করত। এই ব্যবস্থা আজও বহাল রয়েছে।
পেশার মর্যাদা : এক আড়তদার আক্ষেপ করে বলেন-শুটকি কম করে হলেও তিন হাত বদল হয়ে ভোক্তার কাছে পৌঁছায়। অথচ অনেকে শুটকি ব্যবসাকে তুচ্ছ করেন। বাস্তবে প্রতিটি পেশাই সম্মানজনক, আর শুটকি রপ্তানির মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিও লাভবান হয়।
মাছ আহরণের বিখ্যাত স্থান : সুন্দরবনের রাঙাবালি ও সোনাদিয়ার শুটকি গুণগত মানে সেরা। আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হলো বাইশদিয়া, আলোরকূল, নারিকেল, টেকনাফ, কক্সবাজার, শাহপরীরদ্বীপ ও কাপ্তাই।
শুটকির রাজার আসন : লাক্ষা শুটকি মাছের রাজা হিসেবে পরিচিত-এক কেজির দাম এখন কয়েক হাজার টাকা। দেখতে লাক্ষার মতো হওয়ায় অনেকে ভোলপোপা কিনে ঠকে যায়। রূপচান্দা শুটকির দামও আকাশচুম্বী; অতিরিক্ত লবণ ব্যবহারে এর স্বাদে ভিন্নতা আসে।
ইছা শুটকি, ফাঁইস্যা, ইলিশ শুটকি, লইট্টা, পোপা, ছুরি, সিলেটি শুটকি-এ ছাড়াও আরও বহু জাত রয়েছে।
শুটকি পট্টির অবস্থান ও বিস্তার : কর্ণফুলীর উত্তর তীর, নতুন চাকতাই বাজারের লাগোয়া এলাকা-এটাই শুটকি পট্টি। খাতুনগঞ্জ থেকে ওসমানিয়া গলি পার হলেই আছদগঞ্জ। আগে দুটি সেতুর মাঝখানে সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন এর বিস্তার অনেক বেড়েছে। অনেকে বলেন-আগের মতো মানের শুটকি এখন পাওয়া যায় না। কারণ একসময় বাজারে বিক্রি না হওয়া ইলিশ শুটকি তৈরির জন্য আছদগঞ্জে আসত। এখন ইলিশ এত দামি যে বিক্রেতারা কাঁচাই বিক্রি করে বেশি লাভ পান-তাই শুটকি বানানোর দরকার হয় না। একই অবস্থা লাক্ষা, রূপচান্দা ও অন্যান্য মাছেও। বাজারে শুকানোর আগেই মাছ খুচরায় বেশি দামে বিক্রি হয়ে যায়। সবচেয়ে বড় সংকট-সাগরে আগের মতো মাছ নেই। জেলেরা অল্প মাছ নিয়ে কূলে ফিরছে, আর এর ধাক্কা লেগেছে পুরো বাজারে। ভবিষ্যতে শুটকি কোন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়াবে-কেউই নিশ্চিত নই।
[লেখক: প্রাবন্ধিক]
ইপেপার
জাতীয়
সারাদেশ
আন্তর্জাতিক
নগর-মহানগর
খেলা
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
শিক্ষা
অর্থ-বাণিজ্য
সংস্কৃতি
ক্যাম্পাস
মিডিয়া
অপরাধ ও দুর্নীতি
রাজনীতি
শোক ও স্মরন
প্রবাস
নারীর প্রতি সহিংসতা
বিনোদন
সম্পাদকীয়
উপ-সম্পাদকীয়
মুক্ত আলোচনা
চিঠিপত্র
পাঠকের চিঠি
শতদল বড়ুয়া
মঙ্গলবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৫
রসনাবিলাসে শুটকির কোনো তুলনা নেই। চট্টগ্রামের শুটকি দেশ-বিদেশে পরিচিত এক সুস্বাদু খাদ্য। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের অগ্নিমূল্যের আঁচ শুটকির বাজারেও লেগেছে, তবে চট্টগ্রামের এমন কোনো পরিবার নেই যারা শুটকি খায় না। ভোজনবিলাসী হোক বা সীমিত সামর্থ্যের মানুষ-শুটকি সবারই প্রিয়। শুটকির দাম যেভাবে বাড়ছে, মনে হয় ভবিষ্যতে তা শিশুদের পাঠ্যবইয়ের বিরল দ্রব্যের তালিকায় স্থান পেতে পারে। দাম বাড়ার পেছনে যথেষ্ট কারণও রয়েছে। সরেজমিনে যে অভিজ্ঞতা পাওয়া যায়, তা কোনোভাবেই আশাব্যঞ্জক নয়।
শুটকি পট্টির জন্মকথা : চট্টগ্রাম নগরের আছদগঞ্জ বর্তমানে শুটকি পট্টি নামে পরিচিত। প্রায় দেড়শো বছর আগে নজুমিয়া সওদাগর ও নগেন্দ্রলাল বড়ুয়া কপার্স সূতা এবং পাহাড়ি রবিশস্যের ব্যবসা করতেন। কর্ণফুলীর তীরে একটি নতুন চর দেখা দিলে তারা সেটি লিজ নেওয়ার উদ্যোগ নেন। নগেন্দ্রলাল বড়ুয়া পারিবারিক কারণে অর্থ দিতে না পারলেও নজুমিয়া সওদাগর পিছিয়ে যাননি। তিনি হাটহাজারীর খন্দকিয়া গ্রামের হরেকৃষ্ণ মহাজনকে সঙ্গে নিয়ে চর লিজ নেন। শুরুতে ছোট দুই-একটি ঘর তুলে ব্যবসা শুরু হয়। পরে নগেন্দ্রলাল বড়ুয়াও যুক্ত হন। ব্যবসার মূল উদ্যোক্তা দুজন হলেও মতের অমিল ছিল না। নজুমিয়া সওদাগর ও নগেন্দ্রলাল বড়ুয়া তাঁদের আত্মীয়স্বজন ও গ্রামের মানুষদের ব্যবসায় যুক্ত করেন। এভাবেই কর্ণফুলীর চরটি ধীরে ধীরে শুটকি পট্টি বা আছদগঞ্জ নামে পরিচিত হয়। আছদগঞ্জ নামের উৎস নির্দিষ্টভাবে জানা যায়নি। ব্রিটিশ আমলে বৌদ্ধ সম্প্রদায় এখানে ব্যবসায় সবচেয়ে সক্রিয় ছিল। মুসলমানরাও টিকে থাকলেও হিন্দু সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ কমে আসে। তবে তিন সম্প্রদায়ের মধ্যে জাতিগত বিভেদ ছিল না; বরং সহযোগিতা ও আন্তরিকতা ছিল প্রশংসনীয়। তাঁদের অঙ্গীকার ছিল-“প্রয়োজনে জীবন দেবো, কিন্তু ব্যবসার মান অক্ষুণ্য রাখব।”
শুটকি ব্যবসার প্রথম যুগ : নোয়াপাড়া, মোহরা, কধুরখীল, চরণদ্বীপ, কালুরঘাট, শিকলবাহা, জুলধা-এলাকার জেলেরা সাগরে মাছ ধরতেন। প্রয়োজনের মাছ বিক্রি করে বাকি মাছ রোদে শুকিয়ে রাখতেন। আছদগঞ্জের ব্যবসায়ীরা নৌকায় এসব জায়গায় গিয়ে শুটকি কিনে আনতেন এবং আড়তে বিক্রি করতেন।
শুটকি তৈরির সময় ও প্রক্রিয়া : কার্তিকের শেষ থেকে ফাল্গুনের শেষ পর্যন্ত তিন-চার মাস শুটকি তৈরির মৌসুম। আগে ইঞ্জিনবোট না থাকায় কাঠের নৌকায় ১০০–১৫০ মাঝিমাল্লা সাগরে যেতেন। মাছ ধরে তীরে এনে রোদে শুকানো হতো। জলদাশ সম্প্রদায় এ কাজে দক্ষ হওয়ায় তাঁদের চাহিদা ছিল বেশি। তবে খরচের তুলনায় আয় কম হওয়ায় তাঁদের জীবনযাপন ছিল কষ্টকর।
বহরদার ও তাদের গল্প : যাঁদের একাধিক বোট থাকত, তাঁরা ‘বহরদার’ নামে পরিচিত হতেন। “জাল যার, মাছ তার”-এই নীতিতে বেশি জালের মালিক বেশি মাছ পেতেন। শুটকি ব্যবসার অনেক গল্পের একটি হলো: এক বহরদার সুন্দরবনের নদীতে জাল ফেলতে গিয়ে হঠাৎ বাঘের আক্রমণে নিখোঁজ হয়ে যান। জেলেরা বাঘটিকে ‘মামা’ বলে সম্বোধন করত-এও এই অঞ্চলের চিরাচরিত প্রথা।
শুটকি বন্দরের সূচনা : পাকিস্তান আমলে শুটকি পট্টিতে ‘বন্দর’ বা আড়ত ব্যবস্থার সূচনা হয়। এতে শুটকি ব্যবসা দুইভাগে বিভক্ত হয়-আড়তদার ও খুচরা ব্যবসায়ী। জেলেরা ও বোট মালিকরা শুটকি আড়তে এনে বিক্রি করত, আর খুচরা ব্যবসায়ীরা সেখান থেকে কিনে শহর কিংবা মফস্বলে সরবরাহ করত। এই ব্যবস্থা আজও বহাল রয়েছে।
পেশার মর্যাদা : এক আড়তদার আক্ষেপ করে বলেন-শুটকি কম করে হলেও তিন হাত বদল হয়ে ভোক্তার কাছে পৌঁছায়। অথচ অনেকে শুটকি ব্যবসাকে তুচ্ছ করেন। বাস্তবে প্রতিটি পেশাই সম্মানজনক, আর শুটকি রপ্তানির মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিও লাভবান হয়।
মাছ আহরণের বিখ্যাত স্থান : সুন্দরবনের রাঙাবালি ও সোনাদিয়ার শুটকি গুণগত মানে সেরা। আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হলো বাইশদিয়া, আলোরকূল, নারিকেল, টেকনাফ, কক্সবাজার, শাহপরীরদ্বীপ ও কাপ্তাই।
শুটকির রাজার আসন : লাক্ষা শুটকি মাছের রাজা হিসেবে পরিচিত-এক কেজির দাম এখন কয়েক হাজার টাকা। দেখতে লাক্ষার মতো হওয়ায় অনেকে ভোলপোপা কিনে ঠকে যায়। রূপচান্দা শুটকির দামও আকাশচুম্বী; অতিরিক্ত লবণ ব্যবহারে এর স্বাদে ভিন্নতা আসে।
ইছা শুটকি, ফাঁইস্যা, ইলিশ শুটকি, লইট্টা, পোপা, ছুরি, সিলেটি শুটকি-এ ছাড়াও আরও বহু জাত রয়েছে।
শুটকি পট্টির অবস্থান ও বিস্তার : কর্ণফুলীর উত্তর তীর, নতুন চাকতাই বাজারের লাগোয়া এলাকা-এটাই শুটকি পট্টি। খাতুনগঞ্জ থেকে ওসমানিয়া গলি পার হলেই আছদগঞ্জ। আগে দুটি সেতুর মাঝখানে সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন এর বিস্তার অনেক বেড়েছে। অনেকে বলেন-আগের মতো মানের শুটকি এখন পাওয়া যায় না। কারণ একসময় বাজারে বিক্রি না হওয়া ইলিশ শুটকি তৈরির জন্য আছদগঞ্জে আসত। এখন ইলিশ এত দামি যে বিক্রেতারা কাঁচাই বিক্রি করে বেশি লাভ পান-তাই শুটকি বানানোর দরকার হয় না। একই অবস্থা লাক্ষা, রূপচান্দা ও অন্যান্য মাছেও। বাজারে শুকানোর আগেই মাছ খুচরায় বেশি দামে বিক্রি হয়ে যায়। সবচেয়ে বড় সংকট-সাগরে আগের মতো মাছ নেই। জেলেরা অল্প মাছ নিয়ে কূলে ফিরছে, আর এর ধাক্কা লেগেছে পুরো বাজারে। ভবিষ্যতে শুটকি কোন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়াবে-কেউই নিশ্চিত নই।
[লেখক: প্রাবন্ধিক]