alt

suppliment » anniversary2025

গ্রাম বাংলার সংস্কৃতির অতীত ও বর্তমান

প্রণব মজুমদার

: মঙ্গলবার, ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫

সংবাদ বয়সের দিক থেকে বেশ পরিণত। ৭৫ বছর মানে রতœ জয়ন্তীর শুভ সময়! আমিও পরিণত। তবে প্রিয় সংবাদের চেয়ে বয়সে ১৩ বছর কম আমার। শত প্রতিবন্ধকতা ও সীমাবদ্ধতার মধ্যে জাতীয় একটি দৈনিকের ধারাবাহিকভাবে পথচলা সত্যি বিস্ময়ের! দৈনিক সংবাদকে আমরা পারিবারিকভাবে চিনি সেই ছেলেবেলা থেকে। ঘরে শিল্প সংস্কৃতির আবহ। দাদা ও বোনরা প্রায় সকলেই গান বাজনা ও নাটকের সঙ্গে যুক্ত। মা প্রচুর বই পড়তেন। গৃহে সকলেরই বই পড়ার অভ্যাস। ঘরে পত্র-পত্রিকা থাকবে না তা কী করে হয়! নাট্যমোদী চিকিৎসক পিতা ডিসপেন্সারিতেও পত্রিকা পড়েন। দৈনিক পূর্বদেশ ছেড়ে বাবা প্রগতিশীল ও উদারমনা ‘দৈনিক সংবাদ’ ঘরে আনতে শুরু করলেন। সময়টা তখন সত্তরের দশকের শেষ দিক। সবেমাত্র স্কুল পেরিয়েছি। বাবা মা মনে করতেন, জ্ঞানে আলোকিত হতে হলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি নানা ধরনের বই ও পত্র-পত্রিকা পাঠের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। সে চিন্তাধারায় সময় পেলেই বইও পত্র-পত্রিকা পড়ার জন্য শহরের গণপাঠাগারে ছুটে যেতাম। সামাজিকভাবে সাহিত্য ও শিল্প-সং¯ৃ‹তিতে সমৃদ্ধ চাঁদপুর শহর। যে শহরে আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। কোনো ধর্মালম্ববী মানুষের সঙ্গে কারো খুব একটা বিবাদ ছিল না তখন। ছিল না এখানে কোনো ধর্মের বিভাজনের আচরণ। শিক্ষা ও সংস্কৃতিমুখি আমার প্রিয় শহরে শিশু সংগঠন থেকে শুরু করে ক্রীড়া, নাট্য ও সঙ্গীত সংগঠন প্রায় সবই ছিল। প্রথমে চাঁদের হাট পরে খেলাঘর করতাম। খেলাঘর সংগঠনে সম্পৃক্ত থাকার সুবাদে সংবাদের সঙ্গে আমারও গভীর সম্পর্ক তৈরি হয়। খেলাঘরের ভাইয়া তখন দেশের বিখ্যাত সাংবাদিক বজলুর রহমান। সংবাদ পত্রিকার সঙ্গেও যুক্ত তিনি। মনন ও রুচিশীল দৈনিক পত্রিকা সংবাদে খেলাঘর পাতা প্রকাশ হয় প্রতি মঙ্গলবারে। দুই পৃষ্ঠা জুড়ে খেলাঘরের শিশু সাহিত্য ও বিজ্ঞান বিষয়ক লেখায় উন্নত সংবাদ। মফস্বল শহর চাঁদপুর থেকেই আমি জাতীয় পত্রিকা সংবাদের খেলাঘর পাতার মাধ্যমে লেখালেখি শুরু করি। আস্তে আস্তে প্রকাশের ব্যাপ্তি ঘটে ইত্তেফাকের কচি কাঁচার আসর, দৈনিক বাংলার সাত ভাই চম্পা ও কিশোর বাংলার পাতায়। উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার পাঠ চুকিয়ে ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে উচ্চশিক্ষার পাঠ নিতে ঢাকায় আসি। সংশ্লিষ্ট হই কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসর এর সঙ্গে। খেলাঘরের নিয়মিত সাহিত্য বাসর, সংবাদের খেলাঘর পাতার সম্পাদনা পরিষদে যুক্ত হয়ে যাই। শিশুতোষ এবং বড়দের বই সমালোচনার পাশাপাশি বড়দের উপযোগী সাহিত্য রচনায় নিবিষ্ট হই। তখন হাতেগোনা কটি সাপ্তাহিক সাহিত্য কাগজ বের হতো নিয়মিত। বিচিত্রা, সচিত্র সন্ধানী, রোববার অন্যতম। রোকনুজ্জামান খান (দাদাভাই), বজলুর রহমান (ভাইয়া), আফলাতুন, রফিকুল হক (দাদুভাই), গাজী শাহবুদ্দীন আহমেদ, শামসুর রাহমান, কায়সুল হক, বিপ্রদাশ বড়–য়া, সেলিনা হোসেন, আবুল হাসনাত, রফিক আজাদ, খালেদা এদিব চৌধুরী ও আখতার হুসেনের মতো অসাম্প্রদায়িক ও প্রকৃত বাঙালি চেতনার সম্পাদক আর বোধ হয় পাব না আমরা। এসব গুণীজন অধিকাংশই আজ প্রয়াত। কৃতজ্ঞতায় তাঁদের স্মরণ করি। লেখালেখিতে এদের আন্তরিকতা ও প্রেরণা ভুলি কীভাবে? কোন লেখার মান বা বিষয় সাহিত্য উপযোগী না হলে কীভাবে তা উপযুক্ত হবে সঠিক পরামর্শ দিয়ে তা সহাস্য বলে দিতেন তাঁরা।

বদলে গেছে সব! সংসার, সমাজ ও রাষ্ট্র। বদলে গেছে পৃথিবী। পৃথিবী যখন বদলে যায় তখন সাহিত্য ও সংস্কৃতি বাদ থাকে কীভাবে? তাও পরিবর্তিত হয়েছে। রাতারাতিই বলা যায়। সেকাল আর একাল। পরিবর্তনের ব্যবধান ঢের। মনে হয় এইতো সেদিন। দিনগুলো কত সোনালি আর রঙিন ছিল! বাউল স¤্রাট শাহ আব্দুল করিমের বিখ্যাত গানটার কথা মনে পড়ে গেল। তিনি লিখেছেন-

আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম

গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু-মুসলমান

মিলিয়া বাউলা গান আর মুর্শিদী গাইতাম।

৭০ বছর পরে বাংলার ভূখ-ে আমূল পাল্টে যাবে তা তিনি রবীন্দ্রনাথের মতো আঁচ করতে পেরেছিলেন। সাধক শাহ আবদুল করিম গানে তাঁর শৈশব ও তারুণ্যের দিনগুলোকে সেরা সময় ভেবেছেন। বাংলার জমিনে সকল ধর্মের মানুষের সংস্কৃতির সুনিবিড় বিনিময়ের অসাম্প্রদায়িক চেতনার চিত্রকে তিনি ইতিবাচক হিসেবে দেখেছেন। তিরানব্বই বয়সের (১৯১৬-২০০৯) আয়ুস্কালে তিনি লোকজ বাংলার প্রান্তরে হেঁটেছেন অনেকটা সময়। জীবনের পড়ন্ত বেলায় চেতনার গভীরে নিমগ্ন সাধকের সমাজ ও রাষ্ট্র নিয়ে মনোভাব ইতিবাচক ছিল না। শাহ আব্দুল করিম গবেষক ও সাংবাদিক সুমন কুমার দাশের রচনায় জানা যায় আশির দশকের শেষে গানটি লেখা হয়। তখন দেশে স্বৈরাচারী এরশাদ বিরোধী আন্দোলন চলছিল। অশান্তি ও অস্থিরতা বাউল সাধক করিমও পছন্দ করতেন না। তাঁর বালকবেলা এবং কিশোরকাল অনেকের মতো রঙিন ও আনন্দময় ছিল। আমিও সেই সোনালি দিনগুলোর কথা ভেবে আবেগে আপ্লুত হয়ে যাই। সত্যিই তো, আগে কি সুন্দর দিন কাটাতাম!

সুন্দর স্বপ্নের মতো আমারও শৈশব ও কৈশোর ছিল। সোনালি সেই জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়গুলো ছিল বেশ আন্তরিক। দুরন্তপনা যে ছিল না তাও নয়। কিন্তু হতাশা ছিল না খুব একটা। নি¤œ মধ্যবিত্ত বড় পরিবারের চাঁদের হাটে সুস্থ সংস্কৃতির আবহে আমার জন্মলাভ। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সঙ্গে শিল্পের নানা কলার শাখা প্রশাখায় বেড়ে ওঠা। গ্রামীণ আদলে মফঃস্বল মহকুমা শহরে জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে যাপনের সেই সুখানুভব এখনতো স্বপ্ন। খুড়াতো ভাইবোনদের নিয়ে বড় চাঁদের হাট। শিক্ষা ও সংস্কৃতিমুখী আমাদের সেই পরিবারে অভাব ছিল, সংকট ছিল, কিন্তু খুব একটা মিথ্যাচার ছিল না, ছিল না ভ-ামী ও কূপম-ূকতা। জ্ঞানের প্রতি মগ্নতা ছিল। ভালোবাসা ছিল, মায়া মমতা ছিল, ছিল ত্যাগ আর সহযোগী মনোভাব।

সুমধুর আজান, মোরগের ডাক, পাখিদের মায়াময় শব্দ ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলতো আমাদের। সকাল সাতটায় ওঠা ছিল পারিবারিক নিয়ম। ঘুম থেকে জেগেই হাত মুখ ধুঁয়ে একটি চৌকিতে সবার পড়তে বসে যাওয়া ছিল দিন শুরুর কার্যসূচি। কাঁসার ছোট্ট বাটিতে করে গুড় মুড়ি খাওয়া। তারপর সাড়ে ন’টার মধ্যে বিদ্যালয়ে যাবার জন্য প্রস্তুতি চলতো। ডাল সিদ্ধ কিংবা আলু ভর্তা দিয়ে গরম ভাত খেয়ে পদব্রজে বিদ্যালয়ে যাওয়া। বিকেলে কিছু খেয়ে সোজা বাড়ির পাশে খেলার মাঠে। সন্ধ্যার আগে পুকুরঘাট থেকে হাত মুখ ধুয়ে হারিকেনের আলোর গোল হয়ে আবার পড়তে বসা। রাতের খাবার আটটার মধ্যে সমাপ্ত। রাত দশটার মধ্যে ঘুমানোর জন্য বিছানায় যাবার বাধ্যবধকতা ছিল। বিদ্যালয়ের সাত দিনের বন্ধ হলেই গাঁয়ের বাড়ি বেড়ানো, নানা পাবনের খাওয়া দাওয়া ছিল পরিবারের সংস্কৃতি। শহরের রূপ নয়, বদলে গেছে গ্রামীণ সেই সংস্কৃতিও। এখন তথ্য ও প্রযুক্তির সভ্যতায় ছেলেমেয়েরা দিনে ঘুমায়, রাতে পড়ে। স্মার্টফোনে রঙিন স্বপ্ন দেখে। বিনোদন মানে খেলাধুলা নয়, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে বিভিন্ন অ্যাপসে ঢোকা। ফাস্টফুডে আসক্তি, মৌলিক সঙ্গীত ছেড়ে কনসার্টে উন্মাদনাই যেন ওদের আনন্দ! ভোগ বেড়েছে। মুনাফালোভির সংখ্যা বেড়েছে। খাদ্যে ভেজাল বেড়েছে। জালিয়াতি ও প্রতারণা বেড়েছে। হতাশা বেড়েছে। বেড়েছে ধর্ম ব্যবসা। আচরণে বাণিজ্যকরণে মানুষের মধ্যে মানবতা প্রায় লুপ্ত হয়ে গেছে।

বাল্য বেলায় দেখতাম কষ্টার্জিত উপার্জনে মধ্যবিত্তের সংসার চলতো। চাহিদা কম ছিল, ছিল আয় বুজে ব্যয় করার মানসিকতা। শিক্ষা ছিল সমাজে অতি মূল্যবান; সম্পদ ও অর্থ সে ক্ষেত্রে গৌণই ছিল। প্রজ্ঞাবানদেরও গুরুত্ব ছিল রাজনীতিতে। রূপচর্চা বলতে মুখের পাউডার, চোখে কাজল ও চুলে ফিতা এবং পায়ে আলতা এসব এখন দেখা যায় না। শিল্পপতি বলতে প্রধানত পাট ও বস্ত্রকল মালিকদের বুঝাতো। ব্যাংক ঋণ নিয়ে বাণিজ্য প্রসার এমনটা খুব কমই দেখা যেত। ইচ্ছাকৃত রুগ্ণ শিল্প এবং ব্যাংক ঋণের খেলাপী সংস্কৃতির ইতিহাস হচ্ছে ৪ দশকের। শিক্ষা পুরোপুরি বাণিজ্যিক হয়ে গেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও আনুষ্ঠানিকতা বেশি। শিক্ষকগণ শ্রেণিতে পড়ানোর চেয়ে ব্যক্তি উদ্যোগে বাসায় কিংবা কোচিংয়ে একক ও দলগতভাবে পাঠ্যদানে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। জানার জন্য নয়, শিক্ষাকে মূলধনীকরণের লক্ষ্যে ভালো ফলাফলের প্রত্যাশায় গাইড বইয়ের ওপর নির্ভরশীলতা বেড়েছে। এতে করে উচ্চশিক্ষায় নামে শিক্ষার্থীদের অন্ধকার আগামীতে নিক্ষিপ্ত করছে। প্রযুক্তির আধুনিক সভ্যতায় থেকে ওদের আচরণে সৌম্যভাব হারিয়ে গেছে। কথা বিনিময়ে ভাষাগতভাবে ওরা ‘বাংলিশ’। প্রমিত বাংলা ভাষায় ইংরেজি, হিন্দি, উর্দু ও আরবি প্রভৃতি ভাষার মিশ্রণ দেখা যাচ্ছে।

ছবি

গাছপাথরের সময়

ছবি

সন্তোষ গুপ্ত : এক বিরল ব্যক্তিত্ব

ছবি

সংস্কৃতি কি বাঁচাবে আমাদের?

ছবি

স্বাধীনতা থেকে স্বাধীনতা নারীর সংখ্যালঘু-দশার শেষ কোথায়?

ছবি

পার্বত্য আদিবাসী সংস্কৃতির ভেতর-বাহির

ছবি

বিশ্বসেরা বিাশ্ববিদ্যালয়ে কাব্যচর্চা

ছবি

গণমাধ্যমের হাল-হকিকত

ছবি

গণতন্ত্রের জন্যে অপরিহার্য মুক্ত ভাবনার সুরক্ষা

ছবি

সাহসী সাংবাদিকতার পথিকৃৎ জহুর হোসেন চৌধুরী

ছবি

জন্মেজয় দৈনিক সংবাদ যেন সফল হয় সর্প নিধনে

ছবি

পঁচাত্তর বছরে বাঙালির সাংস্কৃতিক জাগরণ

উত্তাল চল্লিশে দেশ বিভাগ কি অনিবার্য ছিল?

গণমানুষের সংগ্রামের প্রগতিশীল মুখপত্র

ছবি

দৈনিক সংবাদের সাথেই বেড়ে উঠেছি

সংবাদ থাকুক সংবাদ-এর মতোই

ক্ষমতার হস্তান্তর নয় রূপান্তর চাই

tab

suppliment » anniversary2025

গ্রাম বাংলার সংস্কৃতির অতীত ও বর্তমান

প্রণব মজুমদার

মঙ্গলবার, ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫

সংবাদ বয়সের দিক থেকে বেশ পরিণত। ৭৫ বছর মানে রতœ জয়ন্তীর শুভ সময়! আমিও পরিণত। তবে প্রিয় সংবাদের চেয়ে বয়সে ১৩ বছর কম আমার। শত প্রতিবন্ধকতা ও সীমাবদ্ধতার মধ্যে জাতীয় একটি দৈনিকের ধারাবাহিকভাবে পথচলা সত্যি বিস্ময়ের! দৈনিক সংবাদকে আমরা পারিবারিকভাবে চিনি সেই ছেলেবেলা থেকে। ঘরে শিল্প সংস্কৃতির আবহ। দাদা ও বোনরা প্রায় সকলেই গান বাজনা ও নাটকের সঙ্গে যুক্ত। মা প্রচুর বই পড়তেন। গৃহে সকলেরই বই পড়ার অভ্যাস। ঘরে পত্র-পত্রিকা থাকবে না তা কী করে হয়! নাট্যমোদী চিকিৎসক পিতা ডিসপেন্সারিতেও পত্রিকা পড়েন। দৈনিক পূর্বদেশ ছেড়ে বাবা প্রগতিশীল ও উদারমনা ‘দৈনিক সংবাদ’ ঘরে আনতে শুরু করলেন। সময়টা তখন সত্তরের দশকের শেষ দিক। সবেমাত্র স্কুল পেরিয়েছি। বাবা মা মনে করতেন, জ্ঞানে আলোকিত হতে হলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি নানা ধরনের বই ও পত্র-পত্রিকা পাঠের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। সে চিন্তাধারায় সময় পেলেই বইও পত্র-পত্রিকা পড়ার জন্য শহরের গণপাঠাগারে ছুটে যেতাম। সামাজিকভাবে সাহিত্য ও শিল্প-সং¯ৃ‹তিতে সমৃদ্ধ চাঁদপুর শহর। যে শহরে আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। কোনো ধর্মালম্ববী মানুষের সঙ্গে কারো খুব একটা বিবাদ ছিল না তখন। ছিল না এখানে কোনো ধর্মের বিভাজনের আচরণ। শিক্ষা ও সংস্কৃতিমুখি আমার প্রিয় শহরে শিশু সংগঠন থেকে শুরু করে ক্রীড়া, নাট্য ও সঙ্গীত সংগঠন প্রায় সবই ছিল। প্রথমে চাঁদের হাট পরে খেলাঘর করতাম। খেলাঘর সংগঠনে সম্পৃক্ত থাকার সুবাদে সংবাদের সঙ্গে আমারও গভীর সম্পর্ক তৈরি হয়। খেলাঘরের ভাইয়া তখন দেশের বিখ্যাত সাংবাদিক বজলুর রহমান। সংবাদ পত্রিকার সঙ্গেও যুক্ত তিনি। মনন ও রুচিশীল দৈনিক পত্রিকা সংবাদে খেলাঘর পাতা প্রকাশ হয় প্রতি মঙ্গলবারে। দুই পৃষ্ঠা জুড়ে খেলাঘরের শিশু সাহিত্য ও বিজ্ঞান বিষয়ক লেখায় উন্নত সংবাদ। মফস্বল শহর চাঁদপুর থেকেই আমি জাতীয় পত্রিকা সংবাদের খেলাঘর পাতার মাধ্যমে লেখালেখি শুরু করি। আস্তে আস্তে প্রকাশের ব্যাপ্তি ঘটে ইত্তেফাকের কচি কাঁচার আসর, দৈনিক বাংলার সাত ভাই চম্পা ও কিশোর বাংলার পাতায়। উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার পাঠ চুকিয়ে ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে উচ্চশিক্ষার পাঠ নিতে ঢাকায় আসি। সংশ্লিষ্ট হই কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসর এর সঙ্গে। খেলাঘরের নিয়মিত সাহিত্য বাসর, সংবাদের খেলাঘর পাতার সম্পাদনা পরিষদে যুক্ত হয়ে যাই। শিশুতোষ এবং বড়দের বই সমালোচনার পাশাপাশি বড়দের উপযোগী সাহিত্য রচনায় নিবিষ্ট হই। তখন হাতেগোনা কটি সাপ্তাহিক সাহিত্য কাগজ বের হতো নিয়মিত। বিচিত্রা, সচিত্র সন্ধানী, রোববার অন্যতম। রোকনুজ্জামান খান (দাদাভাই), বজলুর রহমান (ভাইয়া), আফলাতুন, রফিকুল হক (দাদুভাই), গাজী শাহবুদ্দীন আহমেদ, শামসুর রাহমান, কায়সুল হক, বিপ্রদাশ বড়–য়া, সেলিনা হোসেন, আবুল হাসনাত, রফিক আজাদ, খালেদা এদিব চৌধুরী ও আখতার হুসেনের মতো অসাম্প্রদায়িক ও প্রকৃত বাঙালি চেতনার সম্পাদক আর বোধ হয় পাব না আমরা। এসব গুণীজন অধিকাংশই আজ প্রয়াত। কৃতজ্ঞতায় তাঁদের স্মরণ করি। লেখালেখিতে এদের আন্তরিকতা ও প্রেরণা ভুলি কীভাবে? কোন লেখার মান বা বিষয় সাহিত্য উপযোগী না হলে কীভাবে তা উপযুক্ত হবে সঠিক পরামর্শ দিয়ে তা সহাস্য বলে দিতেন তাঁরা।

বদলে গেছে সব! সংসার, সমাজ ও রাষ্ট্র। বদলে গেছে পৃথিবী। পৃথিবী যখন বদলে যায় তখন সাহিত্য ও সংস্কৃতি বাদ থাকে কীভাবে? তাও পরিবর্তিত হয়েছে। রাতারাতিই বলা যায়। সেকাল আর একাল। পরিবর্তনের ব্যবধান ঢের। মনে হয় এইতো সেদিন। দিনগুলো কত সোনালি আর রঙিন ছিল! বাউল স¤্রাট শাহ আব্দুল করিমের বিখ্যাত গানটার কথা মনে পড়ে গেল। তিনি লিখেছেন-

আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম

গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু-মুসলমান

মিলিয়া বাউলা গান আর মুর্শিদী গাইতাম।

৭০ বছর পরে বাংলার ভূখ-ে আমূল পাল্টে যাবে তা তিনি রবীন্দ্রনাথের মতো আঁচ করতে পেরেছিলেন। সাধক শাহ আবদুল করিম গানে তাঁর শৈশব ও তারুণ্যের দিনগুলোকে সেরা সময় ভেবেছেন। বাংলার জমিনে সকল ধর্মের মানুষের সংস্কৃতির সুনিবিড় বিনিময়ের অসাম্প্রদায়িক চেতনার চিত্রকে তিনি ইতিবাচক হিসেবে দেখেছেন। তিরানব্বই বয়সের (১৯১৬-২০০৯) আয়ুস্কালে তিনি লোকজ বাংলার প্রান্তরে হেঁটেছেন অনেকটা সময়। জীবনের পড়ন্ত বেলায় চেতনার গভীরে নিমগ্ন সাধকের সমাজ ও রাষ্ট্র নিয়ে মনোভাব ইতিবাচক ছিল না। শাহ আব্দুল করিম গবেষক ও সাংবাদিক সুমন কুমার দাশের রচনায় জানা যায় আশির দশকের শেষে গানটি লেখা হয়। তখন দেশে স্বৈরাচারী এরশাদ বিরোধী আন্দোলন চলছিল। অশান্তি ও অস্থিরতা বাউল সাধক করিমও পছন্দ করতেন না। তাঁর বালকবেলা এবং কিশোরকাল অনেকের মতো রঙিন ও আনন্দময় ছিল। আমিও সেই সোনালি দিনগুলোর কথা ভেবে আবেগে আপ্লুত হয়ে যাই। সত্যিই তো, আগে কি সুন্দর দিন কাটাতাম!

সুন্দর স্বপ্নের মতো আমারও শৈশব ও কৈশোর ছিল। সোনালি সেই জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়গুলো ছিল বেশ আন্তরিক। দুরন্তপনা যে ছিল না তাও নয়। কিন্তু হতাশা ছিল না খুব একটা। নি¤œ মধ্যবিত্ত বড় পরিবারের চাঁদের হাটে সুস্থ সংস্কৃতির আবহে আমার জন্মলাভ। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সঙ্গে শিল্পের নানা কলার শাখা প্রশাখায় বেড়ে ওঠা। গ্রামীণ আদলে মফঃস্বল মহকুমা শহরে জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে যাপনের সেই সুখানুভব এখনতো স্বপ্ন। খুড়াতো ভাইবোনদের নিয়ে বড় চাঁদের হাট। শিক্ষা ও সংস্কৃতিমুখী আমাদের সেই পরিবারে অভাব ছিল, সংকট ছিল, কিন্তু খুব একটা মিথ্যাচার ছিল না, ছিল না ভ-ামী ও কূপম-ূকতা। জ্ঞানের প্রতি মগ্নতা ছিল। ভালোবাসা ছিল, মায়া মমতা ছিল, ছিল ত্যাগ আর সহযোগী মনোভাব।

সুমধুর আজান, মোরগের ডাক, পাখিদের মায়াময় শব্দ ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলতো আমাদের। সকাল সাতটায় ওঠা ছিল পারিবারিক নিয়ম। ঘুম থেকে জেগেই হাত মুখ ধুঁয়ে একটি চৌকিতে সবার পড়তে বসে যাওয়া ছিল দিন শুরুর কার্যসূচি। কাঁসার ছোট্ট বাটিতে করে গুড় মুড়ি খাওয়া। তারপর সাড়ে ন’টার মধ্যে বিদ্যালয়ে যাবার জন্য প্রস্তুতি চলতো। ডাল সিদ্ধ কিংবা আলু ভর্তা দিয়ে গরম ভাত খেয়ে পদব্রজে বিদ্যালয়ে যাওয়া। বিকেলে কিছু খেয়ে সোজা বাড়ির পাশে খেলার মাঠে। সন্ধ্যার আগে পুকুরঘাট থেকে হাত মুখ ধুয়ে হারিকেনের আলোর গোল হয়ে আবার পড়তে বসা। রাতের খাবার আটটার মধ্যে সমাপ্ত। রাত দশটার মধ্যে ঘুমানোর জন্য বিছানায় যাবার বাধ্যবধকতা ছিল। বিদ্যালয়ের সাত দিনের বন্ধ হলেই গাঁয়ের বাড়ি বেড়ানো, নানা পাবনের খাওয়া দাওয়া ছিল পরিবারের সংস্কৃতি। শহরের রূপ নয়, বদলে গেছে গ্রামীণ সেই সংস্কৃতিও। এখন তথ্য ও প্রযুক্তির সভ্যতায় ছেলেমেয়েরা দিনে ঘুমায়, রাতে পড়ে। স্মার্টফোনে রঙিন স্বপ্ন দেখে। বিনোদন মানে খেলাধুলা নয়, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে বিভিন্ন অ্যাপসে ঢোকা। ফাস্টফুডে আসক্তি, মৌলিক সঙ্গীত ছেড়ে কনসার্টে উন্মাদনাই যেন ওদের আনন্দ! ভোগ বেড়েছে। মুনাফালোভির সংখ্যা বেড়েছে। খাদ্যে ভেজাল বেড়েছে। জালিয়াতি ও প্রতারণা বেড়েছে। হতাশা বেড়েছে। বেড়েছে ধর্ম ব্যবসা। আচরণে বাণিজ্যকরণে মানুষের মধ্যে মানবতা প্রায় লুপ্ত হয়ে গেছে।

বাল্য বেলায় দেখতাম কষ্টার্জিত উপার্জনে মধ্যবিত্তের সংসার চলতো। চাহিদা কম ছিল, ছিল আয় বুজে ব্যয় করার মানসিকতা। শিক্ষা ছিল সমাজে অতি মূল্যবান; সম্পদ ও অর্থ সে ক্ষেত্রে গৌণই ছিল। প্রজ্ঞাবানদেরও গুরুত্ব ছিল রাজনীতিতে। রূপচর্চা বলতে মুখের পাউডার, চোখে কাজল ও চুলে ফিতা এবং পায়ে আলতা এসব এখন দেখা যায় না। শিল্পপতি বলতে প্রধানত পাট ও বস্ত্রকল মালিকদের বুঝাতো। ব্যাংক ঋণ নিয়ে বাণিজ্য প্রসার এমনটা খুব কমই দেখা যেত। ইচ্ছাকৃত রুগ্ণ শিল্প এবং ব্যাংক ঋণের খেলাপী সংস্কৃতির ইতিহাস হচ্ছে ৪ দশকের। শিক্ষা পুরোপুরি বাণিজ্যিক হয়ে গেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও আনুষ্ঠানিকতা বেশি। শিক্ষকগণ শ্রেণিতে পড়ানোর চেয়ে ব্যক্তি উদ্যোগে বাসায় কিংবা কোচিংয়ে একক ও দলগতভাবে পাঠ্যদানে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। জানার জন্য নয়, শিক্ষাকে মূলধনীকরণের লক্ষ্যে ভালো ফলাফলের প্রত্যাশায় গাইড বইয়ের ওপর নির্ভরশীলতা বেড়েছে। এতে করে উচ্চশিক্ষায় নামে শিক্ষার্থীদের অন্ধকার আগামীতে নিক্ষিপ্ত করছে। প্রযুক্তির আধুনিক সভ্যতায় থেকে ওদের আচরণে সৌম্যভাব হারিয়ে গেছে। কথা বিনিময়ে ভাষাগতভাবে ওরা ‘বাংলিশ’। প্রমিত বাংলা ভাষায় ইংরেজি, হিন্দি, উর্দু ও আরবি প্রভৃতি ভাষার মিশ্রণ দেখা যাচ্ছে।

back to top