alt

উপ-সম্পাদকীয়

একজন ইউএনওর বিদায়ে মানুষ কাঁদল কেন

মোহাম্মদ আবু নোমান

: বুধবার, ০১ ফেব্রুয়ারী ২০২৩

এক বৃদ্ধ নারী কান্না করছেন উপজেলা চত্বরে বসে। গণমাধ্যমকর্মীরা জিজ্ঞেস করতেই হাউমাউ করে বললেন, ‘টিয়ুনু বলে যাইবগু? (ইউএনও নাকি চলে যাচ্ছে)। এহন আঁরে হনে চাইবু (এখন আমাকে কে দেখবে?)’। এভাবে শুধু চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার বারখাইন ইউনিয়নের শোলকাটা এলাকার ৫০ বছর বয়সী রহিমা বেগমই নয়, কান্না করেছেন বহু মানুষ। ওই বৃদ্ধা শেষমেশ স্বাভাবিক হয়ে ইউএনওকে বিদায় দিতে পারেননি কান্না বন্ধ করতে না পেরে।

অন্যদিকে উপজেলা পরিষদের দ্বিতল ভবনে কান্নার রোল। কান্না আর পুষ্পবৃষ্টি ভেদ করে নিচে নামতেই নিজে কাঁদলেন এবং কাঁদালেন চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শেখ জুবায়ের আহমেদ। এ যেন একজন আপাদমস্তক ভালোবাসার ফেরিওয়ালা! আনোয়ারার মাটি ও মানুষের হৃদয়ে অমরত্ব লাভ করে, সবারই অশ্রু টলটল চোখে রাজসিক বিদায় নিয়ে গেলেন শেখ জুবায়ের। মাত্র ৩ বছর ১১ মাসে আনোয়ারাবাসীকে এক সোনালি অধ্যায় উপহার দিয়ে গোপালগঞ্জে এডিসি হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে চলে যাওয়ার দিন গত ২৪ জানুয়ারি এমনতর দৃশ্যের অবতারণা ঘটে।

দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী সরওয়ার জামান এসেছিলেন শেখ জোবায়ের আহমেদকে বিদায় জানাতে। ইউএনও থাকা অবস্থায় জোবায়ের আহমেদ চাতরী চৌমুহনী বাজারে সরওয়ার জামানকে দোকান করে দিয়েছেন। ওই দোকানের আয়েই তার সংসার চলছে।

পদোন্নতি ও বদলিজনিত কারণে কোন সরকারি কর্মকর্তা বা একজন ইউএনও এলাকা ছেড়ে যাচ্ছেন- যাবেন এটাই তো স্বাভাবিক। প্রশ্ন হতে পারে, ইউএনও জুবায়ের কী এমন করেছেন যে, তাকে নিয়ে লিখতে হবে বা এতো আবেগী হতে হবে?

এখন রাজনৈতিক নেতা বা কতিপয় সরকারি কর্মকর্তা মারা গেলেও মানুষ হাসে, খুশি হয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। কারো ক্ষেত্রে উল্লাস করা হয়। কারো কার্যক্রমে ঝাড়– মিছিল, বিদায়ে মিষ্টি বিতরণ করা হয়। অথচ এখানে ফুল ছিটানোর বৃষ্টি, আরেকদিকে কান্নাকাটি! কিছু কান্না দেখেও আনন্দ লাগে, আর ভালো মানুষের বিদায়ে মানুষ কাঁদে, ঠিক এ রকম একটা পরিস্থিতিতে আনোয়ারাবাসী।

আমাদের প্রয়োজন এমনই সৎ ও মানবিক গুণাবলীসম্পন্ন সরকারি কর্মকর্তা। যিনি শেখ জোবায়ের আহমেদের মতো সামনে থেকে নেতৃত্ব দেবেন। উপজেলায় স্মৃতিসৌধ, শহীদ মিনার, শিশুপার্ক, দুটি নান্দনিক পুকুরঘাট নির্মাণ, উপজেলা সদরের খেলার মাঠের উন্নয়ন, গাছ লাগিয়ে পরিষদ চত্বরকে দৃষ্টিনন্দন করে সাজানো, পাঠাগার, ব্যায়ামাগার, শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র, এ ধরনের বিভিন্ন অবকাঠামো তৈরি ও নানা উদ্যোগ নিয়েছিলেন শেখ জোবায়ের। এগুলো মানুষের কোনো না কোনো কাজে লেগেছে বা তাদের মধ্যে ভালোলাগা তৈরি হয়েছে। এছাড়া উপজেলার জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনার মতো আয়োজনগুলোতে মানুষের সমর্থন পান জোবায়ের আহমেদ।

আনোয়ারা উপজেলায়তো ইউএনও শেখ জুবায়েরের আগে অনেকেই এসেছিলেন। কিন্তু তার মধ্যে নিঃস্বার্থ ভালোবাসা, উদারতা, মহানুভবতা শ্রেষ্ঠত্ব ছিলো, তার প্রমাণ আনোয়ারাবাসীর কান্না। দেশ-বিদেশে কর্মস্থলে যাওয়ার কারণে আপন ভাই-বন্ধু, ছেলে-মেয়ে বা কোনো স্বজনের বিদায়ে যেমন বুকে জড়িয়ে ধরে, মানুষ পিছু পিছু অনেক দূর পর্যন্ত এসে বিদায় দেন, শেখ জোবায়ের আহমেদের বিদায়েও তেমনই করেন আনোয়ারা উপজেলার অনেক বাসিন্দা। বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের এমন ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে শেখ জোবায়েরও আবেগ সামলাতে না পেরে নিজেও কেঁদেছেন। বিদায়ের সেই ভিডিও ও ছবিগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ঘুরছে। হাজার-হাজার সর্বসাধারণ ফেসবুকে পোস্ট দিয়েও জোবায়ের আহমেদের বিদায়ে কেন কেঁদেছেন বা অন্যরা কেঁদেছেন, সে কথা লিখেছেন। আমরা বলবো- এই সততা, এই নিষ্ঠতা, এই একজন কর্মযোদ্ধা। মানুষকে ভালোবাসতে এবং মানুষের থেকে ভালোবাসা পেতে মানবিক হৃদয় লাগে। একজন উপজেলা নির্বাহী অফিসারের বিদায়ে এমন মুহূর্ত আসে বা হয়, তা আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে পাওয়া বিরল।

অসংখ্য মানুষের ভালোবাসা নিয়ে কর্মস্থল হতে বিদায় নিতে পারা ভাগ্য ও যোগ্যতার বিষয়। জোবায়ের সাহেবকে অভিনন্দন! প্রতিটি উপজেলার ইউএনও যদি এমন হতো তাহলে তো পুরো বাংলাদেশের চেহারাই বদলে যেতো। আশা করি একদিন হবে। একজন উপজেলা নির্বাহী অফিসার ওই উপজেলার মানুষদের কতটুকু ভালোবাসলে বিদায় বেলায় এরকম কান্না করে, তা আমাদের জানা নেই। আসলে শেখ জোবায়ের তার আপন যোগ্যতায় আনোয়ারাবাসীর মন জয় করেছেন।

দুর্নীতি-লুটপাটের জ্বরে আক্রান্ত গোটা দেশকে বাঁচাতে হলে এমন দেশপ্রেমিক কর্মকর্তাদেরই আজ বড় বেশি প্রয়োজন। এটা সত্য দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় দায়িত্বশীলদের দায়িত্ব ও দায় অনেক বেশি; কিন্তু হঠাৎ করে আসমান থেকে ভালো মানুষ আসবে, দেশ ভালো হয়ে যাবে- এই অবাস্তব কল্পনা ঠিক নয়। দেশ ভালো হতে হলে আমাদের বেশিরভাগ মানুষকেই যার যার জায়গা থেকে ভালো মানুষ হওয়ার চেষ্টা করতে হবে।

২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে আনোয়ারা উপজেলায় ইউএনও হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন শেখ জোবায়ের আহমেদ। শেখ জোবায়ের আহমেদের নেতৃত্বে তিন বছরে দু’বার জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন কার্যক্রমে দেশসেরা উপজেলা হয়েছে আনোয়ারা।

ইউএনওর বিভিন্ন সৃজনশীল পরিকল্পনা প্রসঙ্গে আনোয়ারা উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ফেরদৌস হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, শেখ জোবায়ের একজন ‘ডায়নামিক লিডার’ ছিলেন। জন্মনিবন্ধন প্রসঙ্গে ইতোপূর্বে গণমাধ্যমে কোনো কোনো শিশুর মা বলেছিলেন- ‘সন্তান জন্ম দেওয়া যতটা না কষ্টের, তার চেয়ে বাচ্চার জন্মনিবন্ধন করা বেশি কষ্টের।’ জোবায়ের আহমেদ যখন ইউএনও হিসেবে দায়িত্ব নেন, তখন এ কার্যক্রমের সফলতার হার খুবই কম ছিল। ইউনিয়ন পরিষদ, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন সংস্থা এ কাজের সঙ্গে জড়িত। ইউএনও হিসেবে তিনি নেতৃত্ব ও কাজের সমন্বয় করেছেন। আগাম জন্ম তথ্য জেনে হবু মাকে চিঠি লেখা, নবজাতককে টিকা দিতে আসার পর পরবর্তী টিকা নিতে হলে জন্মনিবন্ধন কার্ড লাগবে, এটি বলে দেওয়া, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ইমামদের মাধ্যমে মসজিদে বিষয়টি জানানোসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়।

জানা যায়, ইউএনও হিসেবে শেখ জোবায়ের আহমেদ যখন দায়িত্ব পালন করেছেন, তখন তার হাসিমুখ দেখে সবাই ভরসা পেতেন, কথা বলার সাহস পেতেন। করোনা মহামারির সময় সুষ্ঠুভাবে ত্রাণ বিতরণের পাশাপাশি তিনি মানুষের মনে সাহস দিয়েছেন। করোনার সময় তিনি আঞ্চলিক ভাষায় এক ভিডিও বার্তা দেন, যা মানুষ খুব পছন্দ করে- ‘আনোয়ারার সবার জ্বর সারলে তিনি বাড়িতে যাবেন।’ এটাও মানুষ ইতিবাচকভাবে নিয়েছিল। তিনি করোনার টিকা গ্রহীতাদের ফুল আর নাশতার প্যাকেট দিয়ে প্রশংসিত হন। ওই সময় শেখ জোবায়ের আহমেদ তিনবার করোনায় আক্রান্ত হয়েও হাল ছাড়েননি। নিজ যোগ্যতাগুণে ঔজ্জ্বল্য ছড়িয়েছেন আনোয়ারার পথে-প্রান্তরে। কর্মদক্ষতায় এভাবে ইউএনও শেখ জোবায়ের আহমেদ উপজেলার সর্বস্তরের জনসাধারণের মন জয় করার সাথে পেয়েছেন দুইবার দেশসেরার স্বীকৃতি।

এ কথা ঠিক যে, দেশের নানাপ্রান্তে নানান পেশায় এমন অল্প কিছু জোবায়ের হয়তো আছেন; কিন্তু এ দেশের অধিকাংশ কর্মকর্তা কেন জোবায়েরের মতো হয় না? কেন তারা সবাই এমন ভালোবাসা পাওয়ার মতো কাজ করে না? কেন অনেকের বিরুদ্ধে দুর্নীতি আর লুটপাটের অভিযোগ ওঠে? কেন তারা টাকা আর ক্ষমতা চায়, ভালোবাসা পেতে চায় না? তাহলেই তো এ দেশের চিত্রটা বদলে যেত!

[লেখক : প্রাবন্ধিক]

বিয়েতে মিতব্যয়িতা

এমপিওভুক্ত শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের বঞ্চনার কথা

রোহিঙ্গা সমস্যা : বাহবা, ব্যর্থতা ও ভবিষ্যতের ভয়

ডেঙ্গু প্রতিরোধে করণীয়

প্রযুক্তির ফাঁদে শৈশব : স্ক্রিন টাইম গিলে খাচ্ছে খেলার মাঠ

রমগদ্য : সিরাজগঞ্জে ‘ব্রিটিশ প্রেতাত্মা’

বামপন্থা : নীতির সঙ্গে নেতৃত্বের ভূমিকা

দাবি আদায়ে জনদুর্ভোগ : জনশিক্ষা ও সুশাসনের পথ

ইমাম রইস উদ্দিন হত্যাকাণ্ড : সুবিচার নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব

কারাগার, সংশোধনাগার ও ভবঘুরে কেন্দ্রগুলোর সংস্কার কি হবে

জ্বালানির বদল, জীবিকার ঝুঁকি

প্রসঙ্গ : রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী ও চট্টগ্রামে এস্কর্ট ডিউটি

দেশটা কারো বাপের নয়!

বুদ্ধের বাণীতে বিশ্বশান্তির প্রার্থনা

আর কত ধর্ষণের খবর শুনতে হবে?

সংস্কারের স্বপ্ন বনাম বাস্তবতার রাজনীতি

মধুমাসের স্মৃতি ও দেশীয় ফলের রসাল সমারোহ

মুর্শিদাবাদে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট

লিঙ্গের রাজনীতি বা বিবাদ নয়, চাই মানবিকতার নিবিড় বন্ধন

বাজেট : বাস্তবতা, চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

যুক্তরাষ্ট্র-ইরান পারমাণবিক আলোচনার স্থবিরতা

রম্যগদ্য: “বাঙালি আমরা, নহি তো মেষ...”

সর্বজনীন শিক্ষার বলয়ের বাইরে আদিবাসীরা : অন্তর্ভুক্তির লড়াইয়ে বৈষম্যের দেয়াল

শোনার গান, দেখার টান : অনুভূতির ভোঁতা সময়

ছবি

ছিন্নপত্রে বাংলাদেশের প্রকৃতি ও রবীন্দ্র চেতনা

ভেতরের অদৃশ্য অপরাধ : সমাজের বিপন্ন মানসিকতা

দারিদ্র্য ও বৈষম্য নিরসনে খাসজমি ও জলার গুরুত্ব

অবহেলিত কৃষক ও বাজার ব্যবস্থার বৈষম্য

রাক্ষুসে মাছের দাপটে বিপন্ন দেশীয় মাছ : করণীয় কী?

বজ্রপাতের আতঙ্কে জনজীবন

তাহলে কি ঘৃণায় ছেয়ে যাবে দেশ, মানবজমিন রইবে পতিত

কর্পোরেট ও ব্যক্তিগত সামাজিক দায়বদ্ধতা

‘রাখাইন করিডর’ : একটি ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষণ

ভিন্নমতের ভয়, নির্বাচনের দোলাচল ও অন্তর্বর্তী সরকারের কৌশলী অবস্থান

সমুদ্রসম্পদ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা

কৃষি শিক্ষা হোক উদ্যোক্তা গড়ার মাধ্যম

tab

উপ-সম্পাদকীয়

একজন ইউএনওর বিদায়ে মানুষ কাঁদল কেন

মোহাম্মদ আবু নোমান

বুধবার, ০১ ফেব্রুয়ারী ২০২৩

এক বৃদ্ধ নারী কান্না করছেন উপজেলা চত্বরে বসে। গণমাধ্যমকর্মীরা জিজ্ঞেস করতেই হাউমাউ করে বললেন, ‘টিয়ুনু বলে যাইবগু? (ইউএনও নাকি চলে যাচ্ছে)। এহন আঁরে হনে চাইবু (এখন আমাকে কে দেখবে?)’। এভাবে শুধু চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার বারখাইন ইউনিয়নের শোলকাটা এলাকার ৫০ বছর বয়সী রহিমা বেগমই নয়, কান্না করেছেন বহু মানুষ। ওই বৃদ্ধা শেষমেশ স্বাভাবিক হয়ে ইউএনওকে বিদায় দিতে পারেননি কান্না বন্ধ করতে না পেরে।

অন্যদিকে উপজেলা পরিষদের দ্বিতল ভবনে কান্নার রোল। কান্না আর পুষ্পবৃষ্টি ভেদ করে নিচে নামতেই নিজে কাঁদলেন এবং কাঁদালেন চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শেখ জুবায়ের আহমেদ। এ যেন একজন আপাদমস্তক ভালোবাসার ফেরিওয়ালা! আনোয়ারার মাটি ও মানুষের হৃদয়ে অমরত্ব লাভ করে, সবারই অশ্রু টলটল চোখে রাজসিক বিদায় নিয়ে গেলেন শেখ জুবায়ের। মাত্র ৩ বছর ১১ মাসে আনোয়ারাবাসীকে এক সোনালি অধ্যায় উপহার দিয়ে গোপালগঞ্জে এডিসি হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে চলে যাওয়ার দিন গত ২৪ জানুয়ারি এমনতর দৃশ্যের অবতারণা ঘটে।

দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী সরওয়ার জামান এসেছিলেন শেখ জোবায়ের আহমেদকে বিদায় জানাতে। ইউএনও থাকা অবস্থায় জোবায়ের আহমেদ চাতরী চৌমুহনী বাজারে সরওয়ার জামানকে দোকান করে দিয়েছেন। ওই দোকানের আয়েই তার সংসার চলছে।

পদোন্নতি ও বদলিজনিত কারণে কোন সরকারি কর্মকর্তা বা একজন ইউএনও এলাকা ছেড়ে যাচ্ছেন- যাবেন এটাই তো স্বাভাবিক। প্রশ্ন হতে পারে, ইউএনও জুবায়ের কী এমন করেছেন যে, তাকে নিয়ে লিখতে হবে বা এতো আবেগী হতে হবে?

এখন রাজনৈতিক নেতা বা কতিপয় সরকারি কর্মকর্তা মারা গেলেও মানুষ হাসে, খুশি হয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। কারো ক্ষেত্রে উল্লাস করা হয়। কারো কার্যক্রমে ঝাড়– মিছিল, বিদায়ে মিষ্টি বিতরণ করা হয়। অথচ এখানে ফুল ছিটানোর বৃষ্টি, আরেকদিকে কান্নাকাটি! কিছু কান্না দেখেও আনন্দ লাগে, আর ভালো মানুষের বিদায়ে মানুষ কাঁদে, ঠিক এ রকম একটা পরিস্থিতিতে আনোয়ারাবাসী।

আমাদের প্রয়োজন এমনই সৎ ও মানবিক গুণাবলীসম্পন্ন সরকারি কর্মকর্তা। যিনি শেখ জোবায়ের আহমেদের মতো সামনে থেকে নেতৃত্ব দেবেন। উপজেলায় স্মৃতিসৌধ, শহীদ মিনার, শিশুপার্ক, দুটি নান্দনিক পুকুরঘাট নির্মাণ, উপজেলা সদরের খেলার মাঠের উন্নয়ন, গাছ লাগিয়ে পরিষদ চত্বরকে দৃষ্টিনন্দন করে সাজানো, পাঠাগার, ব্যায়ামাগার, শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র, এ ধরনের বিভিন্ন অবকাঠামো তৈরি ও নানা উদ্যোগ নিয়েছিলেন শেখ জোবায়ের। এগুলো মানুষের কোনো না কোনো কাজে লেগেছে বা তাদের মধ্যে ভালোলাগা তৈরি হয়েছে। এছাড়া উপজেলার জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনার মতো আয়োজনগুলোতে মানুষের সমর্থন পান জোবায়ের আহমেদ।

আনোয়ারা উপজেলায়তো ইউএনও শেখ জুবায়েরের আগে অনেকেই এসেছিলেন। কিন্তু তার মধ্যে নিঃস্বার্থ ভালোবাসা, উদারতা, মহানুভবতা শ্রেষ্ঠত্ব ছিলো, তার প্রমাণ আনোয়ারাবাসীর কান্না। দেশ-বিদেশে কর্মস্থলে যাওয়ার কারণে আপন ভাই-বন্ধু, ছেলে-মেয়ে বা কোনো স্বজনের বিদায়ে যেমন বুকে জড়িয়ে ধরে, মানুষ পিছু পিছু অনেক দূর পর্যন্ত এসে বিদায় দেন, শেখ জোবায়ের আহমেদের বিদায়েও তেমনই করেন আনোয়ারা উপজেলার অনেক বাসিন্দা। বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের এমন ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে শেখ জোবায়েরও আবেগ সামলাতে না পেরে নিজেও কেঁদেছেন। বিদায়ের সেই ভিডিও ও ছবিগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ঘুরছে। হাজার-হাজার সর্বসাধারণ ফেসবুকে পোস্ট দিয়েও জোবায়ের আহমেদের বিদায়ে কেন কেঁদেছেন বা অন্যরা কেঁদেছেন, সে কথা লিখেছেন। আমরা বলবো- এই সততা, এই নিষ্ঠতা, এই একজন কর্মযোদ্ধা। মানুষকে ভালোবাসতে এবং মানুষের থেকে ভালোবাসা পেতে মানবিক হৃদয় লাগে। একজন উপজেলা নির্বাহী অফিসারের বিদায়ে এমন মুহূর্ত আসে বা হয়, তা আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে পাওয়া বিরল।

অসংখ্য মানুষের ভালোবাসা নিয়ে কর্মস্থল হতে বিদায় নিতে পারা ভাগ্য ও যোগ্যতার বিষয়। জোবায়ের সাহেবকে অভিনন্দন! প্রতিটি উপজেলার ইউএনও যদি এমন হতো তাহলে তো পুরো বাংলাদেশের চেহারাই বদলে যেতো। আশা করি একদিন হবে। একজন উপজেলা নির্বাহী অফিসার ওই উপজেলার মানুষদের কতটুকু ভালোবাসলে বিদায় বেলায় এরকম কান্না করে, তা আমাদের জানা নেই। আসলে শেখ জোবায়ের তার আপন যোগ্যতায় আনোয়ারাবাসীর মন জয় করেছেন।

দুর্নীতি-লুটপাটের জ্বরে আক্রান্ত গোটা দেশকে বাঁচাতে হলে এমন দেশপ্রেমিক কর্মকর্তাদেরই আজ বড় বেশি প্রয়োজন। এটা সত্য দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় দায়িত্বশীলদের দায়িত্ব ও দায় অনেক বেশি; কিন্তু হঠাৎ করে আসমান থেকে ভালো মানুষ আসবে, দেশ ভালো হয়ে যাবে- এই অবাস্তব কল্পনা ঠিক নয়। দেশ ভালো হতে হলে আমাদের বেশিরভাগ মানুষকেই যার যার জায়গা থেকে ভালো মানুষ হওয়ার চেষ্টা করতে হবে।

২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে আনোয়ারা উপজেলায় ইউএনও হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন শেখ জোবায়ের আহমেদ। শেখ জোবায়ের আহমেদের নেতৃত্বে তিন বছরে দু’বার জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন কার্যক্রমে দেশসেরা উপজেলা হয়েছে আনোয়ারা।

ইউএনওর বিভিন্ন সৃজনশীল পরিকল্পনা প্রসঙ্গে আনোয়ারা উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ফেরদৌস হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, শেখ জোবায়ের একজন ‘ডায়নামিক লিডার’ ছিলেন। জন্মনিবন্ধন প্রসঙ্গে ইতোপূর্বে গণমাধ্যমে কোনো কোনো শিশুর মা বলেছিলেন- ‘সন্তান জন্ম দেওয়া যতটা না কষ্টের, তার চেয়ে বাচ্চার জন্মনিবন্ধন করা বেশি কষ্টের।’ জোবায়ের আহমেদ যখন ইউএনও হিসেবে দায়িত্ব নেন, তখন এ কার্যক্রমের সফলতার হার খুবই কম ছিল। ইউনিয়ন পরিষদ, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন সংস্থা এ কাজের সঙ্গে জড়িত। ইউএনও হিসেবে তিনি নেতৃত্ব ও কাজের সমন্বয় করেছেন। আগাম জন্ম তথ্য জেনে হবু মাকে চিঠি লেখা, নবজাতককে টিকা দিতে আসার পর পরবর্তী টিকা নিতে হলে জন্মনিবন্ধন কার্ড লাগবে, এটি বলে দেওয়া, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ইমামদের মাধ্যমে মসজিদে বিষয়টি জানানোসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়।

জানা যায়, ইউএনও হিসেবে শেখ জোবায়ের আহমেদ যখন দায়িত্ব পালন করেছেন, তখন তার হাসিমুখ দেখে সবাই ভরসা পেতেন, কথা বলার সাহস পেতেন। করোনা মহামারির সময় সুষ্ঠুভাবে ত্রাণ বিতরণের পাশাপাশি তিনি মানুষের মনে সাহস দিয়েছেন। করোনার সময় তিনি আঞ্চলিক ভাষায় এক ভিডিও বার্তা দেন, যা মানুষ খুব পছন্দ করে- ‘আনোয়ারার সবার জ্বর সারলে তিনি বাড়িতে যাবেন।’ এটাও মানুষ ইতিবাচকভাবে নিয়েছিল। তিনি করোনার টিকা গ্রহীতাদের ফুল আর নাশতার প্যাকেট দিয়ে প্রশংসিত হন। ওই সময় শেখ জোবায়ের আহমেদ তিনবার করোনায় আক্রান্ত হয়েও হাল ছাড়েননি। নিজ যোগ্যতাগুণে ঔজ্জ্বল্য ছড়িয়েছেন আনোয়ারার পথে-প্রান্তরে। কর্মদক্ষতায় এভাবে ইউএনও শেখ জোবায়ের আহমেদ উপজেলার সর্বস্তরের জনসাধারণের মন জয় করার সাথে পেয়েছেন দুইবার দেশসেরার স্বীকৃতি।

এ কথা ঠিক যে, দেশের নানাপ্রান্তে নানান পেশায় এমন অল্প কিছু জোবায়ের হয়তো আছেন; কিন্তু এ দেশের অধিকাংশ কর্মকর্তা কেন জোবায়েরের মতো হয় না? কেন তারা সবাই এমন ভালোবাসা পাওয়ার মতো কাজ করে না? কেন অনেকের বিরুদ্ধে দুর্নীতি আর লুটপাটের অভিযোগ ওঠে? কেন তারা টাকা আর ক্ষমতা চায়, ভালোবাসা পেতে চায় না? তাহলেই তো এ দেশের চিত্রটা বদলে যেত!

[লেখক : প্রাবন্ধিক]

back to top