alt

উপ-সম্পাদকীয়

মেডিকেল বর্জ্য অব্যবস্থাপনা, দায় কার?

মল্লিক আকরাম হোসেন ও সানজিয়া মহিউদ্দিন

: বৃহস্পতিবার, ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২১

চিকিৎসাসেবা আমাদের জীবন ও স্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য। কিন্তু চিকিৎসাসেবা কার্যক্রম থেকে উৎপন্ন বর্জ্য মানুষ এবং তার আশপাশের পরিবেশের জন্য একটি মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে। মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সম্প্রতি বিশ্বব্যাপী প্রধান উদ্বেগের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। মেডিকেল বর্জ্যরে দুর্বল ব্যবস্থাপনা বা অব্যবস্থাপনা মানুষ এবং পরিবেশের ওপর সরাসরি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। প্রতিদিন বিপুল পরিমাণে সম্ভাব্য সংক্রামক এবং বিপজ্জনক বর্জ্য সারা বিশ্বের স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোতে উৎপন্ন হয়। মেডিকেল বর্র্জ্য পরিবেশগত স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করে। এজন্য মেডিকেল বর্জ্যরে ক্ষেত্রে চূড়ান্ত ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন। বর্জ্য উৎপাদনকারী, ব্যবস্থাপনার সাথে জড়িত এবং যে এলাকায় এসব ব্যবস্থাপনা করা হয় এর আশপাশে বসবাসকারীদের জন্য স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করতে পারে। বিশেষ করে চিকিৎসা বর্জ্য হেপাটাইটিস বি/সি এবং আলডিএস (এইচআইভি) স্বাস্থ্যের সংক্রমণের মতো রোগ সৃষ্টি করতে পারে। এছাড়া করোনা মহামারীতে এমন দুর্বল মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। বিশেষ করে করোনায় সেটি আরো ভয়ানক অবস্থা ধারণ করেছে সন্দেহ নেই।

প্রায় ১৬০ মিলিয়ন মানুষের শহর রাজধানী ঢাকা। এত বিপুল মানুষের শহরে মেডিকেল বর্জ্যরে অব্যবস্থাপনা নগরের পরিবেশ এবং শহরবাসীর স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক পরিণতি ঘটাচ্ছে। জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগে ২০১৭ সালে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে আমার তত্ত্বাবধায়নে এ নিবন্ধের অপর লেখক সানজিয়া মহিউদ্দিন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে একটি গবেষণা কাজ করেন। গবেষণার উদ্দেশ্য ছিল বিদ্যমান মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা মূল্যায়ন করা এবং দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কীভাবে মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা মানুষের ওপর প্রভাব ফেলে এর কারণগুলো চিহ্নিত করা। এ গবেষণায় গুণগত এবং পরিমাণগত উভয় তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করা হয়েছিল। গবেষণায় দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের চারটি সরকারি হাসপাতাল, চৌদ্দটি বেসরকারি হাসপাতাল, চারটি ক্লিনিক এবং আটটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে জরিপ চালানো হয়। গবেষণার ফলাফলে এটি স্পষ্ট যে, ঢাকা দক্ষিণ সিটির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা অসন্তোষজনক। গবেষণায় আরও জানা গেছে যে, দক্ষ জনবলের অভাব, অপর্যাপ্ত সংগ্রহ ও সঞ্চয় সুবিধা, অপর্যাপ্ত পরিবহন ও নিষ্পত্তি সুবিধার কারণে চিকিৎসা বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সীমাবদ্ধ। জনসাধারণ এবং ছোট ছোট স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কীভাবে মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করতে হয় সেটিই জানেন না সংশ্লিষ্টরা।

ঢাকা শহরে ১২০০ এরও বেশি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান আছে। এর মধ্যে প্রায় ৩৭৭ স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থিত। আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় যে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) চেয়ে দক্ষিণ সিটিতে স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের ঘনত্ব অত্যধিক বেশি। মাঠ জরিপের সময় ডিএসসিসি এলাকার পাঁচটি অঞ্চল নির্বাচন করা হয়েছিল। এছাড়া এ অঞ্চলেই ঢাকা শহরের বড় বড় ৩টি হাসপাতাল অবস্থিত। সেগুলো হলো- ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (ডিএমসিএইচ), স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (এসএসএমসিএইচ) এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল (বিএসএমএমইউ)। এই তিনটি বৃহত্তম পাবলিক হাসপাতাল প্রচুর পরিমাণে মেডিকেল বর্জ্য উৎপন্ন করে। মাঠ জরিপ থেকে জানা যায়, সবচেয়ে বেশি বর্জ্য তৈরি হয় রোগীর পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে; এর পরিমাণ প্রায় ৪৬.৪ শতাংশ। এর পাশাপাশি রয়েছে সাধারণ বর্জ্য ৩১.৯ শতাংশ, ওষুধ জাতীয় বর্জ্য ১৩ শতাংশ, ধারাল বর্জ্য প্রায় ৫.৮ শতাংশ এবং রাসায়নিক বর্জ্য প্রায় ২.৯ শতাংশ। এসব বর্জ্যরে উৎস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে অপারেশন রুম, ওয়ার্ড রুম এবং ল্যাবরেটরি।

গবেষণায় স্পষ্ট যে, সরকারি এবং প্রাইভেট ক্লিনিকে মেডিকেল বর্জ্য রাখার যে ৩ বা ৪ রঙের কনটেইনার থাকার নিয়ম থাকলেও তা সঠিকভাবে মেনে চলে না। প্রতিদিন খুব সকালে ডিএসসিসি সাধারণ ও বিপজ্জনক মেডিকেল বর্জ্য সংগ্রহ করে থাকে আর ‘প্রিজম বাংলাদেশ’ (একটি এনজিও) শুধু মেডিকেল বর্জ্য সংগ্রহ করে থাকে। তবে সব স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে দেখা গেছে মেডিকেল বর্জ্য রাখার জন্য খোলা ও অনুপযুক্ত জায়গা ব্যবহার করে। দেখা গেছে, প্রায় ৮৩.৪ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে বিপজ্জনক বর্জ্যরে জন্য কোন আলাদা ব্যবস্থা কিংবা নষ্ট করার মতো সুবিধা নেই। চিকিৎসা বর্জ্য পরিশোধন, ধ্বংস এবং বর্জ্য পরিবহনের জন্য তাদের ডিএসসিসি এবং প্রিজম বাংলাদেশ এর ওপর নির্ভর করতে হয়। এসব বর্জ্য পরিবহনে উৎপাদক প্রতিষ্ঠান ৩১.৯ শতাংশ ম্যানুয়াল পদ্ধতি, ট্রলিতে ৬৩.৮ শতাংশ, হুইলারে ৪.৩ শতাংশ বর্জ্য পরিবহন করে। এছাড়া ডিএসসিসি ২১.৭ শতাংশ এবং প্রিজম বাংলাদেশ ৭৩.৯ শতাংশ মেডিকেল বর্জ্য তাদের নিজস্ব মেডিকেল বর্জ্য ভ্যানে পরিবহন করে।

জরিপের ফলাফলে দেখা যায় যে, স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বাহিত মেডিকেল বর্জ্যরে ৪৬.৪ শতাংশ সিটি করপোরেশনের জমিতে ফেলা হয়, উন্মুক্ত স্থানে পোড়ানো হয় ১০.১ শতাংশ, ডাস্টবিনে পোড়ানো হয় ৮.৭ শতাংশ এবং মাটিতে পুঁতে রাখে ৫.৮% শতাংশ। এছাড়া ডিএসসিসি সাধারণ বর্জ্য হিসেবে ডাস্টবিনে ফেলে ১৫.৯% শতাংশ এবং বর্জ্য শোধনাগারে ১১.৬ শতাংশ ব্যবহার করে। তবে প্রিজম বাংলাদেশ ঢাকার অদূরেই মাতুয়াইলে অবস্থিত ডাম্পে মেডিকেল বর্জ্য শোধনাগারে ৭২.৫ শতাংশ মেডিকেল বর্জ্য চূড়ান্তভাবে ধ্বংস করে থাকে। তবে সবচেয়ে আশঙ্কার কথা হলো, যেখানে প্রতিটি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা থাকা দরকার সেখানে ৮৬ শতাংশ প্রতিষ্ঠানেই কোন পরিকল্পনা নেই। যথাযথ মনিটরিং সুবিধা এবং দায়িত্বশীলতার অভাবে মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা দুর্বল হয়ে গেছে।

জরিপে দেখা গেছে, অর্ধেকেরও বেশি (৫১%), বিশেষ করে ছোট স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি তত্ত্বাবধান বা পর্যবেক্ষণের জন্য কোনো ব্যবস্থাপনা টিম নেই। বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য তত্ত্বাবধান কমিটি এবং দল থাকলেও তা যথেষ্ট নয়। এছাড়াও আরো বেশ কিছু বিষয় আছে যে কারণে ঢাকা শহরের মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন হচ্ছে না। এজন্য সেই গবেষণাপত্রে আমরা বেশকিছু সুপারিশ করেছি। যেগুলো প্রয়োগ করলে মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থপনায় শৃঙ্খলা ফিরবে সেগুলো হলো- মেডিকেল এবং নন-মেডিকেল কর্মীদের জন্য প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা কর্মসূচির ব্যবস্থা করা, মেডিকেল বর্জ্যরে ঝুঁকি সম্পর্কে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি, জাতীয় পরিকল্পনা বা নীতির সাথে সঙ্গতি রেখে মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত কাঠামো তৈরি করা, সব বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মীদের জন্য যথাযথ নির্দেশনাসহ লিখিত নিয়ম এবং নির্দেশিকা প্রস্তুত করা, প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির তত্ত্বাবধান ও পর্যবেক্ষণের জন্য একটি ভালো ব্যবস্থাপনা টিম থাকা এবং যথেষ্ট দক্ষ জনশক্তি থাকা, যাতে মেডিকেল বর্জ্যে সঠিক ব্যবস্থাপনা করার মাধ্যমে যথাযথ ব্যবস্থাপনা সুবিধা এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থার মধ্যে একটি শক্তিশালী সমন্বয়ের মাধ্যমে মেডিকেল বর্জ্যরে সঠিক ব্যবস্থাপনা সম্ভব।

[লেখক : মল্লিক আকরাম হোসেন- অধ্যাপক, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়; সানজিয়া মহিউদ্দিন- প্রাক্তন শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়]

বিয়েতে মিতব্যয়িতা

এমপিওভুক্ত শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের বঞ্চনার কথা

রোহিঙ্গা সমস্যা : বাহবা, ব্যর্থতা ও ভবিষ্যতের ভয়

ডেঙ্গু প্রতিরোধে করণীয়

প্রযুক্তির ফাঁদে শৈশব : স্ক্রিন টাইম গিলে খাচ্ছে খেলার মাঠ

রমগদ্য : সিরাজগঞ্জে ‘ব্রিটিশ প্রেতাত্মা’

বামপন্থা : নীতির সঙ্গে নেতৃত্বের ভূমিকা

দাবি আদায়ে জনদুর্ভোগ : জনশিক্ষা ও সুশাসনের পথ

ইমাম রইস উদ্দিন হত্যাকাণ্ড : সুবিচার নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব

কারাগার, সংশোধনাগার ও ভবঘুরে কেন্দ্রগুলোর সংস্কার কি হবে

জ্বালানির বদল, জীবিকার ঝুঁকি

প্রসঙ্গ : রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী ও চট্টগ্রামে এস্কর্ট ডিউটি

দেশটা কারো বাপের নয়!

বুদ্ধের বাণীতে বিশ্বশান্তির প্রার্থনা

আর কত ধর্ষণের খবর শুনতে হবে?

সংস্কারের স্বপ্ন বনাম বাস্তবতার রাজনীতি

মধুমাসের স্মৃতি ও দেশীয় ফলের রসাল সমারোহ

মুর্শিদাবাদে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট

লিঙ্গের রাজনীতি বা বিবাদ নয়, চাই মানবিকতার নিবিড় বন্ধন

বাজেট : বাস্তবতা, চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

যুক্তরাষ্ট্র-ইরান পারমাণবিক আলোচনার স্থবিরতা

রম্যগদ্য: “বাঙালি আমরা, নহি তো মেষ...”

সর্বজনীন শিক্ষার বলয়ের বাইরে আদিবাসীরা : অন্তর্ভুক্তির লড়াইয়ে বৈষম্যের দেয়াল

শোনার গান, দেখার টান : অনুভূতির ভোঁতা সময়

ছবি

ছিন্নপত্রে বাংলাদেশের প্রকৃতি ও রবীন্দ্র চেতনা

ভেতরের অদৃশ্য অপরাধ : সমাজের বিপন্ন মানসিকতা

দারিদ্র্য ও বৈষম্য নিরসনে খাসজমি ও জলার গুরুত্ব

অবহেলিত কৃষক ও বাজার ব্যবস্থার বৈষম্য

রাক্ষুসে মাছের দাপটে বিপন্ন দেশীয় মাছ : করণীয় কী?

বজ্রপাতের আতঙ্কে জনজীবন

তাহলে কি ঘৃণায় ছেয়ে যাবে দেশ, মানবজমিন রইবে পতিত

কর্পোরেট ও ব্যক্তিগত সামাজিক দায়বদ্ধতা

‘রাখাইন করিডর’ : একটি ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষণ

ভিন্নমতের ভয়, নির্বাচনের দোলাচল ও অন্তর্বর্তী সরকারের কৌশলী অবস্থান

সমুদ্রসম্পদ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা

কৃষি শিক্ষা হোক উদ্যোক্তা গড়ার মাধ্যম

tab

উপ-সম্পাদকীয়

মেডিকেল বর্জ্য অব্যবস্থাপনা, দায় কার?

মল্লিক আকরাম হোসেন ও সানজিয়া মহিউদ্দিন

বৃহস্পতিবার, ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২১

চিকিৎসাসেবা আমাদের জীবন ও স্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য। কিন্তু চিকিৎসাসেবা কার্যক্রম থেকে উৎপন্ন বর্জ্য মানুষ এবং তার আশপাশের পরিবেশের জন্য একটি মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে। মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সম্প্রতি বিশ্বব্যাপী প্রধান উদ্বেগের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। মেডিকেল বর্জ্যরে দুর্বল ব্যবস্থাপনা বা অব্যবস্থাপনা মানুষ এবং পরিবেশের ওপর সরাসরি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। প্রতিদিন বিপুল পরিমাণে সম্ভাব্য সংক্রামক এবং বিপজ্জনক বর্জ্য সারা বিশ্বের স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোতে উৎপন্ন হয়। মেডিকেল বর্র্জ্য পরিবেশগত স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করে। এজন্য মেডিকেল বর্জ্যরে ক্ষেত্রে চূড়ান্ত ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন। বর্জ্য উৎপাদনকারী, ব্যবস্থাপনার সাথে জড়িত এবং যে এলাকায় এসব ব্যবস্থাপনা করা হয় এর আশপাশে বসবাসকারীদের জন্য স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করতে পারে। বিশেষ করে চিকিৎসা বর্জ্য হেপাটাইটিস বি/সি এবং আলডিএস (এইচআইভি) স্বাস্থ্যের সংক্রমণের মতো রোগ সৃষ্টি করতে পারে। এছাড়া করোনা মহামারীতে এমন দুর্বল মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। বিশেষ করে করোনায় সেটি আরো ভয়ানক অবস্থা ধারণ করেছে সন্দেহ নেই।

প্রায় ১৬০ মিলিয়ন মানুষের শহর রাজধানী ঢাকা। এত বিপুল মানুষের শহরে মেডিকেল বর্জ্যরে অব্যবস্থাপনা নগরের পরিবেশ এবং শহরবাসীর স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক পরিণতি ঘটাচ্ছে। জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগে ২০১৭ সালে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে আমার তত্ত্বাবধায়নে এ নিবন্ধের অপর লেখক সানজিয়া মহিউদ্দিন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে একটি গবেষণা কাজ করেন। গবেষণার উদ্দেশ্য ছিল বিদ্যমান মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা মূল্যায়ন করা এবং দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কীভাবে মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা মানুষের ওপর প্রভাব ফেলে এর কারণগুলো চিহ্নিত করা। এ গবেষণায় গুণগত এবং পরিমাণগত উভয় তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করা হয়েছিল। গবেষণায় দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের চারটি সরকারি হাসপাতাল, চৌদ্দটি বেসরকারি হাসপাতাল, চারটি ক্লিনিক এবং আটটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে জরিপ চালানো হয়। গবেষণার ফলাফলে এটি স্পষ্ট যে, ঢাকা দক্ষিণ সিটির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা অসন্তোষজনক। গবেষণায় আরও জানা গেছে যে, দক্ষ জনবলের অভাব, অপর্যাপ্ত সংগ্রহ ও সঞ্চয় সুবিধা, অপর্যাপ্ত পরিবহন ও নিষ্পত্তি সুবিধার কারণে চিকিৎসা বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সীমাবদ্ধ। জনসাধারণ এবং ছোট ছোট স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কীভাবে মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করতে হয় সেটিই জানেন না সংশ্লিষ্টরা।

ঢাকা শহরে ১২০০ এরও বেশি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান আছে। এর মধ্যে প্রায় ৩৭৭ স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থিত। আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় যে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) চেয়ে দক্ষিণ সিটিতে স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের ঘনত্ব অত্যধিক বেশি। মাঠ জরিপের সময় ডিএসসিসি এলাকার পাঁচটি অঞ্চল নির্বাচন করা হয়েছিল। এছাড়া এ অঞ্চলেই ঢাকা শহরের বড় বড় ৩টি হাসপাতাল অবস্থিত। সেগুলো হলো- ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (ডিএমসিএইচ), স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (এসএসএমসিএইচ) এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল (বিএসএমএমইউ)। এই তিনটি বৃহত্তম পাবলিক হাসপাতাল প্রচুর পরিমাণে মেডিকেল বর্জ্য উৎপন্ন করে। মাঠ জরিপ থেকে জানা যায়, সবচেয়ে বেশি বর্জ্য তৈরি হয় রোগীর পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে; এর পরিমাণ প্রায় ৪৬.৪ শতাংশ। এর পাশাপাশি রয়েছে সাধারণ বর্জ্য ৩১.৯ শতাংশ, ওষুধ জাতীয় বর্জ্য ১৩ শতাংশ, ধারাল বর্জ্য প্রায় ৫.৮ শতাংশ এবং রাসায়নিক বর্জ্য প্রায় ২.৯ শতাংশ। এসব বর্জ্যরে উৎস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে অপারেশন রুম, ওয়ার্ড রুম এবং ল্যাবরেটরি।

গবেষণায় স্পষ্ট যে, সরকারি এবং প্রাইভেট ক্লিনিকে মেডিকেল বর্জ্য রাখার যে ৩ বা ৪ রঙের কনটেইনার থাকার নিয়ম থাকলেও তা সঠিকভাবে মেনে চলে না। প্রতিদিন খুব সকালে ডিএসসিসি সাধারণ ও বিপজ্জনক মেডিকেল বর্জ্য সংগ্রহ করে থাকে আর ‘প্রিজম বাংলাদেশ’ (একটি এনজিও) শুধু মেডিকেল বর্জ্য সংগ্রহ করে থাকে। তবে সব স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে দেখা গেছে মেডিকেল বর্জ্য রাখার জন্য খোলা ও অনুপযুক্ত জায়গা ব্যবহার করে। দেখা গেছে, প্রায় ৮৩.৪ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে বিপজ্জনক বর্জ্যরে জন্য কোন আলাদা ব্যবস্থা কিংবা নষ্ট করার মতো সুবিধা নেই। চিকিৎসা বর্জ্য পরিশোধন, ধ্বংস এবং বর্জ্য পরিবহনের জন্য তাদের ডিএসসিসি এবং প্রিজম বাংলাদেশ এর ওপর নির্ভর করতে হয়। এসব বর্জ্য পরিবহনে উৎপাদক প্রতিষ্ঠান ৩১.৯ শতাংশ ম্যানুয়াল পদ্ধতি, ট্রলিতে ৬৩.৮ শতাংশ, হুইলারে ৪.৩ শতাংশ বর্জ্য পরিবহন করে। এছাড়া ডিএসসিসি ২১.৭ শতাংশ এবং প্রিজম বাংলাদেশ ৭৩.৯ শতাংশ মেডিকেল বর্জ্য তাদের নিজস্ব মেডিকেল বর্জ্য ভ্যানে পরিবহন করে।

জরিপের ফলাফলে দেখা যায় যে, স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বাহিত মেডিকেল বর্জ্যরে ৪৬.৪ শতাংশ সিটি করপোরেশনের জমিতে ফেলা হয়, উন্মুক্ত স্থানে পোড়ানো হয় ১০.১ শতাংশ, ডাস্টবিনে পোড়ানো হয় ৮.৭ শতাংশ এবং মাটিতে পুঁতে রাখে ৫.৮% শতাংশ। এছাড়া ডিএসসিসি সাধারণ বর্জ্য হিসেবে ডাস্টবিনে ফেলে ১৫.৯% শতাংশ এবং বর্জ্য শোধনাগারে ১১.৬ শতাংশ ব্যবহার করে। তবে প্রিজম বাংলাদেশ ঢাকার অদূরেই মাতুয়াইলে অবস্থিত ডাম্পে মেডিকেল বর্জ্য শোধনাগারে ৭২.৫ শতাংশ মেডিকেল বর্জ্য চূড়ান্তভাবে ধ্বংস করে থাকে। তবে সবচেয়ে আশঙ্কার কথা হলো, যেখানে প্রতিটি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা থাকা দরকার সেখানে ৮৬ শতাংশ প্রতিষ্ঠানেই কোন পরিকল্পনা নেই। যথাযথ মনিটরিং সুবিধা এবং দায়িত্বশীলতার অভাবে মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা দুর্বল হয়ে গেছে।

জরিপে দেখা গেছে, অর্ধেকেরও বেশি (৫১%), বিশেষ করে ছোট স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি তত্ত্বাবধান বা পর্যবেক্ষণের জন্য কোনো ব্যবস্থাপনা টিম নেই। বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য তত্ত্বাবধান কমিটি এবং দল থাকলেও তা যথেষ্ট নয়। এছাড়াও আরো বেশ কিছু বিষয় আছে যে কারণে ঢাকা শহরের মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন হচ্ছে না। এজন্য সেই গবেষণাপত্রে আমরা বেশকিছু সুপারিশ করেছি। যেগুলো প্রয়োগ করলে মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থপনায় শৃঙ্খলা ফিরবে সেগুলো হলো- মেডিকেল এবং নন-মেডিকেল কর্মীদের জন্য প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা কর্মসূচির ব্যবস্থা করা, মেডিকেল বর্জ্যরে ঝুঁকি সম্পর্কে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি, জাতীয় পরিকল্পনা বা নীতির সাথে সঙ্গতি রেখে মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত কাঠামো তৈরি করা, সব বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মীদের জন্য যথাযথ নির্দেশনাসহ লিখিত নিয়ম এবং নির্দেশিকা প্রস্তুত করা, প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির তত্ত্বাবধান ও পর্যবেক্ষণের জন্য একটি ভালো ব্যবস্থাপনা টিম থাকা এবং যথেষ্ট দক্ষ জনশক্তি থাকা, যাতে মেডিকেল বর্জ্যে সঠিক ব্যবস্থাপনা করার মাধ্যমে যথাযথ ব্যবস্থাপনা সুবিধা এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থার মধ্যে একটি শক্তিশালী সমন্বয়ের মাধ্যমে মেডিকেল বর্জ্যরে সঠিক ব্যবস্থাপনা সম্ভব।

[লেখক : মল্লিক আকরাম হোসেন- অধ্যাপক, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়; সানজিয়া মহিউদ্দিন- প্রাক্তন শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়]

back to top